০৩. সুরমা ঘরের জানালার সামনে

.

সুরমা ঘরের জানালার সামনে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন, আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলেন অতীত-কথা। সুমতির কথা। আশ্চর্য সুমতি। যত মধু তত কটু। যত কোমল তত উগ্ৰ তীব্ৰ। যত অমৃত তত বিষ। অমৃত তার ভাগ্যে জোটে নি, সে পেয়েছিল বিষ। সে বিষ আগুন হয়ে জ্বলেছিল। সুমতির পুড়ে মরার কথা মনে পড়লেই সুরমার মনে হয়, হতভাগিনীর নিজের হাতে জ্বালানো সন্দেহের আগুনে সে নিজেই পুড়ে মরেছে। ওটা যেন তার জীবনের বিচিত্র অমোঘ পরিণাম। প্রথম দিন থেকেই সুমতি তাকে সন্দেহ করেছিল। কৌতুক অনুভব করেছিল সুরমা। ভেবেছিল জ্ঞানেন্দ্রনাথকে সে ভালবেসেছে বা ভালবাসবেই। ভালবাসা হয়ত অন্ধ। ভালবাসায়, কাকে ভালবাসছি, কেন ভালবাসছি, এ প্রশ্নই জাগে না। তবু ইউরোপে-শিক্ষিত জজসাহেব বাপের মেয়ে সে; আবাল্য সেই শিক্ষায় শিক্ষিত, বি-এ পড়ছে তখন, তার এটুকু বোধ ছিল যে, বিবাহিত, গোঁড়া হিন্দুঘরের ছেলে, পদবিতে মুনসেফের প্রেমে পড়ার চেয়ে হাস্যকর নির্বুদ্ধিতা অন্তত তার পক্ষে আর কিছু হতে পারে না। মনে মনে আজও রাগ হয়, সুমতির মত হিন্দুঘরের অর্ধশিক্ষিত মেয়েরা ভাবে যে, তাদের অর্থাৎ বিলেত-ফেরত সমাজের মেয়েদের সতীত্বের বালাই নেই, তারা স্বাধীনভাবে প্রেমের খেলা খেলে বেড়ায় প্রজাপতির মত। জ্ঞানেন্দ্রনাথ শুধু সুমতির বর বলেই সে তার সঙ্গে হাস্যকৌতুকের সঙ্গে কথা বলেছিল। জ্ঞানেন্দ্রনাথ সুপুরুষ, বিদ্বান, কিন্তু তার দিকে সপ্ৰেম দৃষ্টিপাতের কথা তার মনের মধ্যে স্বপ্নেও জাগে নি। সুমতির বর, লোকটি ভাল, বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করতে চেয়েছিল। সুমতি হতভাগিনীই অপবাদ দিয়ে তার জেদ জাগিয়ে দিলে; সেই জেদের বশে সমে দৃষ্টির অভিনয় করতে গিয়ে জড়িয়ে পড়ল সে। সুমতি সুরমাকে যেন ঠেলে নিয়ে গিয়ে জ্ঞানেন্দ্রনাথের গায়ের উপর ফেলে দিলে।

সুমতির সন্দেহ এবং ঈর্ষা দেখে সে জ্ঞানেন্দ্রনাথকে নিয়ে খেলা খেলতে গিয়েছিল; সুমতিকে দেখিয়ে সে জ্ঞানবাবুর সঙ্গে একটু অন্তরঙ্গভাবে মেলামেশার অভিনয় করতে গিয়েছিল। সুমতি আরও জ্বলেছিল। বেচারা থার্ড মুনসেফ একদিকে হয়েছিল বিহ্বল অন্যদিকে হয়েছিল নিদারুণভাবে বিব্রত। সুরমার কৌতুকোচ্ছলতার আর অবধি ছিল না; তারুণ্যের উল্লাস প্রশ্রয় পেয়ে বন্য হয়ে উঠেছিল। প্রশ্রয়টা এই আত্মীয়তার। ছুটির পর কলকাতায় ফিরে গিয়ে সে কবিতার চিঠি লিখেছিল জ্ঞানবাবুকে। ইচ্ছে করেই লিখেছিল। সুমতিকে জ্বালাবার জন্য। তার বাবাই শুধু সুমতিকে ভালবাসতেন না, সেও তাকে ভালবেসেছিল। অনুগ্রহের সঙ্গে স্নেহ মিশিয়ে। যে বস্তু, সে-বস্তুর দাতা হওয়ার মত তৃপ্তি আর কিছুতে নেই। পরম স্নেহের ছোট শিশুকে। রাগিয়ে যেমন ভাল লাগে তেমনি ভাল লাগত সুমতিকে জ্বালাতন করতে। বছর দেড়েকের বড়ই ছিল সুমতি, কিন্তু মনের গঠনে বুদ্ধিতে আচরণে সুরমাই ছিল বড়। তার সঙ্গে এই ভ্যাবাকান্ত হিন্দু জামাইবাবুটিকে বিদ্রুপ করে সে এক অনাদিত কৌতুকের আনন্দ অনুভব করত। প্রথম কবিতা তার আজও মনে আছে। সুমতির পত্রেই লিখেছিল—জামাইবাবুকে বলিস–

সুমতি তোমার পত্নী, দুৰ্ম্মতি শ্যালিকা
টোবাকো পাইপ আমি, সুমতি কলিকা
পবিত্র হ্রকোর, তাহে নাই নিকোটিন।
সুমতি গরদ ধুতি, আমি টাই-পিন।
পিনের স্বধর্ম ঘেঁচা, নিকোটিনে কাশি;
ধন্যবাদ, সহিয়াছ মুখে মেখে হাসি।

উত্তরে সুমতির পত্রের নিচে দু ছত্ৰ কবিতাই এসেছিল।

ধন্যবাদে কাজ নাই অন্যবাদে সাধ
অর্থাৎ মার্জনা দেবী, হলে অপরাধ।

সুরমা কবিতা দু লাইন পড়ে ভ্রূ কুঞ্চিত করেছিল, ঠোঁটে বিচিত্ৰ হাসি ফুটে উঠেছিল তার। মনে মনে বলেছিল! গবুচন্দ্ৰটি তো বেশ! ধার আছে! মিছরির তাল নয়, মিছরির ছুরি!

এর পরই হঠাৎ অঘটন ঘটে গিয়েছিল। পর পর দুটি। একখানা বিখ্যাত ইংরেজি কাগজে একটা প্রবন্ধ বের হয়েছিল—একটি অহিংস সিংহ ও তার শাবকগণ। গান্ধীজীকে আক্রমণ করে প্রবন্ধ। লেখক বলেছিলেন, একটি সিংহ হয়ত অভ্যাসে ও সাধনায় অহিংস হতে পারে, কিন্তু তাই। বলে কি ধরে নেওয়া যায় যে, তার শাবকেরাও তাদের স্বভাবধর্ম হিংসা না নিয়ে জন্মগ্রহণ করবে, বা রক্তের প্রতি তাদের অরুচি জন্মাবে? প্রবন্ধের ভাষা যেমন জোরালো, যুক্তি তেমনি ক্ষুরধার। বুদ্ধের কাল থেকে এ-পর্যন্ত ইতিহাসের নজির তুলে এই কথাই বলেছেন লেখক, অহিংসার সাধনা অন্যান্য ধর্মের সাধনার মত ব্যক্তিগত জীবনেই সফল হতে পারে। রাষ্ট্রে এই বাদকে প্রয়োগ করার মত অযৌক্তিক আর কিছু হয় না। এমনকি, সম্প্রদায়গতভাবেও এ-বাদ সফল হয় নি, হতে পারে না। প্রবন্ধটি কয়েকদিনের জন্য চারিদিকে, বিশেষ করে শিক্ষিত সমাজে, বেশ একটা শোরগোল তুলেছিল। সুরমা পড়েছিল সে প্ৰবন্ধ। লেকের বক্তব্য তার খারাপ লাগে নি। সেকালে সরকারি চাকুরে বিশেষ করে বড় চাকুরে যারা এবং অচাকুরে, অতিমাত্রায় ইউরোপীয় সভ্যতা-ঘেঁষা সমাজে একদল লোক মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন যে, গান্ধীজীর এই অহিংসা নিতান্তই অবাস্তব এবং সেই হেতু ব্যর্থ হতে বাধ্য। শুধু তাই নয়, অত্যাধুনিক ইউরোপীয় মতবাদ ও সভ্যতাবিরোধী এই গান্ধীবাদী আন্দোলনকে অনেকখানি। তাঁদের বিরুদ্ধে পরিচালিত বলে মনে করতেন। সমাজে আসরে মজলিসে এ-সম্পর্কে অনেক আলোচনা হত। তাদের সকলেরই ধারণা ছিল যে, অহিংসার এই মতবাদ—এটা নিতান্তই বাইরের খোলসমাত্র। সিংহচর্মাবৃত গর্দভ নয়, গর্দভচর্মাবৃত সিংহ। সুরমার বাবা অরবিন্দুবাবু ভিন্ন মতের মানুষ ছিলেন। গান্ধীজীর প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ছিল অসাধারণ। কিন্তু তবুও জজসাহেব হিসেবে তিনি এবং তার সঙ্গে স্ত্ৰীকন্যা বাধ্য হয়েই বিরোধী শিবিরের মানুষ বলে লোকের দ্বারাও গণ্য হতেন এবং নিজেরাও নিজেদের অজ্ঞাতসারেই বোধ করি তাই বলে গণ্য করতেন। সেই কারণেই প্রবন্ধটির বিষয়বস্তু ভাল লেগেছিল। লেখার ঢঙটিও অতি ধারালো, বাঁকানো। দিনকয়েক পরে তার বাবা তাকে লিখলেন—এ প্রবন্ধ জ্ঞানেন্দ্র লিখেছে। আমাকে অবশ্য দেখিয়েছিল। ভাল লিখেছে, পড়ে দেখিস।

সুরমার বিস্ময়ের আর অবধি ছিল না। এ লেখা সুমতির মুখচোরা কার্তিকের কলম থেকে বেরিয়েছে। ঠিক যেন ভাল লাগে নি! মনে হয়েছিল সে যেন ঠকে গেছে, জ্ঞানেন্দ্রনাথই তাকে। ভালমানুষ সেজে ঠকিয়েছে।

এর কিছুদিন পরেই আর এক বিস্ময়। হঠাৎ সেদিন কলেজ-হস্টেলে নতুন একখানা টেনিস র‍্যাকেট হাতে দেখা করতে এলেন সুমতির পতি! টেনিস র‍্যাকেট! হাসি পেয়েছিল সুরমার। উচ্চপদের দণ্ড। পাড়াগাঁয়ের ছেলে, অনেক বিনিদ্র রাত্রি অধ্যয়ন করে পরীক্ষায় ভাল ফল করে একটি বড় চাকরি পেয়েছে, তারই দায়ে অফিসিয়ালদের ক্লাবে চাঁদা তো গুনতেই হচ্ছে, এর ওপর এতগুলি টাকা খরচ করে টেনিস র‍্যাকেট! বেচারাকে একদা হয়ত পা পিছলে পড়ে ঠ্যাঙখানি ভাঙতে হবে। হেসে সে বলেছিল—খেলতে জানেন, না হাতেখড়ি নেবেন?

জ্ঞানেন্দ্রবাবু বলেছিলেন শেখাবেন?

—শেখালেই কি সব জিনিস সব মানুষের হয়? নিজের ভরসা আছে?

–তা আছে। ছেলেবেলায় ভাল গুলি-ডাণ্ডা খেলতাম।

খিলখিল করে হেসে উঠেছিল সুরমা। তারপর বলেছিল—পারি নে তা নয়। কিন্তু গুরুদক্ষিণা কী দেবেন?

—বলুন কী দিতে হবে? বুঝে দেখি।

–আপনার ওই কার্তিকী ঢঙের গোঁফজোড়াটি কামিয়ে ফেলতে হবে।

হেসে জ্ঞানেন্দ্রনাথ বলেছিলেন বিপদে ফেললেন। কারণ এই গোঁফজোড়াটি সুমতির বড় প্রিয়। ওর একটা পোষা বেড়াল ছিল, সেটা মরে গিয়েছে। তার দুঃখ সুমতি এই গোঁফজোড়াটি দেখেই ভুলেছে।

সুরমা বক্ৰহেসে বলেছিল—তা হলে ও দুটি কামাতেই হবে। আমি বরং সুমতিকে একটা ভাল কাবলী বেড়াল উপহার দেব।

এরপরই হঠাৎ কথার মোড়টা ঘুরে গিয়েছিল। পাশেই টেবিলের উপর পুরনো খবরের কাগজের মধ্যে লালনীল পেন্সিলে দাগমারা সেই কাগজখানা ছিল, সেটাই নজরে পড়েছিল জ্ঞানেন্দ্রনাথের। তিনি কৌতুকে কাগজখানা টেনে নিয়েছিলেন এবং পাশে লেখা নানান ধরনের মন্তব্যের উপর চোখ বুলিয়ে হেসে বলেছিলেনওরে বাপ রে। লোকটা নিশ্চয় বাসায় মরেছে।

উঃ, কী সব কঠিন মন্তব্য!

সুরমা মুহূর্তে আক্রমণ করেছিল জ্ঞানেন্দ্রনাথকে। কেন, তা বলতে পারে না। কারণ মন্তব্যগুলির একটিও তার লেখা ছিল না, এবং জজসাহেবের মেয়ে এই মতবাদের ঠিক বিরুদ্ধ মতবাদও পোষণ করত না। তাই আজও সে ভেবে পায় না কেন সে সেদিন এমন তীব্রতাবে আক্রমণ করেছিল তাকে। বলেছিল—বাসায় তিনি মরেন নি, আমার সামনে তিনি বসে আছেন। সে আমি জানি। ছদ্মনামের আড়ালে বসে আছেন। এই বলেই শুরু করেছিল আক্রমণ। তারপর সে অবিশ্ৰান্ত শবর্ষণ। জ্ঞানেন্দ্ৰনাথ শুধু মুচকি হেসেছিলেন। শরগুলি যেন কোনো অদৃশ্য বর্মে আহত হয়ে ধার হারিয়ে নিরীহ শরের কাঠির মতই ধুলোয় লুটিয়ে পড়েছিল। সুরমা ক্লান্ত হলে জ্ঞানেন্দ্রনাথ বলেছিলেন–মিষ্টিমুখের গাল খেয়ে ভারি ভাল লাগল।

সুরমা দপ্‌ করে জ্বলে উঠেছিল, বলেছিল—ডাকব অন্য মিষ্টিমুখীদের? বলব ডেকে যে, এই দেখ সেই কুখ্যাত প্রবন্ধের লেখক কে? দেখবেন?

জ্ঞানেন্দ্রনাথের চোখ দুটোও দপ্ কর জ্বলে উঠেছিল। সুরমার চোখ এড়ায় নি। সে বিস্মিত হয়েছিল। গোবরগণেশ হলেও তার হাতে কলম দেখলে বিস্ময় জাগে না, শখের বাবু কার্তিকের হাতে খেলার তীর-ধনুকও বেখাপ্পা লাগে না, কিন্তু ললাটবহ্নি চোখের কোণে আগুন হয়ে জ্বলল কী করে? কিন্তু পরমুহূর্তেই জ্ঞানেন্দ্রনাথ সেই নিরীহ গোপাল-জ্ঞানেন্দ্রনাথ হয়ে গিয়েছিলেন।

পরমুহূর্তেই হেসে জ্ঞানেন্দ্রনাথ বলেছিলেনদেখতে রাজি আছি। কিন্তু আজ নয়, কাল। সুমতিকে তা হলে টেলিগ্রাম করে আনাই। আমার পক্ষে উকিল হয়ে সে-ই লড়বে। কারণ মেয়েদের গালিগালাজের জবাব এবং অযৌক্তিক যুক্তির উত্তরে এই ধরনের জবাব দেওয়া আমার পক্ষে তো সম্ভবপর নয়।

কতকগুলি মেয়ে এসে পড়ায় আলোচনাটা বন্ধ হয়েছিল।

তারপরই দ্বিতীয় ঘটনা। টেনিস র‍্যাকেট নিয়েই ঘটল ঘটনাটা।

 

খ.

পুজো ছিল সেবার কার্তিক মাসে। পুজোর ছুটিতে বাবা সেবার দিন-পনের দার্জিলিঙে কাটিয়েই কর্মস্থলে ফিরে এলেন। সাঁওতাল পরগনার কাছাকাছি কর্মস্থলের সেই শহরটি শরৎকাল থেকে কয়েকমাস মনোরম হয়ে ওঠে। ফিরেই সুরমা শুনেছিল, সুমতিরা পুজোর ছুটিতে সেবার দেশে যায় নি, এখানেই আছে, সুমতিরই অসুখ করেছিল। সুমতি তখন পথ্য পেয়েছে, কিন্তু দুর্বল। চ্যাটার্জিসাহেব পুজোর তত্ত্ব, কাপড়চোপড়, মিষ্টি নিয়ে নিজে গিয়েছিলেন ওদের বাড়ি, সঙ্গে সুরমাও গিয়েছিল। আসবার সময় সুরমা জ্ঞানেন্দ্রনাথকে বলে এসেছিল,বিকেলে যাবেন। আজ টেনিসে হাতেখড়ি দিয়ে দেব।

চ্যাটার্জিসাহেব নিজে ভাল খেলতেন। এককালে স্ত্রীকেও শিখিয়েছিলেন। সুরমা ছেলেবেলা থেকে খেলে খেলায় নাম করেছিল। সেদিন চ্যাটার্জিসাহেব খেলতে আসেন নি। সুরমা জ্ঞানেন্দ্রনাথকে নিয়ে একা একা খেলতে নেমে নিজে প্রথম সার্ভ করে, করে বলটার ফেরত-মার দেখে চমকে উঠেছিল। সে-বল সে আর ফিরিয়ে মারতে পারে নি। জ্ঞানেন্দ্রর মার যে পাকা খেলোয়াড়ের মার। সুরমা হেরে গিয়েছিল।

খেলার শেষে সে বলেছিল—আপনি অত্যন্ত শ্ৰুড লোক। তার চেয়ে বেশি কপট লোক আপনি। ডেঞ্জারাস ম্যান!

–কেন? কী করলাম?

–থাকেন যেন কত নিরীহ লোক, ভাজা মাছটি উলটে খেতে জানেন না, অথচ–।

জ্ঞানেন্দ্রনাথ হেসে বলেছিলেন—তা হলে গোঁফজোড়াটা থাকল আমার?

ওই খেলার ফাঁকেই কোথা দিয়ে কী হয়ে গেল। জ্ঞানেন্দ্রনাথের প্রতি আকৃষ্ট হল সে। সুমতি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল তার ওপর। গ্রাহ্য করে নি সুরমা। বরং ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছিল ওর ওপর। চরম হয়ে গেল ওখানকার টেনিস কম্পিটিশনের সময়। বড়দিনের সময় সুরমা গিয়ে কম্পিটিশনে যোগ দিলে, পার্টনার নিলে জ্ঞানেন্দ্রকে। ফাইন্যালের দিন খেলা জিতে দুজনে ফটো তুলতে গিয়েছিল। ফটো তুলবার আগে জ্ঞানেন্দ্র বলেছিলেন, তোমার সঙ্গে ফটো তুলব, গোঁফটা কামাব না।

ওই খেলার অবসরেই আপনি ঘুচে পরস্পরের কাছে তারা তখন তুমি হয়ে গেছে।

সুরমা হেসে উঠেছিল। এবং সে-দিন জ্ঞানেন্দ্র যখন তাদের কুঠি থেকে বিদায় নেন তখন। নিজের একগোছা চুল কেটে একটি খামে পুরে তাঁর হাতে দিয়ে বলেছিল—আমি দিলাম, আমার দক্ষিণা! কিন্তু আর না। আর আমিও তোমার সঙ্গে দেখা করব না, তুমিও কোরো না। সুমতি সহ্য করতে পারছে না। আজ আমাকে সে স্পষ্ট বলেছে, তুই আমার সর্বনাশ করলি।

অনেককাল পর আজ সুরমা উঠে এসে দাঁড়ালেন টেনিস ফাইন্যালের পর তোলানো সেই ফটোখানার সামনে। পরস্পরের দিকে তাকিয়ে আছে তারা। ফোকাসের সময় তারা ক্যামেরার দিকেই তাকিয়ে ছিল, কিন্তু ঠিক ছবি নেবার সময়টিতেই নিজেদের অজ্ঞাতসারে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলেছিল। জ্ঞানেন্দ্রনাথের কপিখানা নেই, সেখানা সুমতি—। এই ঘটনার স্মৃতি মাথার মধ্যে আগুন জ্বেলে দেয়।

ঈর্ষাতুরা সুমতি! আশ্চর্য কঠিন ক্রূর ঈর্ষা। পরলোক, প্রেতবাদ, এ-সবে সুরমা বিশ্বাস করে। না, কিন্তু এ-বিশ্বাস তার হয়েছে, মানুষের প্রকৃতির বিষই হোক আর অমৃতই হোক, যেটাই তার স্বভাব-ধৰ্ম—সেটা তার দেহের মৃত্যুতেও মরে না, যায় না; সেটা থাকে, ক্রিয়া করে যায়। সুমতির ঈর্ষা আজও ক্রিয়া করে চলেছে; জীবনের আনন্দের মুহূর্তে অকস্মাৎ ব্যাধির আক্রমণের মত আক্রমণ করে, মধ্যে মধ্যে সেই আক্রমণের থেকে নিষ্কৃতি বোধ করি এজন্মে আর হল না। কিন্তু আজ যেন এ-আক্ৰমণ অতি তীব্র, হঠাৎ ওই আগুনটা জ্বলে ওঠার মতই জ্বলে উঠেছে। খড়ের আগুনটা নিভেছে, এটা নিভল না।

 

গ.

তাঁর কাঁধের উপর একখানা ভারী হাত এসে স্থাপিত হল। গাঢ় স্নেহের আভাস তার মধ্যে, কিন্তু হাতখানা অত্যন্ত ঠাণ্ডা। স্বামী রবারের চটি পরে শতরঞ্জির উপর দিয়ে এসেছেন; চিন্তামগ্নতার মধ্যে মৃদু শব্দ যেটুকু উঠেছে তা সুরমার কানে যায় নি।

-অকারণ নিজেকে পীড়িত কোরো না। ধীর মৃদু স্বরে বললেন– জ্ঞানেন্দ্রনাথপরের দুঃখের জন্যে যে কাঁদতে পারে, সে মহৎ; কিন্তু অকারণ অপরাধের দায়ে নিজেকে দায়ী করে পীড়ন করার নাম দুর্বলতা। দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দিয়ো না। এস।

ঘুরে তাকালেন সুরমা, স্বামীর মুখের দিকে তাকাবামাত্র চোখ দুটি ফেটে মুহূর্তে জলে ভরে টলমল করে উঠল।

জ্ঞানেন্দ্রবাবু তাকে মৃদু আকর্ষণে কাছে টেনে এনে কাঁধের উপর হাতখানি রেখে অনুচ্চ গাঢ় গম্ভীর স্বরে বললেন– আমি বলছি, তোমার কোনো অপরাধ নেই, আমারও নেই। না। অপরাধ সমস্ত তার! হা তার! উই ডিড নাথিং ইমমরাল, নাথিং ইললিগ্যাল। তোমার সঙ্গে বন্ধুত্বের অধিকার আমার ছিল। সেই অধিকারের সীমানা কোনোদিন অন্যায়ভাবে অতিক্রম আমরা করি নি। বিবাহের দায়ে অপর কোনো নারীর সঙ্গে পুরুষের বা কোনো পুরুষের সঙ্গে বিবাহিতা নারীর বন্ধুত্বের বা প্রীতিভাজনতার অধিকার খর্ব হয় না। আমারও হয় নি, তোমারও হয় নি।

সুরমার চোখ থেকে জলের ফোঁটা কটি ঝরে পড়ল; পড়ল জ্ঞানেন্দ্রনাথের বাঁ হাতের উপর। বাঁ হাত দিয়ে তিনি সুরমার একখানি হাত ধরেছিলেন সেই মুহূর্তটিতে। জ্ঞানেন্দ্রনাথ বললেন–তুমি কাঁদছ? না, কেঁদো না। আমাকে তুমি বিশ্বাস কর। আমি অনেক ভেবেছি। সমস্ত ন্যায় এবং নীতিশাস্ত্রকে আমি চিরে চিরে দেখে বিচার করেছি। আমি বলছি অন্যায় নয়। অন্যায় হয় নি। শুধু বন্ধুত্ব কেন সুরমা, প্রেম, সেও বিবাহের কাটা খালের মধ্যে বয় না। বিবাহ হলেই প্রেম হয়। না সুরমা। বিবাহের দায়িত্ব শুধু কর্তব্যের, শপথ পালনের। সুমতিকে বিবাহ করেও তোমাকে আমি যে-নিয়মে ভালবেসেছিলাম সে-নিয়ম অমোঘ, সে-নিয়ম প্রকৃতির অতি বিচিত্ৰ নিয়ম, তার উপর কোনো ন্যায় বা নীতিশাস্ত্রের অধিকার নেই। যে-অধিকার আছে সে-অধিকার আমি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলাম। প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে এসেছিল ভালবাসা, তাকে আমি সংযমের বাধে বেধেছিলাম। প্রকাশ করি নি। তোমার কাছে না, সুমতির কাছে না, কারও কাছে না। আর তোমার কথা? তোমার বিচার আরও অনেক সোজা। তুমি ছিলে কুমারী। অন্যের কাছে। তোমার দেহমনের বিন্দুমাত্র বাধা ছিল না। শুধু সুমতির স্বামী বলে আমাকে তোমার ছিনিয়ে নেবারই অধিকার ছিল না, কিন্তু ভালবাসার অবাধ অধিকার লক্ষ বার ছিল তোমার। সুরমা, আজও স্থির বিশ্বাসে ভগবান মানি নে, নইলে বলতাম ভগবানেরও ছিল না। কোনো অপরাধ নেই আমাদের। বিচারালয়েই বল বা যে কোনো দেশের মানুষের বিচারালয়েই বল, সেখানে সিদ্ধান্ত নির্দোষ। জড়িমাশূন্য পরিষ্কার কণ্ঠের দৃঢ় উচ্চারিত সিদ্ধান্ত! দুর্বলতাই একমাত্র অপরাধ, যার জন্য প্রাণ অভিশাপ দেয় আত্মাকে।

স্থিরদৃষ্টিতে অভিভূতের মত সুরমা স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে কথাগুলি শুনছিলেন। জ্ঞানেন্দ্রনাথের দৃষ্টি স্থির। তিনি তাকিয়ে ছিলেন একটু মুখ তুলে ঘরখানার কোণের ছাদের। অংশের দিকে, ওইখানে ওই আবছায়ার মধ্যে দেওয়ালের গায়ে কোন মহাশাস্ত্রের একটি পাতা ফুটে উঠেছে, এবং তিনি তাই পড়ে যাচ্ছেন ধীরে ধীরে, দৃঢ়কণ্ঠে।

–চল, বাইর চল, বেড়াতে যাব।

সুরমা এটা জানতেন। এইবার তিনি বাইরে যেতে বলবেন। যাবেন। অনেকটা দূরে ঘুরে আসবেন। আগে সারা রাত ঘুরেছেন, ক্লাবে গিয়েছেন, মদ্যপান করেছেন। রাত্রে আলো জ্বলে টেনিস খেলেছেন দুজনে। এখন এমনভাবে সুমতিকে মনে পড়ে কম। এবার বোধহয় দু বছর পরে এমনভাবে মনে পড়ল। সোজা পথে তো সুমতিকে তারা আসতে দেন না। কথার পথ ধরে সুমতি তাদের সামনে এসে দাঁড়াতে চেষ্টা করলেই কথার পথের মোড় ঘুরিয়ে দেন তারা। অন্য কথায় গিয়ে পড়েন। আর সুমতি দীর্ঘদিন পরে ঘুরপথ ধরে সামনে এসেছে। বাথরুমের জানালা দিয়ে ওই আগুনের ছটার সঙ্গে মিশে অশরীরিণী সে ঈর্ষাতুরা এসে দুজনের মাঝখানে দাঁড়িয়েছে।

 

ঘ.

গাড়ি চলল। শ্ৰাবণ-রাত্রিতে আবার মেঘ ঘন হয়ে উঠেছে। প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার নতুন অ্যাসফন্টের সমতল সরল পথ। শহর পার হয়ে, নদীটার উপর নতুন ব্যারেজের সঙ্গে তৈরি ব্রিজ পার হয়ে শাল-জঙ্গলের ভিতর দিয়ে চলে গেছে নতুন-তৈরি পথ। দুপাশে শালবনে বর্ষার বাতাসে মাতামাতি চলেছে। নতুন পাতায় পাতায় বৃষ্টিধারার আঘাতে ঝরঝর একটানা শব্দ চলেছে। মধ্যেমাঝে এক-এক জায়গায় পথের পাশে পাশে কেয়ার ঝাড়। সেখানে কেয়া ফুল ফুটেছে, গন্ধ আসছে। ভিজে অ্যাসফন্টের রাস্তার বুকে হেডলাইটের তীব্র আলোর প্রতিচ্ছটা পড়েছে; পথের বাঁকে হেডলাইটের আলো জঙ্গলের শালগাছের গায়ে গিয়ে পড়েছে; অদ্ভূত লাগছে।

গাড়ি চলেছে। এক সময় যেন প্রকৃতির রূপ বদলাল অন্ধকার যেন গাঢ়তর হয়ে উঠল। চারিপাশে আকাশ থেকে ঘন কালো মেঘপুঞ্জ পুঞ্জ হয়ে মাটিতে নেমেছে মনে হচ্ছে। মেঘ নয়, ওগুলি পাহাড়, আরণ্যভূম এবং পার্বত্যভূম এক হয়ে গেল এখান থেকে। অ্যাসফন্টের রাস্তা এইবার সর্পিল গতি নিচ্ছে, সত্যই সাপের মত এঁকেবেঁকে চলেছে। দূরে কোথাও প্রবল একটাগ ঝরঝর শব্দ উঠেছে, একটানা শব্দ; দিমণ্ডল-ব্যাপ্ত করা প্রচণ্ড উল্লাসের একটা বাজনা যেন। কোথাও বেজে চলেছে; বাজনা নয়,পাহাড় থেকে ঝরনা ঝরেছে। গাড়ির মধ্যে স্বামী-স্ত্রী দুজনে স্তব্ধ হয়ে বসে আছেন, ঘোষাল সাহেব তার হাতের মধ্যে সুরমার একখানি হাত নিয়ে বসে আছেন। মধ্যে মধ্যে দু-চারটি কথা। কাটাকাটা, পারম্পর্যহীন।

—এটা সেই বনটা নয়? যেখানে গলগলে ফুলের গাছ দেখেছিলাম?

–এই তো বাঁ পাশে; পেরিয়ে এলাম।

তারপর আবার দুজনে স্তব্ধ। গলগলে ফুলের সোনার মত রঙ। ফুল তুলে সুরমাকে দিয়েছিলেন; সুরমা একটি ফুল খোপায় পরেছিল। ঘোষাল সাহেবের হাতের মুঠো ক্রমশ দৃঢ় হয়ে উঠেছিল; অন্তরে আবেগ গাঢ় হয়ে উঠেছে। সুরমা একটি অস্ফুট কাতর শব্দ করে উঠলেন। উঃ!

–কী হল? সবিস্ময়ে প্রশ্ন করলেন স্বামী।

মৃদুস্বরে সুরমা শুধু বললেন–আংটি।

–লেগেছে? বলেই হেসে ঘোষাল সাহেব হাত ছেড়ে দিলেন। আঙুলের আংটির জন্যে হাতের চাপ বড় লাগে।

–না। অন্ধকারের মধ্যেই অল্প একটু মুখ ফিরিয়ে স্বামীর দিকে চেয়ে স্বামীর হাতখানি নিজের হাতের মধ্যে টেনে নিলেন। না, ছেড়ে দিতে তিনি চান না।

আবার স্তব্ধ দুজনে। মনের যে গুমট অন্ধকার কেটে যাচ্ছে তাই যেন বাইরে ছড়িয়ে পড়ছে। মুহূৰ্তে মুহূর্তে; তারা প্রশান্ত ক্লান্তিতে আচ্ছন্ন হয়ে তার চেয়ে চেয়ে দেখছেন। অকস্মাৎ দূরের একটানা বাজনার মত ঝরনার সেই ঝরঝর শব্দটা প্রবল উল্লাসে বেজে উঠল। যেন একটা পাঁচিল সরে গেল, একটা বদ্ধ সিংহদ্বার খুলে গেল। একটা চড়াই অতিক্রম করে ঢালের মুখে বাঁক ফিরতেই শব্দটা শতধারায় বেজে উঠেছে। চমকে উঠলেন সুরমা।

–কিসের শব্দ?

—ঝরনার। বর্ষার জলের ঢল্‌ নেমেছে। নিঝরের স্বপ্নভঙ্গ। স্বরাতুর হাসি ফুটে উঠল ঘোষাল সাহেবের মুখে। সুরমা উৎসুক হয়ে জানালার কাছে মুখ রাখলেন, যদি দেখা যায়!

ঘোষাল সাহেব চোখ বুজে মৃদুস্বরে আবৃত্তি করলেন,

শিখর হইতে শিখরে ছুটিব
ভূধর হইতে ভূধরে লুটিব
হেসে খলখল, গেয়ে কলকল, তালে তালে দিব তালি।

কয়েক সেকেন্ড স্তব্ধ থেকে আবার বললেন–এত কথা আছে এত গান আছে এত প্রাণ আছে মোর। তারপর বললেন– প্রাণ গান গাইছে। লাইফ ফোর্স। যেখানে জীবন যত দুর্বার, সেখানে তার গান তত উচ্চ। কিন্তু সব প্রাণেরই কামনা বিশ্বগ্ৰাসী, তাই তার দাবি—নাল্পে সুখমস্তি—ভূমৈব সুখম্। বিপুল বিশাল প্রাণেরও যত দাবি এক কণা প্রাণেরও তাই দাবি। বড় অনবুঝ। বড় অনবুঝ।

একটু চুপ করে থেকে বললেন––কিন্তু যার যতখানি শক্তি তার একটি কণা বেশি পাবার অধিকার তার নাই। নেচারস্ জাজমেন্ট! কোথাও নদী পাহাড় কেটে ভেঙে চুরমার করে দিয়ে আপন পথ করে নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে, কোথাও স্তব্ধ হয়ে খানিকটা জলার সৃষ্টি করে পাহাড়ের পায়ের তলায় পড়ে আছে, শুকিয়ে যাচ্ছে। বড়জোর মানস সরোবর। কিন্তু মাথা কোটার বিরাম নাই।

অকস্মাৎ সুরমা দেবী সচেতন হয়ে উঠলেন, বললেন–কটা বাজল?

শঙ্কিত হয়ে উঠেছেন তিনি। দর্শনতত্ত্বের মধ্যে ঘোষাল সাহেব ঢুকলে আর ওঁর নাগাল পাবেন না তিনি। মনে হবে, এই ঝরনাটার ঠিক উলটো গতিতে তিনি পাহাড়ের উচ্চ থেকে উচ্চতর শিখরে উঠে চলেছেন, আর তিনি সমতলে অসহায়ের মত ওঁর দিকে তাকিয়ে আছেন। ক্রমশ যেন চেনা মানুষটা অচেনা হয়ে যাচ্ছে। প্রাণ হাঁপিয়ে ওঠে। একথা বললে আগে বিচিত্র ভঙ্গি করে তার দিকে তাকিয়ে বলতেন—তা হলে ইন্সিওরেন্স পলিসি, গভর্নমেন্ট পেপার আর শেয়ার স্ক্রিপ্টগুলো নিয়ে এস। তাই নিয়ে কথা বলি। অথবা আলমারি খুলে হুইস্কির বোতল বের করে দাও। গিভ মি ড্রিঙ্ক। হেঁটে নামতে দেরি লাগবে অনেক। তার চেয়ে স্থলিত চরণে গড়গড় করে গড়িয়ে এসে পড়ব তোমার কাছে। তোমার অঙ্গে ঠেকা খেয়ে দাঁড়িয়ে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকব। বলে হা-হা করে হাসতেন। যে-হাসি সুরমা সহ্য করতে পারতেন না।

আগে ঘোষাল সাহেব সত্য সত্যই এ-কথার পর মদ খেতেন, পরিমাণ পরিমাপ কিছু মানতেন না। এখন মদ আর খান না। সুদীর্ঘকালের অভ্যাস একদিনে মহাত্মার মৃত্যুদিনের সন্ধ্যায় ছেড়ে দিয়েছেন। মদ ধরেছেন জ্ঞানেন্দ্রনাথ সুরমাদের সংস্পর্শে এসে। শুরু তার টেনিস খেলার পর ক্লাবে। সেটা বেড়েছিল সুমতির সঙ্গে অশান্তির মধ্যে। সুমতির মৃত্যুর পর সুরমাকে। বিয়ে করেও মধ্যে মধ্যে এমনই কোনো অস্বস্তিকর অবস্থা ঘনিয়ে উঠলেই সেদিন মদ বেশি খেতেন। গান্ধীজীর মৃত্যুর পর গোটা রাত্রিদিনটা তিনি স্তব্ধ হয়ে বসে ছিলেন একখানা ঘরের মধ্যে। উপবাস করে ছিলেন। জীবনে গান্ধীজী সম্পর্কে তিনি যত কিছু মন্তব্য করেছিলেন ডায়রি উলটে উলটে সমস্ত দেখে তার পাশে লাল কালির দাগ দিয়ে লিখেছিলেন—ভুল, ভুল। সুরমা তার সামনে কতবার গিয়েও কথা বলতে না পেরে ফিরে এসেছিলেন। তারপর, তখন বোধহয় রাত্রি নটা, ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বেয়ারাকে ডেকে বলেছিলেন—সেলারে যতগুলি বোতল আছে নিয়ে এস।

বোতলগুলি খুলে উজাড় করে ঢেলে দিয়েছিলেন মাটিতে। তারপর বলেছিলেন—আমার খাবারের মধ্যে মাছ মাংস আজ থেকে যেন না থাকে সুরমা।

সুরমা বিস্মিত হন নি। এই বিচিত্র মানুষটির কোনো ব্যবহারে বিস্ময় তাঁর আর তখন হত না।

সেই অবধি মানুষটাই যেন পালটে গেলেন। এ আর-এক মানুষ। মানুষ অবশ্যই পালটায়, প্রতিটি দিন, প্রতিটি ক্ষণে পালটায়, প্রকৃতির নিয়ম, পরিবর্তন অনিবার্য পরিণতি। কিন্তু এ-পরিবর্তন যেন দিক পরিবর্তন। একবার নয়, দুবার। প্রথম পরিবর্তন সুমতির মৃত্যুর পর। শান্ত মৃদু মিষ্টভাষী কৌতুকপরায়ণ জ্ঞানেন্দ্রনাথ সুমতির মৃত্যুর পর হয়ে উঠেছিলেন অগ্নিশিখার মত দীপ্ত এবং প্রখর, কথায়-বার্তায় শাণিত এবং বক্র; দুনিয়ার সমস্ত কিছুকে হা-হা করে হেসে উড়িয়ে দিতেন।

একবার, তখন জ্ঞানেন্দ্রনাথ বর্ধমানে ডিস্ট্রিক্ট জজ, তাদের বাড়িতে সমবেত হয়েছিলেন। রাজকর্মচারীদের নবগ্রহমণ্ডলী, তার চেয়েও বেশি কারণ, এঁরা ছিলেন সপরিবারে উপস্থিত। তর্ক জমে উঠেছিল ঈশ্বর নিয়ে। তর্কের মধ্যে জ্ঞানেন্দ্রনাথ কথা বলেন নি বেশি কিন্তু যে কম কথা কটি বলেছিলেন তা যত মারাত্মক এবং তত ধারালো ও বক্র ব্যঙ্গাত্মক। লঙ্কা ফোড়নের মত অ্যাঁঝালো এবং সশব্দ। হঠাৎ এরই মধ্যে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের বার বছরের ছেলেটি বলে উঠেছিল—গড ইজ নাথিং বাট বারেশন।

কথাটা ছেলেমানুষি। শুনে সবাই হেসেছিল; কিন্তু জ্ঞানেন্দ্রনাথের সে কী অট্টহাসি! তিন দিন ধরে হেসেছিলেন।

ধীরে ধীরে বয়সের সঙ্গে সঙ্গে হাসির উচ্ছলতা তাঁর কমে এসেছিল, কিন্তু প্রকৃতিতে তিনি পাল্টান নি। প্রথম যেন স্তব্ধ হয়ে গেলেন যুদ্ধের সময়। তারপর গান্ধীজীর মৃত্যুর দিনে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে অন্য মানুষ হয়ে গেলেন। এখন দৰ্শনতত্ত্বের গহনে প্রবেশপথে তাকে পিছন ডাকলে তিনি আগের মত অট্টহাস্য করেন না মদ খান না, চোখ বন্ধ করে চুপ করে বসে থাকেন এবং তারই মধ্যেই এক সময় ঘুমিয়ে পড়েন। এমন ক্ষেত্রে তাঁকে সহজ জীবনের সমতলে নামাতে একটি কৌশল আবিষ্কার করেছেন সুরমা। তাকে কোনো গুরুদায়িত্ব বা কর্তব্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। তাতেই কাজ হয়।

 

ঙ.

আজ ওই নদীর জলের এবং ওই পাহাড়ের বাঁধের দৃঢ়তার কথা ধরে জীবনতত্ত্বের জটিল গহনে তিনি ক্ৰমে ক্ৰমে সুরমার নাগালের বাইরে চলে যাবার উপক্রম করতেই শঙ্কিত হয়ে সুরমা নিজের হাতঘড়িটার দিকে তাকালেন। বোধ করি বিদ্যুতের চমক দেখে আপনাআপনি চোখ বুজে ফেলার মত সে তাকানো, বললেন–কটা বাজছে? আমার ঘড়িটায় কিছু ঠাওর করতে পারছি না। চোখের পাওয়ার খুব বেড়ে গেছে। দেখ তো?

জ্ঞানেন্দ্রনাথ চোখ বন্ধ করে গাড়ির ঠেসান দেওয়ার গদিতে মাথাটি হেলিয়ে দিয়ে মৃদুস্বরে বললেন–গাড়ির ড্যাসবোর্ডের ঘড়িটা দেখ।

ড্যাসবোর্ডের ঘড়িটা বেশ বড় একটা টাইম-পিস। তার উপর রেডিয়ম দেওয়া আছে। জ্বলজ্বল করছে। সুরমা চমকে উঠে বললেন–ও মা। এ যে বারটা!

–বারটা? ক্লান্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন জ্ঞানেন্দ্রনাথ। কিন্তু তার বেশি চাঞ্চল্য প্রকাশ করলেন না। চোখ বুজে ভাবছিলেন, চোখ খুললেন না।

–গাড়ি ঘোরাও। বললেন– সুরমা।

–ঘোরাব?

–ঘোরাবে না? ফিরে তো আবার সেই নথি নিয়ে বসবে। ওদিকে সেসস্ চলছে, সেই দশটার সময়–

তবুও তেমনিভাবে বসে রইলেন জ্ঞানেন্দ্রনাথ।

গোটা কেটা মাথার মধ্যে উঘাটিতযবনিকা রঙ্গমঞ্চের দৃশ্যপটের মত ভেসে উঠল।

জটিল বিচাৰ্য ঘটনা। নৌকো উটে গিয়েছিল। নৌকো ড়ুবেছিল ছোট ভাইয়ের দোষে। তারা জলমগ্ন হয়েছিল। ছোট ভাই আঁকড়ে ধরেছিল বড় ভাইকে। বড় ভাই ছাড়াতে চেষ্টা করেও পারে নি। শেষে ছোট ভাইয়ের গলায় তার হাত পড়েছিল। এবং সে-স্বীকার সে করেছে। কিন্তু–

আসামিকে মনে পড়ল তার!

আবার একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন তিনি।

সুরমাও স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন। জ্ঞানেন্দ্রনাথ স্তব্ধ হয়েই আছেন, কিন্তু তখন ড়ুবে গেছেন মামলার ভাবনার মধ্যে। সে সুরমা বুঝতে পারছেন। জ্ঞানেন্দ্রনাথের কপালে চিন্তার রেখা ফুটে উঠেছে। এ তবু সহ্য হয়। সহ্য না করে উপায় নাই! এ কর্তব্য। কিন্তু এ কী হল তার জীবনে? তিনি পেলেন না। তার সঙ্গে চলতে পারলেন না? না! হারিয়ে গেলেন? টপটপ করে চোখ থেকে তাঁর জল পড়তে লাগল। কিন্তু সে-কথা জ্ঞানেন্দ্রনাথ জানতে পারলেন না; অন্ধকার গাড়ির মধ্যে তিনি চোখ বন্ধ করেই বসে আছেন। মনশ্চক্ষে ভেসে উঠেছে আদালত, জুরী, পাবলিক প্রসিকিউটার, আসামি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *