চার
অনুর মা এখন ফুলের বিছানায় শুয়ে আছে। শ্যামবাজারের মোড় থেকে অর্ক ফুল কিনে এনেছিল কিন্তু একটু আগে নুকু ঘোষ বিরাট একটা মালা পাঠিয়ে দিয়েছে। খাটিয়ার চারপায়ে ধুপ জ্বলছে। সারাদিন রোদে পুড়ে যদিও অনুর মায়ের মুখ কালো তবু এত সাদা ফুলে তাকে অন্যরকম দেখাচ্ছে। অর্ক আর বিলু গিয়েছিল ফুল আনতে, আসার আগে পাঞ্জাবীর দোকান থেকে রুটি আর কষা মাংস খেয়ে এসেছে। দারুণ খেতে। অর্ক এই প্রথমবার খেল। ব্যাপারটা ওরা চেপে গেছে অন্যদের কাছে। অর্ক দেখল, ক্যাশিয়ার হবার বেশ মজা আছে, চট করে কেউ হিসেব জিজ্ঞাসা করে না। ওরা যখন অনুর মাকে সাজাচ্ছিল তখন মাধবীলতা গলি থেকে বেরিয়ে এল। চারটের সময় টিউশনিতে যায় সে পাইকপাড়ার ইন্দ্র বিশ্বাস রোডে।
সারাদিন ছেলে ঘরে ফেরেনি। দুপুরের রান্না করা ভাত হাঁড়িতেই পড়ে আছে। অপেক্ষা করে করে অনেক বেলায় খেয়েছে মাধবীলতা। অনিমেষ বলেছিল, ‘মৃতদেহ ম্যানেজ করা খুব ঝামেলার ব্যাপার, আজকের দিনটা আর কিছু বলো না ওকে।’
মাধবীলতা অনিমেষের দিকে তাকিয়েছিল, ‘তোমার ছেলে তুমি বুঝবে, আমার কি!’
অনিমেষ এই রকম কথাবার্তা সহ্য করতে পারে না। এক ধরনের নিরাসক্তির আড়ালে তীব্র খোঁচা থাকে যা হজম করা মুশকিল। সে বলল, ‘ছেলে কিন্তু তোমার, তুমি অনিচ্ছা করলে ও আসতো না।’
মাধবীলতা চমকে মুখ ফেরাল। তারপর কিছুক্ষণ অনিমেষের দিকে তাকিয়ে রইল। অনিমেষের অস্বস্তি হল এবার। আঘাতটা দিতে যত আনন্দ হচ্ছিল দিয়ে দেবার পর ততই বিস্বাদ লাগল। হঠাৎ ওর মনে হল তার দিকে তাকিয়ে আছে বটে কিন্তু মাধবীলতা তাকে দেখছে না। ওর দৃষ্টি হঠাৎ শূন্য হয়ে গিয়েছে। অবশ্য খুব দ্রুত নিজেকে সামলে নিল মাধবীলতা। কিন্তু এ প্রসঙ্গে আর একটিও কথা বলল না।
অর্ক দুপুরে বাড়িতে খেতে যায়নি এ রকমটা এর আগে হয়নি। দুপুর থেকেই অর্ক এ নিয়ে অস্বস্তিতে ছিল। কিন্তু সঙ্গীরা কেউ যখন খেতে যাচ্ছে না তখন সে যায় কি করে! স্বাস্থ্যের কারণেই হোক কিংবা ক্লাস নাইনে পড়ছে বলেই ওরা ওকে দলে নিয়ে নিয়েছে। কিন্তু ওদের প্রত্যেকের বয়স ওর চেয়ে পাঁচ থেকে দশ বছর বেশী। খিদে পেয়েছে বলে বাড়িতে যাওয়া তাই প্রেস্টিজের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। শ্যামবাজার থেকে বিলুর সঙ্গে খেয়ে এসে শরীরটা ঠাণ্ডা হলেও মন হয়নি। এই নিয়ে মায়ের মুখোমুখি হতেই হবে অর্ক জানে। এইসময় সে শিবমন্দিরের পাশের রকে বসে মাধবীলতাকে বেরিয়ে আসতে দেখল। ফুল দিয়ে সাজাবার পর আবার ভিড়টা জমেছে। মাধবীলতা সেদিকে না তাকিয়ে ট্রাম রাস্তার দিকে চলে গেল।
মড়ার পাশে হরিপদ বসেছিল। অনুপমাও আর কাঁদছিল না। জ্ঞান ফেরার পর হরিপদ কারো সঙ্গে কথা বলছিল না। কিলা চেঁচিয়ে বলল, ‘চল বে, আর দেরি করে লাভ নেই।’
সঙ্গে সঙ্গে সাজসাজ পড়ে গেল। অর্ক ঠিক করেছিল এবার সে কাঁধ দেবে না। সকালবেলায় যথেষ্ট শিক্ষা হয়ে গিয়েছে। চারজনের কাঁধে অনুর মা ওপরে উঠতেই খুরকি শিরা ফুলিয়ে চিৎকার করল, ‘বল্ হরি আবে হরি বল্।’ সঙ্গে সঙ্গে সাড়া দিল অন্যান্যরা, ‘বল্ বল্ হরি বল্।’
কিলা এবার লাফিয়ে পড়ল সামনে। শরীরটাকে বেঁকিয়ে চুরিয়ে হাঁটু ভেঙ্গে চিৎকার করল, ‘হ্যারি হ্যারি বোল্ বল্, চল বে চল্ চল্।’ এই চিৎকার বল্লমের মত উড়ে যাচ্ছিল চারপাশে। ঈশ্বরপুকুর লেন দিয়ে ওরা যখন এই রকম ভঙ্গী নিয়ে শব্দ করতে করতে বের হচ্ছে তখন আশে পাশের বাড়ির সামনে ভিড় জমে গেছে। অর্ক পাশে পাশে হাঁটছিল। কিলা তাকে বলল, ‘লে বে, তুই স্লোগান দে।’ অর্ক একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘কি স্লোগান দেব?’
‘আরে ওই একটা ছাড়া তো অন্যকথা বলা যাবে না।’
দ্রুত হাঁটতে হচ্ছে বলে অর্ক প্রথমটায় কাঁপা গলায় বলল, ‘হরি বোল।’ কিন্তু বলেই বুঝল ঠিক হল না। ওই মড়া নিয়ে যাওয়ার স্পীডের সঙ্গে এইরকম করে বললে চলবে না। ওরা এখন ঠিক ট্রাম রাস্তার মাঝখান দিয়ে যাচ্ছে। ফলে পেছনের গাড়িগুলো হাঁটিহাঁটি করে আসছে। আর জি কর ব্রিজ থেকে নামবার সময় অর্ক খুঁজে পেল। দলের সামনে ছুটতে ছুটতে সে চেঁচাল, ‘বল্ হরি হরি বল্।’ একটা সুর এবং তালে শব্দচারটি উচ্চারিত হওয়ায় কিলা সেই ছন্দে কোমর এবং বুক দোলাতে লাগল। ক্রমশ সেটা সংক্রামিত হয়ে গেল পুরো দলটায়। এমন কি যে চারটে ছেলে কাঁধ দিয়েছিল তাদের একজন চেঁচিয়ে উঠল, ‘আবে গাণ্ডুরা, আমি নাচব না?’ খুরকি ন্যাড়াকে বলল, ‘যা বে,তুই নিজের মাকে কাঁদ দে, কোয়াকে ছেড়ে দে।’
ন্যাড়া খিঁচিয়ে উঠল, ‘আমি ছোট না? চারটে কাঁধ সমান হবে?’ ন্যাড়া কথা বলতে বলতে শরীর দোলাচ্ছিল অর্কের স্লোগানের ছন্দে। ততক্ষণে দলটা এসে গেছে শ্যামবাজারের মোড়ের কাছে। সুভাষ বোসের মূর্তির সামনে হঠাৎ কোয়ারা খাটিয়া নিচে নামিয়ে রেখে টুইস্ট শুরু করে দিল। সেই ভর বিকেলে পাঁচ রাস্তা ধেয়ে ছুটে আসা অজস্র গাড়ি বাধ্য হল দাঁড়িয়ে পড়তে। ফুটপাথে ভিড় জমে গেল। ট্রাফিক পুলিসগুলো দাঁত বের করে হাসতে লাগল ব্যাপারটা দেখে। পনের জন ছেলে উত্তাল নেচে যাচ্ছে মড়ার খাটিয়া নামিয়ে। তাদের ঠিক পেছনে একটি প্রৌঢ় খোঁচা দাড়ি নিয়ে সাদা চোখে তাকিয়ে। যেন সামনে কি হচ্ছে সে দেখতেই পাচ্ছে না। তার গা ঘেঁষে একটি যুবতী মেয়ে গায়ে শাড়ির আঁচল জড়িয়ে ডানদিকের হোর্ডিং-এর পোস্টার দেখছে। সেখানে মিঠুন এইরকম নাচের ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে। এর মধ্যে স্লোগানটা একটু পাল্টেছে। অর্কর মুখ থেকে বিলুর মুখে পৌঁছে গিয়ে সেটা তীব্র স্বরে উচ্চারিত হচ্ছে, ‘হ্যারি বোল্ ডিস্কো বোল্ হ্যারি কিস্কো। পনেরটা শরীর এখন নেতাজীর সামনে উত্তাল, সেগুলো অবিশ্বাস্য দক্ষতায় ভাঙ্গছে, বুক এবং শুকনো নিতম্ব চরকির মত ঘুরছে।
এই সময় একটা মোটর বাইক শব্দ করে এসে থামল সামনে। বৃহৎ চেহারার এক সার্জেন্ট চেঁচিয়ে উঠল, ‘এই শালা শুয়ারের বাচ্চারা, মড়া তোল।’ চকিতেই অনুর মা আবার কাঁধে উঠে গেল। যদিও নৃত্য এবং স্লোগান থামল না তবু সেই গতিতেই দলটা মোড় পেরিয়ে ভূপেন বোস অ্যাভিন্যুতে ঢুকে গেল। অবিরত গাড়ির হর্ন বাজছে পেছনে, সার্জেন্ট ট্রাফিকের জট ছাড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। পাতাল রেলের খোঁড়াখুঁড়িতে ভূপেন বোস অ্যাভিন্যুকানা হয়েছিল, এদের মিছিল সেখানে ঢুকে পড়ায় ট্রাফিক পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেল। একটা অ্যাম্বুলেন্স নড়তে পারছিল না এক চুল। মুখ বের করে ড্রাইভার চেঁচিয়ে উঠল, ‘ও দাদারা একটু ছেড়ে দিন, স্ট্রোক কেস নিয়ে যাচ্ছি।’
কিলা বলল, ‘নিয়ে যেতে হবে না, খাটিয়ায় শুইয়ে দে।’
নিমতলায় যখন ওরা পৌছাল তখন সন্ধ্যে পেরিয়ে গেছে। দুটো পা ভারী হয়ে উঠেছিল অর্কর, গলা প্রায় ভেঙ্গে গেছে। মড়া নামিয়ে রাখতেই কটু গন্ধ নাকে এল। নিমতলায় এই প্রথম আসা ওর। বিলু বলল, ‘আবে অক্ক, চল দেখে আসি আমরা ক’লম্বর!’
‘নম্বর?’
তুই শালা বিয়ে করতে এসেছিস নাকি যে এলি আর ঢুকিয়ে দেবে? চল বে!’
শ্মশানের ভেতরে ঢুকল ওরা। দাউ দাউ করে চিতা জ্বলছে দুটো। তাদের ঘিরে শ্মশানযাত্রীরা বিহুল চোখে তাকিয়ে। অর্ক দুটো পা দেখতে পেল, চিতা থেকে বেরিয়ে আছে, তখনও পোড়েনি। ওর শরীরটা গুলিয়ে উঠল। কটু গন্ধটা যে মড়া পোড়ার তা বুঝতে অসুবিধে হল না আর। ইলেকট্রিক চুল্লির ওখানে বেশ ভিড়। মড়া যেমনভাবে এসেছে তেমনভাবে সুযোগ পাবে পুড়তে। বিলু বলল, ‘তাড়াতাড়ি আমাদের নাম লেখা নইলে মড়া পচবে।’
ভিড়ের মধ্যে অর্ক এগোচ্ছিল। এই সময় কানে এল, ‘তাড়াতাড়ি পোড়াবেন?’ সে মুখ ফিরিয়ে দেখল একটা শুড্যা চোরের মত তাকে দেখছে। এ শালা নির্ঘাৎ দালাল। সে হাত নাড়ল, ‘ফোট্।’
ঠিক তক্ষুনি একজন ভদ্রলোক লোকটাকে ডাকল, ‘এই যে ভাই, হবে?’
‘আপনাকে বলেচি তো একস্ট্রা তিরিশ ছাড়তে হবে। এসব লাইনে অনেক খরচ, ভাগ বাঁটোয়ারা আছে।’ লোকটা রোয়াবের সঙ্গে বলল।
‘ওটা কুড়ি কর।’
‘দূর মাইরি, আপনি ভদ্রলোকের ছেলে?’
‘মানে?’
‘নিজের বাপকে পোড়াবেন তবু দর কষাকষি করছেন। কুড়ি আর তিরিশে পার্থক্যটা কি? আপনার চান্স আসতে আরো চার ঘণ্টা লেগে যাবে। আর এর মধ্যে যদি কোন এম এল এ-র রেফারেন্স এসে যায় তো হয়ে গেল! রাজি হলে আধঘণ্টার মধ্যে তুলে দেব।’ দালালটা বলল।
‘গোলমাল হবে না তো?’
‘সে রিস্ক আমার।’ তারপর গলা নামিয়ে বলল, ‘দুটো জেনুইনের পর একটা ফলস ঢোকানো আছে আপনাদের জন্যে।’
‘ঠিক আছে।’
‘মালটা ছাড়ুন তাহলে।’
‘আগে দিতে হবে?’
‘হ্যাঁ, তাই নিয়ম।’
অর্ক আর দাঁড়াল না। ভিড় ঠেলে টেবিলের সামনে পৌঁছাতে অসুবিধে হচ্ছিল। সে কনুই দিয়ে ধাক্কা মেরে চিৎকার করল, ‘সোরে যান মোশাই।’ এর মধ্যেই সে জেনেছে যে এইভাবে কথা বললে, দারুণ কাজ হয়। কিলা কিংবা খুরকির মত তার উচ্চারণ সঠিক হয় না বটে তবু কাজ দেয়। এখানেও তাই হল। খুব হেক্কড় নিয়ে সে জিজ্ঞাসা করল, ‘অনেকক্ষণ বসে আছি, কত দেরি হবে?’
এখানকার লোকগুলো বোধহয় ঘাটা-পড়া, এইসব কথায় অভ্যস্ত। মুখ তুলে দেখল না পর্যন্ত, বলল, ‘নাম লিখিয়েছেন?’
‘কিসের নাম?’
‘আট ঘণ্টার আগে হবে না। ফাস্ট কাম ফাস্ট সার্ভ।’
হঠাৎ অর্কর মনে পড়ল ব্রজমাধব পালের কথা। সে বলল, ‘খাতা খুলে দেখুন ব্রজবাবু নাম লিখিয়ে গিয়েছে।’
‘কে ব্রজবাবু? ওসব নাম বললে কোন কাজ হবে না। পাবলিক এতক্ষণ কষ্ট করে দাঁড়িয়ে আছে। আর এখানে ব্রজবাবু।’ বলতে বলতেই যেন কিছু মনে পড়ে গেছে এমন ভঙ্গীতে চোখ তুলল লোকটা, ‘কি বললেন নামটা!’
‘ব্রজমাধব পাল!’
দ্রুত খাতাটা টেনে নিয়ে লোকটা নামগুলোয় চোখ বুলিয়ে বলল, ‘ডেডবডির নাম কি?’
‘অন্নপূর্ণা।’
এবার লোকটা খিঁচিয়ে উঠল, ‘এতক্ষণ কোথায় ছিলেন? ডেকে ডেকে গলা ভেঙ্গে গেল কেউ সাড়া দিল না। আপনার পরে এসে বডি উঠে গেছে আর—। যাক, এর পরে আপনারা, বড়ি নিয়ে আসুন আর সার্টিফিকেটটা দিন।’
হাসপাতালের কাগজটা হাতে তুলে দিয়ে অর্ক বলল, ‘টাকা পয়সা তো সব দিয়ে দেওয়া হয়েছে, না?’
‘হ্যাঁ। সে জ্ঞান দেখছি টনটনে।’
অর্ক বেরিয়ে আসছিল এমন সময় আর একটা লোক চেঁচিয়ে উঠল, ‘কি ব্যাপার মশাই, আমরা কি আঙ্গুল চুষতে এসেছি?’
খাতা-সামনে লোকটা বলল, ‘মানে?’
‘এইমাত্র শালা ওদের বডি নামাতে দেখলাম আর আপনি আগে তুলে দিচ্ছেন?’
‘আপনি কখন বডি নামাতে দেখেছেন জানি না কিন্তু আমার খাতায় তিন ঘণ্টা আগে নাম উঠে গেছে। আমি সেটাই দেখব।’
‘তাহলে তো পেসেন্ট হাসপাতালে গেলেই এখানে নাম লেখাতে হবে।’
‘তাই করবেন।’
‘ঠিক আছে, দেখি ওই মড়া কি করে পোড়ে! এ্যাই পঞ্চু!’ লোকটা চেঁচিয়ে ডাকতেই একটা মাস্তান-দেখতে ছেলে এগিয়ে এল, ‘কি দাদা!’ লোকটা তাকে ফিসফিসিয়ে কিছু বলতেই মাস্তানটা এগিয়ে এল অর্কর সামনে, ‘আবে, আগে এদের বডি পুড়বে তারপর অন্য কথা। আমার নাম পঞ্চু।’
‘কে পঞ্চ!’ অর্কর মাথায় আগুন জ্বলে উঠল।
‘তোর বাপ।’
সঙ্গে সঙ্গে হাত চালালো অর্ক। ডান হাতের পাঞ্জার পাশ দিয়ে তীব্র আঘাত করল পঞ্চুর চোয়ালে। কিছুটা হড়কে গিয়ে ঝট করে ছুরি বের করল পঞ্চু। অর্ক সেটা দেখতে পেয়েই দৌড়াতে শুরু করল সামনে। বিকট আওয়াজ করে পঞ্চু পেছনে আসছে। মুহূর্তেই ওর দলের ছেলেরা হ্যা হ্যা করে যোগ দিল ওর সঙ্গে।
অনুর মায়ের শরীরটার কাছে পৌঁছেই অর্ক চেঁচিয়ে উঠল, ‘কিলা, শালারা আসছে!’
ওরা বসেছিল। ডাকটা শুনেই ড়াক করে উঠে দাঁড়াল। দলটাকে দেখে থমকে দাঁড়াল পঞ্চুরা। শুধু পঞ্চু চেঁচাল, ‘আবে, এগিয়ে আয়, কোন বাপ তোকে বাঁচায় দেখি!’
খুরকির হাতে খুর এসে গিয়েছে এর মধ্যে। সে এক পা এগিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘পঞ্চু না?’
‘আবে খুরকি!’ পঞ্চুর গলা পাল্টে গেল।
‘র্যালা নিচ্ছিস কেন বে?’ খুরকি খুরটা নাচাচ্ছিল।
‘আরে ওস্তাদ, তোমার পার্টি নাকি ও?’
‘হ্যাঁ।’
‘শালা আমার গায়ে হাত চালিয়েছে।’
খুরকি টান টান হয়ে দাঁড়িয়ে। কিলা বলল, ‘বেশ করেছে।’ পঞ্চু বলল, ‘না ওস্তাদ, এর বদলা আমি নেব। নিমতলায় এসে আমার গায়ে হাত তুলে ফিরে যাবে এমন মাল আজও পয়দা হয়নি।’
দুটো হাত দুপাশে ছড়িয়ে বুক চিতিয়ে খুরকি বলল, ‘লে শালা বদলা নে। দেখি কোন খানকির ছেলে এদিকে আসে।’
পঞ্চু একমুহূর্ত ভাবল। তারপর বলল, ‘কিন্তু বিচারটা ঠিক হল? তুমি মাইরি লাইনের ওস্তাদ তুমি ঠিক বিচার করলে?’
ওদের মধ্যে হাত দশেকের ব্যবধান। অন্যান্য শ্মশানযাত্রীরা নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা দেখছে। খুরকি পঞ্চুকেই জিজ্ঞাসা করল, ‘কেন হাত তুলেছিল?’
পঞ্চু জবাব দিল, ‘ওই বডি তোমাদের তা জানতাম না। আমাদের বডি আগে এসেছে আর ও শালা ম্যানেজ করে প্রথমে পোড়াতে যাচ্ছে দেখে বলতেই হাত তুলল।’
অর্ক উত্তেজিত ছিল। পঞ্চু তাড়া করার সময় সে সত্যি ভয় পেয়েছিল। এখন খুরকির প্রতাপ দেখে সে অনেকটা সাহস ফেরত পেয়েছিল। চিৎকার করে বলল, ‘মিথ্যে কথা। আমি ওর নাম জিজ্ঞাসা করতে বলেছিল ও নাকি আমার বাপ।’
‘বলেছিলি?’ খুরকি জিজ্ঞাসা করল।
‘এতো আমরা বলেই থাকি! তাই বলে হাত তুলবে?’
‘ঠিক করেছে, শোধবোধ হয়ে গিয়েছে। তুই মিটমাট করবি কিনা সেটাই বল?’ খুরকির মুখ বিকৃত হল।
পঞ্চু সেদিকে তাকিয়ে যেন হাল ছাড়ল, ‘ঠিক আছে ওস্তাদ। তোমার কথায় আমি ছেড়ে দিলাম। কিন্তু আর কোনদিন যদি পাই তো দেখিয়ে দেব এ তোমায় বলে রাখছি।’
ওরা চলে গেলে খুরকি বলল, ‘হারামি!’
কিলা বলল, ‘ঝাড়লি না কেন?’
খুরকি মাথা নাড়ল, ‘শালার সঙ্গে জেলে ছিলাম না?’
এইবার অর্ক বলল, ‘চল, বডি নিয়ে চল।’
সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে গেল সবাই। হই হই করে অনুর মাকে ইলেকট্রিক চুল্লির কাছে নিয়ে যাওয়া হল। কিলা জিজ্ঞাসা করল, ‘ব্রজটা টাকা দিয়েছে এখানে?’
অর্ক মাথা নাড়ল, হ্যাঁ।
‘তোর কাছে মাল আছে?’
‘গুণে দেখিনি।’
‘দ্যাখ বে।’
অর্ক পকেট থেকে টাকা বের করে বলল একশ বিশ। কিলা হাত নাড়ল, ‘যা বাব্বা, তিরিশ টাকা হাপিস!’
বিলু বলল, ‘এ শালা কি বে! ফুল কিনতে হল, ফুলের দাম জানিস? কোনদিন কিনেছিস?’
কিলা বিহ্বল চোখে অনুর মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ফুল শালা এত দামী!’
চুল্লিতে ঢোকাবার সময় অনুপমা ছাড়া আর কেউ কাঁদল না। হরিপদ মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। অর্ক দেখল কোয়া অনুর কাঁধে হাত রেখে খুব সান্ত্বনা দিচ্ছে। কোয়ার দাঁড়ানোর ভঙ্গীটা খুব খারাপ। সে চেঁচিয়ে ডাকল, ‘অ্যাই কোয়া?’
সেইভাবেই দাঁড়িয়ে কোয়া বলল, ‘কি বে?’
‘ওর লাভার আছে।’
কথাটা কানে যাওয়া মাত্র অনুপমা কোয়ার শরীরের কাছ থেকে ছিটকে সরে গিয়ে মায়ের জন্যে কাঁদতে লাগল। কোয়া এগিয়ে এল অর্কর কাছে, ‘তুই মাইরি কথাটা বলার আর সময় পেলি না। বেশ লাইন হচ্ছিল।’
এই সময় বিলু বলল, ‘আর তো কিছু করার নেই। অ্যাই ন্যাড়া, তুই তোর বাপদের নিয়ে ফিরে যাস। অক্ক, তুই ওকে দশটা টাকা দে।’
‘কেন?’
‘ডোমরা চাইতে পারে।’
অর্ক পকেট থেকে দশটা টাকা বের করে এক মুহূর্ত কি ভেবে ন্যাড়াকে এড়িয়ে হরিপদর সামনে গিয়ে দাঁড়াল। হরিপদ পাথরের মূর্তির মত বসে আছে। তার উপস্থিতিতেও কোন সাড় নেই। অর্ক বুঝল হরিপদকে টাকা দিলে কাজ হবে না। ন্যাড়া পেছন থেকে বলল, ‘আমাকে টাকা দিতে বলল, আমাকেই দাও।’
অর্ক হাত নাড়ল, ‘ফোট!’ তারপর একা দাঁড়ানো অনুর সামনে গেল, ‘এই টাকাটা নাও।’
অনুর মুখ ফোলা, চোখ লাল। অর্ককে দেখতে পেয়ে যেন স্বস্তি পেল। বলল, ‘কেন?’
‘আমরা যাচ্ছি। যদি কোন দরকার লাগে তুমি খরচ করবে, ন্যাড়াকে দিও না।’ টাকাটা অনুর হাতে দিয়ে ঘুরে দাঁড়াতেই অর্কর চোখে পড়ল দূরে একটা লোক কাউকে খুঁজতে খুঁজতে এদিকে আসতেই ওদের দেখতে পেয়ে থমকে দাঁড়াল। এখন এমন ভান করে দাঁড়িয়ে আছে যেন এদিকে কোন মনোযোগ নেই ওর। লোকটাকে চিনতে পারল সে। অনুর লাভার! ঈশ্বরপুকুরে থাকে না তবে কাগজ দেয়। সে বলল, ‘আর তোমার চিন্তা নেই, পেছন দিকে তাকিয়ে দ্যাখো!’
অনু একটু অবাক হয়ে পেছন ফিরে দেখল। তারপর লোকটাকে চিনতে পেতেই আবার সজোরে কেঁদে উঠল। অর্ক জিজ্ঞাসা করল, ‘আরে, আবার কি হল?’
‘ওকে চলে যেতে বল, ও যেন না আসে।’ অনু কাঁদছিল।
‘কেন?’ কিছুই বুঝতে পারছিল না অর্ক।
‘মা মরার আগে ওকে চায়নি, ওর জন্যেই মা মরেছে!’ অনুর কান্না থামছিল না।
অর্কর মেজাজ গরম হয়ে গেল। সে বলল, ‘ফোট তো! মরা মানুষের কথার কোন দাম আছে নাকি! আজব চিজ মাইরি।’ বলে হন হন করে এগিয়ে গেল লোকটার দিকে। অনুকে কাঁদতে শুনে মুখ ফিরিয়েছিল লোকটা এবার অর্ককে দেখে চোখ নামাল। অর্ক বলল, ‘আমরা কাটছি, আপনি কেসটা টেক আপ করুন।’
বিলু বোধহয় পুরো ব্যাপারটা দেখেছিল। অর্ক কাছে আসতে আফসোসের গলায় বলল, ‘যাঃ শালা! আগে জানলে দশ টাকা ছাড়তাম না!’
‘কেন?’ অর্ক হতভম্ব।
‘ন্যাড়ার জামাইবাবু খরচা করবে, আমরা কে বে? নারে কোয়া?’
কোয়া জিজ্ঞাসা করল, ‘শালাকে ঝাড়ব?’
অর্ক চেঁচিয়ে উঠল, ‘না!’
কোয়া চমকে গেল, ‘কি বে, চেঁচাচ্ছিস কেন?’
অর্ক কিছু বলল না। সে নিজেই বুঝতে পারছিল না কেন এমন করে চেঁচিয়ে উঠল। এই সময় কিলা ডাকতেই ওরা ওইদিকে এগিয়ে গেল। এর মধ্যে দলটা ছোট হয়েছে। বোধহয় খুরকি আর কিলা কিছু ফালতু মালকে ফুটিয়ে দিয়েছে। তারা ফিরে গিয়েছে ঈশ্বরপুকুরে। অর্ক দেখল শ্মশান ছেড়ে ওরা নদীর ধার দিয়ে বাগবাজারের দিকে এগোচ্ছে। ওর দুটো পায়ে বেশ ব্যথা করছিল এবং খিদেও পেয়ে গেছে এতটা পরিশ্রমের ফলে। সে বলল, ‘বাসে ওঠ্, আর হাঁটতে পারছি না।’
‘বাস কি বে, ট্যাক্সি বল!’ কোয়া উত্তর দিল। সঙ্গে সঙ্গে অর্কর মনে পড়ল ওর পকেটে এখনও প্রচুর টাকা অতএব ট্যাক্সিতে চড়া যেতে পারে।
কথাটা শুনে খুরকি কিলাকে বলল, ‘এ শালারা কি ধুর মাইরি! নিমতলায় এসেও পেসাদ না নিয়ে ফিরে যাবে!’ সে কিলার কাঁধে হাত রেখে হাঁটছিল। কিলা বলল, ‘আমাদের অক্কবাবু বড় ভাল ছেলে। ওর মা তো মাস্টারনি, তাই!’
অর্ক পেছন থেকে কথাটা শুনে চোখ কুঁচকে তাকাল। মাকে নিয়ে কোন রসিকতা করছে নাকি? কিন্তু খুরকি কথাটার জবাব না দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে বলল, ‘আবে অক্ক, তুই ভদ্রলোক?’
অর্ক বলল, ‘তুই কি?’
‘আমি ফালতু আদমি, খুর চালাই। তবে এক নম্বর, ভদ্রলোকেরা দু’ নম্বর হয়। তুই?’
‘জানি না।’
‘জানতে হবে। নইলে না ঘাটকা না ঘরকা থেকে যাবি। যেই পঞ্চু তাড়া করবে অমনি লেজ গুটিয়ে পালাবি!’
পঞ্চুর নামটা শুনতে পাওয়া মাত্র ভেতরে ভেতরে গুটিয়ে গেল অর্ক। পঞ্চুর গালে সে হাত চালিয়েছিল ঠিক কিন্তু ও মাল বের করতেই তার মনে হয়েছিল পালানো ছাড়া বাঁচবার পথ নেই। কেন? কেন সে রুখে দাঁড়াল না। পঞ্চু তো খুরকির মত রোগা, গায়ের জোরে তার সঙ্গে পারতো না। তবে? তবু অপমানটা হজম করতে কষ্ট হচ্ছিল ওর, ‘তোরা পালাস না? সেবার হেমির পার্টি পাড়ায় চার্জ করেছিল যখন তখন তোরা হাওয়া হয়েছিলি না?’
খুরকি বলল, ‘সে ওদের কাছে যন্তর ছিল, দলে ভারী ছিল তাই।’
অর্ক হাসল, ‘সে কথাই বলছি। সব সময় রুখে দাঁড়ালে বিপদে পড়তে হয়, মোকা দেখে লড়, তাই না বিলু?’
বিলু বলল, ‘এসে গেছি।’
এদিকের রাস্তায় আলো জ্বলে না বোধহয়। কিছু হোগলার ছাউনি আছে নদীর গা ঘেঁষে। খুরকি একটা লোককে ডাকতেই সে অন্ধকার ফুঁড়ে উঠে এল। তার সঙ্গে নিচু গলায় কথা বলে ওরা রাস্তা পেরিয়ে একটা গলির মুখে চলে এল। এখন রেডিওতে নাটক হচ্ছে। আশে-পাশের বাড়িগুলোয় আলো জ্বলছে না। বোধহয় লোডশেডিং। অর্ক দেখল চাঁদ উঠেছে। এ এমন চাঁদ যার কোন জ্যোৎস্না নেই। মোক্ষবুড়ির বুকের মত। কেউ দুবার তাকায় না।
ভাঁড়ে ভাঁড়ে মাংস আর শাল পাতায় রুটি এসে গেল। সেই লোকটাই নিয়ে আসছিল। খুরকি বলল, ‘অক্ক, ওকে চব্বিশ টাকা দিয়ে দে।’
কিলা বলল, ‘চব্বিশ কেন রে?’
‘আটজনের রুটি-মাংস, ওই টাকায় তোর নাং দেবে?’ লোকটা দাঁড়িয়েছিল। আবছা আলোয় অর্ক দেখল লিকলিকে লোকটা মড়ার মত চোখে তাকিয়ে আছে। সে তাড়াতাড়ি টাকাটা দিয়ে দিতেই লোকটা অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। অর্ক বলল, ‘তোদের মাইরি যা টেস্ট, যা টাকা ছিল তাতে ভাল রেস্টুরেন্টে খেতে পারতাম।’
ওরা রকে বসে খাচ্ছিল। কথাটা শুনে কিলা খিক-খিক করে একটু হাসল। মাংসটা বেঁধেছে ভাল তবে বড্ড ছিবড়ে। খাওয়া শেষ হতেই খুরকি সিটি মারল। তারপর বলল, ‘অক্ক, দশটা টাকা দে।’
‘আবার কি?’
‘মধু খাব বে, নইলে এখানে আসে কেউ। মাল!’
টাকাটা হাত বদল হল। তারপরেই একটা স্ত্রীলোক চারটে গ্লাস আর বোতল নিয়ে এল। অর্ক দেখছিল। খাওয়ার পর হাত ধোওয়া হয়নি। এই জিনিস ওদের খেতে দেখেছে সে অনেকবার। তিন নম্বরের সামনে শিবমন্দিরের পেছনে বসে এটা নিত্য খাওয়া হয়। সে সঙ্গে থেকেছে কিন্তু কোনদিন খায়নি। কেন খায়নি সেটা ভাবা বৃথা। টপাটপ মেরে দিচ্ছিল ওরা। চারজন খেয়ে গ্লাসগুলো অন্য চারজনের হাতে তুলে দিচ্ছিল।
বিলু বলল, ‘তুই তো কখনও খাসনি, আজ টেস্ট কর।’
অর্ক হাসল, ‘মাতাল হয়ে যাব না তো?’
‘না বে। আমরা আছি কি করতে?’
অন্ধকারে ঢোক গিলল অর্ক। তারপর উৎকট গন্ধযুক্ত তরল পদার্থ গলায় ঢেলে দিল। বুক জ্বলছে, গা গোলাচ্ছে। পিচ করে এক দলা থুতু ফেলল সে। বিলু হাসল, ‘দ্যাখ মাইরি খুরকি, অক্কর মুখটা দ্যাখ!’
দাঁতে দাঁত চেপে অর্ক বলল, ‘আর এক গ্লাস দে।’
Interesting !