৪
‘এটা কি অম্বিকাবাবুর বাড়ি?’
দরজা ধরে যে-মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে, সে জবাব দিল না। তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রইল। মেয়েটির বয়স উনিশ-কুড়ি। হালকা-পাতলা গড়নের শ্যামলা মেয়ে। চোখ দু’টি অপূর্ব। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার চোখ নয়। কিন্তু মেয়েটি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মিসির আলি বললেন, অম্বিকাবাবুর সঙ্গে আমার খুব প্রয়োজন। আমার নাম মিসির আলি।
‘আমি আপনাকে চিনি।’
তাই বুঝি? তাহলে তো ভালোই হল। লোকজন আমাকে চিনতে শুরু করেছে এটাই সমস্যা। তোমার নাম কি?’
‘অতসী।’
‘অতসী, তোমার বাবা কি আছেন?
মেয়েটি জবাব দিল না। দরজা ধরে দাঁড়িয়ে রইল। মিসির আলি নিশ্চিত হলেন অম্বিকাবাবু বাড়িতেই আছেন। তবে অতসী হয়তো তা স্বীকার করবে না। মিথ্যা করে বলবে, বাবা বাড়ি নেই। তবে মেয়েটিকে দেখে মনে হচ্ছে মিথ্যা বলার অভ্যাস এখনো হয় নি। মিথ্যা বলার আগে তাকে নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হচ্ছে। মিসির আলি মেয়েটিকে বিপদ থেকে উদ্ধার করলেন। হাসিমুখে বললেন, ‘উনি বোধহয় বাড়ি নেই।’
অতসী হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। সঙ্গে-সঙ্গে বলল, ‘জ্বি-না, নেই।’
‘তাঁর সঙ্গে আমার বিশেষ প্রয়োজন ছিল। কখন এলে তাঁকে পাওয়া যাবে বল তো?’
মিসির আলি আবার মেয়েটিকে বিপদে ফেললেন। এখন অতসীকে বাধ্য হয়ে সময় দিতে হবে। কিংবা বলতে হবে তাঁর সঙ্গে দেখা করা যাবে না। এই দু’টির কোনটি সে বলবে কে জানে।
মিসির আলি বললেন, ‘তাঁর সঙ্গে দেখা না করলেও অবশ্যি চলে। তোমার সঙ্গে কথা বললেও হয়। আমি বরং তোমার সঙ্গে দু’-একটা কথা বলে চলে যাই।’
অতসী চমকে উঠে বলল, ‘আমার সঙ্গে? আমার সঙ্গে কী কথা?’
‘তুমি কথা বলতে না চাইলে বলতে হবে না।’
‘আসুন, ভেতরে আসুন।’
‘ভেতরে আসারও প্রয়োজন দেখছি না। এখানে দাঁড়িয়েই কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করে চলে যাই। জিজ্ঞেস করব?’
‘করুন।’
‘অম্বিকাবাবুর তিনটি দাঁত কি সোনা দিয়ে বাঁধানো?’
অতসী হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। এবার সে তাকাল ভীত চোখে। তার চোখের পাতা দ্রুত কাঁপছে। নাকের পাটায় ঘাম জমছে। চোখে-চোখেও তাকাচ্ছে না। মাথা নিচু করে আছে। চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এখন আর নেই।
‘অতসী।
অতসী তাকাল। কিছু বলল না।
‘শোন মেয়ে, তোমার বাবা এক রাতে আমার সঙ্গে গল্প করতে এসেছিলেন। তিনি বললেন, তাঁর নাম ওসমান গনি। তিনি অপ্রকৃতিস্থ একজন মানুষের অভিনয় করলেন। বেশ ভালো অভিনয়। আমি ধরতে পারলাম না।’
‘বাবা কি আপনাকে এ-বাড়ির ঠিকানা দিয়ে এসেছিলেন?’
‘না।’
‘তাহলে ওনাকে খুঁজে বের করলেন কীভাবে?’
মিসির আলি হাসতে-হাসতে বললেন, ‘তুমি একটু আগে বলেছ, তুমি আমার নাম জান। নাম যদি জান, তাহলে এটাও জানা উচিত যে, মানুষ খুঁজে বের করার মতো বুদ্ধি আমার আছে। কী করে বের করেছি জানতে চাও?’
অতসী হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।
‘তাহলে শোন। তোমার বাবা বলেছিলেন তাঁর ডায়াবেটিস। এই অংশটি অভিনয় নয়। কারণ তিনি চিনি ছাড়া চা খেতে চাইলেন। একজন ডায়াবেটিক পেশেন্ট, যে ঢাকায় থাকে, সে চিকিৎসার জন্যে ডায়াবেটিক সেন্টারে যাবে এটাই স্বাভাবিক। কাজেই আমি গেলাম বারডেমে, জিজ্ঞেস করলাম, তাঁদের এমন কোনো রুগী আছে কি না, যার তিনটি দাঁত সোনা দিয়ে বাঁধানো। তারা সঙ্গে-সঙ্গে বলল—অম্বিকাবাবু। সোনা দিয়ে দাঁত বাঁধানো না থাকলে খুঁজে বের করতে আরেকটু সময় লাগত।’
অতসী তাকিয়ে আছে। তার চোখ দেখে বোঝা যাচ্ছে না সে বিস্মিত হয়েছে কি না। মিসির আলি চাচ্ছেন মেয়েটি বিস্মিত হোক। কারণ মেয়েটিকে বিস্ময়ে অভিভূত করা তাঁর নিজের স্বার্থেই প্রয়োজন। সে বিস্ময়ে অভিভূত হলেই তাঁর সব প্রশ্নের জবাব দেবে। আগ্রহ করে দেবে।
‘অতসী।’
‘জ্বি।’
‘তোমার বাবা যে বাড়িতেই আছেন তা আমি জানি। যদিও বুঝতে পারছি না, কেন তুমি তোমার বাবার সঙ্গে আমাকে দেখা করতে দিচ্ছ না।’
‘আমার বাবা অসুস্থ।’
‘ও।’
‘বিশ্বাস করুন তিনি অসুস্থ।’
‘বিশ্বাস করছি।’
‘আপনি কি ভেতরে এসে বসবেন?’
‘তুমি দরজা থেকে হাত নামালেই ঘরে ঢুকব। আজ সারাদিন খুব ছোটাছুটি করেছি। চা খাওয়া হয় নি। তুমি কি চা খাওয়াবে?’
‘আপনি দুধ ছাড়া চা যদি খেতে পারেন, তাহলে খাওয়াব। ঘরে দুধ নেই।’
‘চা দুধ ছাড়া খাওয়াই ভালো।’
অতসী দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়াল। মিসির আলি ঘরে ঢুকলেন। ঘরে ঢুকে তাঁর মন খারাপ হয়ে গেল। হতদরিদ্র অবস্থা। এই ঘরটি নিশ্চয়ই এদের বসার ঘর। দু’টা বেতের চেয়ার। অনেক জায়গায় বেত খুলে গেছে। তার দিয়ে মেরামত করা। ঘরের প্রায় পুরোটা জুড়ে বড় একটা চৌকি। চৌকিতে পাটি পাতা। সেই পাটিও দীর্ঘ ব্যবহারে জীর্ণ। পাটির পাশে হাতপাখা—যদিও একটি সিলিং ফ্যান দেখা যাচ্ছে। মাকড়সা জাল বানিয়েছে ফ্যানের পাখায়—অর্থাৎ ফ্যানটি অনেকদিন ঘুরছে না।
মিসির আলি মনস্থির করতে পারলেন না কোথায় বসবেন। পাটিতে বসবেন না বেতের চেয়ারে বসবেন। পাটিতে বসাই ঠিক করলেন। এখান থেকে বাড়ির ভেতরের খানিকটা দেখা যায়।
মেয়েটি চা বসিয়েছে বারান্দায়। এদের রান্নাঘর সম্ভবত বারান্দায়। দু’-কামরার বাড়ি। ভেতরের ঘরে নিশ্চয়ই মেয়েটি ঘুমায়। বসার ঘরে থাকেন অম্বিকাবাবু। ভদ্রলোকের পেশা কী, তা বোঝা যাচ্ছে না। চটপটে ধরনের কথাবার্তা এবং গল্প তৈরি করে বিশ্বাসযোগ্যভাবে বলার ক্ষমতা থেকে দু’ ধরনের সম্ভাবনার কথা মনে হয় :
(১) ভদ্রলোকের পেশা দালালি করা।
(২) ভদ্রলোক একজন জ্যোতিষী।
জ্যোতিষী হবার সম্ভাবনাই বেশি, কারণ তাঁর হাতে তিনটি পাথরের আঙটি। তবে জ্যোতিষীরা ঘরে নানান নিদর্শন ছড়িয়ে রাখবে, রাস্তায় সাইনবোর্ড থাকবে—
‘জ্যোতিষসম্রাট অম্বিকাচরণ
কর গণনা ও কোষ্ঠী বিচার করা হয়।’
অতসী চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ঢুকল। মৃদু গলায় বলল, ‘চা নিন।’
মিসির আলি চায়ের কাপ হাতে নিলেন।
অতসী ক্ষীণ গলায় বলল, ‘ঘরে চিনিও নেই। চিনি ছাড়া চা। আপনি কিছু মনে করবেন না। বাবা চায়ে চিনি খান না, কাজেই চিনি কেনা হয় না।’
‘অতসী, তুমি বস।’
অতসী বেতের চেয়ারে বসল। মিসির আলি বললেন, ‘তোমার মুখ দেখে মনে হচ্ছে চিনি ছাড়া চা দিয়ে তুমি মন-খারাপ করেছ। মন-খারাপ করার কিছু নেই। আমি চায়ে দুধ খাই, চিনি খাই না।’
মেয়েটি কিছু বলল না। মিসির আলি বললেন, ‘তুমি আর তোমার বাবা, তোমরা দু’ জন এখানে থাক?
‘হ্যাঁ।’
‘তোমরা ক’ ভাই-বোন?’
‘আমি একা।’
‘তোমার মা জীবিত নেই?’
‘না।’
‘কতদিন আগে মারা গেছেন?’
‘ষোল-সতর বছর আগে।’
‘কি করেন তোমার বাবা?’
‘তিনি নবীনগর গার্লস স্কুলের অঙ্কের শিক্ষক ছিলেন। রিটায়ার করেছেন। আগে প্রাইভেট পড়াতেন। এখন আর পড়ান না। অসুস্থ।’
‘কতদিন ধরে অসুস্থ?’
‘বছর দুই।’
‘খুব অপ্রিয় একটা প্রশ্ন করছি অতসী, তোমাদের চলে কীভাবে?’
অতসী জবাব দিল না। স্থির চোখে তাকিয়ে রইল। মিসির আলি পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্যে বললেন, ‘আমি ভেবেছিলাম তোমার বাবা একজন জ্যোতিষী। তিনি যে স্কুল-শিক্ষক বুঝতে পারি নি।’
অতসী যন্ত্রের মতো গলায় বলল, ‘আপনি ঠিকই অনুমান করেছেন। বাবা মাস্টারির পাশাপাশি জ্যোতিষচর্চা করতেন।’
‘করতেন বলছ কেন? এখন করেন না?’
‘না।’
‘শখের চর্চা?’
‘শখের চর্চা না। তিনি টাকা নিতেন।’
‘ও আচ্ছা। তাঁর রোজগার কেমন ছিল?’
‘তাঁর রোজগার ভালোই ছিল। তিনি রোজগার যেমন করতেন খরচও তেমন করতেন। আপনি নিশ্চয়ই তাঁর হাতের আঙটি তিনটি লক্ষ করেছেন। একটি আঙটি হচ্ছে নীলার। বিক্রি করলে অনেক টাকা পাওয়ার কথা।’
‘বিক্রি করছ না কেন? আমার মনে হচ্ছে বিক্রি করার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।’
অতসী জবাব দিল না। মিসির আলি বললেন, ‘কাগজ-কলম আন তো। আমি আমার বাসার ঠিকানা লিখে দিচ্ছি। তোমার বাবা সুস্থ হলে আমাকে খবর দিও। আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করব। হাতটাও না-হয় দেখাব।’
‘আপনি হাত দেখায় বিশ্বাস করেন?’
‘না, করি না। অতিপ্রাকৃত কোনো কিছুতেই বিশ্বাস করি না।’
‘তাহলে বাবাকে হাত দেখাতে চাচ্ছেন কেন?’
‘কৌতূহল, আর কিছুই না। আমি ভূত বিশ্বাস করি না। কিন্তু কেউ যদি বলে আমার বাসায় একটা পোষা ভূত আছে, দড়ি দিয়ে খাটের পায়ার সঙ্গে বেঁধে রাখি-তাহলে আমি অবশ্যই ঐ ভূত দেখতে যাব।’
মিসির আলি উঠে দাঁড়ালেন। অতসী তাঁকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিল। মিসির আলি বললেন, ‘যাই।’ মেয়েটি কিছুই বলল না।
রাস্তায় নেমে মিসির আলি পিছন ফিরে তাকালেন। অতসী এখনো দরজা ধরে দাঁড়িয়ে। একটা বিশেষ জরুরি কথাই মিসির আলি জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেছেন, ওসমান গনিকে মেয়েটি চেনে কি না। তিনি ফিরে এলেন। মেয়েটি দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। সেও যেন জানে—মিসির আলি ফিরে আসবেন।
‘অতসী।’
‘জ্বি।’
‘তুমি কি ওসমান গনি সাহেবকে চেন?’
অতসী চুপ করে রইল। মিসির আলি জবাবের জন্যে মিনিট দুই অপেক্ষা করলেন। আর অপেক্ষা করার অর্থ হয় না। মেয়েটি মুখ খুলবে না।
‘অতসী।’
‘বলুন।’
‘আমার ঠিকানাটা হারাবে না। যত্ন করে রেখ। আমি অপেক্ষা করব তোমাদের জন্যে। আমি তোমাদের সাহায্য করতে চাই।’
ঠিক তখন বাড়ির ভেতর থেকে পশুর গর্জনের মতো গর্জন শোনা গেল। কেউ মনে হয় ভারি কিছু ছুঁড়ে ফেলল।
মিসির আলি বললেন, ‘তোমার বাবাকে কি তালাবন্ধ করে রাখা হয়েছে?’ অতসী হ্যাঁ, না কিছুই বলল না।
মেয়েটি স্থির চোখে তাকিয়ে আছে। সে একবারও চোখের পলক ফেলল না। মিসির আলি পথে নামতে-নামতে ভাবতে লাগলেন, মানুষ সেকেন্ডে ক’বার চোখের পলক ফেলে? চোখের পলক ফেলা দিয়ে মানুষের চরিত্র কি বিচার করা যায়? যেমন সেকেন্ডে ৫ বারের বেশি যে চোখের পলক ফেলবে সে হবে রাগী। যে ৩ বারের কম ফেলবে সে হবে ঠাণ্ডা ধরনের মানুষ। কেউ কি চেষ্টা করেছে?
.
এক সপ্তাহ কেটে গেল। কেউ মিসির আলির সঙ্গে দেখা করতে এল না। আর বোধহয় আসবে না। আসবার হলে প্রথম দু’-তিন দিনের ভেতরই আসত। অষ্টম দিনে মিসির আলি নিজেই গেলেন। অনেকক্ষণ দরজার কড়া নাড়ার পর বাচ্চা একটা ছেলে দরজা খুলল। মিসির আলি বললেন, ‘অতসী আছে?’
ছেলেটা হাসিমুখে বলল, ‘আমরা নতুন ভাড়াটে। তারা চলে গেছে।’
‘কোথায় গেছে, জান?’
‘না।’
‘আচ্ছা।’
আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে, মিসির আলি কেন জানি নিশ্চিন্ত বোধ করছেন। বড় ধরনের ঝামেলা মাথার ওপর থেকে নেমে গেলে যে-ধরনের স্বস্তিবোধ হয়, সে-ধরনের স্বস্তি। শরীরটা খারাপ হবার পর থেকে তাঁর ভেতর একধরনের অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। চাপ সহ্য করতে পারেন না। ওসমান গনি-অম্বিকাচরণ এই দু’ জনের ব্যাপারটা তাঁর ওপর চাপ দিচ্ছিল। এখন মনে হচ্ছে চাপ থেকে মুক্তি পেলেন। আর ভাবতে হবে না। আশি লাখ লোকের বাস এই শহরে। আশি লাখ লোকের ভেতর কেউ যদি হারিয়ে যেতে চায়, তাকে খুঁজে বের করা মুশকিল। আর দরকারই-বা কি?
মিসির আলি রিকশা নিলেন। হালকাভাবে বৃষ্টি পড়ছে। কুয়াশার মতো বৃষ্টি। বৃষ্টিতে ভিজতে-ভিজতে ঘরের দিকে রওনা হয়েছেন। তাঁর ভালো লাগছে। বৃষ্টি বাড়ছে, কিন্তু তাঁর হুড তুলতে কিংবা প্লাস্টিকের পর্দায় শরীর ঢাকতে ভালো লাগছে না। রাস্তায় লোকজন আগ্রহ নিয়ে তাঁকে দেখছে—একটা মানুষ রিকশায় বসে ভিজতে—ভিজতে এগুচ্ছে। রিকশাওয়ালা ধমকের স্বরে বলল, ‘হুড তুলেন। ভিজতেছেন ক্যান?’ মিসির আলি জবাব দিলেন না। রিকশাওয়ালা রাস্তার পাশে রিকশা থামিয়ে বিরক্ত মুখে হুড তুলতে লাগল। হুড থাকা সত্ত্বেও একটা মানুষ তার রিকশায় ভিজতে— ভিজতে যাবে এটা তার সহ্য হচ্ছে না। সে হয়তো সূক্ষ্মভাবে অপমানিত বোধ করছে।
রিকশা আবার চলতে শুরু করল। মিসির আলি ভাবতে শুরু করলেন, কি করে এই অম্বিকাচরণবাবুকে খুঁজে বের করা যায়। কাজটা কি খুব জটিল? তাঁর কাছে মনে হচ্ছে না। ভদ্রলোক যে-বাড়িতে ছিলেন সে-বাড়ির মালিক জানতে পারে। নতুন বাড়ির ঠিক ঠিকানা না পারলেও, কোন এলাকায় গিয়েছেন তা বলতে পারার কথা। আশেপাশের মুদির দোকানগুলি খুঁজতে হবে। নিশ্চয় আগে যেখানে ছিলেন তার আশেপাশের মুদির দোকানে তাঁর বাকির খাতা আছে। বাকির সব টাকা দিতে না পারলে দোকানদারকে নতুন বাসার ঠিকানা বলে যাবেন, এটাই সঙ্গত। সবচেয়ে বড় সাহায্য পাওয়া যাবে বিটের পিওনদের কাছ থেকে। এরা বলতে পারবে, তবে সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।
‘রিকশাওয়ালা।’
‘জ্বে?’
‘আপনার নাম কি ভাই?’
কেরামত।’
‘শুনুন ভাই কেরামত, আপনি আমাকে যেখান থেকে এনেছিলেন ঠিক সেইখানে নামিয়ে দিয়ে আসুন। আর হুডটা ফেলে দিন। আমার বৃষ্টিতে ভিজতে-ভিজতে যেতে ভালো লাগছে।’
রিকশাওয়ালা রিকশা থামাল। সে অসম্ভব বিরক্তি নিয়ে তাকাচ্ছে। মিসির আলি লক্ষ করেছেন, রিকশাওয়ালাদের মধ্যে এই একটা ব্যাপার আছে, তারা যেখান থেকে যাত্রা শুরু করেছে, কখনো সেখানে যেতে চায় না। হয়তো কোনো এক কুসংস্কার তাদের মধ্যেও আছে। যেখান থেকে যাত্রা শুরু সেখানে ফিরে আসা যাবে না। ফিরে এলে চক্র সম্পূর্ণ হয়। মানুষ কখনো চক্র সম্পূর্ণ করতে চায় না। সে চক্র ভাঙতে চায়, কিন্তু প্রকৃতি নামক অজানা অচেনা একটা কিছু বারবার মানুষের চক্র সম্পূর্ণ করে দেয়। কেন করে?
তুমুল বর্ষণ হচ্ছে।
মিসির আলি ভিজছেন। ভালো লাগছে। তাঁর খুব ভালো লাগছে।