সূৰ্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বই নিয়ে বসার কথা। এটা হচ্ছে বড়চাচার কঠিন নিয়ম। তবে সব নিয়মেরই ফাক আছে। এই নিয়মের বেলাতেও তা সত্যি। মাঝে মাঝে সন্ধ্যাবেলা বড়চাচা রাজনীতি নিয়ে আলাপ করবার জন্যে পাশের উকিল সাহেবের বাড়ি যান। সেই বাড়িতে যাওয়া মানে পাক্কা তিন ঘণ্টার ধাক্কা। ফিরতে ফিরতে রাত নটা। ঐসব দিনগুলিতে সূৰ্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে বই নিয়ে বসার দরকার নেই। কিছুক্ষণ খেলাধূলা করা যায়। আমরা ছোটরা বড়চাচা ছাড়া কাউকে ভয় করি না। আমার ধারণা সব বাড়িতে এরকম এক-আধা জন মানুষ থাকে যাদের সবাই ভয় করে, অন্যদের পাত্তাই দেয় না।
যাই হোক, বড়চাচা বাসায় নেই–উকিল সাহেবের বাসায় গেছেন, আর আমরা নতুন একটা খেলা বেয়া করেছি। এই খেলার নাম–পানি খেলা। সবাই মাগে করে পানি নিয়ে এ ওর গালে ছিটিয়ে দেবার চেষ্টা করছি। খুবই মজার খেলা।
খেলা যখন তুঙ্গে, তখন খবর পেলাম অংক স্যার এসেছেন। সব সময় দেখেছি দারুণ আনন্দের সময়ই খারাপ ব্যাপারগুলি ঘটে। পথিবীটা এরকম কেন কে জানে? নিয়মকানুনগুলি যখন করা হয়, তখন নিশ্চয়ই শিশুদের কথা কেউ ভাবে নি। আমার ধারণা এই পৃথিবীর সব নিয়মকানুনই হচ্ছে শিশুদের কষ্ট দেবার নিয়ম।
আমি একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বাইরে এসে দাঁড়ালাম। অংক স্যার বললেন, কী করছিলি?
আমি অন্য দিকে তাকিয়ে বললাম, পড়ছিলাম স্যার।
অংক স্যার বললেন, ভেরি গুড। বলেই বিকট একটা ঢেকুর তুলে ফ্যাকাশে হয়ে গেলেন। মনে হলো বেশ লজ্জাও পেলেন। ঢেকুর কি ভূতের বাচ্চা গিলে ফেলার কারণে নাকি? হতেও পারে। গতকাল স্যার ক্লাসে আসেন নি। অংক স্যার ক্লাসে না আসাব মানুষ না।
অংক স্যারকে কেমন রোগা রোগ লাগছে। মুখ শুকনো। চোখ লাল। মনে হচ্ছে রাতে ঘুমুতে পাবেন নি। গায়ে চান্দব জড়িয়ে ক্লান্ত ভঙ্গিতে বসে আছেন এবং একটু পরপর ঢেকুর তুলছেন। একেক বার ঢেকুর তোলেন আর হতাশ একটা ভঙ্গি করেন। ফ্যাকাশে হাসি হাসেন এবং দীর্ঘনিঃশ্বাসও ফেলেন।
কেমন আছিস হুমায়ূন।
জি স্যার ভালো। আপনার শরীরটা কি স্যার ভালো না?
উঁহু। গত রাতে ঘুম হয় নি।
কেন স্যার?
স্যার ইতস্তত করে বললেন, না–মানে–ঐ দিন তোর বোতলের ঐ জিনিসটা গিলে ফেললাম, তারপর থেকে–মানে
তারপর থেকে কী স্যার?
না, কিছু না। একটু পরপল ঢেকুর উঠছে। ভূতের সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই। আমি জানি। শারীরিক কোনো অসুবিধা হয়েছে আর কী।
জি স্যার। ওষুধ খান, সেরে যাবে।
খেয়েছি তো। নাকস ভমিকা এক ডোজ খেয়েছি। দুই শ পাওয়ার। কমছে না তো। মনে হচ্ছে, আরো যেন বেড়েছে।
সত্যি নাকি স্যার?
স্যার উত্তর না দিয়ে বড় রকমের একটা ঢেকুর তুললেন। সেই ঢেকুরের সঙ্গে পেটের ভেতরে বিচিত্র শব্দ হতে লাগল–টপ টপাটপ! কুম! গুরু রুরুরুর!! স্যার নিজেই সেই শব্দে বিচলিত। বিচলিত এবং হতভম্ব। তিনি চিকন গলায় বললেন, হুঁমায়ূন, যে লোক তোকে ভূতের বাচ্চা দিয়েছে ওর কাছে আমাকে নিয়ে চল তো।
কেন স্যার?
এমনি। যাই একটু গল্প করে আসি। ভূত-ফুত আমি বিশ্বাস করি না। ভূতের কথা বলে তিনি যে বাচ্চাদের ভয় দেখাচ্ছেন, এটাও ঠিক না। বাসা চিনিস না? আমাকে নিয়ে চল।
মুনিরকেও সাথে নিয়ে যাই স্যার? মুনিরের সঙ্গেই তাঁর ভালো চেনা-জানা।
দুনিয়াসুদ্ধ লোক নিয়ে যাওয়ার কোনো দরকার দেখি না। তুই গেলেই হবে।
অনেকক্ষণ কড়া নাড়ার পর বুড়ো লোকটি দরজা খুললেন। আমাদের দিকে এক পলক তাকিয়েই বললেন, এক মিনিট। এই বলে পাশের ঘরে চলে গেলেন। খুটাখুটি শব্দ শোনা যেতে লাগল। যেন হামানদিস্তায় কিছু পিষছেন।
অংক স্যার ঘাবড়ে গিয়ে বললেন, দেখতে অবিকল রবি ঠাকুরের মতো না?
জি স্যার।
আমি তো চমকেই গিয়েছিলাম।
প্ৰথম দিন আমিও চমকে গিয়েছিলাম স্যার।
খুটাখুটি শব্দ হচ্ছে কীসের রে?
জানি না স্যার। হয়তো ভূতের ভর্তা বানাচ্ছেন।
ভূতের ভর্তা মানে? কী সব ছাগলের মতো কথা বলছিস।
বুড়ো ভদ্রলোক ফিরে এলেন। হাতে গ্লাস ভর্তি লালাভ জিনিস। মুখ-ভর্তি হাসি। তিনি দরাজ গলায় বললেন, গ্লাসে কী আছে অনুমান করতে পারবে? চিরতার পানি। স্বয়ং কবিগুরু খেতেন। আমিও খাই। তোমাদের দুজনকেই তুমি করে বললাম। বয়সে দুজনই আমার চেয়ে ছোট। ছোটটাকে তো চিনি, আমার কাছ থেকে ভূতের বাচ্চা নিয়ে গিয়েছিল। তুমি কে?
স্যার কাঁপা গলায় বললেন, আমি হুমায়ূনের শিক্ষক। অংক স্যার।
বাহ্ খুব ভালো তো। অংক ব্যাপারটা আমারও খুব ভালো লাগে। আচ্ছা তুমি মনে মনে দুই সংখ্যার একটা অংক ভাব। ভেবেছ?
অংক স্যার শুকনো গলায় হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ালেন।
এর সঙ্গে সাত যোগ দাও। দিয়েছ?
জি।
যোগ দেবার পর যা হয় তা তুমি ১১০ থেকে বাদ দাও। দিয়েছ?
জি।
খুব ভালো। এর সঙ্গে পনের যোগ দাও।
দিলাম।
যে সংখ্যা মনে মনে ভেবেছি তাও এর সঙ্গে যোগ কর। করেছ?
জি করেছি।
দুই দিয়ে ভাগ দাও। এর থেকে নয় বাদ দাও। যা থাকল। তাকে তিন দিয়ে গুণ দাও। দিয়েছ?
জি।
তোমার উত্তর হলো গিয়ে ১৫০। কি, হয়েছে?
জি, হয়েছে। আশ্চর্য তো!
অংক স্যার হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলেন। বুড়ো ভদ্রলোক বললেন, এইসব মজার মজার অংক করে ছাত্রদের কৌতূহল জাগিয়ে তুলতে হয়। তা না, কঠিন কঠিন সব অংক দিয়ে তোমরা ছাত্রদের ভয় পাইয়ে দাও। অংক একটা মজার জিনিস, তোমরা সেই মজাটাই ছাত্রদের দিতে পার না। খুব খারাপ। এখন বলে আমার কাছে কী চাও?
অংক স্যার বললেন, কিছু চাই না জনাব।
বুড়ো খুব রেগে গেলেন। থমথমে গলায় বললেন, কিছু চাই না মানে? শুধু শুধু আমার সময় নষ্ট করতে এসেছ। আর একটু পরপর এমন বিশ্ৰী ঢেকুর তুলছ কেন? কী হয়েছে?
অংক স্যারের মুখটা কেমন কালো হয়ে গেল। আমার দিকে একবার করুণ চোখে তাকিয়ে মাথা চুলকাতে লাগলেন।
আমি বললাম, আপনি যে আমাকে ভূতের বাচ্চাটা দিয়েছিলেন, অংক স্যার সেটা গিলে ফেলেছেন। তারপর থেকে শুধু ঢেকুর উঠছে। স্যারের বড় কষ্ট।
বুড়ো অবাক হয়ে বললেন, ভূতের বাচ্চ গিললে কেন! ভূত কি কোনো খাদ্যদ্রব্য? বলো এটা কি কোনো মজাদার কিছু?
স্যার আমতা আমতা করছেন। জবাব দিচ্ছেন না।
কী, চুপ করে আছ কেন? জবাব দাও। কেন ভূতের বাচ্চা গিললে?
ভূত বলে যে কিছু নেই এটা ছাত্রদের বোঝাবার জন্যে।
কিছু যদি না থাকে তাহলে তোমার পেটে যে জিনিসটা গজগজ করছে সেটা কী? বলো কী সেটা?
না, মানে অসুখ-বিসুখ কিছু হয়েছে বোধহয়।
অসুখ-বিসুখ কিছু না। ভূতের বাচ্চা হজম হচ্ছে না। দাঁড়াও, দেখি কী করা যায়। নাকোব ফুটো দিয়ে বের করে দিচ্ছি। সময় লাগবে। চট করে হবে না। পঞ্চাশটা বৈঠক দিতে হবে। তিন সেরা গরম পানি খেতে হবে। মুরগির পালক দিয়ে নাকে সুড়সুড়ি দিতে হবে। তখন খুব হাঁচতে থাকবে। সেই হাঁচির সঙ্গে ভূত বেরিয়ে আসবে। অনেক যন্ত্রণা।
আমরা দুজন বাসায় ফিরে চলেছি। বুড়ো ভগদলোক ভূতের বাচ্চাটা বের করে আবার বোতলে ভরে আমাকে দিয়েছেন। অংক স্যারের ঢেকুর তোলা বন্ধ হয়েছে। তবে তিনি খুব গম্ভীর। একবার শুধু বললেন, ব্যাপারটা কিছু বুঝতে পারছি না।
আমি বললাম, তাহলে কি স্যার ভূত আছে?
আরে না, ভূত আবার কী? ঐ বুড়ো আমাদের বোকা বানিয়েছে। ব্যাটা মনে হচ্ছে বিরাট ফাজিল।
কিন্তু স্যার আপনার ঢেকুর তো বন্ধ হয়েছে।
স্যার কিছু বললেন না। তাঁকে খুব চিন্তিত মনে হলো। যেন কিছুতেই হিসাব মেলাতে পারছেন না।