০৩. সাব্লাইম কথাটা

॥ ৩ ॥

‘সাব্লাইম’ কথাটা লালমোহনবাবুকে এই প্রথম ব্যবহার করতে শুনলাম। অবিশ্যি শুধু সাব্লাইম নয়, তার সঙ্গে স্বর্গীয়, হেভেন্‌লি, অপার্থিব অনির্বচনীয় ইত্যাদি বিশেষণ ব্যবহার করে এথিনিয়াম ইস্কুলের কবি মাস্টার বৈকুণ্ঠ মল্লিকের লেখা একটি ছ’লাইনের কবিতা আবৃত্তি করে ফেললেন ভদ্রলোক। ঘটনা আর কিছুই না, দ্বিতীয় দিন ভোরে উঠে ভদ্রলোক তাঁর ঘরের জানালায় দাঁড়িয়েই দেখেন যে সামনে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যাচ্ছে, আর তাতে সবে সূর্যের গোলাপী রঙের ছোপ পড়তে শুরু করেছে। সঙ্গে সঙ্গে ভদ্রলোক আমাকে ঘুম থেকে তুলে এনে তাঁর পাশে দাঁড় করালেন। বললেন, ‘এ জিনিস কারুর সঙ্গে শেয়ার না করলে মজাই নেই।’ আর তার পরেই বিশেষণের তোড়, আর সব শেষে উদাত্ত কণ্ঠে আবৃত্তি করা কবিতা—

‘অয়ি কাঞ্চনজঙ্ঘ!
দেখেছি তোমার রূপ উত্তরবঙ্গে
মুগ্ধ নেত্রে দেখি মোরা তোমারে প্রভাতে
সাঁঝেতে আরেক রূপ, ভুল নেই তাতে—
তুষার ভাস্কর্য তুমি, মোদের গৌরব
সবে মিলে তোমারেই করি মোরা স্তব।’

আবৃত্তি শেষ করে দম নিয়ে বললেন, ‘সম্বোধনে আকারটা একার হয়ে যায় সেটাকে কীভাবে কাজে লাগিয়েছেন কবি, দেখছ তপেশ?’

আমি মাথা নেড়ে বললাম, ‘দেখেছি’, যদিও সংস্কৃত ব্যাকরণটা ভালো জানা নেই বলে ভদ্রলোক ঠিক বলছেন না ভুল বলছেন সেটা বুঝতে পারলাম না।

‘এটাই গ্রেট পোয়েটের লক্ষণ’, বললেন লালমোহনবাবু।

ফেলুদাও অবিশ্যি কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখেছিল, তবে সেটা হোটেলের বাইরে থেকে। ও ভোরে উঠে যোগব্যায়াম সেরে আমি ওঠার আগেই বেরিয়ে পড়েছিল। তারপর ম্যাল থেকে অবজারভেটারি হিলের চারিদিকে চক্কর মেরে চায়ের ঠিক আগে ফিরে এসেছিল। বলল, ‘যতবার কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখি ততবার বয়সটা যেন কিছুটা কমে যায়। আর সব চেয়ে ভাল কথা—যেখানে সেখানে বাড়ি উঠে শহরটার অনেক ক্ষতি করলেও অবজারভেটারি হিলের রাস্তাটার কোনো পরিবর্তন হয়নি।’

‘আমারও আজ প্রথম মনে হল যেন জন্ম সার্থক’, বললেন লালমোহনবাবু।

‘যাক!’ বলল ফেলুদা। ‘এত গাঁজাখুরি গল্প লিখেও যে আপনার সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলো টিকে আছে সেটা জেনে খুব ভালো লাগল।’

‘আজ তাহলে আমরা কী করছি?’

আমরা হোটেলের ডাইনিং রুমে ব্রেকফাস্ট করছিলাম; ফেলুদা কাঁটা দিয়ে ওমলেটের খানিকটা অংশ মুখে পুরে বলল, ‘আজ সকালে একবার মজুমদার মশাইয়ের ওখানে যাবার ইচ্ছে আছে। কাল থেকে ওঁর বাড়িতে শুটিং আরম্ভ হয়ে যাবে, তখন বড্ড ভীড়। আজ মনে হয় নিরিবিলি বসে একটু কথা বলা যাবে। এমন লোককে কালটিভেট করাটা আমি কর্তব্যের মধ্যে ধরি।’

‘তথাস্তু’, বললেন লালমোহনবাবু।

আমরা সাড়ে আটটায় বেরিয়ে পড়লাম। ম্যাল থেকে নেমে দাশ স্টুডিও আর কেভেনটারের পাশ দিয়ে নেহরু রোড ধরে সোজা তিন কোয়ার্টার মাইল গেলে মাউন্ট এভারেস্ট হোটেল। সেটা ছাড়িয়ে গেলেই পাব আমরা মিঃ মজুমদারের বাড়ির রাস্তা।

সেই রাস্তা ধরে কিছুদূর উঠতেই একজন বাঙালি ভদ্রলোককে জিগ্যেস করতে উনি বলে দিলেন যে আর মিনিট খানেক হাঁটলেই আমরা নয়নপুর ভিলাতে পৌঁছে যাব।

বাড়ি খুঁজে পেতে কোনই অসুবিধা হল না। লাল টালির ছাদওয়ালা কাঠের বাংলো বাড়ি, বেশ ছড়ানো, তিনদিক ঘিরে রয়েছে সুন্দর বাগান, আর পিছনে পূবদিকে ঘন ঝাউবনের পরেই উঠেছে খাড়াই পাহাড়।

বাগানে একটা মালি কাজ করছিল, সে আমাদের দেখেই এগিয়ে এল।

‘মিঃ মজুমদার আছেন?’ জিগ্যেস করল ফেলুদা।

‘কী নাম বলব?’

‘বল যে কাল যাঁর সঙ্গে সন্ধ্যায় আলাপ হয়েছিল সেই মিত্তিরবাবু দেখা করতে এসেছেন।’

মালি খবর দিতে চলে গেল। আমি অবাক হয়ে বাড়িটার শোভা দেখছিলাম। উত্তরে চাইলেই সোজা কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যাচ্ছে। এখন ঝলমলে রুপোলি। যিনিই বাড়িটা বানিয়ে থাকুন, তাঁর রুচির তারিফ করতে হয়।

মালির পিছন পিছন দেখি মিঃ মজুমদার নিজে বেরিয়ে এসেছেন।

‘গুড মর্নিং! আসুন আসুন, ভিতরে আসুন!’

আমরা তিনজন বাড়ির নাম লেখা সাদা কাঠের গেট খুলে ভিতরে এগিয়ে গেলাম। ভদ্রলোক এককালে বেশ সুপুরুষ ছিলেন সেটা দিনের আলোতে দেখে বুঝতে পারছি। দেখে অসুস্থ বলে মনেই হয় না। মিঃ মজুমদারের সঙ্গে আরেকজন ভদ্রলোক বেরিয়ে এসেছিলেন, জানলাম তিনিই হলেন সেক্রেটারি রজত বসু। খয়েরি ট্রাউজারের উপর গাঢ় নীল পোলো-নেক পুলোভার পরেছেন, মাঝারি হাইট, রং বেশ পরিষ্কার।

আমাদের বৈঠকখানায় নিয়ে গেলেন মিঃ মজুমদার। আমরা ভাগাভাগি করে দুটো সোফায় বসলাম। ঘরের এক পাশে একটা কাচের আলমারিতে গুচ্ছের ছোটবড় রুপোর কাপ সাজানো রয়েছে। বোঝা যায় সেগুলো মিঃ মজুমদার নানান সময়ে নানান স্পোর্টস প্রতিযোগিতাতে পেয়েছেন। মাটিতে একটা লেপার্ডের ছাল, আর দেয়ালে দুটো হরিণ আর একটা বাইসনের মাথাও দেখলাম।

‘আজ সন্ধ্যায় আমার ছেলে সমীরণ আসবে’, বললেন বিরূপাক্ষ মজুমদার। ‘বাপ-ছেলের মধ্যে কোনো মিল খুঁজে পাবেন বলে মনে হয় না। সে ব্যবসাদার, শেয়ার মার্কেটে ঘোরাঘুরি করে।’

‘তিনি কি ছুটিতে আসছেন, না কোনো কাজে?’

‘সাতদিনের ছুটিতে। অন্তত বলছে ত তাই, তবে ও চুপচাপ বসে ছুটি ভোগ করার ছেলে নয়। ভয়ানক ছটফটে। ত্রিশ হতে চলল, এখনো বিয়ে করেনি। আর কবে করবে জানি না। যাকগে—এখন আপনাদের কথা বলুন।’

‘আমরা বরং আপনার কথা শুনতে এসেছি,’ বলল ফেলুদা।

‘আমার কথার ত শেষ নেই,’ বললেন মিঃ মজুমদার। ‘আই হ্যাভ লেড এ ভেরি কালারফুল লাইফ। অবিশ্যি পরের দিকে সেটল করে গিয়েছিলাম। একটা ব্যাঙ্কের পুরো দায়িত্ব এসে পড়ে আমার ঘাড়ে। স্বভাবতই তখন অনেকটা সামলে নিতে হয়। তরুণ বয়সটা—শুধু তরুণ কেন, প্রায় চল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত—খুব হৈ-হুল্লোড় করেছি। খেলাধুলো, আউটডোর-ইনডোর, শিকার, কিছুই বাদ দিইনি।’

‘আর তার সঙ্গে আপনার কাটিং জমানোর হবি।’

‘হ্যাঁ, সেটা কখনো বাদ পড়েনি। রজত আপনাকে একটা নমুনা দেখিয়ে দেবে।’

ভদ্রলোক সেক্রেটারির দিকে ইঙ্গিত করাতে তিনি উঠে গিয়ে ভিতরের ঘর থেকে একটা মোটা বড় খাতা এনে ফেলুদার হাতে দিলেন। আমি আর লালমোহনবাবু উঠে গিয়ে ওর পাশে দাঁড়ালাম।

বিচিত্র খাতা, তাতে সন্দেহ নেই।

‘আপনি দেখছি লণ্ডনের কাগজ থেকেও কাটিং রেখেছেন,’ বলল ফেলুদা।

‘হ্যাঁ, বললেন বিরূপাক্ষ মজুমদার। ‘লণ্ডনে আমার এক ডাক্তার বন্ধু আছে। তাকে বলাই আছে—কোনো সেনসেশন্যাল খবর পেলেই যেন আমাকে কেটে পাঠিয়ে দেয়।’

‘খুন রাহাজানি অ্যাক্সিডেন্ট অগ্নিকাণ্ড আত্মহত্যা—কিছুই বাদ নেই দেখছি।’

‘তা নেই’, বললেন মিঃ মজুমদার।

‘কিন্তু আপনি কী একটা ক্রাইমের কথা বলেছিলেন যেটার কোনো কিনারা হয়নি?’

‘হ্যাঁ—তেমন একটা ক্রাইম আছে বটে। সেটার খবর আপনি খাতায় পাবেন; আর আরেকটি আছে যেটা খাতায় পাওয়া যাবে না, কারণ সেটা খবরের কাগজের কানে পৌঁছায়নি।’

‘সেটা কী ব্যাপার?’

‘সেটা আমায় জিগ্যেস করবেন না, কারণ তার উত্তর আমি দিতে পারব না। আমায় মাপ করবেন। যাই হোক, রজত—একবার যাও তো সিক্সটি নাইনের ভলুমটা নিয়ে এস।’

রজতবাবু এবার আরেকটা খাতা নিয়ে এসে ফেলুদাকে দিলেন।

‘খাতার মাঝামাঝি পাবেন খবরটা’, বললেন মিঃ মজুমদার। ‘জুন মাসে ঘটে ঘটনাটা। স্টেটসম্যানের খবর, হেডিং হচ্ছে, যতদূর মনে পড়ে—“এমবেজ্‌লার আনট্রেসড”।’

‘পেয়েছি’, বলল ফেলুদা। তারপর খানিকদূর পড়েই বলল, ‘এ যে দেখছি আপনাদেরই ব্যাঙ্কের ঘটনা!’

‘সেই জন্যেই ত ওটা ভুলতে পারি না’, বললেন মিঃ মজুমদার। ‘পড়লেই বুঝতে পারবেন, আমাদেরই ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্টের একটি ছেলে, নাম ভি. বালাপোরিয়া, প্রায় দেড়লাখ টাকা ব্যাঙ্ক থেকে হাতিয়ে উধাও হয়ে যায়। পুলিশ বিস্তর চেষ্টা করেও তার আর সন্ধান পায়নি। আমি তখন ছিলাম ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার।’

ফেলুদা বলল, ‘যদিও অনেকদিনের ঘটনা, তাও আমার ব্যাপারটা আবছা আবছা মনে আছে। গোয়েন্দা হবার আগে এই ধরনের ক্রাইমের খবর আমিও খুঁটিয়ে পড়তাম।’

ক্রাইমের খবর আমিও খুঁটিয়ে পড়তাম

ইতিমধ্যে লালমোহনবাবু আর আমিও খবরটা পড়ে ফেলেছি।

বিরূপাক্ষবাবু বললেন, ‘তখনই আমার একবার মনে হয়েছিল যে শার্লক হোম্‌স বা এরক্যুল পোয়ারোর মতো একজন প্রাইভেট গোয়েন্দা থাকলে হয়ত ব্যাপারটার একটা সুরাহা হত। পুলিশের উপর আমার নিজের যে খুব একটা আস্থা আছে তা নয়।’

ফেলুদা কিছুক্ষণ খাতাটা উল্টে-পাল্টে দেখে ধন্যবাদ দিয়ে ফেরত দিয়ে দিল।

ইতিমধ্যে কফি এসে গেছে। বেয়ারাটির বেশ ভদ্রচেহারা, হঠাৎ দেখলে চাকর বলে মনে হয় না। আমরা ট্রে থেকে কফি তুলে নিলাম।

ফেলুদা বলল, ‘বাইরে আপনার ঘোড়াটা দেখলাম; আপনি বুঝি ওটাতেই চলা-ফেরা করেন?’

মিঃ মজুমদার বললেন, ‘চলা-ফেরা মানে আমি শুধু বিকেলে একবার বেরোই। বাকি সময়টা আমি বাড়িতেই থাকি। আমার অভ্যাসগুলো ঠিক সাধারণ মানুষের মতো নয়। রিটায়ার করার পর থেকে আমার রুটিনটা একটা অদ্ভুত চেহারা নিয়েছে। আমার ইনসম্‌নিয়া আছে সে কথা আগেই বলেছি। আমি ঘুমোই দুপুরবেলা, তাও এক গেলাস দুধের সঙ্গে একটা করে বড়ি খেয়ে। ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে শুই, উঠি ঠিক পাঁচটায়। তারপর চা খেয়ে বেরোই। রাত্তিরটা আমি বই পড়ি।’

‘একদমই ঘুমোন না রাত্রে? ফেলুদা অবাক হয়ে জিগ্যেস করল।

‘একদমই না’, বললেন ভদ্রলোক। ‘অবিশ্যি, এককালে আমার ঠাকুরদাদারও শুনেছি এই বাতিক ছিল। তিনি ছিলেন ডাকসাইটে জমিদার। তাঁর রাতটা ছিল দিন, আর দিনটা রাত। জমিদারীর কাজকর্ম তিনি রাত্রেই দেখতেন, আর সারা দুপুর আফিং খেয়ে ঘুমোতেন। ভালো কথা, আপনার ধূমপানের প্রয়োজন হলে আমার সামনেই করতে পারেন; আই ডোন্ট মাইণ্ড।’

‘থ্যাঙ্ক ইউ’, বলে ফেলুদা একটা চারমিনার ধরাল। বিরূপাক্ষবাবুর ষাটের কাছে বয়স হলেও তাঁকে বৃদ্ধ বলে মোটেই মনে হয় না।

‘কাল থেকে ত আপনার বাড়িতে শুটিং শুরু হবে’, বলল ফেলুদা। ‘আপনার উপর দিয়ে অনেক ধকল যাবে।’

‘আই ডোন্ট মাইণ্ড’, বললেন ভদ্রলোক। আমি থাকব বাড়ির উত্তরপ্রান্তে, কাজ হবে দক্ষিণ দিকটায়। পরিচালক ভদ্রলোকটিকে বেশ ভালো লাগল, তাই আর না করলাম না।’

এই কথা বলতে বলতেই একটা জীপের আওয়াজ পেয়ে ঘুরে দেখি ফিল্মের দল এসে গেছে। বাগান পেরিয়ে দরজার মুখে এসে টোকা মারলেন পুলক ঘোষাল।

‘কাম ইন স্যার’, বলে উঠলেন বিরূপাক্ষ মজুমদার।

পুলক ঘোষাল ঢুকে এলেন, তাঁর পিছনে মহাদেব ভার্মা আর রাজেন রায়না।

‘আমরা শুটিং-এ বেরোচ্ছি’, বলল পুলক ঘোষাল, ‘তাই ভাবলাম একবার আপনার সঙ্গে দেখা করে যাই। কাল থেকে ত আপনার এখানেই কাজ, তাছাড়া এই দুটি অভিনেতার সঙ্গে আপনার আলাপও হয়নি। ইনি হলেন ছবির নায়ক রাজেন রায়না, আর ইনি হলেন ভিলেন মহাদেব ভার্মা।’

‘বসুন, বসুন’, বললেন মিঃ মজুমদার। ‘যখন এলেন তখন একটু কফি খেয়ে যান!’

‘না স্যার! আজ আর বসব না। কাল থেকে ত প্রায় সারাটা দিনই এখানে থাকতে হবে। ভালো কথা, আপনার সেক্রেটারি বলছিলেন আপনি নাকি দুপুরটা ঘুমোন। তা, দুপুরে ত আমাদের কাজ হবে, এ বাড়ি থেকে একটু দূরে আমাদের জেনারেটর চলবে। তাতে আপনার ব্যাঘাত হবে না ত?’

‘মোটেই না,’ বললেন মিঃ মজুমদার। ‘আমি দরজা জানালা ভেজিয়ে পর্দা টেনে শুই। বাইরের কোনো আওয়াজ ঘরে ঢোকেই না।’

লক্ষ করছিলাম ভদ্রলোক কথা বলার সময় রায়না আর ভার্মার দিকে তীক্ষ দৃষ্টি দিয়ে দেখছেন। বললেন, ‘যাক, এবার তাহলে বলতে পারব যে ফিল্মস্টারের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। অ্যাদ্দিন এ সৌভাগ্যটা হয়নি।’

এবার পুলক ঘোষাল লালমোহনবাবুর দিকে ফিরলেন।

‘লালুদা, আপনাকে একটা রিকোয়েস্ট ছিল।’

‘কী ভাই?’

‘আমার মেমরি খুব শার্প, লালুদা। আমার স্পষ্ট মনে আছে নাইনটিন সেভেনটিতে গড়পারে ফ্রেণ্ডস ক্লাবে “ভূশণ্ডীর মাঠে” প্লে হয়েছিল। সরস্বতী পুজোয়। আপনার মনে পড়ছে?’

‘বিলক্ষণ!’

‘আপনি তাতে নদু মল্লিকের পার্ট করেছিলেন, মনে আছে?’

‘বাবা, সে কি ভুলতে পারি! পাখোয়াজের বোলটা পর্যন্ত এখনো মনে আছে—ধা ধা ধিন্‌তা কত্তা গে, গিন্নী ঘা দেন কর্তাকে!—ওঃ! সে কি ভোলা যায়? জীবনে আমার প্রথম এবং শেষ অভিনয়।’

“না না, শেষ নয়।’

‘মানে?’

‘এখানকার বেঙ্গলী ক্লাব আমাদের ডুবিয়েছে। বলেছিল দু-একটা ছোট পার্টের জন্য লোক দেবে, এখন বলছে তারা কলকাতায় চলে গেছে ছুটিতে। বিশেষ করে একটি পার্ট—বুঝেছেন লালুদা, ভিলেনের রাইট হ্যাণ্ড ম্যান—’

‘কে—অঘোরচাঁদ বাটলিওয়ালা?’

‘হ্যাঁ দাদা!’

‘কিন্তু তার ত বেশি কিছু করার নেই; শুধু দুটো সীন।’

‘সেই দুটো সীন আমাদের একটু উদ্ধার করে দিতে হবে দাদা! কথা খুব কম। আজ বিকেলে গিয়ে আপনাকে ডায়ালগ দিয়ে আসবে। এ কাজটা কাইণ্ডলি আপনি করে দিন। সবশুদ্ধ তিনদিনের কাজ।’

‘আমরা কিন্তু আর দশদিন মাত্র আছি।’

‘এক উইকের মধ্যে আপনার কাজ শেষ করে দেব।’

‘কিন্তু এই চেহারা নিয়ে—’

‘আপনাকে মেক-আপ দেবো। ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি আর একটা পরচুলা। ফার্স্টক্লাস মানাবে। কেয়া ভাই মহাদেব, মেরা চয়েস মে কুছ গলতি হ্যায়?’

‘নেহী নেহী ভাই’, বললেন মহাদেব ভার্মা।

‘আপনার সিগার খাওয়ার অভ্যেস আছে?’ লালমোহনবাবুকে জিগ্যেস করলেন পুলক ঘোষাল।

‘ধূমপান করতুম এককালে’, হাত কচলাতে কচলাতে বললেন লালমোহনবাবু, ‘কিন্তু সিগারেট ছেড়েছি দশ বছর হল।’

‘তাতে কী হল? হাতে একটা জ্বলন্ত সিগার রাখবেন; সেটায় দু-একটা টান দিলেই হবে। আর হ্যাঁ, চোখে একটা কালো চশমা।’

বেশ বুঝতে পারছিলাম যে লালমোহনবাবু ব্যাপারটাতে ক্রমেই মেতে উঠছিলেন। এবার বললেন, ‘ওক্কে! যখন এত করে বলছ তখন না করব না। আমার নিজের গল্পে একটা গেস্ট অ্যাপিয়ারেন্স মন্দ কী? কিন্তু একটা কথা।’

‘কী?’

‘আমার নামের পাশে যেন একটা “অ্যাঃ” থাকে। পেশাদারী অভিনেতা হতে আমি নারাজ। হলে অ্যামেচার, আর না হলে নয়। ঠিক ত?’

‘ওক্কে!’ বললেন পুলক ঘোষাল।

এই সুযোগে আমিও একটা ব্যাপার সেরে নিলাম। পুলক ঘোষালকে জিগ্যেস করলাম, ‘আমি শুটিং দেখতে আসতে পারি ত?’

‘একশোবার, ভাই, একশোবার’, বললেন পুলক ঘোষাল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *