অথ দুর্নীতি-কথা
আমি জানি, এ-কথা বললে আমাকে আবারও লোকে সন্দেহ করবে। আমার ভাবনা নিয়ে সন্দেহ, চরিত্র নিয়ে সন্দেহ, এমনকী আমার স্বাভাবিক চিন্তার জগৎ নিয়ে সন্দেহ। আমি এতকাল যা দেখেছি–অধিকাংশ মানুষ চান–আমাদের এই পৃথিবীর মানুষ আরও সৎ হোক, আরও ভালো হোক, কোনো মিথ্যাচার যেন মানুষকে ক্লিন্ন না করে, লোভ, হিংসা, মাৎসর্য, পরশ্রীকাতরতা যেন আমাদের গ্রাস না করে। হা! বাঁচার জন্য এইরকম একটা আদর্শ পরিবেশ আমরা চাই বটে, কিন্তু কোনোদিন পাই না। বাজারে গেলেই বৃদ্ধ বলেন–আরে মশাই! কালে কালে কী হল! চুরি, খুন, রাহাজানি, ধর্ষণ, হরণ ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। এবারে মশাই! চলে যেতে পারলেই হয়। আমি প্রথম প্রথম ঠাট্টা করে বলতাম এগুলো না। থাকলে কতকগুলো সৎ লোকের কত ক্ষতি হয়ে যেত বলুন তো। এই যে যত খবরের কাগজওয়ালারা, তারা যদি হরিনাম-সংকীর্তন, বাঙালির স্বাস্থ্যচর্চা এবং ডাবল-টি-ও’র কর্মসমিতির কার্যবিবরণ দিত, তাহলে একান্ত বৈষ্ণব, স্বাস্থ্যবান পুরুষ এবং শিল্পপতিরা ছাড়া কয়জন সাধারণ মানুষ খবরের কাগজ পড়ত! এতগুলো টিভি চ্যানেলের কী হাল হত? পাড়ার আড্ডাখানাগুলোর গুষ্টিসুখ কোথায় যেত? বাসে-ট্রেনে লোকে কী আলোচনা করত? এইসব সাধারণ সৎ মানুষদের দৈনন্দিন জীবন কতটা পানসে হয়ে যেত ভাবতে পারেন?
আমার ঠাট্টা শুনে বৃদ্ধ মানুষটি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে আমাকে নিতান্ত সমাজবোধহীন অল্পসত্ত্ব ব্যক্তি হিসেবে উপেক্ষা করে চলে গেছেন। তবু আমি বৃদ্ধকে বলিনি যে, আপনি কেন ওই ডাকাতি, ধর্ষণ এবং হরণের ঘটনাগুলি পড়েছেন। সেদিনের কাগজে শিক্ষামন্ত্রীর শিক্ষানীতি নিয়ে আলোচনা ছিল, স্বাস্থ্য সম্বন্ধে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সাফাই-কাহিনি ছিল। সে সব ছেড়ে আপনি কিনা….। বৃদ্ধকে এ কথাও বলিনি যে, আপনার আমলে কী ছিল মশাই! সকলে সাধু ছিলেন, ধর্ষণ-হরণ হত না, সকলে সত্য কথা বলত, আর সরকারি অফিসে ঘুষ বলে কিছু ছিল না? কর্পোরেশনের লোকেরা বিনা কোনো ইয়েতে বাড়ির প্ল্যান স্যাংশন করে দিত?
এই এতটুকু মুখপাতের পরেই আগে যা বলেছিলাম–আমার ভাবনা, চরিত্র এবং স্বাভাবিকতা নিয়ে সন্দেহ উঠবে। তবে কি আমি খুন-জখম, হরণ-ধর্ষণের ঘটনাগুলিকে উৎসাহ জোগাচ্ছি, নাকি এইসব খবরই আমার ভালো লাগে। যদি আমাকে সত্য কথা বলতে বলেন এবং যদি আপনারাও সত্য কথা বলেন, তাহলে নিশ্চয় বলব–এগুলিতে আমার-আপনার উৎসাহ না থাকলেও এইসব ঘটনাই আমরা পড়ি, দেখি এবং চর্চা করি। এগুলির মাধ্যমে মানুষের কোন প্রবৃত্তি তুষ্ট হয়, তা মনস্তাত্ত্বিকেরা জানেন, আমি বলব না। সঙ্গে সঙ্গে এটাও জানাব যে, এগুলি আজকের কোনো ‘ফেনোমেনন’ নয়, এগুলি চিরকাল আছে, ছিল এবং থাকবে। আমি এ কথাও বলে থাকি যে, ভগবান ব্রহ্ম শুধু কতকগুলি দেবতা এবং ঋষি সৃষ্টিকরেই ক্ষান্ত হননি, তিনি অসুর, রাক্ষস, সাপ-শকুনও সৃষ্টি করেছিলেন, আর মানুষ সৃষ্টির মধ্যেই তার সবচেয়ে বড়ো মুনশিয়ানা। মানুষের মধ্যে দেবতা-ঋষি, অসুর-রাক্ষস, সাপ-শকুন সকলের প্রতিচ্ছায়া আছে। আর মৎস্যপুরাণের সেই বিখ্যাত পৌরাণিক ঘটনাটা ভুলে যাবেন না। প্রজাপতি ব্রহ্মা তার মানসপুত্রকে সন্তান সৃষ্টি করতে বললে তিনি যোগবলে কতকগুলি জরামরণহীন অমর্ত্য পুরুষ সৃষ্টি করলেন। ব্রহ্মা কিন্তু এই সৃষ্টিকর্মে এতটুকু খুশি হলেন না। বামদেবকে এই ধরনের সৃষ্টি করতে নিষেধ করে রসিক ঠাকুর ব্রহ্মা বললেন-দেখ বাছা! জরা-মরণহীন এক সম্পূর্ণ শুদ্ধা সৃষ্টি কখনও খুব ভালো হতে পারে না–নৈবংবিধা ভবেৎ সৃষ্টির্জরামরণবর্জিত। পৃথিবীর যাবতীয় শুভ এবং কল্যাণকর বস্তু দিয়ে কখনও এই বিশাল সৃষ্টিকর্মের মাহাত্ম্য তৈরি হতে পারে না। জগতে ভালো থাকবে এবং তার পাশাপাশি মন্দও থাকবে–এই হল সৃষ্টির রহস্য।
সাধে কি আর সকল দেবতাকে ছেড়ে সর্বকালের এই পিতামহপ্রতিম মানুষটিকে সৃষ্টিকার্যের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। অত্যন্ত বাস্তববোধ অথচ হৃদয়ে মহাকবিত্ব না থাকলে ব্ৰহ্ম অতবড়ো দামি কথাটা বলতে পারতেন না। সত্যিই তো, এই জগতে যদি একটা লোকও মিথ্যা না বলত, মিথ্যাচার না করত, অন্যায় না করত, প্রত্যেকেই সৎ, সাধু, মহৎ এবং বদান্য হয়ে বসে থাকত তাহলে এই জগতের কোনো বৈচিত্র্য থাকত না, বিশেষত্বও থাকত না। সম্পূর্ণ জগৎটা সততা এবং সাধুতার গড্ডলিকায় এমন স্থির, জড় এবং নিষ্প্রাণ হয়ে উঠত যে, সে জগৎ রসিক-ভাবুক-শিল্পীজনের বাসযোগ্য হত না। পিতামহ ব্রহ্মার আশয় যদি ঠিক-ঠিক বুঝে থাকি, তাহলে বুঝতে হবে সবকিছুরই প্রয়োজন আছে–ভালো-মন্দ, সাদা-কালো, সাধু-অসাধু-সকলেরই প্রয়োজন আছে–ভালো এবং সৎকে বোঝার জন্য মন্দ এবং অসতের প্রয়োজন আছে। আর যাঁরা বলেন, আগে এমন ছিল না, এখনই যত খারাপ হয়েছে, তাদের বলি–সব কালেই খারাপ ছিল, মন্দ ছিল, অসাধুতা ছিল এবং সেগুলি কাটিয়ে ওঠার রাজনৈতিক এবং সামাজিক সংগ্রাম চিরটা কাল চলেছে এবং এখনও তা চলছে, পরেও তাই চলবে।
আজকে যে বিষয় নিয়ে এই প্রবন্ধ লিখতে বসেছি, তার ইংরেজি প্রতিশব্দটা বেশ জুতসই বটে, কিন্তু বাংলা বা সংস্কৃতে খুব ভালো প্রতিশব্দ নেই। কথাটা খুব বলি আমরা–করাপশন’। করাপশনে’ দেশ ভরে গেছে। করাপশন’ কথাটার একটা সার্বিক ব্যাপ্তি আছে–এই ধরুন, সরকারি অফিসার ঘুষ খাচ্ছে, কিংবা মন্ত্রী-আমলা নিজের আখের গোছাচ্ছেন, বিদ্যালয়ের শিক্ষক ফাঁকি দিচ্ছেন–এ সবই কিন্তু করাপশনের আওতায় পড়বে। এমনকী সক্রেটিস, বুদ্ধ অথবা চৈতন্যের মতো–এমনকী এতবড়ো মানুষ না হলেও নিদেনপক্ষে যদি রামমোহন, বিদ্যাসাগর বা ডিরোজিওর মতো সংস্কারক মানুষ যদি স্বসময়ের যুবা পুরুষদের নিজস্ব বৈপ্লবিক ভাবনা-চিন্তায় অনুপ্রাণিত করে থাকেন, তবে সেটাও কিন্তু যুবসমাজকে করাপ্ট’ করার ভাবনা বলে চিহ্নিত হয়েছে। সংস্কৃত বা বাংলায় এই শব্দের কী মানে করবেন–অসাধুতা? অন্যায় আচরণ? অধর্ম? অথবা এগুলো সবই।
দেখুন, চুরি-ডাকাতি অথবা খুন-রাহাজানিকে কিন্তু ‘করাপশন’ বলে না, সেগুলো ‘ক্রাইম’, কিন্তু একজন সরকারি অফিসার চুরি করলে, অথবা ব্যবসার প্রয়োজনে বা আত্মোন্নতির প্রয়োজনে একজন সমৃদ্ধ মানুষ যদি ভাড়াটে গুন্ডা দিয়ে কাউকে খুন করায় অথবা রাজনৈতিক ভোট-সিদ্ধির জন্য একজন সবলে ধর্ষিতা নারীকে যদি দুশ্চরিত্রার অপবাদ দেওয়া হয়, সেগুলি কিন্তু করাপশন’। মূলত এগুলি ক্রাইম’ হলেও বিশদর্থে এগুলি করাপশনের আওতায় পড়ে। তার মানে শেষ পর্যন্ত এই দাঁড়াল যে, চুরি, খুন-জখম, রাহাজানি অথবা ধর্ষণ যদি একটা সমাজের সাধারণ ক্রিয়াকলাপ হয়ে দাঁড়ায়, তখন আবারও কিন্তু সেই বিক্ষিপ্ত কথাটা বারবার শোনা যাবে–করাপশনে’ দেশ ভরে গেছে। সত্যি কথা বলতে কী ক্রাইম এবং করাপশনের মধ্যে একচুলের একটা তফাত আছে। ক্রাইম’ বস্তুটা অনেক সময়েই একটা ব্যক্তিগত স্তরে নিহিত থাকে কিন্তু করাপশন’ ব্যাপারটা অনেকটাই সামাজিক এবং বৃহত্তর স্তরে চলে যায়।
আজকের দিনে আপনারা তো মনু-মহারাজের নাম শুনলেই খানিকটা গালমন্দ করে থাকেন। হ্যাঁ, এ-কথাও মানি যে স্ত্রী এবং শূদ্রদের ব্যাপারে তার কথাবার্তা এবং ভাবভঙ্গি খুব একটা ভালো নয়। কিন্তু এ-ছাড়াও তো বিষয় আছে। সে-সব জায়গায় সেই কালের দিনে মনু-মহারাজের বিশ্লেষণ শুনলে অবাক হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। তা সেটা খ্রিস্টীয় ২য়/৩য় শতাব্দী হবে, সেইকালে মনু বলছেন–চোর দুরকমের হয়। প্রকাশ এবং অপ্রকাশ–দ্বিবিধাংস্তস্করা বিদ্যাৎ পরদ্ৰব্যাপহারকা। এই দুই প্রকারের মধ্যে যারা অপ্রকাশ চোর–অর্থাৎ যারা নিজেদের লুকিয়ে রাখে, প্রচ্ছন্ন রাখে, কাজ সারা হয়ে গেলেই যারা বনে-জঙ্গলে আশ্রয় নেয়, তাদের তো বোঝা যায়। তারা মানুষের অসাবধানতার সুযোগ নিয়ে ধন-সম্পত্তি অপহরণ করে এবং সে-সব অপহরণ করার যন্ত্রপাতিও আছে–কেউ বাড়িতে সিঁদ কাটবে, সন্ধিভেদক, কেউ বা ধারালো অস্ত্র দিয়ে পথিকের পকেট কাটবে অথবা সংস্কৃত প্রাকৃত শব্দের বিবর্তন মেনে গ্রন্থি>গণ্ঠি>গাঁঠ কাটবে–অর্থাৎ গ্রন্থিচ্ছেদক।
এই অপ্রকাশ বা ‘প্রচ্ছন্নবঞ্চক’ গাঁঠকাটা তথা সিঁদেল চোরদের নিয়ে মনু যত চিন্তা করেছেন, যত শব্দ ব্যয় করেছেন, তার চেয়ে অনেক বেশি চিন্তা করেছেন প্রকাশ্য চোর বা প্রকাশ-চোরদের নিয়ে। আমি আগে ভাবতুম–প্রকাশ-চোর বলছেন কেন মনু, এরা কি প্রকাশ্যে লোক দেখিয়ে চুরি করে। পরে বুঝেছি যে, বেশি বুদ্ধি করেই তিনি কথাটা বলেছেন, কেননা এই হল সেই করাপশনের জায়গা, যেখানে চুরির ব্যাপারটা সকলের জানা-প্রকাশ’ কথাটার তাৎপর্য এইখানেই। আজকের দিনে সরকারি স্তরে কতকগুলো জায়গা জানাই আছে–জানাই আছে যে, এইসব দপ্তরে চুরি হয়, টাকার লেনদেন হয়। লোকে জেনেই পকেটে বেশি টাকা নিয়ে বেরোন যাতে কলকাতা কর্পোরেশন, এক্সাইজ, কাস্টমস, সেলস ট্যাক্স-এর দপ্তরে নিজের কর্মযোগ ব্যাহত না হয়। এই যে জানাই আছে–এখানে নিজের কাজ করাতে গেলে অতিরিক্ত টাকাপয়সা ছড়াতে হবে–এটাই প্রকাশ চৌর্য, হয়তো মনুর মতে এখনকার কর্মরত পুরুষেরাই প্রকাশ-চোর।
মনু তার সময়ের ‘করাপশন’ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বিভিন্ন দপ্তরের প্রকাশ-চোরদের একটা সাধারণ উপাধি দিয়েছেন এবং সেই উপাধিটি এতটাই সর্বাশ্লেষী যে সমস্ত দপ্তরের তাবৎ অসাধু কর্মচারীরা এই শব্দের আওতায় এসে যাবেন। মনু বলেছেন–উৎকোচকাঃ অর্থাৎ যারা ঘুষ নেন, কার্যার্থী ব্যক্তির কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে যারা অন্যায় অযৌক্তিক কাজটি করে দেন। উৎকোচ’ শব্দটা এতটাই বিশদ ব্যাপ্ত শব্দ যে, টাকা দিয়ে বাড়ির অন্যায় প্ল্যান স্যাংশন করা, অথবা টাকার বদলে মদের দোকানের লাইসেন্স বার করাটাই শুধু উৎকোচের বিশেষ ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত হয় না, একজন মানুষ যদি দারোয়ানকে টাকা দিয়ে কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পান, তবে সেটাও উৎকোচের আওতায় পড়ে।
এ-ছাড়াও আর এক ধরনের প্রকাশ-চোর আছে–যাদের মনু বলেছেন ‘ঔপধিক। এটা যে কতখানি আধুনিক দৃষ্টিসম্পন্ন এক শব্দপ্রয়োগ, তা ভাবলে অবাক হতে হয়। আজকাল আমাদের শহর-গ্রাম-আধা শহরে এলাকাভিত্তিক রাজত্ব করেন ‘তোলাবাজ’ নামে এক বিচিত্র মানবাংশ। এরা কখনও সরাসরি রাজনৈতিক দলের লোক, কখনও বা রাজনীতির মদতে পুষ্ট, এরা বিভিন্ন ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করেন মানুষের কাছ থেকে। মনু হয়তো ‘তোলাবাজ’ দেখেননি সেই অর্থে, কিন্তু সেই যুগের সমাজেও এমন খণ্ডাংশ একটা ছিল, যারা মানুষকে ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করত। শুধু টাকা আদায় করা নয়, এই শব্দের টীকা করতে গিয়ে টীকাকার কুল্লুকভট্ট লিখেছেন–”ঔপধিক’ হল সেই ধরনের প্রবঞ্চক যারা ভয় দেখিয়ে পরধন হরণ করে এবং সেই ধনেই জীবিকানির্বাহ করে। অতি প্রাচীন কালেও যে এই ধরনের ত্রাসসৃষ্টিকারী মানুষের অভাব ছিল না, মনুর লিস্টিতে ‘ঔপধিক’ শব্দটা থেকে তা বোঝা যায়।
রাজকর্মে নিযুক্ত রাজকর্মচারীদের মধ্যে যে করাপশন’ ভীষণভাবে চলে–এ-কথা মনু নানাভাবেই বুঝেছেন, সে-কথা সময়মতো বলব। কিন্তু সেকালে আরও যে-সব জায়গায় কিরাপশন’-এর নমুনা দেখেছেন মনু তা প্রধানত ব্যবসার ক্ষেত্রে, যাকে মনু বলেছেন–নানা পণ্যোপজীবিনঃ–অর্থাৎ যে-সব ব্যবসাদারেরা পণ্যের মূল্য এবং পরিমাণের ব্যাপারে বঞ্চনা করে। আর একটা অদ্ভুত জিনিস দেখা যাচ্ছে, যাতে মনুর নিন্দাকারীরা আশ্চর্য হবেন এবং আধুনিক বিজ্ঞানমঞ্চের মানুষেরা খুশি হবেন, সেটা হল–মনু বলছেন–এরাও এক ধরনের প্রকাশ-চোর, যারা এই ধরনের মিথ্যে কথার স্তোকবাক্য উচ্চারণ করে বলে তোমার প্রচুর ধন-পুত্র-লক্ষ্মী লাভ হবে। মনু এঁদের নাম দিয়েছেন মঙ্গলাদেবৃত্ত এবং মনুর মনে এরা লোক-ঠকানো প্রবঞ্চক। এমনকী তাদের ওপরেও মনু খুশি নন, যারা হাতের রেখা দেখে মানুষের শুভাশুভ ফল বলে জীবিকানির্বাহ করেন। মনুর ভাব দেখে মনে হয়–জ্যোতির্বিদ্যাকুশল জ্যোতিষী ছাড়াও আরও এক ধরনের মানুষ ছিলেন যারা হাত দেখে ভবিষ্যৎ বলতেন– যাদের পারিভাষিক নাম ঈক্ষণিক’। মনু এঁদের প্রবঞ্চক তথা প্রকাশ-চোরদের অন্যতম বলে নির্ধারণ করেছেন।
‘করাপশন’-এর আরও যেসব জায়গা আমরা আধুনিককালেও চিহ্নিত করি, তার মধ্যে অন্যতম স্থান হল বৈদ্য-চিকিৎসকদের ক্ষেত্র। এই গণতন্ত্রের মাহাত্ম্য মাথায় রেখেও আমরা এখনও বলতে পারি না যে আমাদের হাসপাতালগুলি অথবা আমাদের চিকিৎসককুল সর্বথা দুর্নীতিমুক্ত। সত্যি বলতে হলে বলতে হয়–এ বিষয়ে আমরা মনুর সময়কাল থেকে দু-হাজার বছর পেরিয়ে এসেও প্রায় একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি। মনুও চিকিৎসকদের দুষছেন, আমাদের মতো করেই শ্রদ্ধা সত্ত্বেও চিকিৎসকদের একাংশের ওপর সমস্ত দুর্নীতির দায় চাপিয়ে দিচ্ছেন। শ্রদ্ধার কথাটা এইজন্য বলছি, যে প্রকাশ এবং অপ্রকাশ এই দুই ধরনের প্রবঞ্চককে প্রথম দফায় চোর বললেও, তালিকা করার সময় মনু তাঁদের বলেছেন-সমাজের কাটা–প্রকাশান্ লোককণ্টকা। তার মধ্যেও আবার ডাক্তার-বদ্যি-চিকিৎসকদের বিশেষণ হিসেবে যে শব্দটি ব্যবহার করেছেন সেটার জন্য এই ইঙ্গিতটা আছে যে সকল চিকিৎসকই এমন নন। মনু বলেছেন–ঠিক ঠিক কাজ করছেন না এমন চিকিৎসকেরাও এই সমাজের কাটা, তাঁরাও অর্থগৃধুতার দ্বারা প্রবঞ্চনা করছেন সমাজকে অসম্যকারিণশ্চৈব.চিকিৎসকাঃ।
চিকিৎসকদের কথায় পরে আবার আসব। মূল প্রস্তাবের ভূমিকা রচনা করার সময়েই মনুর কথা এসে গেল। তাই কথাটা শেষ না করে অন্য কথা আরম্ভ করতে পারছিলাম না। মনুর যুক্তিমত প্রকাশ-চোরদের প্রসঙ্গ উদ্ধার করে আমরা শুধু বোঝাতে চাইলাম যে, তিনিই বোধহয় প্রথম ব্যক্তি, যিনি ‘করাপশন’ বলতে আমরা যা বুঝি, তার খানিকটা অন্তত তার সময় এবং যুক্তিমত বুঝতে পেরেছিলেন। তাঁর সময় এবং যুক্তি তো বুঝতেই হবে, যেমন ধরুন পাশাখেলা বা জুয়াখেলা আজকের দিনে হলেও তার কোনও ‘অফিসিয়াল’ নিয়মকানুন নেই, কিন্তু সে যুগে তা ছিল। ফলে করাপশন-এর একটা জায়গা ছিল এই পাশাখেলার আসরগুলি। বেশ জুত করেই তখনকার দিনে পাশাখেলা হত এবং তা খেলা হত বাজি ধরে। খোদ ঋগবেদের মধ্যেই পাশাখেলা নিয়ে একটা সম্পূর্ণ সূক্ত আছে এবং সেখানে পাশায়-হারা জুয়াড়ির এমন আতান্তরের কথাও আছে, যাতে মনে হয় বাজি ফেলে খেলায় হারার পর জুয়াড়ি যদি প্রতিজ্ঞাত অর্থ প্রতিপক্ষকে না দিত, তবে রাজ-দরবারে নালিশ করা যেত। ঋগবেদের কালের এই ন্যূতক্রীড়ার এমন আইনসিদ্ধ প্রযুক্তি দেখতে পাচ্ছি যে, পাশাড় জুয়াড়ির বাপ-ভাই-মা জুয়াড়ির ওপর রীতিমতো বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছে। নালিশের জোরে রাজপুরুষ অথবা প্রতিপক্ষ জুয়াড়ি জুয়াড়ির বাড়িতে চলে আসছে এবং জুয়াড়ির বাপ-মা-ভাই হতচ্ছেদ্দা করে বলছে–আমরা একে চিনি না, একে বেঁধে নিয়ে যান আপনারা–পিতা মাতা ভ্রাতর এনমাহু-ন জানীমো নয়ত বদ্ধমেন।
লক্ষণীয় বিষয় হল, বেদের কাল থেকে বৃহদ্দেবতার কাল, আর মহাভারতের কাল থেকে শূদ্রকের মৃচ্ছকটিক রচনার কাল–এই বিরাট সময় জুড়ে যে পাশাখেলার রমরমা দেখা যায়, তাতে এটুকু পরিষ্কার যে, বিত্তশালী, মধ্যবিত্ত এবং গরিব মানুষ–সকলের কাছেই পাশাখেলার একটা বিরাট জগৎ ছিল, যাকে মৃচ্ছকটিক সাধারণভাবে বলেছে–দাবা-পাশার জগৎটা হল আসলে মানুষের কাছে সিংহাসনহীন রাজ্যপাট–দ্যুতং হি নাম পুরুষস্য অসিংহাসনং রাজ্য। মনে রাখতে হবে পাশাখেলার জন্য সরকারি এবং বেসরকারি সভাগৃহ থাকত, সেই সভাগৃহের মালিক থাকত, সেখানে বাজি ধরে দ্বন্দ্বী-প্রতিদ্বন্দ্বীরা পাশা খেলতেন এবং তাতে খেলার নিয়ম এবং নিয়ম-ভাঙার ফলে করাপশন’-এরও জায়গা ছিল। মনে আছে, মৃচ্ছকটিক নাটকে সংবাহক নামে সেই মানুষটি যখন পাশাখেলায় দশ মোহর হেরে দ্যুতসভা থেকে পালিয়ে গিয়েছিল, তখন দ্যুতসভার মালিক এবং সংবাহকের খেলার প্রতিদ্বন্দ্বী মাথুর দুজনেই তাকে তাড়া করেছিল। সে অবস্থায় কোথাও আশ্রয় পায়নি সংবাহক। অবশেষে যে তাকে বাঁচাতে এসেছিল, সেও কিন্তু এক জুয়াড়ি। মনু মহারাজ দেখেছিলেন যে জগতে জুয়াড়িরাই নায়ক এবং প্রতিনায়ক, সেখানে করাপশন’ তথা প্রকাশচৌর্যই হয়তো সাধারণ নিয়ম। দাবা-পাশা-তাসের জায়গায় করাপশন-এর ব্যাপারটি যদি এখনও বোধগম্য না হয়ে থাকে, তবে পাঠক মহাশয়কে আজকের দিনে পাড়ায় পাড়ায় ‘চিট ফান্ড’, ‘বেসরকারি লটারি-খেলা’ এবং অল্প বিনিয়োগে বৃহ-বস্তু-লাভের শীঘ্র সুবর্ণ সুযোগের জায়গাগুলি স্মরণ করিয়ে দিই, তাহলেই বুঝতে পারবেন কিরাপশন’ কেমন করে হয়।
আজকের দিনের চেতনা এবং গবেষণার দৃষ্টিতে মনু-কথিত দুর্নীতিগুলির মধ্যে রাজকর্মে নিযুক্ত রাজপুরুষের অর্থ আদায় করার ক্ষেত্রগুলি ছাড়া অন্য কিছু হয়তো করাপশন’ বলে গণ্য হবে না। কিন্তু সামাজিক নীতি-নিয়ম এবং অর্থের দানাদান-সংক্রান্ত ক্ষেত্রগুলি তীক্ষ্ণভাবে খেয়াল করলে সে-কালের করাপশন’-এর দৃষ্টান্তগুলিও সঠিক বোঝা যাবে। একথা মানতেই হবে যে, সুপ্রাচীনকালে যখন আইনগুলিই ভালো করে তৈরি হয়নি, তখন করাপশন’ ব্যাপারটাকেও তেমন করে ধরা যায় না। আর আগেই তো বলেছি যে, অভাবের তাড়নায় বা স্বভাবের তাড়নায় যে চুরি করছে, তাকে কিরাপশন’ বলা যায় না, এমনকী ইহজগতে বা পরকালের নরকে চোরকে ফুটন্ত তেলের কড়াইতে ফেলে শাস্তি দিলেও সে পাপ করাপশন’ নয়। বরঞ্চ করাপশন’-এর প্রথম অর্থটা সেইখানেই সবচেয়ে প্রযুক্ত হবে, যেখানে আইন-বহির্ভূত খাতে টাকাপয়সার লেনদেন হচ্ছে। এমনকী টাকাপয়সাই বা কেন শুধু, এই আইন-বহির্ভুত ঘটনা যদি পণ্য-বিনিময়ের ক্ষেত্রেও ঘটে তবে তাকেও করাপশন’ বলা যায়। যেমন খোদ ঋগবেদের সত্য-যুগেও যে চুরির ঘটনা ঘটেছে, তাতে শাস্তি ছিল সূর্যের তাপ–রূপক ভাঙলে সেটাকে ফুটন্ত তেলের কড়াই বলতেও আপত্তি নেই। কিন্তু এটা ‘করাপশন’ নয়। বরঞ্চ লোকের বিশ্বাস ভাঙিয়ে ইন্দ্রমূর্তি বিক্রি করার যে ঘটনাটা ঋগবেদে আছে, সেটাকে আমরা স্বচ্ছন্দে ‘করাপশন’ বলতে পারি।
অনেকটাই এ-ঘটনা আমাদের কেওড়াতলা শ্মশানের শবলগ্ন ফুল-বিছানা-খাটের কথা মনে করিয়ে দেয়। এমনই শুনতাম যে, নগরের শ্মশানে শবদেহের সঙ্গে যে ফুল-বিছানা-খাট আসে, তার ফুলগুলি কিছুক্ষণের মধ্যে পাশের বাজারে বিক্রি হয়ে যায়, খাট এবং বিছানাও আস্তে আস্তে নির্দিষ্ট জায়গায় চলে যায় পুনরায় বিক্রির জন্য। ঋগবেদে দেখছি–লোকের বিশ্বাস ছিল যে, ইন্দ্রের মূর্তি ঘরে রাখলে শত্রুনাশ হয়। এই বিশ্বাসের ফলে ইন্দ্রের মূর্তি কেনা-বেচা হত। তা একজন বিক্রেতা অনেকগুলি ইন্দ্রের মূর্তি তৈরি করে, লোকের কাছে বিক্রি করেছে। কিন্তু বিক্রির সময় লোভে পড়ে কম দামেই মূর্তিগুলি ছেড়ে দিয়েছিল। পরে সে ভাবল–আরও অনেক লাভ হত, নেহাতই বোকামি হয়ে গেছে অত কম পয়সায় মূর্তি বেচে। সে এবার ক্রেতার কাছে গিয়ে বলছে আমি ওই মূর্তি তোমার কাছে বিক্রি করিনি, তুমি আমার মূর্তি ফেরত দাও, নয়তো বেশি দাম দাও–ভূয়সা বমরচৎ কনীয়োবিক্রীতে অকনিষং পুনর্যন্। বৈদিক এই ক্রেতা ভদ্রালোকও কম পাটোয়ারি-বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ নন, তিনি বললেন–এই এটুখানি ইন্দ্রমূর্তির জন্য যা দাম দিয়েছি, অনেক দিয়েছি, তাছাড়া তোমার সঙ্গে যা কথা হয়েছে, তার ওপরে একটি পয়সাও দেব না। ক্রেতা নিজের কথায় গাট হয়ে বসে রইল–স ভূয়সা কনীয়ে নারিরেচীৎ। মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি এরপর যেন অদ্ভুত একটা নিরপেক্ষ মন্তব্য করে বললেন–যারা দীন এবং যারা দক্ষ, তারা দুই পক্ষই পণ্যমূল্যকে নিজের পক্ষে দোহন করে–দীনা দক্ষা বিদুহস্তি প্রবাণ।
দেখুন, বৈদিক শব্দ-পঙক্তির সঙ্গে টীকাকার সায়নের মোটামুটি সাযুজ্য রেখে একটা অর্থ তো সাজিয়ে দিলাম বটে, পরে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বেদজ্ঞ অভিজিৎ ঘোষের সঙ্গে যোগাযোগ করে দেখলাম যে বৈদিক ঋষির এই এক পঙুক্তি মন্ত্র-দর্শনের মধ্যে গভীর অর্থ আছে বিশ্বব্যাপী পণ্ডিত বিশেষজ্ঞরা এই শেষ পঙক্তি নিয়ে মাথা কুটে মরেছেন। এক জাপানি বেদজ্ঞ, যাঁর নাম তোশি ফুমি গোতে (Toshi Fumi Goto), তিনি একটা গোটা প্রবন্ধই লিখে ফেলেছেন ওই শেষ রহস্য-পঙক্তির ওপর বিদুহস্তি প্রবাণম্। অত কথা লিখতে গেলে এই প্রবন্ধ শেষ হবে না। তবে এইটুকু বলা দরকার, অতিশয় বিজ্ঞ জার্মান এবং ইংরেজ পণ্ডিতেরা ‘প্রবাণ শব্দটির আরও একটা রূপ দেখেছেন। এটা ঠিক অন্যতর এক পাঠ নয়, অন্যতর এক রূপ। ওঁরা বলেছেন (প্র)-বাণ’ শব্দটা (প্র)-পাণ’-এ হতে পারে। কথাটা এইজন্যে এসেছে যে, গ্রিফিথ সাহেব অথবা গেলনার সাহেব যেখানে ইংরেজি কিংবা জার্মান অনুবাদ করতে গিয়ে ‘দোহন’ (দুহন্তি) ক্রিয়ার সঙ্গে তাল রেখে আক্ষরিক অনুবাদ করেছেন 430165767- simple and clever both milk out the udder-ovets সরল এবং চতুর দুই জনেই গোরুর আলান দুইয়ে নিচ্ছে, সেখানে ইন্দ্রমূর্তির কেনা-বেচার তাৎপর্যটাই হারিয়ে যায়। পণ্ডিতেরা বুঝেছেন যে, ঋষির রহস্য আরও গভীরে এবং তা শব্দবোধের ব্যাপার। ওঁরা মনে করেন–শব্দটা যদি বাণ’ হয় তবে বণি কথাটাও একই ক্রিয়াপদ থেকে এসেছে, আর সেটা যদি পাণ’ হয়, তবে পণী, পণ্য, পণম, বিপণন, প্রপণন এইসব শব্দের অর্থ ওই পাণ-কথাটার মধ্যে লুকিয়ে আছে। এফ. বি. জে. কয়পার সাহেব আমাদের ভাগ্যে আজও বেঁচে আছেন। তিনি আধুনিক গবেষণার সমস্ত সূত্র বিচার করে দেখিয়ে দিয়েছেন যে, বৈদিক শব্দটা সম্ভবত(বিদুহস্তি প্র)’ পাণ-ই হবে এবং তার প্রাচীন অর্থ হবে কেনার মূল্য, কেননা এক্কেবারে মূল ইন্দো-ইয়োরোপীয় ভাষায় এই শব্দের সঠিক প্রতিশব্দ (vafna : price, value) রয়ে গেছে, যে শব্দ থেকে পাণ’ অথবা কথঞ্চিৎ দূরগত অনার্যোচিত উচ্চারণে তা বাণ’ হয়ে গেছে।
আমরা যে এতক্ষণ ধরে ভাষাতত্ত্বের মধ্যে শব্দসন্ধান করে যাচ্ছি তার কারণ একটাই। এখানে ইন্দ্রমূর্তির বিক্রেতা মানুষটি বোধহয় দীন, অর্থাৎ সে গরিবও বটে, সরলও বটে। আর ক্রেতা ভদ্রলোক, তাঁর টাকাপয়সার সম্পন্নতা কতটুকু আছে তা বোঝা যাচ্ছে না বটে, কিন্তু সে চতুর বটে। বৈদিক ভাষায় দক্ষ। গ্রিফিথ এবং গেলনারের অনুবাদে এই ক্রেতা ভদ্রলোক এতটাই চতুর যে, তিনি খুশি হয়ে উঠছেন–ভাগ্যিস্ তিনি ইন্দ্রমূর্তিটি কেনেননি অথবা কেনার পরও বিক্রেতার চাপে পড়ে আর বেশি পয়সা দেননি। বৈদিক পঙক্তিতে এতটা পর্যন্তও কোনো দুর্নীতির ব্যাপার নেই, ব্যাপারটা পণ্যবস্তুর মূল্য নিয়ে দরকষাকষিযেখানে ক্রেতা-বিক্রেতা দুই পক্ষই পরস্পরকে দুইয়ে নিতে চায়–বি দুহন্তি প্র পাণম্প রস্পর পরস্পরের কাছ থেকে লাভ করতে চায়। কিন্তু এর পরের মন্ত্রেই টের পাওয়া যাবে যে, সেই বেদের কালেও ক্যাওড়াতলা শ্মশানের মতো বিক্রীত বস্তুর আবর্তন ঘটত।
পরের মন্ত্রে দেখা যাচ্ছে ইন্দ্রমূর্তির বিক্রেতা হেঁকে বলছে–কে আমার এই ইন্দ্রকে দশটা গোরু দিয়ে কিনবে গোক ইমং দশভির্নমেন্দ্রং ক্ৰীণাতি ধেনুভিঃ। অসুররাজ বৃত্রের মতো বড়ো শত্রুকেও নাশ করবে এই ইন্দ্র। তোমাদের শত্রুবধ হয়ে গেলে আবার এই ইন্দ্রমূর্তি আমায় ফিরিয়ে দেবে–যদা বৃত্ৰানি জংঘন অথৈনং মে পুনর্দৎ। এই হল ক্যাওড়াতলা শ্মশানের মতো সেই ঋগ্বৈদিক স্থান। এটা বেশ বোঝা যাচ্ছে যে, বিক্রেতা মানুষের গভীর বিশ্বাসের জায়গাটার আর্থিক ফায়দা তুলতে চাইছে। সে-যুগে সম্পদ অথবা বিত্ত হিসেবে এক-একটা গোরুর মূল্য কম ছিল না। সেই গোরু দশ-দশটার বিনিময়ে একটা ইন্দ্রমূর্তি–এটা বেশ চড়া দামই বটে, আর সেইজন্যেই হয়তো আগের মন্ত্রের ক্রেতা মূর্তিটা না কিনে বড়ো খুশি হয়ে গিয়েছিল। অথবা কম দামে কিনে আর একটি পয়সাও বাড়তি দেয়নি। কিন্তু দীন, সরল বিক্রেতাও দক্ষ হয়ে উঠেছে বুঝি। সে তার পণ্যের দামটি চড়া হাঁকছে বটে। কিন্তু পরের কথাতে সে তার দরকষাকষির সম্ভাবনাটুকু তো বজায় রেখেইছে, উপরন্তু কাজ হয়ে গেলে তাকেই পণ্য ফেরত দেবার মধ্যে আধুনিক শ্মশানের দুর্নীতিটুকুও আছে। এটা ঠিক ভাড়া খাটানোও নয়। লোকের বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে একই জিনিস বারবার বিক্রি করার মধ্যে যে দুর্নীতি আছে, এটাকেই বিশদর্থে করাপশন’ বলা যায়।
তবু বলি, বৈদিক কালে আইনের গ্রন্থি তেমন শক্ত হয়নি, আর করাপশন’-এর ক্ষেত্রগুলিও তেমন স্পষ্ট নয়। বস্তুত মানুষ তো নিজে নিজেই দুর্নীতিগ্রস্ত হয় না। একটি মানুষ তার পরিবার, সমাজ এবং সরকারি ব্যবস্থার মধ্যে থাকে বটে, কিন্তু রাজশাসন এবং শাসনাধিকারে অধিষ্ঠিত কর্মচারী যদি শাসনের শিথিলতা বুঝে ব্যক্তিগত উপার্জনে মন দেয় এবং অন্যদিকে সামাজিক একক হিসেবে একজন মানুষও যখন আইনের বাইরে এসে ব্যক্তিগত সুযোগ গ্রহণ করে, তখনই দুর্নীতির জায়গা স্পষ্ট হয়ে ওঠে উভয়ত। অর্থাৎ আমাদের সামাজিক জীবনে আইন-বহির্ভূত অর্থের দান এবং আদান, সোজা কথায়–ঘুষ দিয়ে সুযোগ কেনা–এটাই যদিও দুর্নীতি বা করাপশন’-এর সবচেয়ে প্রচলিত রীতি, কিন্তু এমনও দুর্নীতি আছে যা বাইরে থেকে বোঝা যায় না, যেমন গভীরে তার নিঃশব্দ পদ-সংক্রমণ, তেমনই ব্যাপ্ত তার জাল। অধিক অর্থের বিনিময়ে সুযোগ কেনার যে জায়গাটা, সেখানে কখনও কাজ করে অজ্ঞানতা বা অকর্মণ্যতা, আবার কখনও কাজ করে স্বজন-পোষণ, ব্যক্তিগত অসুবিধে-সুবিধে এবং কর্তব্যে ফাঁকি দেয়া, এমনকী জাতি-বর্ণের বৈষম্যও কখনও দুর্নীতির জন্ম দেয়।
এমন অবশ্য হতেই পারে যে, একজনের সংসারের টানাটানি, কম মাইনে পাওয়া, জীবনধারণের দৈনন্দিন গ্লানি থেকে ব্যক্তিগত দুর্নীতির জন্ম হয়, অথবা এমন হতেই পারে যে, দক্ষ এবং কর্মকুশল এক ব্যক্তিও বহুল। দুর্নীতির জায়গায় কাজ করতে এসে পারস্পরিক সংক্রমণে নিজেও দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে ওঠে, কিন্তু পণ্ডিত-সুজনেরা গবেষণা করে দেখিয়েছেন যে, দুর্নীতির পিছনে আছে যূথবদ্ধ মানুষের মনস্তত্ত্ব, যা একটি সমাজের সাংস্কৃতিক পরিবেশকে পূর্বাহেই দূষিত করে রেখেছে। যে-কোনো বড়ো দুর্নীতিচক্রের পিছনে এমন একটা পূর্বাবস্থা থাকবেই, যেখানে সরকারে অধিষ্ঠিত ব্যক্তি–সে গণতন্ত্রেই হোক বা রাজতন্ত্রে–সেই ব্যক্তির হাতে যথেষ্ট ক্ষমতা আছে এবং সে নিজের স্বার্থে এবং সুযোগসন্ধানীর স্বার্থে নির্ধারিত পথের বাইরে চলাফেলা করতে পারে।
দুর্নীতি কেন হয়, করাপশন ব্যাপারটার নিদান কী, এই গবেষণার খুব বেশি প্রয়োজন নেই এখানে। বরঞ্চ বলতে চাই-করাপশন-এর সমস্ত ঘটনাই প্রায় আমাদের সভ্যতার সমবয়সি। আর শুধু ভারতবর্ষ কেন, যে-কোনো প্রাচীন সভ্যতা–তা গ্রিস দেশেরই হোক অথবা মিশর, তা অ্যাসিরীয় সভ্যতাই হোক অথবা ভারতীয়–সব জায়গাতেই দুর্নীতি ছিল, ঘুষও চলত। অ্যাথেনীয় বিচারব্যবস্থায় বিচারমণ্ডলে অবস্থিত ‘জুরি’দের ঘুষ দিয়ে স্বানুকূলে নিয়ে আসার মতো দুর্নীতির রাজ ছিল সেকালে। সবচেয়ে বড়ো কথা, ঘুষ খাওয়া বা দেওয়া যেখানে অনেকটাই ব্যক্তিগত অথবা একটি প্রতিষ্ঠানের গোষ্ঠীর মধ্যে এই ব্যবহার চলে, সেখানে প্রাচীনতম সভ্যতায় রাষ্ট্রীয় ঘুষের কারবারও চলত, বিশেষত ক্ষয়িষ্ণু রাজতন্ত্র বা পরিবারতন্ত্র নিজস্ব অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে পররাষ্ট্র বা বিদেশি শক্তিকেও ঘুষ দিত, কখনও বা নতুন রাজনৈতিক শক্তি অথবা জমিদারতন্ত্র–নিজস্ব প্রতিষ্ঠার তাগিদে ক্ষয়িষ্ণু বা তুলনামূলকভাবে বলবত্তর সহায়কেও ঘুষ দিত। এসব দুর্নীতির ঘটনা বিদেশি সভ্যতায় অনেক বেশি ঘটেছে, তবে ভারতবর্ষের প্রাচীন সভ্যতায় তেমন করে ঘটেনি। বেদ এবং ব্রাহ্মণ গ্রন্থগুলি তথা উপনিষদেও সত্য, ঋত এবং ত্যাগের এত মাহাত্ম্য শোনা যায় যে, রাজাদের অথবা বৈদিক আমলে প্রচলিত গোষ্ঠীগুলির পক্ষে ঘুষ দিয়ে নিজেদের রাজত্ব বা গোষ্ঠীতন্ত্র কায়েম করতে হয়নি। খ্রিস্ট পরবর্তী সময়ের সাহিত্যে, বিশেষত কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে দুর্বলতর রাজা সন্ধি-বিগ্রহের প্রয়োজনে বলবত্তর রাজাকে ভূমি-হিরণ্যের বিনিময়ে নিজের অনুকূলে নিয়ে আসছেন, এমন পরামর্শ আছে। তবে কৌটিল্যের এই বিনিময় পদ্ধতি অনেকটাই রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্যে পড়ে, এটা ঠিক রাজনৈতিক ‘করাপশন’ নয়।
প্রাচীন যুগে রাজতন্ত্র ছিল, অতএব রাজতন্ত্রে কী ধরনের করাপশন চলত, তারই ইঙ্গিতটা প্রথম দেওয়া দরকার এবং সে ইঙ্গিতটা মনু-মহারাজ বেশ স্পষ্ট করেই দিয়েছেন। মনু বলেছেন–অন্তত আঠারোটা দোষের মধ্যে একটা-না-একটা রাজাদের গ্রাস করে বসে। এগুলোর মধ্যে অন্যতম চরম দোষের একটা হল অর্থদূষণ। সোজা কথায় রাজার ‘অর্থদূষণ’ বলতে বোঝায়–রাজকোষে জমা-পড়া অর্থের অপহরণ এবং যে অর্থ যাকে দিতে হবে, সেই অর্থ পুরোটা তাকে না দিয়ে নিজে ভোগ করা–অর্থদূষণ অর্থানাম্ অপহরণ, দেয়ানাম্ অদান। বলতে পারেন, রাজতন্ত্রে রাজাই সব, তাঁর যা ইচ্ছে তাই করতে পারেন। সবিনয়ে জানাই–প্রাচীন নির্দেশ এমন ছিল না। রাজকোষে যে অর্থ জমা পড়েছে, তা রাজকর বাবদ প্রজাদের দেওয়া অর্থ, তার আয়-ব্যয়ের সূক্ষ্ম হিসেব রাখা হত। সেখানে যে অর্থ জমা পড়ল, তার অর্ধেক লিখিয়ে অর্ধেক আত্মসাৎ করা অথবা জনকল্যাণমূলক কর্ম যা করণীয় ছিল, তা না করে নিজের কাজে লাগানোর ব্যাপারটা রাজাদের আদর্শ নীতি ছিল না। মনু এটাকেই ‘অর্থদূষণ’ বলেছেন এবং বলেছেন–এই দোষ যদি রাজাকে গ্রাস করে, তবে তার রাজ্য এবং জীবন দুই-ই নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
তবে অর্থষণ যেসবসময় রাজাদেরই গ্রাস করত, তা নয়।রাজ-অধিকারে নিযুক্ত মন্ত্রী-অমাত্য-সচিবেরাও অর্থদূষণে লিপ্ত হতেন। মনু-কৌটিল্যের মতো রাজধর্ম-বিশেষজ্ঞরা বারবার নানা ছলে মন্ত্রী-অমাত্যদের পরীক্ষা করে নিতে বলেছেন। এমনও বলেছেন–যাঁকে মন্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করার কথা রাজা ভাবছেন, তাকে পূর্বেই প্রচুর অর্থ এবং কামনার বিষয় উপহার দিয়ে তাঁর নীতি-স্থিতি বুঝে নেবার চেষ্টা করবেন। বিশেষত বিত্ত, রাজকোষ বা অনুরূপ কোনো অধিকার, যেখানে টাকাপয়সার লেনদেন হয়, সেখানে অর্থের ব্যাপারে যিনি শুদ্ধ বলে চিহ্নিত হয়েছেন, তাকেই রাজা নিযুক্ত করবেন। কিন্তু পরীক্ষা করে নিলেও, শত পরীক্ষা করে নিলেও রাজযন্ত্রের শিথিলতা, বাস্তব পরিবেশ এবং রাজাদের ব্যক্তিগত অশুদ্ধির কারণে একান্ত অর্থশুদ্ধ মন্ত্রীরাও করাপটেড’ হয়ে পড়েন। এমনকী তা এমনও হয়, বিশেষত রাজা যদি নিজে করাপটেড’ হন, তাহলে মন্ত্রী-অমাত্যেরাও সেখানে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েন। কেননা, কৌটিল্য বলেই দিয়েছেন রাজা যেমন চরিত্রের হবেন, তার মন্ত্রী অমাত্য সচিব এমনকী সেনা-সেনাপতিরাও তেমন প্রকৃতিরই হবেন–স্বয় যচ্ছীলাঃ তচ্ছীলাঃ প্রকৃতয়ো ভবন্তি।
আমরা আগে বলেছিলাম–নিজের রাজ্য ঠিক রাখার জন্য পররাষ্ট্রীয় শক্তিমত্তর রাজাকে ভূমি এবং অর্থের বিনিময়ে তুষ্ট রাখাটা একরকম রাজনৈতিক প্রক্রিয়া, সেটা ঠিক করাপশন’ নয়। কিন্তু একই ধরনের এই তথাকথিত রাজনৈতিক প্রক্রিয়া যদি রাজার নিজের রাজ্যপাটের মধ্যেই হতে থাকে, তাকে করাপশন ছাড়া আর কীই বা বলা যায়। মহাভারতের মধ্যে একটা ঘটনার উল্লেখ করা যায়। সেকালের দিনে রাজা বদলের সঙ্গে মন্ত্রী-অমাত্য-সেনাপতি ইত্যাদি রাজার সহায়ক জনকে অর্থ-মান দিয়ে নিজের অনুকূলে তৈরি করে নেবার একটা ব্যাপার ছিল অর্থাৎ রাষ্ট্রযন্ত্রকে নিজের অনুকূলে না নিয়ে এলে রাজার পক্ষে রাজ্য চালানো অসুবিধে হত। মহাভারতের অন্যতম প্রতিনায়ক মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র যখন পুত্রের হিতৈষণায় পঞ্চপাণ্ডবকে তাঁদের জননীসহ বারণাবতের জতুগৃহে পাঠাতে চাইছেন, তখন তিনি যেটা ভয় পেয়েছিলেন, সেটা হল–যুধিষ্ঠির পিতৃ-পিতামহক্রমে যে মন্ত্রী-অমাত্য লাভ করেছেন, তারা পাণ্ডুর কাছে এতটাই কৃতজ্ঞ যে, তারা যুধিষ্ঠিরের পক্ষেই থাকবেন এবং পাণ্ডব-ভাইদের বারণাবতে পাঠিয়ে কোনো দুর্ঘটনার মধ্যে ফেলার ব্যাপারটা মেনে নেবেন না। ফলত সেই সব কৃতজ্ঞ মন্ত্রী-অমাত্যেরা যুধিষ্ঠিরের জন্য উলটে আমাদেরই না হত্যা করে বসে-কথং যুধিষ্ঠিরস্যার্থে ন নো হনঃ সবান্ধবান্।
দুর্যোধন এতক্ষণ ধরে পিতার কথা শুনছিলেন, কিন্তু আর তার ধৈর্যে কুলাল না। আসলে তিনি এখনকার রাজনৈতিক দলনেতাদের মতোই জানতেন যে দুর্নীতিরও একটা মোহ আছে। এখন যেমন নিজস্ব স্থিতাবস্থা বজায় রাখার জন্য সরকার পক্ষ আমলা-পুলিশদের বিচিত্র উপায়ে হাত করে ফেলে, এই দুর্নীতি তখনও জানা ছিল, আর ঠিক সেই কারণেই দুর্যোধন ধৃতরাষ্ট্রের মুখের শঙ্কা কেড়ে নিয়ে বললেন–ছোঃ! মন্ত্রী, অমাত্য আর জনগণ! আপনি যে কথা বলছেন অর্থাৎ ধনে-মানে যেভাবে তাদের তুষ্ট হতে দেখেছেন–অর্থমানেন পূজিতাঃ–এই কথা তো? তো, সে কায়দা কি আমি জানি না? ওইসব মন্ত্রী, অমাত্য আর সাধারণ লোক, দুদিনে আমার পক্ষে চলে আসবে। ধ্রুব অস্মাৎসহায়াস্তে ভবিষ্যন্তি প্রধানতঃ। কারণ রাজকোষ এবং অমাত্যরা–সবই এখন আমার হাতে।
দুর্যোধন যেটা পরিষ্কার করে বললেন না, সেটা হল–তার হাতে রাজকোষ আছে বলেই অমাত্যরা তার অনুগত হয়ে পড়েছে। দুর্যোধনের কাছে ভরসা পেয়ে ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডবদের বারণাবতে পাঠাতে সম্মত হয়েছেন এবং পরে দেখা যাচ্ছে এই বারণাবতে যাবার কথা তাকে নিজের মুখে বলতেও হয়নি। দুর্যোধনের টাকা খেয়ে ধৃতরাষ্ট্রের মন্ত্রীরা–অর্থাৎ পূর্বে যাঁরা পাণ্ডুর মন্ত্রী ছিলেন যারা পূর্বে যুধিষ্ঠিরের গুণ গাইতেন–তারাই এখন ধৃতরাষ্ট্র-দুর্যোধনের হয়ে বলতে লাগল–আঃ! বারণাবতের মতো অমন সুন্দর জায়গা হয় না, তার ওপরে আবার সেখানে পশুপতি শিবের মেলা বসেছে। উঃ! এত সুন্দর জমাটি জায়গা না। মন্ত্রী-অমাত্যের মুখের এই উচ্ছ্বাসে ভুলে পাণ্ডবরা নিজেরাই বারণাবতে যাবার টোপ গিলেছেন, এবং অজান্তেই জতুগৃহের আগুনে পুড়ে মরার টোপও। মন্ত্রী অমাত্যদের বশে এনে দুর্যোধন আরও বড়ো যে দুর্নীতিটি করেছিলেন, সেটি হল–পৌর জনপদবাসীদের টাকাপয়সা দিয়ে ভোলানো। দুর্যোধনেরা সব ভাই মিলে জনগণের মধ্যে এমন টাকা ছড়িয়েছিলেন, বিশেষত রাষ্ট্রযন্ত্রের অন্যান্য অঙ্গ মন্ত্রী-অমাত্য-সচিব-সেনাপতি– সকলকে অর্থ এবং অযোগ্য লোককে অপ্রয়োজনীয় সম্মান দিয়ে এমনভাবেই হাত করে নিয়েছিলেন অর্থমন-প্রদানাভ্যাং সঞ্জহার সহানুজঃ–যে, তারা আর প্রতিপক্ষের অনুকূলে একটা কথাও বলত না।
আমরা বলি–এটাকেও ‘করাপশন’ বলে, যেখানে রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রধান পুরুষের দুর্নীতির কাজে মন্ত্রী-অমাত্য-জনগণ সকলেই শামিল হয়ে যেতে পারে। এ কোনো ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগত ঘুষ চালাচালির করাপশন নয়, এ হল সার্বিক দুর্নয়ের এক ব্যাপ্তিময়তা, যাতে করে করাপশনটাকেই সামগ্রিক নীতি হিসেবে মেনে নেয় মানুষ। আর ‘করাপশন’ যখন এইভাবে অভ্যাস হয়ে যায়, তখন মন্ত্রী-অমাত্যদের কোনো লজ্জা থাকে না। স্বার্থসিদ্ধির জন্য ইতর খলজনের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং তাদের মাধ্যমে তারা স্বার্থসিদ্ধি ঘটান। সরল সত্য বলা সাধারণ মানুষ। তাতে মৃত্যুর পরোয়ানা লাভ করে।
কথাটা বলছি এইজন্য যে, এই সার্বিক দুর্নীতির রূপ আমাদের সাধের গণতন্ত্রেও বড়ো অপ্রত্যক্ষ নয়। মন্ত্রী থেকে দলনেতা, বিরোধী নেতা থেকে দলপুষ্ট ক্ষমতাশালী ব্যক্তির বিরুদ্ধে যদি সত্যবক্তা সরল ব্যক্তি মুখ খোলেন, তবে তিনি নিজের জীবন নিঃসংশয়ে কাটাতে পারবেন না। মহাভারতে ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে বলেছিলেন–যারা মন্ত্রীদের চুরির সম্বন্ধে রাজার কাছে সত্য ঘটনা নিবেদন করে, তাদের তোমায় প্রোটেকশন দিতে হবে, নইলে মন্ত্রীরা তাকে মেরে ফেলবে। আমরা গণতন্ত্রের বালাই নিয়ে শুধু এইটুকু যোগ করি যে, শুধু চুরি নয়, যে-কোনো ব্যাপার বা যে-কোনো দুর্নীতি, যা দলীয় নেতার প্রসঙ্গে সত্য অথচ তার অপ্রিয়, তা প্রকাশ করলে সত্যবক্তার বিপদ অবশ্যম্ভাবী এবং সেটা করাপশন-এর অন্যতম অঙ্গ।
ভীষ্ম এই সার্বিক ‘করাপশন’-এর প্রসঙ্গে যুধিষ্ঠিরকে কোশল দেশের ক্ষেমদর্শী রাজার উপাখ্যান শুনিয়ে বলেছিলেন–পুরাকালে কোশল দেশে ক্ষেমদর্শী রাজা যখন রাজত্ব করছেন, তখন কালকবৃক্ষীয় নামে এক মুনি এসে উপস্থিত হলেন রাজার কাছে। প্রথমেই বলে রাখা ভালো–ক্ষেমদর্শী এবং কালকবৃক্ষীয়–এই দুটি নামের মধ্যেই রূপক আছে। প্রথম জন মঙ্গলদশী, কল্যাণদশী। আর কালকবৃক্ষীয় স্থাণু সাক্ষীর মতো, তিনি সবকিছু দেখতে পান। যাই হোক, ক্ষেমদর্শী রাজার অবস্থা দেখে কালকবৃক্ষীয় মুনি আজ কথা বলতে আরম্ভ করেছেন। রাজার রাজ্যে করাপশন-র্যাকেট ধরিয়ে দেবার জন্য তিনি অদ্ভুত একটি কাজ করেছেন। তিনি একটি কাককে খাঁচায় পুরে জনগণকে বোঝাতে লাগলেন–তোমরা এই কাকের বিদ্যা শিক্ষা করো। কেননা কাক সব জানে, ভূত, ভবিষ্যৎ, বর্তমান–সব।
আমরা জানি–কাকের এই ভূত-ভবিষ্যৎ জানার ক্ষমতা থাকতে পারে না। প্রতীকী ব্যবহারে মুনি বোঝাতে চাইছেন যে, রাজ্যের মন্ত্রী-অমাত্যেরা চুরি করছে, অথচ সেটা কেউ বলছে না। কাক কিন্তু এমন নয়, তার অভ্যাসই হল–কোনোকিছু অন্যরকম দেখলেই, অন্যরকম শুনলেই সে কা-কা করে চেঁচায় এবং আপন গোষ্ঠী-সচেতনতায় সকল কাককে একত্র জড়ো করে। কালকবৃক্ষীয় মুনি জনগণকে নিদেনপক্ষে এ বায়সী বিদ্যা’ শিখতে বলছেন। তিনি নিজে বিভিন্ন দপ্তরে ঘুরে-ঘুরে যত অনাচার দুর্নীতির খবর পেয়েছেন–সর্বং পর্যচর যুক্তঃ প্রবৃত্ত্যৰ্থী পুনঃপুনঃ–সেসব তিনি রাজ্যবাসীকে জানিয়েছেন। ওই কাকের কথা বলতে বলতে একদিন কালকবৃক্ষীয় মুনি প্রায় আধুনিক বিরোধী দলনেতার মতোই বেশকিছু লোককে তার পাশে পেয়ে গেলেন এবং যথোচিত সাহস সঞ্চয় করে সেইসব লোককে নিয়ে বিভিন্ন সরকারি কর্মচারীদের অন্যায় দুর্নীতিগুলি সব বুঝিয়ে দিলেন–সর্বেষাং রাজযুক্তানাং দুষ্করং পরিদৃষ্টবান্।
সর্বভাবে জনগণকে অবহিত করার পর মুনি একদিন সেই খাঁচায়-পোরা কাকটি নিয়ে উপস্থিত হলেন মেদর্শী রাজার কাছে। লক্ষণীয়, এতদিন ধরে যে জনগণ বায়সী বিদ্যা শিখে বিস্তর কা-কা করে লোসংগ্রহ করল, তারা কেউই মুনির সঙ্গে নেই। আছে শুধু সেই প্রথম কাকটি, যে মহাসারল্যে সত্য বলতে প্রস্তুত। মুনি এবার রাজার সামনে এক-এক মন্ত্রীর দিকে আঙুল দেখিয়ে বলতে লাগলেন–অমুক জায়গায় এই কৌশলে তুমি টাকা মেরেছ, এই এই লোক জানে, আর এই কাকটিও তাই বলছে–এব আখ্যাতি কাকো’য়। এইরকম আরও কয়েকজন মন্ত্রীকে টাকা মারার দায়ে অভিযুক্ত করে মুনি চলে গেলেন রাজার দরবার থেকে। শনাক্তকারী কাকও তাঁর সঙ্গে চলে গেল।
পরের দিন যে ঘটনা ঘটল, সেটাই ভয়ঙ্কর। খাঁচার অধিকারী রাত্রে ঘুমিয়েছেন, যেমন সব বিরোধী নেতাই সারাদিন অন্তহীন বিপ্লবের পর রাত্রে ঘুমোন। কিন্তু পূর্বদিনের শনাক্ত হওয়া মন্ত্রীরা ইতোমধ্যেই তোক লাগিয়ে দিয়েছেন। তাদের কেউ রাতের অন্ধকারে এসে মুনির পাশে রাখা পঞ্জরস্থ কাকটিকে সূচ্যগ্র শরের আঘাতে মেরে রেখে গেল–তম্ অস্যাভিসুপ্তস্য নিশি কাক অবেধয়। তারপরে মৃতের শরীর নিয়ে যেমন পলিটিকস হয়। কাকের ছিন্নভিন্ন শরীর দেখে, সেই মৃত কাকটিকে নিয়েই মুনি উপস্থিত হলেন রাজার কাছে বায়সন্তু বিনির্ভিন্নং দৃষ্টা বাণেন পঞ্জরে। তারপর মৃত কাকের দিকে অঙ্গুলি সঙ্কেত করে মুনি বললেন–এই তো আপনার রাজ্যের অবস্থা, যে সত্য কথা বলবে, তারই তো এই অবস্থা হবে। আপনার এবং আপনার রাজ্যের হিত করতে গিয়ে এই কাক মারা পড়ল। রাজ্যের সমস্ত করাপশন’-এর ক্ষেত্রগুলি পুনরুল্লেখ করে মুনি বললেন–আপনার রাজ্য হাঙর-কুমিরে ভর্তি নদীর মতো, তবু আমি এই মূর্খ কাককে নিয়ে এই ভয়ঙ্কর রাজনীতির নদী পার হতে চেয়েছিলাম–কাকেন বালিশেনেমাং যামতামহং নদীম্।
মূর্খ কাক, নাকি যে সত্য কথা বলে মিথ্যা দুর্নীতি শনাক্ত করে সেই মূর্খ। রাজনীতি এবং রাজযন্ত্রে যখন করাপশন’ ঢুকে যায়, তখন এইরকমই ঘটে। মহাভারতের টীকাকার নীলকণ্ঠের আমলে গণতান্ত্রিক সরকার-পক্ষ এবং অতিপুষ্ট বিরোধী দলনেতারা ছিলেন না। কিন্তু প্রসঙ্গত টীকা লিখবার সময় নীলকণ্ঠ অদ্ভুত একটা কথা লিখেছেন। লিখেছেন–রাজনীতির এই নদীটা সজাতীয় এবং বিজাতীয় দুর্বগ্রাসী রাজপুরুষের দ্বারা পরিব্যাপ্ত। আজকের আধুনিক রাজনীতিতেও এই একই চিত্র। স্বজাতীয় রাজপুরুষ, সরকার–গোষ্ঠী, তার স্বজাতীয় দল, দলনেতা, দল-পক্ষপাতী আমলারা-পুলিশেরা আর বিজাতীয় বিরোধী গোষ্ঠী, বিরোধী দল, দলনেতা এবং বিরোধীমত পুষ্ট আমলা-পুলিশ। এই সজাতীয় আর বিজাতীয় রাজনীতি–দুয়ের মধ্যেই যেখানে দুর্বগ্রাসী দুর্নীতি চলে, সেখানে বলির পাঁঠা হল মূর্খ কাক অর্থাৎ মূর্খ জনগণ।
আমরা জানি, যে-কোনো সমাজের রাষ্ট্রযন্ত্রে এবং রাজনীতিতে দুর্নীতি, অন্যায় এবং করাপশন থাকবে, ভালো-মন্দের মিশেলে মন্দটা থাকবেই এবং থাকবেন সেই খাঁচাবন্দি সত্যভাষী, মূর্খ কাক-প্রতিম জনতা, যাঁরা শোরগোল তুলবেন, চেঁচাবেন এবং দু-একজন মারা যাবেন। আমরা ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগত ঘুষ চালাচালি নিয়ে আরও খানিক প্রাচীন তথ্য নিবেদন করব ভেবেছিলাম, কিন্তু লেখ্য বিষয়ের যান্ত্রিক সীমাবদ্ধতা থাকায় রাজনৈতিক করাপশন’-এর দিঙনির্দেশ করেই ক্ষান্ত রইলাম আপাতত।