অজয়বাবুর কথা শুরু
আমার জন্ম হালিশহরে বটে, কিন্তু পাঁচ বছর বয়স থেকে আমি মানুষ হয়েছি ভারতের মধ্যপ্রদেশে।
আমার বাবা ছিলেন ডাক্তার। মানুষের জীবন ও মৃত্যু নিয়ে ছিল তাঁর কারবার এবং ছেলেবেলা থেকেই দেখে এসেছি জীববিদ্যা, প্রাণিবিদ্যা ও শরীরতত্ত্ব প্রভৃতি নিয়ে তাকে গভীর অধ্যয়ন ও আলোচনা করতে। বাবার পাঠাগারে মানুষ ও অন্যান্য জীবজন্তুর কঙ্কাল সাজানো ছিল। খুব অল্পবয়স থেকেই কৌতূহলী হয়ে সেগুলি নিয়ে আমিও নাড়াচাড়া ও তাদের অর্থ বোঝবার চেষ্টা করতুম। বাল্যকালের এই কৌতূহলই ক্রমে দৃঢ়তর হয়ে আমার জীবনকে চালনা করেছিল একেবারে এক নতুন পথে।
বাড়ির ও আমাদের সংসারের কথাও কিছু কিছু বলা দরকার। সংসারে ছিলেন বাবা, আমার ছোটোভাই অশোক এবং আর একটি মেয়ে। মা মারা গিয়েছিলেন অশোকের জন্মের পরে।
মেয়েটির নাম মমতা। সে যখন শিশু, তখনই তার মা ও বাবাকে হারিয়েছিল। তার বাবার সঙ্গে আমার বাবার বিশেষ বন্ধুত্ব ছিল—তেমন বন্ধুত্ব সচরাচর দেখা যায় না। কাজেই মমতা যখন পিতৃহীন হল, তার ভারগ্রহণ করলেন আমার বাবাই। কেবল তাই নয়, একথা আমাদের আত্মীয়স্বজন সবাই জানত যে, ভবিষ্যতে মমতাই হবে আমার সহধর্মিনী!
পরিবারের বাইরে আর-একজন ছিল আমার নিত্যকার সঙ্গী। সে হচ্ছে আমার বাল্যবন্ধু প্রণব। শিশুবয়স থেকেই আমি বেশি লোকের সঙ্গে মেলামেশা করতে পারতুম না। কারুর সঙ্গে অশিষ্টতা করতুম না বটে, কিন্তু উঠতুম-বসতুম খেলাধুলো করতুম একমাত্র প্রণবেরই সঙ্গে। আমাদের দুজনেরই প্রাণে জাগত একই ছন্দ, একই আনন্দ।
কেবল এক বিষয়ে প্রণবের সঙ্গে আমার পার্থক্য। তার আদর্শ ও আমার আদর্শ এক ছিল না।
প্রণবের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল, কলেজ থেকে বেরিয়ে সে হবে অধ্যাপক। আমার উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল, আমি হব বৈজ্ঞানিক। অধ্যাপকের কাজ নিয়ে গাধাকে ঘোড়ায় পরিণত করবার ব্যর্থ চেষ্টায় সারাজীবন কাটিয়ে দেওয়া—আমার কাছে এ চিন্তাও ছিল অসহনীয়। আমি জানতে চাই এই বিপুল বিশ্বের গুপ্তকথাকেন মানুষ জন্মায়, কেন মানুষ বাঁচে, কেন মানুষ মরে?
বাবার পাঠাগারে তন্ত্র সম্বন্ধে কতকগুলো বই ছিল। সেগুলো একে একে পাঠ করে। দেখলুম যে, তান্ত্রিকরা বিশ্বাস করেন, মন্ত্রের প্রভাবে মৃতদেহেও জীবন সঞ্চার করা যায়। যদিও ঝাড়ফুঁক ও মন্ত্রশক্তির ওপরে আমার এতটুকু শ্রদ্ধাও ছিল না, তবু মৃতদেহে এই যে জীবনসঞ্চার করবার কল্পনা—এটা আমাকে আকর্ষণ করতে লাগল আলেয়ার আলোর মতন।
বাবার কাছে একদিন এই প্রসঙ্গ তুলতেই তিনি উচ্চহাস্য করে উঠলেন। তারপর বললেন, অজয়, বিজ্ঞানচর্চার দিকে তোমার ঝোঁক আছে, এটা আমি লক্ষ করেছি। কিন্তু যদি যথার্থ বৈজ্ঞানিক হতে চাও তাহলে সেকেলে তন্ত্র-মন্ত্রের কথা ভুলে যাও, কারণ ওসব হচ্ছে গ্রিমের লেখা পরির গল্পের মতো।
কিছুদিন পরেই হাতে পড়ল আমেরিকায় প্রকাশিত একখানি মাসিকপত্র, তার নাম তন্ত্র। কাগজখানির নাম দেখেই বিস্মিত হলুম, কারণ এটা অত্যন্ত অপ্রত্যাশিত। আধুনিক বিজ্ঞানের অন্যতম প্রধান লীলাক্ষেত্র আমেরিকাতেও তাহলে সেকেলে ভারতীয় তন্ত্রের প্রভাব আছে?
কাগজখানির আগাগোড়া পাঠ করে বিস্ময় আরও বেড়ে উঠল দেখলুম, অনেক বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক ও ডাক্তার প্রভৃতি ভারতীয় যোগীদের সমাধি বা যোগনিদ্রা নিয়ে মাথা ঘামিয়েও আসল রহস্যের চাবি খুঁজে না পেয়ে হতভম্ব হয়ে গিয়েছেন। এমনকি অনেকে তান্ত্রিক সাধকদের মড়া জাগানোকেও সত্য বলে মানতে বাধ্য হয়েছেন। তাহলে দেখা যাচ্ছে, বিজ্ঞান-প্রিয় একেলে আমেরিকানরাও এসব কথাকে পরির গল্প বলে মনে করে না।
প্রকৃতির রহস্যসাগরে ড়ুব দেওয়ার জন্যে আমার আগ্রহ আরও প্রবল হয়ে উঠল।
আমার সাধারণ পাঠ্য-জীবন নিয়ে এখানে বিস্তৃতভাবে আলোচনা করবার দরকার নেই। এইটুকু বললেই যথেষ্ট হবে যে, বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে আমার প্রধান আলোচ্য হল, রসায়নবিদ্যা। বিশেষ করে রসায়ন বিদ্যাবলেই আধুনিক বৈজ্ঞানিকরা প্রকৃতির বহু অজানা-শক্তির অধিকারী হয়েছেন এবং এইজন্যেই এই বিশেষ বিভাগেই হল আমার কার্যক্ষেত্র।
এখানে আমি যে পরম জ্ঞানী অধ্যাপকের সাহায্য লাভ করলুম, তিনি আমার দৃষ্টি খুলে দিলেন নানা দিকে।
প্রথম দিনেই তিনি বললেন, এ বিভাগের প্রাচীন পণ্ডিতরা অসম্ভবকে সম্ভব করবেন বলে আশা দিতেন, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে করতে পারেননি কিছুই। আধুনিক পণ্ডিতরা বিশেষ কিছু করবেন বলে আমাদের আশান্বিত করেন না। কারণ তারা জানেন যে পৃথিবীতে পরশ। পাথরের অস্তিত্ব নেই এবং মৃত সঞ্জীবনী সুধা হচ্ছে অলস কল্পনা মাত্র। কিন্তু নিজের গুপ্ত ভাণ্ডারে বসে প্রকৃতি কেমন করে কাজ করেন, সেটা তারা আবিষ্কার করতে ছাড়েননি। তারই ফলে আজ তারা হয়েছেন অনন্ত শক্তির অধিকারী।
এই অধ্যাপকটিকে পথপ্রদর্শকরূপে পেয়ে দিনে দিনে আমি জ্ঞানরাজ্যের মধ্যে অনেক দূর অগ্রসর হয়ে গেলুম। অধ্যাপকের নিজের একটি পরীক্ষাগার ছিল, সেখানকার সমস্ত দুর্লভ যন্ত্রপাতি নিয়ে আমি কাজ করবার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হলুম না।
কেবল দিনের বেলায় পরীক্ষাগারে নয়, নিজের ঘরে বসেও প্রায় সারারাত ধরে আমি রাশি রাশি বৈজ্ঞানিক পুস্তক পাঠ ও গভীর চিন্তা করতুম। রসায়ন বিভাগে আমার দ্রুত অগ্রগতি দেখে অন্যান্য ছাত্ররা যেমন বিস্মিত হত, তেমনি আনন্দিত হতেন আমার অধ্যাপক। এইভাবে দুই বৎসর কেটে গেল।
আমার বিশ্ববিদ্যালয় ছিল দেশান্তরে। দুই বৎসরের মধ্যে বাড়ি ফেরবার কথা একবারও আমার মনে হয়নি—এমনি একান্তভাবে আমি নিমগ্ন হয়েছিলুম গভীর সাধনায়। এমনকি, ছুটির দিনেও আমি ছুটি নিতুম না।
একটা বিষয় সর্বদাই আমাকে আকৃষ্ট করত। সেটা হচ্ছে মানুষ এবং অন্যান্য জীবজন্তুর দেহের কাঠামো। মনে ক্রমাগত এই প্রশ্ন জাগত, জীব-জীবনের উৎস কোথায়? এমন প্রশ্ন কত লোকেরই মনে জাগে, কেউ কিন্তু সদুত্তর খুঁজে পায়নি। অথচ আমার বিশ্বাস, মানুষের মিথ্যা ভয়, কাপুরুষতা বা অবহেলা যদি তাকে বাধা না দিত, তাহলে হয়তো সে এক প্রশ্নের উত্তর লাভ করত অনেকদিন আগেই।
ভেবে দেখলুম, জীবনের কারণ অন্বেষণ করতে গেলে আগে আমাকে পরীক্ষা করতে হবে মৃত্যুকে। শরীর-সংস্থান বিদ্যা বা অ্যানাটমি সম্বন্ধে আমি অভিজ্ঞ ছিলুম। কিন্তু কেবল সেইটুকুই যথেষ্ট নয়। সেইসঙ্গে হাতেনাতে মানব দেহের ধ্বংস ও স্বাভাবিক বিকৃতিও লক্ষ করা উচিত। মনে মনে একটা সংকল্প করলুম। এ সংকল্পের কথা শুনলে সাধারণ মানুষ হয়তো শিউরে উঠবে। কিন্তু কোনওরকম অলৌকিক আতঙ্কই কোনওদিন আমাকে অভিভূত করতে পারেনি—এ শিক্ষা পেয়েছি আমি শৈশবে বাবার কাছ থেকে। ভূতের গল্প বা ভূতের আবির্ভাব, আমার কাছে এসব ছিল হাসির ব্যাপার।
আমাদের বাসার কাছে ছিল একটি গোরস্থান। এক গভীর রাত্রে চুপিচুপি আমি সেইদিকে যাত্রা করলুম। সঙ্গে নিলুম একটি চোরা লণ্ঠন ও শাবল।
গভীর রাত্রি। আকাশ নিশ্চন্দ্র। চারদিকে থমথমে অন্ধকার। মাঝে মাঝে পাচার ডাকে স্তব্ধতা জেগে উঠেই আবার ঘুমিয়ে পড়ছে।
গোরস্থানের ভেতরে গিয়ে দাঁড়ালুম। একটা মস্ত ঝুপসি গাছ হঠাৎ মড়মড় শব্দ করে উঠল—দমকা বাতাসের ধাক্কায়। কতকগুলো ঝিঝিপোকা আচমকা একসঙ্গে ডেকে উঠেই যেন কোনও বিভীষিকার সাড়া পেয়ে আবার চুপ মেরে গেল। কী একটা জীব শুকনো পাতার ওপরে সশব্দে পা ফেলে ছুটে পালিয়ে গেল—বোধহয় শেয়াল।
এসব দেখেশুনে আমার কিছুমাত্র ভাবান্তর হল না। গোরস্থান তো কেবলমাত্র সেইসব জীবনহীন দেহরক্ষার আধার-আগে যারা ছিল সৌন্দর্যে কমনীয় এবং এখন যারা হয়েছে কীটের খোরাক।
সেই রাত্রেই গোটা চারেক পুরানো ও নতুন কবর খুঁড়ে কতকগুলো অস্থিসার বা অর্ধগলিত বা প্রায় অবিকৃত মড়া বার করে লণ্ঠনের আলোতে পরীক্ষা করলুম।
এইভাবে আমার পরীক্ষা চলতে লাগল রাত্রির পর রাত্রি ধরে।
এইসব নরদেহ-কবিরা যাদের রূপ বর্ণনা করে আসছেন যুগ-যুগান্তর ধরে, এখানে। তাদের কী অবস্থা! মৃত্যু এসে হরণ করেছে তাদের সমস্ত রং-গড়ন, গতি-ভঙ্গির ছন্দ।
কিন্তু এদের মধ্যে কোথায় জীবনের সমাপ্তি এবং কোথায় মৃত্যুর আরম্ভ? কোন ফাঁক দিয়ে পলায়ন করেছে চঞ্চল জীবন এবং আবির্ভূত হয়েছে অসাড় মরণ? ভাবতে ভাবতে
আচম্বিতে প্রগাঢ় অন্ধকারের ভেতরে ফুটে উঠল এক অপূর্ব সত্যের বিচিত্র জ্যোতি!
আশ্চর্য সেই আলোক রহস্য—কিন্তু কত সহজ তার অর্থ! অবাক ও অভিভূত হয়ে ভাবতে লাগলুম, পৃথিবীর এত বড়ো বড়ো প্রতিভাধর এই একই রহস্য নিয়ে চিরকাল ধরে মস্তিষ্কচালনা করে এসেছেন, কিন্তু এমন সহজ অর্থটাও কারুর কাছে ধরা পড়েনি। আর আমি হচ্ছি জ্ঞান-রাজ্যের এক নগণ্য অতিথি, আমার কাছেই কিনা সেই চিরন্তন সত্য এমন অকস্মাৎ আত্মপ্রকাশ করলে!
ভাববেন না আমি পাগল! সত্য বলছি আমি আবিষ্কার করেছি জন্ম ও জীবনের কারণ! কেবল তাই নয়, এখন আমি জীবনহীন জড়ের মধ্যেও জীবন সঞ্চার করবার ক্ষমতা অর্জন করেছি।