০৩. সারাদিন ঝাঁ-ঝাঁ রোদ ছিল

সারাদিন ঝাঁ-ঝাঁ রোদ ছিল। অথচ সন্ধ্যা মেলাবার আগেই মেঘ জমে আকাশ কালো হয়ে গেল। বরকত সাহেব জহিরকে নিয়ে রাস্তায় নামতেই ফোঁটা-ফোঁটা বৃষ্টি পড়তে লাগল। বরকত সাহেব বললেন, বৃষ্টি হলে বাঁচা যায়, কি বল জহির?

জহির চুপ করে রইল। বরকত সাহেব বললেন, অফিসে আমার মাথার ওপরের ফ্যানটা ছিল নষ্ট। গরমে সারাদিন খুব কষ্ট করেছি।

বৃষ্টির ফোঁটা ঘন হয়ে পড়তে শুরু করেছে। বরকত সাহেবের সঙ্গে ছা আছে তবে তিনি ছাতা মেললেন না। আনন্দিত গলায় বললেন, বৃষ্টি যাত্রা খুবই শুভ। তোমার এই বিয়েটা হবে বলে মনে হচ্ছে। যদি হয় তোমার জন্যেও সুবিধা। কাওরানবাজারে মেয়ের নামে ছোট্ট একটা ঘর আছে। ঐখান থেকে রেগুলার ভাড়া পাবে। চল প্রথমে কিছু মিষ্টি কিনে নিই। খালি হাতে যাওয়া ঠিক না।

দুকেজি মিষ্টি কেনা হল। বরকত সাহেব জহিরকে মিষ্টির দাম দিতে দিলেন না। গম্ভীর গলায় বললেন, মিষ্টি তো তুমি নিচ্ছ না। আমি নিচ্ছি। যার বাসায় যাচ্ছি সেই ভদ্রলোক আমার পরিচিত। আমাদের অফিসের পারচেজ অফিসার জব্বার সাহেবের ভায়রা ভাই, মেয়ের বড় খালু।

বরকত সাহেব পনের টাকায় একটা রিকশা নিলেন। বৃষ্টিতে রিকশা করে যাওয়ার। আনন্দই নাকি আলাদা। রিকশায় উঠার পরপর মুষলধারে বর্ষণ শুরু হল। বরকত সাহেব বললেন, ভালো বর্ষণ হচ্ছে, তাই না জহির?

জ্বি মামা।

ইংরেজিতে এই ধরনের বৃষ্টিকে বলে ক্যাটস এন্ড ডগস। কেন বলে কে জানে। তুমি কি ভিজে যাচ্ছ নাকি?

জহির ভিজে যাচ্ছিল, তবু বলল, না।

বরকত সাহেব বললেন, আমি ভিজে যাচ্ছি কেন তা তো বুঝলাম না। কোত্থেকে যেন হুড়হুড় করে পানি ঢুকছে।

 

বরকত সাহেব প্রবল বাতাসের বিপরীতেও সিগারেট ধরালেন। গলার স্বর খানিকটা নামিয়ে বললেন, রিকশা নিয়েছি কারণ তোমাকে কয়েকটা কথা বলা দরকার। বেবিটেক্সিতে গেলে শব্দের যন্ত্রণাতেই কিছু শোনা যেত না।

জহির শংকিত গলায় বলল, কী কথা?

ঐ মেয়ে সম্পর্কে দুএকটা কথা। ওর কিছু ইতিহাস আছে। আমি আগে জানতাম না। আজই জানলাম। মেয়ের বড় খালু বললেন। উনার কাছ থেকে সব শুনে একবার ভাবলাম মেয়ে দেখা ক্যানসেল করে দেই। বাংলাদেশে মেয়ের তো অভাব নেই, তাই না? তারপর চিন্তা করলাম, এর একটা মানবিক দিক আছে। তাছাড়া তুমি যেমন কলসিডারেট ছেলে সব দিক বিবেচনা করে তুমি হয়ত…

ব্যাপারটা কি মামা?

মেয়ের আগে একটা বিয়ে হয়েছিল।

জহির প্রথম ভাবল সে কানে ভুল শুনছে। মেয়ের আগে বিয়ে হয়েছে মানে? এ কেমন কথা? জহির অস্পষ্ট স্বরে বলল, কী বলছেন এসব?

তুমি যা ভাবছ তা না। কাগজে-পত্রে বিয়ে। কাগজে-পত্রে ঠিক না। টেলিফোনে। টেলিফোনে এক সময় বিয়ের খুব চল হল না? ছেলে বিদেশে—মেয়ে দেশে টেলিফোনে বিয়ে হয়ে যায়। তারপর মেয়ে চলে যায় স্বামীর কাছে। ঐ রকম বিয়ে। ছেলে ইউনিভারসিটি অব ওয়াশিংটনে মেরিন বায়োলজিতে পিএইচডি করত। টেলিফোনে বিয়ে হল। মেয়ে চলে যাবে কিন্তু ভিসার জন্যে যেতে পারে না। আমেরিকানরা ভিসা দিতে বড় ঝামেলা করে। ভিসা পেতে লাগল নমাস। যাবার সব ঠিকঠাক, হঠাৎ ছেলের এক টেলিগ্রাম এসে উপস্থিত, মেয়ে যেন না আসে। যা বৃষ্টি! কি বলছি শুনতে পাচ্ছি জহির?

জ্বি পারছি।

যাই হোক, মেয়ের যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। তার সপ্তাহখানেক পর ছেলের চিঠি এসে উপস্থিত। সে এই বিয়েতে আগ্রহী নয়। তাকে যেন ক্ষমা করা হয়। পুরো ব্যাপারটার জন্য সে খুবই লজ্জিত এবং অনুতপ্ত। ক্ষতিপূরণ হিসেবে সে পাঁচ হাজার ডলারের একটা ড্রাফট পাঠাল। মেয়ে অবশ্যি কিছুতেই তা নিবে না। মেয়ের আত্মীয়স্বজনরা মেয়ের কথা শুনল না। কাওরানবাজারে মেয়ের নামে একটা ঘর রাখল।

কতদিন আগের কথা?

বছর দুই। বিনা অপরাধে মেয়েটার শাস্তি হচ্ছে। মেয়েটার আগে বিয়ে হয়েছে এটা শুনেই সবাই পিছিয়ে যায়। কী রকম বিয়ে, কী সমাচার কিছুই জানতে চায় না। জানলেও পিছিয়ে পড়ে। মেয়ের বাবা ক্ষমতাবান হলে ভিন্ন কথা ছিল। বাবা স্কুল মাস্টার। চার পাঁচটা ছেলেমেয়ে, তাই আমি ভাবলাম—তোমার যদি আপত্তি থাকে। তাহলে নাহয় বাদ দাও। তবে আমার কি মনে হয় জান জহির, দুঃখ পাওয়া মেয়ে তো, এ ভালো হবে।

জহির চুপ করে রইল।

তুমি কি মেয়ে দেখতে চাও না?

চাই।

দ্যাটস গুড। মেয়ে পছন্দ হলে বিয়ে করে ফেলা সমস্যায় পড়া একটা পরিবারকে সাহায্য করা হবে। এর ফল শুভ না হয়েই যায় না। তাছাড়া তোমার মন ভালো। এই মেয়ের জন্য একটা ভালো মনের ছেলে দরকার।

 

পল্লবীতে বাড়িটার সামনে তারা যখন রিকশা থেকে নামল তখন দুজনই চুপসে গেছে। পনের টাকায় ঠিক করে আনা রিকশাওয়ালা চাচ্ছে পচিশ টাকা। ইলেকট্রিসিটি চলে গিয়ে চারদিকে ঘন অন্ধকার।

টর্চ লাইট জ্বালিয়ে এক ভদ্রলোক ছাতা হাতে এগিয়ে এলেন। বিনীত গলায় বলতে লাগলেন, বড় কষ্ট হল। আপনাদের বড় কষ্ট হল। গত পাঁচ বছরে এমন বৃষ্টি হয় নাই। ঘরের ভেতরে পানি ঢুকে গেছে ভাইসাব।

বসার ঘরটা ছোট।

এই ছোট একচিলতে ঘরের ভেতর একটা সোফা সেট ছাড়াও একটা খাট। খাটের মাথার দিকে পড়ার টেবিল। পড়ার টেবিলের কোণ ঘেঁষে একটা বুক শেলফ। বুক শেলফের বই দেখে মনে হয় এ বাড়িতে রহস্য-রোমাঞ্চ প্রেমিক কোনো পাঠক আছে। জহির বসেছে কোনার দিকে বেতের চেয়ারে। বুক শেলফের বইয়ের নাম পড়তে চেষ্টা করছেনরপিশাচ, ভয়ংকর রাত, তিন গোয়েন্দার অভিযান, একটি রক্তপিপাসু প্রেতের কাহিনী।

টেবিলের ওপর একটা হারিকেন জ্বলছে। হারিকেন থেকে যত না আলো আসছে। তারচে বেশি আসছে ধোঁয়া। বয়স্ক একজন লোক বিরক্ত গলায় বললেন, হারিকেনটা ঠিক করে দাও না কেন? তের চৌদ্দ বছরের একটি বালিকা হারিকেন ঠিক করতে এসে হারিকেন নিভিয়ে ফেলল। ঘর পুরোপুরি অন্ধকার। ভদ্রলোক বিরক্ত গলায় বললেন, এরা যদি একটা কাজও ঠিকমতো পারে। যাও এই জঞ্জাল নিয়ে যাও এখান থেকে। মোমবাতি আন।

মোমবাতি আনতে দেরি হল। সেই মেয়েটিই মোমবাতি নিয়ে এসেছে। মোমবাতি টেবিলে বসাতে-বসাতে বলল, বাবা ওনাদের খাবার দেওয়া হয়েছে।

বরকত সাহেব বললেন, এখনই খাবার কি? কথাবার্তা বলি।

বয়স্ক ভদ্রলোক বললেন, খাবার বোধহয় বেড়ে ফেলেছে। এরা কোনো কাজ ঠিকমতো করতে পারে না। বললাম ঘন্টাখানিক পরে খাবার দিতে অন্ধকারের মধ্যেই দিয়ে বসে আছে। আসুন চারটা খেয়ে নেই। আসুন, ভেতরে আসুন। আরে গাধাগুলো কি বারান্দায় আলো দেবে না?

তিনজন খেতে বসলেন। জহির, তার মামা এবং বুড়ো এক ভদ্রলোক, যার নাম দিদার হোসেন। ইনিই মেয়ের বড় খালু। খাবার টেবিলের কোনা ঘেঁষে মাথা নিচু করে যে মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে তাকে একপলক দেখে জহির হতভম্ব। এই কি সেই মেয়ে। মানুষ এত সুন্দর হয়! এত স্নিগ্ধ চেহারা কারোর হয়? দ্বিতীয়বার তাকাবার সাহস তার হল না। যদি দ্বিতীয়বার তাকিয়ে দেখে আগের দেখায় ভ্রান্তি ছিল।

 

দিদার হোসেন বিরক্ত গলায় বললেন, কাঠের মতো দাঁড়িয়ে আছ কেন মা। মেহমানদের স্লামালিকুম দাও।

মেয়েটি ক্ষীণ স্বরে বলল, স্লামালিকুম।

দিদার হোসেন বললেন, এর নাম আসমানী। তুমি খাদিমদারি করে তো মা।

লোকজন খাওয়ানোয় মেয়েটি মনে হয় খুবই আনাড়ি। জহির প্লেটে হাত ধুয়েছে, সেই পানি না সরিয়েই আসমানী সেখানে এক হাতা পোলাও দিয়ে লজ্জায় বেগুনি হয়ে গেল।

দিদার হোসেন রাগী গলায় বললেন, এরা কোন একটা কাজ যদি ঠিকমত পারে। এই ছেলে কি পানিভাত খাবে?  জহির আরেক পলক তাকাল মেয়েটির দিকে। বেচারির চোখে পানি এসে যাচ্ছে। জহিরের মনটা মায়ায় ভরে গেল। মেয়েটা জহিরের প্লেটটা সরিয়ে নিতে গেল। ধাক্কা লেগে একটা পানির গ্লাস উল্টে গেল।

দিদার হোসেন তিক্ত মুখে বললেন, এ বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষ গাধা। আসমানী তুই যা তো এখান থেকে।

মেয়েটি পালিয়ে বাঁচল। জহির বুঝতে পারছে রান্নাঘরে ঢুকে এই মেয়েটা হাউমাউ করে কাঁদবে। আহা বেচারি!

দিদার হোসেনের মেজাজ আরো খারাপ হল। কিছুক্ষণ পরপর ছোটখাট বিষয় নিয়ে তিনি হৈচৈ করতে লাগলেন, আচ্ছা লেবু কে কেটেছে। একটা লেবুও কি এরা ঠিকমত কাটতে জানে না? এইসব কী? এটা কি মানুষের বাড়ি না আস্তাবল?

 

রাত দশটায় ফেরার ঠিক আগে আগে বরকত সাহেব বললেন, মেয়ে আমাদের পছন্দ হয়েছে। আমরা একটা আংটি নিয়ে এসেছি। আপনারা যদি অনুমতি দেন তাহলে আংটিটা আসমানী মার হাতে পরিয়ে দিতে পারি।

দিদার হোসেন আনন্দে অভিভূত হয়ে গেলেন। তাঁর চোখে অশ্রু চিকচিক করতে লাগল। যারা খুব সহজে রাগতে পারেন তারা খুব সহজে আনন্দিত হতে পারেন। দিদার হোসন গাঢ় স্বরে বললেন, এই মেয়েটাকে আমি ছোটবেলা থেকে চিনি। সে যে কত ভালো মেয়ে আপনারা যত দিন যাবে তত বুঝবেন। মেয়েটা দুঃখী। দুঃখী মেয়েটাকে আপনি সুখ দিলেন। আল্লাহ আপনার আলো করবে।

আংটি নেবার জন্যে মেয়েটা বসার ঘরে এল। জহিরের খুব ইচ্ছে হচ্ছিল আরেকবার মেয়েটির দিকে তাকাতে। বড় লজ্জা লাগছে। কেউ না দেখে মত সে কি একবার তাকাবে?

জহির তাকাল। আশ্চর্য, মেয়েটিও তাকিয়ে আছে। কী গভীর মায়া, কী গভীর ভালবাসা মেয়েটির চোখে। চোখ দুটি ফোলা-ফোলা।

আহা বেচারি বোধহয় কাঁদছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *