দ্বিতীয় খণ্ড – বাংলার নবজাগরণ (১৮০০-১৯০৫)
চতুর্থ অধ্যায় – অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে বাংলা দেশ (১৭৬৫-১৮০০)
১৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দে পলাশি যুদ্ধের পর অর্ধশতাব্দীর মধ্যে ইংরেজী শাসন বাংলা দেশে কিরূপে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল প্রথম খণ্ডে তাহা বিবৃত হইয়াছে। কিন্তু শাসনব্যবস্থায় গুরুতর পরিবর্তন হইলেও ধর্ম, সমাজ, শিক্ষা, সংস্কৃতি প্রভৃতি বিষয়ে বিশেষ কোন পরিবর্তন ঘটে নাই। এই গ্রন্থের দ্বিতীয় ভাগে মধ্যযুগের পরিবর্তন সম্বন্ধে আলোচনা করা হইয়াছে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত এই সকল সম্বন্ধে বাংলা দেশের অবস্থা প্রায় একরূপই ছিল। কবিবর নবীনচন্দ্র সেন ‘পলাশির যুদ্ধ’ নামক বিখ্যাত কাব্যে পলাশির যুদ্ধক্ষেত্রে নবাব সিরাজউদ্দৌল্লার শোচনীয় পরাজয়ের পর অস্তগামী সূর্যের উদ্দেশ্যে মোহনলালের যে এক সুদীর্ঘ কাল্পনিক উক্তি উদ্ধৃত করিয়াছেন তাহাতে আছে :
“আজি গেলে, কালি পুনঃ হইবে উদয়,
গেল দিন, এই দিন ফিরিবে আবার,
ভারত-গৌরব-রবি ফিরিবার নয়,
ভারতের এই দিন ফিরিবে না আর।”
কিন্তু ইহা নিছক কবির কল্পনা মাত্র। পলাশির যুদ্ধের সময় বা পরে বাংলা দেশের লোকের মনে এই আশঙ্কা কখনও উদিত হয় নাই। সে সময়ের অবস্থায় গৌরব করিবার মতও বিশেষ কিছু ছিল না। উনবিংশ শতাব্দীতে বাঙ্গালীর ধর্ম, সমাজ, শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতিক চেতনা, দেশপ্রীতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে যে সমুদয় উন্নতি বাঙ্গালীকে গৌরবের সর্বোচ্চ চূড়ায় উঠাইয়াছিল, অষ্টাদশ শতাব্দীতে তাহার বিন্দুমাত্র সূচনা বা সম্ভাবনা দেখা যায় নাই। এই সমুদয় গুরুতর পরিবর্তনের ফলে বাঙ্গালীর জাতীয় জীবনে যে নবজাগরণের সূত্রপাত হইয়াছিল এবং যাহা ক্রমে সমুদয় ভারতবর্ষে বিস্তৃত হইয়া নবীন ভারত গঠন করিয়াছে, পৃথিবীর যে-কোন দেশের ইতিহাসে তাহা এক গৌরবময় অধ্যায় বলিয়া পরিগণিত হইবার যোগ্য। এই পরিবর্তন সম্যক বুঝিতে হইলে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে বাংলা দেশের অবস্থার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া আবশ্যক।
পলাশির যুদ্ধের সময় মুসলমান নবাবদের রাজ্যশাসন প্রথা এবং দরবারের সামাজিক ও ব্যক্তিগত দুর্নীতি অবনতির চরম সীমায় পৌঁছিয়াছিল। রাজকর্মচারীরা প্রায় সকলেই অযোগ্য ও অসৎ এবং রাজপরিবারের অধিকাংশের অবস্থাও প্রায় তদ্রূপই ছিল। “আলিবর্দি অনেকটা ইহার ব্যতিক্রম ছিলেন, কিন্তু তাঁহার পরিবারে এমন একজন পুরুষ ছিল না যাহাকে প্রকৃত মানুষ বলা যাইতে পারে, এবং স্ত্রীলোকেরা ছিল ততোধিক পাপিষ্ঠা।”[১] বিলাস-ব্যসন ও ইন্দ্রিয়ের সুখভোগই নবাব ও তাহাদের অনুচরদের একমাত্র কাম্য ছিল-নারী ও পুরাই ছিল তাহাদের নিয়ত সঙ্গী। সিরাজউদ্দৌল্লা, মীরণ প্রভৃতির প্রকৃতি এমন ছিল যে, রাজ্যের সম্ভ্রান্ত লোকেরাও সর্বদাই ভয়ে তটস্থ থাকিত। ফলে সৈন্যরা ছিল অপদার্থ ও অকর্মণ্য এবং নবাবের বিরুদ্ধে অহরহ ষড়যন্ত্র ও বিদ্রোহ লাগিয়াই ছিল। পারিবারিক জীবনও ইন্দ্রিয়পরায়ণতা ও বিলাস-ব্যসনের ফলে কলুষিত হইয়াছিল। ধর্ম, সমাজ ও সাহিত্যে এই কলুষতা পূর্ণরূপে প্রতিফলিত হইয়াছিল।
নবাব-দরবারের এই কলুষতা যে হিন্দু-মুসলমান উভয় সমাজকেই কতকটা দূষিত করিয়াছিল তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। মধ্যযুগে প্রায় ছয়শত বৎসর একত্র বাস করিয়াও হিন্দু ও মুসলমান যে সম্পূর্ণ পৃথক দুইটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত ছিল ইহা পূর্বেই বলা হইয়াছে।[২] ঊনবিংশ শতাব্দীতেও এই পার্থক্য স্পষ্টতঃ স্বীকৃত হইয়াছে। ১৮৬৯ খ্রীষ্টাব্দে অমৃতবাজার পত্রিকায় মুসলমানদের সম্বন্ধে একটি সুদীর্ঘ প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। ইহা হইতে কিঞ্চিৎ উদ্ধৃত করিতেছি :
“হিন্দু ও মুসলমানে এদেশের অধিবাসীগণ বিভক্ত। …আমাদের দেশের মুসলমানের পূর্বপুরুষেরা তাবতেই যে আফগানিস্থান, তাতার প্রভৃতি দেশ হইতে আসিয়াছেন তাহা নয়। পূৰ্ব্বকালে হিন্দুসমাজের শাসন অতি কঠোর ছিল। …যবনে বল দ্বারা কোন হিন্দু স্ত্রীলোককে হরণ করিলে সে গোষ্ঠী সমেত পতন হইত। এরূপ ঘটনা ভদ্রলোকের গৃহে অতি বিরল হইত, অপর (নীচ জাতীয়) লোকের মধ্যেই বিস্তর ঘটিত। এমন কি কোন একটি সামান্য ঘটনা হইলেই তাহার জাতি যাইত। এইরূপে এদেশে মুসলমানের দল বৃদ্ধি হয়। এই সমাজচ্যুত হতভাগ্য ব্যক্তিরা আসল মুসলমান কর্তৃক গৃহীত হইল না। কাজেই তাহারা নিজেরা বা পৃথক একদলই হইল।…ইহাদের পূৰ্বপুরুষ তল্লাস করিতে গেলে জানা যাইবে যে ইহারা…নীচজাতীয় হিন্দুগণের সন্তান।…ইহাদের সঙ্গে কি ভদ্র হিন্দুর তুলনা হইতে পারে? সচরাচর গণনা করা হইয়া থাকে যে এদেশে দুই ভাগ হিন্দু ও একভাগ মুসলমান, কলিকাতার জনসংখ্যা নিরূপণ দেখিলে (হিন্দু ২,৩৯,১৯০ ও মুসলমান ১,১৩,০৫৯) তাহাই বোধ হয়। এই মুসলমানদের মধ্যে যদি বারো আনার পূর্বপুরুষ এদেশে জাত ধরা হয়, তবু বোধহয় কম ধরা হইল। এ হিসাবে এতদ্দেশে ৩০ লক্ষ বিদেশস্থ, অর্থাৎ জাতি মুসলমান ও ২ কোটি ৬০ লক্ষ হিন্দু আছে।[৩]
বাংলা দেশে মুসলমানদের উৎপত্তি সম্বন্ধে উল্লিখিত বিবরণ কতদূর সত্য তাহা বলা কঠিন। কিন্তু তৎকালীন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও সম্ভ্রান্ত হিন্দুগণ সাধারণ বাঙ্গালী মুসলমানদিগক কী চক্ষে দেখিতেন তাহার সম্বন্ধে ইহা হইতে অনেকটা সত্য ধারণা করা যায়। বিংশ শতাব্দীর প্রথমে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে কাল্পনিক ভ্ৰাতৃভাবের যে প্রবল বন্যা ও উজ্জ্বাস বহিয়াছিল–তাহার সহিত উল্লিখিত উক্তির কোন সমন্বয় বা সামঞ্জস্য করা কঠিন। অপ্রিয় হইলেও ঐতিহাসিক সত্যকে উপেক্ষা করা উচিত নহে–কারণ তাহা হইলে ঐতিহাসিক বিবর্তন সম্বন্ধে সঠিক ধারণা করা যায় না। পাকিস্তান সৃষ্টির মূলে যে কেবল সৈয়দ আহম্মদ ও জিন্নার অবদান আছে তাহা নহে, মুসলমান সম্প্রদায়ের সম্বন্ধে হিন্দুদিগের চিরন্তন মনোভাবও ইহার জন্য কতক পরিমাণে দায়ী। এই মনোভাব কতদূর ন্যায়সঙ্গত ছিল এবং কী কারণে গড়িয়া উঠিয়াছিল, বর্তমান প্রসঙ্গে তাহার আলোচনা অনাবশ্যক। বহুকাল পাশাপাশি অবস্থানের অবশ্যম্ভাবী ফলস্বরূপ উভয়ের মধ্যে অনেক স্থলে বাহ্যিক প্রীতির বন্ধন ছিল এবং উভয়ে উভয়ের সামাজিক আচার অনুষ্ঠান এবং লৌকিক ধর্মসংস্কার ও বিশ্বাস কিছু কিছু গ্রহণ করিয়াছিল। কিন্তু হিন্দু ও মুসলমান যে বাংলা দেশে বরাবরই দুইটি সম্পূর্ণ পৃথক সম্প্রদায় ছিল; ধর্ম, সামাজিক আচার-ব্যবহার, সাহিত্য, শিক্ষা, শিল্প প্রভৃতির মধ্যদিয়া যে উভয়ের মধ্যে সংমিশ্রণ তো দূরের কথা, কোন নিবিড় যোগসূত্র গড়িয়া উঠে নাই, একথা অস্বীকার করা কঠিন। তাহারা প্রতি গ্রামে ও শহরে বা পাশাপাশি গ্রামে একসঙ্গে বাস করিত–কিন্তু তাহারা এক পরিবার বা এক সমাজভুক্ত হয় নাই তাহারা ছিল মাত্র প্রতিবেশী। উভয়ের মধ্যে সাধারণতঃ সদ্ভাব ও মৈত্রীর সম্বন্ধ ছিল, আবার কখনও ধর্ম বা সামাজিক বৈষম্যের ফলে মতান্তর, মনান্তর, কলহ ও মারামারি হইত-কদাচিৎ ইহা তুমুল দাঙ্গাতেও পর্যবসিত হইত। সংক্ষেপে বলিতে গেলে ইহাই ছিল বাংলায় হিন্দু-মুসলমানের প্রকৃত সম্বন্ধ। তাহাদের মধ্যে সচরাচর বৈরীভাব ছিল না কিন্তু ভ্রাতৃত্ব-বন্ধনেরও কোন প্রমাণ নাই। হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে ব্যক্তিগত সৌহার্দ ও অকৃত্রিম বন্ধুত্বের নিদর্শন থাকিলেও সম্প্রদায়িক ভ্ৰাতৃভাব কখনও প্রতিষ্ঠিত হয় নাই বরং সর্ববিষয়ে উভয়ের মধ্যে মৌলিক প্রভেদ এত গুরুতর ছিল যে ইহার কোন সম্ভাবনাও কেহ মনে করিত এরূপ কোন প্রমাণ নাই। বিংশ শতাব্দীর পূর্বে ইহা কেহ কখনও কল্পনাও করে নাই। ইংরেজ আমলে হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ কিরূপে বৃদ্ধি পাইতে পাইতে অবশেষে পাকিস্তানের সৃষ্টি হইল ইহা সঠিক বুঝিতে হইলে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে কিরূপ সম্বন্ধ ছিল সে-বিষয়ে প্রকৃত ধারণার প্রয়োজন। আধুনিক যুগে হিন্দু-মুসলমানের সম্বন্ধ বাংলার তথা ভারতের ইতিহাসে একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এইজন্য প্রথমেই এই বিষয়টি একটু বিস্তৃতভাবে আলোচিত হইল।
বাংলায় মুসলমান সমাজে কতকগুলি নূতন প্রথার উদ্ভব হইয়াছিল এবং এমন কতকগুলি পরিবর্তন ঘটিয়াছিল যাহা ইসলামের ধর্মবিশ্বাসের বিরোধী। এ সম্বন্ধে এই গ্রন্থের দ্বিতীয় ভাগে যাহা বলা হইয়াছে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধ সম্বন্ধেও তাহা প্রযোজ্য। এই প্রসঙ্গে অনুরূপ আরও কয়েকটি দৃষ্টান্ত দিতেছি। হিন্দু-বিবাহের অনেক মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান মুসলমান সমাজে ঢুকিয়াছিল। দৃষ্টান্তস্বরূপ, বিবাহের পূর্বে কন্যাস্নান ও নানা কেলি-কৌতুক-রঙ্গ, মেয়েদের শাড়ী পরিধান ও চুলের খোঁপায় ফুল খুঁজিয়া দেওয়া, ধান্যদূর্বা দিয়া বর বরণ প্রভৃতির উল্লেখ করা যাইতে পারে। কোনও কোনও মুসলমান-সম্প্রদায়ে বিধবা-বিবাহ নিষিদ্ধ বা নিন্দনীয় ছিল। এই সমুদয় ছাড়াও যাত্রাকালে শুভ ও অশুভ বস্তু দর্শন, ভূত-প্রেতে বিশ্বাস, জ্যোতিষগণনার উপর নির্ভরশীলতা, মাথায় হাত দিয়া শপথ করা, পূজ্যপাদ ব্যক্তিকে পায়ে হাত দিয়া প্রণাম, শিশুর অন্নপ্রাশন প্রভৃতি এমন বহু হিন্দুপ্রথা বাংলার মুসলমান সমাজে প্রচলিত ছিল যাহা মুসলমান ধর্মশাস্ত্রে অনুমোদিত নহে।
বাংলার বৈষ্ণবধর্মও মুসলমানদের উপর প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল। অনেক মুসলমান লেখক বৈষ্ণব পদাবলী রচনা করিয়াছেন। মুসলমান সাহিত্যে কর্মফলভোগ ও জন্মান্তরবাদে বিশ্বাস প্রতিধ্বনিত হইয়াছে।
এই সমুদয় খুব স্বাভাবিক কারণেই ঘটিয়াছিল। বাংলা দেশের বহু মুসলমান যে ধর্মান্তরিত হিন্দু এ-বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। আমার বাল্যকালে আমাদের গ্রামের নিকটে এক মুসলমান জমিদার ছিলেন; তাঁহার পিতামহ বা প্রপিতামহ যে হিন্দু ছিলেন ইহা ঐ অঞ্চলে সর্বজনবিদিত ছিল। সাধারণ মুসলমানদের মধ্যেও এরূপ কয়েকটি দৃষ্টান্তের কথা মনে আছে। সুতরাং ইহারা যে পূর্বসংস্কার ও আচার-ব্যবহার কিছু কিছু বজায় রাখিবেন ইহা অস্বাভাবিক নহে। হিন্দু মুসলমানের সংস্কৃতি ও ধর্মবিশ্বাসের উপর পরস্পরের প্রভাব সম্বন্ধে এই গ্রন্থের দ্বিতীয় ভাগে যাহা বলা হইয়াছে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগেও তাহাই ছিল। সুতরাং ইহার পুনরুক্তি নিপ্রয়োজন।
দুইটি বিষয়ে হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে বিশেষ সাদৃশ্য ছিল। প্রথমতঃ এই দুই সংস্কৃতিই ধর্মকেন্দ্রিক এবং দুইয়ের মধ্যেই ধর্মান্ধতা যথেষ্ট পরিমাণে ছিল। উভয় সমাজেই প্রচলিত বিশ্বাস ও অনুষ্ঠানই ধর্মের স্থান অধিকার করিত কোনরূপ যুক্তি-তর্ক বা ন্যায়-অন্যায়ের বিচার বড় একটা ছিল না। হিন্দুসমাজে সতীদাহ, গঙ্গায় শিশু-সন্তান বিসর্জন, চড়ক প্রভৃতি নিষ্ঠুর প্রথা এবং বিধবা-বিবাহ নিষেধ ও কৌলীন্য প্রথার বিষময় ফল লোকে ধর্মের অঙ্গ বলিয়া বিনাবিচারে মানিয়া লইয়াছে; স্ত্রীলোকের অক্ষরপরিচয় হইলেই তাহাদের বৈধব্যদশা ঘটিবে ইহা বিশ্বাস করিয়া তাহাদিগকে শিক্ষা হইতে বঞ্চিত করিয়া রাখিয়াছে। হিন্দু ও মুসলমান উভয় সমাজেই ভদ্রঘরের স্ত্রীলোকের কঠোর পর্দার ব্যবস্থা নির্বিচারে অনুসৃত হইয়াছে। হিন্দুদিগের প্রধান ধর্মোৎসব দুর্গাপূজা ধনীর গৃহে জাঁকজমক, নৃত্য-গীত ও পানভোজনের উপলক্ষ মাত্রে পর্যবসিত হইয়াছে।
দ্বিতীয়তঃ, হিন্দু ও মুসলমান উভয় সমাজেই শিক্ষা ও জ্ঞানের গণ্ডী প্রায় ধর্ম বিষয়েই সীমাবদ্ধ ছিল। পাশ্চাত্ত্য জগতে এই সময়ে নূতন নূতন চিন্তাধারার বিকাশ ও জ্ঞানবিজ্ঞানের অদ্ভুত উন্নতি সাধন হইতেছিল কিন্তু ইহার কোন সংবাদই বাংলা দেশে পৌঁছায় নাই। এমনকি মুদ্রণযন্ত্র সম্বন্ধেও হিন্দু-মুসলমানেরা সম্পূর্ণ অজ্ঞ ছিল। বাংলাভাষায় তখন গদ্যসাহিত্যের অস্তিত্ব ছিল না। অবশ্য বাঙ্গালীরা গদ্যভাষায় কথাবার্তা বলিত, চিঠিপত্র লিখিত। কিন্তু খ্রীষ্টীয় মিশনারীদের দুই একখানি প্রচার-গ্রন্থ ছাড়া ১৮০০ খ্রীষ্টাব্দের পূর্ব বাংলাগদ্যে লিখিত এমন একখানি গ্রন্থও নাই যাহা সাহিত্য বলিয়া গৃহীত হইতে পারে।
উপসংহারে বক্তব্য এই যে, বাঙ্গালীর নীতি ও চরিত্র এবং হিন্দু-মুসলমানের সামাজিক সম্বন্ধ বিষয়ে এই গ্রন্থের দ্বিতীয় ভাগে যাহা বলা হইয়াছে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগ সম্বন্ধেও তাহা মোটামুটিভাবে প্রযোজ্য।
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে বাঙ্গালীর ধর্ম, সমাজ, শিক্ষা ও সংস্কৃতির যে সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হইল, পরবর্তী একশত বৎসরের মধ্যেই তাহার গুরুতর পরিবর্তন সাধিত হয়। ঐ সময়ের মধ্যেই স্বদেশপ্রেম ও জাতীয়ভাবের উন্মেষ এবং রাজনীতিক অধিকার লাভের প্রেরণা দেখা দেয়। যে সমুদয় কারণে এই গুরুতর পরিবর্তন ঘটে তাহাদের মধ্যে ইংরেজীশিক্ষাই প্রধান বলিয়া গ্রহণ করা যাইতে পারে। সুতরাং প্রথমেই এই বিষয়টি আলোচনা করিয়া পরে জাতীয় নবজাগরণের বিভিন্ন দিক সম্বন্ধে পৃথক পৃথক ভাবে আলোচনা করা হইবে।
পাদটীকা
১. History of Bengal Vol. II (Published by Dacca University), p. 497.
২. বাংলা দেশের ইতিহাস (মধ্যযুগ) ৩১৭-৩৪ পৃ.
৩. যোগেশচন্দ্র বাগল প্রণীত “ভারতবর্ষের স্বাধীনতা” (১ম খণ্ড) পৃ. ১৭৪-৭৬। বর্তমান যুগের রুচিসম্মত না হওয়ায় কয়েকটি শব্দ বাদ দেওয়া বা পরিবর্তন করা হইল।