০৩. সিরাজ

সন্ধের সঙ্গে সঙ্গেই ওরা জলেশ্বরীর ভেতরে পা রাখে। তিন সড়কের মোড়ে ডাকবাংলা থেকেই সীমানা ধরা হয়। কিন্তু সড়ক ধরে আসে নি। তার আগে ছিল সেই খাল, যে খালের পুলের ওপর সকালে ডিনামাইট ফেটেছিল। সে জায়গাটা ঘুরে, বনের ভেতর দিয়ে ওরা কবরস্থানের পাশ দিয়ে আবার রেললাইনের ওপর জলেশ্বরীর ডিসট্যান্ট সিগন্যালের কাছে এসে দাঁড়ায়।

কোথাও কোনো শব্দ নেই। এমনকি দূরে যে দুএকটা ঘর চোখে পড়ে তাতেও কোনো বাতি নেই।

এতক্ষণ ফসলের মাঠে যে স্তদ্ধতা ছিল, তা থেকে শহরের এই স্তব্ধতা একেবারে আলাদা। এখানে টের পাওয়া যায় মানুষ আছে, কিন্তু নিঃশ্বাস পতনের শব্দ নেই। শব্দের সম্ভাবনা আছে কিন্তু শব্দ নেই।

বিলকিস উদ্বিগ্ন চোখে সিরাজের দিকে তাকায়।

সিরাজ গুম হয়ে থাকে।

রেললাইন ধরে গেলেই বিলকিসের বাড়ি সংক্ষিপ্ত পথে পৌঁছুনো যায়। সেই পথেই এগোয় তারা। কান খাড়া করে রাখে। কিন্তু কিছুই টের পাওয়া যায় না।

দ্রুত পায়ে ওরা দুজনে চলে। আর কিছুদূর গেলেই ছোট একটা সড়ক লাইনটাকে কাটাকুটি করে গেছে। তার বাঁ হাতিতে কয়েক পা দূরেই কাদের মাস্টারের বাড়ি।

অন্ধকারের ভেতরেও দূর থেকে চোখে পড়ে লম্বা ঘরের পেছনে টক আমের গাছটি।

শেষ কয়েক হাত বিলকিস দৌড়ে যায় বাড়ির দিকে।

বাড়ির সদর দরোজায়। থমকে দাঁড়ায় সে। সিরাজ এসে যায়।

সিরাজ বলে, বাড়িতে কেউ নেই মনে হয়।

সদর দরোজায় পা দিয়েই রক্তের ভেতরে সেটা টের পেয়েছিল। দরোজা হয় খোলা। ভেতরে জমাট অন্ধকার।

ক্রস্ত পায়ে দুজনে ঢোকে। অন্তত বাইরের চেয়ে নিরাপদ। অন্ধকারের ভেতরেই চোখে পড়ে বাড়ির কিছু কাপড় ঝুলছে, বারান্দায় বালতিতে রাখা পানি, বদনা। রান্নাঘরে মেঝের ওপর ইতস্তত ছড়িয়ে আছে বাসনকোসন যেন এইমাত্র কেউ খেতে খেতে উঠে গেছে। দাওয়ার নির্টে পড়ে আছে শাদা-কালো খোপ কাটা ফুটবল।

শোবার ঘরের বারান্দায় কাঠের পুরনো যে চেয়ারটাতে কাদের মাস্টার বসতেন, সেই চেয়ারটা এখনো আছে। সারা বাড়িতে চেয়ারের এই শূন্যতা আরো বিকট মনে হয়।

সমস্ত ঘরগুলো দৌড়ে এসে বিলকিস চেয়ারের পিঠ ধরে দাঁড়ায়।

কোথায় গেল সব?

বুঝতে পারছি না। পাশের কোনো বাড়ি থেকেও আওয়াজ পাচ্ছি না।

কী হবে, সিরাজ?

আপনি একটু বসুন।

বিলকিস। তবু চেয়ারের পিঠ ধরে দাঁড়িয়ে থাকে।

আপনি বসুন তো। এতটা পথ হেঁটে এসেছেন।

প্ৰায় জোর করে সে চেয়ারে বসিয়ে দেয় বিলকিসকে। যে ছেলেটিকে সারা বিকেল সদ্য কৈশোর পেরুনো অপ্ৰতিভা তরুণ বলে মনে হচ্ছিল, এখন তাকে অন্য রকম মনে হয়। একটি সন্ধেয় সে অনেকগুলো বৎসর পেরিয়ে এসেছে। তার গলায় নিশ্চয়তা এসেছে, চিন্তায় তৎপরতা।

আপনি বসুন। উতলা হবেন না।

সিরাজ নিজে এবার সারা বাড়ি ঘুরে আসে। প্রতিটি ঘরের ভেতর উঁকি দেয়। তারপর সদর দরোজা দিয়ে বাইরে যায়। আবার কয়েক মিনিটের মধ্যেই ফিরে আসে।

পাশের কোনো বাড়িতেও মানুষ নেই। মনে হয়, পালিয়েছে।

তার চেয়ে অন্য কিছু তো হতে পারে? মানুষগুলো খুন হতে পারে। বিলকিসের চোখে সেই উদ্বেগ ফুটে বেরোয়। সে আর বসে থাকতে পারে না। উঠে দাঁড়ায়।

তাহলে?

আপা, আপনি বসুন।

আবার তাকে চেয়ারে বসিয়ে দেয় সিরাজ। কিছুক্ষণ পরে কী চিন্তা করে বলে, আপনি একা থাকতে পারবেন? আধা ঘণ্টা?

তুমি কোথায় যাবে?

দেখি যদি খবর পাওয়া যায়।

তার হাত ধরে বিলকিস। না, তুমি বেরিও না।

আমার কিছু হবে না।

কোথায় খবর পাবে? কে আছে?

দেখি না, ইস্টিশানের পাশে কয়েকটা দোকান আছে, বাসা আছে, তারা হয়তো কিছু বলতে পারবে।

অত দূরে যাবে? যদি তোমাকে ধরে?

সিরাজ হাসে।

বাহাদুরি কোরো না।

আপনি জানেন না দিদি, মিলিটারি সন্ধের পর বেরোয় না। ওদের সব দিনের বেলায়।

হাত ছেড়ে দেয় বিলকিস।

আপনি একা থাকতে পারবেন তো? আমি বেশি দেরি করব না।

সিরাজ বেরিয়ে গিয়ে আবার ফিরে আসে।

আপনি বারান্দাতেই বসবেন?

কেন?

সদর দরোজায় কেউ দাঁড়ালে সোজা দেখা যায়। দরোজা বন্ধ করে যেতে চাই না। কেউ হয়তো সন্দেহ করবে। ভেতরে লোক আছে। কী হয়েছে বোঝা যাচ্ছে না তো। আপনি বরং রান্নাঘরের ওদিকটায় থাকুন, আমার গলা না পাওয়া পর্যন্ত সাড়া দেবেন না, কোনো শব্দ হলেও বেরুবেন না। আমি এসে আপনাকে ডাকব।

সিরাজ নিঃশব্দ পায়ে অন্ধকারের ভেতর মিলিয়ে যায়। তার চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকার যেন রোয়া ফুলিয়ে বিশাল আকার ধারণ করে। রান্নাঘরের পাশে কুয়োর পাড়ে দাঁড়িয়ে গা ছমছম করে ওঠে বিলকিসের। সেখান থেকে দ্রুত পায়ে সে সরে আসে।

রান্নাঘরের পেছনের বেড়ার ওপারে পাশের বাড়ি। বেড়ার ফাঁক দিয়ে তার আঙিনা দেখা যায় দিনের বেলায়। মা অনেক সময় বেড়া ফাঁক করে পাশের বাড়ির বৌয়ের সঙ্গে কথা বলতেন। সাইকেলের দোকান আছে। ওদের; স্বামীটি হাঁপানিতে ভোগে। যখন টান ওঠে, এ বাড়িতে সারা রাত ঘুমানো যায় না তার শ্বাস নেবার আর্তিতে।

এখন সে বাড়ি নিঃস্তব্ধ। বেড়া ফাঁক করে দেখে সে। কঠিন অন্ধকার ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ে না। কান খাড়া করে। মানুষের উপস্থিতির কোনো সাড়া পাওয়া যায় না।

বিলকিসের মনে হয়, রান্না ঘরের দরোজায় কে এসে দাঁড়িয়েছে। মুহূর্তে সে ঘুরে তাকায়। কেউ না। কেউ যদি এসে দাঁড়াত তার পালাবার পথ থাকত না। লাফ দিয়ে সে ঘর থেকে বেরোয়। উঠানের কাপড়গুলো ছয়ে দেখে। শুকিয়ে খটখটি হয়ে আছে। একটা শার্ট, বাচ্চাদের কয়েকটা জামা, গামছা, দুটো শাদা শাড়ি। মৃদু বাতাসে শাড়ির ভাঁজ করা পেট ফুলে ফুলে ওঠে। আবার ঝুলে পড়ে অনবরত পতাকার মতো সখেদে কাপে। একটা শাড়ির কোণ হাতের মুঠোয় নিয়ে বিলকিস তার মুখে চেপে ধরে। সাবান দিয়ে ধোবার পরও মানুষের সুবাস এখনো যায় নি। সে তার মায়ের বোনের উপস্থিতি অনুভব করে। ওদের কি মেরে ফেলেছে?

তাহলে লাশ গেল কোথায়? তাহলে তো রক্তের দাগ থাকত। অন্ধকারে হয়তো রক্তের দাগ চোখে পড়ে নি। বাতি জ্বালালেই দেখতে পাবে। জ্বালাবে সে বাতি? নিশ্চয়ই রান্নাঘরে ছেলেবেলা থেকে পরিচিত পূর্বদিকের তাকে কুপি লণ্ঠন সাজানো আছে। পাশে রাখা আছে দেশলাই।

রান্নাঘরে সে আবার আসে। অতি পরিচিত ঘরে তাকে হাতড়াতে হয় না। ঠিক পৌঁছে যায় তাকের কাছে। হাত দিয়ে অনুভব করে দুটো কুপি, একটা লণ্ঠন। পাশে খড়মড় ওঠে দোলাইয়ের বাক্স।

সন্তৰ্পণে সে লণ্ঠন নামায়।

সিরাজ সাবধান করে গিয়েছিল, কেউ যেন টের না পায় বাড়িতে মানুষ আছে। বাতি জ্বালালে যদি কারো চোখে পড়ে? কিন্তু মিলিটারি তো রাতে বেরোয় না। চোখে পড়বে। কার? লণ্ঠনের চিমনি তুলে ধরে বিলকিস। ফস করে দেশলাই জ্বালিয়ে কাঠিটা ধরে রেখে সে কান খাড়া করে, পেছনে তাকিয়ে দ্যাখে। তারপর সলতে ধরিয়ে খুব ছোট করে দেয়।

সেই অল্প আলোতেও চোখে পড়ে–নিভে যাওয়া উনোনের ওপর খোলা কড়াই। রান্না শেষ হবার আগেই চলে যেতে হয়েছে। ঘরের এক কোণে হয়তো চাল বাছা হচ্ছিল, কুলোর ওপর এখনো কিছু চাল। মেঝের ওপর একটা থালায় দুখানা আটার রুটি, আধা-খাওয়া কলা। লণ্ঠনটা আঁচলে ঢেকে সে দ্রুত পায়ে শোবার ঘরে যায় প্ৰথমে। কী জানি কেন, এখন আর তার তেমন ভয় করে না। এমন একেকটা মুহূর্ত আসে, মানুষ যখন বাস্তব থেকে উন্নীত হয়ে যায়।

ঘরের ভেতরে সে প্ৰথমেই মেঝের ওপর সন্ধান করে। কোথাও কি রক্তের দাগ দেখা যাচ্ছে?

খাট দেখে, দেয়াল দেখে, পাশে পার্টিশন করা তার ছোট ভাইয়ের ঘর। খোকা কি রংপুরে ছিল? না, বাড়িতেই ছিল? বিছানা ব্যবহার করা মনে হয়। হয়তো খোকা কলেজে আর ফিরে যায় নি। জলেশ্বরীতেই বসে ছিল। খোকার জন্যে হঠাৎ বুকের ভেতরে মুহূর্তে কাঁপন ওঠে তার।

এই বয়সের ছেলেদেরই তো ওরা মেরে ফেলে।

সিরাজের কথা এতক্ষণ সে ভুলেই গিয়েছিল।

উদ্বিগ্ন হয়ে বারান্দায় বেরিয়ে আসে সে। কতক্ষণ হয়ে গেছে, সিরাজ এখনো ফিরছে না কেন?

বাড়ির সকলে গেছে কোথায়? কখন গেছে? মেরে ফেলেছে বলে মনে হচ্ছে না তার সব দেখেশুনে। কিন্তু হঠাৎ এমন করে চলে যেতে হলো কেন? একবার তো নদীর ওপারে চলে গিয়েছিল, আবারো কি সেখানেই গেছে?

লণ্ঠন নিভিয়ে, চেয়ারটাকে কোনো শব্দ না করে টেনে এনে বারান্দার শেষ প্রান্তে রাখে। বিলকিস। এখান থেকে সদর দরোজা চোখে পড়ে না। সে বসে।

এই প্রথম তার সারা পা টিনটিন করে ওঠে। পাঁচ মাইল হাঁটার ক্লান্তি অনুভব করে সে। ব্যথাটা আস্তে আস্তে পা থেকে সারা পিঠে ছড়িয়ে পড়ে তার। বড় পিপাসা পায়। পেটের ভেতরে পাকিয়ে ওঠে। সারা দিন কিছু পেটে পড়ে নি। ব্যথার সঙ্গে এখন যুক্ত হয় ক্ষুধার যন্ত্রণা।

মাথার ভেতরটা ভয়াবহ রকমে শূন্য মনে হয়।

আলতাফ ফিরে আসবে সে আর আশা করে না। তবু ঢাকায় ছিল, যদি কখনো কোনো খবর পাওয়া যায়। যদি এমন হয় যে, সে ঘুমিয়ে আছে, দরোজায় সাবধানী করাঘাত, দরজা খুলতেই আলতাফ।

হাতের টাকা সব শেষ হয়ে আসে। বাড়ি ভাড়া দুমাসের বাকি পড়ে। বাড়িওয়ালাকে আজকাল আর চেনা যায় না। এখন সে দাড়ি রেখে দিয়েছে, মাথা থেকে টুপি নামে না। সে এসে ভাড়ার জন্যে যত না চাপ দেয়, তার চেয়ে বেশি করে পরামর্শ দেয়–দেশের বাড়িতে চলে যান, এখানে একা থাকা তো ভালো মনে করি না।

তারপর শমশের এসে বলে, ভাবি, ঢাকায় এখন শুরু হয়ে গেছে। শোনেন নি। পরশু দিন গুলির শব্দ? ফার্মগেটে? আমাদের ছেলেরা হামলা করেছিল।

শমশেরের সন্দেহ, মিলিটারি এখন তৎপর হয়ে যাবে, খুঁজে বের করবে, কোন বাড়ির সঙ্গে ইন্ডিয়ার যোগাযোগ আছে। আলতাফ যদি ইন্ডিয়ায় গিয়ে থাকে, তাহলে মিলিটারি একদিন বিলকিসকেই ধরবে।

আমার মনে হয়, আপনি দেশের বাড়িতে চলে যান ভাবি।

আলতাফ কি ইন্ডিয়ায় গেছে? যদি এমন হয়, যুদ্ধে যোগ দিয়েছে সে? এই যে শোনা যায়, ছেলেরা এখানে পুল উড়িয়ে দিয়েছে, ওখানে গ্রেনেড ছুঁড়েছে, এক গাড়ি সৈন্য খতম করেছে–যদি তার কোনো একটি আলতাফের কাজ হয়? ঢাকায় রাতে যে প্রায়ই গুলির শব্দ শোনা যায়, তার সবই কি মিলিটারির? কোনো একটি কি আলতাফের নয়?

বিলকিস একই সঙ্গে বুকের ভেতরে মঙ্গল কামনায় কাপন এবং প্রতিরোধের গৌরব অনুভব করে।

যদি গত বছরও তারা নিষেধ তুলে নিত তাহলে আজ তার কোলে থাকত সন্তান। আলতাফের।

বুকের ভেতরে হঠাৎ ক্ষোভ জমে ওঠে। বিয়ের পর তো পাঁচ বছর গেছে! এবার একটি ছেলে হবার কথা ভাবা উচিত ছিল তাদের।

ছেলে হলে, এখন এই পরিস্থিতিতে মুশকিল হতো। না হয়েছে, ভালোই হয়েছে।

কিন্তু আলতাফ যদি আর ফিরে না আসে! যদি সে রাতেই তার মৃত্যু হয়ে থাকে। আলতাফ . কি ইচ্ছে করে নীরব থাকবে? আলতাফ কি তাকে ভালোবাসে না? বিলকিস কি তাকে ভালোবাসা দেয় নি?

আপা।

চমকে ওঠে বিলকিস। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। ঠিক বুঝতে পারে না, সত্যি কি মানুষের স্বর? না তার কল্পনা?

অন্ধকার ফুঁড়ে সিরাজ দেখা দেয়। আপা, আমি। চারদিকে দ্রুত চোখ বুলিয়ে নেয় সে। কেউ এসেছিল?

না। আমি ঠিক ছিলাম। কিছু শুনলে?

হুঁ।

কী?

খালের পুলটা ঠিক ভাঙতে পারে নি। একদিকের রেলটা গেছে।

পুলের কথা নয়, মা ভাইবোনের কথা শুনতে চায় বিলকিস। কিন্তু সাহস করে জিগ্যেস করতে পারে না। উদ্বিগ্ন চোখে অন্ধকারের ভেতর সিরাজের দিকে তাকিয়ে থাকে। কোথা থেকে একটা ফোঁটা আলো এসে সিরাজের চোখ দুটিকে স্পষ্ট করে তুলেছে। মনে হয়, ছলছল করছে।

সিরাজ বলে, আর যা শুনলাম, আপনার সকলেই ভালো আছে।

কার কাছে শুনলে? কোথায় আছে ওরা?

নদীর ওপারে, বিশেষ করে টাওনের এ দিকটার সবাই আজ দুপুরে বেরিয়ে যায়। আপনার সকলকেই দেখা গেছে। ওদিকের কেউ বিশেষ সরতে পারে নি। ওদিকে বিহারীদের বাড়ি অনেকগুলো। মিলিটারি ওদের বন্দুক দিয়েছে।

সিরাজ প্রায় মুখস্থের মতো না থেমে বলে যায়। এক ধরনের অস্থিরতা লক্ষ করা যায়, যেন বক্তব্য শেষ করতে পারলেই নিষ্কৃতি পায় সে।

বিলকিস সেটা লক্ষ করে। হয়তো, একাকী বাইরে বিপদের মধ্যে ঘুরে আসবার উত্তেজনায় সিরাজের গলার স্বরও পাল্টে গেছে।

আপনি কী করছিলেন এতক্ষণ? আমার একটু দেরিই হয়ে গেল।

বসে ছিলাম।

ভয় পান নি তো?

বিলকিস ছোট্ট করে মাথা নাড়ে। ভয়ের অনুভূতিটাই তখন তার কাছে অচেনা বলে বোধ হয়।

তুমি সত্যি শুনেছি, ওরা নদীর ওপারে গেছে?

হাঁ, এখানকার কয়েকজন ছেলে, বাড়ি বাড়ি এসে মেয়েদের তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে আসতে বলে। ওরাই সকলকে নদীর ঘাট পর্যন্ত নিয়ে যায়।

শুধু মেয়েদের উল্লেখ শুনে বিলকিস বিচলিত হয়ে পড়ে।

আর খোকা?

আপনার ভাই?

হাঁ, খোকা সঙ্গে যায় নি?

সবাই গিয়েছে। আপনার কিছু ভাবতে হবে না। রাতে ঠিক সুবিধে হবে না। কাল দিনের বেলায় দেখি, আপনাকে ওপারে দিয়ে আসা যায় কি না।

তুমি যে বললে, রাতে মিলিটারি থাকে না, দিনে অসুবিধে হবে না?

আপনি একটা ছেড়া শাড়ি পরে নেবেন। দেখে যেন চাষীদের বাড়ির মনে হয়।

তুমি ভাই অনেক করলে আমার জন্যে। বিলকিস তার হাত ধরে বলে। সিরাজের ভেতরে কোথায় যেন সে খোকাকে দেখতে পায়। কখনো কখনো সমস্ত মানুষের মুখ এক হয়ে যায়। এখন এমনি একটা সময়।

দ্রুত কণ্ঠে সিরাজ বলে, আপনার তো কিছু খাওয়া হয় নি!

না, না, আমার খিদে পায় নি। তোমার?

দিদি, আপা, সামনে পুরো একটা রাত। না খেয়ে থাকবেন? রান্নাঘরে কিছু নেই?

দাঁড়াও বাতি জ্বালি।

না। বাতি জ্বালাবেন না।

একটু আগে লণ্ঠন ধরিয়েছিল বিলকিস। সেটা মনে করে বুক চমকে ওঠে এখন।

আসলে, আপা, এখানে থাকা আর ঠিক হবে না।

কেন?, এ পাড়ায় কেউ নেই। বিহারীরা জানে। লুট করতে আসতে পারে। ওদের তো এখন রাজত্ব।

তাহলে?

আসুন আগে রান্নাঘরে যাই। মুড়িটুড়ি কিছু থাকলে নিয়ে চলুন বেরোই।

কোথায়?

যেখানে হোক। এখানে না, আপা। এখানে আজ রাতে ভয় আছে, আমি শুনে এসেছি।

বলতে গিয়ে সিরাজের গলাও কেঁপে যায়।

বিলকিসই তাকে সাহস দেয়; সে সাহস মুখের নয়, অন্তরের ভেতর থেকে বোধ করে সাহস।

ভয় পেও না। ঢাকায় এ কমাস একা একটা বাড়িতে থেকেছি।

কিন্তু এখান থেকে আমাদের যেতেই হবে।

যাব। আগে দেখি রান্নাঘরে কিছু আছে কিনা। লণ্ঠন জুলি। একটু আগেও জ্বেলেছিলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *