০৩. সাহেব বাড়ি

৩. সাহেব বাড়ি

রশীদ স্যার আমাদের ইতিহাস পড়ান। আসল ইতিহাস মনে হয় খারাপ না, কিন্তু আমাদের ক্লাসে যে জিনিসটা পড়ানো হয় তার থেকে জঘন্য আর কিছু হতে পারে না, রাজা বাদশাহ নিয়ে বানানো সব গালগল্প! সলীল একবার কোথা থেকে একটা বই জোগাড় করে এনে দিয়েছিল, বইয়ের নাম ”প্রাচীন পৃথিবীর সভ্যতা”, সে যে কি সাংঘাতিক একটা বই! পড়লে মনেই হয় না ইতিহাস পড়ছি, মনে হয় রহস্য উপন্যাস পড়ছি। মিশরের ফারাওদের কাহিনী, কেমন করে মমি তৈরি করত তার ইতিহাস, দক্ষিণ আমেরিকার মায়াদের কাহিনী, কেমন করে প্রত্যেকদিন হাজার হাজার মানুষের বুক কেটে হৃদপিণ্ড বের করে সূর্য দেবতাকে উৎসর্গ করত তার বর্ণনা, রোমানদের গল্প, ক্রীতদাসের বিদ্রোহের কি সাংঘাতিক একটা কাহিনী! কিন্তু আমাদের ক্লাসে সেসব কিছুই পড়ানো হয় না। রশীদ স্যার মনে হয় ব্যাপারটা টের পেয়েছেন, তাই আমাদের কিছু পড়ানোর চেষ্টা করেন না। ক্লাসে এসে চেয়ারে দুই পা তুলে একটা বিচিত্র ভঙ্গিতে বসে পড়েন, দেখে মনে হয় এভাবে বসতে বুঝি খুব আরাম। তারপর ইতিহাস বইটা হাতে নিয়ে বলেন, বাহান্ন পৃষ্ঠা থেকে ষাট পৃষ্ঠা পর্যন্ত পড় মনে মনে। গোলমাল করবি না। খবরদার।

আমরা প্রথমে একটু সময় পড়ি, তারপর নিজেরা নিজেরা ফিসফিস করে কথা বলি, চুপি চুপি চোর পুলিশ খেলি। যাদের কাছে ডিটেকটিভ বই আছে ইতিহাস বইয়ের উপর রেখে পড়তে শুরু করি। মজিদ স্যার মাঝে মাঝে হুঙ্কার দিয়ে বলেন, কোন কথা না, খবরদার।

আমরা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে আবার কথা বলতে শুরু করি। কোন রকম কথা না বলে কেমন করে থাকে একজন মানুষ? সলীল আমার পাশে বসেছিল, গলা নামিয়ে বলল, এক জায়গায় যাবি আজ?

কোথায়?

সাহেব বাড়ি।

সেটা কোনখানে?

মজিদ স্যার আবার হুঙ্কার দিলেন, খবরদার, আর কোন কথা না। জবাই করে ফেলব।

সলীল তাই আর কথা বলতে পারল না। চোখ নামিয়ে বুঝিয়ে দিল সাহেব বাড়ি হচ্ছে রহস্যময় এক বাড়ি।

.

সলীলের এটা প্রায় নেশার মত হয়ে গেছে। রহস্যময় জিনিসের জন্যে সে কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়ায়! রহস্যময় সব জিনিসে তার শখ। সত্যিকারের রহস্যময় জিনিস আর কয়টা আছে? কিন্তু সলীলের জন্যে সেটা কোন সমস্যা না, সাধারণ একটা জিনিসকে সে সাংঘাতিক একটা রহস্যময় জিনিস হিসেবে কল্পনা করে নিতে পারে। সবার কাছে যেটা মনে হয় জংলা জায়গায় ভাঙা একটা বাড়ি সলীল সেটা দেখে মুগ্ধ হয়ে যায়। তার চোখ চকচক করতে থাকে, উত্তেজনায় কথা বলতে পারে না। বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলে বলে, ইশ! কি সাংঘাতিক! কি সাংঘাতিক!

সলীলের সাথে ঘুরে ঘুরে আমারও এখন একটু অভ্যাস হয়েছে। ব্যাপারটা আসলে কঠিন না। প্রথমে অনেক বই পড়তে হয়। বইয়ে নানা রকম বিচিত্র কাহিনী থাকে, সেগুলি জানা থাকলে কল্পনা করা খুব সোজা। ভাঙা একটা বাড়ি দেখে সলীল বলে, দেখ, দেখ একেবারে আজটেক মন্দিরের মত!

আমিও মাথা নেড়ে বলি, হ্যাঁ, ঐ ওপরে নিশ্চয়ই পুরোহিত দাঁড়াত পাথরের চাকু নিয়ে?

হ্যাঁ, আর ঐ বারান্দায় মানুষকে শোওয়াতো বলি দেয়ার জন্যে। মানুষ আর মানুষ দাঁড়িয়ে থাকত চারিদিকে। হাত তুলে গান গাইত —

আমি আর সলীল তখন বিচিত্র একটা শব্দ বের করতে শুরু করে দিই, যেন প্রাচীন মানুষ গান গাইছে! ব্যাপারটা খারাপ না।

সলীলের রহস্যময় বাড়িটাও সেরকম একটা কিছু হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু মনে হয় সেখানে যাওয়াটা খারাপ না। আজ হাফ স্কুল, দুপুরে ছুটি হয়ে যাবে। সন্ধ্যের ট্রেনে বাবা ঢাকা ফেরৎ যাবে, তার আগে এমনিতেই বাসায় ফিরে যাওয়ার তো কোন মানেই হয় না। খামাখা আরেক চোট মার খাওয়া।

স্কুল ছুটির পর আমি আর সলীল নদীর তীর ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। নদীর মনে হয় এক ধরনের যাদু আছে। এর কাছে আসলেই মন ভাল হয়ে যায়। এর কারণটা কি কে জানে? মনে হয় অনেক খোলামেলা, অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায় সে জন্যে। যখন বড় কোন নৌকা যায় তখন আমি আর সলীল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখি, কি যে ভাল লাগে দেখতে! মাঝিরা দাঁড় টানছে, বড় লগি দিয়ে দুজন দুপাশ থেকে ঠেলছে, বুড়ো মাঝি শক্ত করে হাল ধরে রেখেছে। নৌকার মাঝেই এক কোণায় একজন রান্না বসিয়েছে, কি আশ্চর্য রহস্যময় ব্যাপার!

নদীর তীর ধরে হেঁটে হেঁটে কদমতলা পর্যন্ত এসে ব্রীজের ওপর দিয়ে হেঁটে নদী পার হয়ে এলাম। নদীর এপাশে আরো অনেকদূর হেঁটে লাশকাটা ঘর পার হয়ে চাঁদমারী। পাহাড়ের পিছন দিয়ে গিয়ে, দুটো সর্ষে ক্ষেতের পর ছোট খালটা পার হয়ে বেশ জংলা মতন একটা জায়গায় সলীল এসে থামল। অকারণে গলা নামিয়ে বলল, এটা সাহেব বাড়ি।

বাড়ি কই?

ঐ যে দেখিস না?

আমি তাকিয়ে দেখলাম, সত্যিই গাছপালার ভিতরে একটা পুরানো দালান। দেখে মনে হয় ভেঙে পড়ে যাচ্ছে। চারিদিক থেকে গাছ বের হয়ে এসেছে লতাপাতায় ঢাকা। দেখেই কেমন জানি না গা ছমছম করতে থাকে। সলীল ফিসফিস করে বলল, কি সাংঘাতিক না?

আমি মাথা নাড়লাম।

আয়, আরেকটু কাছে যাই।

কার বাড়ি এটা।

জানি না।

কেউ থাকে এখানে?

ধুর! কেমন করে থাকবে? দেখিস না এটা পোড়াবাড়ি। কি রকম ছমছমে দেখেছিস? কি সাংঘাতিক! তাই না?

আমি আবার মাথা নাড়লাম।

আয় ভিতরে যাই। ভিতরে?

আমি চমকে উঠে বললাম, ভিতরে যাবি?

কেন যাব না? দেখে আসি।

আমার ঠিক ইচ্ছে হচ্ছিল না কিন্তু তবু সলীলের উৎসাহে এগিয়ে গেলাম। বাসার। পিছন দিকে একটা ভাঙা সিঁড়ি পাওয়া গেল, গাছপালা লতাপাতায় ঢাকা। সলীল বলল, চল উপরে উঠি।

কার না কার বাসা!

কেউ থাকে না এখানে। আর আমরা তো চুরি করতে যাচ্ছি না, দেখতে যাচ্ছি।

আমি বাধ্য হয়ে সলীলের সাথে সাথে ওপরে উঠতে থাকি। ওপরে একটা বারান্দা। মত পাওয়া গেল। সেখান দিয়ে আরেকটা সিঁড়ি বেয়ে মনে হল ছাদের দিকে যাওয়া যায়। দুজনে রওনা দিয়েছি, হঠাৎ করে কে যেন কানের কাছে বলল, কি খোকা, কাকে চাও?

আমি আর সলীল এমন চমকে উঠলাম সে আর বলার মত নয়। আরেকটু হলে এত জোরে লাফিয়ে উঠতাম, নিশ্চয়ই একেবারে ছাদে মাথা ঠুকে যেতো। অনেক কষ্টে নিজেদের শান্ত করে ঘুরে তাকিয়ে দেখি, একজন অদ্ভুত মানুষ আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। মানুষটা শুকনো মতন, চোখে সোনালী ফ্রেমের চশমা, মাথায় কাঁচা পাকা চুল। দেখে মনে হয়, কলেজের প্রফেসর কিন্তু গায়ের জামা কাপড় বাচ্চা ছেলেদের মত! রঙিন একটা শার্ট, তার সবগুলি বোতাম খোলা। ভিতরে একেবারে অসম্ভব পরিষ্কার একটা গেঞ্জি, যেন এইমাত্র কিনে এনে পরেছে। নীল রঙের ভুসভুসে একটা প্যান্ট, পায়ে টেনিস শু। হাতে খুব চকচকে একটা ঘড়ি, দেখে মনে হয় খুব দামী। মানুষটাকে একই সাথে খুব শিক্ষিত একজন ভদ্রমানুষ আবার কেমন জানি পাগল পাগল মনে হচ্ছে। সবচেয়ে বিচিত্র হচ্ছে একটা লাল গামছা, যেটা তার গলা থেকে ঝুলছে। রিকশাওয়ালা, কুলী বা চাষীরা যেভাবে গামছা ঝুলিয়ে রাখে সেরকম।

আমাদের খানিকক্ষণ লাগল সামলে নিতে। সলীল সামলে নিল আগে, আমতা আমতা করে বলল, না মানে ইয়ে–

কাউকে খোঁজ করছ? লোকটার গলার স্বর খুব ভাল। টেলিভিশনে যারা খবর পড়ে তাদের মত।

সলীল আবার মাথা নাড়ল, উঁহু। কাউকে খোঁজ করছি না।

আমি ভয়ে ভয়ে লোকটার দিকে তাকালাম। এখনই নিশ্চয়ই বাজখাই গলায় একটা ধমক দেবে, সেই ধমকে আমরা নিশ্চয়ই দিশেহারা হয়ে ছুটে পালাব। কিন্তু লোকটা ধমক দিল না। বরং মনে হল একটু হেসে দিল। হেসে বলল, তোমরা কারা? এখানে কি মনে করে?

আমি বললাম, ইয়ে, মানে—

কোন কাজে, নাকি এমনি?

এমনি।

বেশ বেশ। লোকটা চশমা খুলে তার লাল গামছা দিয়ে খুব যত্ন করে তার চশমাটা পরিষ্কার করতে শুরু করল। তারপর আবার চোখে দিয়ে বলল, কাজের অনেক সময় পাবে বড় হলে। এখন এমনিতেই ঘুরোঘুরি কর। সেটাই ভাল।

লোকটাকে বদমেজাজি মনে হচ্ছে না, হয়তো ধমক দিয়ে আমাদের বিদায় করে দেবে না। আমি সাহস করে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি এখানে থাকেন?

আমি? সব সময় থাকি না। মাঝে মাঝে থাকি।

সলীলের চোখ চকচক করে উঠে, কি সুন্দর বাসা!

সুন্দর? লোকটি অবাক হয়ে সলীলের দিকে তাকাল।

হ্যাঁ। কি সুন্দর চারিদিকে। গাছপালা নির্জন সুমশাম!

নির্জন? সুমশাম?

হ্যাঁ। এটা কি আপনার নিজের বাসা?

আমার পূর্বপুরুষের ছিল। এখন আমার। কিছুদিনের জন্যে আমার।

তারপরে?

তারপরে জানি না কি হবে। লোকটা একটা নিঃশ্বাস ফেলল, তারপর লাল গামছা দিয়ে মুখ মুছে বলল, এখন আমার চা খাওয়ার সময়। তোমরা কি খাবে এক কাপ চা আমার সাথে?

আমি সলীলের দিক তাকালাম। একেবারে অপরিচিত একজন মানুষের সাথে চা খাওয়া কি ঠিক হবে? বাবাকে দেখেই কিনা জানি না, বড় মানুষদের আমার কেন জানি বিশ্বাস হয় না, শুধু মনে হয়, নিশ্চয়ই কোন রকম বদ মতলব আছে। এই লোকটাকে দেখে অবিশ্যি কেমন জানি ভাল মানুষের মত মনে হচ্ছে। আমরা তাই আর না করতে পারলাম না। লোকটির পিছনে হেঁটে হেঁটে পাশের একটা ঘরে ঢুকলাম। বাইরে থেকে দেখে যেরকম মনে হয় বাসাটি ভেঙে পড়ে যাচ্ছে, ভিতরে কিন্তু সেরকম খারাপ না। ঘরের মাঝে কোন আসবাব নেই, মাঝখানে শক্ত একটা কাঠের টেবিলের উপরে একটা স্টোভ, সেই স্টোভে কুচকুচে কালো একটা কেতলি। লোকটি স্টোভটা বারকয়েক পাম্প করে জ্বালিয়ে দিল, শো শো শব্দ করে সেখান থেকে নীল আগুন বের হতে থাকে। কেতলিতে খানিকটা পানি ভরে লোকটি স্টোভের উপর চাপিয়ে দিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, স্কুল থেকে আসছ?

আমাদের হাতে বই, কাজেই আমরা যে স্কুল থেকে আসছি বোঝা খুব কঠিন নয়। আমরা মাথা নাড়লাম।

কোন ক্লাসে পড়?

সেভেন।

ভেরী গুড। ভেরী গুড। লোকটার মুখ কেন জানি খুব খুশি খুশি দেখাতে থাকে। ক্লাস সেভেনে পড়া কেন এত খুশির ব্যাপার আমি ঠিক ধরতে পারলাম না।

নাম কি তোমাদের?

আমি সলীল।

আমি মুনীর।

ভেরী গুড। ভেরী গুড। লোকটা মনে হল আরো বেশি খুশি হয়ে গেল। মাথা নেড়ে হাসতে হাসতে বলল, আমার নাম জহুরুল চৌধুরী। প্রফেসর জহুরুল চৌধুরী।

জহুরুল নামটা সলীল ঠিক ধরতে পারল না, জিজ্ঞেস করল, প্রফের জারুল চৌধুরী?

লোকটা হা হা করে হেসে উঠে বলল, জারুল? ভালই বলেছ। জারুল! জারুল চৌধুরী! প্রফেসর জারুল চৌধুরী। হা হা হা …

আমি সলীলকে ধাক্কা দিয়ে বললাম, গাধা! জারুল না, জহুরুল। জহুরুল চৌধুরী। ও। ও। সলীল একটু লজ্জা পেয়ে বলল, জহুরুল

লোকটি, মাথা নেড়ে সলীলকে থামিয়ে দিয়ে বলল, না না, জারুলই ভাল! চমৎকার নাম। গাছের নামে নাম। জারুল চৌধুরী খুব ভাল শোনায়! কি বল?

বোঝাই যাচ্ছে মানুষটা একটু পাগলা গোছের, কিন্তু ভাল মানুষ তাতে কোন সন্দেহ নেই। লোকটা হাসিমুখে আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, আজ থেকে তোমাদের কাছে আমার নাম জারুল চৌধুরীই হোক। প্রফেসর জারুল চৌধুরী।

আমি একটু ইতঃস্তত করে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কিসের প্রফেসর?

আমি ম্যাথমেটিক্সের প্রফেসর। গণিতশাস্ত্রের। অংকের। অংক ভাল লাগে তোমাদের?

অংক ভাল লাগে সেরকম কোন মানুষ কি সত্যি হওয়া সম্ভব? আমরা তবু ভদ্রতা করে মাথা নাড়লাম, বললাম, জী। ভাল লাগে।

ক্লাস সেভেনে কি অংক শেখায় তোমাদের? ক্যালকুলাস?

আমরা মাথা নাড়লাম, না।

প্রফেসর জারুল চৌধুরী মনে হল খুব অবাক হলেন। ক্যালকুলাস শেখায় না? ভারি আশ্চর্য। যত ছোট থাকতে সম্ভব ক্যালকুলাস শেখানো উচিৎ। ছোটরা শিখবে খুব সহজে। আমি ভেবেছিলাম একটা বই লিখব, নাম দিব ”শিশুদের ক্যালকুলাস”।

প্রফেসর জারুল চৌধুরী তার বইয়ের বিষয়বস্তু কি হবে সেটা আমাদের বোঝাতে শুরু করলেন। আমরা ঠিক বুঝতে পারছিলাম না, তবু মাথা নাড়তে থাকলাম।

কেতলিতে পানি গরম হয়ে যাবার পর প্রফেসর জারুল চৌধুরী আমাদের টিনের মগে চা তৈরি করে দিলেন। একটা প্যাকেট থেকে খানিকটা মুড়ি বের করে দিয়ে বললেন, স্কুল থেকে এসেছ, নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছে। আমার কাছে তো মুড়ি ছাড়া। আর কিছু নাই। মুড়ি খাও তো তোমরা?

জী খাই।

আমরা মুড়ি খেতে খেতে চায়ে চুমুক দিলাম। টিনের মগে চা খেতে হয় খুব। সাবধানে, ঠোঁট পুড়ে যায় খুব সহজে। চায়ে কি চমৎকার গন্ধ! মনে হল পায়েশ খাচ্ছি। আমি চায়ে চুমুক দিয়ে বললাম, আপনি কলেজের প্রফেসর?

হুঁ। প্রফেসর জারুল চৌধুরী মাথা নাড়লেন, এক সময়ে ছিলাম। এখন আর না।

রিটায়ার করেছেন?

বলতে পার এক ধরনের রিটায়ার।

আমরা চা খেতে খেতে প্রফেসর জারুল চৌধুরীর সাথে কথা বলতে লাগলাম। একজন প্রফেসর, তাও যাতা প্রফেসর না, অংকের প্রফেসর, আমাদের সাথে। এমনভাবে কথা বলছেন যেন আমরা ছোট নই, তাঁর সমবয়সী! আমরা একেবারে মুগ্ধ হয়ে গেলাম।

আমরা হয়তো আরো কিছুক্ষণ কথা বলতাম কিন্তু হঠাৎ টেবিলের নিচে পা লেগে কি একটা পড়ে গেল, আমি মাথা নিচু করে দেখি, একটা ছোট বাক্স, ভিতরে ভাঙা। কাঁচের বোতল। জারুল চৌধুরী বললেন, ওটা কিছু নয়। ভাঙা কাঁচের টুকরা। ঘরের ভিতরে রাখাই ঠিক হয়নি।

ভাঙা কাঁচ দিয়ে কি করবেন?

সূতায় মাঞ্জা দেব।

আমি আর সলীল চোখ বড় বড় করে তাকালাম, কিসে মাঞ্জা দেবেন?

সূতায়। ঘুড়ির সূতায়। ঢাউস একটা ঘুড়ি কিনে এনেছি, এই এত বড়, জারুল চৌধুরী দুই হাত দিয়ে দেখালেন।

হঠাৎ করে আমার একটা সন্দেহ হতে থাকে, মানুষটা নিশ্চয়ই পাগল। তা না হলে এরকম বয়স্ক একজন মানুষ সূতায় মাঞ্জা দিয়ে ঘুড়ি উড়ায়? হাতে দামী ঘড়ি পরে, গলায় গামছা ঝুলিয়ে রাখে? আমাদের মত বাচ্চা ছেলেদের সাথে এরকম ভাল ব্যবহার করে? আমি আড়চোখে সলীলের দিকে তাকালাম, দেখি তার মুখও কেমন জানি ফ্যাকাসে হয়ে গেছে, সেও নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছে। ঢোক গিলছে একটু পর পর।

চা প্রায় শেষ হয়ে আসছিল, আমি ঢকঢক করে বাকিটা শেষ করে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, আমাদের যেতে হবে। দেরি হয়ে গেছে।

সলীলও সাথে সাথে উঠে দাঁড়াল। ঢোক গিলে বলল, হ্যাঁ। অনেক দেরি হয়ে গেছে।

জারুল চৌধুরী বাইরে তাকিয়ে মাথা নেড়ে বললেন, হ্যাঁ, মনে হয় দেরি হয়ে গেছে।

আমরা মাথা নেড়ে বইপত্র হাতে নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম। ভয় হচ্ছিল, হাসিখুশি মানুষটা হঠাৎ বুঝি ক্ষেপে উঠে চিৎকার করে লাফিয়ে পড়বে। হাতে থাকবে একটা রাম দা, এক কোপে আমাদের গলা আলাদা করে দেবে। কিন্তু সেরকম কিছু। হল না। আমাদের ভাল মানুষের মত দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে বললেন, ঠিক আছে। সলীল আর মুনীর, বাসায় যাও এখন। খুব ভাল লাগল তোমাদের সাথে কথা বলে।

আমি আর সলীল গুটিগুটি সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলাম। নদীর ঘাটে এসে সলীল একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, মানুষটা আসলে পাগল। তাই না?

আমি মাথা নাড়লাম। কেমন জানি আমার একটু মন খারাপ হল।

.

বাসায় এসে দেখি, ট্রেন ফেল করেছেন বলে বাবা ঢাকা যেতে পারেননি। আমাকে দেখে তার চোখ কেমন জানি চকচক করে উঠল। মুখে লোল টেনে বললেন, আয় হারামজাদা, আজ বাসায় আয়! কখন স্কুল ছুটি হয়েছে আর তুই এখন বাসায় আসিস? আজকে তোর একদিন কি আমার একদিন।

শিউলী গাছের নিচের ডালগুলি সব ভেঙে শেষ করে নেয়া হয়েছে, বাবাকে অনেক কষ্ট করে উপর থেকে একটা ডাল ভাঙতে হল।

তারপর আমাকে যা একটা মার মারলেন, সেটা আর বলার মত না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *