তিথি কখনো তার সঙ্গের পুরুষের দিকে ভাল করে তাকায় না। সব পুরুষকেই তার কাছে এক রকম মনে হয়। একদল কদাকার হাঁসের ছানার মত। সব একই রকম। কাউকে আলাদা করা যায় না। তবে তিথি তার আজকের সঙ্গীকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। যদিও খুঁটিয়ে দেখার মত কিছু এই লোকটির নেই।
এর বয়স চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশের মধ্যে। কিছু বেশিও হতে পারে। গোঁফ অর্ধেকের বেশি পাকা–অবশ্যি মাথার চুল পাকেনি। হয়ত মাথায় কলপ দিয়েছে। গোঁফে দেয়নি। কিংবা দিয়েছিল–বারবার ধোবার কারণে উঠে গেছে। লম্বাটে মুখ। খুব খাড়া নাক। চোখে বেমানান এক চশমা। চশমা সাধারণত চোখের সঙ্গে লেগে থাকে–নাকের কারণে এর চোখ চশমা থেকে অনেকখানি দূরে। লোকটির মাথার চুল খুব পাতলা। কপালের অনেকখানি পুরোপুরি ফাঁকা। হয়ত আগে কখনো অপরিচিত মেয়ে নিয়ে বের হয়নি। এই ধরনের পুরুষ বেশ ভাল। এরা কিছুতেই জড়তা কাটাতে পারে না। অসম্ভব ঘাবড়ে যায়। এবং এক সময় বিব্রত গলায় বলে, তুমি চলে যাও আমার কিছু লাগবে না। কেউ কেউ আবার হঠাৎ করে মহাপুরুষ সেজে ফেলে। গাম্ভীর গলায় বলে, তোমার মত মেয়ে এই লাইনে কেন? এই সব ছেড়ে বিয়ে-টিয়ে করে সংসারী হও। এখনো সময় আছে। তারপর বলে বাড়িতে আছে কে? ফ্যামিলি মেম্বার কত? এই লাইনে আসবার কারণটা কি? না–সোসাইটিটা একবারে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
এই লম্বামুখো মানুষটা কি বলবে কে জানে। উদ্ভট কিছু করবে কি? বিচিত্র নয়। নার্ভাস ধরনের পুরুষ প্রায় সময়ই উদ্ভট কাণ্ডকারখানা করে। বুড়ো ধরনের এক লোক একবার কাঁদো কাঁদো। গলায় বলল–কিছু মনে করো না। তুমি আমার মেয়ের মত। বিশ্ৰী অবস্থা। এ জাতীয় বিশ্ৰী অবস্থা মনে হচ্ছে এবারও হবে।
লোকটি একটির পর একটি সিগারেট টেনে যাচ্ছে। তার ধোঁয়া টানার ভঙ্গি, সিগারেটের ছাই ফেলার ভঙ্গি দেখেই বোঝা যাচ্ছে। এ সিগারেট খায় না। তারা মগবাজারের একটা চাইনিজ রেস্টুরেন্টে মুখোমুখি বসে আছে। এগুলিকে বলে ফ্যামিলি রুম। বেলা তিনটা চারটার দিকে ফ্যামিলি রুমগুলি ভর্তি হয়ে যায়। বয় পর্দা টেনে দেয়। হুঁট করে ঢুকে পর্দা-ঘেরা মানুষগুলোকে বিরক্ত করে না। যার জন্যে মোটা বিকশিস পাওয়া যায়।
লোকটি চোখ থেকে চশমা নামিয়ে রুমাল দিয়ে চশমার কাঁচ মুচছে। কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত থাকা। এর বেশি কিছু না।
তোমার নাম কি?
সে প্রশ্নটা করল তিথির দিকে না তাকিয়ে। তিথি বলল আমার নাম দিয়ে তো আপনার কোনো দরকার নেই। লোকটি এই উত্তর হয়ত আশা করেনি। কেমন হচকচিয়ে গেল।
আমি আগে কখনো এভাবে কারো সঙ্গে আসিনি। আমার ইচ্ছাও ছিল না। আমি একজন ফ্যামিলি ম্যান। আমার কোনো বদ অভ্যেস নেই। মাঝে-মধ্যে সিগারেট খাই। আগে পান খেতাম জর্দা দিয়ে। ডাক্তার বলল জর্দাটা হার্টের জন্য খুব খারাপ। সিগারেটের চেয়েও খারাপ, তাই পানও ছেড়ে দিয়েছি। অবশ্যি এমনিতে পানটা কিন্তু খারাপ না, ভিটামিন সি আছে। ভিটামিন সি-টা শরীরের জন্যে খুবই দরকার।
তিথি বলল, আমাকে এসব কথা কেন বলছেন?
লোকটি অস্বস্তিতে রুমাল দিয়ে নাক ঘষতে লাগল। যেন খুব ধাঁধায় পড়ে গেছে। কি করবে–কি বলবে বুঝতে পারছে না।
তুমি গান জানো?
না, জানি না। আর জানলেও আপনি নিশ্চয়ই চান না। এখানে আমি একটা গান শুরু করি। না-কি চান?
না না, তা চাই না। সব কিছুরই একটা সময় আছে। তুমি বস। আমি সিগারেট নিয়ে আসি। সিগারেট শেষ হয়ে গেছে।
একজন বয়কে বললেই এনে দেবে। আপনার যেতে হবে না।
না থাক, আমিই যাচ্ছি।
লোকটি দ্রুত বের হয়ে গেল। তার চলে যাবার ভঙ্গি দেখে মনে হল সে আর ফিরবে না। না ফিরলে মন্দ হয় না। তিথির ঘুম পাচ্ছে। সে মনে মনে ঠিক করল মিনিট দশেক অপেক্ষা করে চলে যাবে। না লোকটি চলে যায়নি। সিগারেট নিয়ে ফিরছে। মুখ ভর্তি পান। তার গায়ের ধবধবে সাদা পাঞ্জাবিতে পানের পিকের দাগ। অথচ একটু আগেই বলছিল–পান খায় না। তিথি বলল, আপনি কি আমাকে অন্য কোথাও নিয়ে যাবেন? নাকি সারাক্ষণ এখানেই কাটাবেন?
লোকটি খুবই অবাক হয়ে বলল, আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি না। কোথায় নিয়ে যাব তোমাকে?
সে তো আপনি ঠিক করবেন। কোনো হোটেলে কিংবা আপনার বাসায়।
কি সর্বনাশের কথা! বাসায় আমার স্ত্রী আছে–বড় মেয়ে ক্লাস সেভেনে পড়ে। আজিমপুর গার্ল স্কুলে। ফরিদা যদি এইসব ব্যাপারে কিছু জানতে পারে তাহলে সে আমাকে কিছু বলবে না। সোজা ছাদে উঠে ছাদ থেকে লাফিয়ে নিচে পড়ে যাবে। ফরিদা হচ্ছে আমার স্ত্রীর নাম।
বুঝতে পারছি।
খুবই চমৎকার মেয়ে। আদর্শ মা, আদর্শ স্ত্রী। এখন অবশ্যি শরীরটা খুবই খারাপ। বছর তিনেক ধরে বিছানায় পড়ে আছে। একেবারে কংকাল। ডাক্তার খুব খারাপ ধরনের অসুখ বলে সন্দেহ করছে। বাঁচবে না।
তাই নাকি?
হ্যাঁ তাই। ইয়ে তোমার নামটা কিন্তু বলনি।
আমার নাম পরী।
বাহ সুন্দর নাম।
এটা আমার আসল নাম না। নকল নাম।
নামের আবার আসল-নকল আছে নাকি?
কেন থাকবে না। মানুষের মধ্যেও তো আসল মানুষ নকল মানুষ আছে। যেমন আমি একজন নকল মানুষ।
ভদ্রলোক মনে হচ্ছে খুব ধাঁধায় পড়ে গেছে। সে বেশ খানিক্ষণ চুপচাপ থেকে আচমকা বলল, তুমি ঠাণ্ডা কিছু খাবে? ফান্টা কিংবা পেপসি?
না।
খাও, একটা ফান্টা খাও। এই বয়, দু’টা ফান্টা দাও। আমি আবার ফান্টা ছাড়া কিছু খেতে পারি না। কোক পেপসি এইসব আমার কাছে ওষুধের মত লাগে। আমার নাক আবার খুব সেনসেটিভ। ফরিদাও আমার মত। মানে ওর নোকও খুব সেনসেটিভ। দুধের কোনো জিনিস খেতে পারে না, গন্ধ লাগে। অথচ দুধটা এখন তার খাওয়া দরকার। আচ্ছা, তুমি কি দুধে গন্ধ পাও?
তিথি হেসে ফেলল।
লোকটি বিব্রত স্বরে বলল, আমি খুব আবোল-তাবোল কথা বলছি তাই না?
না ঠিক আছে। বলুন, যা বলতে ইচ্ছা করে। শুধু ছ’টার আগে ছেড়ে দেবেন। আমি অনেক দূরে থাকি।
কোথায় থাক?
তা দিয়ে তো আপনার দরকার নেই। আপনি নিশ্চয় আমার বাসায় বেড়াতে যাবেন না। না-কি যাবেন?
তুমি ঐসব মেয়েদের মত না। তুমি অন্য রকম।
আপনি কি ঐসব মেয়েদের সঙ্গে আগেও মিশেছেন?
না।
তাহলে বুঝলেন কি করে, ঐসব মেয়েরা কেমন?
না মানে যে রকম ভেবেছিলাম তুমি সে রকম না। অন্য রকম।
কি রকম ভেবেছিলেন?
লোকটি জবাব দিল না। রুমাল দিয়ে মাথা ঘষতে লাগল। তিথি বলল, গল্প করতে চাচ্ছিলেন গল্প করুন। চুপ করে বসে আছেন কেন?
না মানে ওঠা দরকার, ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে। পাঁচটার সময় অ্যায়েন্টমেন্ট। তোমাকে ওরা টাকা দিয়ে দিয়েছে তো?
হ্যাঁ।
ভাল, খুব ভাল। খুবই ভাল।
চলুন, তাহলে উঠি। পাঁচটা বাজতে দেরি নেই।
আরেকটু বস। এই ধর দশ মিনিট। অবশ্যি তোমার যদি কোনো কাজ না থাকে।
আমার কোনো কাজ নেই।
লোকটি ভয়ে ভয়ে তার একটা হাত তিথির ডান হাতের উপর রাখল। রেখেই সরিয়ে নিল। মনে হচ্ছে এই কাজটি করে সে খুব লজ্জা পেয়েছে।
তিথি বলল, আপনার টাকাটা তো মনে হচ্ছে জলে গেল।
লোকটি নিচু গলায় বলল, তুমি একটি চমৎকার মেয়ে।
আমি চমৎকার মেয়ে, এটা আপনাকে বলল কে?
বোঝা যায়। চেহারা দেখে বোঝা যায়।
আচ্ছা। আপনি কি করেন?
ছোটখাটো ব্যবসা করি। তেমনি কিছু না। তবে খারাপ ও না। গত বছর গাড়ি কিনলোম একটা। তবে আমি অবশ্যি গাড়িতে চড়ি না। কেমন যেন দমবন্ধ দমবন্ধ লাগে। রিকশাটিা এদিক দিয়ে ভাল। হাওয়া খেতে খেতে যাওয়া যায়।
পাঁচটা বেজে গেছে–চলুন উঠি।
তুমি আগে যাও, আমি পরে আসছি।
কেউ দেখে ফেলবে সে জন্যে?
লোকটি তার জবাব দিল না। তিথি উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, আপনি কি আমাকে একটা চাকরি জোগাড় করে দিতে পারেন? আমি এসএসসি পাস করেছি।
কি রকম চাকরি?
যে কোন চাকরি। টাইপিস্টের চাকরি বা এই জাতীয় কিছু।
টাইপিং জানো?
জি-না। তবে আমি শিখে নিতে পারব। আমি খুব দ্রুত শিখতে পারি।
আমার কাছে কোনো চাকরি নেই। আমার অফিসে অল্প কিছু কর্মচারী আছে নতুন লোক নেওয়ার অবস্থা অফিসে নেই। তাছাড়া…
তাছাড়া কি?
হঠাৎ করে সুন্দরী একটা মেয়েকে চাকরি দিলে নানান কথা উঠবে। আমার স্ত্রী শুনতে পেলে মনে কষ্ট পাবে। আমাকে অবশ্যি কিছু বলবে না।
ছাদ থেকে লাফিয়েও পড়তে পারে, তাই না?
লোকটি উঠে দাঁড়িয়ে মানিব্যাগ থেকে ভিজিটিং কার্ড বের করে নিচু গলায় বলল, এইখানে ঠিকানা আছে, দবির উদ্দিন বি.এ। দবির ইন্ডাস্ট্রিজ ৩১/৩ জিগাতলা, তুমি মাস তিনেক পর একবার খোঁজ নিও।
মাস তিনেক পর খোঁজ নিতে বলছেন কেন? আপনার কি ধারণা মাস তিনেকের মধ্যেই আপনার স্ত্রীর ভালমন্দ কিছু হয়ে যাবে?
লোকটি শীতল গলায় বলল, তোমাকে যতটা ভাল মেয়ে আমি ভেবেছিলাম ততটা ভাল তুমি না। তোমার মত মেয়ে যে রকম সাধারণত হয় তুমিও সেই রকমই। আলাদা কিছু না।
তিথি হেসে ফেলল। হাসতে হাসতেই বলল, আমাকে রাগিয়ে দেয়াটা কিন্তু বুদ্ধিমানের কাজ হয়নি। কার্ডে আপনার বাসার ঠিকানা আছে। সেই ঠিকানায় যদি হঠাৎ উপস্থিত হয়ে যাই তখন কি হবে?
দবির উদ্দিন জবাব দিল না। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল।
তিথির ঠোঁটে এখন আর হাসি নেই। সে কৃঠিন চোখে তাকাচ্ছে। দবির এই মেয়েটির দ্রুত ভাবান্তরের রহস্য ধরতে পারছে না। সব কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।
তিথি নিচু গলায় বলল, পুরো টাকাটা জলে ফেলবেন কেন? কিছুটা অন্তত উসুল হোক। ব্লাউজ খুলে ফেলছি, আপনি আমার বুকে হাত দিন। আর যদি তাও না চান অন্তত তাকিয়ে দেখুন। আপনার অসুস্থ স্ত্রীর বুক নিশ্চয়ই আমার বুকের মত সুন্দর না।
দবিরের চেহারা ছাইবৰ্ণ হয়ে গেছে। সে অল্প অল্প কাঁপছে। তিথির মুখের কঠিন ভাজগুলি হঠাৎ সতেজ হয়ে গেল। সে বলল, আমি আপনার সঙ্গে ঠাট্টা করছিলাম। আপনি কিছু মনে করবেন না। আপনি চমৎকার মানুষ। চলুন, আমরা যাই।