হরিপ্রসন্ন বাবুর সঙ্গে মতিন সাহেবের যোগাযোগের একমাত্র সূত্র হচ্ছে–মতিন সাহেবের বড় মেয়ে নিশা। হরিবাবু নিশাকে কিছুদিন অংক শিখিয়েছেন। নিশার কোন শিক্ষকই বেশীদিন পছন্দ হয় না। তাঁকেও পছন্দ হয় নি। সে দুমাস অংক করেই বলল, বাবা উনাকে বদলে দাও।
মতিন সাহেব বলেছিলেন, কেন মা? এত ভাল টিচার…
নিশা ঘাড় বাঁকিয়ে বলল, উনি কেমন করে জানি তাকান আমার ভাল লাগে। মতিন সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, কেমন করে তাকান?
আমি তোমাকে বলতে পারব না।
মতিন সাহেবের বিস্ময়ের সীমা রইল না। তাঁর মনটা খারাপ হয়ে গেল। তিনি হরিবাবুকে ছাড়িয়ে দিলেন।
মজার ব্যাপার হচ্ছে হরিবাবু কখনো কোন বিশেষভাবে নিশার দিকে তাকান নি। তাঁর মুখে মা-জননী ছাড়া অন্য কোন ডাকও ছিল না। ষাট বছর বয়েসী একজন বৃদ্ধ ক্লাস টেনের একটা বাচ্চা মেয়ের দিকে বিশেষ ভঙ্গিতে তাকানোর প্রশ্নও উঠে না। সেই সময় নিশার ধারণা হয়ে গিয়েছিল পৃথিবীর সব পুরুষই তার দিকে বিশেষভাবে তাকায়। তার সঙ্গে ভাব করার চেষ্টা করে।
হরিবাবু চলে গেলেও তিনি এই বাড়িতে আসা-যাওয়া বন্ধ করেন না। প্রায়ই দেখা যায় বসার ঘরে চুপচাপ বসে আছেন। নিশাকে খবর পাঠাতেন। সে ঘাড় বাঁকিয়ে বলতো–আমি যেতে পারব না। কেন আসে শুধু শুধু। ভদ্রলোককে অনেকক্ষণ একা বসে থাকতে হত। শেষ পর্যন্ত নিশা অবশ্যি আসত। শুধু আসতো না–হাসি মুখে অনেকক্ষণ গল্প করত।
হরিবাবুর নিকট বা দূর কোন আত্মীয়-স্বজন ছিল না। স্ত্রী মারা গেছেন। যৌবনে বিয়ের এক বছরের মাথায়। দুই ভাই পার হয়ে গেছেন ইন্ডিয়ায়। তিনি বাসাবো এলাকায় টিনের দু কামরার একটা ঘরে কুড়ি বছর একাই কাটিয়ে দিয়েছেন। ফরিদা বিদ্যায়তনের শিক্ষক ছিলেন। চাকরি থেকে অবসর নেবার পর ভয়াবহ সমস্যায় পড়ে গেলেন। প্রাইভেট স্কুল। পেনসনের ব্যবস্থা নেই। প্রাভিডেন্ট ফাণ্ডের টাকাও পুরোটা পেলেন না। যা পেলেন তাও দ্রুত শেষ হয়ে গেল। গৃহশিক্ষকতা করার ক্ষমতা নেই। ছাত্র-ছাত্রী কেউ আসেও না। বয়সের নানান আদি ব্যাধিতে পুরোপুরি কাবু হয়ে গেলেন। একমাত্র কাজ দাঁড়াল পুরানো ছাত্র-ছাত্রীকে খুঁজে বের করে তাদের সঙ্গে কিছুদিন করে থাকার ব্যবস্থা করা যায় কি না সেই চেষ্টা করা। বাসাবোর বাড়িটি দুমাস আগে ছেড়ে দিয়েছেন। বাসা ধরে রাখার কোন অর্থও নেই। তাঁর হাত শূন্য। অর্থ এবং বিত্তের মধ্যে আছে তাঁর স্ত্রীর কানের একজোড়া দূল। স্ত্রীর মৃত্যুর পর সে দুলজোড়া তিনি নিজের হাতে স্ত্রীর কান থেকে খুলে রেখেছিলেন।
মতিন সাহেবের বাড়িতে তিনি খুব ভয়ে ভয়ে এসে উঠেছেন। এখনো মতিন সাহেবের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়নি। কয়েকটা দিন এই বাড়িতে থাকতে চান। এই প্রসঙ্গে মতিন সাহেবের সঙ্গে কিভাবে আলাপ করবেন তা অনেকবার মনে মনে ভেবে রেখেছেন। সমস্যা হচ্ছে বয়সের কারণেই বোধ হয় ভেবে রাখা কথা তিনি কখনো ঠিকমত বলতে পারেন না। তাছাড়া মতিন সাহেব লোকটিকেও তিনি ভয় পান। জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে অর্থ ও বিত্তবান সব মানুষকেই তিনি ভয় করা শুরু করেছেন।
হরিবাবু বারান্দায় বসেছিলেন।
এষা তাকে ডেকে নিয়ে গেল। বসার ঘরে মতিন সাহেব তাঁর জন্যে অপেক্ষা করছেন। হরিবাবু মনে মনে গীতার শ্লোক বলতে লাগলেন–
তমসো মা জ্যোতির্গময়
মৃত্যেৰ্মামৃতং গময়।
হে ঈশ্বর, আমাকে অন্ধকার থেকে আলোকে নিয়ে যাও। মৃত্যু থেকে অ-মৃত্যুতে।
মতিন সাহেব বললেন, বসুন।
হরিবাবু বসলেন।
শুনলাম, কিছুদিন এখানে থাকতে চান?
জি।
ব্যাপারটা কি?
হরিবাবু ভেবে রাখা কথা দ্রুত মনে করার চেষ্টা করলেন। কোন কিছুই মনে পড়ল না। নিজের অভাবের কথা বলতে পারলেন না। মাথার ভেতর গীতার শ্লোক ঘুরতে লাগলো —
তমসো মা জ্যোতির্গময়
মৃত্যেৰ্মামৃতং গময়।
কতদিন থাকতে চান?
এই অল্প কটা দিন। আমার আয়ু শেষ। যাওয়ার জায়গা নাই।
আত্মীয়-স্বজন কেউ নেই?
খুড়তোতো এক ভাই থাকে পাটনায়–তার ঠিকানা জানি না।
আমি বরং আপনাকে কিছু অর্থ সাহায্য করি। একজন মানুষকে রাখার অনেক সমস্যা। বুঝতেই পারছেন।
হরিবাবু বিড় বিড় করে গীতার শ্লোক বললেন। মতিন সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন–এসব কি বলছেন?
গীতার একটা শ্লোক। বয়স হয়ে গেছে–এখন ঠিকমত কিছু ভাবতেও পারি না–বলতেও পারি না। আপনাকে আমি বেশীদিন যন্ত্রণা দেব না, কয়েকটা দিন। আমার প্রতি দয়া করুন। আমি রোজ সকালে উঠে ঈশ্বরের কাছে–মৃত্যু প্রার্থনা করি। ঈশ্বর আমার প্রার্থনা শুনেছেন। আমার সময় আগতপ্রায়।
ঈশ্বর প্রার্থনা শুনেছেন তা কি করে বুঝলেন?
এটা বোঝা যায়।
মতিন সাহেব সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন–আচ্ছা থাকুন।
আপনি কি আমাকে থাকতে বললেন?
হ্যাঁ বললাম।
মতিন সাহেব এষাকে বলেছিলেন–ঐ লোকটার ঘর হরিবাবুকে দিয়ে দে।
এষা বললো, মিস্টার জুলাই এর ঘর? সে তো এখনো যায় নি।
ঐ ঘরে আরেকটা খাট দিয়ে দে, তা হলেই তো হল। প্রত্যেকের আলাদা ঘর লাগবে নাকি?
হরিবাবু বললেন, আপনি আমাকে কিছু বললেন?
না। আপনাকে কিছু বলিনি।
হরিবাবুর জায়গা হল মিস্টার জুলাই এর সঙ্গে। প্রথম রাত আনন্দে তিনি ঘুমুতে পারলেন না।