০৩. সবাই মিলে যখন কাত হয়ে

০৩.

সবাই মিলে যখন কাত হয়ে থাকা স্কুলের দিকে তাকিয়ে আছেন তখন ভিড় ঠেলে একজন মানুষ এগিয়ে এলেন। মানুষটিকে দেখলে প্রথমেই যে-কথাটি বলতে হয় সেটা হচ্ছে যে মানুষটা মোটা। কোনো মানুষ যদি কানা খোঁড়া হয় কখনো তাকে কানা খোঁড়া বলতে হয় না। কোনো মানুষ যদি মোটা হয় তাকেও মোটা বলা ঠিক নয়, কিন্তু এই মানুষটিকে মোটা না বলে কোনো উপায় নেই। তাঁর হাত পা মোটা মোটা থামের মতো, তার বিশাল পেট উঁচু হয়ে আছে। তার বিশাল মুখে মোটা মোটা গাল চোখ নাক মুখ মনে হয় অনেক কষ্ট করে কোনোরকমে সেখানে টিকে আছে। মানুষটি একটু হাঁটলেই তার সারা শরীরের মেদ মাংস ভুড়ি থরথর করে কাঁপতে থাকে। মানুষটি ভিড় ঠেলে সামনে এসে হাঁপাতে লাগলেন। মানুষটি এত মোটা যে তার এই বিশাল শরীর নিয়ে একপা হাঁটা শুকনো পাতলা একজন মানুষের দুই মাইল দৌড়ে আসার সমান। খানিকক্ষণ বড় বড় নিঃশ্বাস নিয়ে মোটা মানুষটি বললো, “এখানে ফরা ভাই ফারু ভাই আর হারু ভাই কে?”

ফরাসত আলি বললেন, “আমি ফরাসত আলি।”

ফারুখ বখত বললেন, “আম ফারুখ বখত।”

হারুন ইঞ্জিনিয়ার বললেন, “আমি হারুন ইঞ্জিনিয়ার।”

মোটা মানুষটি বড় বড় দুইটা নিঃশ্বাস নিয়ে বললেন, “আমার নাম মির্জা মাস্টার।” কথাটি বলেই তাঁর নিঃশ্বাস ফুরিয়ে গেল, তিনি মুখ হাঁ করে নিঃশ্বাস নিতে লাগলেন।

ফারুখ বখত জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কিসের মাস্টার?”

“বাচ্চাদের। আমি বাচ্চাদের পড়াই।”

“কোথায় পড়ান?”

“স্কুলে।”

”কোথায় স্কুল?”

“স্কুল নেই।”

“স্কুল নেই? ফারুখ বখত অবাক হয়ে বললেন, বুঝতে পারলাম না, আপনি স্কুলে পড়ান, কিন্তু আপনার স্কুল নেই?”

“ছিল। স্কুল ছিল। গতরাতে ঝড়ে উড়ে গেছে।”

ফরাসত আলি বললেন, “গতরাতে তো বেশি বড় ঝড় হয়নি! এই ঝড়ে স্কুল উড়ে গেল?”

মির্জা মাস্টার তখন একটু হাসার চেষ্টা করে বললেন, “খুব দুর্বল স্কুল ছিল। বাঁশের চাটাই দিয়ে ঢেকে উপরে একটা ছাউনি। আমি জোরে একটা হাঁচি দিলে স্কুল উড়ে যায় সেরকম অবস্থা।”

একসাথে অনেকগুলি কথা বলে ফেলে মির্জা মাস্টার মুখ বড় বড় করে নিঃশ্বাস নিতে লাগলেন।

হারুন ইঞ্জিনিয়ার চশমা খুলে কাঁচটা খুব মনোযোগ দিয়ে খানিকক্ষণ পরিষ্কার করে বললেন, “কীরকম স্কুল আপনার?”

“গরিব বাচ্চাদের। যেসব বাচ্চাকাচ্চা রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়ায়, মিনতি টোকাইয়ের কাজ করে তাদের স্কুল।”

হঠাৎ করে ফারুখ বখত, ফরাসত আলি আর হারুন ইঞ্জিনিয়ার তিনজন একসাথে মির্জা মাস্টারের দিকে ঘুরে তাকালেন। ফারুখ বখত কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি গরিব বাচ্চাদের পড়ান?”

“হ্যাঁ।”

“আপনার স্কুলের খরচ কে দেয়?”

“আমার স্কুলের কোনো খরচ নাই, কেউ দেয় না। বাচ্চারা আসে আমি তাদের পড়াই।”

“কী পড়ান?”

“প্রথমে পড়তে শেখাই। তারপরে অঙ্ক। তারপরে যে যেটা পড়তে চায়। কেউ ইংরেজি, কেউ সায়েন্স।”

“আপনার কতজন ছাত্র?”

“ঠিক নাই। ধান কাটার মৌসুমে কমে যায়। বৃষ্টি-বাদলার দিনে একটু বেশি হয়। অনেক রকম ছাত্র আমার, কেউ বাসায় কাজ করে, কেউ মিনতি, কেউ মুটে, কেউ টোকাই। কেউ রেলস্টেশনে কুলি। দুইজন আছে পকেটমার।”

“পকেটমার?”

“জি। এইখানে পকেটমারদের একটা কলেজ আছে, দুইজন এখনই চান্স পেয়ে গেছে। চমৎকার হাতের কাজ। আপনার পকেট খালি করে দেবে আপনি টের পর্যন্ত পাবেন না। কলেজের প্রিন্সিপাল বলেছে এই দুইজন নাকি বড় হয়ে কলেজের সুনাম রাখবে।”

“আপনি পকেটমার কলেজের প্রিন্সিপালকে চেনেন?”

“না, ব্যক্তিগত পরিচয় নাই। তারা পরিচয় গোপন রাখে। আমি লোকমুখে খবর পাই।”

ফরাসত আলি খানিকক্ষণ অবাক হয়ে মির্জা মাস্টারের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, “এখন আপনার স্কুল উড়ে গেল, ছাত্রদের কী অবস্থা?”

“ছাত্ররা মহাখুশি। একেবারে পড়ায় মনোযোগ নাই। এরা গরিব মানুষের পোলাপান, বাসায় পড়াশোনার আবহাওয়া নেই–পুরো ব্যাপারটা মনে করে একটা ঠাট্টা-তামাশা।”

“ঠাট্টা তামাশা?”

“জি। কখনো ধমক দিয়ে কখনো আদর করে পড়াতে হয়। অনেক যন্ত্রণা।”

ফারুখ বখত জিজ্ঞেস করলেন, “এখন আপনার ছাত্ররা কোথায়?”

“এইখানেই আছে নিশ্চয়। দিনরাত সবগুলি টোটো করে ঘোরাঘুরি করে। যেখানে একটু হৈচৈয়ের খোঁজ পায় সেখানে হাজির হয়।”

মির্জা মাস্টার মাথা ঘুরিয়ে মানুষের ভিড়ের দিকে তাকালেন, ছোট ছোট বাচ্চারা যারা ছোটাছুটি করছে তাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “এই যে এরা সব আমার ছাত্র। ঐ যে বাদাম বিক্রি করছে ছেলেটা আমার একেবারে একনম্বর ছাত্র। অ্যালজেবরা শুরু করেছে। ঐ যে দূরে দুইজন কুস্তি করছে ঐ দুজনও আমার ছাত্র। স্কুল উড়ে গেছে আর পড়তে হবে না, তাদের মনে বড় আনন্দ!”

মির্জা মাস্টার মুখ হা করে খানিকক্ষণ নিঃশ্বাস নিয়ে বললেন, “আমি খোঁজ পেয়েছি যে আপনারা একটা স্কুল তৈরি করছেন। তাই ভাবছিলাম আমার ছাত্রদের জন্যে যদি একটা ঘর পাওয়া যায়। কিন্তু এখন তো দেখি স্কুলঘর আপনারা দাঁড়া করেছেন উলটো। স্কুলের মেঝে আকাশে উঠে গেছে, দরজা-জানালা আড়াআড়ি, এই স্কুলে ছাত্র ঢুকবে কোন দিক দিয়ে আর মাস্টার ঢুকবে কোন দিক দিয়ে?”

হারুন ইঞ্জিনিয়ার গলা উঁচিয়ে বললেন, “ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে আপনার এত মাথাব্যথা কিসের?”

“ছোটখাটো?” মির্জা মাস্টার তার ছোট ছোট চোখ দুটিকে যথাসাধ্য বড় করার চেষ্টা করে বললেন, “ছোটখাটো একটা আস্ত স্কুল উলটা করে দাঁড় করেছেন সেটা ছোটখাটো?”

“অবশ্যি ছোটখাটো। একরাত্রে স্কুল উলটো করে দাঁড় করানো হয়েছে, আরেক রাত্রে স্কুল খুলে সোজা করা হবে।”

মির্জা মাস্টার খানিকক্ষণ হারুন ইঞ্জিনিয়ারের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, “এক রাত্রে?”

অবশ্যি এক রাত্রে! ভাবছেন কী আপনি? এটা আমার আবিষ্কার করা প্রসেস। আমেরিকা জার্মানি আর জাপানে এটার পেটেন্ট আছে! স্কুলঘরের দায়িত্ব আমি নিয়েছি, আমি ঠিক করে দেব-আপনি আপনার ছাত্রছাত্রী নিয়ে মাথা ঘামান।”

মির্জা মাস্টার তখন ফরাসত আলি আর ফারুখ বখতের দিকে তাকালেন, ইতস্তত করে বললেন, “কী মনে হয় আপনাদের? স্কুলঘরটা যখন শোওয়ানো হবে তখন কি একটা ঘর পাওয়া যাবে আমার ছাত্রছাত্রীর জন্যে”

ফারুখ বখত বললেন, “আপনি এটা কী বলছেন?”

মির্জা মাস্টার থতমত খেয়ে বললেন, “না মানে ভাবলাম এত বড় একটা স্কুল তার একটা ছোট ঘর যদি দিতেন। কিন্তু আপনাদের যদি অসুবিধে হয় তা হলে থাক–”

ফারুখ বখত মেঘস্বরে বললেন, “না-না-না, আমি মোটেও সেটা বলছি না। আমি বলছি আপনি শুধু একটা ঘর কেন চাইছেন, এই পুরো স্কুল আমরা দিয়ে দেব আপনার ছাত্রছাত্রীদের

“পু-পু-পুরো স্কুল?”

“পুরো স্কুল। ফারুখ বখত ফরাসত আলির দিকে তাকিয়ে বললেন, দিয়ে দেব না পুরো স্কুল?”

ফরাসত আলি মাথা নাড়লেন, “অবশ্যই পুরো স্কুল দিয়ে দেব। স্কুলঘর শেষ হবার আগেই আমাদের ছাত্র খুঁজে বের করার কথা ছিল, এখন আমাদের আর ছাত্র খুঁজে বের করতে হবে না। না চাইতেই পেয়ে গেলাম।” ফরাসত আলি আনন্দে দাঁত বের করে হাসলেন, সাধারণত তিনি হাসলে দাড়িগোঁফের আড়ালে তার দাঁত ঢেকে থাকে, এবারে ঢেকে থাকল না, বেশ খানিকটা বের হয়ে গেল।

মির্জা মাস্টারের ছোট ছোট চোখগুলি গোল হয়ে গেল, খানিকক্ষণ তিনি কথা বলতে পারলেন না, বড় বড় কয়েকটা নিঃশ্বাস নিয়ে কোনোমতে বললেন, “পু-পু পুরো স্কুলটা আমার ছাত্রছাত্রীর জন্যে দিয়ে দেবেন? আমার এইসব গরিব মিনতি মুটে ছাত্রদের? কাজের ছেলে, টোকাইদের?”

ফরাসত আলি মাথা নাড়লেন।

মির্জা মাস্টার খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, “আসলে ঠাট্টা করছেন, তাই না? আসলে এটা বড়লোকের বাচ্চাদের জন্যে স্কুল। তারা যেন পাস করেই বিলাত আমেরিকা যেতে পারে। তাই না?”

ফারুখ বখত মাথা নেড়ে বললেন, “না। আজ থেকে এটা আপনার ছাত্রদের স্কুল।”

মির্জা মাস্টার হঠাৎ তার বিশাল শরীর নিয়ে থপথপ করে স্কুলের মাঠে ছুটে যেতে থাকলেন। মাঠের মাঝামাঝি গিয়ে তিনি হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বললেন, “পথচারী স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা–”

হঠাৎ উপস্থিত লোকজনের মাঝে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অনেকগুলি বাচ্চা মির্জা মাস্টারকে ঘিরে দাঁড়াল, তাদের পায়ে জুতো নেই, শরীরে কাপড় নেই, ছোট কয়েকজনের নাক থেকে সর্দি ঝরছে। কয়েকটি বাচ্চা মেয়ে, তাদের কোলে আরও ছোট ন্যাদান্যাদা বাচ্চা।

মির্জা মাস্টার তার ছাত্রদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “এই যে দেখছ স্কুলঘর উপুড় হয়ে শুয়ে আছে, এই স্কুল এখন থেকে তোমাদের।

“আমাদের?”

“হ্যাঁ।”

“খোদার কসম?”

মির্জা মাস্টার হুংকার দিয়ে বললেন, “কথায়-কথায় তোমাদের সাথে আমার কসম কাটতে হবে? বলেছি বিশ্বাস হয় না?”

উপস্থিত বাচ্চাগুলি মাথা নাড়ল, না তাদের বিশ্বাস হয় না।

মির্জা মাস্টার হাঁসফাঁস করতে করতে বললেন, “আমি তোমাদের শিক্ষক। শিক্ষক হচ্ছে বাবার মতো। বাবারা কি তার ছেলেমেয়েকে মিথ্যা কথা বলে?”

উপস্থিত বেশির ভাগ ছেলেমেয়েরা মাথা নেড়ে বলল, “জে, বলে।”

মির্জা মাস্টার হুংকার দিয়ে বললেন, “কিন্তু আমি বলি না। এটা তোমাদের স্কুল।”

কালো ঢ্যাঙামতন একজন বলল, “আমরা যদি দালানটা ছুঁই তা হলে সাহেবেরা রাগ করবে না?”

“না, রাগ করবে না।”

“গিয়ে ছুঁয়ে দেখব?”

”যাও দ্যাখো।”

বলমাত্র একটা বিচিত্র ব্যাপার ঘটল, হঠাৎ করে পুরো শিশুর দল স্কুলঘরের দিকে ছুটে যায়। তারা স্কুলঘরের কাত হয়ে শুয়ে থাকা দালানটি ছুঁয়ে দেখে। একজন দুজন দরজা-জানালা বেয়ে উপরে উঠতে শুরু করে। কয়েকজন আড়াআড়িভাবে বসানো দরজায় ফাঁক দিয়ে নিচের একটা ক্লাসঘরে ঢুকে যায়। কাত হয়ে থাকা জানালার ফাঁক দিয়ে দেখা যায় বাচ্চাগুলি দেয়াল থেকে বের হয়ে থাকা বেঞ্চে ঝুলছে। ঘরের ভেতর থেকে হৈচৈ এবং আনন্দধ্বনি শোনা যেতে থাকে।

ফরাসত আলি অবাক হয়ে বললেন, “ঢুকল কেমন করে ভিতরে?”

ফারুখ বখত হাসিমুখে বললেন, “ছোট বাচ্চাদের ব্যাপার! তাদের অসাধ্য কিছু নাই।” সত্যি সত্যি তাদের অসাধ্য কিছু নেই। দেখা গেল বাচ্চাগুলি দেয়াল খিমচে ধরে উপরে উঠে যাচ্ছে। পিছনে একটা বাচ্চাকে ঝুলিয়ে একটা ছোট মেয়ে বিপজ্জনকভাবে একটা জানালা দিয়ে ঢুকে গেল। কয়েকজনকে দেখা গেল একটা দরজা দিয়ে ঝুলতে ঝুলতে ভিতরে কোথায় জানি লাফিয়ে পড়ছে। ছোট ছোট কয়েকটি শিশুকে ছুটতে দেখা গেল, মনে হল একজন তাদেরকে দৌড়ে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ করে কালোমতন একটা বাচ্চা একটা জানালা দিয়ে লাফিয়ে বের হল, উপর থেকে নিচে পড়তে পড়তে সে নিজেকে সামলে নিল, দেয়াল বেয়ে পিছলে সে নিচে নেমে আসতে থাকে। দেখে মনে হয় ছেলেটির ভয়ংকর ফূর্তি হচ্ছে।

হারুন ইঞ্জিনিয়ার তার চশমা মুছতে মুছতে পাংশুমুখে বললেন, “ছেলেগুলি পড়ে ব্যথা পাবে না তো?”

ফারুখ বখত ভুরু কুচকে বললেন, “শুধু ছেলে বলছ কেন? কমপক্ষে একডজন মেয়েও আছে ওখানে। ওই দ্যাখো, ঘাড়ে একটা বাচ্চা নিয়ে কীভাবে লাফ দিল! ইশ! ফারুখ বখত আতঙ্কে তার চোখ বন্ধ করে ফেললেন।”

ফরাসত আলি বললেন, “আমাদের কথা তো শুনবে বলে মনে হয় না।”

হারুন ইঞ্জিনিয়ার মাথা নাড়লেন, “না। শুনবে না।”

ফাসত আলি তাঁর দাড়ি চুলকাতে চুলকাতে বললেন, “মির্জা মাস্টারের কথা শুনবে, হাজার হলেও তাদের শিক্ষক। তাঁকে বলতে হবে।”

ফরাসত আলি হন্তদন্ত হয়ে মাঠের মাঝে হেঁটে যেতে লাগলেন, তাঁর পিছুপিছু ফারুখ বখত, ফারুখ বখতের পিছুপিছু হারুন ইঞ্জিনিয়ার। এই তিনজনকে হেঁটে আসতে দেখে মির্জা মাস্টার তাঁদের দিকে তাকালেন, তাঁর গোলগাল মুখে নাক চোখ মুখ এত ছোট ছোট দেখায় যে সেখানে কোনো ধরনের অনুভূতিরই ছাপ পড়ে না। তার স্কুলের ছাত্রছাত্রীর কাজকর্ম দেখে তিনি কতটুকু ভয় পেয়েছেন বোঝা গেল না। ফরাসত আলি বললেন, “মির্জা মাস্টার! আপনার কি মনে হয় না যে ছেলেমেয়েগুলি যেভাবে লাফঝাঁপ দিচ্ছে–”

“ঠিকই বলেছেন।” মির্জা মাস্টার মাথা নেড়ে বললেন, “ছেলেমেয়েগুলি যেভাবে লাফ দিচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে তাদের স্কুলটা অসম্ভব পছন্দ হয়েছে।”

“আমি সেটা বলছি না।” ফরাসত আলি মাথা নেড়ে বললেন, “আমি যেটা বলতে যাচ্ছি–”

“বুঝেছি আপনি কী বলতে চাচ্ছেন।” মির্জা মাস্টার একগাল হেসে বললেন, “আমিও ঠিক এই কথাটাই বলতে চাচ্ছি। স্কুলঘরটা এইভাবে কাত হয়েই থাকুক। এটাকে সোজা করে কাজ নেই।”

হারুন ইঞ্জিনিয়ার চোখ কপালে তুলে বললেন, “কী বললেন? স্কুলটাকে সোজা করে কাজ নেই?”

“না! এই ছেলেপিলেরা কিছুতই স্কুলঘরে ঢুকতে চায় না। আমার সবচেয়ে বড় সমস্যা স্কুলঘরের মাঝে ঢোকানো, কিন্তু কাত হয়ে থাকা এই স্কুলঘর দেখে এরা এত মজা পেয়েছে আমার মনে হয় স্কুলটা এভাবে রেখে দিলেই হয়। সবাই তা হলে প্রত্যেকদিন স্কুলে আসবে।”

ফরাসত আলি খানিকক্ষণ অবাক হয়ে মির্জা মাস্টারের দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর কয়েকবার চেষ্টা করে বললেন, “স্কুলটা ঠিক করা হবে না? এইভাবে কাত হয়ে থাকবে? দরজা-জানালা আড়াআড়ি? মেঝে আকাশে উঠে যাচ্ছে?”

মির্জা মাস্টার আবার একগাল হেসে বললেন, “হ্যাঁ।”

হারুন ইঞ্জিনিয়ার তার চশমা খুলে জোরে জোরে কাঁচ পরিষ্কার করতে করতে বললেন, “আপনি আসলে আমাদের সাথে মশকরা করছেন, তাই না?”

মির্জা মাস্টার তার ছোট ছোট চোখ দুটিকে যতদূর সম্ভব উপরে তুলে বললেন, “আমি কখনো মশকরা করি না। সত্যি সত্যি বলছি।”

ফারুখ বখত খানিকক্ষণ কাত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা স্কুলটাকে দেখলেন, বাচ্চাদের হৈচৈ আনন্দোচ্ছ্বাস শুনলেন, তারপর মির্জা মাস্টারের দিকে তাকিয়ে বললেন, “যদি পড়ে ব্যথা পায়?”

“পাবে না।” মির্জা মাস্টার মাথা নেড়ে বললেন, “ব্যথা পাবে না। এরা চলন্ত ট্রেন থেকে লাফিয়ে নামে, স্টিমার থেকে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তরতর করে সুপারি গাছ বেয়ে উঠে যায়–এরা কখনো পড়ে ব্যথা পাবে না। এরা বড়লোকের ন্যাদান্যাদা বাচ্চা না, এদের নিয়ে কোনো চিন্তা করবেন না।”

ফারুখ বখত বললেন, “ঠিক আছে, তা হলে কয়েকদিন স্কুলঘরটাকে এভাবেই রাখা যাক। এটাকে সোজা করার এত তাড়াহুড়ো কী?”

মির্জা মাস্টার জোরে জোরে মাথা নেড়ে বড় বড় করে নিঃশ্বাস নিতে লাগলেন।

ফরাসত আলি স্কুলঘরটার দিকে তাকিয়ে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “ঠিক আছে তা হলে থাকুক এইভাবে।”

হারুন ইঞ্জিনিয়ার হঠাৎ করে খুব রেগে উঠলেন, গলা উঁচিয়ে বললেন, “তোমাদের সবার মাথা-খারাপ হয়েছে, তা-ই না?”

ফারুখ বখত বললেন, “কেন? মাথা-খারাপ হবে কেন? মির্জা মাস্টার এত করে চাইছেন, তাই কয়েকদিন স্কুলটাকে এভাবে রাখা হচ্ছে, তার বেশি কিছু না।”

“আর আমার মান-সম্মান? লোকজন বলাবলি করবে হারুন ইঞ্জিনিয়ার ঘরবাড়ি তৈরি করে উলটো। এরপর আমার কাছে কেউ কোনোদিন আসবে?”

“আসবে না কেন? একসোবার আসবে।” ফারুখ বখত সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, “এটা তো পাকাঁপাকিভাবে রাখা হচ্ছে না। কয়েকদিনের জন্যে রাখা হচ্ছে।”

হারুন ইঞ্জিনিয়ার নাক দিয়ে ফোৎ করে একটা শব্দ করে খুব রেগেমেগে চুপ করে রইলেন।

.

পরদিন ভোরে স্কুলের আশেপাশে অনেক ভিড়। এলাকার যত বাচ্চা ছেলেপিলে আছে তারা সবাই চলে এসেছে। কীভাবে জানি খবর চলে গেছে যে এই স্কুলঘরে পড়াশোনা শুরু হয়েছে। ভিড়ের বেশির ভাগ অবিশ্যি মজা দেখার জন্যে এসেছে, সবাই স্কুলটাকে ঘিরে জটলা পাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পান-সিগারেটের দোকান বেশ কয়েকটা খুলে গেছে, ঝালমুড়ি এবং চানাচুর নিয়ে কিছু ছেলেপিলে ঘুরে বেড়াচ্ছে, স্কুলের ঘণ্টা বেজে উঠলে তারাও নাকি ক্লাসঘরে ঢুকে পড়বে। কৌতূহলী দর্শক ছাড়াও রয়েছে খবরের কাগজের সাংবাদিক। ক্যামেরা নিয়ে ছবি তুলে তারা, নোটবইয়ে কীসব লেখালেখি করছে। টেলিভিশন থেকেও লোক এসেছে, মস্ত বড় ভিডিও ক্যামেরা নিয়ে তারা এক কোণায় দাঁড়িয়ে আছে।

সকাল আটটা বাজতেই বিশাল একটা ঘণ্টা বাজিয়ে দেয়া হল এবং হঠাৎ করে দেখা গেল পিলপিল করে নানা আকারের ছাত্রছাত্রীরা দল বেঁধে স্কুলঘরের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। তারা দেয়াল খিমচে খিমচে সুপারি গাছের মতো স্কুলঘর বেয়ে উঠতে থাকে এবং আড়াআড়ি দরজা-জানালার মাঝে দিয়ে ভিতরে ঢুকতে শুরু করে। বাচ্চাদের হৈচৈ এবং আনন্দ-চিৎকারে জায়গাটা কিছুক্ষণের জন্য সরগরম হয়ে যায়। স্কুলঘরের দরজা-জানালা ছাদ এবং মেঝের মাঝে দিয়ে দুরন্ত ছেলেরা লাফঝাঁপ দিতে থাকে এবং বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল জনতা সার্কাস দেখার মতো সেটা উপভোগ করতে থাকে। লোকজনের হৈচৈ দেখে জায়গাটাকে ঠিক স্কুলের মতো মনে না হয়ে একটা বাজারের মতো মনে হচ্ছিল।

.

উপস্থিত সব লোকজন হঠাৎ করে চুপ করে যায়–দেখা গেল মির্জা মাস্টার তার বিশাল দেহ নিয়ে থপথপ করে এগিয়ে আসছেন। তিনি কীভাবে কাত হয়ে থাকা এই স্কুলঘরের দেয়াল খিমচে খিমচে উপরে উঠবেন সেটি দেখার জন্যে বিশাল জনতা রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করতে থাকে।

মির্জা মাস্টার স্কুলঘরের নিচে দাঁড়িয়ে ফ্যাকাশে মুখে একবার উপরে তাকালেন। কয়েক পা এগিয়ে তিনি স্কুলঘরের প্রায়-মসৃণ দেয়ালটি স্পর্শ করে হঠাৎ করে বুঝতে পারলেন হিসেবে একটি ছোট গোলমাল হয়ে গেছে। স্বাভাবিক ঘরের স্বাভাবিক দরজা দিয়েই তাকে মোটামুটি কসরত করে ঢুকতে হয়, এই কাত হয়ে থাকা স্কুলের দেয়াল বেয়ে উপরে উঠে আড়াআড়ি দরজা দিয়ে ভিতরে ঢোকা তার জন্যে একেবারেই অসম্ভব ব্যাপার। সোজা রাস্তায় দশ পা হাঁটলেই তাঁকে খানিকক্ষণ বসে নিঃশ্বাস নিতে হয়, এই স্কুলঘরের দেয়াল বেয়ে ওঠার চেষ্টা করলে তার হার্টফেল করে মরে যাওয়া বিচিত্র কিছু না।

স্কুলের উপর থেকে নানা ধরনের ছাত্রছাত্রীরা দরজা-জানালা এবং ফাঁকফোকর দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে তাঁকে ডাকাডাকি করতে থাকে, মির্জা মাস্টার ঠিক কী করবেন বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

ফারুখ বখত, ফরাসত আলি এবং হারুন ইঞ্জিনিয়ার অন্যান্য কৌতূহলী মানুষদের সাথে দাঁড়িয়ে পুরো ব্যাপারটি লক্ষ করছিলেন এবং মির্জা মাস্টারের বিশাল দেহটিকে উপরে তোলার জটিল সমস্যাটার কথা তারাও মোটামুটি একই সাথে বুঝতে পারলেন। ফারুখ বখত গলা নামিয়ে বললেন, “এখন কী করা যায়? এত মানুষজন দাঁড়িয়ে দেখছে যদি শিক্ষক ছাত্রদের কাছে যেতে না পারে তা হলে তো খুব লজ্জার ব্যাপার হবে।”

হারুন ইঞ্জিনিয়ার রেগে উঠে বললেন, “তখনই বলেছিলাম এরকম পাগলামি করতে যাবেন না, স্কুলঘরটাকে সোজা করেন–কিন্তু আমার কথা শুনলেন না।”

ফরাসত আলি বললেন, “এখন তো রাগ-গোস্বার সময় না, এখন হচ্ছে ক্রাইসিসের সময়। কিছু-একটা বুদ্ধি বের করো তাড়াতাড়ি।”

হারুন ইঞ্জিনিয়ার মাথা চুলকে বললেন, “বুদ্ধি বের করার কী আছে? একটা কপিকল বেঁধে মির্জা মাস্টারকে টেনে তুলতে হবে উপরে।”

“আছে কপিকল?”

“হ্যাঁ, আছে কয়েকটা। শক্ত নাইলনের দড়িও আছে।”

“তাহলে আর সময় নষ্ট করে কাজ নেই। শুরু করে দাও।”

হারুন ইঞ্জিনিয়ার গম্ভীর হয়ে বললেন, “সমস্যার সমাধান না করে সেটাকে রেখে দিতে হয় না, সেটা শুধু নতুন সমস্যা তৈরি করে।”

ফরাসত আলি দাঁত বের করে হেসে বললেন, “যদি কোনো সমস্যা না থাকে তা হলে আর বেঁচে থাকার আনন্দ কোথায়?”

কিছুক্ষণের মাঝেই দেখা গেল স্কুলঘরের উপরে শক্ত একটা কপিকল লাগানো হয়েছে। তার ভিতর দিয়ে নাইলনের শক্ত দড়ি ঢোকানো হয়েছে, দড়ির এক মাথায় মির্জা মাস্টারকে আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা হল, অন্য মাথায় হাত লাগাল উপস্থিত দর্শকদের প্রায় শদুয়েক উৎসাহী ভলান্টিয়ার।

হারুন ইঞ্জিনিয়ার হাতে একটা রুমাল নিয়ে একবার উপর দিকে তাকালেন, একবার মির্জা মাস্টারের বিশাল দেহের দিকে তাকালেন, তারপর উৎসাহী ভলান্টিয়ারদের দিকে তাকিয়ে তার রুমালটি নেড়ে বললেন, “মারো টান–”

শদুয়েক মানুষ একসাথে নাইলনের দড়ি ধরে হ্যাঁচকা টান মারে, সবাই আশা করেছিল মির্জা মাস্টার বুঝি মিটারখানেক উপরে উঠে যাবেন, কিন্তু তিনি উপরে উঠলেন না। সবাই সবিস্ময়ে দেখল স্কুলঘরটি মিটারখানেক বাঁকা হয়ে গেল।

হারুন ইঞ্জিনিয়ার মাথা নেড়ে বললেন, “ভয় পাবেন না। আবার টান মারেন”

উপস্থিত লোকজন হাইয়ো’ বলে আবার হ্যাঁচকা টান মারে। এবারে মির্জা মাস্টার খানিকটা উপরে উঠলেন, শূন্য থেকে ঝুলছেন বলে তাঁকে দেখায় একটা অতিকায় মাকড়শার মতো। তার হাত-পা ইতস্তত নড়তে থাকে এবং মনে হয় মাকড়শাটি উপর থেকে ঝুলছে।

উপস্থিত লোকজন প্রচণ্ড উৎসাহে আবার হ্যাঁচকা টান মারে এবং মির্জা মাস্টার আরেকটু উপরে উঠে যান। ধীরে ধীরে তিনি উপরে উঠতে থাকেন এবং উপর থেকে তাঁর ছাত্রছাত্রীরা প্রচণ্ড চাঁচামেচি করে উৎসাহ দিতে থাকে। হারুন ইঞ্জিনিয়ার তার রুমাল নাড়িয়ে বলতে থাকেন, ‘মারো টান’, অন্য সবাই বলে ‘হাইয়ো’ এবং সত্যি সত্যি মির্জা মাস্টার উপরে উঠে এলেন। কিছুক্ষণের মাঝেই তিনি একটা দরজার কাছাকাছি পৌঁছে গেলেন এবং দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা তার অসংখ্য ছাত্রছাত্রী তাকে খামচে ধরে ফেলে টেনে ক্লাসঘরের মাঝে ঢুকিয়ে ফেলে। সাথে সাথে উপস্থিত দর্শকেরা চিৎকার করে হাততালি দিয়ে জায়গাটি সরগরম করে দেয়।

মির্জা মাস্টার ক্লাসঘরে পৌঁছানোর পর ফরাসত আলি এবং ফারুখ বখত স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। ফরাসত আলি বললেন, “যাক বাবা বাঁচা গেল। প্রথমদিন স্কুল যদি ঠিক করে শুরু করা না যেত মনটা খুঁতখুঁত করত।”

ফারুখ বখত মাথা চুলকে বললেন, “স্কুল ঠিক করে হচ্ছে কি না তুই কেমন করে জানিস? হয়তো ক্লাসঘরে ঢুকতে গিয়ে মির্জা মাস্টার ব্যথা পেয়েছেন। হয়তো লম্বা হয়ে পড়ে আছেন, ছাত্ররা পাখা দিয়ে বাতাস করছে। হয়তো ভয়ে অজ্ঞান হয়েছেন—”

ফরাসত আলি মাথা নাড়লেন, “না, মির্জা মাস্টার ভালোই আছেন, ক্লাস নিতে শুরু করেছেন।”

“তুই কেমন করে জানিস?”

“আমি জানি। এইমাত্র ডানদিকে হেঁটে গেলেন–”

ফারুখ বখত অবাক হয়ে বললে, “তুই কেমন করে জানিস?”

“তাকিয়ে দ্যাখ। পুরো স্কুলঘরটা ডানদিকে বাঁকা হয়ে আছে। হঠাৎ সেটা সোজা হয়ে গেল, তারপর আবার বামদিকে বাঁকা হয়ে গেল।” ফরাসত আলি দাড়ি চুলকাতে চুলকাতে বললেন, “মির্জা মাস্টার বামদিকে গেলেন।”

ফারুখ বখত এবং ফরাসত আলি সবিস্ময়ে স্কুলঘরের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ দেখতে পেলেন পুরো স্কুলঘরটা একবার দুলে উঠল।

ফরাসত আলি চমকে উঠে বললেন, “কী হল হঠাৎ?”

হারুন ইঞ্জিনিয়ার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “মনে হয় মির্জা মাস্টার একটা হাঁচি দিলেন।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *