০৩. হেস্টিংসের বন্ধু পলিয়ের

হেস্টিংসের বন্ধু পলিয়ের

রবার্ট ক্লাইভ পলাশির যুদ্ধে জয়ী হওয়ার ফলে আস্তে-আস্তে বাংলা, বিহার, ওড়িশা নবাবের হাত থেকে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির হাতে চলে এল, একথা সবাই জানে। কিন্তু যুদ্ধ জয় করা এক, আর দেশের উপর শাসন বিস্তার করা অন্য জিনিস। ক্লাইভ দেশে চলে যাবার পরে ওয়ারেন হেস্টিংস বাংলার গভর্নর হয়েছিলেন। তখন কোম্পানির ক্ষমতা অনেক বেড়েছে। মুঘল সম্রাটের উত্তরাধিকারীরা আগেকার সম্রাটদের ক্ষীণ ছায়া মাত্র। দিল্লির বাদশাদের বলা হত শাহেনশা। অর্থাৎ সমস্ত পৃথিবীর মালিক, কিন্তু ওয়ারেন হেস্টিংসের সময় দিল্লির বাদশাহের সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব দিল্লির চারপাশে কয়েক মাইলের মধ্যেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। গ্রীষ্মের দিনে পুকুর প্রায় শুকিয়ে গেলে তার মাঝখানে যেমন একটু তলানি পড়ে থাকে।

বাদশাহ শাহ আলমের নাম আগে ছিল আলি গহর। তাঁর সম্বন্ধে একটি পুরনো ছড়া আছে:

বাদশাহ শাহ আলম্,
দিল্লিসে পালম।

অর্থাৎ নামেই বাদশাহ, কিন্তু তাঁর সাম্রাজ্যসীমা হচ্ছে দিল্লি থেকে পালম গ্রাম পর্যন্ত। এখন যেখানে দিল্লির এয়ারপোর্ট হয়েছে, তারই পাশে। কয়েক বছর আগেও এয়ারপোর্টে আসবার সময় পুরনো পালম গ্রামের বাড়িঘর দেখা যেত। এখন প্রাচীর দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে, তাই পুরনো দিনের ছবি অল্পস্বল্পই চোখে পড়ে।

ওয়ারেন হেস্টিংস সম্পর্কে অনেক দুর্নাম আমাদের দেশে শোনা যায়। সেসব একেবারে মিথ্যা নয়। কোম্পানির তখন টাকা-পয়সার খুব অভাব; যুদ্ধবিগ্রহ তো লেগেই আছে। তাঁকে অনেক সময় যে-উপায়ে টাকা যোগাড় করতে হয়েছে, তা প্রশংসনীয় নয়। অযোধ্যার বেগমদের উপর তিনি অনেক জবরদস্তি করেছিলেন, তাও সত্য। নন্দকুমারের ফাঁসির সঙ্গেও তাঁর নাম জড়ানো। সেসব সত্ত্বেও বলব, তাঁর অনেক সৎগুণ ছিল যা সাধারণত দেখা যায় না। ভারতবর্ষ সম্বন্ধে বিদেশীদের যে সাধারণ অবজ্ঞা, তিনি তার থেকে অনেকাংশে মুক্ত ছিলেন। চোদ্দ বছর বয়সে এদেশে চাকরি নিয়ে এসেছিলেন। তাঁর হাতের লেখা ভাল ছিল আর অঙ্ক জানেন, এই বলে চাকরির দরখাস্ত করেছিলেন। তাঁর নিজের হাতের লেখা দরখাস্ত এখনও আছে। দেখলে মনে হবে হাতের লেখা সম্বন্ধে কথাটি মিথ্যা বলেননি। এদেশে এসে তিনি ফার্সি শিখেছিলেন। বাংলাও বলতে শিখলেন। তিনি গভর্নর না হলে তখন সংস্কৃতের চর্চা কি আরবি-ফার্সির চর্চা বন্ধ হয়ে যেত। লেখাপড়ায় তাঁর খুব উৎসাহ ছিল। সংস্কৃতের প্রতি তাঁর অনুরাগ কারুর চেয়ে কম ছিল না। তাঁর একজন বন্ধু ছিলেন, নাম আঁতোয়ান ল্যুই অঁরি পলিয়ের। নামেই বোঝা যাচ্ছে, পলিয়ের ইংরেজ ছিলেন না, তাঁদের পরিবার আসলে ফরাসি। কিন্তু তাঁরা সুইট্জারল্যাণ্ডে এসে বসবাস করছিলেন। ১৭৫৭ সালে অর্থাৎ পলাশির যুদ্ধের বছরে, ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানিতে পলিয়ের চাকরি পান। তাঁর কাকা পল পূর্বে মাদ্রাজে কোম্পানির চাকরি করে গিয়েছেন। আঁতোয়ান ল্যুই পলিয়ের অর্থাৎ ভাইপো কিছুদিন দক্ষিণ ভারতবর্ষে চাকরি করেছিলেন। ১৭৬১ সালে তৃতীয় পেশোয়া প্রথম বাজীরাওয়ের সঙ্গে পানিপথে আহমদ শাহ আবদালির লড়াই হয়েছিল।

এই লড়াইয়ে মারাঠাদের পরাজয় হয়। ভারতবর্ষের ইতিহাসের স্রোত তার ফলে অন্য মোড় নিল। এই সময় আঁতোয়ান পলিয়ের সুবে বঙ্গ-বিহার-ওড়িশায় বদলি হয়ে এলেন।

কলকাতায় তখন নানারকম কাজের তোড়জোড় চলছিল। ট্যাঙ্ক স্কোয়ারের কাছে কোম্পানির যে পুরনো কেল্লা ছিল, তা নবাবের সৈন্যদের হাতে তখন প্রায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। আরও দক্ষিণে ময়দানে নতুন কেল্লা গড়বার চেষ্টা চলছিল। মাদ্রাজের চিফ ইঞ্জিনিয়ার জন্ ব্রোহিয়ার কলকাতায় এসে কাজও আরম্ভ করেছিলেন, কিন্তু তাঁর কাজ বেশিদূর এগোয়নি। তাছাড়া তাঁর সম্বন্ধে গুজব শোনা যাচ্ছিল যে, টাকাপয়সারও নাকি হিসাব-পত্র ঠিক নেই। এসব কথা হয়তো সত্যি, কারণ এক সুযোগে ব্রোহিয়ার কলকাতা থেকে পালিয়ে সিংহলে চলে গেলেন। সিংহল তখন ওলন্দাজদের হাতে। তাঁকে লোক পাঠিয়ে ধরে আনাও তাই সম্ভব ছিল না। বছর দুয়েক পলিয়ের কলকাতার দুর্গের কাজকর্ম দেখতে লাগলেন। তখন তিনি ছিলেন চিফ ইঞ্জিনিয়ার। পলিয়েরের অসুবিধা ছিল যে, তাঁকে কাজের জন্য যা টাকা দেওয়া হত, তাতে তাঁর খরচ কুলোত না। তাছাড়া খাবার লোকের অভাব ছিল। তা হলেও পলিয়ের ভাল করে কাজ করেছিলেন। নতুন দুর্গের যে প্ল্যান ছিল, তার সামান্য অদল-বদল করে নদীর ধারে একটি বড় গেট তৈরি করাবার ব্যবস্থা করেছিলেন। এটিকে বলা হয় ‘ওয়াটার গেট’। এর ফলে দুর্গ থেকে জাহাজ আসা-যাওয়ার খুব সুবিধা হয়েছিল। রবার্ট হজেস নামে এক চিত্রকর ১৭৮০ সালে কলকাতায় এসেছিলেন। তিনি পলিয়েরের এই কাজের খুব প্রশংসা করে গিয়েছেন। পলিয়েরের তখন কাজকর্মে সুনাম হয়েছে। অযোধ্যার নবাবের একজন ভাল ইঞ্জিনিয়ারের দরকার ছিল। তাঁর কাছে পলিয়েরের নাম প্রস্তাব করে পাঠানো হল। তখন অযোধ্যা রাজ্যে অনেক ইংরেজ চাকরি করতেন। নিজেরা ব্যবসা করে তাঁরা অল্পদিনের মধ্যেই খুব ধনী হয়ে উঠতেন। কিন্তু সবসময় ধর্মপথে নয়। পলিয়েরের আশা হয়েছিল, সবসময় তিনি চাকরি তো করবেনই, তাছাড়া অন্য ইংরেজদের মতো ব্যবসা করে রাতারাতি ধনী হয়ে যাবেন। তাঁর এ-স্বপ্ন সফল হয়নি। অল্পদিনের মধ্যে বোঝা গেল, তাঁর চাকরি নিয়ে কলকাতায় গোলমাল চলছে।

তখন কলকাতায় কোম্পানি রাজ্য চালাবার জন্য একটি ছোট কমিটি ছিল; তাকে কাউন্সিল বলা হত। কাউন্সিলের পাঁচজন সদস্যের মধ্যে তিনজনই বললেন, পলিয়েরকে যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি ফিরিয়ে আনা উচিত, কারণ তিনি ওখানকার যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত হয়েছেন। তাঁকে এ ক্ষমতা কে দিল? ওয়ারেন হেস্টিংস অনেক প্রতিবাদ করলেন, পলিয়েরও কাউন্সিলকে জানালেন যে, এখন ফিরে গেলে তাঁর খুব টাকাপয়সার ক্ষতি হবে। তিনি অযোধ্যায় যে ব্যবসা করছিলেন, সে তো নতুন কিছু নয়, সব ইংরেজ কর্মচারীই এই কাজ করে থাকেন। কিন্তু ফল কিছুই হল না। অবশেষে আর কোনো উপায় রইল না, পলিয়ের কলকাতায় ফিরে এলেন। অল্পদিনের মধ্যে অযোধ্যার নবাবের টাকাপয়সার অবস্থা আরও খারাপ হয়ে উঠল। একবার কথা হয়েছিল, পলিয়েরকে আবার লখনউ ফেরত পাঠানো হোক্, কিন্তু এই কারণে তা সম্ভব হল না।

পলিয়েরের দুঃখের দিন অবশ্য শেষ হয়ে আসছিল। কোম্পানির ডিরেক্টরদের কাছে ওয়ারেন হেস্টিংস খুব প্রশংসা করে চিঠি লিখেছিলেন। পলিয়ের বিরক্ত হয়ে কিছুদিন আগে কোম্পানির চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন কিন্তু তাঁকে ডেকে এনে লেফ্টেন্যান্ট কর্নেলের পদ দেওয়া হল এবং অযোধ্যায় থাকা সম্বন্ধেও কোনো নিষেধ রইল না। পলিয়ের তো খাঁটি ইংরেজ ছিলেন না। সেকথা আগেই বলেছি। খাঁটি ইংরেজ ছাড়া আর কাউকে লেফ্টেন্যান্ট কর্নেলের উপরের পদ পাবার যোগ্য বলে মনে করা হত না।

পলিয়ের এর পর থেকে বেশির ভাগ সময় লখনউয়ে থাকতেন। তাঁর অতিথি-সৎকারেরও প্রশংসা শোনা যায়। তখন ইংরেজরা কেউ কেউ ভারতীয় ভাষা ও ইতিহাস-চর্চা করতে ভালবাসতেন। ওয়ারেন হেস্টিংসের সঙ্গে পুলিয়েরের এ-বিষয়ে কিছু মিল ছিল। পলিয়ের অনেক প্রাচীন পুঁথি সংগ্রহ করেছিলেন। ১৭৮৪ সালে যখন কলকাতায় ওয়ারেন হেস্টিংস ও স্যার উইলিয়াম জোনস নানারকম গবেষণার জন্য এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করলেন, তখন পলিয়ের প্রথম থেকেই তার সদস্য হয়েছিলেন। সে প্রায় দুশো বছর আগে, ১৭৮৪ সালে। এখন পার্ক স্ট্রিটে এশিয়াটিক সোসাইটির মস্ত বাড়ি। তখন সোসাইটির নিজের বাড়িঘর বলতে কিছু ছিল না। টাউন হলের কাছে সুপ্রিম কোর্টের বাড়িতে এশিয়াটিক সোসাইটির অফিস ছিল। পলিয়ের তো লখনউ থাকতেন, কাজেই সব অধিবেশনে আসতে পারতেন না। মাঝে-মাঝে এসে প্রবন্ধ পড়তেন, কিংবা আলোচনায় যোগ দিতেন। অল্পদিন পরে পলিয়ের ইউরোপে ফিরে গেলেন।

১৭৯৫ সালে একদল ডাকাতের হাতে পড়ে পলিয়েরের মৃত্যু হয়। ডাকাতরা তাঁকে আক্রমণ করেছিল কেন, বলি। এদেশে থাকবার ফলে পলিয়েরের একটা খারাপ অভ্যাস হয়েছিল। তিনি এদেশের রাজারাজড়াদের দেখাদেখি পোশাকের সঙ্গে হীরা জহরতও ব্যবহার করতেন বিস্তর। সম্ভবত তারই লোভে ডাকাতরা তাঁকে আক্রমণ করেছিল। পলিয়ের বেদের পুঁথি সংগ্রহ করেছিলেন। সেসব লণ্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়ামে দেখতে পাওয়া যায়। প্যারিসে বিখ্যাত লাইব্রেরি বিবলিওথেক নাশিওনাল-এ তাঁর সংগৃহীত অনেক আরবি ফার্সি ও সংস্কৃত কাগজপত্র আছে। প্রায় চল্লিশ বছর আগে এশিয়াটিক সোসাইটির বাড়িতে একটি সিন্দুকের মধ্যে তাঁর লেখা ইতিহাসের পাণ্ডুলিপির একটি খসড়া পাওয়া গিয়েছে। সেটি ছাপা হয়েছে। এশিয়াটিক সোসাইটির বাড়িতে পণ্ডিতদের অনেক পুরনো মূর্তি ও তৈলচিত্র আছে। পলিয়েরের কিন্তু নেই। মূর্তির কথা উঠছে না, কিন্তু একটি তৈলচিত্র থাকলে মন্দ হত না। তবু যা হোক ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের গ্যালারিতে পলিয়েরের ছবি দেখতে পাওয়া যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *