পরের দিন আমার ঘুম ভাঙলো দেরিতে। ঘড়িতে দেখি বেলা সাড়ে দশটা বাজে। আমাদের ছেলেরা বারাসত থেকে ফিরে এসেছে। তাদের চিৎকার, কোলাহলই বলতে গেলে আমাকে ঘুম থেকে উঠিয়েছে। নইলে আমি আরো ঘুমোতে পারতাম। চোখ রগড়াতে রগড়াতে সিগারেটের প্যাকেটে দেখি একটাও সিগারেট নেই। মাসুমকে বললাম, দেতো একটা। টান দিতেই আমার চোখের দৃষ্টি সতেজ হয়ে উঠলো। মাসুমকে জিগ্গেস করলাম, কখন এলে, অন্যরা কোথায়, কেমন নাটক করলে? আমার মনে হলো সে কারো সঙ্গে কথা বলার জন্য অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করছিলো। বোঝা গেলো নরেশদার সঙ্গে কথা বলে বিশেষ যুত করতে পারেনি। কারণ তিনি বরাবর ঠাণ্ডা মানুষ। হঠাৎ করে কোনো ব্যাপারে অতিরিক্ত উৎসাহ প্রকাশ করতে পারেন না। মাসুম চাঙা হয়ে বললো, দানিয়েল ভাই, আপনি থাকলে দেখতেন কি ট্রিমেন্ডাস সাকসেস হয়েছে। আমরা ক্যারেকটরের মুখ দিয়ে এহিয়া ইন্দিরা এক হ্যায়’ এ শ্লোগান পর্যন্ত দিয়েছি। দর্শক শ্রোতারা কি পরিমাণ হাততালি দিয়েছে সে আমি প্রকাশ করতে পারবো না। আমি জানতে চাইলাম, অন্যান্যরা কোথায়? মাসুম জানালো, ক্ষীতিশ আর অতীশ টিফিন করে কলেজে চলে গেছে। বিপ্লব গেছে তার বোন শিখা আর দীপাকে মামার বাসায় রেখে আসতে। সালামটা তো পেটুক। এক সঙ্গে টিফিন করার পরও ফের খাবারের লোভে একজন সিপিএম কর্মীর সঙ্গে তার বাসায় গেছে। আমি বললাম, ওরা ফিরে এসেছে, একথা আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছে না। কেনো আপনি ওকথা বলছেন? সকলে এক সঙ্গে এসেছি, সবাই দেখেছে। বললাম, আমার কেমন জানি সন্দেহ হচ্ছে বারাসতের লোকেরা সবাইকে এক সঙ্গে খুন করে মাটির নিচে পুঁতে রেখে দিয়েছে। কেন, খুন করবে কেন, আমরা কি অপরাধ করেছি। আমি জবাব দিলাম, যদি খুন না করে থাকে এবং তোমরা এক সঙ্গে নিরাপদে ফিরে এসে থাকো, তাহলে ধরে নিতে হবে সেখানকার লোকেরা তোমাদের পাগলটাগল ঠাউরে নিয়েছিলো। সেজন্য কোনো কিছু করা অনাবশ্যক বিবেচনা করেছে। মাসুম বললো, অতো সোজা নয় খুন করা। আমরা তো রিফিউজি ক্যাম্পের ভেতরে নাটক করিনি। কে না জানে সেখানে কংগ্রেসের রাজত্ব। আমরা নাটক করেছি ক্যাম্প থেকে একটু দূরে। সিপিআই(এম) এর তৈরি করা স্টেজে। অথচ রিফিউজি ক্যাম্পের সমস্ত লোক নাটক দেখতে এসেছে। নাটক যখন চরম মুহূর্তটির দিকে এগুচ্ছিলো একজন সিপিএম কর্মী পরামর্শ দিলেন, দাদা এই জায়াগায় একটু প্রম্পট করে দিন এহিয়া ইন্দিরা এক হ্যায়। তাই দিলাম। কথাটা যখন চরিত্রের মুখে উচ্চারিত হলো, সে কি তুমুল করতালি আর গোটা মাঠ ভর্তি মানুষের মধ্যে কি তীব্র উত্তেজনা! জানেন তো বারাসত হলো সিপিআইএম-এর সবচে মজবুত ঘাঁটি। কংগ্রেসের মাস্তানরা এসে কোনো উৎপাত সৃষ্টির চেষ্টা যদি করতো, তাহলে একটাও জান লিয়ে পালিয়ে যেতে পারতো না। উত্তেজনার তোড়ে পানির জগটা মুখে নিয়ে ঢকঢক করে অনেকখানি পানি খেয়ে ফেললো। এরই মধ্যে মাসুমের উচ্চারণপদ্ধতির মধ্যে কোলকাতার লোকের মতো টানটোন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গালের বাঁ দিকটা মুছে নিয়ে সে বলতে আরম্ভ করলো, এহিয়া ইন্দিরার মধ্যে কি কোনো বেশ কম আছে। এহিয়ার সৈন্যরা সরাসরি খুন করছে। শ্রীমতি বাংলাদেশ ইস্যুটাকে নিয়ে লেজে খেলাচ্ছেন। এতে তাঁরই লাভ। বিরোধী দলগুলোকে কাবু করার এমন সুযোগ তিনি জীবনে কি আর কোনদিন পাবেন? নকশালদের তৎপরতা এখন কোথায়? এখন কোলকাতার রাস্তায় রাস্তায় বোমা ফাটে না কেনো? বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি ভারতীয় জনগণ বিশেষ করে পশ্চিম বাংলার জনগণের যে জাগ্রত সহানুভূতি ইন্দিরাজী সেটাকেই নিজের এবং দলের আখের গুছাবার কাজে লাগাচ্ছেন। এতোকাল সিপিএম বলতো শাসক কংগ্রেস বাংলাদেশের মানুষকে ধাপ্পা দিচ্ছে। তাদের দেশে ফেরত পাঠাবার কোনো বাস্তব কর্মপন্থা গ্রহণ করবে না। এখন সে কথা সবাই বলছে। এই তো সেদিন যুগান্তরের মতো কংগ্রেস সমর্থক পত্রিকায় বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়ের মতো প্রবীণ সাংবাদিকও লিখতে বাধ্য হয়েছেন, বাংলাদেশের মানুষদের দুঃখ-দুর্দশা তুঙ্গে উঠেছে। আর ওদিকে শ্রীমতি ইউরোপ, আমেরিকায় বাবু’ ধরে বেড়াচ্ছেন। মাসুমের কোলকাতায় এসে অনেক উন্নতি হয়েছে। তার মধ্যে একটি হলো জিভটি অত্যন্ত ধারালো এবং পরিষ্কার হয়েছে। এখন যে কোনো সভাসমিতিতে দাঁড় করিয়ে দিলে ঝাড়া আড়াই ঘন্টা লেকচার ঝাড়তে পারে।
আমি বাধা দিয়ে বললাম, তোমার এই মূল্যবান বক্তৃতার বাকি অংশ না হয় আরেকদিন শোনা যাবে। আজকে আমাকে অনেক কাজ করতে হবে। এখনো দাঁত মাজিনি। মুখ ধুইনি। কিছু মুখেও তো দিতে হবে। খালি পেটে কি আর লেকচার ভালো লাগে? স্পষ্টই মাসুম বিরক্ত হলো। তার জ্বলন্ত উৎসাহে বাধা পড়েছে। আপনি যতো বড়ো বড়ো কথাই বলুন না কেনো, ভেতরে ভেতরে একটি পেটি বুর্জোয়া। আমি বললাম, তোমার এই শ্রেণী বিশ্লেষণের কাজটিও আরেকদিন করতে হবে। আপাততঃ নরেশদা কোথায় আছেন, সংবাদটা জানিয়ে আমাকে বাধিত করো। কি জানি এখন কোথায় আছেন। কিছুক্ষণ আগে তো দেখলাম রাঁধুনি চিত্তের সঙ্গে ঘুটুর ঘুটুর করে কি সব কথাবার্তা বলছেন। দানিয়েল ভাই জানেন, এই নরেশদা লোকটার ওপর আমার ভয়ানক রাগ হয়। আপনার সঙ্গে তবু কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলা যায়, নরেশদা গাছের মতো মানুষ। কোনো ব্যাপারেই কোনো রিএ্যাকশন নেই।
আমি গামছাটা কাঁধে ঝুলিয়ে দাঁত ঘষতে ঘষতে বেরিয়ে গেলাম। চাপাকলের গোড়ায় দেখি কোনো ভিড় নেই। দুটো মাত্র চাপাকল একশো দেড়শো জন ছাত্রের প্রয়োজন মেটাবার পক্ষে মোটেই যথেষ্ট নয়। গোসলের সময়টিতেও একটা তীব্র কম্পিটিশন লেগে যায়। প্রথম প্রথম এখানে গোসল করতে আসতে ভীষণ অপ্রস্তুত বোধ করতাম। কারণ, হোস্টেলের ছাত্রদের অনেকেরই আসল নিবাস পূর্ববাংলা, তথা বাংলাদেশ। কারো কারো মা, ভাই, আত্মীয়স্বজন এখনো বাংলাদেশে রয়ে গেছে। তবে এ কথা সত্যি যে সংখ্যাগুরু মুসলমান সম্প্রদায়ের একটা অংশের অত্যাচারে এদের দেশ ছাড়তে হয়েছে। অনেকের গায়ে টোকা দিলেই গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, বরিশাল, ঝিনাইদহ এসকল এলাকার গন্ধ পাওয়া যাবে। জীবন্ত ছাগল থেকে চামড়া তুলে নিলে যে অবস্থা হয়, এদের দশাও অনেকটা সে রকম। কোলকাতা শহরে থাকে বটে, কিন্তু মনের ভেতরে ঢেউ খেলছে পূর্ববাংলার দীঘল বাঁকের নদী, আঁকাবাঁকা মেঠো পথ, হাটঘাট, ক্ষেতফসল, গরুবাছুর। আমি গোসল করতে গেলেই নিজেরা বলাবলি করতো, কীভাবে একজনের বোনকে মুসলমান চেয়ারম্যানের ছেলে অপমান করেছে। অন্যজন বলতে পাশের গায়ের মুসলমানেরা এক রাতের মধ্যে ক্ষেতের সব ফসল কেটে নিয়ে গেছে।
ছোটোখাটো একটি ছেলে তো প্রায় প্রতিদিন উর্দু পড়াবার মৌলবীকে নিয়ে নতুন কৌতুক রচনা করতো। ভাবতাম আমাকে নেহায়েত কষ্ট দেয়ার জন্যই এরা এসব বলাবলি করছে। অথচ মনে মনে প্রতিবাদ করারও কিছু নেই। প্রায় প্রতিটি ঘটনাই অক্ষরে অক্ষরে সত্য। উঃ সংখ্যালঘু হওয়ার কি যন্ত্রণা! তাদের কথাবার্তার ধরন দেখে মনে হতো সুলতান মাহমুদ, আলাউদ্দিন খিলজী থেকে শুরু করে আওরঙ্গজেব পর্যন্ত যতো অত্যাচার হিন্দুদের ওপর হয়েছে তার জন্য যেনো আমিই অপরাধী। মাঝে মাঝে ভাবতাম, বার্মা কি আফগানিস্তান কোথাও চলে যাওয়া যায় না।
এখন অবশ্য আমার নিজের মধ্যেই একটা পরিবর্তন এসেছে। যেখানেই পৃথিবীর দুর্বলের ওপর অত্যাচার হয়, মনে হয়, আমি নিজেও তার জন্য অল্প বিস্তর দায়ী। কেনো এসব অনুভূতি হয় বলতে পারবো না। এখন আমাকে সবাই সমাদর করে। আমি অসুস্থ মানুষ বলে কেউ কেউ আমাকে বালতিতে পানি ভরতি করে দিয়ে যায়। সম্যক পরিচয়ের অভাবই হচ্ছে মানুষে মানুষে হিংসা-বিদ্বেষের মূল।
আমি গোসল সেরে এসে দেখি, নরেশদা কাপড়চোপড় পরে একমাত্র কাঠের চেয়ারখানার ওপরে ব্যালকনির দিকে মুখ করে বসে রয়েছেন। ঘরে আমার পূর্বপরিচিত জয়সিংহ ব্যানার্জী তাঁর যজমানের মেয়েটিকে নিয়ে মুখ নিচু করে বসে আছেন। এই জয়সিংহ ব্যানার্জীর সঙ্গে বাংলাবাজারে আমার পরিচয়। একটা ছোটো বইয়ের দোকান চালাতো। ব্রাহ্মণ জানতাম। কিন্তু যজমানি পেশাটাও একই সঙ্গে করছে, জানতে পারলাম কোলকাতা এসে। প্রিন্সেপ স্ট্রীটে দেখা, সঙ্গে একটি মেয়ে। আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলো যজমানকন্যা। নরেশদা বোধ হয় জয়সিংহ ব্যানার্জী মানুষটিকে ঠিক পছন্দ করতে পারেননি। এই অপছন্দের কারণ, জিগগেস করতে যেয়েও করতে পারিনি। কতোজনের কতো কারণ থাকে। ওদের আজকে যে আসার কথা দিয়েছিলাম, সে কথা মনেই ছিলো না। আমার পায়ের শব্দে নরেশদা পেছনে ফিরে তাকালেন। এতো দেরি করলে যে। আমি বললাম, দেরি আর কোথায় করলাম। ঘুম থেকে উঠতেই দেরি হয়ে গেলো। তার ওপর মাসুমের আস্ত একখানি লেকচার হজম করতে হলো। টিফিন করতে যাবে না? সে কি আপনি সকাল থেকে কিছু না খেয়েই বসে আছেন? তিনি বললেন, তুমি কি মনে করো? মনে করাকরি নিয়ে কাজ নেই। চলুন।
জয়সিংহ ব্যানার্জীকে বললাম, আপনারা একটু অপেক্ষা করুন, এই আমরা কিছু খেয়েই চলে আসবো। নরেশদা বললেন, উনারাও সঙ্গে চলুক। আমাকে তো রুম বন্ধ করে যেতে হবে আর তো কেউ নেই। পাহারা দেবে কে? আমি যাবো আমার কাজে, তোমাকেও বোধ হয় বেরোতে হবে। অতএব কাপড়চোপড় পরে একেবারে তৈরি হয়ে নেয়াই উত্তম। মনে আছে তো তিনটের সময় তোমাকে কোথায় যেতে হবে? আমার শরীরে একটা প্রদাহ সৃষ্টি হলো। বললাম, চলুন, চলুন। রাস্তার ওপাশের ছোট্টো অবাঙালি দোকানটিতে যেয়ে পুরি তরকারি খেয়ে নিলাম। জয়সিংহ ব্যানার্জী এবং তাঁর যজমানকন্যা কিছুতেই খেতে রাজি হলেন না। তাঁরা বসে বসে আমাদের খাওয়া দেখলেন।
ঘুম থেকে ওঠার পর থেকেই দেখছি আকাশে বড়ো বড়ো মেঘ দৌড়াদৌড়ি করছে। তখনো মাটির ভাঁড়ের চা শেষ করিনি। ঘন কালো মেঘে কোলকাতার আকাশ ছেয়ে গেছে। একটু পরেই বড়ো বড়ো ফোঁটায় বৃষ্টি নেমে এলো। দেখতে দেখতে রাস্তায় জল দাঁড়িয়ে গেলো। আমাদের আর বেরুবার কোনো উপায় রইলো না। নরেশদা বললেন, এরপরে তুমি কোথায় যাবে? আমি বললাম, এদের নিয়ে প্রিন্সেপ স্ট্রীটে সোহরাব সাহেবের কাছে যাবো। তিনি যদি একটি স্লীপ ইস্যু করে দেন তাহলে এঁরা কোলকাতা শহরে থেকেই রেশন ওঠাতে পারবেন। তিনি জবাব দিলেন না। পাজামা অনেক দূর অবধি গুটিয়ে এই প্রচণ্ড বিষ্টির মধ্যেই, তোমরা একটু বসো, আমি ছাতাটি নিয়ে আসি-বলে বেরিয়ে গেলেন। গিয়ে আবার তিন চার মিনিটের মধ্যে ছাতাসহ ফিরে এলেন। জিগগেস করলাম, এতো বিষ্টির মধ্যে আপনি কোথায় চললেন? তিনি বললেন, শেয়ালদা। ওমা শেয়ালদা কেনো? মধ্যমগ্রামে গিয়ে প্রণব আর সুব্রত বাবুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আসি। আমার হাতে চাবি দিয়ে বললেন, ফিরতে একটু দেরি হতে পারে। চিত্তের সঙ্গে সব ব্যবস্থা করে রেখেছি। দেখবে তক্তপোষের নিচে দু’টো বাটি আর টেবিলের ওপর একটি ব্যাগ। ওসব ব্যাগের মধ্যে ভরে নিয়ে যাবে। আস্ত ব্যাগটাই তায়েবার কাছে রেখে আসবে। আর ধরে এই ত্রিশটা টাকা রইলো। তিনি হাঁটু অবধি পাজামা গুটিয়ে তুমুল বিষ্টির মধ্যে অদৃশ্য। হয়ে গেলেন।
মধ্যমগ্রামের সুব্রত বাবু নরেশদাকে স্কুলে একটা চাকরি দেবেন বলে কথা দিয়েছিলেন। সেই ভরসায় এই বিষ্টিবাদল মাথায় করে তিনি মধ্যমগ্রাম যাচ্ছেন। আমাদের বেঁচে থাকা ক্রমশ কঠিন এবং অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। ভেতর ভেতর কি তীব্র চাপ অনুভব করলেই না নরেশদার মতো আরামপ্রিয় স্থবির মানুষ শেয়ালদার রেলগাড়িতে এই ঝড়-জল তুচ্ছ করে ভিড় ঠেলাঠেলি উপেক্ষা করে মধ্যমগ্রাম পর্যন্ত ছুটে যেতে পারেন। বাইরে যতোই নির্বিকার হোন না কেনো, ভেতরে ভেতরে মানুষটা ভেঙ্গে খান খান হয়ে যাচ্ছে।
নরেশদা চলে যেতেই আমরা তিনজন অপেক্ষাকৃত হালকা বোধ করলাম। তার উপস্থিতির দরুন জয়সিংহ ব্যানার্জী স্বাভাবিক হতে পারছিলেন না। আমরা টুকটাক কথাবার্তা বলছিলাম। বাইরে বিষ্টি পড়ছে বলে তো আর দোকানে বসে থাকা যায় না। দোকানের মালিকের আড়চোখে চাওয়ার উপদ্রব থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আরো তিন ভড় চা চেয়ে নিলাম। একটু একটু করে চুমুক দিয়ে খাচ্ছিলাম। আমাদের ভাবখানা এই, বিষ্টি থামা অবধি এই ভাঁড় দিয়েই চালিয়ে যাবো। পঁচিশ পয়সা দামের চায়ের ভাড় তো আর সমুদ্র নয়। এক সময়ে শেষ হয়ে গেলো। কিন্তু বিষ্টি থামলো না। দোকানী এবার রুদ্রমূর্তি ধারণ করে বললো, বাবুজী এবার উঠতে হোবে। আমার দোসরা কাস্টমারকে জায়গা দিতে হোবে। আমি বললাম, এই বিষ্টির। মধ্যে আমি যাবো কেমন করে। দোকানী মোক্ষম জবাব দিলো, বাবু বিষ্টি তো আমি মন্তর পড়ে নামায়নি। আপনারা বোলছেন যাবো কেমন করে, ওই দেখুন। মাথা বাড়িয়ে দেখলাম, শতো শতো মানুষ এই প্রবল বিষ্টির মধ্যেও এদিক থেকে ওদিকে যাচ্ছে। ওদিক থেকে এদিকে আসছে। মেয়েদের শাড়ি, ব্লাউজ, পেটিকোট ভিজে শপ শপ করছে। ট্রাম বাস দাঁড়িয়ে গেছে, কিন্তু মানুষের নিরন্তর পথ চলার কোনো বিরাম নেই।
অগত্যা আমাদেরও উঠতে হলো। কিছুদূর গিয়ে একটা বাড়ির বোয়াকে কিছুক্ষণ দাঁড়ালাম। তারপর আর কিছুদূর গিয়ে রাজা সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারের বাঁকে ডঃ বিধান রায়ের বাড়ির কাছে চলে এলাম। কিন্তু বর্ষণের বেগ আমাদের থামতে দিচ্ছিলো না। আমরা আরেকটা চালার নিচে দাঁড়িয়ে চা খাওয়ার ছল করে আরেকটু আশ্রয় চুরি করলাম। চা খেতে খেতেই বিষ্টির বেগ একটু ধরে এলো। এই সুযোগেই আমরা প্রিন্সেপ স্ট্রীটের অফিসটিতে চলে এলাম। ভেতরে ঢোকার উপায় নেই। ঠেলাঠেলি, কনুই মারামারি করছে হাজার হাজার মানুষ। কিন্তু কেউ কাউকে পথ দিচ্ছে না। সকলেই অসহায়। সকলেই একটুখানি আশ্রয় চায়। অফিস বিল্ডিংয়ের পাশের খালি জায়গাটিতে প্রতিরাতে হাজার হাজার বাংলাদেশের তরুণ ঘুমোয়। একখানি চাদর বিছিয়ে লুঙ্গিটাকে বালিশ হিসেবে ব্যবহার করে কেউ কেউ। যার তাও নেই, কাঁকর বিছানো মাটিকেই শয্যা হিসেবে মেনে নিয়ে রাত গুজরান করে। এদের মধ্যে ট্রেনিং ক্যাম্পে যাওয়ার জন্য অপেক্ষমান তরুণ যেমন আছে, আছে ধাড়ী নিষ্কর্মার দল। চোরাচর, এমন কি কিছু কিছু সমকামী থাকাও বিচিত্র নয়। অন্যান্য দিন এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতো। গোটা সংখ্যাটা এক সঙ্গে দেখা যেতো না। আজ বাসাভাঙ্গা কাকের মতো সবাই অফিস বিল্ডিংটিতে একটুখানি ঠাই করে নিতে মরীয়া হয়ে চেষ্টা করছে। যেদিকেই তাকাই না কেন শুধু মাথা, কালো কালো মাথা। ওপরে ওঠা প্রথমে মনে হয়েছিলো অসম্ভব। ভিড়ের মধ্যে একটি আঙুল চালাবার মতোও খালি জায়গা নেই। কেমন করে যাবো। একটি মেয়ে বয়সে যুবতী তার গায়ের কাপড় ভিজে গায়ের সঙ্গে আঁটসাট হয়ে লেগে গেছে। এই অবস্থায় এতোগুলো মানুষ তাকে দেখছে, দেখে আমি নিজেই ভয়ানক লজ্জা পেয়ে গেলাম। এরই মধ্যে দেখি মানুষ ওপরে উঠছে এবং নিচে নামছে।
আমরাও একটা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ওপরে উঠে এলাম। কি করে ওপরে এলাম, সেটা ঠিক ব্যক্ত করা যাবে না। যে কষ্টকর প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সন্তান মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ট হয়, তার সঙ্গে এই ওপরে ওঠার কিঞ্চিৎ তুলনা করা চলে। অফিসের খোপ খোপ কাউন্টারগুলোতে আজ আর কোনো কাজ চলছে না। সর্বত্র মানুষ গিস গিস করছে। এখানে সেখানে মানুষ ঝক ঝক মৌচাকের মতো জমাট বেঁধে আছে। জয়সিংহ ব্যানার্জীকে বললাম, এতো কষ্ট করে আসাটা বৃথা হয়ে গেলো। এই ভিড় ঠেলাঠেলির মধ্যে আমি সোহরাব সাহেবকে খুঁজবো কোথায়? এই সময়ে দেখা গেলো তিন তলার চিলেকোঠার দরোজার পাল্লা দুটো ফাঁক হয়ে একটা হাত বেরিয়ে এসেছে এবং ইশারা করে ডাকছে। কাকে না কাকে ডাকছে, প্রথমে বিশেষ আমল দেইনি। সিঁড়িতেও মানুষ, তিল ধারণের স্থান নেই। লোকজন এই জলঅচল ভিড়ের মধ্যে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললো, এই যে, আপনাকে ওপরে ডাকা হচ্ছে। ওপরে গিয়ে দেখলাম সোহরাব সাহেব পাজামা হাঁটুর ওপর তুলে একটা হাতল ভাঙ্গা চেয়ারে বসে চারমিনার টানছেন আর শেখ মুজিবের মুণ্ডপাত করছেন। আমি অবাক হয়ে গেলাম। আজ বঙ্গবন্ধু শব্দটি তিনি উচ্চারণ করলেন না। আরেকজন ছাত্রনেতা নীরবে বসে বসে সোহরাব সাহেবের কথামৃত শ্রবণ করছে। ছাত্রনেতাটিরও হয়তো জরুরী কোনো ঠেকা আছে। অথবা হতে পারে সোহরাব সাহেবের খুব রিলায়েবল লোক। নইলে নির্বিবাদে এমন বিরূপ মুজিবচর্চা এই প্রিন্সেপ স্ট্রীটের অফিসে কেমন করে সম্ভব। আমি বললাম, চুটিয়ে তো নেতার সমালোচনা করা হচ্ছে। যদি আমি চিৎকার করে জনগণকে জানিয়ে দেই তখন বুঝবেন ঠেলাটা। তখখুনি আমার দৃষ্টি সোহরাব সাহেবের হাঁটুর দিকে ধাবিত হলো। যতোটুকু পাজামা গুটিয়েছেন, দেখা গেলো কালো কালো লোমগুলো সোজা দাঁড়িয়ে গেছে। একেবারে লোমের বন। ঘরে একজন মহিলা আছে দেখেও তিনি পাজামাটা ঠিক করে নিলেন না। বসার কোনো ব্যবস্থা ছিলো না। স্বল্প পরিসর কক্ষটিতে তাই দাঁড়িয়ে রইলাম। সোহরাব সাহেব বললেন, নেতাকে বকবো না তো কাকে বকবো। নেতার ডাকেই তো ঘর ছেড়ে বেরিয়েছি। আজকে আসার সময় দেখলাম, বাচ্চাটার পাতলা পায়খানা হচ্ছে। যে ঘরটিতে থাকি পানি উঠেছে। আর কতো কষ্ট করবো। এখন পাকিস্তানের সঙ্গে একটা মিটমাট করে ফেললেই হয়। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাই। আমি বললাম, আপনি যদি একথা বলেন, তাহলে গোটা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধটা দাঁড়াবে কিসের ওপর।
সোহরাব সাহেব বললেন, সাধে কি আর এরকম কথা মুখ দিয়ে আসে। কতোদিকে কতো কাণ্ড ঘটছে সেসবের হিসেব রাখেন? আমি বললাম, কোনো হিসেবই রাখিনে সোহরাব সাহেব। কি করে রাখবো। সোহরাব সাহেব আমার হাতে একটা লিফলেট দিয়ে বললেন, আপনি হার্মলেস মানুষ, তাই বিশ্বাস করে পড়তে দিচ্ছি। লিফলেটটি আগরতলা থেকে বেরিয়েছে। সংক্ষেপে তার মর্মবস্তু এ রকমঃ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানী সৈন্যের হাতে ধরা পড়বার আগে এক ঘরোয়া সভা ডেকেছিলেন। তাতে তিনি যদি পাকিস্তানী সৈন্যের হাতে ধরা পড়েন, কি কি করতে হবে সেসকল বিষয়ে আলোচনা হয়েছিলো। ওই সভায় একজন নাকি শেখ সাহেবের কাছে সাহস করে জিগগেস করছিলো, বঙ্গবন্ধু, আপনার অবর্তমানে আমরা কার নেতৃত্ব মেনে চলবো। শেখ সাহেব আঙুল তুলে শেখ মনিকে দেখিয়ে বলেছিলেন, তোমরা এর নেতৃত্ব মেনে চলবে। লিফলেটটা ফেরত দিলে তিনি পাঞ্জাবির পকেট হাতড়ে একটা জেন্ট সাইজের পকেট রুমালের মতো পত্রিকা বের করে আমার হাতে দিয়ে বললেন, এই দাগ দেয়া অংশটুকু পাঠ করুন। তারপর বিশুদ্ধ বাঙাল উচ্চারণে বললেন, নেতাকে কি আর সাধে গাইল্যাই। পত্রিকাটিও পড়ে দেখলাম। সংক্ষেপে সারকথা এই আগরতলাতে নেতৃত্বের দাবিতে দুই প্রতিদ্বন্দ্বি ছাত্রের দল একরকম সম্মুখসমরে অবতীর্ণ হতে যাচ্ছিলো। তার প্রতিবাদে আগরতলার মানুষ মিছিল করে জানিয়ে দিয়েছে ওই মাটিতে বাংলাদেশের মানুষদের মারামারি হানাহানি তারা বরদাস্ত করবে না। বাংলাদেশের মানুষ নিজেদের মধ্যে হানাহানি করতে চায় নিজেদের দেশে গিয়ে করুক। কাগজটা ফেরত দিয়ে সোহরাব সাহেব আমাকে জিগগেস করলেন, ভালো লেখেনি? আমি মাথা নাড়লাম। অনেকক্ষণ এক নাগাড়ে দাঁড়িয়ে থেকে পায়ে বাত ধরে গেছে। সুতরাং অধিক কথা না বাড়িয়ে বলে ফেললাম, সোহরাব সাহেব আপনার কাছে এদের জন্য একটা রেশনকার্ড ইস্যুর স্লীপ নিতে এসেছিলাম। আমি জয়সিংহ ব্যানার্জী এবং তার যজমানের মেয়ে সবিতাকে দেখিয়ে দিলাম। তিনি বললেন, আরে সাহেব আপনি আমায় মুসকিলে ফেললেন। এই ভিড় হট্টগোলের সময় আমি কাগজ কোথায় পাই, কি করে কলম জোগাড় করি। আমি পকেট থেকে কাগজ কলম বের করে বললাম, এই নিন, আপনি লিখে দিন। তিনি খসখস করে গদবাধা ইংরেজিতে লিখে দিলেন, প্লীজ ইস্যু রেশন কার্ড ফর মি, সো এন্ড সো… ইত্যাদি, ইত্যাদি। কাগজটা আমার হাতে দিয়ে বললেন, বাঁদিকের কাউন্টারে যে লোক বসে তাকে দেখলে এই স্লীপটা দিয়ে দেবেন। ওরা চলে গেলো। আমরা আরো কিছুক্ষণ গল্পগাছা করলাম। এরই মধ্যে বিষ্টি ধরে এসেছে। তবে মেঘ কাটেনি। ঘড়িতে দেখলাম একটা বাজে। আমাকে উঠতে হলো। দোতলায় নেমে দেখি আবদ্ধ মানবণ্ডলীর মধ্যে চলাচলের একটা সাড়া পড়ে গেছে। একটানা অনেকক্ষণ আবদ্ধ থাকার পর মানুষের মধ্যে একটা চলমানতার সৃষ্টি হয়েছে। দেখতে দেখতে ভিড় অনেকটা হাল্কা হয়ে এলো। নিচে নেমে এলাম। রাস্তায় পানি নামতে অনেক সময় লাগবে, তাও যদি আবার বিষ্টি না হয়। এখন আমি কি করবো চিন্তা করছি। এমন সময় পিস্তলের আওয়াজের মতো একটা তীক্ষ্ণ তীব্র কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। এই যে দাদা আপনাকে একটা কথা জিগাইরার লাইগ্যা ডাক্তার রায়ের বাড়ি থেইক্যা ফলো করছি। আমি তাকিয়ে দেখলাম, লোকটার গাত্রবর্ণ ধানসেদ্ধ হাড়ির তলার মতো কৃষ্ণবর্ণ। মুখে দাঁড়িগোঁফ গজিয়েছে। পরনে একখানি ময়লা হাঁটু ধুতি। গায়ের জামাটিও ময়লা। একেবারে আদর্শ জয়বাংলার মানুষ। কিছুক্ষণ তাকিয়েও কোনো হদিশ করতে পারলাম না, কে হতে পারে। লোকটি বললো, আমারে আপনে চিনতে পারছেন না দাদা, আমি বাংলা বাজারের রামু। ওহ্ রামু, তুমি কেমন আছো? দাদা ভগবান রাখছে। তোমার মা বাবা সবাই ভালো। দাদা, মা বাবার কথা আর জিগাইবেন না। সব কটারে দেশের মাটিতে রাইখ্যা আইছি। রামু হু হু করে কেঁদে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। এটা কোনো নতুন ঘটনা নয়। প্রতিটি হিন্দু পরিবারেরই বলতে গেলে এরকম একেকটা করুণ ভয়ঙ্কর কাহিনী আছে। এসব কথা শুনতে বিশেষ ভালো লাগে না। কারণ আমি তো ভুক্তভোগী নই। তথাপি কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলাম। পরক্ষণেই রামু আমাকে ছেড়ে দিয়ে সটান সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রেখে সরাসরি জানতে চাইলো। দাদা জয়সিংহ ঠাকুরের লগে আপনার এতো পিরিত কিয়ের। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। মনে মনে রামুকে ধন্যবাদ দিলাম। একটা পীড়াদায়ক অস্বস্তিকর পরিস্থিতি থেকে আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে রামু। বললাম, রামু পিরিত-টিরিত কিছু নয়। জয়সিংহ তাঁর যজমানের মেয়েকে নিয়ে খুব অসুবিধেয় পড়েছেন। আমাকে ধরেছেন একটা রেশন কার্ডের স্লিপ করিয়ে দেবার জন্য। তা করিয়ে দিলাম। মেয়েটির নাকি আর কোনো অভিভাবক নেই। তাই তাকে পোষার দায়িত্ব জয়সিংহের ঘাড়ে এসে পড়েছে। অন্যায় কিছু করেছি রামু? রামু এবারে রাগে ফেটে পড়লো। শালা বদমাইশ বাউন, মা আর বুন দুইডা ক্যাম্পে কাঁইদ্যা চোখ ফুলাইয়া ফেলাইছে। আর হারামজাদা মাইয়াডারে কইলকাতা টাউনে আইন্যা মজা মারবার লাগছে। আর ওই মাগীডাও একটা খানকী। বুঝলেন দাদা এই খবরটা আপনেরে জানান উচিত মনে কইর্যা পাছু ধরছিলাম। তারপর উত্তরের কোনো পরোয়া না করে রামু হাঁট ধুতিটা আরো ওপরে তুলে রাস্তায় পানির মধ্যে পা চালিয়ে হন হন করে চলে গেলো। হঠাৎ করে আমার খুব রাগ হচ্ছিলো। কাউকে খুন করে ফেলার ইচ্ছে জাগছিলো। করার মতো কিছু না পেয়ে রেগে দাঁতে অধর চেপে দাঁড়িয়ে রইলাম। একটু পরে থুতনির কাছে তরল পদার্থের অস্তিত্ব অনুভব করে আঙ্গুল দিয়ে দেখি, রক্ত। আমার অধর কেটে গিয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় লাল রক্ত বেরিয়ে আসছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম।
.
০৪.
হোস্টেলে পৌঁছুতে বেলা দুটো বেজে গেলো। ক্ষীতিশ কলেজ থেকে ফিরেছে। বললো, দাদা, মেজদা নাকি চিত্তকে কি সব রান্নাবান্না করার ফরমায়েশ দিয়ে গেছে। চিত্ত বারে বারে খুঁজছে। আমি বাইরে থেকে খেয়ে এসেছি। নইলে নিজেই কবে খেয়ে নিতাম। ব্যাপার জানেন নাকি কিছু? বললাম, হ্যাঁ ক্ষীতিশ, একজন রোগীর জন্য কিছু খাবার রান্না করে নিতে হবে হাসপাতালে। যদি এরই মধ্যে রান্না হয়ে গিয়ে থাকে তুমি একটু কষ্ট করে ভাত আর মাছ আলাদা আলাদাভাবে এই বাটিটার মধ্যে ভরে দিতে বলল। তক্তপোষের তলা থেকে আমি ছোট্টো বাটিটা বের করে ক্ষীতিশের হাতে দিলাম। অল্পক্ষণ পর ক্ষীতিশ ভাত তরকারি ভর্তি বাটিটা নিয়ে এলে আমি পেটমোটা হাতব্যাগটা টেনে নিয়ে আস্ত বাটিটা ব্যাগের পেটের ভেতর ঢুকিয়ে রাখলাম। ক্ষীতিশ জিগগেস করলো, দাদা কি এখনই বেরুবেন। আমি বললাম, হা ক্ষীতিশ, আমাকে এখুনিই বেরুতে হচ্ছে। কতোদূর যাবেন? পিজি হাসপাতাল। ক্ষীতিশ বললো, শহরে কোনো ট্রাম বাস চলছে না, রাস্তায় এক কোমর জল। আকাশের দিকে চেয়ে দেখুন, যে কোনো সময়ে বিষ্টি নামতে পারে। ব্যালকনির দিকে দরোজা জানালা খুলে দিলো। কালো মেঘ কোলকাতার আকাশের চার কোণ ছেয়ে একেবারে নিচে নেমে এসেছে।ট্রাম বাস ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। হাতে টানা রিকশাগুলো ডিঙিনৌকার মতো চলাফেরা করছে। বাস্তবিকই পথে বেরুবার পক্ষে মোটেই অনুকূল নয়। তথাপি মানুষ চলাচল করছে। মহিলারা মাথায় ছাতা মেলে ধরছে বটে, কিন্তু অনেকেরই পরনের শাড়ি কোমর অবধি ভিজে গেছে। আমি বললাম, যেতেই হবে আমাকে। তুমি বরং একটা উপকার করো। নিচের কোনো দোকান থেকে সস্তায় একটা জয়বাংলা বর্ষাতি কিনে এনে দাও। বিশটি টাকা বের করে তার হাতে তুলে দিলাম। সে আর কোনো কথা না বাড়িয়ে টাকাটা নিয়ে চলে গেলো।
ইত্যবসরে আমি একটা পুরোনো প্যান্ট পরে হাঁটু অবধি গুটিয়ে নিলাম। দেশ থেকে এক জোড়া জুতো এনেছিলাম। কোলকাতায় আসার পর বিশেষ পরা হয়নি। সেটা পরে নিলাম। স্যাণ্ডেল জোড়ার যে অবস্থা হয়েছে আশঙ্কা করছিলাম পানির সঙ্গে যুদ্ধে পেরে উঠবে না। ক্ষীতিশ বর্ষাতি কিনে এনে দিলে পরে নিয়ে ব্যাগ হাতে বেরিয়ে পড়লাম। পথে নামতেই আবার ঝম ঝম করে বিষ্টি নামলো। বর্ষণের বেগ এতো প্রবল, পাঁচ হাত দূরের জিনিসও ঝাপসা কুয়াশার মতো দেখাচ্ছে। ফুটপাত দিয়ে চলতে গিয়ে পর পর দু’জন পথচারীর সঙ্গে ধাক্কা লাগিয়ে ফেললাম। রাস্তা পানিতে ফুলে ফেঁপে একটা ছোটো খাটো বাঁকা নদীর মতো দেখাচ্ছে। এই কোমর পানির মধ্যে চলতে গিয়ে আমার মনে হলো শরীরে মনে যেন আমি কিছুটা কাঁচা হয়ে উঠেছি। এই ধারাজল আমার শরণার্থী জীবনের সমস্ত কালিমা ধুয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আশ্চর্য একটা সুড়সুড়ি অনুভব করছিলাম। আমি যেনো আবার সেই ছোট্টো শিশুটি হয়ে গেছি। মনে পড়ে গেলো বাড়ির পাশের খালটিতে কি আনন্দেই না সাঁতার কাটতাম। ছাত করে মনে পড়ে গেলো। একবার ঝড়বিষ্টির মধ্যে ভিজেচুপসে তায়েবাদের গেন্ডারিয়ার বাড়িতে হাজির হয়েছিলাম। তায়েবা দরোজা খুলে আমাকে দেখে রবীন্দ্রনাথের সে গানটির দুটো কলি কি আবেগেই না গেয়ে উঠেছিলো–
‘আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার, পরান সখা বন্ধু হে আমার’
সেদিন আর আজ। আমি রাস্তার মাঝখান দিয়ে হাঁটছি। প্রতি পদক্ষেপে অতীত, আমার আর তায়েবার অতীত, মনের মধ্যে ঢেউ দিয়ে জেগে উঠছে।
ওর সঙ্গে আমার পরিচয় উনিশো আটষট্টি সালে। সেদিনটার কথা এখনো আমার স্পষ্ট মনে আছে। মৃত্যুর মুহূর্তেও ভুলতে পারবো না। আগস্ট মাসে একটা দিনে প্রচণ্ড গরম পড়েছিলো। আমি গিয়েছিলাম বাঙলা বাজারের প্রকাশক পাড়ায়। নানা কারণে মনটা বিগড়ে গিয়েছিলো। সুনির্মলদা আমাকে বললেন, চলো একটা জায়গা ঘুরে আসি। হেঁটে হেঁটে গেন্ডারিয়ার লোহারপুল পেরিয়ে বুড়িগঙ্গার পারের একটা ছোট্টো একতলা বাড়ির সামনে এসে সুনির্মলদা বললেন, তুমি এখানে একটু দাঁড়াও, আমি দেখি ভেতরে কেউ আছে কিনা। তিনি এগিয়ে গিয়ে দরোজায় কড়া নাড়তে লাগলেন। দরোজার পাল্লা দুটো ফাঁক হয়ে গেলো। সুনির্মলদা ভেতরে ঢুকলেন। আমাকে হাত নেড়ে ডাকলেন, এসো দানিয়েল। আমিও ভেতরে প্রবেশ করলাম। সুনির্মলদা বললেন, দেখো তায়েবা কাকে ধরে নিয়ে এসেছি। সাদা শাড়ি পরিহিতা উজ্জ্বল শ্যামল রঙের মহিলাটি আমাকে ঘাড়টা একটুখানি দুলিয়ে সালাম করলো। সুনির্মলদা তক্তপোষের সাদা ধবধবে চাঁদরের ওপর পা উঠিয়ে বসলেন। মহিলাটি বললেন, আপনিও পা উঠিয়ে বসুন। ক্ষুণ্ণকণ্ঠে বললাম, আমার পায়ে অনেক ময়লা। আপনার আস্ত চাদরটাই নষ্ট হয়ে যাবে, বরঞ্চ আমাকে একটা অন্যরকম আসন দিন। আপনি যদি কিছু মনে না করেন, একটা কথা বলি। আপনি পাটা ধুয়েই বসুন। আমি পানি এনে দিচ্ছি। এক বদনা পানি এনে দিলে আমি পা দু’টো রগড়ে পরিষ্কার করে বিছানার ওপর বসেছিলাম। স্পষ্ট মনে আছে, সেদিন আমি একটা পাটভাঙ্গা সাদা পাঞ্জাবি পরেছিলাম। কি একখানা লাল মলাটের বই সারাক্ষণ বুকের সঙ্গে আঁকড়ে ধরেছিলাম। ঘামেভেজা পাঞ্জাবির বুকের অংশে মলাটের লাল রঙটা গাঢ় হয়ে গিয়েছিলো। মহিলাটি আমার পাঞ্জাবির দিকে তাকিয়ে জিগগেস করলো, ওমা আপনার পাঞ্জাবিতে এমন খুন খারাবীর মতো রঙ দিয়েছে কে? আমি ঈষৎ অপ্রস্তুত হয়ে বললাম, কেউ দেয়নি। কখন বইয়ের মলাটের রঙটা পাঞ্জাবিতে লেগে গেছে খেয়াল করিনি। লক্ষণ সুবিধের নয় বলে মহিলাটি সুন্দর সাদা দাঁত দেখিয়ে হাসলো। ফুলদানীতে একটি সুন্দর রজনীগন্ধার গুচ্ছ। তার হাসিটি রজনীগন্ধার মতো সুন্দর স্নিগ্ধ ঘাড়টাও রজনীগন্ধার মতো ঈষৎ নোয়ানো।
আমি ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম, ঘরে বিশেষ আসবাবপত্তর নেই। তক্তপোষের ওপর হারমোনিয়াম, তবলা এবং তানপুরা। পাশে পড়ার টেবিল। সামনে একখানি চেয়ার। শেলফে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু পাঠ্য বই। একেবারে ওপরের তাকে সেই চমকার চারকোণা ফুলদানিটি, যার ওপর শোভা পাচ্ছে সদ্যচ্ছিন্ন রজনীগন্ধার গুচ্ছ। মনে মনে অনুমান করে নিলাম, এ বাড়িতে গানবাজনার চল আছে। এ বাড়ির কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে। এই ঘরজোড়া তক্তপোষটিতে নিশ্চয়ই একের অধিক মানুষ অথবা মানুষী ঘুমায়।
সুনির্মলদা বললেন, দানিয়েলের সঙ্গে এখনো পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়নি। দানিয়েল, এ হোল আমাদের বোন তায়েবা। আর ও হচ্ছে দানিয়েল, অনেক গুণ, কালে কালে পরিচয় পাবে। তবে সর্বপ্রধান গুণটির কথা বলে রাখি–ভীষণ বদরাগী। নাকের ওপর দিয়ে মাছি উড়ে যাওয়ার উপায় নেই, দু’টুকরো হয়ে যায়। তায়েবা সায় দিয়ে বললো, বারে যাবে না, যা খাড়া এবং ছুঁচোলো নাক। মহিলা আমার তারিফ করলো কি নিন্দে করলো সঠিক বুঝতে পারলাম না। কিছুক্ষণ পরে আরো দু’জন মহিলা এসে ঘরে ঢুকলো। মুখের আদলটি তায়েবারই মতো। তবে একজনের রঙ একেবারে ধবধবে ফর্সা। তার পরনে শাড়ি। আরেক জন অতো ফর্সা নয়, কিছুটা মাজা মাজা। তার পরনে শালোয়ার কামিজ। তায়েবা পরিচয় করিয়ে দিলো। শালোয়ার পরিহিতাকে দেখিয়ে বললো, এ হলো আমার ইমিডিয়েট ছোটো বোন। নাম দোলা। বিএ পরীক্ষা দেবে। খেলাধুলার দিকে ওর ভীষণ ঝোঁক। আর ও হচ্ছে তার ছোটটি নাম ডোরা। গানবাজনা করে। সুনির্মলদা আপনারা কথাবার্তা বলুন, কিছু খাবার দেয়া যায় কি না দেখি।
সেদিন গেন্ডারিয়ার বাসা থেকে ফিরে আসার সময় দেখি আকাশে একখানা চাঁদ জ্বলছে। আমি পাঞ্জাবির বুকের লালিয়ে যাওয়া অংশটি বার বার স্পর্শ করে দেখছিলাম। একি সত্যি সত্যি বইয়ের মলাটের রঙ নাকি হৃদয়ের রঙ, রক্ত মাংস চামড়া ভেদ করে পাঞ্জাবিতে এসে লেগেছে। আমার মনে হয়েছিলো, ওই দূরের রূপালী আভার রাত আমার জন্যই এমন অকাতরে কিরণধারা বিলিয়ে হৃদয় জুড়োনো সুবাস ঢালছে। আজ সুনির্মলদার বিরুদ্ধে আমার অনেক নালিশ। তবু, আমি তাকে পুরোপুরি ক্ষমা করে দিতে পারবো, কেনোনা তিনি আমাকে বুড়ীগঙ্গার পাড়ে তায়েবাদের সে গেন্ডারিয়ার বাসায় নিয়ে গিয়েছিলেন।
এসপ্ল্যানেড ছাড়িয়ে বাঁক ঘুরে রবীন্দ্রসদন অভিমুখী রাস্তাটা ধরতেই পানির প্রতাপ কমে এলো। বিষ্টি হচ্ছে, তথাপি রাস্তাঘাটে জল দাঁড়ায়নি। এতোক্ষণে কেমন ঝোঁকের মাথায় এতদূর চলে এসেছি। এখন নিজের দিকে তাকাতে একটু চেষ্টা করলাম। প্যান্টে নিশ্চয়ই পঁচাপানির সঙ্গে কোলকাতার যাবতীয় ময়লা এসে মিশেছে। লোমকূপের গোড়ায় গোড়ায় এখন থেকেই চুলকোতে শুরু করেছে। বর্ষাতিটা গায়ের সঙ্গে লেপ্টে গেছে। সস্তার তিন অবস্থার এক অবস্থা প্রথম দিনেই প্রত্যক্ষ করা গেলো। এখানে সেখানে ছড়ে গেছে। পায়ের নীচের জুতো জোড়ার অবস্থা ভুলে থাকার চেষ্টা করছি, কিন্তু পারছিনে। প্রতি পদক্ষেপেই অনুভব করছি, বৃষ্টিতে গলে যাওয়া এঁটেল মাটির মতো সোলটা ফকফকে হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে আরেকবার সামনে চরণ বাড়ালেই সোল দুটো আপনা থেকেই পাকা ফলের মতো খসে পড়বে। নিজের ওপর ভয়ানক করুণা হচ্ছিলো। সিগারেট খাওয়ার তেষ্টা পেয়েছে। প্যান্টের পকেট থেকে সিগারেট আর ম্যাচ বের করে দেখি ভিজে একবারে চুপসে গেছে। দুত্তোর ছাই, রাগ করে সিগারেট ম্যাচ দুটোই ড্রেনের মধ্যে ছুঁড়ে দিলাম।
হাসপাতালের গেট খুলতে এখনো প্রায় আধঘন্টা বাকি। এ সময়টা আমি কি করি। মুষলধারে বিষ্টি ঝরছে। ধারে কাছে কোনো রেস্টুরেন্টও নেই যে বসে সময়টা পার করে দেয়া যায়। মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেলো। দারোয়ানের কাছে গিয়ে বললাম, ডঃ মাইতির সঙ্গে দেখা করতে যাবো। আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে দারোয়ানের বুঝি দয়া হলো। সে ঘটা করে লোহার গেটের পাল্লা দুটো আলাদা। করলো। আমি ফাঁক দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লাম।
তায়েবার কেবিনে ঢুকে দেখি, সে শুয়ে আছে। পাশের বেডের উৎপলা আজও হাজির নেই। তায়েবা কি ঘুমিয়ে পড়েছে, নাকি এমনিতে চোখ বন্ধ করে আছে। মস্তবড়ো পড়ে পড়ে গেলাম। আয়া টায়া কিংবা নার্স জাতীয় কাউকে খোঁজ করার জন্য করিডোরের দিকে গেলাম। আমার সিক্ত জুতো থেকে ফাঁস ফাঁস হাঁসের ডাকের মতো এক ধরনের আওয়াজ বেরিয়ে আসছে। আর প্যান্ট থেকে পানি পড়ে ধোয়া মোছা তকতকে মেঝে ভিজিয়ে দিচ্ছে। এ অবস্থায় কেউ আমাকে দেখে হাসপাতালের পরিচ্ছন্নতা নষ্ট করার অপরাধে যদি ঘাড় ধরে বের করে দেয় আমার বলার কিছুই থাকবে না। এক সময় তায়েবা চোখ মেলে জিগগেস করলো, কে? আমি তার সামনে যেয়ে দাঁড়ালে খুব গম্ভীর গলায় পরম সন্তোষের সঙ্গে বললো, ও দানিয়েল ভাই, আপনি এসেছেন তাহলে। আমি সেই পেটমোটা ব্যাগটা তার হাতে গছিয়ে দিয়ে বললাম, এর মধ্যে ভাত-মাছ রান্না করা আছে। সে ব্যাগটা স্টীলের মিটসেফের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখলো। খুশিতে তার চোখজোড়া চিকচিক করে উঠলো। দানিয়েল ভাই বসুন, টুলটা দেখিয়ে দিলো। তারপর আমার আপাদমস্তক ভালো করে তাকাতেই শক লাগার মতো চমক খেয়ে বিছানার ওপরে উঠে বসলো। একি অবস্থা হয়েছে আপনার দানিয়েল ভাই, সব দেখি ভিজে একেবারে চুপসে গেছে। আমি বললাম, বারে ভিজবে না, রাস্তায় এক কোমর পানি ভেঙ্গেই তো আসতে হলো। তায়েবা জানতে চাইলো, এ বিষ্টির মধ্যে সব পথটাই কি আপনি হেঁটে এসেছেন। আমি বললাম, উপায় কি? ট্রাম বাস কিছুই তো চলে না। তাছাড়া ট্যাক্সীতে চড়া সেতো ভাগ্যের ব্যাপার। সহসা তার মুখে কোনো কথা জোগালো না। বিছানা থেকে নেমে বাথরুমে গিয়ে একটি বড়োসরো তোয়ালে আমার হাতে দিয়ে বললো, আপাততঃ গায়ের ওই কিম্ভুত কিমাকার জন্তুটা এবং পায়ের জুতো জোড়া খুলে গা মাথা ভালো করে মুছে নিন। আমি দেখি কি করা যায়। সে গোবিন্দের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে একেবারে করিডোরের শেষ মাথায় চলে গেলো। গায়ের বর্ষাতিটা খোলার পর ফিতে খুলে জুতাজোড়া বের করার জন্য যেই একটু মৃদু চাপ দিয়েছি অমনি সোল দুটো আপসে জুতো থেকে আলাদা হয়ে গেলো। আমার ভয়ানক আফশোস হচ্ছিলো। এই এক জোড়া জুতো অনেকদিন থেকে বুকের পাঁজরের মতো কোলকাতা শহরের জলকাদা-বিষ্টির অত্যাচার থেকে রক্ষা করে আসছিল। আজ তার পরমায়ু শেষ হয়ে গেলো। গা মোছার কথা ভুলে গিয়ে একদৃষ্টে খসে পড়া সোল দু’টোর দিকে তাকিয়ে রইলাম।
এই সময়ের মধ্যে গোবিন্দকে সঙ্গে নিয়ে তায়েবা ফিরে এলো। সে গোবিন্দকে কি একটা ব্যাপারে অনুরোধ করছে। আর গোবিন্দ বারে বারে মাথা নেড়ে বলছে, না। দিদিমণি, সে আমাকে দিয়ে হবে না। দেখছেন কেমন করে বিষ্টি পড়ছে। দোকান পাট সব বন্ধ। তাদের কথা ভালো করে কানে আসছিলো না। আমি জুতো জোড়ার কথাই চিন্তা করছিলাম। তায়েবা গোবিন্দের কানের কাছে মুখ নিয়ে কি একটা বলতেই তাকে অনেকটা নিমরাজী ধরনের মনে হলো। বললো, টাকা আর ছাতার ব্যবস্থা করে দিন। আমার খুব ভয় লাগছিলো, পাছে তায়েবা আমাকে কোনো টাকা পয়সা দিতে বলে, আসলে আমার কাছে বিশ বাইশ টাকার অধিক নেই এবং টাকাটা খরচ করারও ইচ্ছে নেই। পঞ্চাশ নয়া পয়সা ট্রাম ভাড়া বাঁচাবার জন্য দৈনিক চার ছয় মাইল পথ অবলীলায় হেঁটে চলাফেরা করছি ইদানীং। আমার জুতোর খসে পড়া সোল দু’খানি তায়েবার দৃষ্টি এড়ালো না। জিগগেস করলো, কি হলো আপনার জুতোয়? আমি বললাম, কোলকাতায় পানির সঙ্গে রণভঙ্গ দিয়ে এই মাত্র জুতোজোড়া ভবলীলা সাঙ্গ করলো। সে বালিশের তলা থেকে একটা পার্স বের করে আপন মনে টাকা গুণতে গুণতে উচ্চারণ করলো, ও তাহলে এই ব্যাপার। কেবিনের বাইরে গিয়ে গোবিন্দের সঙ্গে নিচু গলায় আবার কি সব আলাপ করলো। ভেতরে ঢুকে আমাকে বললো, আপনার সেই জন্তুটা একটু দিন, গোবিন্দ একটু বাইরে থেকে আসবে। গোবিন্দের হাতে নিয়ে বর্ষাতিটা দিলো। গোবিন্দ হাঁটা দিয়েছে, এমন সময় ডাক দিয়ে বললো, গোবিন্দদা এক মিনিট দাঁড়াও। আমার কাছে এসে জানতে চাইলো আপনার তো সিগারেট নেই। আমি বললাম, না। কি সিগারেট যেনো আপনি খান। চারমিনার। এই ছাইভস্ম কেননা যে টানেন। সে দরোজার কাছে গিয়ে বললো, গোবিন্দ, ওখান থেকে পয়সা দিয়ে এক প্যাকেট চারমিনার আর একটা ম্যাচ আনবেন। তারপর তায়েবা বাথরুমে যেয়ে পা দুটো পরিষ্কার করে এসে কোনো রকমে নিজেকে বিছানার ওপর ছুঁড়ে দিলো। স্যাণ্ডেল না পরে সে বেরিয়ে গিয়েছিলো, এটা সে নিজেই খেয়াল করেনি। এই হাঁটাহাঁটি ডাকাডাকিতে নিশ্চয়ই তার অনেক কষ্ট হয়েছে। সেদিন আমি ভুল করেছিলাম। আসলে তায়েবা সে আগের তায়েবা নেই। একটুকুতেই হাঁপিয়ে ওঠে। এখন সে বিছানায় পড়ে আছে শীতের নিস্তরঙ্গ নদীর মতো। চুপচাপ শান্ত স্থির।
আমার কেমন জানি লাগছিলো। খুব ম্লান কণ্ঠে ধীরে ধীরে বললো, দানিয়েল ভাই জানেন, জীবনে আপনি খুব বড়ো হবেন। তার গলার আওয়াজটা যেনো অনেক দূর থেকে ভেসে আসছিলো। কণ্ঠস্বরে চমকে গেলাম। তবুও রসিকতা করে বললাম, বড়ো তো আর কম হইনি, এখন বুড়ো হয়ে মরে যাওয়াটাই শুধু বাকি। আপনি সবসময় কথার উল্টো অর্থ করেন। থাক, আপনার সঙ্গে আর কথা বলবো না। এমনিতেও আমার বিশেষ ভালো লাগছে না। সে হাঁ করে নিশ্বাস নিতে লাগলো। আমি জানতে চাইলাম, তায়েবা আজ তোমার শরীরটা কি খুব খারাপ? না না অতো খারাপ নয়। দেখছেন না কি নোংরা বিষ্টি। তাছাড়া আমাকে আজ আবার ইঞ্জেকশন দিয়েছে। যেদিন ইঞ্জেকশন দেয় খুবই কষ্ট হয়। অনেকক্ষণ ধরে দিতে হয়তো। আমি বললাম, ঠিক আছে, কথা না বলে চুপ করে থাকো। সারাদিন তো চুপ করেই আছি। একবার মাত্র মাইতিদা এসেছিলেন সেই ইঞ্জেকশন দেয়ার সময়। তারপর থেকেই তো একা বসে আছি। কথা বলবো কার সঙ্গে। উৎপলার সঙ্গে টুকটাক কথা বলে সময় কাটাতাম। কাল শেষ রাত থেকে তার অসুখটা বেড়েছে তাই তাকে ইনটেনসিভ কেয়ারে নিয়ে গেছে। আজ সকালে আমাদের ওয়ার্ডের পঁয়তাল্লিশ নম্বরের হাসিখুশী ভদ্র মহিলাটি মারা গেছেন। আমার কি যে খারাপ লাগছে। মনে হচ্ছে দম বন্ধ হয়ে আমিও মারা যাবো। প্রতিদিন এখানে কেউ না কেউ মরছে। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় ছুটে পালিয়ে যাই কোথাও। আমি বললাম, কোথায় যেতে চাও তায়েবা। সে জবাব দিলো জানিনে। হঠাৎ তায়েবা আমার ডান হাতখানা ধরে বললো, আচ্ছা দানিয়েল ভাই, আপনার মনে আছে একবার ঝড়বিষ্টিতে ভিজে সপসপে অবস্থায় আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন। আমি বললাম, কি আশ্চর্য তায়েবা, আসার সময় পথে সে কথাটি আমারও মনে পড়েছে। সে উৎফুল্ল হয়ে ওঠার চেষ্টা করে বললো, বুঝলেন দানিয়েল ভাই, আপনার সঙ্গে আমার মনের গোপন চিন্তার একটা মিল রয়েছে। তায়েবা গুনগুন অস্কুটস্বরে সে গানের কলি দু’টো গাইতে থাকলো। আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার, পরান সখা বন্ধু হে আমার।
জানেন দানিয়েল ভাই, গেন্ডারিয়ার বাড়ির জন্য আমার মনটা কেমন আনচান করছে। গতরাতে স্বপ্নে দেখেছি আমাদের পোষা ময়নাটি মরে গেছে। পাশের কাঠ ব্যবসায়ীর বাড়িতে রেখে এসেছিলাম। সেই অবধি মনটা হু হু করছে। এরকম বিষ্টির সময় বুড়িগঙ্গা কেমন ফেঁপেফুলে অস্থির হয়ে ওঠে। পানির সে কেমন সুন্দর চীৎকার। তিন বোন পাশাপাশি এক সঙ্গে ঘুমোতাম। দিনাজপুর থেকে মা আর বড়ো ভাইয়া এসে থাকতো। ছোটো ভাইটি সারাক্ষণ পাড়ায় ঝগড়াঝাটি মারামারি করে বেড়াতো। এখন জানিনে কেমন আছে। একটা যুদ্ধ লাগলো আর সব কিছু ওলোট পালোট হয়ে গেলো। এখানে আমি পড়ে আছি। দোলা গেছে তার গ্রুপের মেয়েদের সঙ্গে ট্রেনিং নিতে সেই ব্যারাকপুর না কোথায়। মা দিনাজপুরে। বড়ো ভাইয়া কোথায় খবর নেই। ইচ্ছে করেই তায়েবা ডোরার নাম মুখে আনলো না, পাছে আমার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। বরাবর দেখে আসছি তায়েবার কাছে গোটা পৃথিবী একদিকে আর ডোরা একদিকে। রেডিও কিংবা টিভিতে ডোরার রবীন্দ্র সঙ্গীতের যেদিন প্রোগ্রাম থাকতো, সে রিকশাভাড়া খরচ করে চেনাজানা সবাইকে বলে আসতো আজকের রবীন্দ্র সঙ্গীতের প্রোগ্রামটা শুনবেন, আমার বোন ডোরা গান গাইবে। আর ডোরাও ছিলো তায়েবার অন্তপ্রাণ। অতো বড়ো ডাগর মেয়েটি, তবু তায়েবাকে জড়িয়ে ধরে না ঘুমোলে ঘুম আসতো না। তায়েবা কাছে না বসলে খাওয়া হতো না। মাঝে মাঝে ডোরার পেটে কি একটা ব্যথা উঠতো। তখন তায়েবাকে সব কিছু বাদ দিয়ে ডোরার বিছানার পাশে হাজির থাকতে হতো। আজ তায়েবার এই অবস্থায় ডোরা কি করে প্রায় বুড়ো একজন মানুষের সঙ্গে দিল্লীহিল্লী ঘুরে বেড়াচ্ছে আমি ভেবে কুলিয়ে উঠতে পারিনে। তায়েবা দু’চোখ বন্ধ করে আছে আমি এক রকম নিশ্চিত যে, সে ভোরার কথাই চিন্তা করছে।
গলা খাকারীর শব্দে পেছন ফিরে তাকালাম। গোবিন্দ বাইরে থেকে ফিরে এসেছে। তার হাতে একটা প্যাকেট। ডাক দিলো, এই যে দিদিমনি, নিন আপনার জিনিসপত্তর। এর মধ্যে সব আছে। আর ওই নিন পাঁচ টাকা চল্লিশ নয়া পয়সা ফেরত এসেছে। তায়েবা বললো, অনেকতো কষ্ট করলেন, গোবিন্দদা, এই টাকাটা তুমিই রাখো। গোবিন্দের ভাঙ্গা চোরা মুখমণ্ডলে খুশীর একটা চাপা ঢেউ খেলে গেলো। তায়েবা তার বিছানার ওপর প্যাকেটটা উপুর করলো। ভেতরের জিনিসপত্তর সব বেরিয়ে এসেছে। একটা ধুতি, মাঝামাঝি দামের একজোড়া বাটার স্যাণ্ডেল, সিগারেট, ম্যাচ আর তার নিত্য ব্যবহারের টুকিটাকি জিনিস। আমার দিকে তাকিয়ে তায়েবা কড়া হুকুমের সুরেই বললো, দানিয়েল ভাই, তাড়াতাড়ি বাথরুমে ঢোকেন পরনের ওই প্যান্ট খুলে ফেলে এই সাবানটা দিয়ে যেখানে যেখানে রাস্তার পানি লেগেছে ভালো করে রগড়ে ধুয়ে ফেলুন। এ পানির স্পর্শ বড়ো সাংঘাতিক। স্কীন ডিজিজ-টিজিজ হয়ে যেতে পারে। তারপর এই স্যাণ্ডেল জোড়া পরবেন। দয়া করে আপনার জুতোজোড়া ওইদিকের ডাস্টবিনে ফেলে আসুন ওটা তো আর কোনো কাজে আসবে না। আমি বললাম, তায়েবা আমি যে ধুতি পরতে জানিনে। এবার তায়েবা ঝঙ্কার দিয়ে উঠলো, আপনি এখনো ক্ষেতের কুমড়োই রয়ে গেছেন। কিছুই শেখেননি। অতো আঠারো রকমের প্যাঁচ গোচের দরকার কি? আপনি দু’ভজ দিয়ে সোজা লুঙ্গির মতো করেই পরবেন। যান, যান বাথরুমে ঢোকেন, অতো কথা শুনতে চাইনে। এদিকে ভিজিটিং আওয়ারের সময় ঘনিয়ে এলো।
আর কথা না বাড়িয়ে বাথরুমে ঢুকে পড়লাম। আমি ধুতিখানা লুঙ্গির মতো করে পরে বাইরে এসে জিগগেস করলাম, এখন ভেজা প্যান্টটা নিয়ে কি করি। তায়েবা বললো, কোণার দিকে চিপেটিপে রাখুন, যাবার সময় ব্যাগের ভেতর পুরে নিয়ে যাবেন। তারপর আমাকে আবার বাথরুমে প্রবেশ করতে হলো। শরীর ঘসেমেজে লুঙ্গির মতো করে ধুতিপরা অবস্থায় আমাকে দেখে তায়েবা মুখ টিপে হাসলো। আয়নার সামনে গিয়ে দেখে আসুন, আপনাকে এখন ফ্রেশ দেখাচ্ছে। আপনার এমন একটা কুৎসিত স্বভাব, সবসময় চেহারাখানা এমন কুৎসিত করে রাখেন, মনে হয় সাত পাঁচজনে ধরে কিলিয়েছে। তাকিয়ে দেখলে ঘেন্না করতে ইচ্ছে হয়। তায়েবা এ । কথা কম করে হলেও একশোবার বলেছে। কিন্তু আমার চেহারার কোনো সংস্কার করা সম্ভব হয়নি। আমি বললাম, তায়েবা আমি বোধ হয় মানুষটাই কুৎসিত। আমার ভেতরে কোনো সৌন্দর্য নেই বাইরে ফুটিয়ে তুলবো কেমন করে? তায়েবা আমার কথার পিঠে বললো, তাই বলে কি চব্বিশঘণ্টা এমন গোমড়া মুখ করে থাকতে হবে, তারও কি কোনো কারণ আছে? সব মানুষেরই এক ধরনের না এক ধরনের দুঃখ আছে, তাই বলে দিনরাত একটা নোটিশ নাকের ডগায় ঝুলিয়ে রাখতে হবে নাকি? এই যে আমাকে এই অবস্থায় দেখছেন, আমার কি দুঃখের অন্ত আছে, কিন্তু বেশতো আছি। যাক, এ পর্যন্ত বলে তায়েবা হাঁফাতে থাকলো।
আমি ভুলে গিয়েছিলাম যে একজন সিরিয়াস রোগীর সঙ্গে কথা বলছি। আসলে আমি কথা কাটাকাটি করছি বুড়ীগঙ্গার পাড়ের তায়েবার সঙ্গে। সে তায়েবা আর এ তায়েবা এক নয়, একথা বার বার ভুলে যাই। গেন্ডারিয়ার বাসায় ভাই-বোন পরিবেষ্টিত তায়েবার যে রূপ, তার সঙ্গে বর্তমান তায়েবার আর কি কোনো তুলনা করা যেতে পারে? বড়ো জোর বর্তমান তায়েবা গেন্ডারিয়ার তায়েবার একটা দূরবর্তী ক্ষীণ প্রতিধ্বনি মাত্র। গেন্ডারিয়ার বাড়িতে তায়েবাকে যে দেখেনি কখনো তার আসল রূপ ধরতে পারবে না। খাচ্ছে, খাওয়াচ্ছে, রাঁধছে, বাড়ছে, বোনদের তত্ত্ব তালাশ করছে, কলেজে পাঠাচ্ছে, নিজে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছে সর্বত্র একটা ঘূর্ণির বেগ জাগিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। কখনো খলখল হাসিতে অপরূপা লাস্যময়ী, কখনো দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে প্রচণ্ড রাগে ফেটে পড়ছে। একে ধমক দিচ্ছে, তাকে শাসাচ্ছে, সদা চঞ্চল, সদা প্রাণবন্ত। আবার কখনো চুপচাপ গম্ভীর। তখন তাকে মনে হয়, সম্পূর্ণ ধরাছোঁয়ার বাইরে, অত্যন্ত দূরের মানবী। কোনো পুরুষের বাহুবন্ধনে ধরা দেয়ার জন্য যেনো তার জন্ম হয়নি। কোনো শাসন বারণ মানে না। দুর্বার গতিস্রোতে সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায়, এক জায়গায় আটকে রাখে কার সাধ্য। চেষ্টা যে করিনি তা নয়। প্রতিবারই প্রচণ্ড আঘাত করে সে নিজের গতিবেগে ছুটে গেছে। আবার যখন তাকে ছেড়ে আসতে চেষ্টা করেছি, সে নিজেই উদ্যোগী হয়ে কাছে টেনে নিয়েছে। যখন সে নিজের মধ্যে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে আকাশের তারকারাজি কিংবা বুড়িগঙ্গাতে ভাসমান নৌকার রাঙ্গা রাঙ্গা পালগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতো, তখন তাকে তারকার মতো সুদূর এবং রহস্যময় নদীতে চলমান রাঙ্গাপালের একটা প্রতীক মনে হতো। যেন কারো কোনো বন্ধনে ধরা দেয়ার জন্য সে পৃথিবীতে আসেনি। তায়েবার অনেক ঘনিষ্ট সান্নিধ্যে আমি এসেছি। কতোদিন, কতোরাত্রি তার সঙ্গে আমার একত্রে কেটেছে। এ নিয়ে বন্ধু বান্ধবেরা আমাকে অনেক বিশ্রী ইঙ্গিত করেছে। তায়েবার নিজের লোকেরাও কম হাঙ্গামা হুজ্জত করেনি। এমনকি, তার অভিভাবকদের মনেও ধারণা জন্মানো বিচিত্র নয় যে আমি তাকে গুণ করেছি।
আমি কিন্তু তায়েবাকে কখনো আমার একথা স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি। তার সঙ্গে সম্পর্কের ধরনটা কি, অনেক চিন্তা করেও নির্ণয় করতে পারিনি। হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে আছে সে। চোখ দুটো সম্পূর্ণ বোজা। নিঃশ্বাস ফেলার সঙ্গে সঙ্গে নাকের দু’পাশটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। তার ডান হাতটা আমার মুঠোর মধ্যে। এই যে গভীর স্পর্শ লাভ করছি তাতে আমার প্রাণের তন্ত্রীগুলো সোনার বীণার মতো ঝঙ্কার দিয়ে উঠছে। এই স্পর্শ দিয়ে যদি পারতাম তার সমস্ত রোগবালাই আমার আপন শরীরে শুষে নিতাম। তার জন্য আমার সব কিছু এমন অকাতরে বিলিয়ে দেয়ার এই যে সহজ সরল ইচ্ছে- ওটাকে কি প্রেম বলা যায়? যদি তাই হয় আমি তাহলে তায়েবার প্রেমে পড়েছি। দানিয়েল ভাই, কথা বললো তায়েবা। তার চোখ দু’টো এখনো বোজা। কণ্ঠস্বরটা খুবই ক্ষীণ, যেনো স্বপ্নের ভেতর তার চেতনা ভাষা পেতে চেষ্টা করছে। আমি তার দুটো হাতই টেনে নিলাম। দানিয়েল ভাই, আবার ডাকলো তায়েবা। এবার তার কণ্ঠস্বরটি অধিকতরো স্পষ্ট। আমি বললাম, তায়েবা বলো। সে চোখ দুটো খুললো, শাড়ির খুঁটে মুছে নিলো। তারপর ধীরে, অতি ধীরে উচ্চারণ করলো, দানিয়েল ভাই, এবার যদি বেঁচে যাই, তাহলে নিজের জন্য বাঁচার চেষ্টা করবো। আমার বুকটা কেঁপে গেলো। বললাম, এমন করে কথা বলছো কেন? দানিয়েল ভাই, আমার অসুখটি এতো সোজা নয়। আপনি ঠিক বুঝবেন না, মৃত্যু আমার প্রাণের দিকে তাক করে আছে। এক সময় বোটা শুদ্ধ আস্ত হৃদপিণ্ডটি ছিঁড়ে নেবেই। বললাম, ছি ছি তায়েবা, কি সব আবোল তাবোল প্রলাপ বকছো। দানিয়েল ভাই, এই মুহূর্তটিতে এই কথাটিই আমার কাছে সব চাইতে সত্য মনে হচ্ছে। সারা জীবন আমি আলেয়ার পেছনে ছুটেই কাটিয়ে গেলাম। মা, ভাই-বোন, বন্ধু-বান্ধব সকলের সুখে হোক দুঃখে হোক একটা অবস্থান নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু আমি তো হাওয়ার ওপরে ভাসছি। তারা হয়তো সুখ পাবে জীবনে, নয়তো দুঃখ পাবে, তবু সকলে নিজের নিজের জীবনটি যাপন করবে। কিন্তু আমার কি হবে, আমি কি করলাম? আমি যেনো স্টেশনের ওয়েটিং রুমেই গোটা জীবনটা কাটিয়ে দিলাম। প্রতিটি মানুষ একটা জীবন নিয়েই জন্মায়। সে জীবনটাই সবাইকে কাটাতে হয়। কিন্তু জীবনযাপনের হিসেবে যদি ফাঁকি থাকে তাহলে জীবন ক্ষমা করে না। ডাক্তারেরা যাই বলুন, আমি তো জানি আমার অসুখের মূল কারণটা কি? এক সময় আমার জেদ এবং অভিমান দুইই ছিলো। মনে করতাম আমি অনেক কিছু ধারণ করতে পারি।
এখন চোখের জলে আমার সে অভিমান ঘুচেছে। দশ পনেরো বছর থেকে তো বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখছি। এখন সেই বাংলাদেশ যুদ্ধ করছে, কিন্তু আমি কোথায়? আমার সব কিছু তো চোখের সামনেই ছত্রখান হয়ে গেলো। আমার মা কোথায়, ভাই-বোনেরা কোথায়, এখানে আমি একেবারে নিতান্ত একাকী। আপন রক্তের বিষে একটু একটু করে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছি। তার দু’চোখের কোণায় দু’ফোঁটা পানি দেখা দিলো, আমি রুমাল দিয়ে মুছিয়ে দিলাম। তায়েবা বললো, জানেন দানিয়েল ভাই, আগে আমি কোণাকানচি হিসেব করে চিন্তা করতে ঘৃণা করতাম। এখন নানা রকম চিন্তা আমার মাথায় ভর করে। মানুষ মরলে কোথায় যায়, মাঝে মাঝে সে চিন্তাও আমার মনে উদয় হয়। উৎপলা বলছে মানুষ মরলে তার আত্মা পাখি হয়ে যায়। আবার আরতিদি বলেন, এক জন্মে মানুষের শেষ নয়। তাকে বার বার জন্মাতে হয়। এসব বিশ্বাস করিনে, তবে শুনতে ভালোই লাগে। ধরুন কোনো কারণে আরো একবার যদি আমি জন্মগ্রহণ করি, তাহলে নিতান্ত সাধারণ মেয়ে হয়েই জন্মাবো। পরম নিষ্ঠা সহকারে নিজের জীবনটাই যাপন করবো। ঢোলা জামা পরা আঁতেলদের বড়ো বড়ো কথায়, একটুও কান দেবো না। আমি পেটুকের মতো বাঁচবো। খাবো, পরবো, সংসার করবো। আমার ছেলেপুলে হবে, সংসার হবে, স্বামী থাকবে। সেই সংসারের গণ্ডির মধ্যেই আমি নিজেকে আটকে রাখবো। কখনো বাইরে পা বাড়াবো না।
তায়েবার এ সমস্ত কথা আমার ভালো লাগছিলো না। বরাবরই জেনে এসেছি, সে বড়ো শক্ত মেয়ে। কখনো তাকে এরকম দেখিনি। এ কোন্ তায়েবার সঙ্গে কথা বলছি? জোর দিয়ে বলতে চাইলাম, তায়েবা এখনো সামনে তোমার ঢের জীবন পড়ে আছে, যেভাবে ইচ্ছে কাটাতে পারবে। কিন্তু আমার নিজের কানেই নিজের কণ্ঠস্বর বিদ্রুপের মতো শোনালো। তায়েবা বললো, না দানিয়েল ভাই, আপনাকে নিয়ে আর পারা গেলো না। আপনি দেখতে মিনমিনে হলে কি হবে, বড়ো বেশি একরোখা এবং গোঁয়ার। নিজে যা সত্য মনে করেন সকলের ওপর চাপিয়ে দিতে চেষ্টা করেন। সে জন্যই ভয় হয়, আমার মতো আপনার কপালেও অনেক দুঃখ আছে। আমার শরীরের খবর আমার চাইতে কি আপনি বেশি জানেন? আমি জানতে চাইলাম, আচ্ছা তায়েবা, তোমার অসুখটা কি? তায়েবা এবার ফোঁস করে উঠলো। কখনো জানতে চেয়েছেন আমার অসুখটা কি? আর অসুখের ধরন জেনে লাভ নেই, অসুখ অসুখই। তবু একটা ডাক্তারি নাম তো আছে। সেটা আমাকে বিরক্ত না করে ডঃ মাইতির কাছে জিগগেস করুন না কেনো। বললাম, ডঃ মাইতির কাছে গতকাল আমি জানতে চেয়েছিলাম, তোমার কি অসুখ। উল্টো তিনি আমাকেই প্রশ্ন করলেন, আমি জানি নাকি তোমার কি অসুখ। সেটা আপনি ডঃ মাইতির সঙ্গে বোঝাঁপড়া করুন গিয়ে। বিরক্ত হয়ে তায়েবা বিছানার উপর শরীরটা ছেড়ে দিলো।
ডঃ মাইতি আবার কি করলো হে? হাতে স্টেথেসকোপ দোলাতে দোলাতে ডঃ মাইতি কেবিনে প্রবেশ করলেন। দানিয়েল সাহেব, হাতখানা একটু বাড়িয়ে দিন, হ্যান্ডশেক করি। এই ঘোরতররা বিষ্টির মধ্যে চলে আসতে পেরেছেন। বাহ! সোজা মানুষ তো নয়। বোঝা গেলো চরিত্রের মধ্যে স্টার্লিং কোয়ালিটি আছে। শেকহ্যান্ডের পর বললাম, আপনার রোগির কি অনিষ্ট করলাম? নিশ্চয়ই, তাহলে ধরে নিচ্ছি আপনি গতকালের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছেন। আমি হাসলাম। তারপর তায়েবার দিকে তাকিয়ে জিগগেস করলেন, গিলছো না এখনো বাকি আছে। মাইতিদা ভাতের কথা তো একেবারে ভুলেই গিয়েছিলাম। এতোক্ষণ দানিয়েল ভাইতে আমাতে ঝগড়া চলছিলো। ডঃ মাইতি বললেন, ঝগড়ার বিষয়বস্তু কি আগে বলো। তায়েবা বললো, মাইতিদা আপনি যেনো কেমন, ঝগড়া করতে গেলে আবার বিষয়বস্তুর দরকার হয় নাকি। যে ঝগড়ার বিষয়বস্তু নেই, তা আমি শুনবো না। ওসব কথা এখন রাখো। ওয়ার্ডে ডঃ ভট্টাচার্যির পা দেয়ার আগে তোমার বায়না করে আনা ওই ভাত মাছ তাড়াতাড়ি গিলে ফেলল। উনি এসে পড়লে একটা অনর্থ বাধাবেন। হঠাৎ আমার পরিধেয় বস্ত্র দেখে ডঃ মাইতির চোখজোড়া কৌতুকে ঝিকমিকিয়ে উঠলো। বাহ! দানিয়েল সাহেব দেখছি আপনার উন্নতি ঘটে গেছে। আমি একটুখানি অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। বললাম, আমি সেই বৌবাজার থেকে এক কোমর পানির মধ্যে দিয়ে হেঁটে এসেছি তো। তিনি জিগগেস করলেন, এই ঘোলাজলের সবটুকু পথ কি আপনি নিজের পায়ে হেঁটে এসেছেন? আমি মাথা দোলালাম। এখানে এসে দেখি প্যান্ট ময়লায় ভরে গেছে, আর পা থেকে জুতো নামাতেই সোলদুটো খসে পড়লো। তায়েবা টাকা দিয়ে হাসপাতালের গোবিন্দকে পাঠিয়ে এই ধুতি আর স্যান্ডেল জোড়া কিনে এনেছে। তাহলে দিদিমনির দান দক্ষিণে করারও অভ্যেস আছে। বাহ! বেশ বেশ। তার কথাতে কেমন জানি লজ্জা পাচ্ছিলাম। এই লজ্জার হাত থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্যই বলে বসলাম, ধুতি প্যাঁচগোচ দিয়ে পরতে জানিনে। তাই দু’ভাঁজ করে লুঙ্গির মতো করে পরেছি। ঠিক আছে, বেশ করেছেন, আজ হাসপাতাল থেকে যাওয়ার পথে আমার বাসা হয়ে যাবেন, আপনাকে ধুতি পরা শিখিয়ে দেবো। এ সুযোগে আপনার সঙ্গে একটু গপ্পোটপ্লোও করা যাবে। হ্যাঁ কি বলেন। বললাম, আমি তো আপনার কোয়ার্টার চিনিনে, কি করে যাবো। আরে মশায়, অতো উতলা হচ্ছেন কেননা, একটু ধৈর্য ধরুন প্রথমে আমি চিনিয়ে দেবো। তারপর তো আপনি যাবেন। ওই যে হাসপাতালের গেট। তার অপজিটে লাল দালানগুলো দেখছেন তার একটার দোতলাতে আমি থাকি। নাম্বারটা মনে রাখবেন একুশের বি। এদিক ওদিক না তাকিয়ে সোজা দোতলায় উঠে বেল টিপবেন। আপনার জন্য আমি অপেক্ষা করে থাকবো। কি চিনতে পারবেন তো? আমি বললাম, মনে হচ্ছে পারবো। মনে হচ্ছে কেন? আপনাকে পারতেই হবে। এটুকুও যদি না পারেন, কর্পোরেশনের লোকজনদের লিখবো যেনো আপনাকে শহর থেকে বের করে দেয়।
ডঃ মাইতি তায়েবার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি খেতে আরম্ভ করো। আমি ওই দরোজার কাছে দাঁড়িয়ে আছি। ডঃ ভট্টাচার্য যদি এসে পড়েন, আমি হাততালি দেবো। তুমি অমনি সব লুকিয়ে ফেলে বাথরুমে ঢুকে পড়বে। একেবাবে সব ধুয়েই তাঁর সামনে আসবে। দানিয়েল সাহেব যান, জলটল দিয়ে সাহায্য করুন। আমি একটা প্লেট ধুয়ে এনে দিলে তায়েবা মিটসেফ থেকে ব্যাগটা বের করলো, তারপর বাটিটা টেনে নিলো। ভাতগুলো প্লেটে নিয়ে অন্য বাটিটা থেকে কিছুটা মাছের তরকারি ঢেলে নিলো। তার মুখে একটা খুশি খুশি ভাব। জানেন, দানিয়েল ভাই, কতোদিন পরে আজ মাছভাত মুখে দিচ্ছি। বললাম, গতোকাল বলেছিলে এক মাস। হ্যাঁ সেরকম হবে। এক গ্রাস ভাত মুখে তুলে নিলো। তারপর হাতখানা ঠেকিয়ে চুপচাপ বসে রইলো। আমি বললাম, চুপ করে অমন হাত ঠেকিয়ে আছে, খাচ্ছো না কেনো? না, খাবো না এই খাবার কি মানুষে খায়? কি রকম বিচ্ছিরি রান্না, মুখটা তেতো হয়ে গেলো। আহ্ মাইতিদা। ডাক্তার কেবিনের ভেতরে ঢুকলেন, কি হলো তায়েবা, ভাত খেতে চাইছিলে খাও। খেতে যে পারছিনে, সব তেতো লাগে যে। তার আমি কি করবো। তেলমশলা ছাড়া শুধু হলুদজিরের রান্না আপনি খেতে পারবেন, দানিয়েল ভাই। মাছগুলো লবণমরিচ দিয়ে ভাজা করে আনতে পারলেন না। আপনি কিছুই বোঝেন না। আমি বললাম, তা ঠিক আছে। কাল মাছ ভেজে এনে দেবো। হ্যাঁ তাই দেবেন। তায়েবা হাত ধুয়ে ফেললো। ডঃ মাইতি বললেন, আপনার ভাত মাছ বিজনেস এখানেই শেষ। তারপরেও এসকল জিনিস এ কেবিনে যদি আবার আসে, তাহলে আপনার হাসপাতালে আসাটাই বন্ধ করতে হয়। তায়েবা চুপচাপ রইলো। আমার ধারণা ডঃ মাইতির ব্যবস্থাটি মেনে নিয়েছে। ডঃ মাইতি আমাকে বললেন, এক কাজ করুন, এই ভাতমাছ যা আছে সব বাটির ভেতর ভরে ওধারের ডাস্টবিনের ফেলে দিয়ে আসুন তাড়াতাড়ি। আমি বাক্যব্যয় না করে তাঁর নির্দেশ পালন করলাম। বাটি প্লেট সব ধুয়ে নেয়ার পর ডঃ মাইতি বললেন, এবার আমি চলি দানিয়েল সাহেব, মনে থাকে যেনো। সাতটা থেকে সাড়ে সাতটার সময়। আমি বললাম, থাকবে। উনি চলে গেলাম।
আমি তায়েবাকে জানালাম, ডঃ মাইতি সাতটা সাড়ে সাতটার সময় আমাকে তাঁর কোয়ার্টারে যেতে বলেছেন। যাবো? অবশ্যই যাবেন। তিনি আর দীপেনদা আমার জন্য যা করছেন দেশের মানুষ আত্মীয়স্বজন তার এক ছটাক, এক কাচ্চাও করেনি। আমি জানতে চাইলাম, দীপেন লোকটি কে? তায়েবা বললো, দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনিই তো আমাকে চেষ্টা তদবির করে এ হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছেন। আপনি চিনবেন কেমন করে। আর আপনারা সব নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত। আমি মারা গেলাম, বেঁচে রইলাম, তাতে কার কি এসে যায়। আমি জবাব দিলাম না। তায়েবার অনেক রাগ, অনেক অভিমান। তাকে ঘাটিয়ে লাভ নেই। অনাবশ্যক রাগারাগি করে অসুখটা বাড়িয়ে তুলবে। এখন তো প্রায় ছ’টা বাজে। তোমার ডাক্তার আসার সময় হয়েছে। আজ আমি আসি। আবার আসবেন। আমি বললাম, আসবো। প্যান্ট আর বাটিসহ ব্যাগটা নিয়ে যাই। প্যান্ট নিয়ে এখন আর কাজ নেই। নতুন একটা বাসায় যাচ্ছেন। আমি গোবিন্দদাকে দিয়ে কাল লঞ্জিতে পাঠিয়ে দেবো। এক কাজ করুন। ব্যাগ বাটি এসবও রেখে যান। বরং কাল এসে নিয়ে যাবেন।
হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে দেখলাম, মাত্র সোয়া ছটা। ডঃ মাইতির কোয়ার্টারে সাত থেকে সাড়ে সাতটার মধ্যে যে কোনো সময়ে গেলে হবে। আমার ভীষণ ক্ষুধা পেয়েছে। সেই আড়াইটার সময় বেরিয়ে এতোটা পথ হেঁটে এসেছি। তারপর এতোক্ষণ সময় কাটালাম। পেটে কিছু পড়েনি। সারাটা সময় এরকম ক্ষুধা তৃষ্ণার কথা ভুলেই ছিলাম। একটা খাবার দোকান তালাশ করতে লাগলাম। এদিকে দোকানপাটের সংখ্যা তেমন ঘন নয়। তাই বাঁক ঘুরে ভবানীপুর রোডে চলে এলাম একটা সুবিধেজনক খাবার ঘরের সন্ধান করতে। হাজরা রোডের দিকে ধাওয়া করলাম। যে দোকানেই যাই, প্রচণ্ড ভিড়। ভিড়ের মধ্যে ঢুকে পড়তে আমার কেমন জানি প্রবৃত্তি হচ্ছিলো না। নিশীথে পাওয়া মানুষের মতো আমি পথ হাঁটছি। অবশ্য বিশেষ অসুবিধে হচ্ছে না। অনেক আগেই বিষ্টি ধরে গেছে। এদিকটাতে রাস্তাঘাটের অবস্থা একেবারে খটখটে শুকনো। কোলকাতার টুকরো টুকরো খণ্ড খণ্ড আকাশে ঝাঁকে ঝাঁকে তারা জ্বলছে। দু’পাশের দোকানপাটে ধুমধাম কেনাবেচা চলছে। ঢ্যাকর ঢ্যাকর করে ট্রাম ছুটছে। বাস, লরি,ট্রাক, কার এসব যন্ত্রযানের বাঁশি অনাদ্যন্ত রবে বেজে যাচ্ছে। মানুষের স্রোততো আছেই। তারা যেনো অনাদিকাল থেকেই শহর কোলকাতার ফুটপাতের ওপর দিয়ে উজানভাটি দুই পথে ক্রমাগত প্রবাহিত হচ্ছে। মোড়ের একটা স্যান্ডউইচের দোকানে গিয়ে দু’খানা প্যাটিস আর ঢক ঢক করে পানি খেয়ে নিয়ে ডঃ মাইতির কোয়ার্টারের উদ্দেশ্য হাঁটতে লাগলাম। কোন দিকে যাচ্ছি খেয়াল নেই। শুধু পা দুটো আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। কোলকাতায় আসার পর থেকে আমার পা দুটোর চোখ ফুটে গেছে।
সাতটার ওপরে বোধ করি কয়েক মিনিট হবে। আমি ডঃ মাইতির কোয়ার্টারে এসে বেল টিপলাম। একটি ছোকরা চাকর দরোজা খুলে দিয়ে জানতে চাইলো, কাকে চান? আমি জানতে চাইলাম, ডঃ মাইতি আছেন? আছেন, আমি ভেতরে প্রবেশ করে একটা বেতের সোফায় বসে সিগারেট জ্বালালাম। বসবার ঘরের আসবাবপত্তরের তেমন বাহুল্য নেই। কয়েকখানি বেতের সোফা এবং একই ধরনের চাদর ও খাটের ওপর পাতা চাদরটি খুবই সুন্দর এবং মধ্যিখানে একটি বেতের টেবিল। টেবিলের ওপর পাতা চাদরটি খুবই সুন্দর এবং একই ধরনের চাদরও খাটের ওপর পাতা দেখলাম। ওপাশে পুরোনো একটি ক্যাম্প খাট দেয়ালে হেলান দিয়ে আছে। দেয়ালে একজোড়া বুড়োবুড়ির ছবি টাঙ্গানো। চিনতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয়, ডঃ মাইতির মা বাবা। তাছাড়া আছে রবীন্দ্রনাথের একটা বড়ো আকারের ছবি। রবীন্দ্রনাথের বিপরীতে বিবেকানন্দ, রামকৃষ্ণ এবং মহাত্মা গান্ধীর ছবি। ওষুধ কোম্পানীর দু’টো ক্যালেন্ডার, উত্তর দক্ষিণের দু’টি দেয়ালে পরস্পরের দিকে মুখ করে ঝুলছে। এ ছাড়া এনলার্জ করা একটি গ্রুপ ফটো আছে। গাউন পরা একদল যুবকের ছবি। একটুখানি চিন্তা করলেই মনে পড়ে যাবে মেডিক্যাল কলেজের সার্টিফিকেট গ্রহণ করার সময় এই ছবিখানি ওঠানো হয়েছিলো। একেবারে কোণার দিকে হাতঅলা একটি চেয়ার এবং সামনে একটি টেবিল। ডঃ মাইতি জিগগেস করলেন, চিনতে কোনো অসুবিধে হয়নি তো। আমি বললাম, না। তিনি ডাক দিলেন, অনাথ। আবার সে ছেলেটি এসে দাঁড়ালে বললেন, চা দাও। আর শোনো এই বাবু আমাদের সঙ্গে খাবেন এবং রাত্তিরে থাকবেন। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক কৌতুক মিশ্রিত স্বরে বললেন, দেখলেন তো কেমন, বাড়িতে এনে গ্রেপ্তার করে ফেললাম। সহসা আমার মুখে কোনো উত্তর যোগালো না। তিনি ফের জিগগেস করলেন, আপনার কি তেমন জরুরী কাজ আছে। আজ রাত্তিরে এখানে থাকলে কোনো বড়ো ধরনের ক্ষতি হয়ে যাবে কি? জবাব দিলাম, না, তেমন কোনো কাজ নেই। আপনার কি আজ রাতটা আমার সঙ্গে গল্প করে কাটাতে আপত্তি আছে? বারে আপত্তি থাকবে কেনো, এখন আমাদের যে অবস্থা, কে আবার আমার খবর নেবে। দানিয়েল সাহেব, এভাবে কথা বলবেন না। মনে রাখবেন, আপনারা একটি মুক্তিসংগ্রাম করছেন। আমি ডাক্তার মানুষ অধিক খোঁজ খবর রাখতে পারিনে। তায়েবাকে দেখতে হাসপাতালে যেসব ছেলে আসে, তাদের অনেকের দৃষ্টির স্বচ্ছতা এবং অদম্য মনোবল লক্ষ্য করেছি। আপনাদের গোটা জাতি যে ত্যাগতিতিক্ষার মধ্যে দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে, তার প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধ রয়েছে। মানুষের সব চাইতে মহত্তম সম্পদ তার চরিত্র, সে বস্তু আপনার দেশের অনেক যুবকের মধ্যে আমি বিকশিত অবস্থায় দেখেছি। কোনো কোনো সময়ে আপনাদের প্রতি এমন একটা আকর্ষণ অনুভব করি, ভুলে যাই যে, আমি একজন ভারতীয় নাগরিক। আমি কখনো বাংলাদেশে যাবো না। পুরুষানুক্রমে আমরা পশ্চিমবাংলার অধিবাসী। পদ্মার সে পাড়ের মানুষের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কখনো ছিলো না। কিন্তু আপনার দেশের মুক্তিসংগ্রাম শুরু হওয়ার পর থেকে আমার নিজের মধ্যেই একটা পরিবর্তন অনুভব করছি। একদিনে কিন্তু সে পরিবর্তন আসেনি। ক্রমাগত মনে হচ্ছে আমি নিজেই বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের একটা অংশ। এখন আমার ভারতীয়সত্তা আর বাঙালিসত্তা পরস্পরের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। এখন বাঙালি বলে ভাবতে আমার খুব অহঙ্কার হয়। আপনার দেশ যুদ্ধে না নামলে আমার এ উপলব্ধি জন্মাতো কিনা সন্দেহ। কথাগুলো লিটারেল অর্থ ধরে নেবেন না। এটা জাস্ট একটা ফিলিংয়ের ব্যাপার।
আমি বললাম, বাংলা এবং বাঙালিত্বের প্রতি পশ্চিমবাংলার সকল শ্রেণীর মানুষের একটা অতুলনীয় সহানুভূতি এবং জাগ্রত মমত্ববোধ আছে বলেই এখনো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শিরদাঁড়া উঁচু করে থাকতে পেরেছে। পশ্চিমবাংলার বদলে যদি গুজরাট কিংবা পাঞ্জাবে বাংলাদেশের জনগণকে আশ্রয় গ্রহণ করতে হতো, ভারত সরকার যতো সাহায্যই করুক না কেনো, আমাদের সংগ্রামের অবস্থা এখন যা তার চাইতে অনেক খারাপ হতো। পশ্চিম বাংলার মানুষের প্রাণের আবেগ, উত্তাপ এবং ভালোবাসা বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে প্রাণবন্ত এবং সজীব রেখেছে। ছেলেটা চা দিয়ে গেলো। আপনার কাপে কচামচ চিনি এবং কতোটুকু দুধ দেবো বলুন। বললাম, দুধ আমি খাইনে! দু কি আড়াই চামচ চিনি দেবেন। হো হো করে হেসে উঠলেন, ডঃ মাইতি। একটা বিষয়ে দেখছি আপনার সঙ্গে আমার চমৎকার মিল আছে। আমিও চায়ের সঙ্গে দুধ খাইনে।
চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, আমি মুখ মানুষ। প্রোফেশনের বাইরে গেলেই নাচার হয়ে পড়ি। আপনার মতো একজন স্কলার মানুষের সঙ্গে কি নিয়ে কথা বলবো, মশায় সাবজেকট খুঁজে পাচ্ছিনে। আবার সেই হো হো হাসি। আমি বললাম, আপনিও তাহলে তায়েবার কথা বিশ্বাস করে আছেন। এসএসসি থেকে এমএ পর্যন্ত সবগুলো পরীক্ষায় কখনো বিশের মধ্যে থাকার ভাগ্যও আমার হয়নি। তায়েবা যাদেরকে চেনেজানে একটুখানি খাতির করে। তাদের সম্পর্কে বাড়িয়ে বলে, এটাই তার স্বভাব। আমার ব্যাপারে এই পক্ষপাতটুকু এতোদূর মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিলো যে আমার নিজের কান পর্যন্ত গরম হয়ে উঠেছিলো। এনিয়ে তার সঙ্গে আমার অনেক কথা কাটাকাটি হয়েছে। ডঃ মাইতি বললেন, আপনার ব্যাপারে তার একটা লাগাম ছাড়া উচ্ছ্বাস এরই মধ্যে আমি লক্ষ্য করেছি। আপনাকে স্কলার হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়, আপনি বিষ্টিতে কাপড়জামা ভিজিয়ে এলে বাজার থেকে লোক পাঠিয়ে নতুন কাপড়জামা কিনে আনে। এগুলো কি একজন রোগির পক্ষে বাড়াবাড়ি নয়? আসলে আপনাদের সম্পর্কটা কী রকম। আপনি যদি জবাব না দেন আমি অবাক হবো না।
বললাম, ডঃ মাইতি জবাব দেবো না কেনো? লোকে তো বন্ধুজনের কাছেই প্রাণের গভীর কথা প্রকাশ করে। আপনাকে আমি একজন বন্ধুই মনে করি। তায়েবার সঙ্গে আমার সম্পর্কের ধরনটা কি নিজেও আমি ভালো করে নির্ণয় করতে পারিনি। আমার ধারণা সে আমাকে করুণা করে। এই যুদ্ধটা না বাধলে, বিশেষ করে বলতে গেলে এই অসুখটা না হলে তার সঙ্গে আমার দেখা হতো কিনা সন্দেহ। সে তার পার্টির কাজকর্ম নিয়ে থাকতো। আমি আমার কাজ করতাম। তিনি ফের জানতে চাইলেন, আপনাদের মধ্যে একটা হৃদয়গত সম্পর্ক আছে এবং সেটা গভীর, একথা কি অস্বীকার করবেন? ডঃ মাইতি, ও বিষয়টা নিয়ে নিজেও অনেক চিন্তা করেছি, কিন্তু কোনো কুলকিনারা পাইনে। মাঝে মাঝে মনে হয়েছে একটা গভীর সম্পর্ক আছে, কিন্তু পরক্ষণে মনে হয়েছে, না কিছুই নেই। সকাল বেলার শিশির লাগা মাকড়সার জাল যেমন বেলা বাড়লে অদৃশ্য হয়ে যায়, এও অনেকটা সেরকম। সে তার পার্টি ছাড়তে পারবে না। কেনোনা তার অস্তিত্বের সবটাই তার পার্টির মধ্যে প্রোথিত। আর আমার চরিত্র এমন কোনো বিশেষ পার্টির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর মতো মোটেই উপযুক্ত নয়। এতে সব গোঁজামিলের মধ্যে হৃদয়গত একটা সম্পর্ক কেমন করে টিকে থাকতে পারে, আমার তো বোধগম্য নয় ডাঃ মাইতি। ডাক্তার হাততালি দিয়ে উঠলেন, এই খানেই তো মজা। মানুষ ভয়ানক জটিল যন্ত্র। তার হৃদয় ততোধিক জটিল। অতো সহজে কিছু ব্যাখ্যা করতে পারবেন না। আচ্ছা দানিয়েল সাহেব, আপনি কি রাজনীতি করেন? বললাম, মানুষ সব সময়ে তো একটা না একটা রাজনীতি করে আসছে। আমি তা এড়াবো কেমন করে? কিন্তু আমি কোনো পার্টির মেম্বার নই। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ যদি আমার যথাসর্বস্ব দাবি করে, না দিয়ে কি পারবো? আমি সহজ মানুষ, অতো ঘোরপ্যাঁচ বুঝিনে।
ডঃ মাইতি টেবিলে একটা টোকা দিয়ে বললেন, এমনিতে আমি সিগারেট খাইনে। কিন্তু আপনার কথা শুনে একটা সিগারেট টানতে ইচ্ছে করছে। একটা চারমিনার জ্বালিয়ে টান দিয়ে খক খক করে কেশে ফেললেন। মশায়, বললেন তো খুব সহজ মানুষ। আসলে আপনি জটিল এবং দুর্বোধ্য মানুষ। কিন্তু বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই। হয়তো তাই, সব মানুষই একটা না একটা দিকে দুর্বোধ্য, আমরা খেয়াল করিনে। আরে মশায় ওসব গভীর কথা এখন তুলে রাখুন। আপনাকে একটা সিম্পল প্রশ্ন জিগগেস করি, ইচ্ছে করলে আপনি জবাব নাও দিতে পারেন। আমি বললাম, নিশ্চয়ই জবাব দেবো, বলুন আপনার প্রশ্নটা। ডঃ মাইতি স্থির চোখে তাকিয়ে বললেন, তায়েবার সঙ্গে পরিচয়ের পর অন্য কোনো নারীকে কি আপনি। ভালোবেসেছেন? আমি বললাম, না তা হয়নি। কেনো বলুন তো? হয়তো পরিবেশ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি বলেই। অন্য কোনো মেয়েকে ভালোবাসার কথা কখনো আপনার মনে এসেছে? না, তাও আসেনি। আচ্ছা মেনে নিলাম, অন্য কারো সঙ্গে প্রেমে পড়ার কথা চিন্তা করতে পারেননি। অন্ততঃ বিয়েটিয়ের ব্যাপারে কখনো সিরিয়াস হতে চেষ্টা করেছেন কি? আমি বললাম, তাও করিনি। আত্মীয়স্বজন বার বার চাপ দিয়েছে বটে, কিন্তু আমি বার বার এড়িয়ে গেছি। ধরে নিন, এটা এক ধরনের আলসেমী। আপনি একজন পূর্ণবয়স্ক যুবক মানুষ। আপনার কোনো খারাপ অসুখটসুখ নেই তো? কিছু মনে করবেন না। আমি একজন ডাক্তার। ডাক্তারের মতো প্রশ্ন করছি। আমি বললাম, শরীরের ভেতরের ব্যাপারস্যাপার সম্পর্কে তো স্থির নিশ্চিত হয়ে কিছু বলার ক্ষমতা আমার নেই। এমনিতে কোনো রোগটোগ আছে বলে তো মনে হয় না।
ডঃ মাইতি বললেন, এবার আমার কথা বলি। দয়া করে একটু শুনবেন কি? নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই, আপনি বলুন। তাহলে শুনুন, প্লেন এ্যান্ড সিম্পল টুথ। তায়েবার প্রতি আপনার মনের অবচেতনে গভীর ভালোবাসা রয়েছে বলে অন্য কোনো মেয়েকে ভালোবাসা বা বিয়ে করার কথা আপনি চিন্তাও করতে পারেননি। তার দিক থেকে হোক, আপনার দিক থেকে তোক বাস্তব অসুবিধে ছিলো অনেক, যেগুলো ডিঙোবার কথা ভাবতেও পারেননি। আমি বললাম, নদীতে বাঁধ দেয়ার কথা বলা যায়, কেনোনা নদীতে বাঁধ দেয়া সম্ভব। কিন্তু সমুদ্র বন্ধন করার কথা কেউ বলে না, কেনোনা তা অসম্ভব। আমার আর তায়েবার ব্যাপারটিও অনেকটা তাই।
ডঃ মাইতি বললেন, তায়েবা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে প্রায় এক মাস হয়। আপনি তো মাত্র গতকাল থেকেই দর্শন দিচ্ছেন। এই এক মাসে তার সম্পর্কে ডাক্তার হিসেবে আমার কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছে। দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এসে ধরে বসলেন, বাংলাদেশের একজন রোগিকে ভর্তি করতেই হবে। ডঃ ভট্টাচার্যি কিছুতেই রাজী হচ্ছিলেন না। কারণ, হাসপাতালে খালি বেড ছিলো না। শেষ পর্যন্ত আমার অনুরোধেই তিনি রাজী হলেন। মেয়েটাকে প্রথম থেকেই দেখে আমার কেমন জানি অন্যরকম মনে হয়েছিলো। এক মাস খুব দীর্ঘ সময় নয়। তবু এ সময়ের মধ্যে তাকে নানাভাবে জানার সুযোগ আমার হয়েছে। সত্যি বলতে কি, এ রকম স্বার্থবোধ বর্জিত মেয়ে জীবনে আমি একটিও দেখিনি। আমি বললাম, আমিও দেখিনি। এ ব্যাপারেও দেখেছি আপনার মতের সঙ্গে আমার মতের কোনো গরমিল নেই। সে যাক, শুনুন। তায়েবাকে দেখতে হাসপাতালে নানারকম মানুষ আসে। তার যতো কমপ্লেইন থাকুক, সকলের সঙ্গে যথা সম্ভব প্রাণখোলা কথাবার্তা বলে, হাসি ঠাট্টা করে। কখনো কারো কাছ থেকে কিছু দাবি করতে দেখিনি। দেখলাম, একমাত্র আপনার কাছেই তার দাবি। আপনাকেই ভাতমাছ রান্না করে আনতে বললো। আপনার কথা প্রায় প্রতিদিন আমাকে বলেছে। তবুও আপনি যখন এলেন দেখলাম আপনার সঙ্গেই ঝগড়া করছে। যদি আমি ধরে নেই যে তায়েবা আপনাকেই ভালোবাসে, তাহলে কি আমি অন্যায় করবো? আমি একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। তারপর হাসতে চেষ্টা করলাম। হয়তো, হবেও বা। ধন্যবাদ, ফুল চন্দন পড়ুক আপনার মুখে ডঃ মাইতি। আপনি মশায় চমৎকার কথা বলতে জানেন। কথার মারপ্যাঁচে ফসকে যাবেন তেমন সুযোগ আপনাকে দিচ্ছিনে। আপনি কি ভেবেছেন শুধু শুধুই আপনাকে বাড়িতে ডেকে এনেছি। আপনার সঙ্গে আমার মস্ত দরকার। যাক, ডঃ মাইতি আপনি আমার নিজের মূল্যটা আমার কাছে অনেকগুণ বাড়িয়ে দিলেন। এই কোলকাতা আসা অবধি কেউ আমাকে বলেনি, আমার সঙ্গে কারো দরকার আছে। নিজের দরকারেই সকলের কাছে সকালসন্ধ্যা ঘুরে বেড়াচ্ছি। তা বলুন, আপনার দরকারটা কি? শুনে হৃদয় ঠাণ্ডা করি। মশায় অতো রাগ কেনন? শুনবেন, শুনবেন অতো তাড়াহুড়া কিসের? আগে রাতের খাবারটা খান। এখনো তো সবে ন’টা বাজে। তারপর ডাক দিলেন, অনাথ। সে ছেলেটি এসে দাঁড়ালো। খাবার হয়েছে রে। ডালটা এখনো নামানো হয়নি। যা তাড়াতাড়ি কর।
আমি জিগগেস করলাম, ডঃ মাইতি আপনি কোয়াটারে একাই থাকেন? একা মানুষ, একাই তো থাকবে। আপনি বিয়ে করেননি? না মশায়, সে ফাঁদে আজো পা দেইনি। আপনি কি কাউকে ভালোবাসেন? ভালোবাসাটাসা আমাকে দিয়ে পোষাবে না। হঠাৎ করে কাউকে বিয়ে করে ফেলবো। এখনো করেননি কেনো? প্লেন এ্যাণ্ড সিম্পল টুথ হলো, এখনো সবগুলো বোনের বিয়ে দেয়া হয়নি। মশায় আপনি আর কোনো কিছু জিগগেস করবেন না। আপনাকে আমার প্রশ্নের জবাব দেয়ার জন্য নেমন্তন্ন করে এনেছি। আপনি যদি আমার কথা শুনতে চান যেয়ে সব কথা বলে আসবো। আমি বললাম, ডঃ মাইতি, আমাদের থাকার কোনো স্থির ঠিকানা নেই। কোথায় আপনাকে ডাকবো? তিনি বললেন, যখন আপনার দেশ স্বাধীন হবে তখন ডাকবেন। আমার যত কথা সব জানিয়ে আসবো। আর আপনার দেশটাও দেখে আসবো। আচ্ছা, বাই দ্যা বাই, তায়েবার মা, ভাই, বোন উনারা কোথায় আছেন বলতে পারেন? আমি বললাম, তার ইমিডিয়েট একটা ছোটো বোনের বিয়ে হয়েছিলো, সেটি ছাড়া আর মোটামোটি সকলের সংবাদ পেয়েছি। তায়েবার ছোটো ভাইটি ঢাকায়। বড়ো ভাই দিনাজপুরে ছিলেন শুনেছি। সেখান থেকে শুনেছি সীমান্ত অতিক্রম করেছে। আর ওরা তো তিন বোন কোলকাতা এসেছে। এক বোন ব্যারাকপুর না কোথায় অন্যান্য মেয়েদের সঙ্গে ট্রেনিং নিচ্ছে। একেবারে ছোট্টোটি একটা এক্সিডেন্ট করে বসেছে। কি নাম বলুন তো দানিয়েল সাহেব, আই থিঙ্ক আই নো হার। আমি বললাম, ডোরা। ডোরা তো একজন বুড়ো মতো ভদ্রলোককে নিয়ে মাঝে মাঝে হাসপাতালে তায়েবাকে দেখতে আসে। হঠাৎ করে আমি মেজাজ সংযম করতে পারলাম না। তাহলে ডোরাসহ ভদ্রলোক এখনো তায়েবার কাছে আসতে সাহস করেন? একটুখানি চোখলজ্জাও নেই। আরে মশায় আপনি ক্ষেপে গেলেন যে! আগে কি ব্যাপার বলেন তো। আমি বললাম, ঐ যে ভয়ঙ্কর ভদ্রলোক দেখেছেন তিনি ডোরাকে বিয়ে করে ফেলেছেন। ঢাকাতে ঐ ভদ্রলোক এবং তার স্ত্রী ছিলেন তায়েবাদের অভিভাবক। মহিলা শশীকান্ত নামের তার মেয়ের এক গৃহশিক্ষককে নিয়ে শান্তিনিকেতনে ললিতকলা চর্চা করতে গেছেন। আর এদিকে ইনি পাল্টাব্যবস্থা হিসেবে ডোরাকে বিয়ে করে বসে আছেন। আমার বিশ্বাস তায়েবার অসুখ বেড়ে যাওয়ার এটাই একমাত্র কারণ। তাছাড়া আমি আরো শুনেছি মুখের অন্ন জোটাবার জন্য তায়েবাকে অসুস্থ শরীর নিয়ে তিনটে করে ট্যুইশনি করতে হয়েছে। এই মানুষেরা সে সময় কোথায় ছিলেন? তায়েবার কি অসুখ আমি সঠিক বলতে পরবো না, তবে কথাটা সঠিক বলতে পারি অমানুষিক পরিশ্রম না করলে এবং কাণ্ডটি না ঘটালে তার আজ এ অবস্থা হতো না। এই লোকগুলোর নিষ্ঠুরতার কথা যখন ভাবি মাথায় খুন চেপে যায়। অথচ এরাই ঢাকাতে আমাদের কাছে আদর্শের কথা প্রচার করতো। আপনি অনেক আনকোরা তরুণের মধ্যে জীবনের মহত্তর সম্ভাবনা বিকশিত হয়ে উঠতে দেখেছেন, একথা যেমন সত্যি, তেমনি পাশাপাশি একথাও সত্য যে যুদ্ধের ফলে অনেক প্রতিষ্ঠিত মহাপুরুষের খোলস ফেটে খান খান হয়ে পড়েছে এবং আমরা এতোকালের ব্যাঘ্ৰ চৰ্মাবৃত ছাগলের চেহারা আপন স্বরূপে দেখতে পাচ্ছি। শরণার্থী শিবিরগুলোতে আমাদের মানুষের দুর্দশার সীমা নেই। ট্রেনিং ক্যাম্পগুলোতে আমাদের তরুণ ছেলেরা হাজার রকমের অসুবিধের সম্মুখীন হচ্ছে। দেশের ভেতরের কথা না হয় বাদই দিলাম। এখানে কোলকাতায় সাদা কাপড়চোপড় পরা ভদ্রলোকের মধ্যে স্থলন, পতন, যতো রকমেই নৈতিক অধঃপতন হচ্ছে, তার সবগুলোর প্রকাশ দেখতে পাচ্ছি। এখানে যত্রতত্র শুনতে পাচ্ছি, বুড়ো, আধবুড়ো মানুষেরা যত্রতত্র বিয়ে করে বেড়াচ্ছে। পাকিস্তানী সৈন্যদের নিষ্ঠুরতার কথা আমাদের জানা আছে। মাঝে মাঝে এই ভদ্রলোকদের তার তুলনায় কম নিষ্ঠুর মনে হয় না। আমি নিশ্চিত বলতে পারি তায়েবার সঙ্গে এরা কসাইয়ের মতো ব্যবহার করেছে। আমি জানি সে আমাকে কোনোদিন সেসব কথা জানতে দেবে না। এমন কি হাজার অনুরোধ করলেও না। আর আমিও জিজ্ঞেস করবো না। তবে একথা সত্যি যে তায়েবা যদি মারা যায় সেজন্য এঁরাই দায়ী। কিন্তু দুনিয়ার কোনো আদালতে সে মামলার বিচার হবে না।
ডঃ মাইতি নিঃশ্বাস ফেললেন। আপনার অনুমান অনেকটা সত্য। অতিরিক্ত পরিশ্রম এবং টেনশনই তার অসুখটার বাড়াবাড়ির কারণ। যাকগে, যা হয়ে গেছে তার ওপর আপনার তো কোনো হাত নেই। কিন্তু এখন কথা হচ্ছে তায়েবাকে নিয়ে। তার জন্য আপনি কি করতে পারেন? আমি বললাম, মাইতিদা নিজের চোখেই তো দেখতে পাচ্ছেন আমি কি অসহায়। আজ রাতে যেখানে ঘুমাই, কাল রাতে সেখানে যেতে পারি না। এখানে স্রোতের শেওলার মতো আমরা ঘুরে বেড়াচ্ছি। পঞ্চাশ পয়সা ট্রাম ভাড়া বাঁচাবার জন্য ছয় সাত মাইল পথ হাঁটতে আমাদের বাধে না। আজ যদি চোখের সামনে তায়েবা মারাও যায়, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য অবলোকন করা ছাড়া আমার করার কি থাকবে? তবে একটা দুঃখ থেকে যাবে। তায়েবা আপন চোখে বাংলাদেশের স্বাধীনতা দেখে যেতে পারবে না। স্বাধীনতা-অন্ত প্রাণ ছিলো তায়েবার। আলাপে আলোচনায় কথাবার্তায় দেখে থাকবেন, তার নামটি কি রকম কম্পাসের কাঁটার মতো স্বাধীনতার দিকে হেলে থাকে। উনিশশো উনসত্তরের আয়ুববিরোধী আন্দোলনে তায়েবা নিজে থেকে উদ্যোগী হয়ে একশো চুয়াল্লিশ ধারা ভঙ্গ করেছিলো। আমার ব্যক্তিগত লাভক্ষতি সেটা ধর্তব্যের বিষয় নয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সে দেখে যেতে পারবে না, এটাই আমার বুকে চিরদিনের জন্যে একটা আফশোসের বিষয় হয়ে থাকবে। আমি মিনতি করে জানতে চাইলাম, আচ্ছা মাইতিদা, আপনি কি দয়া করে জানাবেন, তায়েবার অসুখটা কি ধরনের? খুব কি সিরিয়াস? তিনি বললেন, আমি তো ভেবেছিলাম আপনি শক্ত মানুষ। এখন দেখছি মেয়ে মানুষের চাইতে দুর্বল। আগে থেকে কাঁদুনি গাইতে শুরু করেছেন। আচ্ছা ধরুন, তায়েবা মারা গেলো। তখন আপনি কি করবেন? আত্মহত্যা করবেন? আমি জবাব দিলাম, তা করবো না, কারণ সে বড়ো হাস্যকর হয়ে দাঁড়াবে। তাহলে কি করবেন? বসে বসে কাঁদবেন? আমি বললাম, তাও বোধ হয় সম্ভব হবে না। এইখানে এই কোলকাতা শহরে বসে বসে কাদার অবকাশ কোথায়? বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি মানুষের কাদবার যথেষ্ট সঙ্গত কারণ আছে। অনেকেই তাদের প্রিয়জন হারিয়েছে। আমিও না হয় তাদের একজন হয়ে যাবো। আপনি তাহলে কিছুই করতে যাচ্ছেন? ডঃ মাইতি ফের জানতে চাইলেন। আমি বললাম, কি করবো, কি করতে পারি? আপনার দিন কাটবে কেমন করে? আমি বললাম, দিন তো একভাবে না একভাবে কেটে যাবে, শুধু মাঝে মাঝে বুকের একপাশটা খালি মনে হবে। মশায় এততক্ষণে আপনি একটা কথার মতো কথা বলেছেন। অনিবার্যকে মেনে নিতেই হবে। এই কথাটা বলার জন্য আপনাকে ডেকে আনা হয়েছে। এখন তায়েবার রোগ সম্বন্ধে আপনি জিগ্গেস করতে পারেন, আমি জবাব দিতে প্রস্তুত। আমি বললাম, বলুন। ডাক্তার ভাবলেশহীন কণ্ঠে জানালেন, লিউক্যামিয়া। জিগগেস করলাম, ওটা কি ধরনের রোগ। তিনি বললেন, ক্যান্সারের একটা ভ্যারাইটি। জিগগেস করলাম, খুব কি কঠিন ব্যাধি। হ্যাঁ, খুবই কঠিন। আমি বললাম, অন্তত যুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত তায়েবা বেঁচে থাকবে তো। সে কথা আমি বলতে পারবো না। আমি একজন জুনিয়র ডাক্তার। ডঃ ভট্টাচার্য তাঁর টেস্টের রিপোর্ট বাঙ্গালোরে পাঠিয়ে অপেক্ষা করছেন। জানেন তো সেখানে ক্যান্সার ট্রিটমেন্টের একটা ওয়েল ইকুইপ সেন্টার আছে। সেখান থেকে এ্যাডভাইজ না আসা পর্যন্ত আমাদের বলার কিছু নেই। দিন একটা চারমিনার। আপনার সঙ্গে থাকলে আমাকেও চেইনস্মোকার হয়ে উঠতে হবে দেখছি। চলুন, খাবার দিয়েছে। কথায় কথায় অনেক রাত করে ফেললাম। আমি নীরবে তাকে অনুসরণ করলাম।
ডঃ মাইতির কোয়ার্টারে আমার চোখে এক ফোঁটা ঘুম আসেনি। সারারাত বিছানায় হাসফাস করেছি। কেমন জানি লাগছিলো। মনে হচ্ছিলো আমার সামনে একটা দেয়াল আচানক মাটি খুঁড়ে দাঁড়িয়ে গেছে। আমার খুব গরম বোধ হচ্ছিলো। মাঝে মাঝে মশারির ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে টেবিলে রাখা বোতল থেকে ঢেলে ঢক ঢক করে পানি খাচ্ছিলাম। আর একটার পর একটা সিগারেট টানছিলাম। দূরের রাস্তায় ধাবমান গাড়ির আওয়াজে আমার কেমন জানি মনে হচ্ছিলো। কোথাও যেনো কেউ ডুকরে ডুকরে কাঁদছে।
শেষরাতের দিকে একটু তন্দ্রার মতো এসেছিলো। সেই ঘোরেই স্বপ্ন দেখলাম আমার আব্বা এসেছেন। স্কুল হোস্টেলে থাকার সময়ে আমি যে বাড়িতে পেয়িংগেস্ট হিসেবে খেতাম, সে বাড়ির সামনে পথ আলো করে দাঁড়িয়ে আছেন। তার পরনে শান্তিপুরের চিকন পাড়ের ধুতি। গায়ে আদ্দির পাঞ্জাবি, গলায় ঝোলানো মক্কা শরীফ থেকে আনা ফুলকাটা চাদর। আর মাথায় কালো থোবাযুক্ত চকচকে লাল সুলতানী টুপী। আমি জিগ্গেস করলাম, আব্বা এতো সুন্দর কাপড়চোপড় পরে আপনি কোথায় চলেছেন? আমার প্রশ্নে তিনি খুবই অবাক হয়ে গেলেন। বেটা তুমি জানো না বুঝি, আজ তোমার বিয়ে। আমিও অবাক হলাম। কারণ আমি সত্যি সত্যি জানিনে। বাবা বললেন, কখনো কখনো এমন কাণ্ড ঘটে যায়। আমি বললাম, আব্বাজান আমার ঈদের চাপকান কই। অন্তত একখানা শাল এ উপলক্ষে আপনিতো আমাকে দেবেন। আব্বা সস্নেহে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, বেটা সাদা ধুতি পরো। আমি বিয়ের সময় সাদা ধুতি পরেই বিয়ে করেছিলাম। তোমার ভাইকেও ধুতি পরিয়ে বিয়ে দিয়েছি। তিনি আমার হাতে একখানা ধুতি সমর্পন করলেন। আমি বললাম, আব্বা আমি যে ধুতি পরতে জানিনে। বেটা বেহুদা বকো না। পরিয়ে দেয়ার মানুষের কি অভাব! যাও তাঞ্জামে ওঠো। আমি বললাম, এ শুভদিনে আপনি অন্তত একখানা ঘোড়ারগাড়ি ভাড়া করবেন না? আব্বা বললেন, বেটা মুরুব্বীদের সঙ্গে বেয়াদবি করা তোমার মজ্জাগত অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে দেখছি। যাও, তাঞ্জামে ওঠো। তারপর তিনি অদৃশ্য হয়ে গেলেন। কোথাও তাকে দেখলাম না। তারপর দেখলাম, চারজন মানুষ আমাকেই একটা খাঁটিয়ায় করে আমাদের গ্রামের পথ দিয়ে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তাদের কাউকে আমি চিনিনে। লোকগুলো আমার খাঁটিয়া বয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় সুর করে বলছে, বলো মোমিন আল্লা বলো। তাদের কণ্ঠের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে রাস্তার লোকেরাও বলছে, আল্লা বলো। আমি মনে মনে বললাম, এ কেমন ধারা বিয়ে গো। বাজী পোড়ে না, বাজনা বাজে না। অমনি পায়ের দিকে বহনকারী দু’জন লোক কথা কয়ে উঠলো। এই লাশটা পাথরের মতো ভারী। একে আমরা বয়ে নিয়ে যেতে পারবো না। মাথার দিকের বাহক দু’জন বললো, না না চলো। আর তো অল্প পথ। তোমরা যাও আমরা পারবো না। তারা কাঁধ থেকে কাত করে আমাকে রাস্তার ওপর ঢেলে দিলো। আমি ধপাস করে মাটিতে পড়ে গেলাম। তন্দ্রা টুটে গেলো। হাঁটুতে প্রচণ্ড চোট লেগেছে। চোখ মেলে চাইলাম, আমি ফ্লোরের ওপর শুয়ে আছি। আর শরীরে সত্যি সত্যি ব্যথা পেয়েছি। কাঁচের জানালার শার্সি ভেদ করে শিশুসূর্যের দু’তিনটে রেখা ঘরের ভেতরে জ্বলছে। খুব পিপাসা বোধ করছিলাম। আবার খাটে ওঠার কোনো প্রবৃত্তি হলো না। তিন চার মিনিট তেমনি পড়ে রইলাম। চোখ বন্ধ করে তার মধ্যে ঘটে যাওয়া ঘটনাকে মনে মনে সাজিয়ে তোলার চেষ্টা করছি। ডঃ মাইতি আমার কাঁধ নাড়া দিয়ে বললেন, একি দানিয়েল সাহেব, আপনি নীচে কেনো? আমি আস্তে আস্তে বললাম, স্বপ্নের ঘোরে খাট থেকে পড়ে গিয়েছি। বাঃ চমৎকার! আপনার মনে এখনো স্বপ্ন আসে, সুতরাং দুর্ভাবনার কোনো কারণ নেই। আশা করি দাড়ি কাটতে এবং স্নান করতে অমত করবেন না। আমি মৃদুস্বরে বললাম, না। তিনি বললেন, বাথরুমে শেভিং রেজার, সাবান ইত্যাদি দেয়া আছে। যান তাড়াতাড়ি যান, এখখুণি খাবার দেয়া হবে। বাথরুমে যেয়ে গালে সাবান ঘষতে ঘষতে দেখি থুতনির কাছে আট দশটা পাকা দাড়ি উঁকি দিচ্ছে। দু’কানের গোড়ায়ও অনেকগুলো বাঁকা চোরা রূপালী রেখা। চোখ ফেটে কান্না আসতে চাইছিলো। আহা আমার যৌবন শেষ হতে চলেছে। আমি বুড়োত্বের দিকে এগুচ্ছি। এতোদিন চোখে পড়েনি কেনো। এক মাসের মধ্যেই কি ম্যাজিকটা ঘটে গেলো।
ডঃ মাইতির সঙ্গে খাবার টেবিলে গেলাম। চুপচাপ লুচি, হালুয়া, ডিম এবং চা খেয়ে গেলাম। আমার কথাবার্তা বলার কোনো প্রবৃত্তি হচ্ছিলো না। তিনিও বিশেষ আগ্রহ দেখাচ্ছিলেন না। সিগারেট জ্বালাতে গিয়ে হঠাৎ তার চোখে চোখে পড়ে যাই। মনে হলো তিনি যেনো কি একটা গভীর বিষয় নিয়ে চিন্তা করছেন। ডঃ মাইতির সঙ্গে আমার একটা সহজ সম্পর্ক তৈরি হয়েছিলো। কিন্তু এই এক রাতের মধ্যে তাতে যেনো একটা বিস্ফোরণ ঘটে গেছে। আমার মনের এরকম একটা অবস্থা, যা ঘটুক আমি কেয়ার করিনে। চারপাশের লোকজন এদের আমি চিনিনে, চিনতেও চাইনে। ডঃ মাইতি আমাকে জিগগেস করলেন, সকালবেলা তায়েবাকে একবার দেখে যাবেন কি? আমি নিস্পৃহভাবে বললাম, চলুন। কোনো ব্যাপারে আর উৎসাহ নেই। গতরাতে তায়েবা যদি ঘুমের মধ্যে মরেও গিয়ে থাকে, আমি যদি হাসপাতালে যেয়ে তার মরা শরীর দেখি, তবু কেঁদে বুক ভাসাবো না। আমি কি করবো, আমার করার কি আছে।
সে যাক, ডঃ মাইতির পেছন পেছন আমি তায়েবার ওয়ার্ডে প্রবেশ করলাম এবং অবাক হয়ে গেলাম। এই সাত সকালে জাহিদুল এবং ডোরা তায়েবার বিছানার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। অন্য সময় হলে বোধ করি আমি নিজের মধ্যে হলেও প্রচণ্ডভাবে ক্ষেপে উঠতাম। আজকে সে রকম কোনো অনুভূতিই হলো না। বরঞ্চ মনে হলো, ওরা আসবে একথা আমার মনের অবচেতনে জানা ছিলো। আমিও চুপচাপ তায়েবার মাথার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। সে পেছনের দেয়ালে হেলান দিয়ে বসেছে। এখনো মুখ ধোয়নি। ফ্যানের বাতাসে মাথার চুল উড়াউড়ি করছে। তার চোখেমুখে বেদনামথিত স্নিগ্ধ প্রশান্তির দীপ্তি। আমাকে দেখামাত্রই তার মুখে কথা ফুটলো। এই যে দানিয়েল ভাই, আসুন। আপনি কি কাল মাইতিদার কোয়ার্টারে গিয়েছিলেন? নইলে এতো সকালে আসবেন কেমন করে? আমি মাথা নাড়লাম, তারপর নীরবে জাহিদুলের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।
জাহিদুলের মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেলো না। তায়েবাদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর থেকেই একটা জিনিস আমি লক্ষ্য করে আসছি। আমরা পাশাপাশি বসে কথা বলতে দেখলে ভুকুটি জোড়া মেলে ধরতেন। তিনি আমাদের পরিচয় আর মেলামেশা কখনো সহজভাবে নিতে পারেননি। এমনকি একাধিকবার মন্তব্য করেছেন, আমি ভীষণ নারীলোলুপ মানুষ। নানা গুণের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও আমি তাঁকে ভড়ং সর্বস্ব একটা ফাঁকা মানুষ জ্ঞান করে আসছি। আর সুযোগ পেলে কখনো ছেড়ে কথা বলিনি। আজকে তিনিও মৃদু হেসে আমাকে অভ্যর্থনা জানালেন। সব কিছুর এমন পরিবর্তন ঘটলো কি করে? সকলেই কি তায়েবার ভাবী পরিণতি সম্পর্কে জেনে গেছে?
জাহিদুল সামনের দিকে ঝুঁকে একটা ব্যাটারিচালিত টেপরেকর্ডার বাজিয়ে তায়েবাকে কি সব গান শোনাচ্ছিলেন। আমার আচমকা উপস্থিতিতে সেটা অনেকক্ষণ বন্ধ ছিলো। তায়েবা বললো, রিউইন্ড করে আবার প্রথম থেকে বাজান জাহিদ ভাই। দানিয়েল ভাইও শুনুক। আমাকে বললো, দানিয়েল ভাই শুনুন, ডোরা দিল্লীতে রবীন্দ্র সঙ্গীতের একটি একক প্রোগ্রাম করেছে। গান বাজতে থাকলো। দেয়ালে হেলান দিয়ে তায়েবা চোখ বন্ধ করে রইলো। বাংলাদেশে থাকার সময়ে ডোরা রেডিও, টিভিতে রবীন্দ্র সঙ্গীতের অনুষ্ঠানে গান গাইতো। যখন গান বাজতো তখনো এমনি করে তায়েবা বিদ্যুতবাহিত স্বরতরঙ্গের মধ্যে নিজের সমস্ত চেতনা বিলীন করে দিত। “তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে যতো দূরে আমি ধাই, কোথাও মৃত্যু, কোথাও বিচ্ছেদ নাই।” ডোরার কণ্ঠ অত্যন্ত সুরেলা। তাতে যেনো বিষাদের একটুখানি ছোঁয়া আছে। এই ছোঁয়াটুকুর স্পর্শেই সঙ্গীতের সুদূরের আহ্বানটি যেনো প্রাণ পেয়ে জেগে উঠে। ডোরা জাহিদুলের কাছে গান শিখেছে। তাঁর সম্পর্কে যার যতোই নালিশ থাকুক, কিন্তু একটি কথা সত্য, যাকে গান শেখান প্রাণমন দিয়ে শেখান। আবার বেজে উঠলো “আমার যে সব দিতে হবে সে তো আমি জানি, আমার যতো বাক্য প্রভু, আমার যতো বাণী।” এমনি করে এক ঘণ্টার প্রোগ্রাম ক্যাসেট প্লেয়ারে বাজতে থাকলো। সবগুলো গান যেনো তায়েবার বর্তমান অবস্থার সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই নির্বাচন করা হয়েছে। তাহলে ডোরাও কি জেনে গেছে অন্তিম পরিণতিতে তায়েবার কি ঘটতে যাচ্ছে। মনের মধ্যে একটুখানি খুঁতখুঁতোনি অনুভব করছিলাম। তায়েবার সেই প্রিয়গান দুটো ডোরা বাদ দিয়েছে কেনো? ‘আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার’ এবং দাঁড়াও আমার আঁখির আগে। সকলে সবদিক দিয়ে তায়েবাকে যেনো অন্তিমযাত্রার জন্য প্রস্তুত করে তুলছে। ডোরা যে পার্ক সার্কাসের বাসায় তায়েবাকে সংজ্ঞাহীন রেখে দিল্লীতে জাহিদুলের সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছিলো, তাও বোধকরি এ জমজমাট নাটকের শেষ দৃশ্য ফুটিয়ে তোলার জন্য নিখুঁতভাবে পরিকল্পনা করেই করা হয়েছিলো।
ক্যাসেট শেষ হলে তায়েবা চোখ খুললো। তার ঠোঁটে হাসি খেলে গেলো। ডোরার গানের শেষে এমনি গর্বের হাসি তার চোখেমুখে খেলে যেতে পূর্বে আমি অনেকবার দেখেছি। তায়েবা খুব ক্ষীণকণ্ঠে জিগগেস করলো, লোকে কেমনভাবে নিয়েছে তোর গান ডুরি। বলাবাহুল্য তায়েবা ডোরাকে ডুরি নামেই ডাকে। এবার ডোরা মুখ খুললো। সে এক আজব ব্যাপার বাপ্পা। নানা জায়গা থেকে গান করার এতো অফার আসতে লাগলো যে গোটা মাসেই শেষ করা যেতো না। ডোরা তায়েবাকে বাপ্পা বলেই ডাকে। কি কারণে বড় বোনকে বাপ্পা বলে সম্বোধন করে তার ইতিকথা আমি বলতে পারবো না। তায়েবা বললো, কয়েকটা অনুষ্ঠান করে এলেই পারতিস। এতো তাড়াতাড়ি কেননা চলে এলি। দিল্লী কতো বড়ো শহর, কতো জ্ঞানীগুণীর ভীড় সেখানে। হাতেরলক্ষ্মী পায়ে ঠেললি। ডোরা দু’হাতে তায়েবার গলা জড়িয়ে ধরলো। বাপ্পা তোমার শরীরের ওই অবস্থায়, সে হু হু করে কেঁদে ফেললো। তায়েবা গভীর আগ্রহে তার পিঠে হাত বুলোতে লাগলো। আমার অসুখতো লেগেই আছে, কিন্তু তোর সুযোগ তো আর প্রতিদিন আসবে না। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললো, জানেন দানিয়েল ভাই, কালকে আপনার যাওয়ার পর থেকে আমি সারারাত বমি করেছি। একবার তো বাথরুমে পা পিছলে পড়েই গিয়েছিলাম। ভাগ্য ভালো আয়াটা ছিলো। নইলে সারারাত পড়ে থাকতে হতো। তায়েবার কথা শুনে ডোরা আমার দিকে বড়ো বড়ো চোখ করে তাকিয়ে রইলো। জাহিদুলের সে পুরোণো ভুকুটি জোড়া জেগে উঠলো। তিনি এমনভাবে আমার দিকে তাকালেন, তার অর্থ করলে এরকম দাঁড়ায় যে জানতাম, তুমি এলেই একটা অঘটন ঘটবে। তিনি তায়েবাকে জিগ্গেস করলেন, কি হয়েছিলো, বমি হতে শুরু করলো কেনো, কখন পড়ে গিয়েছিলে, কই কিছুতো বলোনি। কিছু কুপথ্য মুখে দিয়েছিলে কি? তায়েবা বললো, না না, সে সব কিছুই না। সন্ধ্যের পর থেকে আপনাআপনি বমি হতে শুরু করলো। এক সময় পা পিছলে পড়ে গিয়েছিলাম, আমার মনে হলো, এ নাটকে যা ঘটবে সব দেখে যেতে হবে। পালন করার কোনো ভূমিকা থাকবে না। এমনকি একটা ফালতুরও নয়। অগত্যা আমি উঠে যেতে উদ্যত হলাম। তায়েবার দিকে তাকিয়ে বললাম, তাহলে এখন আসি। পরে না হয় একবার আসবো। না না দানিয়েল ভাই, যাবেন না। আপনার সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে, বরঞ্চ ডোরা তোরা যা। প্রোগ্রাম শেষ হলে যাবার পথে খবর দিয়ে যাস। ডোরা এবং জাহিদুল চলে গেলো। সে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, আমাদের ডোরা খুব গুণী। এরই মধ্যে দিল্লীতে প্রোগ্রাম করে এলো, আজ মহাজাতি সদনে গান গাইবে। আমার শরীরটা হয়েছে একটা মস্তবড়ো বোঝা। নইলে আমিও গান শুনতে যেতাম। অনুষ্ঠানে গাইবার সময় ডোরার গান শুনেছি কতোদিন হয়। মা শুনলে কি যে খুশী। হবে। দানিয়েল ভাই, আপনি একটু উঠে দাঁড়ান। আপনার কাঁধে ভর দিয়ে আমি একটু বাথরুমে গিয়ে মুখটা ধুয়ে নেবো। সকাল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি। আজ দশটায় আবার ডঃ ভট্টাচার্য এসে টেস্টফেস্ট কি সব করবেন। আর সহ্য হয় না। আমি তাকে ধরে ধরে বাথরুমে নিয়ে গেলাম। সে ট্যাপ ছেড়ে দিয়ে মুখে সাবান ঘষলো। তারপর মুখ ধুয়ে নিলো। চিরুনি নিয়ে চুল আঁচড়াতে চেষ্টা করলো। তায়েবা বললো, আমার পা দুটো কাঁপছে, দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিনে। আমি বেসিনে হাত দিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়াবো। আপনি আমাকে একটা টুল এনে দিন। আমি টুলটা এনে দিয়ে বসিয়ে দিলে সে হাঁপাতে লাগলো। তার মুখমণ্ডলে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দিলো। দানিয়েল ভাই, আপনাকে একটা কাজ করতে হবে। খাটের বাজুতে দেখবেন একটা প্লাস্টিকের ঝুড়ি আছে। সেখান থেকে খোঁজ করে একটা তাঁতের শাড়ি, পেটিকোট এবং ব্লাউজ এনে দিন না। এখনো বাসী কাপড় পরে রয়েছি। আমার গা কুটকুট করছে। গেন্ডারিয়ার বাসাতেও দেখেছি প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে ঘরদোর পরিষ্কার করে গোসল সেরে একটা ধোয়া কাপড় পরেছে। আমি প্লাস্টিকের ঝুড়ি থেকে খোঁজ করে শাড়ি, ব্লাউজ এবং পেটিকোট বের করে তায়েবার হাতে দিলাম। সে বললো, এখন টুলটা টেনে ওই দরোজার কাছে নিয়ে কাপড়চোপড়গুলো পরতে হবে। আর আপনি একটু ওপাশে গিয়ে দাঁড়ান। তাকে বসিয়ে রেখে ওপাশে এসে আমি দরজা বন্ধ করে দিলাম। তায়েবা কোন্ কৌশলে এই অল্প পরিসর টুলের ওপর বসে কাপড় চোপড় পরবে আমি ভেবে ঠিক করতে পরছিলাম না।
কাপড় পরা শেষ হলে তায়েবা আমাকে ডাকলো। আমি দরজা খুলোম। কাপড়চোপড় পরেছে বটে, কিন্তু আঁচলটাকে সামলাতে গিয়ে ভারী অসুবিধে হচ্ছিলো। কাঁধ থেকে খসে মেঝেতে পড়ে আঁচলটা ভিজে গেলো। তায়েবা বললো, আপনি ভীষণ অপয়া। আমার আঁচলটা ভিজে গেলো। আঁচল তুলে নিয়ে সে পানি চিপে বের করে নিলো। আরেকবার আপনাকে কষ্ট করতে হবে। আমার শিথানে একটি ক্রীম আছে। কাপড় উঠালেই পাবেন। প্লিজ, সেটা গিয়ে একটু নিয়ে আসুন । আমি ক্রীমটাও নিয়ে তার হাতে দিলাম। সে আঙুলের ডগায় ক্রীম তুলে নিয়ে হাতের তালুতে ঘষে ঘষে মুখমণ্ডলে এবং ঘাড়ের কাছাকাছি লাগালো। এখন আপনি আবার আগের মতো দাঁড়ান। আমি দাঁড়ালাম। কিন্তু সে পায়ের ওপর ভর করে আর উঠতে পারলো না। উঃ দানিয়েল ভাই! আমি বললাম, কি তায়েবা। আমার হাঁটু দু’টো ঠক ঠক করে কাঁপছে। শরীরের সমস্ত শক্তি কাপড় পরতেই শেষ হয়ে গেছে। আপনি আমাকে পাঁজাকোলা করে বিছানায় রেখে আসুন না। আমি দুহাত দিয়ে তাকে উঠিয়ে নিলাম। সে একটি হাত আমার ঘাড়ের ওপর রাখলো। কাজটি শেষ হতে দু’মিনিট সময়ও ব্যয় হয়নি। তায়েবার সঙ্গে আমার পরিচয় চার বছর। কিন্তু এভাবে আত্মসমর্পন সে কখনো করেনি।
বিছানায় শুয়ে শুয়ে সে কয়েকবার হা করে শ্বাস ফেললো। বুঝলাম, তার অসম্ভব কষ্ট হচ্ছে। বেশ কয়েক মিনিট পর আমাকে জিগগেস করলো, দানিয়েল ভাই, আপনি কি ডোরার গান শুনতে যাবেন? যান তো একখানা টিকিট দিতে পারি। আমি বললাম, না, কারণ যেখানে থাকি সেখানে যেতে হবে। তারপর পত্রিকা অফিসে গিয়ে লেখার কিস্তিটি পৌঁছে দিয়ে আসতে হবে। সে কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকলো। তারপর নীরবতা ভঙ্গ করে বললো, আপনি ডুরির প্রতি এতো বিরূপ কেনো? ও কি সংসারের কিছু বোঝে? ঝোঁকের মাথায় একটা কাজ করে এসেছে, তা এমন সিরিয়াসলি না নিলেও তো পারেন। তার যখন জন্ম হয়েছিলো তখন মার ভয়ানক অসুখ ছিলো। আমি নিজের হাতেই সেবাযত্ন করে এতো ডাগরটি করেছি। একবার তো মরতেই চলেছিলো। উঃ তখন আমার ওপর কি ধকলটাই না গেছে! গায়ে গতরে বেড়েছে বটে। আসলে ওর কি বয়স হয়েছে? আপনি ওর দিকে একটু ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে তাকাতে পারেন না। মানুষের ভুলটাকে অতো বড়ো করে দেখেন কেনো?