অবতরণিকা : দ্বিতীয় সংস্করণ
নারী পুরুষতান্ত্রিক সভ্যতার সবচেয়ে নিষিদ্ধ সপ্ৰাণ বস্তু। পুরুষ নারীকে আজো বস্তু, উপভোগ্যতম বস্তু, ব’লেই গণ্য করে; দিকে দিকে তাকে নিষিদ্ধ ক’রে রাখতে চায়, এবং তার জন্যে নিষিদ্ধ করে রাখতে চায় সব কিছু। এক উগ্ৰ পিতৃতন্ত্রের মধ্যে বাস করি আমরা, যেখানে নারী অতিনিষিদ্ধ, নারীর অধিকার দাবি যেখানে দ্রোহিতা, নারী যেখানে দাসী ও ভোগ্যসামগ্ৰী। আমরা আজো আছি প্ৰথা, মধ্যযুগ ও তার নির্মম বিধিবিধানের মধ্যে। আমি প্রথাবিরোধী; প্ৰথা মানুষকে পশুস্তরে আটকে রাখে, বিকশিত হ’তে দেয় না; কিন্তু আমি বিশ্বাস করি নিরন্তর বিকশিত হওয়াই মনুষ্যত্ব। আজ প্রচণ্ডভাবে প্রথার প্রত্যাবর্তন ঘটানো হচ্ছে পৃথিবী জুড়ে; প্রথার পক্ষে কথা বললে এখন অজস্র মুকুট মেলে, প্রথার বিরুদ্ধে গেলে জোটে অপমৃত্যু। রাষ্ট্রলিপ্সু রাজনীতিকেরা মানুষকে আজ উৎসর্গ ক’রে দিচ্ছে প্রথার পায়ে; ক্ষমতার জন্যে তারা মানুষকে পশুতে পরিণত করতেও প্ৰস্তৃত। তবে মানুষ প্রথার মধ্যে বাঁচতে পারে না, পশুও পারে না। প্রথা চিরজীবী নয়, কোনো প্রথা হাজার বছর ধরে চলে এসেছে ব’লেই তা শাশ্বত নয়; কোনো প্ৰথা মহাকাশ থেকে নামে নি, পুরুষতন্ত্রই সৃষ্টি করেছে সমস্ত প্ৰথা। তবে প্রথার স্বেচ্ছামৃত্যু ঘটে না, প্রগতিশীল মানুষেরাই অবসান ঘটায় প্রথার। পৃথিবীতে কিছুই শাশ্বত চিরকালীন নয়। পৃথিবী টিকে থাকবে আরো কয়েক কোটি বছর, প্ৰথা আর পঞ্চাশ বছরও হয়তো টিকবে না; এক শতাব্দী পর উত্তরপুরুষদের কাছে আমাদের সমস্ত বিশ্বাসকে মনে হবে হাস্যকর অপবিশ্বাস। নারী বইটি আমি লিখেছি মানুষের এক বড়ো অংশের ওপর থেকে পুরুষতান্ত্রিক সমস্ত নিষেধ তুলে নেয়ার জন্যে, নারীকে নিষিদ্ধ বস্তু থেকে মানুষের অধিকার দেয়ার জন্যে; আমাদের অন্ধকার অঞ্চলের সমস্ত প্রথার অবসান ঘটানোর জন্যে। নারী এখন এ-অঞ্চলে বিপন্ন; তার যে-সামান্য অধিকার কয়েক শতকে স্বীকার করা হয়েছে, তাও বাতিল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে। চারপাশে প্রতিক্রিয়াশীলতা আজ প্রবল; প্রতিক্রিয়াশীলতার প্রথম শিকার নারী। প্রতিক্রিয়াশীলেরা সমাজ দখল ক’রে প্রথমেই সমাজ থেকে বের ক’রে দেয় নারীকে, অর্থাৎ তার সব অধিকার বাতিল ক’রে ঘরে ঢুকিয়ে তাকে ক’রে তুলে পুরুষের দাসী ও ভোগ্যবস্তু। বাঙলাদেশে নারী মুক্তি পায় নি, তবে তাকে শক্ত শেকল পরানোর আয়োজন চলছে আজ। প্রতিটি প্রতিষ্ঠান কাজ ক’রে চলছে নারীর বিরুদ্ধে; এবং রয়েছে মধ্যযুগীয় মৌলবাদীরা, যারা নারীর দীক্ষিত শত্ৰু । আমাদের অঞ্চলের প্রগতিশীলেরাও প্রথাগত, তাদের ভেতরেও কুসংস্কারের অন্ত নেই; নারীবাদের কথা শুনলে তারাও মৌলবাদীদের মতো আচরণ করেন। তাদের প্রগতিশীলতা পুরুষপ্রাধান্য প্রতিষ্ঠার প্রগতিশীলতা, সেখান থেকে নারী নির্বাসিত । এ-বইটি প্রথা ও পুরুষতান্ত্রিক সভ্যতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। আমি চাই নারীপুরুষের সার্বিক সাম্য।
নারী যে-সাড়া জাগিয়েছে, তা অভূতপর্ব। তবে এটাই স্বাভাবিক। তরুণবাঙলা আজ প্রথা পেরিয়ে যেতে চায়। প্রথাভাঙার কোনো পদ্ধতিকে আমরা সুস্থ সজীব রাখতে পারি নি; এখন প্রথাভাঙার শ্রেষ্ঠ পদ্ধতি নারী । নারী সহজ সুখকর বই নয়, তবুও যে এর প্রথম সংস্করণ ও পুনর্মুদ্ৰণ অল্প সময়ে নিঃশেষিত হয়ে যায়, তার কারণ প্রথাভাঙার সময় এসে গেছে। বইটিতে আমাদের বদ্ধ সমাজের পাঠকেরা বোধ করেছেন মুক্তি : যে-বিষয়ে অপরাধবোধ, দ্বিধা ও কপটতার সাথে কথা বলা বাঙালির স্বভাব, সে-বিষয়ের সমস্ত দরোজা আমি খুলে দিয়েছি। নারী নামক নিষিদ্ধ ও রুদ্ধ গৃহটি সম্ভবত বাঙলা ভাষায় এই প্রথম সম্পূর্ণ খুলে দেয়া হলো। অনেক তরুণী আমাকে জানিয়েছে। এ-বই পড়েই তারা জেনেছে তাদের একটি শরীর আছে, শরীরে নানা প্রত্যঙ্গ রয়েছে। এ ছাড়া আর যা জেনেছে তা জানার কথা কখনো স্বপ্নেও ভাবে নি। এখন তাদের জন্মান্তর ঘটেছে। দ্বিতীয় সংস্করণে বইটির আয়তন বাড়লো, তবে যতোটা বাড়ানোর ইচ্ছে ছিলো ততোটা বাড়লো না : যুক্ত হলো দুটি নতুন পরিচ্ছেদ–নারীবাদী সাহিত্যতত্ত্ব ও সমালোচনা’, এবং নারীদের নারীরা ; নারীদের উপন্যাসে নারীভাবমূর্তি; আর ‘নির্ঘণ্ট’। প্রথম সংস্করণের মুদ্রণক্রটি সংশোধিত হলো, তবু কয়েকটি তুচ্ছ ত্রুটি চোখ এড়িয়ে রয়েই গেলো। বিভিন্ন পরিচ্ছেদে কিছুটা সংযোজনবর্জনও করা হয়েছে। ইচ্ছে ছিলো ‘মেরি ওলস্টোনক্র্যাফটু : অগ্নিশিখা ও অশ্রুবিন্দু’ পরিচ্ছেদটি বাড়ানোর; তাঁর অন্যান্য বই, বিশেষ করে, লেটার্স ব্রিটেন ডিউরিং এ শর্ট বেসিডেন্স ইন সুইডেন, নরওয়ে অ্যান্ড ডেনমার্ক সম্পর্কে আলোচনার; কিন্তু তা আর হলো না। শুধু এটুকু জানানো যেতে পারে যে এ-পত্ৰগুচ্ছের কাছে ঋণী রোম্যান্টিক কবিরা; আর কোলরিজের বিখ্যাত ‘কুবলা খান’ লেখা হয়েছিলো ওলস্টোনক্র্যাফটের পত্রগুচ্ছের ভাব ও কিছু শব্দ সরাসরি নকল ক’রে।
হুমায়ুন আজাদ