০৩. স্পুটনিক বয়েজ ক্লাব

০৩. স্পুটনিক বয়েজ ক্লাব

হড়বড় করে ভাত খাচ্ছিলাম। আম্মা বললেন, সারাদিন কি করিস? ভাতটা পর্যন্ত ধীরে সুস্থে খেতে পারিস না?

একদলা ভাত অর্ধেক চিবিয়ে গিলে ফেলে বললাম, সবাই অপেক্ষা করছে, খেলতে হবে না!

এই মাত্র না আসলি স্কুল থেকে?

আমি আর বৃথা তর্ক করলাম না। এই মাত্র স্কুল থেকে এলে কি খেলতে যাওয়া যায় না? কিন্তু আম্মাকে সেটা কে বোঝাবে?

স্কুলের জামা কাপড় বদলে একটা কালো হাফ প্যান্ট পরে আমি এক ছুটে মাঠে এসে হাজির হলাম। সেখানে কেউ নেই দেখে আমি গেলাম আমাদের ডিটেকটিভ ক্লাবে। সেখানে দেখি ভীষণ ধুমধাড়াক্কার সাথে বল পাম্প করা হচ্ছে। প্রতিদিন টাটকা পাম্প করে নাকি খেলার নিয়ম।

রবিন পাম্প শেষ করে বলল, চল আমরা অন্য পাড়ার সাথে একটা ফুটবল খেলা দিই।

চল! আমরা সবাই এক বাক্যে রাজি হয়ে গেলাম। শুধু সলিল মুখ সূঁচালো করে বলল, কিন্তু ঠাকুরপাড়ার সাথে হেরে যাব।

কখখনো না! রবিন তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়। আজ থেকে আমরা প্র্যাকটিস শুরু করব।

সত্যি সত্যি প্র্যাকটিস শুরু করা হল। আমার উপর জোর দেয়া হল সবচেয়ে বেশি। ভাল গোলকীপার থাকলে নাকি খেলায় অর্ধেক জেতা হয়ে যায়। ওরা সবাই আমার সামনে থেকে দমাদম কিক মেরে গোল দেয়ার চেষ্টা করছিল আমি লাফিয়ে কুদিয়ে সেগুলি ধরার চেষ্টা করছিলাম। একেকবার একেকটা বল হাতের ফাঁক দিয়ে চলে যাচ্ছিল অমনি সবাই চেঁচিয়ে উঠছিল ‘গো-ও-ল!’ আবার যখনি একটা মারাত্মক বল ধরে ফেলছিলাম তখন ওরা ‘সাবাশ’ ‘সাবাশ’ বলতে দ্বিধা করছিল না।

এরপর ওরা নিজেরা একজন আরেকজনকে বল পাস করা শিখতে লাগল। দাঁড়িয়ে থেকে পাস, দৌড়াতে দৌড়াতে পাস, সামনে থেকে পাস, পিছন দিকে পাস, হাজারো রকমের কায়দা! খেলতে খেলতে একসময় বেলা শেষ হয়ে এল, আমরা ঘেমে একাকার। বসে থেকে বিশ্রাম নিতে নিতে মনে হল কোন পাড়ার সাথে ফুটবল খেলা দেয়ার জন্যে এখনই গিয়ে আলাপ করে রাখা ভাল। আমরা তখনই সূত্রাপুর রওনা হলাম। ওদের একটা ফুটবল ক্লাব আছে। ওদের দলটাকে খুঁজে পেতে খুব দেরি হল। বাজারের পাশে নোংরা একটা মাঠে কাদা মেখে ওরা হা-ডু-ডু খেলছে। ওদের ভিতরে যে ছেলেটা মোটামুটি নেতা সে অন্য স্কুলে, তবে আমাদের সাথেই পড়ে। নাম মঞ্জু। ওকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম আমাদের সাথে ফুটবল খেলা দিতে রাজি আছে কি না। একটুও চিন্তা না করে সে বলল, না।

কেন? খেলবি না কেন?

আমাদের বল নেই।

আমাদের আছে। আমি বলটা দেখালাম, এটা দিয়ে খেলব।

আমরা অন্যের বল দিয়ে খেলি না। এই বলে সে একটা চোরা কাটা তুলে চিবুতে লাগল। একটু পরে বলল, আমাদের সাথে হা-ডু-ডু খেলবি?

নাহ! আমি রবিনকে দেখালাম। দেখছিস না হাত নেই?

অ। মঞ্জুকে এবারে একটু কৌতূহলী দেখা গেল। রবিনকে দেখিয়ে বলল, তোদের সাথে এও খেলবে নাকি?

খেলব মানে? আমিই তো ক্যাপ্টেন! বলে রবিন বুকে ছোট্ট একটা ঘুষি মারল। রবিন এমন হঠাৎ করে নিজেকে ক্যাপ্টেন বলে বসল যে আমরা হতচকিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম, একটু প্রতিবাদও করতে পারলাম না। তাছাড়া অন্য পাড়ার সামনে এসব ব্যাপার নিয়ে ঝগড়া করলে সম্মান থাকে না। হীরা তবু চোখ পাকিয়ে বলল, ইহ!

মঞ্জু হীরার কথাটা ঠিক শুনতে পেল না।।

খানিকক্ষণ রবিনকে লক্ষ্য করে মঞ্জু হঠাৎ করে কেন জানি খেলতে রাজি হয়ে গেল। বলল, কোন্ দিন খেলবি?

কাল?

না। কাল আমাদের হা-ডু-ডু খেলা আছে। পরশু, ঠিক আছে।

দিন তারিখ সময় ঠিক করে আমরা ফিরে এলাম। মঞ্জুর সাথে অনেকগুলি শর্ত ঠিক করে এসেছি। কোন দল হেরে গেলে তাকে দুয়ো দেয়া যাবে না। ফাউল হয়ে গেলে মারামারি করা যাবে না। রেফারীর কথা শুনতে হবে এই সব।

পরের দিন আমরা খুব প্র্যাকটিস করলাম। যে দিন খেলা সেদিন সকাল সকাল মাঠে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। ওরা আসল দেরি করে। খেলা শুরু করার সময় দেখা গেল একজন খেলোয়াড় কম। ওদের সাথে খেলা দেখতে এসেছিল এমনি একজন লুঙ্গি মালকোচা মেরে খেলতে নেমে গেল।

খেলা শুরু হওয়ার পর দেখা গেল ওরা কিচ্ছু খেলতে পারে না। আধ ঘণ্টার ভিতর ওরা চারটে গোল খেয়ে গেল। আমি গোল পোস্টে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে গেলাম, একটা বলও ওরা কাছে আনতে পারে না। শেষ পর্যন্ত ওরা হার মানল। আবার সবাইকে নিয়ে দল ভাগ করে খেলা হল। মোটকথা প্রথম খেলাটা একটা যাচ্ছেতাই দলের সাথে খেলে জিতে গেলাম।

.

এরপর থেকে রবিন ঠাকুরপাড়ার টীমের সাথে খেলার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কিন্তু আমি রাজি হলাম না। এখন ওদের সাথে খেললেই হেরে যেতে হবে। ওদের সবগুলো খেলোয়াড় বড় বড়, সব ক্লাস নাইন টেনে পড়া ছেলেপেলে। একজন আবার আমাদের স্কুলের টীমে খেলে!

তবে আমরা আমাদের ছোট শহরের সবগুলো টিমের সাথে খেললাম। একটা টিম ড্র করেছে, পরে আর খেলতে রাজি হয়নি, একটা টিম মারামারি করে খেলা ভণ্ডুল করেছে, এ ছাড়া অন্য সব কয়টা খেলায় জিতে গেছি। বলতে কি আমাদের টিমটার বেশ নাম হয়ে গেল। একদিন আমি নিজের কানে শুনেছি দুটো ছেলে বলতে বলতে যাচ্ছে, স্পুটনিক বয়েজ ক্লাব সবচেয়ে ভাল ফুটবল খেলে। ওদের ক্যাপ্টেনের হাত কাটা, সে মাঠের যেখান থেকে ইচ্ছে দাঁড়িয়ে গোল দিতে পারে।

আমাদের ক্লাবটার নাম স্পুটনিক বয়েজ ক্লাব। নামটি দিয়েছে নান্টু। ও আবার এসব খুব ভাল পারে। আমাদের ডিটেকটিভ ক্লাবের নাম প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সি কোঃ, আর গোপন দলের নাম ব্ল্যাক মার্ডার সব কয়টা নাম নান্টু দিয়েছে। খুব গল্পের বই পড়ে তো! যাই হোক, ছেলে দুটোর কথা শুনে আমার ভীষণ গর্ব হয়েছিল। আমি অন্যদেরও বলেছিলাম, শুনে ওরাও খুব বেশি। তবে হাত কাটা ক্যাপ্টেনের প্রশংসার কথাটা আর বলিনি তাহলে রবিন এমন ভাব আরম্ভ করবে যে ওর সাথে আর থাকাই যাবে না। তবে আসলে আমাদের মাঝে সবচেয়ে ভাল খেলে সলিল, রবিন নয়। আমাদের ড্রিল স্যার পর্যন্ত বলেছিলেন সলিল যদি আরেকটু বড় হতো তাহলেই ওকে স্কুলের টীমে নিয়ে নিতেন।

.

একদিন দোকান থেকে আম্মার জন্যে সুতার গুটি কিনে ফিরছি ঠাকুরপাড়ার একটা ছেলে আমাকে ধরল। খুব তাচ্ছিল্য করে বলল, তোদের নাকি কি একটা ফুটবল টিম আছে?

আমি রাগ চেপে বললাম, হুঁ। স্পুটনিক বয়েজ ক্লাব।

ছেলেটা ঠোঁট ওল্টালো, খেলবি নাকি আমাদের সাথে?

এমনি খেলতে পারি– আমি একটু চিন্তা করে বললাম, আসল খেলা পরে হবে।

ছেলেটা হাসি চেপে বলল, ঠিক আছে, এমনি খেলাই হোক!

তাহলে আসিস আমাদের মাঠে। আমি উদাসীন ভাবে বললাম, কাল বিকেলেই আসিস।

উঁহু। তোরাই আমাদের মাঠে আসিস। আমাদের মাঠ অনেক বড়!

না। আমি রাজি হলাম না। বললাম তোদের ছেলেরা বদের হাড়ি। আমরা জিতে গেলে মারপিট করবে।  

আমাদের জিতে যাওয়াটা ওর কাছে এতই অস্বাভাবিক মনে হল যে ছেলেটা খিল খিল করে হাসতে লাগল। বলল, ঠিক আছে আমরাই আসব। মনে থাকে যেন বিকেল পাঁচটায়।

আমি ফিরে এসে সবাইকে বললাম আগামী কাল বিকেলেই ঠাকুরপাড়ার টীমের সাথে খেলা। শুনে সবাই ভারি উত্তেজিত হয় পড়ল। আমি বললাম, এটা কিন্তু সত্যিকারের খেলা না –

তবে?

এমনি খেলা হবে। কাল দেখব ওরা কি রকম খেলে। তারপর পরে আসল কম্পিটিশান হবে।

ওরা সবাই আমার বুদ্ধির প্রশংসা করল। আমরা ঠিক করলাম কাল প্রথমে আমরা খেলতে রাজি হব না। পরে নিমরাজি হয়ে খেলব আর এমন ভাব দেখব যে খুব তাচ্ছিল্য করে খেলছি। একজন করে খেলা বন্ধ করে বসে থাকব, নিজেরাই নিজেদের একটা গোলও দিয়ে দেব। তাহলে হেরে গেলেও গায়ে খুব বেশি লাগবে না। ওরাও খুব বেশি ঠাট্টা করতে পারবে না।

পরদিন খেলার মাঠে ওরা হাজির হল। এমনি খেলা হচ্ছে বলার পরেও ওদের পাড়ার অনেক ছেলে খেলা দেখতে এসেছে। আমরা নিমরাজি ভাব দেখিয়ে উদাসীন ভাবে খেলতে লাগলাম। দেখি ঠাকুরপাড়ার টীমে আমাদের পাড়ার একটা ছেলে খেলতে নেমেছে। হীরা বলল, তুই ঠাকুরপাড়ার টীমে খেলছিস কেন? তুই না আমাদের পাড়ার?

ছেলেটা নাম কাসেম তাচ্ছিল্য ভরে ঠোঁট উল্টে বলল, ইচ্ছে!

আমরা হৈ হৈ করে আপত্তি তুললাম, আমাদের পাড়ার ছেলে অন্য পাড়ার টীমে খেলতে পারবে না।

ওরা বলল, কাসেম, যদি আমাদের টীমে খেলতে রাজি হয় তাহলে ওদের কোন আপত্তি নেই। কিন্তু ওদের দলে ছেলে কম কাজেই এখন সে তাদের টীমেই খেলবে। কাসেম যে ঠাকুরপাড়ার টিম ছাড়া অন্য কোন টীমে খেলবে না সে তো জানা কথা। তার বাসাটাই শুধু এ পাড়ায়, চলাফেরা খাওয়া-দাওয়া বন্ধুত্ব সব ঠাকুরপাড়ার ছেলেদের সাথে।

শেষ পর্যন্ত কাসেমকে ওদের সাথে খেলতে দিতে হল। খেলায় আমরা পরিষ্কার ভাবে হেরে গেলাম। চারটে গোল খেয়েছি, একটি মাত্র দিয়েছি। বহু কষ্ট করে প্রাণপণ খেলেও এর বেশি একটা গোলও দেয়া গেল না। ওরা টিটকারি দিতে দিতে চলে গেলে আমরা খালি গায়ে মাঠে বসে ঘাস ছিঁড়তে লাগলাম।

টিমটা ভালই। রবিন অনেকক্ষণ পর একটা মন্তব্য করল।

কাসেম যদি আমাদের টীমে খেলত! হীরা দুঃখ করে বলল, কিন্তু যা বদমাইশ!

বিশ্বাসঘাতক! সলিল বিড়বিড় করে গালি দিল।

কাসেমকে আমাদের টীমে আনা যায় না? রবিনের প্রশ্ন শুনে আমরা একসাথে চেঁচিয়ে উঠলাম, পাগল হলি তুই?

ঠাকুরপাড়া হচ্ছে তার মক্কা মদীনা!

ঠাকুরপাড়ার ছেলেরা হচ্ছে তার প্রাণের বন্ধু!

তবু চেষ্টা করব। রবিন গম্ভীর স্বরে বলল, তোরা দেখিস ওকে ঠিক আমাদের টীমে নিয়ে আসব, তারপর ঠাকুরপাড়ার সাথে ফাইনাল খেলা দেব।

কিভাবে আনবি?

দেখিস তো! রবিন কি যেন ভাবতে লাগল।

কাসেমকে আমাদের টীমে আনতে পারলে অবিশ্যি আমাদের টিমটা বেশ শক্ত হয়। কিন্তু তবু কি জেতা যাবে? ওদের হাবুল আর আক্কাস আমাদের স্কুলের ফুটবল টীমে খেলে, পায়ের গোছ এই চওড়া!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *