০৩.২ সম্রাট অসুস্থ

অধ্যায়-১১

পরদিন সম্রাট উইশাউতে থামল, তার ডাক্তার ভিলিয়েরকে বারবার ডাকা হল। প্রধান ঘাঁটিতে এবং আশপাশের সৈন্যদের মধ্যে খবর রটে গেল যে সম্রাট অসুস্থ। আশপাশের লোকরা জানাল, সম্রাট কিছু খায়নি, আর রাতে ভালো ঘুমও হয় নি। নিহত ও আহতদের দৃশ্য তার স্পর্শকাতর মনের উপর এত বেশি চাপ সৃষ্টি করেছে যে তার ফলেই সে অসুস্থ হয়ে পড়েছে।

১৭ তারিখ ভোরবেলা সন্ধির পতাকা নিয়ে একজন ফরাসি অফিসার এল রুশ ম্রাটের সঙ্গে দেখা করতে। অফিসারটির নাম সাভারি। সম্রাট তখন সবে ঘুমিয়ে পড়েছে, তাই সাভারিকে অপেক্ষা করতে হল। দুপুরে তাকে সম্রাটের কাছে নিয়ে যাওয়া হল, আর এক ঘণ্টা পরেই প্রিন্স দলগরুকভকে সঙ্গে নিয়ে সে ফরাসি বাহিনীর অগ্রবর্তী ঘাটির দিকে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল।

গুজব রটে গেল, নেপোলিয়নের সঙ্গে আলেক্সান্দারের একটি সাক্ষাৎকারের প্রস্তাব করতেই সাভারিকে পাঠানো হয়েছিল। গোটা বাহিনীকে আনন্দিত ও গর্বিত করে সাক্ষাৎকারের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা হল, সকলের ধারণাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে এই আলোচনার প্রস্তাব যদি সত্যসত্যই শান্তি প্রতিষ্ঠার বাসনা থেকেই উদ্ভূত হয়ে থাকে সেই আশায় স্থির করা হয়েছে, স্বয়ং সম্রাটের পরিবর্তে উইশাউ যুদ্ধের বিজয়ী নায়ক দলগরুকভকে পাঠানো হোক নেপোলিয়নের সঙ্গে আলোচনায় বসতে।

সন্ধ্যার দিকে দলগরুকভ ফিরে এল, সোজা গেল জারের কাছে, এবং দীর্ঘসময় তার সঙ্গে একলা কাটাল।

১৮ ও ১৯ নভেম্বর সেনাবাহিনী দুইদিনের পথ অতিক্রম করল, এবং ছোটখাট গুলি-বিনিময়ের পর শত্রুপক্ষ ঘাঁটি ছেড়ে পিছিয়ে গেল। ১৯ তারিখ দুপুর থেকে সেনাবাহিনীর উচ্চতম মহলে তীব্র উত্তেজনাপূর্ণ কর্মব্যস্ততা শুরু হল এবং সেটা চলল ২০ তারিখ সকাল পর্যন্ত, তখনই শুরু হল অস্তারলিজের স্মরণীয় যুদ্ধ।

১৯ দুপুর পর্যন্ত সবরকম কর্মব্যস্ততা সীমাবদ্ধ ছিল সম্রাটের প্রধান ঘাঁটিতে। কিন্তু সেইদিন বিকেল থেকেই তা ছড়িয়ে পড়ল কুতুজভের প্রধান ঘাঁটিতে ও সেনাদলের অধিনায়কদের মধ্যে। সন্ধ্যা নাগাদ সব অ্যাডজুটান্টরা ছড়িয়ে পড়ল সেনাবাহিনীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে এবং ১৯ থেকে ২০ রাত্রিতে মিত্রবাহিনীর আশি হাজার সৈন্য রাতের ঘুম থেকে জেগে উঠল কলগুঞ্জনের মধ্যে, ছমাইল দীর্ঘ একটা সুসংহত বাহিনী এগিয়ে চলল স্রোতধারার মতো।

সকালে সম্রাটের প্রধান ঘাঁটিতে যে সুসংহত কর্মধারার সূচনা হয়েছিল এবং গোটা অভিযানের সূত্রপাত ঘটিয়েছিল তাকে তুলনা করা চলে একটা প্রকাণ্ড দুর্গ-ঘড়ির প্রধান চাকার গতির সঙ্গে। একটা চাকা ধীরে ধীরে ঘুরতে শুরু করল, তার থেকে চলতে লাগল আর একটা চাকা, তারপর তৃতীয় চাকা, গতি হতে লাগল দ্রুত থেকে দ্রুততর, দণ্ডযন্ত্র ও দাঁতওয়ালা চাকাগুলো চলতে শুরু করল, ঘণ্টা বাজতে লাগল, সংখ্যাগুলো দেখা দিল, আর এই সব কিছুর ফলে কাঁটা দুটো নিয়মিত গতিতে এগিয়ে চলল।

একটা ঘড়ির কলকজা বেলায় যেমন, একটা সামরিক যন্ত্রের কলকজার বেলায়ও তেমনই একবার কাজ শুরু হলেও চূড়ান্ত ফল পর্যন্ত সেটা এগিয়ে চলে। একটা ঘড়ির বেলায় যেমন অসংখ্য চাকা ও কপিকলের জটিল নড়াচড়ার ফলে কাঁটাগুলি ধীর ও নিয়মিত গতিতে চলে সময় নির্দেশ করে, ঠিক তেমনই ১৬০,০০০ রুশ ও ফরাসি বাহিনীর জটিল কর্মধারা-তাদের আবেগ, বাসনা, অনুশোচনা, লাঞ্ছনা, যন্ত্রণা এবং অহংকার, আতঙ্ক ও উৎসাহ–সবকিছুর একটিমাত্র ফল হল অস্তারলিজের যুদ্ধের অর্থাৎ তথাকথিত তিন সম্রাটের যুদ্ধের ক্ষয়-ক্ষিত-অর্থাৎ মানব-ইতিহাসের ডায়ালের উপর একটি কাটার ধীরগতিতে সঞ্চরণ।

সন্ধ্যা ছটায় কুতুজভ গেল ম্রাটের প্রধান ঘাঁটিতে, অতি অল্প সময় জারের সঙ্গে কাটিয়ে সে গেলে রাজসভার গ্র্যান্ড মার্শাল কাউন্ট তলস্তয়ের সঙ্গে দেখা করতে।

এই সুযোগে বলকনস্কি গেল দলগরুকভের সঙ্গে দেখা করে আসন্ন যুদ্ধের কিছু বিবরণ সংগ্রহ করতে। সে বুঝতে পেরেছে, কোনো ব্যাপারে কুতুজভ বিচলিত ও অসন্তুষ্ট হয়েছে এবং প্রধান ঘাঁটিতে সকলেই তার উপর অসন্তুষ্ট হয়েছে।

দলগরুকভ বিলিবিনের সঙ্গে বসে চা খাচ্ছিল। বলল, আরে, আপনার খবর কি? এ চায়ের ব্যবস্থাটা আগামীকালের উদ্দেশে। আপনাদের বুড়ো মানুষটির খবর কি? মেজাজ খারাপ?

মেজাজ খারাপ বলব না, কিন্তু আমার মনে হয় তার কথা শোনা উচিত ছিল বলেই তার ধারণা।

কিন্তু সমর-পরিষদে তো সকলে তার কথা শুনেছিল, আর তিনি যখন যুক্তিপূর্ণ কথা বলবেন তখন আবার তার কথা শোনা হবে, কিন্তু এই মুহূর্তে যখন নেপোলিয়ন একটা সার্বিক যুদ্ধ ছাড়া আর কোনো কিছুকেই ভয় করে না তকন কালহরণ করা ও একটা কিছুর জন্য অপেক্ষা করে থাকা একেবারেই অসম্ভব।

প্রিন্স আন্দ্রু বলল, আচ্ছা, আপনি তাকে দেখেছেন? বোনাপার্ত দেখতে কেমন? তাকে দেখে আপনার কি মনে হয়েছে?

দলগরুকভ উত্তরে আর একবার বলল, হ্যাঁ, আমি তাকে দেখেছি, আমার দৃঢ় ধারণা একটা সার্বিক যুদ্ধকে সে যত ভয় করছে তেমন আর কোনো কিছুকেই নয়। সে যদি যুদ্ধকে ভয়ই না করবে তাহলে সেই সাক্ষাৎকারের প্রার্থনা জানিয়েছিল কেন? আলোচনাই বা কেন? আর তার চাইতেও বড় কথা, পশ্চাদপসরণ যখন তার যুদ্ধ পরিচালনা রীতির সম্পূর্ণ বিপরীত তখন সে পশ্চাদপসরণই বা করল কেন? আমাকে বিশ্বাস করুন, সে ভয় পেয়েছে, একটা বড় মাপের যুদ্ধকে সে ভয় পেয়েছে। তার দিন ফুরিয়েছে। আমার কথা শুনে রাখুন।

প্রিন্স আন্দ্রু আবার বলল, কিন্তু আমাকে বলুন লোকটি দেখতে কেমন?

পরনে ধূসর ওভারকোট, আমার মুখে ইয়োর ম্যাজেস্ট্রি ডাক শুনতে খুবই উদগ্রীব, কিন্তু তার বড়ই দুঃখ যে আমার কাছ থেকে সে-খেতাবটি পায়নি! এই ধরনের লোক আর কি, এর বেশি কিছু নয়। বিলবিনের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে দলগরুকভ বলল।

সে বলতেই লাগল, বৃদ্ধ কুতুজভের প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধা সত্ত্বেও আমি বলব, বোনাপার্তকে মুঠোর মধ্যে পেয়েও আমরা যদি অকারণে কালক্ষেপ করে তাকে পালাবার সুযোগ করে দেই অথবা আমাদের ফাঁকি দেবার সুযোগ দেই, তাহলে আমাদের জবাব হয় না। না, সুভরভ ও তার রাজনীতিকে আমরা ভুলতে পারি না–শত্রুর আক্রমণের অপেক্ষায় না থেকে নিজেই আক্রমণ কর। আমাকে বিশ্বাস করুন, যুদ্ধের ব্যাপারে বুড়ো ক্যাংটেটরদের (অকারণ কালক্ষেপকারী) অভিজ্ঞতা অপেক্ষা যুবকদের কর্মোৎসাহই শ্রেয়তর পথপ্রদর্শক।

কিন্তু আমরা তাকে কোন পথে আক্রমণ করব? আজই আমি ঘাঁটিগুলি দেখে এসেছি, কিন্তু তার প্রধান সেনাদল যে কোথায় আছে সেটা বলা একেবারেই অসম্ভব, প্রিন্স আন্দ্রু বলল।

সে নিজে আক্রমণের যে পরিকল্পনাটা করেছে সেটাই দলগরুকভকে বোঝাতে চাইল।

ওঃ, সে তো একই ব্যাপার, তাড়াতাড়ি এই কথা বলে দলগরুকভ টেবিলের উপর একটা মানচিত্র বিছিয়ে দিল। যা কিছু ঘটা সম্ভব সবই খুঁটিয়ে দেখা হয়েছে। সে যদি ব্রুনের সামনে থাকে…

খুব দ্রুতলয়ে কিছুটা অস্পষ্টভাবে দলগরুকভ ওয়েরদারের আক্রমণের ছকটা বুঝিয়ে বলল।

জবাব দিতে গিয়ে প্রিন্স আন্দ্রু নিজের ছকটা পেশ করে ওয়েরদারের ছকের দোষত্রুটি ও নিজের ছকের গুণের কথা বলতেই প্রিন্স দলগরুকভের মনোযোগ কেটে গেল, টেবিলের মানচিত্রের দিক না তাকিয়ে অন্যমনস্কভাবে তাকাল প্রিন্স আন্দ্রুর মুখের দিকে।

আজ রাতে কুতুজভের শিবিরে সমর-পরিষদের বৈঠক বসবে, এসব কথা আপনি সেখানেই বলতে পারবেন, দলগরুকভ বলল।

মানচিত্রের কাছ থেকে সরে গিয়ে প্রিন্স আন্দ্রু বলল, তাই করব।

এতক্ষণ পর্যন্ত বিলিবিন মৃদু হাসির সঙ্গে দুইজনের আলোচনা শুনছিল, এবার ঠাট্টার সুরে বলে উঠল, মশাইরা কি নিয়ে এত মাথা ঘামাচ্ছেন? আগামীকাল জয়ই হোক আর পরাজয়ই হোক, রুশ বাহিনীর গৌরব কিন্তু নিরাপদ। একমাত্র আপনাদের কুতুজভ ছাড়া সেনাপতিপদে একজনও রুশ ভদ্রলোক নেই! সেনাপতিরা হলেন : হের জেনারেল উইমফেন লে কোঁৎ দ্য ল্যাগারো, লে প্রিন্স দ্য লিচতাতে, লে প্রিন্স দ্য হোয়েলোহে, আর সবশেসে প্রিশশি এবং আরো সব পোলিশ নামধারী কর্তারা।

দলগরুকভ বলল, তুমি চুপ কর হে নিন্দুক! তোমার কথা সত্যি নয়, এখন আছেন দুজন রুশ, মিলোরাদভিচ ও দখতুরভ, আরো একজন আসছেন কাউন্ট আরাকচিভ, অবশ্য যদি তার স্নায়ুর শক্তিতে কুলোয়।

প্রিন্স আন্দ্রু বলল, যাই হোক, আমার মনে হয় জেনারেল কুতুজভ বেরিয়ে এসেছেন। মশাইরা, আমি আপনাদের সৌভাগ্য ও সাফল্য কামনা করি। দলগরুকভ ও বিলিবিনের সঙ্গে করমর্দন করে সে বেরিয়ে গেল।

ফিরবার পথে কুতুজভ চুপচাপ প্রিন্স আন্দ্রুর পাশেই বসেছিল, কালকের যুদ্ধ সম্পর্কে সে কি ভাবছে এ প্রশ্নটা প্রিন্স আলু তাকে না করে পারল না।

কুতুজভ কঠোর দৃষ্টিতে তার অ্যাডজুটান্টের দিকে তাকাল, তারপর একটু থেমে বলল, আমি মনে করি যুদ্ধে আমাদের হার হবে, কাউন্ট তলস্তয়কেও আমি সেই কথা বলেছি, আর তাকে অনুরোধ করেছি কথাটা সম্রাটকে বলতে। কিন্তু তিনি কি জবাব দিলেন ভাবতে পার? প্রিয় সেনাপতি, ভাত ও কাটলেট নিয়ে আমি বড় ব্যস্ত, যুদ্ধের ব্যাপারটা আপনিই দেখুন! হ্যাঁ…সেই জবাবই আমি পেয়েছি!

*

অধ্যায়-১২

রাত নটার একটু পরেই ওয়েরদার তার পরকিল্পনাটা নিয়ে কুতুজভের শিবিরে গেল, সেখানেই সমর পরিষদের বৈঠক বসবে। সব দলীয় অধিনায়কদেরই প্রধান সেনাপতির কাছে ডাকা হয়েছিল, একমাত্র ব্যাগ্রেশন ছাড়া আর সকলেই নির্ধারিত সময়ে এসে হাজির হল। প্রস্তাবিত যুদ্ধের উপর এখন ওয়েরদারের পরিপূর্ণ কর্তৃত্ব, সে যেনম উৎসুক, তেমনই চটপটে, আর সমর-পরিষদের সভাপতি হওয়া সত্ত্বেও অসন্তুষ্ট ও তন্দ্রালু কুতুজভ তার একেবারে বিপরীত। ওয়েরদার বুঝতে পেরেছে, এ যুদ্ধের গতি এখন তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। সে যেন একটা ভারি গাড়ির সঙ্গে জুড়ে দেওয়া ঘোড়ার মতো সবেগে পাহাড় থেকে নিচে নামছে। সে গাড়িটাকে টানছে, না গাড়িটাই তাকে ঠেলে দিচ্ছে তা সে জানে না, কিন্তু সে সবেগে ছুটে নামছে–এ গতি তাকে কোথায় নিয়ে যাবে সেকথা ভাববার সময়ও তার নেই। সে রাতে সে দুইবার শত্রুপক্ষের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করেছে, দুইবার রুশ ও অস্ট্রিয় দুই সম্রাটের সঙ্গে দেখা করে তার প্রতিবেদন রেখেছে, আর দুইবার গেছে প্রধান ঘাঁটিতে সব বিলি-ব্যবস্থা করতে, তাই এখন ক্লান্ত কুতুজভের বৈঠকে এসেছে।

কুতুজভ অস্তারলিজের কাছাকাছি কোনো সম্ভান্ত লোকের একটি ছোটখাট দুর্গ দখল করে বাস করছে। যে বড় বসবার ঘরটা এখন প্রধান সেনাপতির অফিস হয়েছে সেখানে হাজির হয়েছে স্বয়ং কুতুজভ, ওয়েরদার এবং সমর-পরিষদের সদস্যগণ। চা খেতে খেতে তারা প্রিন্স ব্যাগ্রেশনের আসার জন্য অপেক্ষা করছে। অবশেষে ব্যাগ্রেশনের আর্দালি এসে খবর দিল প্রিন্স বৈঠকে আসতে পারবে না। প্রিন্স আন্দ্রু ঘরে ঢুকে খবরটা প্রধান সেনাপতিকে দিল এবং কুতুজভের পূর্ব অনুমত্ৰিকমে বৈঠকে যোগ দিতে থকে গেল।

তাড়াতাড়ি আসন থেকে উঠে টেবিলের উপর মেলে রাখা ব্রুনের একটা ভৌগোলিক মানচিত্রের কাছে গিয়ে ওয়েরদার বলল, প্রিন্স ব্যাগ্রেশন যখন আসছে না তখন আমরা শুরু করে দিতে পারি।

কুতুজভ ঘুমন্ত অবস্থায় একটা নিচু চেয়ারে বসে ছিল, তার ইউনিফর্মের বোম খোলা থাকায় মোটা গলাটা কলারের উপর দিয়ে ঠেলে বেরিয়ে পড়েছে। ওয়েরদারের কথায় অনেক চেষ্টা করে একটা চোখ খুলে সে বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, আপনার যেমন ইচ্ছা! ইতিমধ্যেই দেরি হয়ে গেছে। বলেই সে আবার মাথাটা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজল।

সমর-পরিষদের সদস্যরা প্রথমে ভেবেছিল কুতুজভ ঘুমের ভান করে পড়ে আছে, কিন্তু প্রস্তাব পড়বার সময় তার নাক দিয়ে যে ধ্বনি নির্গত হতে লাগল তাতে বোঝা গেল যে সেই মুহূর্তে প্রধান সেনাপতি নিদ্রার দুর্বার মানবিক প্রয়োজন মেটাবার কাজেই একান্তভাবে ব্যস্ত আছে। যাতে একমুহূর্ত সময়ও নষ্ট না হয় এমনি ভঙ্গি করে ওয়েরদার কুতুজভের দিকে তাকাল, এবং সে যে ঘুমিয়ে পড়েছে সেবিষয়ে নিশ্চিত হয়ে একটা কাগজ তুলে নিয়ে একঘেয়ে গলায় উচ্চগ্রামে আসন্ন যুদ্ধের বিলি-বন্দোবস্তের কথা পড়তে শুরু করল : ১৮০৫ সালের ৩০ নভেম্বর তারিখে কোবেলনিজ ও সোকোলনিজের পশ্চাদ্বর্তী শত্রুপক্ষের ঘাঁটির উপর আক্রমণের পরিকল্পনা।

পরিকল্পনাটি যেমন জটিল তেমনই শক্ত। মনে হল সেনাপতিরা একান্ত অনিচ্ছায়ই মনোযোগ দিয়ে সেটা শুনছে। দীর্ঘদেহ জেনারেল বাক্সহোদেন দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে একটা জ্বলন্ত মোমবাতির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, মনে হচ্ছে সে কিছুই শুনছে না, নবার ইচ্ছাও নেই। ওয়েরদারের ঠিক উল্টো দিকে চকচকে চোখ মেলে তাকিয়ে আর গোঁফজোড়াকে উপরের দিকে বেঁকিয়ে সামরিক ভঙ্গিতে ঘাড় উঁচু করে বসে আছে লাসচে মিলোরাদভিচ। সারাক্ষণ সে ওয়েরদারের দিকে চোখ রেখে চুপচাপ বসে রইল। ওয়েরদারের ঠিক পাশেই বসেছিল কাউন্ট লাগারে, তার খাঁটি দক্ষিণ ফরাসি মুখে একটা সূক্ষ্ম হাসি লেগেই আছে, সারাক্ষণ সে ছবিওয়ালা একটা নস্যদানিকে আঙুলে ঘোরাতে ঘোরাতে সেইদিকেই তাকিয়ে রইল। একটা দীর্ঘ বাক্যের মাঝখানে নস্যদানি ঘোরানো থামিয়ে মাথাটা তুলে ওয়েরদারকে বাধা দিয়ে কিছু বলতে চাইল। অস্ট্রিয় সেনাপতি কিন্তু পড়েই চলল, রেগে দ্রুকুটি করল, কনুই দুটোতে ঝাঁকুনি দিল, যেন বলতে চাইল : তোমার মতামত আমাকে পরে বল, এখন ভালো ছেলের মতো মানচিত্রের দিকে তাকিয়ে আমার কথায় কান দাও।

কী ভূগোলের পড়ারে বাবা! স্বগতোক্তি মনে হলেও অপরের শোনার পক্ষে যথেষ্ট জোরেই লাগারে বলল।

ওয়েরদারের উল্টো দিকে বসেছিল আর একটি ছোটখাট মানুষ-দখতুরভ, ভোলা মানচিত্রের উপর ঝুঁকে পড়ে সে যুদ্ধের পরিকল্পনা ও অপরিচিত জায়গাটাতে বোঝাবার চেষ্টা করছিল। যে কথাগুলি সে ভালোভাবে শুনতে পাচ্ছে না সেগুলির এবং গ্রামের খটমট নামগুলির পুনরাবৃত্তি করতে সে ওয়েরদারকে কয়েকবার অনুরোধ করল। ওয়েরদার অনুরোধ রাখল, আর দখতুরভ সেগুলি লিখে নিল।

এইভাবে একসময় ওয়েরদারের একঘেয়ে কণ্ঠস্বর যখন থামল তখন কুতুজভ চোখ মেলল, যাঁতার ঘুম পাড়ানি গুনগুনানি থামলে যেমন যাতাওয়ালার ঘুম ভেঙে যায় ঠিক সেইরকম। ততক্ষণে ল্যাপারো তার হাতের সন্যদানি ঘোরানো থামিয়ে ওয়েরদারের যুদ্ধ-পরিকল্পনা সম্পর্কে কি যেন বলতে শুরু করেছে। তা শুনে কুতুজভ বলে উঠল, আপনি তাহলে এখনো ওই বাজে ব্যাপারে নিয়েই আছেন! বলেই সে আবার চোখ বুজল, তার মাথাটা আরো ঢলে পড়ল।

ওয়েরদারের যুদ্ধ-পরিকল্পনাকে সাধ্যমতো তীব্রভাবে আক্রমণ করে লাগারো যুক্তি দেখাল : আক্রান্ত হবার পরিবর্তে বোনাপার্ত তো অনায়াসে নিজেই আক্রমণ করতে পারে, আর সেক্ষেত্রে পুরো পরিকল্পনাটাই তো অকেজো হয়ে যাবে। ওয়েরদারও দৃঢ়তা ও তাচ্ছিল্যের সঙ্গেই সব আপত্তি খণ্ডন করতে লাগল, যেন আগে থেকেই এসব যুক্তির জন্য সে তৈরি হয়েই এসেছে।

বলল, সে যদি আমাদের আক্রমণ করতে পারত তাহলে তো আজই করত।

তাহলে আপনি মনে করেন সে শক্তিহীন? লাগারো বলল।

কোনো বৃদ্ধা স্ত্রী যখন ডাক্তারকে বলে চিকিৎসার ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিতে তখন তার মুখে যে হাসি দেখা দেয় সেইরকম হাসি হেসে ওয়েরদার বলল, তার তো আছে বড় জোর চল্লিশ হাজার সৈন্য।

সেক্ষেত্রে আমাদের আক্রমণের জন্য অপেক্ষা করে থেকে সে তো নিজের সর্বনাশই ডেকে আনছে, সূক্ষ্ম ব্যঙ্গের হাসি হেসে কথাটা বলে সে সমর্থনের আশায় মিলোরাদভিচের দিকে তাকাল।

মিলোরাদভিচ হয়তো অন্য কিছু ভাবছিল, সে শুধু বলল, ধৰ্মত বলছি, কাল যুদ্ধক্ষেত্রেই তো আমরা সবকিছু দেখতে পাব।

ওয়েরদার পুনরায় তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, শত্রু সব আগুন নিভিয়ে দিয়েছে, তার শিবির থেকে একটা একটানা শব্দ শোনা যাচ্ছে। এর অর্থ কি? হয় সে পশ্চাদপসরণ করছে–একমাত্র সেটাকেই আমাদের বয়–আর না হয়তো সে স্থান পরিবর্তন করছে। (তার মুখে ব্যঙ্গের হাসি।) সে যদি তুয়েরাসাতেও ঘাঁটি বানায়, তাহলে তো আমাদেরই অনেক ঝামেলা মিটে যাবে, আর আমাদের ব্যবস্থা সব যেমন আছে তেমনি থাকবে।

প্রিন্স আন্দ্রু অনেকক্ষণ থেকেই সন্দেহ প্রকাশের একটা সুযোগর জন্য অপেক্ষা করেছিল, এবার সে বলল, সেটা কি রকম?

এবার কুতুজভ জেগে উঠল, জোরে জোরে কাশতে কাশতে সেনাপতিদের দিকে তাকাল।

বলল, ভদ্রজনরা, আগামীকালের-বরং বলা যায় আজকের, কারণ মধ্যরাত্রি পার হয়ে গেছে-ব্যবস্থা তো আর এখন পাল্টানো যাবে না। সবই তো আপনারা শুনলেন, আর আমরাও আমাদের কর্তব্য করব। কিন্তু একটা যুদ্ধের আগে সবচাইতে বেশি জরুরি… সে একটু থামল, একটি ভালো ঘুম।

সে উঠবার জন্য গা ঝাড়া দিল। সেনাপতিরা অভিবাদন জানিয়ে চলে গেল। মধ্যরাত পার হয়ে গেছে। প্রিন্স আন্দ্রু বেরিয়ে গেল।

সমর-পরিষদে প্রিন্স আন্দ্রু তার বক্তব্যকে যথাযথভাবে প্রাশ করতে পারেনি, কিন্তু সেখানকার একটা অস্পষ্ট ও অস্বস্তিকর প্রভাব পড়েছিল তার মনের উপর। কাদের কথা ঠিক-দলগরুকভ ও ওয়েরদারের, নাকি যুদ্ধবিরোধী কুতুজভ ও ল্যাগারের-তা সে জানে না। কিন্তু নিজের মতামত পরিষ্কারভাবে সম্রাটকে জানানো কি কুতুজভের পক্ষে সত্যি সম্ভব ছিল না? এও কি সম্ভব যে রাজ-দরবারের জন্য, ব্যক্তিগত বিচার-বিবেচনার জন্য হাজার হাজার মানুষের জীবনকে আমার জীবন, আমার জীবনকে বিপন্ন করতে হবে?

সে ভাবতে লাগল, হ্যাঁ, এটা তো খুবই সম্ভব যে আগামীকালই আমার মৃত্যু ঘটবে। মৃত্যুর এই কথা মনে হতেই পরপর অনেক স্মৃতি, বহুদূরের ও অত্যন্ত ব্যক্তিগত অনেক স্মৃতি তার কল্পনায় ভিড় করল : তার মনে পড়ল বাবা ও স্ত্রীর কাছ থেকে বিদায়ের দৃশ্য, মনে পড়ল স্ত্রীকে ভালোবাসার প্রথম দিনগুলির কথা। স্ত্রীর গর্ভবতী হবার কথা মনে হতেই স্ত্রীর জন্য ও নিজের জন্য তার দুঃখ হল, আবেগাপ্লুত মনে সে ঘর থেকে বেরিয়ে সামনেই পায়চারি করতে লাগল।

কুয়াশা পড়েছে, আর সেই কুয়াশার ভিতর দিয়ে চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়েছে রহস্যজনকভাবে। সে ভাবতে লাগল, হ্যাঁ, আগামীকাল, আগামীকাল! কালই আমার সবকিছু শেষ হয়ে যেতে পারে! এইসব স্মৃতি মিলিয়ে যাবে, আমার কাছে তাদের কোনো অর্থই থাকবে না। আমার কেমন যেন মনে হচ্ছে, এই প্রথম আমার যা-কিছু দেখাবার আছে তা কালই দেখাতে হবে। সে যেন কল্পনায় দেখতে পেল-এই যুদ্ধ, তার ক্ষয়ক্ষতি, যুদ্ধটাকে একটিমাত্র স্থানে কেন্দ্রায়িত করা, আর অধিনায়কদের ইতস্তত মনোভাব। তারপর এল সেই সুখের মুহূর্ত, এল তুলো যার জন্য সে এতকাল অপেক্ষা করেছিল। দৃঢ়তার সঙ্গে স্পষ্ট ভাষায় নিজের অভিমত সে জানাল কুতুজভকে, ওয়েরদারকে, সম্রাটকে। তার মতের সত্যতায় সকলেই অভিভূত হল, কিন্তু কেউ সেটাকে রূপায়িত করতে এগিয়ে এল না, তাই একটা রেজিমেন্টকে, এক ডিভিশন সেনাদলকে সে একটা চূড়ান্ত স্থানে পরিচালিত করে একাই জয়লাভ করল। অপর একটি কণ্ঠস্বর বলে উঠল, কিন্তু মৃত্যু ও যন্ত্রণা? সে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে প্রিন্স আন্দ্রু জয়ের স্বপ্নেই বিভোর হয়ে রইল। পরবর্তী যুদ্ধের পরিকল্পনা সে একাই রচনা করল। সে নামেই কুতুজভের অ্যাডজুটান্ট, আসলে সে একাই সবকিছু করে। পরের যুদ্ধটাও সে একাই জিতল। কুতুজভকে সরিয়ে সেখানে তাকে বসানো হল। অপর কণ্ঠস্বর বলল, আচ্ছা, তারপর? যদি তার আগেই তুমি দশবার আহত বা নিহত না হও, বা তোমার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা না করা হয়, বেশ তো…তারপর?… প্রিন্স আন্দ্রু নিজেই জবাব দিল, তারপর, তারপর কী হবে আমি জানি না, জানতে চাই না, চাইতে পারি না, কিন্তু আমি যদি এটাই চাই–গৌরব চাই, লোকের কাছে পরিচিত হতে চাই, তাদের ভালোবাসা পেতে চাই, তাহলে সেটা তো আমার অপরাধ নয়, শুধু সেইজন্যই তো আমি বেঁচে আছি। হ্যাঁ, শুধু সেইজন্য! সে-কথা কাউকে কোনোদিন বলব না, কিন্তু হে ঈশ্বর! আমি যদি খ্যাতি ও মানুষের ভালোবাসা ছাড়া আর কিছুই না চাই তাহলে আমি কী করব? মৃত্যু, আঘাত, পরিবারের ক্ষতি-কোনো কিছুতেই আমি ভয় করি না। যারা আমার একান্ত আপন বাবা, বোন, স্ত্রী-তারা আমার কাছে যতই মূল্যবান ও প্রিয় হোক, তবু ভয়ঙ্কর ও অস্বাভাবিক মনে হলেও একটি মুহূর্তের গৌরবের জন্য, মানুষের উপর জয়লাভের জন্য, পরিচিত ও অপরিচিত মানুষদের ভালোবাসা উঠোনে কিছু লোকের কথাবার্তা তার কানে এল, জিনিসপত্র বাঁধাছদা করতে করতে আর্দালিরা কথা বলছে, সম্ভবত কোয়ানটি কুতুজভের বুড়ো রাধুনিটির পিছনে লেগেছে। প্রিন্স আন্দ্রু তাকে চেনে, নাম তিত। সে বলছে, তিত, আমি বলছি তিত!

আচ্ছা? বুড়োটি বলল।

যাও তিত, গাওগে গীত! রসিক লোকটি বলল।

আরে, সব উচ্ছন্নে যা! বুড়ো বলল, আর্দালি ও চাকরদের হাস্যরোলে তার কণ্ঠস্বর চাপা পড়ে গেল।

যাই হোক না কেন, সকলের উপর জয়লাভকেই আমি ভালোবাসি, মূল্য দেই। এই কুয়াশার মধ্যে আমার মাথার উপরে যে অলৌকিক শক্তি ও গৌরব ভেসে বেড়াচ্ছে তাকেই আমি মূল্য দেই।

*

অধ্যায়১৩

সেই রাতে ব্যাগ্রেশনের সেনাদলের সামনে একটা খণ্ডযুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব পড়েছিল একটি পল্টনসহ রস্তভের উপর। তার হুজারদের দুজন করে সারি দিয়ে দাঁড় করানো হয়েছে, আর নিজের তন্দ্রার ভাবটা কাটানোর জন্য সে স্বয়ং অশ্বারোহণে চলেছে তাদের পাশে পাশে। কুয়াশার মধ্যেও আমাদের শিবির আগুনের অস্পষ্ট আলোয় চোখে পড়ছে পিছনকার বিস্তৃত প্রান্তর, সামনে কুশায়াচ্ছন্ন অন্ধকার। অনেক চেষ্টা করেও সেই কুয়াশার ভিতর দিয়ে রস্তভ দূরের কিছুই দেখতে পাচ্ছে না : কখনো মনে হচ্ছে শাদা কিছু চকচক করছে, কখনো দেখা যাচ্ছে কালো কালো কিছু, কখনো আলোর ফুটকি দেখে মনে হচ্ছে ওখানে শত্রুরা রয়েছে, আবার পরক্ষণেই মনে হচ্ছে সেটা তার চোখের ভুল। চোখ বুজে আসতেই কল্পনায় ভেসে উঠল–এই সম্রাট, এই দেনিসভ, এই মস্কোর কত স্মৃতি-তাড়াতাড়ি চোখ খুলতেই দেখতে পেল শুধু নিজের ঘোড়ার মাথা ও কান, হুজারদের কালো কালো মূর্তি, আর অনেক দূরে সেই একই কুয়াশাচ্ছন্ন অন্ধকার। রস্তভ ভাবতে লাগল :কেন হয় না?… এরকম তো সহজেই ঘটতে পারে যে সম্রাট আমার সঙ্গে দেখা করে বলবেন : যাও তো, দেখে এসো ওখানে কী আছে। এরকম ঘটনাক্রমে সম্রাটের সঙ্গে কোনো অফিসারের পরিচয় হল আর তিনি তাকে নিজের কাছে টেনে নিলেন-সম্রাট সম্পর্কে এরকম গল্প তো অনেক আছে। তিনি যদি আমাকেও তার পাশে একটু স্থান দেন তো দোষ কী? আঃ, আমি তাকে ভালোভাবে পাহারা দেব, তাকে সত্য কথা জানাব, তার প্রতারকদের মুখোশ খুলে দেব। হঠাৎ দূরের একটা হট্টগোলে তার তন্দ্রা ভেঙে গেল। চমকে উঠে সে চোখ খুলল।

চোখ খুলতেই তার কানে এল হাজার কণ্ঠের একটানা চিৎকার। দূরে একটা আগুন জ্বলে উঠেই নিভে গেল, তারপর আবার আগুন, পাহাড়ের উপরে ফরাসি বাহিনীর রেখা বরাবর আগুন জ্বলে উঠল, তাদের হৈ হুল্লা ক্রমেই বাড়তে লাগল। ফরাসিদের কথাবার্তারস্তভের কানে এল, কিন্তু সে কিছুই বুঝতে পারল না। নানা কণ্ঠস্বর মিলেমিশে একাকার, সে শুধু শুনতে পেল : আহা! আর। রস্তভ পাশের হুজারকে জিজ্ঞেস করল, ওটা কী? তুমি কিছু বুঝতে পারছ? ওটা নিশ্চয় শত্রুপক্ষের শিবির!

হুজার জবাব দিল না।

জবাবের জন্য অপেক্ষা করে রস্তভ পুনরায় জিজ্ঞেস করল, সে কী, তুমি শুনতে পাচ্ছ না?

হুজার অনিচ্ছার সঙ্গে জবাব দিল, কে বলতে পারে ইয়োর অনার?

রস্তভ পুনরায় বলল, যেদিকে দেখা যাচ্ছে তাতে শত্রুই হবে।

হুজার তো তো করে বলল, হতে পারে, আবার নাও হতে পারে। যা অন্ধকার… এই, স্থির হ! নিজের চঞ্চল ঘোড়াটাকে সে বলল।

রস্তভের ঘোড়াটাও চঞ্চল হয়ে উঠেছে, জমাট বরফের উপর পা ঠুকছে, শব্দ শুনে কান খাড়া করে আছে, আর চোখ রেখেছে আলোর দিকে। চিৎকার ক্রমেই বাড়তে বাড়তে এমন একটা প্রচণ্ড গর্জন উঠল যা একমাত্র কয়েক হাজার সৈন্যের পক্ষেই করা সম্ভব। আলোগুলোও ক্রমেই ছড়িয়ে পড়তে লাগল। রস্তভ এখন আর ঘুমিয়ে পড়তে চায় না। শত্রুবাহিনীর উল্লসিত জয়সূচক চিৎকার তাকে নতুন প্রেরণা জুগিয়েছে। সম্রাট দীর্ঘজীবী হোন! সম্রাট! এবার সে স্পষ্ট শুনতে পেল।

ওরা খুব বেশি দূরে নয়, হয়তো নদীটার ঠিক ওপারেই, রস্তভ বলল পাশ্ববর্তী হুজারকে।

হুজার জবাব না দিয়ে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল, রাগতভাবে কাশল। জোর কদমে ছুটে আসা ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ শোনা গেল, কুয়াশা ঢাকা অন্ধকারের ভিতর থেকে হঠাৎ আত্মপ্রকাশ করল জনৈক হুজার সার্জেন্টের মূর্তি, তাকে দেখাচ্ছে একটা হাতির মতো অতিকায়।

রস্তভের পাশে এসে সার্জেন্ট বলল, ইয়োর অনার, সেনাপতিরা!

রস্তভ তখনো আগুন ও হৈ হল্লার দিকেই তাকিয়ে ছিল। রস্তভ সার্জেন্টের সঙ্গে কয়েকজন অশ্বারোহীর সঙ্গে দেখা করতে এগিয়ে গেল। শত্রু শিবিরে আলো ও হল্লার এই বিচিত্র ঘটনা প্রত্যক্ষ করতে এসেছে প্রিন্স ব্যাগ্রেশন ও প্রিন্স দলগরুক অ্যাডজুটান্টদের সঙ্গে নিয়ে। রস্তভ ব্যাগ্রেশনের দিকে এগিয়ে যুদ্ধের অবস্থা জানাল, এবং পরে সেনাপতিদের বক্তব্য শুনবার জন্য অ্যাডজুটান্টদের সঙ্গে মিলিত হল।

প্রিন্স দলগরুকভ ব্যাগ্রেশনকে বলল, বিশ্বাস করুন, এটা একটা চালাকি ছাড়া আর কিছুই না! সে নিজে পিছিয়ে গেছে, আর পশ্চাদ্বর্তী রক্ষীবাহিনীকে হুকুম দিয়েছে আমাদের ঠকাতে আগুন জ্বেলে হৈ-হল্লা করতে।

ব্যাগ্রেশন বলল, তা নয়। আজ সন্ধ্যায় তাদের আমি ওই গোল পাহাড়টার উপর দেখেছিলাম, পশ্চাদপসরণ করলে তারা ওখান থেকেও সরে যেত। …অফিসার!

সন্ধ্যায় তারা ওখানে ছিল, কিন্তু এখনকার কথা আমি জানি না ইয়োর এক্সেলেন্সি। আমার হুজারদের সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে দেখে আসব কী?রস্তভ জবাব দিল।

ব্যাগ্রেশন থামল, জবাব দেবার আগে কুয়াশার মধ্যে রভের মুখটা দেখতে চেষ্টা করল।

একটু চুপ করে থেমে বলল, আচ্ছা, তাই যাও, দেখে এসো।

যাচ্ছি স্যার।

রস্তভ ঘোড়ার পেটটা ঠুকে দিল, সার্জেন্ট ফেদচেংকো ও অপর দুইজনকে বলল তাকে অনুসরণ করতে এবং জোর কদমে ঘোড়া ছুটিয়ে পাহাড় বেয়ে নামতে লাগল। যে রহস্যময় ও বিপজ্জনক দূরবর্তী অঞ্চলে তার আগে আর কেউ যায়নি, মাত্র তিনজন হুজারকে সঙ্গে নিয়ে একাকী সেখানে যেতে পারায় সে যুগপৎ ভীত ও পরিতুষ্ট বোধ করল। ব্যাগ্রেশন পাহাড়ের উপর থেকে ডেকে বলল সে যেন নদী পেরিয়ে না যায়, কিন্তু রস্তভ সে কথা না শোনার ভান করে ঘোড়া ছুটিয়ে এগিয়েই চলল। একছুটে নিচে নামার পরে আমাদের অথবা শত্রুপক্ষের আগুন কোনোটাই তার চোখে পড়ল না, কিন্তু ফরাসিদের চিৎকার আরো স্পষ্ট হয়ে তার কানে এল। উপত্যকায় পোঁছে তার মনে হল সামনে একটা নদী আছে, কিন্তু কাছে গিয়ে দেখল সেটা একটা রাস্তা। রাস্তায় নেমে সে লাগামে টান দিল, রাস্তা ধরেই এগিয়ে যাবে, নাকি রাস্তা পার হয়ে কালো মাঠ ধরে পাহাড়ের দিকে এগিয়ে যাবে তা ভেবে ইতস্তব করল। কুয়াশার মধ্যে চকচকে শাদা রাস্তা ধরে এগিয়ে চলাই অধিকতর নিরাপদ হতো কারণ পথ ধরে কেউ এগিয়ে এলে সেটা সহজেই নজরে পড়বে। আমার পিছনে এস, বলে সে রাস্তাটা পার হয়ে পাহাড়ের দিকে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল-সন্ধ্যাবেলা ফরাসি রক্ষীদল যেখানে ছিল সেইদিক লক্ষ করে।

ইয়োর অনার, ওরা এসে পড়েছে! পিছন থেকে একজন হুজার চিৎকার করে বলল। কুয়াশার ভিতর থেকে হঠাৎ যে কালো মূর্তিটা বেরিয়ে এসেছে সেটা যে কি রস্তভ তা বুঝে উঠবার আগেই একটা আগুনের ঝিলিক দেখা দিল, সঙ্গে সঙ্গে একটা আওয়াজ হল, আর একটা বুলেট সোঁ সোঁ শব্দে উপরে উঠে একটানা বিষণ্ণ শব্দের মধ্যে মিলিয়ে গেল। বন্দুকের আর একটা গুলির ঝিলিক দেখা গেল। রস্তভ ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে ফিরে চলল। কিছুক্ষণ পরে পরেই আরো চারটে গুলির আওয়াজ হল, আর কুয়াশার মধ্যে নানারকম সুর তুলে বুলেটগুলো ছুটে গেল। উত্তেজনায় রস্তভ ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরল, ধীরে ধীরে ফিরে চলল। আরো কয়েকটা! আরো কয়েকটা! তার বুকের মধ্যে একটা খুশির কণ্ঠ বেজে উঠল। কিন্তু আর কোনো গুলি ছুটল না।

একেবারে ব্যাগ্রেশনের কাছাকাছি এসে রস্তভ আবার জোর কদমে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল এবং এক হাত তুলে অভিবাদন জানিয়ে সেনাপতির কাছে পৌঁছে গেল।

দলগরুকভ তখনো বারবারই বলছে যে ফরাসিরা ফিরে গেছে, আগুন জ্বেলেছে শুধু আমাদের ঠকাতে।

রস্তভ এসে পৌঁছবার পরেও সে বলল, তাতে কি প্রমাণ হল? তারা তো রক্ষীদের রেখেও পশ্চাদপসরণ করতে পারে।

ব্যাগ্রেশন বলল, কিন্তু প্রিন্স, পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে তারা সকলে এখনো চলে যায়নি। কাল সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করা যাক, কালই সবকিছু জানা যাবে।

অভিবাদনের ভঙ্গিতে এক হাত তুলে সামনে ঝুঁকে রস্তব বলল, ইয়োর এক্সলেন্সি, রক্ষীবাহিনী সন্ধ্যায় যেখানে ছিল এখনো সেখানেই আছে।

ব্যাগ্রেশন বলল, খুব ভালো, খুব ভালো। ধন্যবাদ অফিসার।

রস্তভ বলল, ইয়োর এক্সেলেন্সি, একটা অনুগ্রহ প্রার্থনা করতে পারি কি?

কি অনুগ্রহ?

আগামীকাল আমাদের অশ্বারোহী সেনাদলটিকে রিজার্ভে রাখা হবে। সেটাকে প্রথম অশ্বারোহী সেনাদলের সঙ্গে যুক্ত করার অনুরোধ কি করতে পারি?

তোমার না কী?

কাউন্ট রস্তভ।

ওঃ, বেশ তো, তুমি আমার সঙ্গেই থাকতে পার।

কাউন্ট ইলিয়া রস্তভের ছেলে? দলগরুকভ জিজ্ঞেস করল।

কিন্তু রস্তভ জবাব দিল না।

তাহলে আমি ভরসা করতে পারি তো ইয়োর এক্সেলেন্সি?

আমি হুকুম প্রচার করব।

রস্তভ মনে মনে বলল, কোনো সংবাদ দিয়ে কাল হয়তো আমাকে সম্রাটের কাছে পাঠানো হবে। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ।

শত্রুপক্ষের আগুন জ্বালানো ও হল্লা করার আসল কারণ হল, নেপোলিয়নের ঘোষণাপত্রটি যখন সৈন্যদের পড়ে শোনানো হচ্ছিল তখন সম্রাট স্বয়ং ঘোড়া ছুটিয়ে গেল ঘুমন্ত সৈন্যদের মধ্যে। তাকে দেখে সৈন্যরা খড়ে আগুন দিয়ে তার পিছন পিছন ছুটতে ছুটতে চিৎকার করতে লাগল, সম্রাট দীর্ঘজীবি হোক! নেপোলিয়নের ঘোষণাটি ছিল : সৈন্যগণ! উলমে অষ্ট্রিয় বাহিনীর পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে রুশ বাহিনী তোমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। যে সেনাদলকে তোমরা হোলাব্রুনে (একেই তলস্তয় শোনা গেবার্ন বলে উল্লেখ করেছেন। দুটো জায়গা পাশাপাশি অবস্থিত।) পর্যুদস্ত করেছিলে তারাই আবার এসেছে। আমাদের ঘাঁটি খুবই শক্তিশালী, তারা যখন ডানদিক থেকে আমাকে ঘিরে ধরবার জন্য এগিয়ে আসবে তখন তাদের একটা অংশ আমার সামনে পড়ে যাবে। সৈন্যগণ! আমি নিজে তোমাদের পরিচালনা করব। তোমাদের স্বাভাবিক শৌর্যের দ্বারা তোমরা যদি শত্রুসৈন্যদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা ও গোলযোগ সৃষ্টি করতে পার, তাহলে আমি থাকব যুদ্ধ খেতে দূরে, কিন্তু যদি মুহূর্তের জন্যও জয় সম্পর্কে সন্দেহ দেখা দেয় তাহলে দেখতে পাবে শক্রর প্রথম আঘাতের সামনে বুক পেতে দাঁড়িয়েছে তোমাদের সম্রাট, কারণ জয়লাভ সম্পর্কে কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না, বিশেষ করে আজকের দিনে যখন আমাদের জাতির সম্মানের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ফরাসি পদাতিক বাহিনীর সম্মান বিপন্ন।

আহতদের সরিয়ে নেবার অজুহাতে তোমাদের ব্যুহ ভেঙে ফেল না! প্রতিটি সৈনিক যেন এই চিন্তায় উদ্বুদ্ধ হয় যে আমাদের জাতির প্রতি ঘৃণায় অনুপ্রাণিত ইংল্যান্ডের এই ভাড়াটে বাহিনীকে পরাস্ত করতেই হবে! এই জয়েই আমাদের অভিযানের সমাপ্তি হবে, আমরা ফিরে যেতে পারব আমাদের শীতকালীন বাসস্থানে, সেখানে ফ্রান্সে নতুন করে গড়ে তোলা ফরাসি বাহিনী আমাদের সঙ্গে যোগ দেবে, আর যে সন্ধি আমি করব তা হবে আমার জনগণের, তোমাদের এবং আমার নিজের যোগ্য।

*

অধ্যায়-১৪

সকাল পাঁচটা এখনো বেশ অন্ধকার। মধ্যবর্তী সেনাদল, রিজার্ভ সেনাদল এবং ব্যাগ্রেশনের দক্ষিণ পার্শ্বস্থ সেনাদল এখনো চলতে শুরু করেনি, কিন্তু বামপার্শ্বস্থ যে পদাতিক, অশ্বারোহী ও গোলন্দাজ সেনাদলের প্রথমে পাহাড় থেকে নেমে গিয়ে ফরাসি বাহিনীর দক্ষিণপা আক্রমণ করবার এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী তাদের বোহেমীয় পর্বতমালার দিকে ঠেলে নিয়ে যাবার কথা, তারা ইতিমধ্যেই জেগে উঠে নড়াচড়া শুরু করে দিয়েছে। যত কিছু বাড়তি জিনিস শিবির-আগুনে ফেলে দেওয়ার ফলে ধোয়ায় চোখ জ্বালা করছে। বাইরে ঠাণ্ডা ও অন্ধকার।

অফিসাররা তাড়াহুড়া করে চা খাচ্ছে, প্রাতরাশ খাচ্ছে, সৈন্যরা বিস্কুট চিবুচ্ছে, শরীর গরম করবার জন্য পা দিয়ে তাল ঠুকছে। চেয়ার, টেবিল, চাকা, বালতি, চালাঘরের অবশিষ্ট অংশ-এককথায় যা কিছু তাদের দরকার নেই অথবা বয়ে নিয়ে যেতে পারবে না সে সবই তারা আগুনের মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। যেই একজন অস্ট্রিয় অফিসারকে দেখা গেল কমান্ডিং অফিসারের বাসস্থানের সামনে, অমনি রেজিমেন্টটা চঞ্চল হয়ে উঠল : সৈন্যরা আগুনের কাছ থেকে ছুটে গেল, পাইপগুলো ঢুকিয়ে দিল বুটের মধ্যে, থলেগুলো তুলে দিল গাড়িতে, বন্দুক ঘাড়ে নিয়ে সার বেঁধে দাঁড়াল।

অফিসাররা কোটের বোতাম আটকাল, কোমরের পেটিতে তরবারি ঝোলাল, তারপর চিৎকার করতে করতে সৈন্যদের সঙ্গে চলতে লাগল। গাড়ির চালক ও আর্দালিরা গাড়িতে ঘোড়া জুড়ল, মালবোঝাই করল, সবকিছু বেঁধেছেদে নিল । অ্যাডজুটান্ট ও অধিনায়করা ঘোড়ায় চেপে ক্রুশ-চিহ্ন আঁকল, চূড়ান্ত নির্দেশ ও হুকুম জারি করল। তারপর শুরু হল সেনাদলের যাত্রা, কোথায় চলেছে তা জানে না, ধোঁয়া ও ক্রমবর্ধমান কুয়াশার জন্য যে জায়গা ছেড়ে যাচ্ছে তাও দেখতে পাচ্ছে না, আবার যেখানে চলেছে তাও দেখতে পাচ্ছে না।

কুয়াশা এত ঘন হয়ে উঠেছে যে আলো ফোঁটা সত্ত্বেও দশ পা দূরের কাউকে দেখা যাচ্ছে না। ঝোঁপগুলোকে দেখাচ্ছে মস্তবড় গাছের মতো, সমান জমিকে দেখাচ্ছে উঁচু-নিচু। যে কোনো জায়গায় যে কোনো দিকে দশ পা দূরেই অদৃশ্য শত্রুর সঙ্গে মোকাবিলা হয়ে যেতে পারে। কিন্তু সেনাদলগুলি দীর্ঘ সময় ধরে একই রকম কুয়াশার মধ্যে চড়াই-উতরাই পেরিয়ে, বাগান-বেড়া এড়িয়ে, নতুন নতুন অজানা জমির উপর দিয়ে এগিয়ে চলল, কোথাও শত্রুর মুখোমুখি হল না। উপরন্তু সৈন্যরা বুঝতে পারল, সামনে-পিছনে সবদিকেই অন্যসব রুশ সৈন্যরাও একই দিকে এগিয়ে চলেছে। প্রতিটি সৈন্য একথা জেনে খুশি হল, যে অচেনা জায়গায় সে চলেছে সেখানে আমাদেরই আরো অনেক সৈন্য চলেছে।

তারা বলাবলি করছে, ঐ দেখ, কুন্ঠিরাও আমাদের পাশ দিয়ে চলে গেল।

কী আশ্চর্য দেখ, আমাদের কত সৈন্য এখানে জমায়েত হয়েছে! কাল রাতে আমি শিবির-আগুনের দিকে তাকিয়েছিলাম, তার যেন আর শেষ নেই। মনে হল, বুঝি খাস মস্কোতেই আছি!

ঘন কুয়াশার মধ্যে প্রায় একঘণ্টা চলবার পরে অধিকাংশ সৈন্যকে থামতে হল, ফলে অস্বস্তির সঙ্গে সকলের মনে হল, কোথাও একটা বিভ্রান্তি ও গোলমাল ঘটেছে। এ ধারণা কেমন করে সকলের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল তা বলা শক্ত, কিন্তু অজান্তেই অতি দ্রুত ধারণাটা ছড়িয়ে পড়ল। আর সঙ্গে সঙ্গেই সকলে ধরে নিল যে বোকা জার্মানদের (রুশ সৈন্যদের চোখে অস্ট্রিয় ও অন্যসব অ-রুশ সৈন্যই জার্মান) জন্যই এই গোলযোগ ঘটেছে, সকলেরই দৃঢ় ধারণা যে ঐ মাংসখেকোরাই একটা সাংঘাতিক বিপদের সূত্রপাত করেছে।

আমরা থেমে গেলাম কেন? রাস্তা বন্ধ না কি? অথবা আমরা কি ফরাসিদের মুখোমুখি হয়েছি।

তা নয়, তাদের কানও সাড়াশব্দ পাচ্ছি না। তারা হলে গুলি চালাত।

তাড়াহুড়া করে তো আমাদের রওনা করিয়ে দেওয়া হল, আর এখানে মাঠের মাঝখানে বেকার আমাদের থামিয়ে দেওয়া হল। ঐ পাজী জার্মানরাই যত নষ্টের গোড়া! বোকা শয়তানের দল!

হ্যাঁ, আমি হলে ওদের সামনে ঠেলে দিতাম, কিন্তু কোনো ভয় নেই, তারা পিছনে ভিড় করে আছে। আর এখানে আমরা ক্ষিধেয় মরছি।

একজন অফিসার বলল, আমি বলি, পথ কি শিগগির খুলবে? সকলে বলছে, অশ্বারোহী বাহিনী পথ আটকে দিয়েছে।

আ, পাজী জার্মানরা! নিজেদের দেশকেও ওরা চেনে না!

ঘোড়া ছুটিয়ে এসে একজন অ্যাডজুটান্ট চেঁচিয়ে বলল, আপনারা কোন ডিভিশনের?

অষ্টাদশ।

তাহলে আপনারা এখানে কেন? আরো অনেক আগেই তো আপনাদের এগিয়ে যাওয়া উচিত ছিল, এখন আর সন্ধ্যার আগে সেখানে পৌঁছতে পারবেন না।

কী সব বাজে হুকুম! কি যে করছে তা নিজেরাই জানে না! বলে অফিসার ঘোড়া ছুটিয়ে দিল।

তারপর একজন অধিনায়ক সক্রোধে অ-রুশ ভাষায় কি যেন বলতে বলতে পাশ কাটিয়ে চলে গেল।

তার কথার নকল করে একজন সৈন্য বলে উঠল, তাফা-লাফা! কি যে বিড়বিড় করে বলে গেল কিছুই বোঝা গেল না। শয়তানদের গুলি করা উচিত।

হুকুম হয়েছিল নয়টার আগে সেখানে পৌঁছতে হবে, কিন্তু এখনো আমরা আধাপথও পার হইনি। চমৎকার হুকুম! চারদিক থেকে নানা কণ্ঠে কথাগুলি ধ্বনিত হতে লাগল।

গোলমালের আসল কারণ হল, অস্ট্রিয় অশ্বারোহী বাহিনী যখন আমাদের বাঁদিক থেকে অগ্রসর হচ্ছিল তখন আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ দেখতে পেল যে আমাদের কেন্দ্রবর্তী সেনাদল ডান-দিককার সেনাদল থেকে

অনেকটা সরে গেছে, আর তাই অশ্বারোহী বাহিনীকে হুকুম করা হল, তারা যেন ডান দিকে ঘুরে যায়। কয়েক হাজার অশ্বারোহী পদাতিক সামনে দিয়ে চলতে শুরু করল, আর তাই পদাতিক বাহিনীকে থেমে পড়তে হল।

একঘন্টা আটক থাকার পর শেষপর্যন্ত তারা পাহাড় বেয়ে নামতে শুরু করল। পাহাড়ের উপরে কুয়াশা সরতে শুরু করলেও নিচে আরো ঘন হয়ে নেমেছে। সেই কুয়াশার মধ্যে সামনে একটা গুলির শব্দ শোনা গেল, তারপর আর একটা, প্রথমে অনিয়মিতভাবে কিছুক্ষণ পর পর… ট্রাটা… টাট–তারপর আরো নিয়মিতভাবে দ্রুতভাবে দ্রুততর গতিতে, গোল্ডবাক নদীর তীরে শুরু হল তুমুল যুদ্ধ।

তারা ভাবেনি নদীর তীরে শত্রুর সঙ্গে দেখা হবে, কুয়াশার মধ্যে হঠাৎ শত্রুর একেবারে মুখে এসে পড়েছে, অধিনায়করাও কোনো উৎসাহের বাণী শোনাচ্ছে না, সকলের মনেই একটা ধারণা জন্মেছে যে তারা অনেক দেরি করে ফেলেছে, তার উপরে ঘন কুয়াশায় তারা কোথাও কিছু দেখতেও পাচ্ছে না–এসব কারণে রুশ সৈন্যরা ধীরে সুস্থে কিছু গুলি ছুড়ল, কিছুটা এগিয়ে গেল, আবার থামল। অফিসার অথবা অ্যাডজুটান্টদের কাছ থেকেও সময়মতো কোনো নির্দেশ এল না, কারণ এই অপরিচিত পরিবেশে তারাও কুয়াশার মধ্যে ইতস্তত ঘুরছে, কার রেজিমেন্ট কোথায় আছে কিছুই বুঝতে পারছে না। এইভাবে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় সেনাদল যুদ্ধে নেমে পড়ল, কারণ তারা নিচের উপত্যকায় নেমে এসেছে। কুতুজভস চতুর্থ সেনাদল প্রাজেন পাহাড়ের উপরেই দাঁড়িয়ে রইল।

নিচে যেখানে যুদ্ধ শুরু হয়েছে সেখানটা এখনো ঘন কুয়াশায় ঢাকা, উপরের দিকটা পরিষ্কার হয়ে এলেও সামনে কী ঘটছে তার কিছুই দেখা যাচ্ছে না। শত্রু সৈন্যরা সকলেই মাইল ছয়েক দূরে আছে, (যেটা আমাদের ধারণা), না কি এই কুয়াশার সমুদ্রে তারা নিকটেই কোথাও আছে, বেলা আটটার আগে তা কেউ জানতে পারল না।

সকাল নয়টা। নিচে একটা কুয়াশা তখনো অখণ্ড সমুদ্রের মতো পড়ে আছে, কিন্তু আরো উঁচুতে শ্লাপ্পানিজ গ্রামে তখন আবহাওয়া বেশ পরিষ্কার হয়ে গেছে। মার্শালদের সঙ্গে নিয়ে নেপোলিয়ন সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। তার মাথার উপরে পরিষ্কার নীল আকাশ, কুয়াশার শাদা সমুদ্রের বুকে সূর্যের প্রকাণ্ড বৃত্তটা কাঁপছে একটা মস্ত বড়, ফাঁপা, রক্তিম নৌকোর মতো। সকোলনিজ ও শ্লাপ্পানিজ গ্রাম দুটির পিছনকার যেসব নদী ও খাড়ির পাশে ঘাঁটি স্থাপন করে আমরা যুদ্ধ শুরু করতে চেয়েছিলাম, গোটা ফরাসি বাহিনী, এমন কি নেপোলিয়ন নিজেও দলবল নিয়ে সেখানে ছিল না, তারা সকলেই রয়েছে এই পাশে আমাদের সেনাদলের এত কাছে যে খালি চোখেই নেপোলিয়ন একজন ঘোড়সওয়ার ও একজন পদাতিককে আলাদা করে চিনতে পারছে। ইতালি অভিযানের সময় নেপোলিয়ন যে নদী জোব্বাটা পরত সেটা পরেই একটা ছোট ধূসর আরবি ঘোড়ার সওয়ার হয়ে সে মার্শালদের কিছুটা সামনে রয়েছে। নিঃশব্দে সে পাহাড়শ্রেণীর দিকে তাকিয়ে আছে, মনে হচ্ছে সেগুলো যেন কুয়াশার সমুদ্র থেকে জেগে উঠেছে, সেখানে অনেক দূরে রুশ সৈন্যরা চলাফেরা করছে, নিচের উপত্যকায় গুলির আওয়াজ সে কান পেতে শুনছে। তার শীর্ণ মুখের একটা মাংসপেশীও কাঁপছে না। ঝকঝকে চোখ দুটি একটা জায়গার উপরেই স্থির নিবদ্ধ। তার ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হতে চলেছে। রুশ বাহিনীর একটা অংশ ইতিমধ্যেই উপত্যকায় নেহে পুকুর ও হ্রদগুলোর দিকে এগিয়ে চলেছে, আর বাকি অংশও প্রাজেন পাহাড়শ্রেণী ছেড়ে যাচ্ছে। নেপোলিয়নেরও মনের বাসনা ওই পাহাড়শ্রেণীকেই আক্রমণ করবে, কারণ ঘাঁটি হিসেবে ওটাই সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ। কুয়াশার উপর দিয়ে সে দেখতে পেল, প্রাজেন গ্রামের নিকটবর্তী দুটো পাহাড়ের ভিতরকার খড়িটা ধরে রুশ বাহিনী দলে দলে এগিয়ে চলেছে, তাদের বেয়নেটগুলো ঝিকমিক করছে, একের পর এক তারা উপত্যকার দিকেই অবিরাম এগিয়ে চলেছে, সারারাত অগ্রবর্তী ঘাঁটিগুলিতে চাকার ও পায়ের যেসব আওয়াজ শুনেছে, এবং রুশ সেনাদলের যে বিশৃঙখল গতিবিধি তার চোখে পড়েছে-এইসব থেকে সে পরিষ্কার বুঝতে পেলেছে যে মিত্রশক্তির বিশ্বাস যে সে রয়েছে তাদের সামনের দিকে অনেক দূরে, যে সেনাদলগুলি প্রাজেনের কাছাকাছি চলাফেরা করছে তারাই রুশ বাহিনীর কেন্দ্র, এবং সফল আক্রমণের পক্ষে সে কেন্দ্র ইতিমধ্যেই যথেষ্ট দুর্বল হয়ে পড়েছে। তথাপি নেপোলিয়ন যুদ্ধ শুরু করল না।

আজ তার কাছে একটা মস্ত বড় দিন-তার রাজ্যাভিষেকের বার্ষিকী দিবস। ভোরের আগে সে ঘণ্টাকয়েক ঘুমিয়েছে, তারপরে উৎসাহে, উদ্যমে ভরপুর হয়ে খোশ মেজাজে ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে ছুটে এসেছে এখানে, তার মনে এখন সেই সুখের হাওয়া যাতে মনে হয় যে সবকিছুই সম্ভব, সবকিছুই সাফল্যে ভরা। কুয়াশার উপর দিয়ে পাহাড়শ্রেণীর দিকে তাকিয়ে সে চুপচাপ বসে রইল, তার নিরুত্তাপ মুখে আত্মবিশ্বাস ও আত্মতৃপ্তির সেই বিশেষ দৃষ্টি ফুটে উঠেছে যা দেখা যায় মধুর ভালোবাসায় বিভোর কোনো বালকের মুখে। মার্শালরা তার পিছনে দাঁড়িয়ে রইল, তার মনোযোগে বিঘ্ন সৃষ্টি করতে সাহস পেল না। সে তাকাচ্ছে একবার প্রাজেন পাহাড়শ্রেণীর দিকে, আবার কুয়াশার ভিতর থেকে ভেসে আসা সূর্যের দিকে।

সূর্য যখন কুয়াশার ভিতর থেকে সম্পূর্ণ বেরিয়ে এল, এবং চারদিকে মাঠ ও কুয়াশা উজ্জ্বল আলোয় ঝলমল করে উঠল, তখন যেন এইজন্যই সে যুদ্ধ শুরু করার ব্যাপারে অপেক্ষা করেছিল–সে সুগঠিত হাত থেকে দস্তানা খুলে মার্শালদের উদ্দেশ্য কী যেন ইশারা করে যুদ্ধ শুরু করার নির্দেশ দিল। অ্যাডজুটান্টদের সঙ্গে নিয়ে মার্শালরা ঘোড়া ছুটিয়ে নানা দিকে ছুটে গেল এবং কয়েক মিনিট পরেই ফরাসি বাহিনীর প্রধান সেনাদল দ্রুতগতিতে প্রাজেন পাহাড়ের দিকে এগিয়ে চলল, ওদিকে রুশ সেনাদল তখন ক্রমাগত নিচের উপত্যকায় নেমে যাওয়ায় প্রাজেন পাহাড় জনশূন্য হয়ে পড়ছে।

*

অধ্যায়-১৫

আটটায় চতুর্থ সেনাদলের অধিনায়ক হিসেবে কুতুজভ সসৈন্যে এগিয়ে গেল প্রাৎজেনে। সম্মুখবর্তী রেজিমেন্টের সৈন্যদের অভিনন্দন জানিয়ে সে তাদের যাত্রা শুরু করার নির্দেশ দিল, তাদের বুঝিয়ে দিল যে সে নিজেই তাদের পরিচালনা করবে। প্রাজেন গ্রামে পৌঁছে সে থামল। প্রধান সেনাপতির দলবলের মধ্যে তার পিছনেই ছিল প্রিন্স আন্দ্রু। তার মনে চাপা উত্তেজনা ও বিরক্তি, দীর্ঘ প্রতীক্ষিত মুহূর্ত আসন্ন হওয়ায় আজ সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে বেঁধে রেখেছে। তার একান্ত বিশ্বাস, আজকের দিনটিই তার কাছে তবে তুলো, অথবা আর্কোলার সেতু (১৭৯৬ সালে এটাই ছিল নেপোলিয়নের এক উজ্জ্বল সাফল্যের ঘটনাস্থল)। সে ঘটনা কোন পথে ঘটবে তা সে জানে না, কিন্তু তার নিশ্চিত ধারণা যে তাই ঘটবে।

নিচে কুয়াশার মধ্যে বাঁদিক থেকে অদৃশ্য সৈন্যদের বন্দুকের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। প্রিন্স আন্দ্রুর ধারণা, যুদ্ধটা সেখানেই কেন্দ্রীভূত হবে। সে ভাবল, ওখানেই আমরা বিপদের সম্মুখীন হব, আর একটা ব্রিগেড বা ডিভিশন দিয়ে ওখানেই আমাকে পাঠানো হবে, আর ওখানেই পতাকা হাতে নিয়ে আমি এগিয়ে যাব, যা কিছু আমার সামনে পড়বে তাকেই ভেঙে চুরমার করে দেব।

অগ্রসরমান সৈনিকদের হাতের পতাকার দিকে সে শান্ত মনে তাকাতে পারছিল না, তার কেবলই মনে হচ্ছিল, হয়তো ওই পতাকাটি হাতে নিয়েই আমি সেনাদলকে পরিচালনা করব।

ঘন কুয়াশা এখন সকালবেলায় পাহাড়ের উপরে জমাট হিমানীকণা থেকে শিশিরে পরিণত হয়েছে, কিন্তু নিচের উপত্যকায় এখন কুয়াশাকে দেখাচ্ছে দুগ্ধশুভ্র সমুদ্রের মতো। উপত্যকার বাদিকে আমাদের সৈন্যরা নেমে গেছে, আর সেখান থেকেই আসছে গুলির শব্দ, কিন্তু সেখানকার কিছুই দেখা যাচ্ছে না। পাহাড়ের উপরে পরিষ্কার আকাশ, ডানদিকে সূর্যের প্রকাণ্ড বৃত্ত। সম্মুখে কুয়াশা-সমুদ্রের ওপারে দেখা যাচ্ছে গাছপালায় ঢাকা কয়েকটা পাহাড়, শত্রুসৈন্য সম্ভবত সেখানেই আস্তানা নিয়েছে, কারণ ওখানে কিছু একটা চোখে পড়ছে। ডানদিকে রক্ষীবাহিনী কুয়াশা-ঢাকা অঞ্চলে ঢুকে গেল, কানে এল তাদের ঘোড়র ক্ষুরের ও চাকার শব্দ, চোখে পড়ল তাদের বেয়নেটের ঝিলিক, বাঁদিক থেকেও অনুরূপ একটি অশ্বারোহী বাহিনী এসে কুয়াশার সমুদ্রে অদৃশ্য হয়ে গেল; সামনে ও পিছনে চলাফেরা করছে পদাতিক বাহিনী। প্রধান সেনাপতি দাঁড়িয়ে আছে গাঁয়ের শেষ প্রান্তে, সৈনিকরা তার পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে। সেই সকালে কুতুজভকে শ্রান্ত ও বিরক্ত মনে হচ্ছে। তার সামনে দিয়ে চলতে চলতে পদাতিক বাহিনী বিনা হুকুমেই হঠাৎ থেমে গেল, মন হল সামনে কোনো কিছুতে বাধা পেয়েছে।

একজন অশ্বারোহী অধিনায়ক সেখানে হাজির হলে কুতুজভ রেগে বলল, হুকুম দিন, সারিবদ্ধভাবে ওরা গ্রামটাকে ঘুরে এগিয়ে যাক। আপনি কি বুঝতে পারছেন না ইয়োর এক্সেলেন্সি প্রিয় মহাশয় যে শত্রুর বিরুদ্ধে অগ্রসর হবার সময় সংকীর্ণ গ্রামের পথে আপনি দলছুটভাবে এগিয়ে চলতে পারেন না?

অধিনায়ক জবাব দিল, গ্রামে ঢোকার মুখেই আমি ওদের শ্ৰেণীবদ্ধ করতে চেয়েছিলাম ইয়োর এক্সেলেন্সি।

কুতুজভ তিক্ত হাসি হেসে উঠল।

শত্রুপক্ষের চোখের সামনে ভালো দৃষ্টান্তই রেখেছেন! খুব ভালো!

শত্রুপক্ষ এখনো অনেক দূরে রয়েছে ইয়োর এক্সেলেন্সি। সেনাসমাবেশের চিত্র অনুসারে…

সেনাসমাবেশ! কুতুজভ চিৎকার করে উঠল। কে আপনাকে একথা বলেছে…দয়া করে হুকুমমতো কাজ করুন।

ঠিক আছে স্যার।

প্রিন্স আন্দ্রুর কানে কানে নেসভিৎস্কি বলল, বুড়ো দেখছি কুকুরের মতো ক্ষেপে গেছে।

টুপিতে সবুজ পালক গোঁজা শাদা ইউনিফর্ম-পরিহিত জনৈক অস্ট্রিয় অফিসার জোর কদমে ঘোড়া ছুটিয়ে এসে সম্রাটের নামে কুতুজভকে জিজ্ঞাসা করল, চতুর্থ সেনাদল যুদ্ধে নেমেছে কি না।

কোনো জবাব না দিয়ে মুখ ঘোরাতেই তার চোখ পড়ল পাশে দাঁড়ানো প্রিন্স আন্দ্রুর উপর। তাকে দেখে কুতুজভের মুখের ভাব কিছুটা নরম হল, তবু অস্ট্রিয় অ্যাডজুটান্টের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে সে বলকনস্কিকে বলল, দেখে এস তো তৃতীয় সেনাদলটি গ্রাম ছেড়েছে কি না। তাদের থামতে বল, তারা যেন আমার নির্দেশের অপেক্ষায় থাকে।

প্রিন্স আন্দ্রু যাবার জন্য পা বাড়াতেই সে তাকে থামিয়ে দিল।

দক্ষ বন্দুকবাজদের কাজে লাগানো হয়েছে কি না তাও জেনে এস। ওরা কি করছে? অস্ট্রিয় অফিসারকে কিছু না বলে কুতুজভ নিজের মনেই বলতে লাগল।

হুকুম তামিল করতেই প্রিন্স আন্দ্রু ঘোড়া ছুটিয়ে দিল। অগ্রসরমান সেনাদলকে ধরে ফেলে তাদের থামিয়ে সে প্রথমেই বুঝে নিল যে আমাদের সেনাদলের সামনের সারিতে কোনো দক্ষ বন্দুকবাজ নেই। প্রধান সেনাপতির হুকুম শুনে রেজিমেন্ট-অধিনায়ক খুবই অবাক হয়ে গেল। তার নিশ্চিত ধারণা, তার সামনে অন্য দল রয়েছে, আর শত্রুপক্ষ রয়েছে অন্তত ছয় মাইল দূরে। ঘন কুয়াশায় ঢাকা অনুর্বর উতরাই ছাড়া সামনে আর কিছুই চোখে পড়ছে না। প্রধান সেনাপতির নামে ভুল সংশোধনের হুকুম দিয়ে প্রিন্স আন্দ্রু ঘোড়া ছুটিয়ে ফিরে গেল। কুতুজভ তখনো সেই একই জায়গায় বয়সের ভারে ক্লান্ত ভারি দেহ নিয়ে ঘোড়ার পিঠে পেচে বসে চোখ বুজে হাই তুলছে। সৈন্যরা এখন আর এগিয়ে যাচ্ছে না, বন্দুকের কুঁদো মাটিতে চুঁইয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

খুব ভালো, খুব ভালো! প্রিন্স আল্লুকে কথাটা বলে সে পাশে দাঁড়ানো ঘড়ি-হাতে অধিনায়কের দিকে ফিরে তাকাল, সে বলতে লাগল, যেহেতু বাঁদিককার সেনাদল নিচে নেমে গেছে, এবার তাদের যাত্রা শুরু করবার সময় হয়েছে।

হাই তুলতে তুলতেই কুতুজভ অস্ফুটে বলল, অনেক সময় আছে ইয়োর এক্সেলেন্সি। সে আবারও বলল, যথেষ্ট সময় আছে।

ঠিক সেই সময় কুতুজভের পিছন দিক থেকে রেজিমেন্টের অভিবাদনের শব্দ শোনা গেল, সে শব্দ অগ্রসরমান রুশ সেনাদলের একদিক থেকে আর একদিক ব্যেপে দ্রুত এগিয়ে আসতে লাগল। বোঝা গেল সৈন্যরা যাকে অভিবাদন জানাচ্ছে সে অতি দ্রুত এগিয়ে আসছে। কুতুজভের ঠিক সম্মুখবর্তী সৈন্যরা যখন সে আওয়াজে যোগ দিল তখন সে একপাশে সরে গিয়ে ভুরু কুঁচকে চারদিকে তাকাতে লাগল। প্রাজেন থেকে আসবার রাস্তা ধরে বিভিন্ন ইউনিফর্ম পরিহিত একদল অশ্বারোহী জোর কদমে ছুটে আসছে। তাদের দুইজন আসছে পাশাপাশি দ্রুত ঘোড়া ছুটিয়ে। একজনের পরনে কালো ইউনিফর্ম, টুপিতে পালক গোঁজা, বাদামি রঙের ঘোড়া, অপর জনের শাদা ইউনিফর্ম, কালো রঙের ঘোড়া। দুই সম্রাট আসছে, পিছনে দলবল। অভিজ্ঞ সৈনিকের ভঙ্গিতে কুতুজভ হাঁক দিল, সাবধান। তারপর এগিয়ে গিয়ে সম্রাটকে অভিবাদন জানাল। তার গোটা চেহারাও ভাবভঙ্গি হঠাৎ পাল্টে গেল। বিনা তর্কে বশংবদ হবার ভঙ্গি তার চোখে-মুখে। তার এই বশংবদ শ্রদ্ধার ভাবে আলেক্সান্দার কিন্তু খুশি হল না।

অবশ্য সে অখুশির ভাবটা নির্মল আকাশের বুকে একটুকরো মেঘের মতো সম্রাটের যৌবনদীপ্ত মুখের উপর মুহূর্তের জন্য ভেসে উঠেই মিলিয়ে গেল। ওলমুজ যুদ্ধক্ষেত্রে বলকনস্কি যখন তাকে দেশের বাইরে প্রথম দেখেছিল, সে তুলনায় অসুখের পরে আজ তাকে অপেক্ষাকৃত কৃশ দেখাচ্ছে, কিন্তু তার দুটি সুন্দর চোখে এখনো রয়েছে মহিমা ও কোমলতার সেই যাদুকরী সংমিশ্রণ, পাতলা ঠোঁট দুখানিতে রয়েছে বিচিত্র ভাবপ্রকাশের সেই ক্ষমতা, আর সহৃদয় নির্দোষ যৌবনের সেই একই চেহারা।

দুই সম্রাটের সঙ্গীদলে রয়েছে রুশ ও অস্ট্রিয় বাহিনীর রক্ষীদল ও রেজিমেন্টের যত সব বাছাই-করা যুবক অফিসার। জানালা খুলে দিলে যেমন বাইরের খোলা হাওয়ায় ঘরের গুমোেট ভাব কেটে যায়, তেমনই এই সব প্রদীপ্ত যুবকদের আগমনে কুতুজভের নিরানন্দ সেনাদলের মধ্যে যেন যৌবন, উৎসাহ ও সাফল্যের আশ্বাসের খোলা হাওয়া বয়ে গেল।

সৌজন্যের সঙ্গে সম্রাট ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে সম্রাট আলেক্সান্দার তাড়াতাড়ি কুতুজভকে বলল, আপনি কেন যাত্রা করছেন না মাইকেল ইলারিওনভিচ?

শ্রদ্ধায় আনত হয়ে কুতুজভ জবাব দিল, আমি অপেক্ষা করছি ইয়োর ম্যাজেস্ট্রি।

ঈষৎ ভ্রুকুটি করে সম্রাট এমনভাবে কান পাতল যেন ঠিক শুনতে পায়নি।

অপেক্ষা করছি ইয়োর ম্যাজেস্ট্রি, কুতুজভ পুনরায় বলল। (প্রিন্স আন্দ্রু লক্ষ্য করল, অপেক্ষা করছি কথাটা বলার সময় কুতুজভের উপরের ঠোঁটটা অস্বাভাবিকভাবে কেঁপে উঠল।) সবগুলি সেনাদল এখনো ঠিকমতো সাজানো হয় নি ইয়োর ম্যাজেস্ট্রি।

সম্রাট শুনল, কিন্তু জবাবটা তার পছন্দ হল না, ঘাড় ঝাঁকুনি দিয়ে নিকটস্থ নভসিলৎসেভের দিকে তাকাল।

আপনি তো জানেন মাইকেল ইলারিওনভিচ, যে ম্রাজ্ঞীর মাঠে সৈন্যরা সমবেত না হওয়া পর্যন্ত কুচকাওয়াজ শুরু হয় না এখন আমরা সেখানে নেই, পুনরায় সম্রাট ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে জার কথাগুলি বলল, যেন তার ইচ্ছা তাকে সমর্থন না করলেও সম্রাট তার কথাগুলি অন্তত শুনুক। কিন্তু সম্রাট ফ্রান্সিস চারদিকটা দেখতেই ব্যস্ত, তার কথায় কান দিল না।

সম্রাট যাতে শুনতে পায় সেজন্য কুতুজভ এবার জোর গলায় বলল, ঠিক সেই কারণেই আমি যাত্রা শুরু করি নি স্যার, কারণ এখানে আমরা কুচকাওয়াজও করছি না, আর সম্রাজ্ঞীর মাঠেও দাঁড়িয়ে নেই।

সম্রাটের দলবল দ্রুত দৃষ্টি-বিনিময় করে নিজেদের অসন্তোষ ও তিরস্কার প্রকাশ করতে লাগল। তাদের সে-দৃষ্টির অর্থ, বুড়ো মানুষ হলেও এভাবে কথা বলা তার উচিত হয় নি।

একাগ্র পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে কুতুজভের চোখের দিকে তাকিয়ে জার অপেক্ষা করতে লাগল, সে আরো কিছু বলে কি না তাই শুনবার জন্য। কিন্তু কুতুজভও সশ্রদ্ধভাবে মাথা নুইয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। প্রায় এক মিনিট দুজনই নীরব।

তারপর মাথা তুলে কুতুজভ বলল, অবশ্য আপনি যদি হুকুম করেন ইয়োর ম্যাজেস্ট্রি।

ঘোড়াটাকে ছুঁয়ে অধিনায়ক মিলোরাদভিচকে ডেকে সে যাত্রা শুরুর নির্দেশ দিল।

সেনাদল চলতে শুরু করল, নভগরদ ও আপশেরন রেজিমেন্টের দুই দল সৈন্য সম্রাটের পাশ দিয়ে এগিয়ে গেল।

লাল মুখ মিলোরাদভিচ দ্রুতগতিতে ঘোড়া ছুটিয়ে যেতে যেতে সম্রাটের সামনে এসে ঘোড়ার রাশ টেনে ধরে তাকে অভিবাদন জানাল।

সম্রাট বলল, ঈশ্বর আপনার সহায় হোন সেনাপতি।

সানন্দে সে ফরাসিতে জবাব দিল, সত্যি স্যার, যা কিছু করা সম্ভব সবই আমরা করব। তার মুখে কাঁচা ফরাসি ভাষা শুনে জারের দলের দ্ৰজনরা ব্যঙ্গের হাসি হাসল।

মিলোরাভিচ হঠাৎ তার ঘোড়ার মুখটা ঘুরিয়ে দিয়ে সম্রাটের ঠিক পিছনে দাঁড়িয়ে হাঁক দিল, বাছারা, শুধু এ গ্রামটা নয়, আরো অনেক গ্রাম তোমাদের দখল করতে হবে।

সাধ্যমতো চেষ্টা করব, সৈন্যরা হাঁক দিল।

এই আকস্মিক চিৎকারে সম্রাটের ঘোড়াটা চমকে উঠল।

ঈষৎ হেসে জনৈক অনুগামীর দিকে তাকিয়ে সম্রাট নির্ভীক আপশেরন সৈনিকদের দেখিয়ে কি যেন বলল।

*

অধ্যায়-১৬

অ্যাডজুটান্টদের সঙ্গে নিয়ে কুতুজভ হাল্কা বন্দুকধারীদের পিছনে পায়ে-হাঁটা চালে ঘোড়ায় চড়ে এগিয়ে চলল।

আধ মাইল পথ যাবার আগেই একটা নির্জন, পরিত্যক্ত বাড়ির সামনে সে থামল, বাড়িটা সম্ভবত একসময় সরাইখানা ছিল, সেখান থেকে দুটো রাস্তা দুই দিকে চলে গেছে। দুটো রাস্তাই পাহাড় থেকে নিচে নেমে গেছে, আর দুটো রাস্তা ধরেই সৈন্যরা এগিয়ে চলেছে।

কুয়াশা কেটে যাচ্ছে, উল্টো দিকের পাহাড়ের উপর মাইল দেড়েক দূরবর্তী শত্রুসৈন্যদের অস্পষ্টভাবে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। নিচে বাঁদিক থেকে গুলির আওয়াজ আরো স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। কুতুজভ থেমে জনৈক অস্ট্রিয় অধিনায়কের সঙ্গে কথা বলতে লাগল। তাদের পিছনে কিছুটা দূরে থেকে প্রিন্স আন্দ্রু তাদের লক্ষ্য করছিল, একজন অ্যাডজুটান্টের দিকে ঘুরে সে ছোট দূরবীণটা চাইল।

দূরের সৈন্যদের দিকে না তাকিয়ে সামনের পাহাড়ের উতরাইয়ের দিকে তাকিয়ে অ্যাডজুটান্টটি বলে উঠল, দেখুন, দেখুন, ঐ তো ফরাসিরা!

দুই অধিনায়ক ও অ্যাডজুটান্ট দূরবীণটা ধরে কাড়াতাড়ি শুরু করে দিল। তাদের সকলের মুখেই হঠাৎ আতংকের ভাব ফুটে উঠল। এতক্ষণ মনে করা হচ্ছিল যে ফরাসিরা মাইল দেড়েক দূরে রয়েছে, কিন্তু হঠাৎ একেবারে অপ্রত্যাশিতভাবে তারা আমাদের ঠিক সামনে এসে পড়েছে।

ওরা কি শত্রুসৈন্য?…না!…হ্যাঁ, তাই বটে!…নির্ঘাৎ…কিন্তু তা কি করে হবে? নানা জনে নানা কথা বলতে লাগল।

খালি চোখে নিচে ডান দিকে তাকিয়ে প্রিন্স আন্দ্রু দেখল, কুতুজভ যেখানে দাঁড়িয়ে আছে তার পাঁচশো পায়ের মধ্যেই একটি ঘনসন্নিবিষ্ট ফরাসি সেনাদল আপশেরন বাহিনীর সঙ্গে মোকাবিলা করতে এগিয়ে আসছে।

এই তো এসেছে! এসেছে চূড়ান্ত মুহূর্তটি! এবার আমার পালা! এই কথা ভেবে প্রিন্স আন্দ্রু ঘোড়া ছুটিয়ে কুতুজভের সামনে হাজির হল।

চেঁচিয়ে বলল, আপশেরনদের থামাতেই হবে ইয়োর এক্সেলেন্সি। কিন্তু ঠিক সেইমুহূর্তে একটা ধোয়ার মেঘ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল, খুব কাছেই শোনা গেল গোলার শব্দ, আর প্রিন্স আন্দ্রুর দুপা দূর থেকেই একটি আতংকিত কণ্ঠস্বর শোনা গেল : ভাইসব! সব গেল! আর সেই স্বর শুনে যেন সেনাপতির নির্দেশ পেয়েছে এমনিভাবে সকলেই ছুটতে শুরু করল।

বিপর্যস্ত ক্রমবর্ধমান জনতা ছুটতে ছুটতে সেইদিকে ফিরে চলল যেখানে মাত্র পাঁচ মিনিট আগে তারা সম্রাটের পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গিয়েছিল। সে জনতার গতিরোধ করা শক্ত তো বটেই, এমনকি তার চাপে নিজেও পিছিয়ে না গিয়ে উপায় ছিল না। বলকনস্কি বিমূঢ়ভাবে চারদিকে তাকাতে লাগল, তার সামনে কী যে ঘটছে তা বুঝতেও পারছে না। নেসভিৎস্কি রাগে মুখ লাল করে কুতুজভকে চেঁচিয়ে বলছে, সে যদি এই মুহূর্তে ঘোড়া ছুটিয়ে ফিরে না যায় তাহলে তাকে নির্ঘাত বন্দি হতে হবে। কুতুজভ এক জায়গায়ই দাঁড়িয়ে রইল, কোনো জবাব না দিয়ে একটা রুমাল বের করল। তার গাল থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। প্রিন্স আন্দ্রু ছুটে তার কাছে এগিয়ে গেল।

নিচের চোয়ালটা কাঁপাতে কাঁপাতে সে জিজ্ঞেস করল, আপনি কি আহত?

রক্তাক্ত গালের উপর রুমালটা চেপে ধরে পলায়মান সৈন্যদের দেখিয়ে কুতুজভ বলল, আঘাতটা এখানে নয়, ওখানে! ওদের থামাও! সঙ্গে সঙ্গে ওদের থামানো যে অসম্ভব সেটা বুঝতে পেরে নিজেই ডান দিকে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল।

পলায়মান জনতার আর একটা ঢেউ তাকে ঘিরে ধরে পিছনের দিকে ঠেলে নিয়ে গেল।

সৈন্যরা এত ঘন হয়ে ছুটছে যে একবার তাদের মধ্যে পড়ে গেলে বেরিয়ে আসা খুবই শক্ত। একজন হক দিল, এগিয়ে চল! আমাদের বাধা দিচ্ছ কেন? আর একজন ঘুরে দাঁড়িয়ে আকাশ লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ল, আর একজন কুতুজভের ঘোড়াটাকেই আঘাত করতে লাগল। অনেক কষ্টে সেই বন্যাস্রোতের মতো জনতার ভিতর থেকে বাঁদিক দিয়ে বেরিয়ে অর্ধেকের বেশি সঙ্গীদের হারিয়ে কুতুজভ একটা গোলার শব্দ লক্ষ্য করে ছুটে গেল। প্রিন্স আন্দ্রুও জোর করে সেই পলাতক বাহিনীর ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে কুতুজভের কাছাকাছি থাকবার চেষ্টা করতে লাগল এবং দেখতে পেল, পাহাড়েরর ঢালুর উপর থেকে রুশ কামানশ্রেণী তখনো গোলাবর্ষণ করে চলেছে, আর ফরাসিরা সেইদিকে ছুটে যাচ্ছে। আরো উপরে দাঁড়িয়ে আছে কিছু রুশ পদাতিক, কামানশ্রেণীকে রক্ষা করতে তারা সামনেও এগিয়ে যাচ্ছে না, আবার পলায়মান জনতার সঙ্গে পিছুও হটছে না। একজন অশ্বারোহী অধিনায়ক পদাতিক বাহিনীর ভিতর থেকে বেরিয়ে কুতুজভের কাছে এগিয়ে এল। কুতুজভের দলবলের মধ্যে মাত্র চারজন তার সঙ্গে আছে। তারা সকলেই বিষণ্ণ মুখে নীরবে পরস্পরকে দেখছে।

পলায়মান সৈনিকদের দেখিয়ে কুতুজভ কোনোরকমে রেজিমেন্ট অধিনায়ককে বলল, ঐ হতভাগাদের থামান। কিন্তু ঠিক সেইসময় বুঝিবা ঐ কথাগুলির শাস্তি হিসেবেই শত্রুর বুলেট এক ঝাঁক ছোট পাখির মতো রেজিমেন্ট ও কুতুজভের দলের উপর দিকে হিস হিস শব্দে ছুটতে লাগল।

ফরাসিরা কামানশ্রেণীকে আক্রমণ করেছে, কুতুজভকে দেখতে পেয়ে তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ছে। এই গোলাগুলির সামনে রেজিমেন্ট-অধিনায়কটি পা চেপে ধরে বসে পড়ল জনাকয়েক সৈন্য পড়ে গেল, এবং একজন দ্বিতীয় লেফটেন্যান্টের হাত থেকে পতাকাটা পড়ে গেল। পতাকাটা পড়বার সময় নিকটস্থ সৈন্যদের বন্দুকের মাথায় জড়িয়ে গেল। বিনা হুকুমেই সৈন্যরা গুলি ছুঁড়তে শুরু করে দিল।

চারদিকে তাকিয়ে কুতুজভ হতাশভাবে আর্তনাদ করে উঠল, ওঃ! ওঃ! ওঃ!…বয়সের ভারে কাঁপা গলায় ফিসফিস করে ডাকল, বলকনস্কি! বলকনস্কি! তারপর বিশৃখল সেনাদল ও শত্রুদের দেখিয়ে অস্ফুট স্বরে বলল, ও সব কি?

তার কথা শেষ হবার আগেই লজ্জা ও ক্রোধের কান্নায় রুদ্ধবাক অবস্থায় প্রিন্স আন্দ্রু ঘোড়া থেকে লাফিয়ে নেমে পতাকাটির দিকে ছুটে গেল।

ছোট শিশুর মতো তারস্বরে চিৎকার করে বলল, বাছারা, এগিয়ে যাও!

পতাকার দণ্ডটি চেপে ধরে ভাবল, এই তো পেয়েছি। তাকে লক্ষ্য করে ছুটে আসা বুলেটের শব্দ শুনে সে খুশিই হল। কয়েকটি সৈন্য পড়ে গেল।

প্রিন্স আন্দ্রু হাঁক দিল, হুররা! কোনোরকমে ভারী পতাকাটিতে তুলে ধরে সম্মুখে ছুটে চলল, তার মনে দৃঢ় প্রত্যয়, পুরো বাহিনী তাকে অনুসরণ করবে।

সত্যি সত্যি মাত্র কয়েকটি পা সে একাকী এগিয়ে গেল। প্রথমে একটি সৈন্য, তারপর আরেকটি এগিয়ে এল, আর দেখতে দেখতে পুরো বাহিনী হুররা বলে হুঙ্কার তুলে ছুটে এসে তাকে ধরে ফেলল। প্রিন্স আন্দ্রুর হাতে ভারী পতাকাটি হেলে পড়ছে দেখে একজন সার্জেন্ট ছুটে এসে সেটা ধরতেই সঙ্গে তার তার মৃত্যু হল। প্রিন্স আন্দ্রু পুনরায় পতাকাদণ্ডটি ধরে সেটাকে টানতে টানতে সেনাদলের সঙ্গে ছুটতে লাগল। সামনেই গোলন্দাজ সৈন্যদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল, তাদের কয়েকজন যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে, আর অপর কয়েকজন কামান ফেলে তার দিকে ছুটে আসছে। সে আরো দেখল, ফরাসি পদাতিক সৈন্যরা তাদের ঘোড়াগুলোকে দখল করে কামানোর মুখ ঘুরিয়ে ধরেছে। প্রিন্স আন্দ্রু ও সেনাদল তখন কামানশ্রেণীর বিশ গজের মধ্যে পৌঁছে গেছে। মাথার উপরে অবিশ্রাম গুলির শব্দ কানে আসছে, ডাইনে-বাঁয়ে একের পর এক সৈন্যরা আর্তনাদ করে ঢলে পড়ছে। কিন্তু তাদের দিকে সে তাকাল না : তার দৃষ্টি শুধু সামনে যা ঘটছে তার দিকে-কামানশ্রেণীর দিকে। এবার সে পরিষ্কার দেখতে পেল দুমড়ানো টুপি মাথায় একটি লাল-চুল গোলন্দাজ একটা ন্যাকড়ার একদিক ধরে আছে, আর একজন ফরাসি সৈন্য সেটার অন্যদিকে ধরে টানছে। দুজনের মুখেই একটা হতবুদ্ধিকর অথচ বিমূঢ় ভাব ফুটে উঠেছে, তারা যে কী করছে তা নিজেরাই জানে না।

সেদিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রিন্স আন্দ্রু ভাবল, ওরা কী করছে? লাল চুল গোলন্দাজটির হাতে যখন অস্ত্র নেই তখন সে পালিয়ে যাচ্ছে না কেন? ফরাসিটাই বা তার বুকে বেয়নেট বসিয়ে দিচ্ছে না কেন? বেয়নেটের কথা মনে হতেই ফরাসি সৈন্যটি সেটা ওর বুকে বসিয়ে দেবে, তার আগে ওর নড়ার লক্ষণ দেখছি না…।

সত্যি সত্যি আর একটি ফরাসি সৈনিক বন্দুক উচিয়ে লোক দুটির দিকে ধেয়ে এল, লাল-চুল গোলন্দাজটির কপালে যা লেখা আছে এখনই তা ঘটে যাবে। কিন্তু সে ঘটনা প্রত্যক্ষ করা প্রিন্স আর হল না। তার মনে হল, পার্শ্ববর্তী একটি লোক সজোরে তার মাথায় মুগুর দিয়ে আঘাত করল। আঘাত সামান্যই লাগল, কিন্তু যন্ত্রণায় কাতর হয়ে সে যা দেখার জন্য অপেক্ষা করছিল সেটা আর দেখা হল না।

এ কী হল? আমি কি পড়ে যাচ্ছি? পা দুটো খাড়া রাখতে পারছি না, ভাবতে ভাবতেই সে চিৎ হয়ে পড়ে গেল। চোখ খুলল, দেখতে চাইল, ফরাসি সৈনিক ও গোলন্দাজের লড়াইটা কীভাবে শেষ হল, লালচুল গোলন্দাজটি মারা গেল কি না, কামানটা বেদখল হল না রক্ষা পেল। কিন্তু কিছু সে দেখতে পেল না। মাথার উপরে শুধুই আকাশ-উঁচু আকাশ, অস্পষ্ট হলেও অসীম উঁচু আকাশ, তার বুখে ভেসে বেড়াচ্ছে সাদা মেঘের দল। কী শান্ত, স্তব্ধ, গম্ভীর, আমরা যখন ছুটছিলাম মোটেই তখনকার মতো নয়, প্রিন্স আন্দ্রু ভাবতে লাগল-লড়াই করতে করতে আর চিৎকার করতে করতে আমরা যখন ছুটছিলাম, ভীত ক্রুদ্ধ মুখে গোলন্দাজ ও ফরাসিটি যখন একটুকরো নেকড়ার জন্য ঝগড়া করছিল, মোটেই তখনকার মতো নয় : অসীম উঁচু আকাশের বুকে মেঘেদের এই ভেসে চলা তার থেকে কত আলাদা! এই উঁচু আকাশটা আগে কেন আমার চোখে পড়েনি। শেষপর্যন্ত ওই আকাশকে দেখতে পেয়ে আমি কত খুশি!! ওই অসীম আকাশ ছাড়া সবই বৃথা, সবই মিথ্যা। ও ছাড়া আর কিছুই নেই, কিছু নেই। এমনকি ওই আকাশও নেই, স্তব্ধতা ও শান্তি ছাড়া আর কিছু নেই। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ!…

*

অধ্যায়-১৭

ব্যাগ্রেশন পরিচালিত আমাদের দক্ষিণ ব্যূহে বেলা নয়টায়ও যুদ্ধ শুরু হয়নি। দলগরুকভ যুদ্ধ শুরু করার যে দাবি জানিয়েছিল তার সঙ্গে একমত না হওয়ায় এবং নিজের দায়িত্ব এড়ানোর জন্য প্রিন্স ব্যাগ্রেশন প্রধান সেনাপতির কাছে লোক পাঠিয়ে তার মতামত জানার প্রস্তাব করল। ব্যাগ্রেশন জানত, সেনাবাহিনীর দুই প্রান্তের মধ্যবর্তী দূরত্ব ছয় মাইলেরও বেশি, যদি পথে নিহত না হয় (হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি), আর প্রধান সেনাপতির সঙ্গে যদি তার সাক্ষাৎ হয় (যেটা খুবই শক্ত) তাহলেও সন্ধ্যার আগে সে ফিরে আসতে পারবে না।

ব্যাগ্রেশন বড় বড় ভাবলেশহীন ঘুম ঘুম চোখে দলের লোকদের দিকে তাকাল, প্রথমেই তার চোখ পড়ল উত্তেজনায় ও আশায় রুদ্ধশ্বাস রস্তভের বালকসুলভ মুখের উপর। তাকেই সে পাঠাল।

টুপিতে হাত তুলে রস্তভ বলল, আর প্রধান সেনাপতির সঙ্গে দেখা হবার আগেই যদি সম্রাটের সঙ্গে আমার দেখা হয়ে যায় ইয়োর এক্সেলেন্সি?

ব্যাগ্রেশনকে বাধা দিয়ে দলগরুকভ বলল, তাহলে সংবাদটা হিজ ম্যাজেস্ট্রিকেই দিতে পার।

পাহারার কাজে ছুটি পেয়ে ভোরের আগেই রস্তভ ঘণ্টা কয়েক ঘুমিয়ে নিয়েছিল, তাই এখন তার শরীর ও মন দুইই বেশ ঝরঝরে ও তাজা হয়ে আছে। তাছাড়া সকাল থেকে তার সব আশাই পূর্ণ হয়েছে : আজকের যুদ্ধে সে অংশ নিতে যাচ্ছে, তার চাইতেও বড় কথা, সবচাইতে সাহসী অধিনায়কের সঙ্গীরূপে সে যাচ্ছে, সংবাদবাহক হিসেবে তাকেই পাঠানো হচ্ছে কুতুজভের কাছে, এমনকি হয়তো সম্রাটের কাছেও। আলো ঝলমল সকাল, তার ঘোড়াটাও ভালো, মনটা আনন্দে ও খুশিতে ভরপুর। নির্দেশ হাতে নিয়ে ঘোড়ার মুখে লাগাম পরিয়ে সে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল। প্রথমে পার হল ব্যাগ্রেশনের সেনাদলকে, তারা যুদ্ধে না নেমে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। তারপর পার হল উভারতের অশ্বারোহী বাহিনী, সেখানে চলেছে যুদ্ধের আয়োজন ও চাঞ্চল্য। তারপরেই সামনে থেকে ভেসে এল কামান-বন্দুকের শব্দ, সে শব্দ ক্রমেই উচ্চ হতে উচ্চতর হতে লাগল।

প্রকৃত অবস্থাটা চোখে দেখবার জন্য পাহাড়ের চূড়ায় উঠে রস্তভ ঘোড়া থামাল, কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও বুঝতে পারল না, ধোয়ার মধ্যে কিছু লোক চলাফেরা করছে, সামনে-পিছনে চলাফেরা করছে সেনাদল, কিন্তু তারা কারা, কোথায় যাচ্ছে, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। এসব দেখেশুনে তার মনে কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া হল :

না, বরং তার উৎসাহ ও দৃঢ়তা আরো বেড়ে গেল।

এগিয়ে চল! এগিয়ে চল! সংবাদটা পৌঁছে দাও! মনে মনে বলতে বলতে সে ঘোড়া ছুটিয়ে ক্রমেই যুদ্ধের দিকে এগিয়ে চলতে লাগল।

ওখানকার অবস্থা কেমন আমি জানি না, কিন্তু নিশ্চয় সবই ভালো, রস্তভ ভাবল।

কিন্তু স্ক্রিয় সৈনিককে পেরিয়েই সে দেখতে পেল, রক্ষীবাহিনীর একটা অংশে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। _ তার মন বলল, ভালোই হল! কাছে থেকে সব কিছু দেখতে পাব।

অগ্রবর্তী সেনাদলের বরাবর সে এগিয়ে চলল। মুষ্টিমেয় কিছু সৈন্য ঘোড়া ছুটিয়ে তার দিকে এগিয়ে এল। আমাদের পক্ষের এই উলহানরা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরছে। রস্তভ তাদের পথ থেকে সরে দাঁড়াল, এমনিতেই তার চোখে পড়ে গেল যে তাদের একজনের শরীর থেকে রক্ত ঝরছে। রস্তভ ঘোড়া ছুটিয়ে দিল।

এসব আমার ব্যাপারই নয়, সে ভাবল। কয়েকশো গজ চলবার পরেই তার চোখে পড়ল, বাঁদিক থেকে কালো ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে একটা মস্ত বড় অশ্বারোহী দল তার পথের দিকেই দ্রুত ছুটে আসছে। আক্রমণোদ্যত ফরাসি অশ্বারোহী বাহিনীর মোকাবিলা করতে ছুটে চলেছে আমাদের অশ্বারোহী রক্ষীবাহিনী।

রস্তভ পরিষ্কারভাবে তাদের চোখ-মুখ দেখতে পাচ্ছে, শুনতে পাচ্ছে তাদের হুকুম : আক্রমণ কর। পাছে তাদের অগ্রগতির মুখে পড়ে ঘোড়াসমেত সে নিজেও চুরমার হয়ে যায়, বা তাদের ধাক্কায় ফরাসিদের মুখোমুখি হতে বাধ্য হয়, তাই সে যথাসম্ভব দ্রুতগতিতে ঘোড়া ছুটিয়ে দিলেও তাদের সম্পূর্ণ এড়িয়ে যেতে পারল না।

অশ্বারোহী রক্ষীবাহিনীর শেষ সৈনিকটির সঙ্গে রস্তভের সংঘর্ষ প্রায় অনিবার্য হয়ে উঠল। প্রকাণ্ড দেহ এই রক্ষীসৈনিকটির মুখভর্তি বসন্তের দাগ। ভ্রুকুটিকুটিল চোখে সক্রোধে সে রস্তভের দিকে তাকাল। রস্তভের মনে হল, এই বিরাটকায় মানুষগুলি ও তাদের ঘোড়াগুলির তুলনায় সে বড়ই ক্ষুদ্রকায় ও দুর্বল, লোকটি হয়তো তাকে ও বেদুইনকে ধরাশায়ী করেই ছুটে যেত যদি না সময়মতো রস্তভ রক্ষীটির ঘোড়ার চোখের সামনে তার চাকুটাকে সশব্দে আস্ফালন করত। ষোল হাত উঁচু কালো ভারি ঘোড়াটা কান খাড়া করে থমকে দাঁড়াল, আর রক্ষীটি সজোরে পাদানি দিয়ে তার পেটে খোঁচা মেরে দ্রুততর গতিতে ছুটে বেরিয়ে গেল। তারপর আর কিছুই সে দেখতে পেল না, কারণ সঙ্গে সঙ্গেই কামান গর্জে উঠল আর ধোঁয়ায় সবকিছু ঢেকে গেল।

সেই মুহূর্তে রভের মনে দ্বিধা দেখা দিল, সে রক্ষীবাহিনীকে অনুসরণ করবে, না কি তাকে যেখানে পাঠানো হয়েছে সেখানেই যাবে। পরবর্তীকালে সে শুনেই ভয় পেয়েছিল যে সেই বিরাটদেহ রক্ষীসৈনিকদের বিরাট দলটির মধ্যে সেদিনকার যুদ্ধ থেকে ফিরে এসেছিল মাত্র আঠারো জন।

ওদের আমি ঈর্ষা করব কেন? আমার সুযোগ তো চলে যায়নি, হয়তো এক্ষুনি ম্রাটের সঙ্গেই আমার দেখা হয়ে যাবে! এই কথা ভেবে রস্তভ ঘোড়া ছুটিয়ে দিল।

পদাতিক রক্ষীবাহিনীর একটি রেজিমেন্টের পিছন দিক দিয়ে চলতে চলতে সে শুনতে পেল কে যেন তার নাম ধরে ডাকছে।

রস্তুভ!

বরিসের কণ্ঠস্বর চিনতে না পেরে সে জবাব দিল, কি?

আমি বলছি, আমরা একেবারে প্রথম সারিতে রয়েছি। আমাদের রেজিমেন্ট আক্রান্ত হয়েছে। বরিস বলল, তার মুখে সেই খুশির হাসি যা দেখা দেয় সেইসব যুবকদের মুখে, জীবনে যারা প্রথম গোলাগুলির সামনে দাঁড়ায়।

রস্তভ থামল।

বলল, তাই নাকি? আচ্ছা, কেমন হল বল তো?

তাদের হটিয়ে দিয়েছি! উৎসাহে বরিস মুখর হয়ে উঠল। কল্পনা করতে পার? বরিস নিজেদের কার্যকলাপের বিবরণ দিতে শুরু করল। তার কথা শেষ হবার আগেই রস্তভ ঘোড়ার পেটে খোঁচা দিল।

কোথায় যাচ্ছ? বরিস জিজ্ঞেস করল।

হিজ ম্যাজেস্ট্রির কাছে একটি চিঠি নিয়ে যাচ্ছি।  

রস্তভ সম্ভবত হিজ হাইনেস বলতে চেয়েছে এ-কথা ভেবে গ্র্যান্ড ডিউককে দেখিয়ে বরিস বলল, ঐ তো তিনি!

কিন্তু উনি তো গ্র্যান্ড ডিউক, আমি চাই প্রধান সেনাপতিকে অথবা সম্রাটকে, বলেই রস্তভ ঘোড়া ছোটাতে উদ্যত হল।

অপরদিক থেকে ছুটে এসে বের্গ চেঁচিয়ে ডাকল, কাউন্ট! কাউন্ট! আমার ডান হাতে আঘাত লেগেছে (রুমাল দিয়ে বাঁধা রক্তাক্ত ডান হাতটা দেখাল), তবু আমি যুদ্ধক্ষেত্রে ছিলাম। বাঁ হাতে তরবারি ধরেছি কাউন্ট। আমাদের পরিবারের সকলেইসব ভন বের্গরাই-নাইট ছিলেন!

সে আরো কিছু বলতে লাগল, কিন্তু সে-কথা শুনবার জন্য রস্তভ অপেক্ষা করল না, ঘোড়া ছুটিয়ে দিল।

সহসা খুব কাছে নিজের সামনে ও আমাদের সৈন্যদের পিছনে সে বন্দুকের শব্দ শুনতে পেল, সে ভাবতেই পারেনি যে সেখানে শত্রুসৈন্য থাকতে পারে।

ভাবল, এটা কী হল? আমাদের বাহিনীর পিছনে শত্রুসৈন্য? অসম্ভব! আর হঠাৎই নিজের জন্য এবং গোটা যুদ্ধের ফলাফলের জন্য তার মন আতংকে শিউরে উঠল। কিন্তু যাই হোক না কেন, এখন আর ঘরে যাবার উপায় নেই। এখানেই প্রধান সেনাপতির খোঁজ করতে হবে, আর যদি সর্বনাশই ঘটে তাহলে সকলের সঙ্গে আমাকেও মরতে হবে।

প্রাৎজেন গ্রামটা এখন, নানা ধরনের সৈন্যে পরিপূর্ণ, সেই গ্রামটা ছাড়িয়ে সে যত এগিয়ে যেতে লাগল ততই সেই বিপদের আশংকা ঘনীভূত হতে লাগল।

তার পথের উপর দিয়ে বিশৃঙ্খলভাবে ছুটে আসা রুশ ও অস্ট্রিয় সৈন্যদের দেখে রস্তভ প্রশ্ন করতে লাগল, এসবের অর্থ কী? এটা কী হচ্ছে? তারা কাকে গুলি করছে সে গুলি ছুড়ছে?

রুশ, জার্মান ও চেক ভাষায় পলায়মান জনতা বলতে লাগল, শয়তানই জানে! তারা সব্বাইকে মারছে! সব শেষ! অবশ্য কী যে হচ্ছে বা হয়েছে তার কিছুই তারা কেউ জানে না।

একজন হেঁকে বলল, জার্মানদের মার!

বিশ্বাসঘাতকের দল-ওদের শয়তানে ধরুক!

রুশদের ফাঁসিতে ঝোলাও! একজন জার্মান অস্ফুট স্বরে বলল।

পথ বেয়ে কয়েকজন আহত সৈনিক চলে গেল, চারদিকে গোলমালের মধ্যে শোনা যেতে লাগল তিরস্কার, চেঁচামেচি, আর্তনাদ, তারপর গোলাগুলি থেমে গেল। রস্তভ পরে জানতে পেরেছিল, রুশ ও অস্ট্রিয় সৈন্যরা পরস্পরকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়েছিল।

সে ভাবল, হা ঈশ্বর! এসবের অর্থ কী? আর এখানে, যেখানে সম্রাট যে কোনো মুহূর্তে তাদের সামনে হাজির হতে পারেন… কিন্তু না। এ কাজ বড়জোর জনাকয়েক বদমাস করতে পারে। অচিরেই এ অবস্থা কেটে যাবে, ওরকম হতে পারে না, হতে পারে না! যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এদের পার হয়ে যেতে হবে!

পরাজয় ও পলায়নের চিন্তা রস্তভের মাথায় ঢোকেনি। প্রাজেন পাহাড়ের উপর ফরাসি কামান ও ফরাসি সৈন্যদের সে দেখতে পেয়েছে, তার উপর নির্দেশ আছে, ওখানেই প্রধান সেনাপতিকে খুঁজতে হবে, কিন্তু সে কথা সে বিশ্বাস করতে পারল না, বিশ্বাস করতে চাইল না।

*

অধ্যায়-১৮

রস্তভের উপর নির্দেশ ছিল প্রাজেন গ্রামের কাছাকাছি কুতুজভ ও ম্রাটের খোঁজ করতে হবে। কিন্তু না, তাদের দুই জনের কাউকে, না কোনো একটি অধিনায়ক অফিসারকে, কেউ নেই সেখানে, সেখানে শুধু নানা ধরনের বিশৃঙ্খল জনতার ভিড়। ক্লান্ত ঘোড়াটাকে নিয়ে সে খুব তাড়াতাড়ি এই ভিড়কে পার হয়ে যেতে চাইল, কিন্তু যত এগোতে লাগল সেনাদলকে ততই বিশৃঙ্খল অবস্থায় দেখতে পেল। প্রাজেন পাহাড়ের উপর থেকে ফরাসি কামান থেকে গোলাবর্ষণের ফলে সকলের মধ্যে একটা হৈ চৈ হুড়োহুড়ি পড়ে গেছে।

যাকে পাচ্ছে রস্তভ তাকেই জিজ্ঞেস করছে, সম্রাট কোথায়? কুতুজভ কোথায়? কিন্তু কেউ কোনো জবাব দিচ্ছে না।

অবশেষে একটি সৈন্যের কলার চেপে ধরে তাকে জবাব দিতে বাধ্য করল।

কী জানি কেন হেসে উঠে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সৈন্যটি বলল, এ, দাদা, তারা সব অনেক আগেই পালিয়েছে!

স্পষ্টই বোঝা গেল সৈনিকটি মদ গিলেছে। তাকে ছেড়ে একজন পদস্থলোকের সহিসের ঘোড়া থামিয়ে রস্তভ তাকেই জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করল। সে জানাল, ঘণ্টাখানেক আগে এই রাস্তা দিয়েই একখানা দ্রুতগামী গাড়িতে জানকে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে, জার সাংঘাতিক আহত।

রস্তভ বলে উঠল, এ হতেই পারে না! নিশ্চয় সে অন্য কেউ।

উপহাসের হাসি হেসে লোকটি জবাব দিল, আমি নিজে তাকে দেখেছি। পিটার্সবুর্গে সম্রাটকে এতবার দেখেছি যে তাকে চেনা আমার উচিত। ঠিক যেমন আপনাকে দেখছি, তেমনই তাকে দেখেছি।…অত্যন্ত ম্লান মুখে তিনি গাড়িতে বসেছিলেন। চারটে কালো ঘোড়াকে কী ছুটিয়েই না দিল! খটাখট শব্দে আমাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল! ততক্ষণে আমি রাজকীয় গাড়ির ঘোড়া ও ইলিয়া আইভানিচকে চিনতে পেরেছিলাম। আমার তো মনে হয় না ইলিয়া জার ভিন্ন অন্য কারো গাড়ি চালায়।

রস্তভ ঘোড়াটা ছেড়ে দিয়ে গমনোদ্যত হতেই তাকে পাশ কাটিয়ে চলতে গিয়ে জনৈক আহত অফিসার তাকে জিজ্ঞেস করল :

আপনি কাকে চান? প্রধান সেনাপতিকে? একটা কামানের গোলায় তার মৃত্যু হয়েছে–আমাদের রেজিমেন্টের সামনে তার বুকে গোলা লেগেছিল।

আর একজন অফিসার তার কথাটা সংশোধন করে বলল, মারা যাননি–আহত হয়েছেন!

রস্তভ জিজ্ঞেস করল, কে? কুতুজভ?

কুতুজভ নয়, কিন্তু কী যেন তার নামটা ঠিক আছে… বেশি লোক তো বেঁচে নেই। এই পথে চলে যান, ওই গ্রামে, অধিনায়করা সব ওখানেই আছেন, এই কথা বলে হসজেরাডেক গ্রামটা দেখিয়ে গিয়ে অফিসারটি চলে গেল।

রস্তভ হেঁটে চলার গতিতে ঘোড়ার পিঠে এগিয়ে চলল, কেন যাচ্ছে, কার কাছে যাচ্ছে, সে-সব না বুঝেই চলতে লাগল। সম্রাট আহত, যুদ্ধে হার হয়েছে। এখন এতে সন্দেহ করাও অসম্ভব। তাড়াতাড়িই বা কী আছে? জার বা কুতুজভ যদি বেঁচে থাকে, যদি অক্ষতই থাকে, তাহলেই বা এখন সে তাদের কী বলবে?

একটি সৈনিক হাঁক দিয়ে বলল, ইয়োর অনার, এ পথ দিয়ে যান, ও পথে গেলে সঙ্গে সঙ্গে মারা পড়বেন! তারা আপনাকে খুন করে ফেলবে!

আর একজন বলল, আঃ, কী সব বকছ? উনি কোথায় যাবেন? এই পথেই তো কাছে হবে।

রস্তভ একটু ভাবল, তারপর যেপথে গেলে সে মারা যাবে বলে ওরা বলেছিল সেই পথেই এগিয়ে গেল।

এখন তো সবই সমান। সম্রাট যদি আহত হয়ে থাকেন, তাহলেও কি আমি নিজেকে বাঁচাতে সচেষ্ট হব? ভাবতে ভাবতে সেদিকেই সে এগিয়ে চলল যেখানে প্রাজেন থেকে পালাতে গিয়ে সবচাইতে বেশিসংখ্যক লোক মারা গেছে। ফরাসিরা এখনো সে অঞ্চলটা দখল করেনি, অক্ষত ও সামান্য আহত রুশরাও অনেক আগেই সে জায়গা ছেড়ে চলে গেছে। সারা মাঠ জুড়ে প্রতি দুএকর জমিতে দশজন করে নিহত ও আহত সৈনিক পড়ে আছে। তাদের চিৎকার ও আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে। এইসব যন্ত্রণাকাতর লোকগুলিকে যাতে না দেখতে হয় সেজন্য রস্তভ জোর কদমে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল, তার ভয় করতে লাগল–ভয়টা নিজের জীবনের জন্য নয়, এই হতভাগ্যদের দেখেও মন স্থির রাখতে যে সাহসের দরকার তার অভাব ঘটবার ভয়।

নিহত ও আহত সৈনিকে ভর্তি মাঠে গুলি করার মতো কেউ না থাকায় ফরাসিরা গুলি বন্ধ করে দিয়েছিল, একজন অ্যাডজুটান্টকে ঘোড়ায় চেপে মাঠ দিয়ে যেতে দেখে তারা রস্তভকে লক্ষ্য করে কয়েকটা গুলি ছুড়ল। গুলির ভয়ংকর শনশন শব্দ আর চারপাশের মৃতদেহের অনুভূতি একত্রে মিলে রস্তভের মনে দেখা দিল নিজের জন্য ত্রাস ও করুণার অনুভূতি। মায়ের শেষ চিঠিটায় কথা মনে পড়ল। সে ভাবল, এইভাবে কামান তাক করা অবস্থায় আমাকে দেখলে মার কী মনে হত?

যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরে এসে রুশ সৈন্যরা হসজেরাডেক গ্রামে আশ্রয় নিয়েছে। ফরাসি কামান সেখানে পৌঁছচ্ছে না, বন্দুকের শব্দও ভেসে আসছে অনেক দূর থেকে। এখানে সকলেই পরিষ্কার বুঝেছে ও বলছে যে যুদ্ধে হার হয়েছে। রস্তভ অনেককেই জিজ্ঞেস করল, কিন্তু সম্রাট বা কুতুজভের খবর কেউ বলতে পারল না। কেউ বলল, সম্রাটের আহত হবার খবরটা ঠিক, আবার কেউ বলল ওটা মিথ্যা গুজব। একজন অফিসার জানাল, গ্রামের পিছনে বাঁদিকে প্রধান ঘাঁটির একজন কাউকে সে দেখেছে। অগত্যা রস্তভ সেই দিকেই ঘোড়ার মুখ ফিরিয়ে দিল। প্রায় দু মাইল পথ চলার পরে শেষে রুশ সেনাদলকেও পার হয়ে চারদিক ঘুরিয়ে নালা কাটা একটা সবজিবাগানের কাছে নালার দিকে মুখ করে দাঁড়ানো দুজন অশ্বারোহীকে সে দেখতে পেল। একজনের টুপিতে শাদা পালক গোঁজা, রস্তভের মনে হল, লোকটিকে সে চেনে, অপরজন সওয়ার হয়েছে একটা সুন্দর বাদামি রঙের ঘোড়ার পিঠে (রস্তভের মনে হল ঘোড়াটাকে সে আগে দেখেছে), দ্বিতীয় লোকটি নালা পর্যন্ত এগিয়ে এসে আস্তে লাফিয়ে নালাটার কাছে এল এবং মুখ ঘুরিয়ে সাদা পালকপরা লোকটিকেও তাই করতে বলল। দ্বিতীয় অশ্বারোহী মাথা ও হাত নেড়ে আপত্তি জানাল, আর তা থেকেই রস্তভ সঙ্গে সঙ্গে চিনতে পারল তার পূজনীয় সম্রাটকে।

রস্তভ ভাবল, কিন্তু এই জনশূন্য মাঠের মধ্যে একাকী, এ লোক তিনি নন, হতে পারেন না। সেই মুহূর্তে আলেক্সান্দার মাথাটা ফেরাল, আর রস্তভ দেখতে পেল সেই প্রিয় মূর্তি যার স্মৃতি গভীরভাবে আঁকা আছে তার মনে। সম্রাটের মুখ বিবর্ণ, গাল ভেঙে গেছে, চোখ বসে গেছে, কিন্তু মুখের মাধুরী যেন তাতে আরো বেড়েছে। সম্রাটের আহত হওয়ার গুজবটা যে মিথ্যা সেটা জেনে রশুভের খুব ভালো লাগল। তাকে দেখে তাই সে খুশি। সে বুঝল, সোজা গিয়ে দলগরুকভের চিঠিটা সে সম্রাটের হাতে দিতে পারে, দেয়াই উচিত।

কিন্তু কোনো প্রেমিক যুবকের সামনে যখন বহু-আকাক্ষিত মুহূর্তটি আসে এবং প্রেমিকার সঙ্গে নির্জনে দেখা হয়, তখন সে যেমন কাঁপতে থাকে, তার স্নায়ু অবশ হয়ে পড়ে, রাতের পর রাত যে কথাগুলি বলার স্বপ্ন দেখেছে তা উচ্চারণও করতে পারে না, বরং সাহায্যের আশায় অথবা পালিয়ে যাওয়ার এক সুযোগের জন্য চারদিকে তাকাতে থাকে, সেইরকম রস্তভও এতকাল ধরে যে সুযোগটি পৃথিবীর অন্য যে-কোনো জিনিসের চাইতে বেশি করে কামনা করেছে, সেই সুযোগ যখন তার সামনে এসে হাজির হয়েছে তখন বুঝতেই পারছে না কেমন করে সম্রাটের কাছে এগিয়ে যাবে, আর এ কাজ করা তার পক্ষে কেন অসুবিধাজনক, অশোভন ও অসম্ভব তারই হাজার যুক্তি তার মনের মধ্যে তোলপাড় করতে লাগল।

নানা কথা ভাবতে ভাবতে রস্তভ যখন বিষণ্ণ মনে সেখানে থেকে সরে যেতে লাগল তখন ক্যাপ্টেন ভনটোল হঠাৎই ঘোড়ায় চেপে সেখানে এসে হাজির হল এবং সম্রাটকে দেখে এগিয়ে এসে তাকে ধরে নামিয়ে পায়ে হেঁটে নালাটা পার হতে সাহায্য করল। কিছুটা অসুস্থ বোধ করায় সম্রাট বিশ্রাম নেয়ার জন্য একটা আপেলগাছের তলায় বসল, ভেনটোলও তার পাশেই রইল। ঈর্ষায় ও অনুতাপে বিদ্ধ হয়ে রস্তভ দূর থেকে দেখতে পেল, ভেনটোল অনেকক্ষণ ধরে ঘনিষ্ঠভাবে সম্রাটের সঙ্গে কথা বলছে, আর সম্রাট কাঁদতে কাঁদতে এক হাতে নিজের চোখ ঢেকে অন্য হাতে ভন টোলের হাতটা চেপে ধরেছে।

তার জায়গায় তো আমিও হতে পারতাম! এই কথা ভেবে ম্রাটের প্রতি করুণায় উদাত চোখের জল কোনোরকমে চেপে একান্ত হতাশায় রশুভ ঘোড়া চালিয়ে এগিয়ে গেল কোথায় যাচ্ছে বা কেন যাচ্ছে তা সে জানে না।

নিজের দুর্বলতাই যে তার এই দুঃখের কারণ এই অনুভূতিই তার হতাশাকে আরো বাড়িয়ে তুলল।

সম্রাটের কাছে সেও তো এগিয়ে যেতে পারত… পারত নয়, যাওয়াই উচিত ছিল। সম্রাটের প্রতি অনুরাগ প্রকাশের একটা অনবদ্য সুযোগ এসেছিল তার সামনে। সে সুযোগ সে নিতে পারেনি। …আমি কী করেছি? সে ভাবল। ঘোড়ার মুখটা ঘুরিয়ে সে ফিরে গেল সেই নালার ধারে যেখানে সে দেখেছিল সম্রাটকে। কিন্তু এখন সেখানে কেউ নেই। শুধু কিছু মালগাড়ি ও যাত্রীগাড়ি চলেছে। একজন কোচয়ানের কাছে সে জানতে পারল, কুতুজভের দলবল বেশি দূরে নেই, কাছের সেই গ্রামেই গাড়িগুলো যাচ্ছে। রস্তভ তাদের পিছু নিল।

সন্ধ্যা পাঁচটার আগে সব যুদ্ধক্ষেত্রেই পরাজয় হল। একশোরও বেশি কামান ইতিমধ্যেই ফরাসিদের হাতে পড়েছে।

একটি সেনাদল অস্ত্র ত্যাগ করেছে। অন্যগুলি অর্ধেক সৈন্য হারিয়ে বিশৃঙ্খলভাবে ইতস্তত সরে পড়ছে।

লাগারো ও দখতুরভের মিলিত সেনাদল আগেসদ গ্রামের নিকটবর্তী বাঁধ ও পুকুরের ধারে ভিড় করেছে।

পাঁচটার পর থেকে একমাত্র আগেসদ বাঁধের উপরই ফরাসিদের কামান থেকে জোর গোলাগুলি চলছে আমাদের পশ্চাদপসরণকারী সৈন্যদের লক্ষ্য করে। এদিক থেকে দখতুরভ আরো কয়েকদল সেনাসমাবেশ করে পশ্চাদ্ধাবনকারী ফরাসি অশ্বারোহীদের লক্ষ্য করে বন্দুক চালাচ্ছে।

দলখভ এখন অফিসার হয়েছে, তার হাতে পায়ে আঘাত লেগেছে। তার সঙ্গে আছে ঘোড়াসওয়ার রেজিমেন্ট কম্যান্ডার ও তার দলের জনাদশেক সৈন্য। গোটা রেজিমেন্টের এই কয়জনই অবশিষ্ট আছে। একটা কামানের গোলা লেগে তাদের পিছনে একজনের মৃত্যু হল, সামনেও একজন মারা পড়ল, রক্ত ছিটকে পড়ল দলখভের গায়ে। অসহায়ভাবে সামনে ছুটতে গিয়ে ভিড়ের মধ্যে সকলে জট পাকিয়ে গেল, কয়েক পা এগিয়েই ভিড় থেমে গেল।

প্রত্যেকেই ভাবছে, একশো গজ এগোতে পারলেই নির্ঘাত বেঁচে যাব, আরো দুমিনিট এখানে থাকলেই অবধারিত মৃত্যু।

ভিড়ের ভিতর থেকে বাঁধের ধারে যাবার জন্য জোর করে পথ করে নিতে গিয়ে দলখভ দুটি সৈন্যকে ছিটকে ফেলে দিল এবং কারখানার পুকুরের উপরকার পিছল বরফের দিকে ছুটে গেল।

পায়ের নিচে বরফ সশব্দে গুড়ো হয়ে যেতে লাগল। সেই অবস্থায়ই সে হেঁকে বলল, এদিকে ঘুরে যাও! এদিকে!

সে দাঁড়িয়ে আছে বরফের উপর। বরফ একটু একটু করে দুলছে, শব্দ করছে। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, কামান অথবা ভিড়ের চাপে এ বরফ তো ভেঙে পড়বেই, এমনকি তার নিজের ভারও বেশিক্ষণ বইতে পারবে না। সৈনিকরা তার দিকে তাকিয়ে তীরের দিকে এগিয়ে গেল, কিন্তু বরফের উপর পা ফেলতে ইতস্তত করতে লাগল। অশ্বারোহী অধিনায়কটি বাঁধের মুখে পৌঁছে হাত তুলে দলখভের উদ্দেশে কিছু বলার জন্য মুখ খুলল। হঠাৎ একটা কামানের গোলা এত নিচু হয়ে হিস-হিস শব্দে ছুটে গেল যে সকলেই মাথা নিচু করল। গোলাটা এসে একটা ভিজে কিছুর উপর পড়ল, আর অধিনায়কটি ঘোড়র উপর থেকে ছিটকে পড়ল রক্তের ডোবার মধ্যে। কেউ তার দিকে ফিরে চাইল না বা তাকে তুলে নেবার কথাও ভাবল না।

বরফের উপরে উঠে যাও, বরফের উপরে! চলল! ঘুরে চলল! শুনতে পাচ্ছ না? এগিয়ে চলো! অধিনায়কটি গোলায় আহত হবার সঙ্গে সঙ্গে অসংখ্য কণ্ঠস্বর চিৎকার করে উঠল, কেন যে তারা চিৎকার করছে, কিসের জন্য, তাও তারা জানে না।

যে-সব গোলন্দাজ বাধের দিকে যাচ্ছিল তাদের একেবারে শেষের সৈনিকটি বরফের দিকে ঘুরে গেল। সঙ্গে সঙ্গে সৈন্যরা দলে দলে বাঁধ থেকে ছুটতে লাগল জমাট পুকুরের দিকে। একেবারে প্রথম সৈনিকটির পায়ের চাপেই বরফের চাই ভেঙে পড়ল, তার একটা পা জলে পড়ে গেল। পা তোলার চেষ্টা করতে গিয়ে সে কোমর পর্যন্ত জলে ডুবে গেল। কাছাকাছি সৈন্যরা পিছিয়ে গেল, কামান-চালক তার ঘোড়াটাকে থামাল, কিন্তু পিছন থেকে তখনো সমানে চিৎকার চলছে : বরফের উপর উঠে যাও, থামলে কেন? এগিয়ে যাও! এগিয়ে যাও! ভিড়ের মধ্যে উঠল আর্ত চিৎকার। খোঁচা খেয়ে ঘোড়াগুলো চলতে শুরু করল। যে বরফ পায়ের চাপে কোনোরকমে টিকেছিল, এবার সেটা অনেকটা জায়গা জুড়ে সশব্দে ভেঙে পড়ল, আর সামনে পিছনে চল্লিশ জনের মতো সৈন্য সেই ধাক্কাধাক্কিতে জড়াজড়ি করে ডুবে গেল।

কামানের গোলা তখনো হিস হিস শব্দে ছুটে এসে পড়ছে বরফের উপর, জলের মধ্যে, আর সবচাইতে ঘন ঘন পড়ছে বাধের উপর, পুকুরের মধ্যে ও তার তীরে ভিড় করা মানুষের উপর।

*

অধ্যায়-১৯

প্রিন্স আন্দ্রু বলকনস্কি পতাকাদণ্ড হাতে নিয়ে প্রাজেন পাহাড়ের মাথায় যেখানে পড়ে গিয়েছিল সেখানেই পড়ে আছে। তার শরীর থেকে প্রচুর রক্তপাত হয়েছে। অচেতন অবস্থায় সে করুণ সুরে শিশুর মতো আর্তনাদ করছে।

সন্ধ্যার দিকে তার আর্তনাদ থেমে গেল, একেবারেই চুপচাপ হয়ে গেল। এইভাবে কতক্ষণ অচেতন ছিল তাও সে জানে না। হঠাৎ তার মনে হল সে এখনো বেঁচে আছে, মাথার ভিতরে কাটা ঘায়ের একটা জ্বালা করা যন্ত্রণা হচ্ছে।

যে উঁচু আকাশটাকে আগে কখনো চিনতাম না, শুধু আজই দেখলাম সেটা কোথায়? এই প্রশ্নই তার প্রথম মনে হল। এ রকম যন্ত্রণাও কখনো পাইনি। হ্যাঁ, আজকের আগে আমি কিছুই জানতাম না, কিচ্ছু না। কিন্তু আমি কোথায় আছি?

সে কান পাতল, ঘোড়র পায়ের শব্দ ও ফরাসি ভাষার কথাবার্তা কানে এল। চোখ খুলল। মাথার উপর আবার সেই উঁচু আকাশ, সেই মেঘ আরো উঁচুতে ভাসতে ভাসতে চলেছে, আর তার ফাঁকে ফাঁকে ঝিলমিল করছে অনন্ত নীলিমা। ক্ষুরের শব্দ আর গলার স্বর শুনে বুঝতে পারল কারা যেন ঘোড়ায় চড়ে এসে তার পাশেই থেমেছে, সে কিন্তু মাথা ফেরাল না, তাদের দিকে তাকালও না।

দুজন এড-ডি-কংসহ স্বয়ং নেপোলিয়ন এসেছে। ঘোড়ায় চড়ে যুদ্ধক্ষেত্রে হাজির হয়ে নেপোলিয়ন চূড়ান্ত নির্দেশ দিয়েছে, অগেসদ বাঁধের উপর গোলাবর্ষণকারী কামানের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে, আর নিজে ঘুরে ঘুরে তাদের দেখছে যারা নিহত ও আহত হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে পড়ে আছে।

একটি মৃত রুশ বোমানিক্ষেপকারী উপুড় হয়ে পড়ে আছে, মাথা ও কালো ঘাড়টা মাটির মধ্যে ঢুকে গেছে, শক্ত হাতটা টান টান হয়ে ছড়িয়ে আছে। তার দিকে তাকিয়ে নেপোলিয়ন বলল, চমৎকার সৈনিক এরা!

গোলাবর্ষণকারী কামানশ্রেণীর কাছ থেকে ছুটে এসে একজন অ্যাডজুটান্ট বলল, এই কামানগুলোর বারুদ ফুরিয়ে গেছে ইয়োর ম্যাজেস্ট্রি।

নেপোলিয়ন বলল, রিজার্ভ থেকে কিছুটা আনিয়ে নাও। কয়েক পা এগিয়ে প্রিন্স আন্দ্রুর সামনে থেমে গেল। সে চিৎ হয়ে পড়ে আছে, তার পাশেই পড়ে রয়েছে পতাকাদণ্ডটা। (জয়ের স্মারক হিসেবে পতাকাটা ফরাসিরা নিয়ে গেছে।)

বলকনস্কির দিকে তাকিয়ে থেকে নেপোলিয়ন বলল, বড় চমৎকার মৃত্যু!

প্রিন্স আন্দ্ৰ বুঝল তাকে লক্ষ্য করেই কথাটা বলা হয়েছে, আর বলেছে নেপোলিয়ন। বক্তাকে যে স্যার বলে সম্বোধন করা হয়েছে সেটা সে শুনেছে। কিন্তু কথাগুলি তার কানে এসেছে মাছির গুঞ্জনের মতো। সে কোনো আগ্রহ দেখাল না, খেয়ালও করল না, সঙ্গে সঙ্গেই ভুলে গেল। মাথার ভিতরটা জ্বলছে, মনে হচ্ছে, রক্তক্ষরণের ফলে তার মৃত্যু এগিয়ে আসছে, মাথার উপর দেখতে পেল সেই সুদূর, সুউচ্চ, চিরন্তন আকাশ।

সে বুঝতে পারল এই লোকটিই নেপোলিয়ন–তার আদর্শ–কিন্তু সেই মুহূর্তে চলমান মেঘসহ ওই সুউচ্চ অসীম আকাশ ও নিজের মধ্যে যে লীলা চলেছে তার তুলনায় নেপোলিয়নকে বড়ই ক্ষুদ্র আর তুচ্ছ বলে মনে হল। কে তার উপর ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে, কে তার সম্পর্কে কী বলছে, এই মুহূর্তে সে-সবই তার কাছে অর্থহীন, এই যে-সব লোকজন তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে তাতেই সে খুশি, সে শুধু চাইছে যে বেঁচে উঠতে তারা তাকে সাহায্য করুক, জীবন তার কাছে আজ নতুন করে অর্থবহ হয়ে উঠেছে, সুন্দর হয়ে দেখা দিয়েছে। সর্বশক্তি একত্র করে সে একটু নড়তে চেষ্টা করল, কিছু বলতে চাইল। আস্তে আস্তে পাটা ছড়িয়ে এমন দুর্বল । রুগ্ন কণ্ঠে সে আর্তনাদ করে উঠল যে তার নিজেরই করুণা হল।

নেপোলিয়ন বলে উঠল, আহা! এ যে বেঁচে আছে! এই যুবককে তুলে নিয়ে কোনো ড্রেসিং-স্টেশনে পৌঁছে দাও।

এই কথা বলে নেপোলিয়ন মার্শাল ল্যানেসের সঙ্গে দেখা করতে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল, মার্শালও টুপিটা হাতে নিয়ে হাসি মুখে এগিয়ে এসে জয়লাভের জন্য সম্রাটকে অভিনন্দন জানাল।

প্রিন্স আন্দ্রুর আর কিছুই মনে নেই : স্ট্রেচারে তোলার ভয়ংকর যন্ত্রণায়, বয়ে নিয়ে যাওয়ার ঝাঁকুনিতে এবং ড্রেসিং-স্টেশনে ক্ষতস্থান কাটাছেঁড়ার ফলে সে জ্ঞান হারাল। দিনের শেষে অন্য বন্দি রুশ অফিসারদের সঙ্গে তাকেও যখন একটা হাসপাতালে পাঠিয়ে দিল তখন তার জ্ঞান ফিরে এল। নিয়ে যাওয়ার পথে সে কিছুটা শক্তি ফিরে পেল, চারদিকে তাকাতে পারল, এমনকি কথা বলতেও পারল।

জ্ঞান ফিরে পেয়ে প্রথমেই সে শুনতে পেল একজন ফরাসি কনভয় অফিসারের কথা, সে দ্রুতলয়ে বলছে, এখানেই আমাদের থামতে হবে : এখনই সম্রাট এখান দিয়ে যাবেন, এই বন্দি ভদ্রলোকদের দেখলে তিনি খুশি হবেন।  আর একজন অফিসার বলল, আজ এত বেশি লোক বন্দি হয়েছে, বলতে গেলে গোটা রুশ বাহিনী, সম্রাট সম্ভবত বন্দিদের ব্যাপারে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন।

সাদা ইউনিফর্মধারী একজন রুশ অফিসারকে দেখিয়ে প্রথম অফিসার বলল, ঠিক আছে! শুনেছি, এই লোকটি সম্রাট আলেক্সান্দারের রক্ষীবাহিনীর অধিনায়ক।

বলকনস্কি প্রিন্স রেপনিনকে চিনতে পারল, পিটার্সবুর্গের উঁচু মহলে তার সঙ্গে অনেকবার দেখা হয়েছে। তার পাশেই অশ্বারোহী রক্ষীবাহিনীর আর একজন আহত অফিসার দাঁড়িয়েছিল, তার বয়স মাত্র উনিশ।

বোনাপার্ত জোর কদমে ঘোড়া ছুটিয়ে এসে থামল।

বন্দিদের দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করল, প্রধান কে?

তারা কর্নেল প্রিন্স রেপনিনের নাম করল।

নেপোলিয়ন জিজ্ঞেস করল, আপনি সম্রাট আলেক্সান্দারের অশ্বারোহী রক্ষী রেজিমেন্টের অধিনায়ক?

আমি একটি ছোট দল পরিচালনা করি।

আপনার রেজিমেন্ট সসম্মানে নিজ কর্তব্য পালন করেছে।

একজন মহান অধিনায়কের প্রশংসাই একটি সৈনিকের কাছে সবচাইতে বড় পুরস্কার।

সানন্দে আপনাকে সে পুরস্কার দিলাম। আপনার পাশে এই যুবকটি কে?

প্রিন্স রেপনিন লেফটেন্যান্ট সুখতেলেনের নাম করল।

তার দিকে তাকিয়ে নেপোলিয়ন হাসল।

আমাদের কাজের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ার পক্ষে সে বড় বেশি তরুণ।

জড়ানো কণ্ঠে সুখতেলের বলল, তারুণ্য তো সাহসের পথে বাধা নয়।

নেপোলিয়ন বলে উঠল, চমৎকার জবাব! যুবক, তুমি অনেকদূর এগিয়ে যেতে পারবে!

প্রিন্স আন্দ্রুকে সম্রাটের সামনে হাজির করা হল। তাকে যুদ্ধক্ষেত্রে দেখার কথা নেপোলিয়নের মনে পড়ে গেল, তাকেও যুবক বলে সম্বোধন করে বলল, তারপর, সাহসী যুবক, তুমি কেমন আছ?

যে সৈনিকরা তাকে এখানে বয়ে এনেছে পাঁচ মিনিট আগেও প্রিন্স আন্দ্রু তাদের সঙ্গে কিছু কথা বলেছে, কিন্তু এখন নেপোলিয়নের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে সে চুপ করে রইল। …যে মহান, নিরপেক্ষ, সদয় আকাশকে সে আজ দেখেছে, তার অর্থ বুঝেছে, তার সঙ্গে তুলনায় এই মুহূর্তে নেপোলিয়নের সব কর্মকাণ্ডকে তার কাছে এতই অকিঞ্চিৎকর মনে হল, তার আদর্শ নায়কের তুচ্ছ অহংকার ও জয়ের আনন্দ তার কাছে এতই ছোট মনে হল, যে নেপোলিয়নের প্রশ্নের কোনো জবাবই সে দিতে পারল না।

রক্তক্ষরণজনিত দুর্বলতা, যন্ত্রণা ও মৃত্যুর নৈকট্য তার মনে যে কঠোর, গম্ভীর চিন্তাকে জাগিয়ে তুলেছে তার তুলনায় এখন সবকিছুই তুচ্ছ ও অর্থহীন মনে হচ্ছে। নেপোলিয়নের চোখের দিকে তাকিয়ে প্রিন্স আন্দ্রু শুধু ভাবতে লাগল মহত্ত্বেরও অর্থহীনতা, যে জীবন বুদ্ধির অতীত তার গুরুত্বহীনতা, এবং যে মৃত্যুর অর্থ জীবিত মানুষের বুদ্ধি ও ব্যাখ্যার অতীত তার অধিকতর গুরুত্বহীনতার কথা।

জবাবের জন্য অপেক্ষা না করে সম্রাট ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে দিল, যেতে যেতেই জনৈক অফিসারকে বলল, এইসব ভদ্রলোকদের উপযুক্ত সেবাযত্ন ও বিশ্রামের ব্যবস্থা করে দাও, ডাক্তার ল্যারে ওদের পরীক্ষা করুক। আ রিভোয়া প্রিন্স রেপনিন! বলে সে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল।

আত্মতুষ্টি আর খুশিতে তার মুখটা জ্বলজ্বল করতে লাগল।

যে সৈনিকরা প্রিন্স আন্দুকে বয়ে এনেছিল তারা তার বোনের নিজের হাতে পরিয়ে দেয়া সোনার ছোট দেবমূর্তিটা দেখতে পেয়ে গলা থেকে খুলে নিয়েছিল, কিন্তু সম্রাট বন্দিদের প্রতি যে অনুগ্রহ দেখিয়ে গেল তাতে তারা তাড়াতাড়ি সেটা ফিরিয়ে দিল।

কে যে কেমন করে ছোট দেবমূর্তিটা তার গলায় পরিয়ে দিল সেটা প্রিন্স আন্দ্রু দেখতে পায়নি, কিন্তু এখন বুঝতে পারল যে সোনার চেনসহ মূর্তিটাকে হঠাৎই ইউনিফর্মের উপর দিয়ে তার বুকের উপর রেখে দেয়া হয়েছে।

বোনের দেয়া দেবমূর্তিটির দিকে তাকিয়ে প্রিন্স আন্দ্রু ভাবল, মারির কাছে সবকিছুই যেমন পরিষ্কার ও সরল মনে হয়, আসলে তাহলে কতই না ভালো হত! বেঁচে থাকতে কার কাছে সাহায্যের প্রার্থনা জানাতে হবে, আর কবরের ওপারে গিয়েই বা কী আশা করতে হবে, তা জানতে পারলে কতই না ভালো হত। এখন যদি বলতে পারতাম, হে প্রভু, আমাকে দয়া করো! তাহলে আমি কত না সুখী, কত না শান্ত হতে পারতাম! …কিন্তু কাকে সে কথা বলব? হয় এমন কোনো সংজ্ঞার অতীত জ্ঞানের অতীত শক্তিকে যাকে সম্বোধন করতে আমি জানি না, ভাষায় প্রকাশ করতেও পারি না–সেই মহান অদ্বৈত অথবা শূন্য-অথবা সেই ঈশ্বরকে মারি যাকে এই রক্ষা কবচের সঙ্গে সেলাই করে দিয়েছে! কিছুই তো নিশ্চিত নয় : আমি যা কিছু বুঝি তার গুরুত্বহীনতা এবং অজ্ঞেয় অথচ একান্ত গুরুত্বপূর্ণ কোনো কিছুর মহত্ত্ব ছাড়া আর সবকিছুই অনিশ্চিত।

স্ট্রেচারগুলো এগিয়ে চলল। প্রতিটি ঝাঁকুনির সঙ্গে সঙ্গে সে আবার অসহ্য যন্ত্রণা বোধ করতে লাগল, জ্বরভাবটা বেড়ে গেল, বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়ল। বাবা, স্ত্রী, বোন ও ভাবী পুত্রের ছবি, যুদ্ধের আগের রাত্রির কোমল অনুভূতি, ছোট নেপোলিয়নের সাধারণ মূর্তি, আর সবার উপরে ওই সুউচ্চ আকাশ-বিকারের ঘোরে এসবই তার মনে ভিড় করতে লাগল।

চোখের সামনে ভেসে উঠল শান্ত পারিবারিক জীবন ও বন্ড হিলসের শান্তিপূর্ণ সুখের ছবি। এই সুখেই সে বিভোর হয়েছিল, এমন সময় ছোট্ট নেপোলিয়ন সহসা এসে হাজির হল অপরের দুঃখদুর্দশায় তার সহানুভূতিহীন ও অদূরদর্শী আনন্দ নিয়ে, তারই ফলে তার মনে জাগল সন্দেহ ও যন্ত্রণা, এখন একমাত্র স্বৰ্গই দিতে পারে প্রতিশ্রুত শান্তি। সকলের দিকে এইসব স্বপ্ন মিলে মিশে একাকার হয়ে গেল অচৈতন্য ও বিস্মৃতির এক বিশৃঙ্খল অন্ধকারে। নেপোলিয়নের ডাক্তার ল্যারের মতে, এ অবস্থার পরিণামে আরোগ্য নয়, মৃত্যুর সম্ভাবনাই অধিক।

ল্যারে বলল, সে স্নায়বিক দুর্বলতা ও পিত্তবিকারে ভুগছে, আর কখনো সুস্থ হবে না।

এদিকে মারাত্মকভাবে আহত অন্য সকলের সঙ্গে প্রিন্স আন্দ্রুকে রেখে দেয়া হল স্থানীয় অধিবাসীদের আশ্রয়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *