সাদা পাজামা আর তাঁতের পাঞ্জাবি পরা, তার ওপর একটা গরম হাফ-কোট, আর মুখে পাইপ নিয়ে শেখ মুজিব বসে আছেন তাঁর বত্রিশ নম্বর ধানমণ্ডির বাড়িতে, বসবার ঘরে। সারাদিন ধরে মানুষজন আসার বিরাম নেই, আসছে অজস্র মিছিল, পাটিকর্মী ও শুভার্থীরা ঘিরে বসে আছে তাঁকে। কথা বলতে বলতে শেখ সাহেবের মুখে ফেনা উঠে আসছে। তাঁর পাশেই সাদা পাজামা ও পাঞ্জাবির ওপর একটা শাল জড়িয়ে বসে আছেন তাজুদ্দীন, তাঁর মুখে অজস্র চিন্তার রেখা, থুতনিতে একটা আঙুল। এক এক সময় ক্লান্ত হয়ে গিয়ে শেখ মুজিব অত্যুৎসাহীদের বলছেন, তোমরা তাজুদ্দীন সাহেবের সাথে কথা কও, আমারে একটু চিন্তা করতে দাও।
দুদিন আগেই “স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ” এবং “স্বাধীন বাংলা শ্রমিক সংগ্রাম পরিষদ” প্রতিরোধ দিবস পালন করেছে। দেশের জনসাধারণ এখন উত্তাল। শেখ মুজিবের ঐ দোতলা বাড়ির ছাদে শস্যশ্যামলা বাংলার প্রতীক সবুজের পটভূমিতে, শহীদের রক্তে রাঙা সূর্যের প্রতীক লাল বৃত্তের মধ্যে, সোনালি রঙে পূর্ববাংলার মানচিত্র আঁকা এক নতুন পতাকা। শ্রমিক নেতা আবদুল মান্নান ঐ একই রকম আর একটি পতাকা তুলে দিয়েছে বাড়ির সামনে। এই বাড়ি এখন ছাত্র, শ্রমিক, বুদ্ধিজীবীদের এক বৃহৎ অংশের আশা-আকাঙ্ক্ষার কেন্দ্র।
শেখ মুজিবের মুখে, চোখে, ভুরুতে নিদারুণ অস্বস্তি। স্বাধীন বাংলা! পাকিস্তান কি ইতিমধ্যেই ভেঙে পড়েছে? পাকিস্তান ভাঙা কি এতই সহজ? তা ছাড়া, কেনই বা তিনি। পাকিস্তান ভাঙতে চাইবেন এখন! ছয় দফা দাবীর জয় হয়েছে, এবারের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবার পর বাঙালী মুসলমানের হাতে শাসন ক্ষমতা না দিয়ে ইয়াহিয়া খান যাবে কোথায়? শেখ মুজিব গোটা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রিত্ব পেলে তিনি পাকিস্তান ভাঙতে যাবেন কেন?
ছাত্ররা ছয় দফার থেকেও বাড়িয়ে এগারো দফা দাবী তুলেছে। স্বাধীন বাংলা, স্বাধীন বাংলা রব উঠেছে চতুর্দিকে। সামরিক শাসকদের হাত থেকে দেশের অর্ধেক অংশ ছিনিয়ে নেওয়া কি মুখের কথা? তিনি প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন, কিন্তু বাংলার মাটির দুর্গ পশ্চিম পাকিস্তানীদের কামানের মুখে কতক্ষণ টিকবে? শুধু মনের জোর দিয়ে কি রাইফেল-বোমার বিরুদ্ধে লড়া যায়? তিনি পূর্ব পাকিস্তানে শতকরা আটানব্বই ভাগ ভোট পেয়েছেন ঠিকই, কিন্তু যদি সত্যি লড়াই লাগে তাহলে কি এ দেশের সব মানুষ তাঁর পিছনে। এসে দাঁড়াবে? যদি লড়াই লাগে…সে লড়াই কতদিন ধরে চলবে ঠিক নেই, কত লক্ষ লক্ষ প্রাণ বিনষ্ট হবে, সে দায়িত্ব তিনি একা নেবেন?
পার্টির উগ্রপন্থী সদস্যরা তাঁকে বারবার বলছে ইয়াহিয়া-ভুট্টো চক্রের সঙ্গে আলোচনায় আর যোগ না দিতে। অযথা কথা বাড়িয়ে, দেরি করিয়ে দেবার কৌশলে ওরা পশ্চিম পাকিস্তান। থেকে আরও সেনা আনাচ্ছে। কিন্তু শেখ মুজিব এখনও চূড়ান্ত বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। তাঁর এখনও ধারণা, ইয়াহিয়া খান লোকটা আইয়ুবের মতন কুটকৌশলী নয়, এর চক্ষুলজ্জা আছে, নির্বাচনের ফলাফলকে এই সেনাপতি মর্যাদা দেবে। আলাপ, আলোচনা এখনো একেবারে অন্ধ গলিতে পৌঁছোয়নি, আজ রাত্রেই একটা কিছু হেস্তনেস্ত হয়ে যেতে পারে।
মাঝখানে বেশ গরম পড়ে গিয়েছিল, আজ আবার একটু শীত শীত ভাব। থমথম করছে। বাতাস। প্রত্যেকটি মানুষের মুখে কী হয় কী হয় ভাব। আজ সারাদিন ধরেই একটা গুজব চতুর্দিকে ঘুরছে যে যে-কোনো মুহূর্তেই মিলিটারি এসে আওয়ামী লীগের সব নেতা এবং ছাত্র নেতাদের বন্দী করবে!
সকাল থেকে পঞ্চান্নটি মিছিল এসেছে শেখ সাহেবের কাছে, তার মধ্যে শুধু মহিলাদেরই মিছিল ছিল ছটা। সকলেরই এক কথা, এবারে কিছুতেই সামরিক শাসকগোষ্ঠীর কাছে নতি স্বীকার করা হবে না। শেখ মুজিব অভিভূত হয়ে পড়ছেন। দৃঢ় ভাষায় তাদের ভরসা দিতে গিয়েও তাঁর কণ্ঠস্বর কেঁপে যাচ্ছে। যদি সত্যিই রাষ্ট্রবিপ্লব বেঁধে যায়, কোন কোন দেশ সাহায্য করবে, কারা অস্ত্র দেবে? যদি কেউ না দেয়? যদি ইণ্ডিয়াও দোনামনা করে? তা হলে কামানের মুখে ছাতু হয়ে যাবে এই সব সরল, তেজী, আদর্শবাদী ছেলে-মেয়েগুলো! না, শেখ মুজিব এখনও আলোচনার টেবিলে বসে সমাধান সূত্র খুঁজতে চান। খানিকবাদেই ইয়াহিয়ার সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎকারের সময় নির্দিষ্ট আছে।
হুড়মুড় করে একদল ছাত্রলীগ জঙ্গী বাহিনীর ছেলে ঢুকে পড়লো ঘরের মধ্যে। তাদের মুখপাত্র হয়ে কামরুল আলম খসরু বললো, মুজিবভাই, আপনি আন্ডার গ্রাউন্ডে চলুন। আপনার এখন বাড়িতে থাকা ঠিক হবে না।
মুখ থেকে পাইপটা নামিয়ে শেখ মুজিব প্রবল ভাবে মাথা নাড়লেন।
তারপর বললেন, তোরা তৈরি হ-গে যা! আমার জন্য ভাবিস না। আমার আর কী করবে, বড় জোর ধরে নিয়ে যাবে। তা বলে আমি চোরের মতন পালিয়ে যেতে পারি না। তা ছাড়া আমি পালিয়ে গেলে আমার খোঁজে ওরা সাধারণ মানুষের ওপর অত্যাচার চালাবে, বাড়ি ঘর পুড়ায়ে দেবে। আমার লোকদের আমি বিপদের মুখে ফেলে রেখে পালিয়ে যেতে পারি না।
কিছুক্ষণ তর্কাতর্কি হলো, কিন্তু শেখ মুজিব অনড়। তিনি আলোচনার শেষ দেখতে চান!
ছাত্রদলের সঙ্গে সিরাজুলও বেরিয়ে এলো বাইরে। একজন কেউ বললেন, আচ্ছা শেখ সাহেব তো গোঁয়ারের মতন বসে থাকবেনই ঠিক করেছেন, কিন্তু ভাবী আর ছেলেমেয়েদের এখান থেকে সরিয়ে দেওয়া উচিত না? সংগ্রাম শুরু হলে এই বাড়িই তো ফাস্ট টার্গেট হবে।
সিরাজুল আবার ভেতরে খবর নিতে গেল। ফিরে এসে জানালো যে ভাবী আর পরিবারের অন্য সবাই শামিবাগে এক আত্মীয়ের বাড়িতে চলে গেছেন।
এবার ওরা চললো জহুরুল হক হলের দিকে। তার আগে, মধুর ক্যান্টিনে ছাত্র লীগের মিটিং আছে রাত এগারোটায়।
পাকিস্তানের ভাবমূর্তির স্রষ্টা কবি ইকবালের নামে ছিল ছাত্রদের একটি হস্টেল, ইকবাল হল। ছাত্ররা সেই নাম বদলে দিয়েছে। সামরিক বাহিনীর সাজানো আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবের মতনই আর একজন আসামী ছিলেন সার্জেন্ট জহুরুল হক। বিচার শেষ হবার আগেই কারাগারের মধ্যে নৃশংস ভাবে হত্যা করা হয় এই সৎ মানুষটিকে। ছাত্ররা তাই তাঁকে স্মরণীয় করেছে ইকবালের নাম মুছে দিয়ে।
জিন্নার নামে যে রাস্তা, সে রাস্তার নামও পাল্টে সূর্য সেনের নামে রাখার দাবী তুলেছে। ছাত্ররা।
–মধুদা, পাঁচ কাপ চা!
অন্যরা এখনো আসেনি। সাজাহান, সিরাজ ও নজরুল ইসলাম না এলে মিটিং শুরু করা যাবে না। চা খেতে খেতে কাদের জিজ্ঞেস করলো, এই সিরাজুল, তুই যার বাসায় থাকোস, সেই বাবুল মিঞা এক আর্মির মেজরের কোয়ার্টারে যাতায়াত করে ক্যান রে?
সিরাজুল কিছু উত্তর দেবার আগেই অন্য একজন বললো, মদ-মুদ গেলতে যায় বোধ হয়! আমাগো প্রফেসরদের মধ্যে বেশ কয়েকজন আছে ফিফথ কলামনিস্ট!
কাদের বললো, কিন্তু বাবুল চৌধুরীরে ভালো মানুষ বইলাই জানতাম। মদ তো খাইতো না আগে, সিগারেট টানতে দেখি নাই। হ্যাঁর পোশাক-পরিচ্ছদের মতন মানুষটাও ক্লিন আছিল।
–আলতাফের ছোট ভাই তো! ঐ আলতাফের পত্রিকা এই ইলেকশানের সময় আওয়ামী লীগকে সাপোর্ট করে নাই। হেই কাগজের মালিক ঐ হোটেলওয়ালা হোসেন মিএ আওয়ামী লীগের ক্যান্ডিডেটের এগেইনস্টে কনটেস্ট করছিল। ওরা সব কয়টাই দুই নম্বরী!
–আমি বাবুল চৌধুরীর কাছে পড়ছি। এমনিতে তো মার্কসিস্ট, অথচ আর্মির সাপোটার, কিছুদিন আগেই চীনা ঘুইরা আসলো।
–ঐসব ফরেন ট্রিপের লোভেই তো আমাগো তথাকথিত ইনটেলেকচুয়ালরা আর্মির ধামা ধরে। এইসব কয়টা হারামখোররে একদিন খতম করতে হবে!
–কী রে, সিরাজুল, চুপ কইরা আছেস ক্যান? বাবুল চৌধুরীর নুন খাইছোস, তাই কিছু বলবি না।
সিরাজুল মাথা নীচু করে রইলো। বাবুল চৌধুরীকে এক সময় সে পীরপয়গম্বর মতন ভক্তি শ্রদ্ধা করতো। এই মানুষটির জন্য সে মনিরাকে নিয়ে গ্রাম থেকে চলে আসতে পেরেছে। ঢাকা শহরে আশ্রয় পেয়েছে। বিদ্বান ও নিখুঁত ভদ্রতার প্রতিমূর্তি বাবুল চৌধুরী ছিল তার আদর্শ সেই বাবুল চৌধুরী তার শ্রদ্ধার আসন থেকে কত নীচে নেমে এসেছেন!
সারাদেশ যখন শেখ মুজিবের নামে রোমাঞ্চিত হচ্ছে, তখনও বাবুল চৌধুরী উঠতে বসতে শেখ সাহেবের নামে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করে। জামাতে ইসলামীদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে সে বলে যে। ছয় দফা হলো পাকিস্তান ভাঙার ষড়যন্ত্র। আওয়ামী লীগ ভারতের টাকা খায়, ইন্দিরা গান্ধীর অঙ্গুলি হেলনে এই পার্টি পাকিস্তানের সর্বনাশ করছে। আর্মি যে ইস্ট পাকিস্তানের ওপর অনবরত দুরমুশ চালাচ্ছে, এই মার্চ মাসেই কত ছাত্রকে গুলি করে মেরে ফেললো, সে সম্পর্কে বাবুল চৌধুরীর কোনো প্রতিবাদ নেই। এখনও নির্লজ্জের মতন তার বন্ধু এক ওয়েস্ট পাকিস্তানী মেজরের বাড়িতে খানাপিনা করতে যায় নিয়মিত। কেউ কেউ বলে, সেই মেজরের। স্ত্রীর সাথে নাকি বাবুল চৌধুরীর গোপন আশনাই আছে।
মঞ্জু ভাবীর মতন অমন চমৎকার এক মহিলা, তাকেও খুব কষ্ট দিচ্ছে বাবুল চৌধুরী। প্রায়ই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি; মঞ্জু ভাবী রাগ করে চলে যায় বাপের বাড়ি। আর ঐ আলতাফ, সেটা তো একটা শয়তান। সে মনিরার ওপর কুদৃষ্টি দিয়েছে।
সিরাজুল বললো, না, আমি বাবুল চৌধুরীর নুন খাই নাই। উনি বাসায় থাকতে দিয়েছেন ফ্রিতে, সেটা ঠিক, কিন্তু কোনোদিন আমি তার কাছ থেকে এক আধলাও সাহায্য নিই নাই। এবার ও বাসা ছেড়ে দেবো!
হঠাৎ দূরে পর পর কয়েকটা বিকট শব্দ হতেই ওরা কথা থামিয়ে উকর্ণ হলো। মেশিন গানের আওয়াজ! এখন গুলি চলছে কোথায়? এখন তো প্রেসিডেন্টের সঙ্গে শেখ সাহেব ও ভুট্টোর মিটিং চলার কথা।
কাদের উঠে গিয়ে বাইরে উঁকি মেরে দেখলো, রাস্তায় লোকজন ছুটোছুটি করছে। আরও কয়েকবার গুলির আওয়াজ শোনা গেল। মন্টু নামে একটা ছেলে দৌড়াতে দৌড়োতে এসে বললো, আইস্যা পড়ছে। আইস্যা পড়ছে! আমি, আর্মি!
এবার শোনা গেল মেঘ গর্জনের মতন গুরু গুরু ধ্বনি! ট্যাঙ্ক বেরিয়েছে মনে হচ্ছে। লোকজন দুপদাপিয়ে পালাচ্ছে। আর এখানে থাকার কোনো মানে হয় না। চায়ের দাম টেবিলের ওপর রেখে সিরাজুল বললো, মধুদা, তুমিও দোকান বন্ধ করে দাও। জগন্নাথ হলে চলে যাও।
জহুরুল হলে দোতলার একটি ঘরে কিছু বোমা ও কয়েকটি থ্রি ও থ্রি রাইফেল জড়ো করে। রাখা আছে। পুলিশই হোক আর আমিই হোক, তাদের কিছুতেই হলের মধ্যে ঢুকতে দেওয়া হবে না। সিরাজুলরা এসে দেখলো কিছু ছেলে হল ছেড়ে পালাচ্ছে। কাদের তাদের ধমক দিতে লাগলো। হলে একসঙ্গে এত ছেলে থাকতে ভয়ের কী আছে? কয়েকজন তবু পালিয়ে গেল, কয়েকজন ফিরলো।
সিরাজুলরা পজিশন নিল দোতলার ঘরটায়। এখনও তারা ব্যাপারটা বুঝতে পারছে না। এত তাড়াতাড়ি কি আলোচনা ভেঙে গেল? শেখ সাহেব বলছিলেন, কাল থেকেই মাশাল ল তুলে নেবার খুবই সম্ভাবনা। তা হলে আজ রাত্তিরে রাস্তায় আর্মি বেরুবে কেন?
প্রচণ্ড শব্দে একটা শেল এসে পড়লো খুব কাছাকাছি। তারপর আর একটা। কামান থেকে গোলা দাগছে? জানলা দিয়ে আর্মির গাড়ি বা কিছুই দেখা গেল না। কাদের একটা খারাপ গালাগাল দিয়ে ছুঁড়ে মারলো পর পর দুটো বোমা। তারপরই শুরু হলো বৃষ্টির মতন গুলিবর্ষণ।
বিপদের গুরুত্বটা এখনো ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। হঠাৎ রাত্তিরবেলা ছাত্রদের মারতে আসবে কেন আর্মি? আজ তো ছাত্ররা কোনো বিক্ষোভ দেখায় নি। কেউ কোনো ভুল অর্ডার দিয়েছে? বাইরে গুলি-গোলার আওয়াজ, হলের মধ্যে চিৎকার করছে ছেলেরা। ঝনঝন শব্দে ভাঙছে জানলার কাঁচ। ট্যাঙ্ক থেকে গোলা ছুঁড়ছে, পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে শব্দ, একদিকের। দেয়াল ভেঙে পড়লো হুড়মুড় করে। সিরাজুল লাফিয়ে সরে এলো সেদিক থেকে।
প্রথমে লুটিয়ে পড়লো কাদের, তারপর মন্টু। কাদের যে মরে যেতে পারে তা বিশ্বাসই করতে পারছে না সিরাজুল। এক মিনিট আগে ও লাফিয়ে লাফিয়ে চিৎকার করে যে খানসেনাদের চোদ্দ পুরুষ উদ্ধার করছিল, একটা গুলিতেই সে শেষ হয়ে গেল? কাঁদেরের নিস্পন্দ শরীরটা ধরে পাগলের মতুন ঝাঁকাতে লাগলো সিরাজুল।
কে যেন তাকে জোর করে টেনে নিয়ে গেল সে ঘর থেকে। হলের মধ্যে ছাত্রদের গুলি করে মারবে। যে-কোনো ছাত্রকে!
এখন আর বাইরে বেরুবার উপায় নেই, হুড়োহুড়ি করে ছেলেরা চলে যাচ্ছে ছাদে। ছাদে এসে গোলা পড়লে তারা আবার নেমে আসছে নিচে, কে যে কোথায় যাবে তা ঠিক করতে পারছে না, যেন খাঁচার মধ্যে রর দৌড়। আতঙ্কের চিৎকার আর বারুদের ধোঁয়ায় পুরো জায়গাটা যেন নরক।
সিরাজুলের হাতে তখনও রাইফেল, সেটা কেড়ে নিয়ে ফেলে দিল হায়দার। পেছন দিকের একটা ঘরের জানলা ভেঙে বাইরে এসে ওরা দু’জন অন্ধকারের মধ্যে একটু দৌড়ে গিয়ে দেখতে পেল গ্যারেজ, আর কিছু চিন্তা না করে দু’জনে উঠে পড়লো সেই গ্যারেজের চালের ওপর। সেখানে আরও দু’তিনজন ছাদে গা মিশিয়ে শুয়ে আছে, তারা বললো, চুপ চুপ!
আর্মি একটু পরেই ঢুকে পড়লো হলের মধ্যে, প্রত্যেক ঘরে ঘরে গিয়ে গুলি করে মারছে ছেলেদের। শুধু ছাত্র হওয়াই অপরাধ। যারা জীবনে কখনো রাজনীতি করেনি তারা হাউ হাত করে কাঁদছে, কেউ কেউ ভাঙা ভাঙা উর্দুতে দয়া ভিক্ষে করছে, সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে কোনো কথা নেই, শুধু গুলি, শুধু গুলি!
গ্যারেজের ছাদে পাঁচটা প্রাণী একেবারে কাঠ হয়ে আছে। সিরাজুল অনবরত ভাবছে, মরে যাবো, মরে যাবো! কাদের মরে গেছে, আমিও মরে যাবো। কাদের, কাদের, একটু আগে বেচে ছিল কাদের, সে আর নেই! কাদের বোমা ছুঁড়ে ভুল করেছিল, কিন্তু বোমা না ছুঁড়লেও ওরা গুলি চালাতোই, ছাত্র আন্দোলন একেবারে শেষ করে দেবার জন্য ওরা সব ছাত্রদেরই মেরে ফেলার পরিকল্পনা নিয়ে এসেছে। এরকম নির্লজ্জভাবে আর্মি এসে সিভিলিয়ানদের মারবে, এ রকম কি কেউ ভাবতে পেরেছিল?
মনিরার কী হবে? সিরাজুল যতক্ষণ না বাড়ি ফেরে, ততক্ষণ মনিরা জেগে থাকে। আজ কথা ছিল, শেখ সাহেবের সঙ্গে প্রেসিডেন্টের মিটিং-এর ফলাফল কী হলো তা না জেনে বাড়ি ফেরা হবে না। সারারাত ও কোনো হলে কাটিয়ে দিতে পারে। আজকের রাতটা কী আর কাটবে? যদি গ্যারেজের ছাদের ওপর টর্চের আলো ফেলে বাঁচার আশা নেই…শুধু মৃত্যু আর্তনাদ আর গুলির শব্দ…কেউ বাঁচবে না। পূর্ব বাংলার যুবশক্তিকে আজ এরা ধ্বংস করে। দেবে…
জহুরুল হলের সঙ্গে সঙ্গে আরও সাঁজোয়া গাড়ি গিয়ে আক্রমণ করলো জগন্নাথ হল, সলিমুল্লা হল, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রাবাসগুলি। নির্বিচারে হত্যা। কামান ও মর্টারের গোলায় লাল হয়ে উঠছে আকাশ।
জগন্নাথ হলের ছেলেরা ভেবেছিল, তারা মাইনরিটি কমিউনিটি, তাদের গায়ে হাত পড়বে না। হলে সরস্বতীর মূর্তি রয়েছে, সেই প্রতিমা নিশ্চয়ই খান সেনারা ছোঁবে না। বেশীর ভাগ ছাত্র গোলাগুলির আওয়াজ শুনে সেই সরস্বতী প্রতিমার পেছনে গিয়ে জড়াজড়ি করে বসেছিল।
কিন্তু আর্মির চোখে পূর্ব পাকিস্তানের সবাই হিন্দু অথবা হিন্দুর দালাল। বাঙালী মুসলমান খাঁটি মুসলমান নয়। তাদের আরও বোঝানো হয়েছে যে প্রচুর ভারতীয় হিন্দু অনুপ্রবেশকারী ঢাকায় আত্মগোপন করে ছাত্রদের খ্যাপাচ্ছে।
মিলিটারি জগন্নাথ হলে ঢুকে লাথি মেরে ভেঙে ফেললো সরস্বতী প্রতিমা। একদল ছাত্রকে দেয়ালের সামনে দাঁড় করিয়ে গুলি চালাবার পর আর একদল ছাত্রদের বাধ্য করা হলো লাশগুলো বাইরে বয়ে নিয়ে যেতে। তারপর তারা মরলো, সেই লাশ বয়ে নিয়ে গেল আর একদল ছাত্র।
জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট, ইংরিজির অধ্যাপক জ্যোর্তিময় গুহ ঠাকুরতা বাধা দিতে এসে গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়লেন মাটিতে। দর্শনের প্রবীণ অধ্যাপক গোবিন্দ দেব নিজের কোয়াটার থেকে ছুটে এলেন, তিনি হাত তুলে বললেন, আমার ছেলেদের মেরো না। তোমাদের অফিসার কে আছে, তাঁর সঙ্গে আমাকে কথা বলতে দাও!
মালাউন কি বাচ্চা বলেই একজন এক ঝাঁক গুলি চালিয়ে দিল তাঁর দেহে। ঘরের মধ্যে ছিল তাঁর পালিত কন্যা রোকেয়া সুলতানা, কোলে তাঁর বাচ্চা, পাশে তাঁর স্বামী। রোকেয়ার স্বামী বাধা দিতে এসে গুলিতে প্রাণ হারালো, রোকেয়া আর্তনাদ করে আল্লাহ বলে। হিন্দুর ঘরে আল্লার নাম শুনে সৈন্যরা একটু থমকে দাঁড়ালো, তারপর ফিরে গেল।
পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যক্ষ মুনিরুজ্জামান সাহেব যেমন পণ্ডিত তেমনই ধার্মিক। জল্লাদেরা গভীর রাতে তার কোয়ার্টারে যখন ঢোকে, তখন তিনি জায়নামাজে বসে কোরআন তলাওয়াত করছিলেন। সেই অবস্থায় তিনি নিহত হলেন, সঙ্গে সঙ্গে প্রাণ দিল তাঁর ভাই, ছেলে।
কামান দাগা হলো ইত্তেফাক অফিসে, পুড়িয়ে দেওয়া হলে ‘পিপল’ পত্রিকার কার্যালয়, গোলা দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া হলো ভাষা আন্দোলনের শহীদ মিনারের চূড়া। মিলিটারি চলাচলে বাধা দেবার জন্য কয়েকটি রাস্তায় লোকেরা ব্যারিকেড করেছিল, ট্যাঙ্ক এসে সেই ব্যারিকেড উড়িয়ে দিল, আগুন লাগিয়ে দিল কাছাকাছি সব কটি বাড়িতে। যারা মরছে তারা মৃত্যুর আগের মুহূর্তেও বুঝতে পারছে না, তাদের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানীদের এত রাগ কেন। শুধু বাঙালী হওয়াই অপরাধ?
সিরাজুলরা গ্যারেজের ছাদ থেকে নামলো পরদিন বিকেলবেলা।
দিনের আলো ফোঁটার পর শুরু হয়েছিল কবর খোঁড়ার পালা। ছাত্রাবাসগুলির সামনের জমিতেই সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে এক হাত দু’হাত মাটি খুঁড়ে তার মধ্যে ফেলা দেওয়া হচ্ছে। লাশ। দু’একটা হাত-পা বেরিয়ে থাকছে, তাতে কিছু আসে যায় না।
সামরিক গাড়ি ও বুটের আওয়াজ যখন আর শোনা গেল না তখনই ভরসা করে নেমে পড়লো সিরাজুলরা। হায়দার সারারাত মুখে হাত চাপা দিয়ে বমি করেছে। সেই বমি সিরাজুলের গায়েও লেগেছে, দু’জনের জামাতেই দুর্গন্ধ। হায়দারের চোখ দুটিও ঘোলাটে হয়ে গেছে। দারুণ সাহসী হায়দারই কাল সিরাজুলকে বাঁচিয়েছে, কিন্তু এখন আর সে মানসিক চাপ সহ্য করতে পারছে না।
অনেক মৃতদেহ এখনও কবর দেওয়া হয়নি। ছড়িয়ে আছে রাস্তায়। কয়েকটা আধ পোড়া বাড়ি থেকে ধোঁয়া বেরুচ্ছে, কোথাও কোনো শব্দ নেই। যেন সত্যিকারের একটা যুদ্ধ-বিধ্বস্ত ঢাকা নগর।
একটা গলির মধ্য দিয়ে বেরিয়ে এলেন জিন্নাত আলী, ইনি জহুরুল হলের সহ-সভাপতি। মুখখানা একেবারে বরফের মতন সাদা, ওদের দেখেও কোনো কথা বললেন না।
রাস্তার গা ঘেঁষে ঘেঁষে এক পা এক পা করে এগোচ্ছে ওরা। মৃতদেহগুলিকে দেখে ওরা যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না যে নিজেরা কী করে বেঁচে আছে। ওদের বাড়িতে কি কেউ বেঁচে আছে?
খানিকটা এগোতেই একজন মিলিটারি চেঁচিয়ে উঠলো, কৌন হ্যায়?
আশ্চর্য ব্যাপার, সৈনিকটি দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার ঠিক মাঝখানে। হাতে সাব-মেশিনগান তবু। তাকে ওরা দেখতে পায়নি কেউ। ওরা দেখছিল শায়িত মৃতদেহগুলির মুখ, কোনো কোনো লাশ একেবারে ছিন্নভিন্ন, তবু এদের মধ্যে চেনা কেউ আছে কিনা, সেটা জানার ব্যাকুলতা।
মিলিটারিটি একেবারে ওদের সামনে, পালাবার কোনো উপায় নেই। প্রায় প্রৌঢ় চেহারার এক পাঠান, চোখ দুটো লালচে, চৌকো চোয়াল। সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত। একটু নড়াচড়া করলেই পর পর গুলিতে ফুড়ে দেবে সবাইকে।
আর বাঁচার কোনো আশা নেই। সামান্য একটু অসাবধানতার মূল্য দিতে হবে প্রাণ দিয়ে। সিরাজুল একবার ভাবলো, কোনোক্রমে লাফিয়ে পড়বে লোকটার ওপরে; তার নিজের প্রাণ গেলেও অন্যরা সেই সুযোগে ছুটে পালাতে পারে। কিন্তু প্রাণ দেওয়া এত সহজ নয়। লোকটা অস্ত্র তুলে আছে, সিরাজুল ওর কাছে পৌঁছোতেই পারবে না!
সিরাজুল তাকালো জিন্নাত আলীর দিকে। তিনি যদি কোনো বুদ্ধি বার করতে পারেন। সিরাজুল দেখতে পাচ্ছে মনিরার মুখ। মনিরা যেন ভালো থাকে!
সৈন্যটি হাতের অস্ত্র নেড়ে ইঙ্গিত করলো কাছে আসার। রবার দিয়ে তৈরী তিনটি পুতুলের মতন ওরা এগিয়ে গেল।
আশ্চর্য ব্যাপার, সৈনিকটির মুখের ভঙ্গি বেশ নরম। সে একবার চট করে পেছন দিক দেখে নিয়ে বললো, ইধার কেয়া কর রহা হ্যায়?
জিন্নাত আলী বললেন, স্যার, হামলোগ ইদারহি রহেতা হ্যায়।
সৈনিকটি জিজ্ঞেস করলো, মুসলমান হ্যায় ইয়া হিন্দু হ্যায়?
হায়দার বললো, মুসলমান হ্যায় সাব, মুসলমান, হামলেগকো সবহি ক খৎনা হ্যায়।
সৈনিকটি ইঙ্গিত করলো পাজামা খুলে ফেলতে। কেউ বিন্দুমাত্র দ্বিধা করলো না। সৈনিকটি ভালো করে তাকিয়ে দেখলোও না, মুখ ফিরিয়ে নিল। অস্ত্রটা নিচু করে সে বললো, যাও, জলদি জলদি ভাগ চলো, আভি আভি কাপটেন সাব চলা আয়গা। তব তত তুমলোগকো ভি নেহি ছোড়ে গা!
তারপর সে দুঃখিত ভাবে মুখ কুঁচকে বললো, কেয়া হো রহা হ্যায় ই দেশ মে!
পাজামার দড়ি না বেঁধেই দৌড়োলা ওরা তিনজন।