আজকাল বাড়িতে ঝগড়াঝাটি, কুটকচালি বড় বেড়েছে। সারাদিন বাড়িময় শেকল আর ফিতে টেনে ঘুরে বেড়াচ্ছে কানুনগোর লোক। আর বশিষ্ঠ মাঝে মাঝে বিকট গলায় পেঁচিয়ে জানান দিচ্ছে, পাপ! পাপ!
বনানী শরৎচন্দ্রের পল্লীসমাজ পড়ে দু’চোখ ভরা জল নিয়ে উঠল। তারপর চিনি-বউয়ের কাছে গিয়ে বলল, যুক্তাক্ষর শেখাবে আমাকে?
চিনি-বউ ঠোঁট টিপে হেসে বলল, শিখেই তো গেছিস। একটা আদর্শলিপি নিয়ে আসিস, দেখিয়ে দেব। খুব যে বই-পড়ার নেশা হয়েছে তোর!
কী ভালই যে লাগে!
বাড়িতে বড় অশান্তি চলছে। চেঁচামেচির কামাই নেই। বিশাল সংসার, অনেক বাসন-কোসন, সোনাদানা, অনেক জিনিস। ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে কথায় কথায় লেগে যাচ্ছে ভাইয়ে ভাইয়ে, বউতে বউতে। এমনকী ছেলেমেয়েগুলো পর্যন্ত বাদ নেই।
বনানীর একটা চমকা ভয় ধরে আজকাল। কী যে হবে! কোথায় যে যাবে!
লক্ষ্মীপিসিরও মেজাজ ভাল নয়। প্রায়ই বলে, আগুন লাগল। এখন দেখ, কতদূর পোড়া যায়।
আমার কী হবে পিসি?
তোর তো সুখের জীবন। এক আঘাটা থেকে আর-এক আঘাটায় গিয়ে উঠবি। তোর আর কী! বিপদ হল আমাদের, যাদের ঘটিবাটি আগলে দিন কাটে। সংসার যে কী নরক রে বাবা!
বর্ধমানে কী কাজে গিয়েছিল চিনি-বউয়ের দাদা। ফেরার সময় ইচ্ছে হল বোনের শ্বশুরবাড়িটা দেখে যেতে। তাই এসে হাজির এক শীতের সকালবেলায়।
চিনি-বউয়ের ঘরে চা গেল, চিড়েভাজা গেল, নারকেল কোরা গেল, ডিমসেদ্ধ গেল।
বনানীরও খুব ইচ্ছে হল যেতে। ডাক্তার মানুষ, যদি একটু তাকেও দেখে।
প্রথমটায় সাহস হল না। আজকাল তার ঘা নেই, ন্যাড়া মাথায় তিন মাসের চুল গজিয়েছে। চিনি বউ মিথ্যে বলেনি। তার আর কিছু না থাক, চুলের ঘেঁষটা ভাল।
একটা বেড়াল তাড়ানোর ভান করে অবশেষে গেলও বনানী। লোভ সামলাতে পারল না।
চিনি-বউয়ের দাদা ছেলেমানুষ। ডাক্তার বলে মনেই হয় না। একটা কাঠের চেয়ারে বসে সিগারেট খেতে খেতে বোনের সঙ্গে খুব কথা কইছে।
বনানীকে দেখে চিনি-বউ বলল, আয়, ভিতরে আয়। এই দেখ আমার দাদা।
দাদা বলতে চিনি-বউয়ের চোখে অহংকার ফুটল বেশ।
ঝলঝলে মরা শরীরটা নিয়ে বনানী চিনি-বউয়ের ডাক্তার দাদার সামনে দাঁড়াল। দরজা ঘেঁষেই।
মেয়েটা কে রে?
ও হচ্ছে বামুনের মেয়ে।
চিনি-বউয়ের দাদা এ কথা শুনে খুব হাসল। তারপর বলল, ওটা কারও পরিচয় হল নাকি? বামুনের মেয়ে না কায়েতের মেয়ে তাই বুঝি জানতে চাইছি?
চিনি বউ লজ্জা পেয়ে জিভ কাটল। তারপর বলল, ওর নাম হল বনানী। বাপটা মাতাল, সত্য দু’চোখে দেখতে পারে না। এ বাড়িতে কুকুর-বেড়ালের মতো পড়ে থাকে। চেহারাটা তো দেখছিস। পনেরো বছর বয়স কেউ বলবে?
পনেরো বছর কথাটা বনানীর নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছিল না। কিন্তু হিসেব করলে তাই দাঁড়ায়। তেরো বছর বয়সে এসেছিল এ বাড়িতে। পনেরোর বেশিই হবে এখন। আজও ঋতুমতী হয়নি। মেয়েমানুষ বলে বোঝাও যায় না তাকে।
চিনি-বউয়ের দাদা তখন ডাক্তারের চোখে দেখল তাকে খানিকক্ষণ। তারপর বলল, ম্যালনিউট্রিশনটাই প্রধান। টনসিল আছে বলে মনে হচ্ছে। এই, তুই এদিকে আয় তো!
বনানীর বুকের মধ্যে আশা, ভরসা, আনন্দ ঠেলাঠেলি করতে লাগল। ডাক্তাররা তো প্রায় ভগবান!
পরে সে জেনেছিল, চিনি-বউয়ের দাদার নাম শুভ্র। শুভ্র দাস। সেদিন তার বুক পিঠে চোঙা ঠেকিয়ে, চোখের পাতা টেনে, পেট টিপে অনেক কিছু দেখেছিল। মাথা নেড়ে বলল, তেমন কিছু সিরিয়াস বলে মনে হচ্ছে না। তবে ব্লাড় আর ইউরিনটা দেখলে বোঝা যেত।
ওই পর্যন্ত হয়ে রইল সেদিন। একজন ডাক্তার তাকে দেখল, কিন্তু কেমন ভাসা-ভাসা ভাবে। কোনও নিদান দিল না।
দাসশৰ্মাদের বাড়িতে তুলকালাম লাগল এর কিছুদিন পর থেকেই। ভাগাভাগি, টানাটানি, চিল-চেঁচানি, মারপিটের উপক্রম হল কতবার। অবশেষে উঠোনে তিনটে আজগুবি বেড়া উঠল। মুখ দেখাদেখি বন্ধ হল।
বনানী পড়ল বশিষ্ঠর ভাগেই। ছোট ভাই কেষ্টর ভাগে পড়ল লক্ষ্মীপিসি। লক্ষ্মীমন্ত একটা সংসারের এমন ছিরি হল ক’দিনের মধ্যেই যে, না দেখলে বিশ্বাস হয় না।
লাকড়িঘরের পাটাতনের ঠাইটুকু বনানীর রয়ে গেল ঠিকই, কিন্তু খাটুনি বাড়ল বেদম। তার ওপর অবস্থা পড়ে যাওয়ায় বশিষ্ঠর গিন্নি কালী ঠাকরুন রোজ বলা শুরু করল, ওই অলক্ষুনেটাকে তাড়াও। বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াবে কে? আর কি আমাদের সেই অবস্থা আছে?
ভয়ে বনানী নিজে থেকেই খাওয়া কমাল। শরীরে যতদুর দেয় ততদুর বা শরীর নিংড়ে তার চেয়েও বেশি খাটতে লাগল। ধান আছড়ানোে অবধি বাদ দিল না।
চিনি-বউ বলল, তুই এখানে টিকতে পারবি না। আমিও বরের কাছে বর্ধমানে চলে যাচ্ছি। তুইও পালা।
কোথায় পালাব? আমার যে যাওয়ার জায়গা নেই।
চিনি-বউ একটু ভেবে বলল, আচ্ছা দাঁড়া। রোববার দাদা আসবে। একবার পরামর্শ করি দাদার সঙ্গে।
শুভ্র দাস রোববারে এল এবং চিনি-বউয়ের সঙ্গে তার কথাও হল।
বনানী দুরুদুরু বুকে অপেক্ষা করছিল উঠোনে।
অবশেষে চিনি বউ ডাকল। আর সেইদিনই শুভ্রদাদাব সঙ্গে বনানী চলে এল কলকাতায়। ঝি-গিরি করতে।
বাবাকে বলে এসেছিল রওনা হওয়ার আগে।
বাবা উদাস মুখে বলল, তুই তো মরতেই জন্মেছিস। যা গিয়ে দেখ বাবুটি কি ডাক্তার?
হ্যাঁ গো বাবা, বড় ডাক্তার।
বাবা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তোর চিকিচ্ছে করবে?
করতে পারে।
বশিষ্ঠ তোকে রাখবে না, আমাকেও বলেছে। এ বরং ভালই হল।
ভাল হয়েছিল কি না কে জানে। বাবার জ্যোতিহীন চোখ, পাঁশুটে ক্ষয়া মুখখানা ভাবতে ভাবতেই সে শুভ্রবাবুর সঙ্গে গাঁ ছেড়ে কলকাতায় এল। খুপরি খুপরি তিন-চারখানা ঘর নিয়ে বাসা। ভারী কষ্ট এখানে মানুষের। সবচেয়ে বড় কষ্ট বোধহয় ছোট্ট জায়গার মধ্যে নিজেকে আঁটিয়ে নেওয়া।
তবু তা একরকম সয়ে নেওয়া যায়। সিঁড়ির তলায় সেই চটের বিছানা, কলঘরে স্নান, ছাদে উঠে কাপড় শুকোনো এসব অভ্যাস করে নিতে সময় লাগত না। কিন্তু ততটা সময় দিল কই শুবাবুর বউ কল্যাণী? কল্যাণী বউদি প্রথম দিনই বলে ফেলেছিল, এ তো টি বি রুগি, কোখেকে ধরে আনলে?
নাক সিঁটকে সেই ঘেন্নার চাউনি কি সহজে ভোলা যায়? বনানী সিঁটিয়ে গেল সেই চোখের সামনে। শরীর নিয়ে তার নিজেরই লজ্জার শেষ নেই। তাতে আবার মুখের ওপর খোঁটা।
দিন সাতেকের মাথায় তাকে নিয়ে শুভ্র আর কল্যাণীর মধ্যে বেশ মন কষাকষি বেধে গেল। বাড়িতে আরও লোক ছিল। শুভ্রবাবুর বাবা আর মা। বনানীর ব্যাপারে তারাও খুশি নয়।
মুশকিলে পড়ল শুভ্র। বনানীকে ফের চাঁপারহাটে রেখে আসতে হবে। আর বনানীর সমস্যা হল, চাঁপারহাট গিয়ে সে ফের উঠবে কোথায়? তার যে সেখানে আর জায়গা নেই।
ঠিক এইসময়ে শুভ্র একদিন পাশের বাড়িতে বনানীকে নিয়ে তার সমস্যার কথা গল্প করেছিল। সে-বাড়িতে একটি আইবুড়ো মেয়ে আছে, ভারী খেয়ালি। সে বলল, রোগ-টোগ যদি না থাকে তবে আমাদের বাড়িতে দিতে পারো। মা-বাবার একজন সর্বক্ষণের সঙ্গী হয়। তবে রোগ থাকলে দিয়ে না।
বনানীর বাস উঠল আবার। ঠেক থেকে ঠেক ঘুরে ঘুরে তার মনের মধ্যে এখন জন্তুর মতো একটা ভয় দেখা দিয়েছে। শুধু বেঁচে থাকাটাই যে এ দুনিয়ায় কী কঠিন ব্যাপার! মাথার ওপর একটা ঢাকনা, দুবেলা দুটো বাসিপাতা যা হোক জুটে যাওয়া, এটাই এক মস্ত প্রাপ্তি তার কাছে। ভগবানকে সে কদাচিৎ ডাকে। তার মনে হয়, ভগবান এক মস্ত মানুষ, তার মতো গরিব ভিখিরির ডাকে কান দেবেন না। কিন্তু এইবার শুভ্রবাবুদের বাসার পাট চুকে যাওয়ার সময় সে এক দুপুরে ভগবানকে খুব ডাকল, এবার যে বাড়ি যাচ্ছি তারা যেন আমায় ঘেন্না না করে, হে ভগবান।
পুঁটুলি বগলে নিয়ে সে যখন সৌরীন্দ্রমোহনের বাড়িতে ঢুকল তখন প্রথম দর্শনেই বাড়িটা তার ভাল লেগে গেল। কম লোক, ঠান্ডা শব্দহীন সব ঘর, বেশ নিরিবিলি। বুড়োবুড়ি আর তাদের আইবুড়ো একটা মেয়ে। বড় ভয় করছিল বনানীর। তাকে এরা পছন্দ করবে তো! যদি না করে তা হলে সে কোথায় যাবে এর পর?
পিঠে কুঁজওয়ালা মেয়েটাকে দেখে বুক শুকিয়ে গেল বনানীর। চোখে খর দৃষ্টি, মুখটা থমথমে গম্ভীর, কেমন যেন।
সোনালি তখন সবে স্কুল থেকে ফিরেছে। মেজাজটি কিছু গরম। বেশ ঝঝের গলায় বলল, যদি তোর গলা কেটে ফেলি তা হলে টু শব্দ করবি?
বনানী এর জবাবে কী বলবে ভেবে না পেয়ে বলল, না।
যদি চিমটি কাটি তা হলে চেঁচাবি?
বনানী ভয়ে ভয়ে বলল, না তো!
যদি কাতুকুতু দিই তা হলে কখনও হসবি?
বনানীর মাথা গণ্ডগোল হয়ে যাচ্ছিল। গায়ে ঘাম দিচ্ছে। কী পাগলের পাল্লাতেই পড়া গেছে। সে ফের মাথা নেড়ে বলল, না।
এ বাড়িতে থাকতে গেলে রোজ পেস্ট আর ব্রাশ দিয়ে দাঁত মাজতে হবে, রোজ সাবান দিয়ে ঘষে ঘষে মান করতে হবে, নোংরা থাকলে কাপড়কাচার মুগুর দিয়ে মাথায় মারব, বুঝলি?
হ্যাঁ।
মাথায় কহাজার উকুন নিয়ে এসেছিস?
বেশি নয়।
ইস, বেশি আবার নয়! ওই উলোঙ্কুলো চুলে লাখে লাখে উকুন আছে। মুখে মুখে কথা বলার অভ্যাস নেই তো? চোপা করলে চুলের মুঠি ধরে ছাদে নিয়ে গিয়ে ধাক্কা দিয়ে নীচে ফেলে দেব।
এবার বনানী ততটা ভয় পেল না। তার মনে হল যতখানি তর্জন-গর্জন হচ্ছে ততদুর খারাপ এ মেয়েটা নয়। সে হঠাৎ হেসে ফেলে বলল, আচ্ছা।
চুরি করে খাস?
না তো।
পয়সা-টয়সা সরাবি না তো?
না।
সব তাতেই যে সায় দিয়ে যাচ্ছিস? পরে যদি স্বরূপ বেরোয় তখন দেখবি মজা।
থেকে গেল বনানী। এতকাল সে যত বাড়িতে থেকেছে— মোট চারটে, তার মধ্যে এইটে সবচেয়ে ভাল। কুঁজওলা মেয়েটার নাম সোনালি। এ বাড়িতে তারই অখণ্ড দাপট। বুড়োবুড়ি বিশেষ সাতে-পাঁচে নেই। সেই সোনালি তাকে একখানা আলাদা ঘর দেখিয়ে দিল। সে ঘরে চৌকি আছে, পাতলা একটা তোশক আছে, একটা বালিশ আর বিছানায় একখানা তাঁতের নকশি চাদরও। এতখানি বনানী স্বপ্নেও ভাবেনি। তার বিছানার স্মৃতি কেবল চট আর খড়ের। নিজেদের বাড়িতে ছিল মাচান। তাতে একসময়ে একটু বিছানা হয়তোবা ছিল। কিন্তু ঘুমের মধ্যে পেচ্ছাপ করার দোষে মাসি এসে চটের বিছানার ব্যবস্থা করে।
বহুদিন বাদে বনানী ফের বিছানা পেল। সেইসঙ্গে পেল আস্ত একখানা গন্ধ সাবান, এক গোলা বাংলা সাবান, এক শিশি তেল, দু’গজ রিবন, একখানা চিরুনি, টুথব্রাশ আর পেস্ট, ছোট্ট এক এক কৌটো পাউডার, দুটো নতুন জামা আর একখানা পুরনো শাড়ি— এইসব। সোনালিপিসি দিতে জানে বটে, এত দেয় যে বনানী দিশেহারা হয়ে যায়। সে বলেই ফেলল, অত দিয়ো না পিসি, আমার অত লাগে না।
এ বাড়িতে পরিষ্কার থাকতে হবে। নোংরা থাকলে চুলের ঝুটি ধরে তাড়াব। বাসি কাপড় ছাড়বি, পায়খানায় যেতে জামাকাপড় ছেড়ে যাবি, হাতমুখ সব সময়ে যেন ঝকঝকে পরিষ্কার থাকে। দাঁত ব্রাশ করতে পারিস না?
পারে না। কিন্তু পারল শেষ পর্যন্ত।
ভয় ছিল বিছানায় পেচ্ছাপ নিয়ে। আজকাল আর বিশেষ একটা হয় না। তবু মাঝে মাঝে করে ফেলে। সোনালি টের পেলে কী যে করবে! ভয়ে ভয়ে জল খাওয়া কমিয়ে দিল সে। রাতে শোওয়ার সময় ভগবানকে বলত, দেখো, যেন আজ না হয়।
সারাদিন প্রাণপণে কাজ করত বনানী। কাজ অবশ্য বিশেষ কিছুই নেই। ঠিকে ঝি আছে, ঠিকে রান্নার লোকও আছে। সে শুধু ঘরদোর সাফসুতরো রাখে, ঝাড়পোছ করে। দোকানপাট করতে হয়। এ বাড়িতে আলমারি ভরতি বই, তাক ভরতি বই। ধুলো ঝাড়তে গিয়ে সে মাঝে মাঝে এক-আধখানা নামিয়ে বসে বসে খানিকটা করে পড়ে নেয়।
ব্যাপারটা একদিন সৌরীন্দ্রমোহনের নজরে পড়ল।
তুই বাংলা পড়তে পারিস?
পারি।
বাঃ। আমার চোখে ছানি বলে পড়তে পারি না। খবরের কাগজটা পড়ে শোনা তো।
সামনের ঝুল বারান্দায় ইজিচেয়ারে আধশোয়া সৌরীন্দ্রমোহনের পায়ের কাছে বসে বেলা দশটার রোদে খবরের কাগজ পড়া বনানীর এ জীবনের সবচেয়ে সুন্দর অভিজ্ঞতা। নীচে দিয়ে রিকশা যায়, লোক যায়, চারদিকে ঝকঝক করে শহর, আর সে বসে বসে এক অদ্ভুত পৃথিবীর নানা অদ্ভুত খবর দুলে দুলে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে পড়ে। মানে বোঝে না সবসময়, কিন্তু মনে ছবির পর ছবি ভেসে উঠতে থাকে।
এইরকমই এক সকালে যখন সে সৌরীন্দ্রমোহনকে কাগজ পড়ে শোনাচ্ছে, তখন রাস্তা থেকে একটা গমগমে গলার ডাক এল, দাদু!
সৌরীন্দ্রমোহন সোজা হয়ে বসলেন, আনন্দিত গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন, আয় অলক, আয়। কেরালা থেকে কবে ফিরলি?
এই তো।
জীবনে যত পুরুষমানুষ দেখেছে বনানী কারও সঙ্গেই এর মিলল না। আসলে পুরুষ আর মেয়েমানুষের তফাতটাও তেমন করে এ পর্যন্ত মনের মধ্যে উঁকি মারেনি তার। আর সে নিজে? সে পুরুষ না মেয়ে, তা নিজের শরীরে এ তাবৎ টের পায়নি সে।
কিন্তু ওই যে লম্বা শক্ত গড়নের অদ্ভুত শান্ত ও অন্যমনস্ক মুখশ্রীর ছেলেটি টকাটক সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে এল, একে দেখেই বনানীর ভিতরে যেন ভূমিকম্পে ভেঙে পড়ল ঘরবাড়ি, গাছপালা দুলতে লাগল ঝড়ে, আকাশে বিদ্যুৎ চমকাল, বাজ পড়তে লাগল উপর্যুপরি।
নিজের রোগ ক্ষয়া শরীরটা এই প্রথম কারও চোখ থেকে আড়াল করার জন্য ছাদে পালিয়ে গেল সে।
অনেক পরে যখন দিদিমার ডাক শুনে নেমে এল তখন সেই ছেলেটি বসে লুচি আর মাংস খাচ্ছে। তার দিকে দৃপাতও করল না। খেয়ে-দেয়ে চলে গেল।
ও কে গো দিদিমা?
দিদিমা উজ্জ্বল মুখে হেসে একগাদা পুরনো খবরের কাগজ খুলে পাঁচ-সাতখানা ছবি তাকে দেখিয়ে বলল, এ হল আমার নাতি। মস্ত সাঁতারু। কত নামডাক। এই দেখ না, কাগজে কত ছবি বেরোয় ওর।
একটা মানুষ এল এবং চলে গেল, কিন্তু সে টেরও পেল না তার এই ক্ষণেকের আবির্ভাব আর-একজনকে কীভাবে চুর্ণ করে দিল ভিতরে ভিতরে। জীবনে এই প্রথম বনানী ভয়ংকরভাবে টের পেল যে, সে মেয়ে। প্রথম জানল, শুধু দুটো খাওয়া আর মাথার ওপর একটু ছাদ, এর বেশি আরও কিছু আছে। তার ভিতরে দেখা দিল লজ্জা, রোমাঞ্চ এবং আরও কত কী!
একা ঘরে রাতের বেলায় তার ঘুম আসছিল না। চোখ জ্বালা করছে, বুকের ভিতর ঢিবঢ়িব, মাথাটা কেমন গরম, গায়ে বারবার কাটা দিচ্ছে। বারবার অলকের চেহারাটা ভেসে উঠছে চোখের সামনে। কিছুতেই ভুলতে পারছে না।
সেই রাত থেকে তার বিছানায় পেচ্ছাপ করা বন্ধ হয়ে গেল। পুরোপুরি। মাত্র এক মাসের মধ্যে ঋতুমতী হল সে। খুবই আশ্চর্য সব ব্যাপার ঘটতে লাগল।
জীর্ণ শরীরটাকে নিয়ে বড় লজ্জা ছিল বনানীর। বেঁচে থাকার তেমন কোনও ইচ্ছাশক্তি কাজ করত না। সে জানত মরার জন্যই তার এই জন্ম। কিন্তু এখন তার ভিতরে এক প্রবল ইচ্ছাশক্তি বাঁধ ভাঙল।
একদিন ঘুম থেকে উঠে ফ্রক পরে সে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁত ব্রাশ করছিল। হঠাৎ সোনালি এসে সঁড়াল কাছাকাছি। তার দিকে এক ঝলক তাকিয়ে বলল, বাঃ রে মুখপুড়ি, তোকে বেশ দেখাচ্ছে তো! চুরি করে খাচ্ছিস নাকি আজকাল?
বনানী আজকাল ঠাট্টা বোঝে। শুধু হাসল।
সোনালি চোখ পাকিয়ে বলল, ফ্রক পরে বারান্দায় দাঁড়াস কেন ধিঙ্গি মেয়ে? পাড়ার ঘোড়াগুলো দেখলে সিটি মারবে। যা, বাথরুমে যা।
শুনে বনানীর চোখ কপালে উঠল। তাকে দেখে ছেলেরা সিটি দেবে! তাকে দেখে!
সে দৌড়ে বাথরুমে গিয়ে ঢুকে একা একা হিঃ হিঃ করে পাগলের মতো হাসতে লাগল। মাগো! সোনালি পিসিটা একদম পাগল। একদম পাগল। এ মা! কী বলে রে!
শুক থেকে প্রজাপতির জন্ম যেমন অদ্ভুত তেমনই অদ্ভুত কিছু ঘটতে লাগল বনানীর শরীরেও। ঝলঝলে সেই রোগা শরীরে কোথা থেকে ধীরে ধীরে জমে উঠছিল পলির স্তর, উর্বরতা।