তৃতীয় অধ্যায় – সত্য ও বাস্তব
যখন আমরা বলি ‘মানুষ’ তখন সহজাত—প্রবৃত্তি—সংগত ব্যক্তিকে বুঝি, যে—ব্যক্তিকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিলে ইচ্ছামতো বর্ধিত হতে পারে। কিন্তু দেখা যায় যে মানুষ সেভাবে বর্ধিত হয় না, কোনো বিশেষ সমাজের মধ্যে বিশেষ মানুষরূপেই সে আত্মপ্রকাশ করে। জন্মগত বৈশিষ্ট্যের জন্য মানুষে মানুষে প্রভেদ থাকে, কিন্তু সমাজ সেই বৈশিষ্ট্যের বিরোধী নয়। উপরন্তু সভ্যতার, ক্রমাবর্তনে যে—বিভেদের (differentiation) সৃষ্টি হয় তাতে মানুষের এই ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য উপলব্ধি করবার পথ আরও প্রশস্ত হতে থাকে। মানুষকে সেইজন্য সহজ—প্রবৃত্তির সমষ্টি হিসাবে দেখা যায় না, কোনো বিশেষ সভ্যতাপ্রসূত মানুষ হিসাবেই দেখা যায়। সে—মানুষের সচেতনতা অন্য মানুষের সঙ্গে পারস্পরিক সম্বন্ধসাপেক্ষ।
মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির অর্থাৎ বহির্জগতের সংগ্রামের প্রারম্ভ থেকে মানুষের সঙ্গে মানুষের এই পারস্পরিক সম্বন্ধ স্থাপনের সূচনা। ব্যক্তি কতকগুলি নিয়মাধীন—শারীরিক (Physiological) ও মনস্তাত্ত্বিক (Psychological)। কিন্তু প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রামে লিপ্ত হয়ে মানুষ নিজেকে বিচ্ছিন্ন করেনি, অর্থনৈতিক উৎপাদন—প্রণালির ভিতর দিয়ে আরও ঘনিষ্ঠভাবে অনুপ্রবিষ্ট হয়েছে। এই অনুপ্রবেশের (interpenetration) ফলে সে যে নূতন নিয়মের অনুবর্তী হয়েছে তার নাম সমাজনীতি (sociology)। এই তিনটি নিয়ম—শারীরনীতি (Physiology), মনোনীতি (Psychology) ও সমাজনীতি (Sociology)—পরস্পর—বিরোধী নয়। এদের পরস্পর—মিলনে ও সহযোগিতাতে একদিকে এই নিয়মগুলি যেমন পরিবর্ধিত হয়েছে, তেমনি আর—একদিকে মানুষিক সভ্যতা ও সংস্কৃতি যুগে যুগে মহিমামণ্ডিত হয়ে অগ্রসর হয়েছে।
ভাবজগতে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের এই সংগ্রামের প্রতিভাত রূপ হচ্ছে বাস্তব (Reality) বা সত্য (Truth)। এই বাস্তব বা সত্য ঊর্ধ্বে শূন্য থেকে মানুষের কোলে নিক্ষিপ্ত হয় না, মানুষই একে সৃষ্টি করে এবং সেইজন্য এ—সত্য জীবন্ত, বর্ধিষ্ণু ও পরিবর্তনশীল। মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সংগ্রাম যত জটিলতর হতে থাকে তত সুন্দরতর ও আপাত—বিরুদ্ধরূপে এই সত্য মানুষের মনে প্রতিভাত হয়। কোনো নির্দিষ্ট সময়ে প্রত্যেক মানুষের মনে এই সত্যের মাত্র আংশিক প্রতিভাসন সম্ভব। বিকৃত, আংশিক ও সীমাবদ্ধ এই প্রত্যক্ষ বাস্তব ক্রমে বিজ্ঞানের অভিজ্ঞতা ও অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সত্যের শক্তিতে মূর্ত হয়ে ওঠে, যেহেতু এ—সত্য সমসাময়িক সামাজিক পরিবেষ্টন—উদ্ভূত এবং সামাজিক পরিবেষ্টনের ভিত্তি হচ্ছে অর্থনৈতিক উৎপাদনব্যবস্থা। কডওয়েল বলেছেন—
Thus at any time truth is the Special Complex formed by the partial reflections of reality in all living men’s heads not as a mere lumping together, but as these views are organised in a given society…”
(Christopher Caudwell—Illusion and Reality)
প্রত্যেক মানুষের মনে ‘সত্য’ দু—রকম উপায়ে জন্ম নেয়—অনুভূত অর্থাৎ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বাস্তবে (Perception) এবং স্মৃতিতে (Memory) অর্থাৎ অতীত অনুভূতির প্রভাবে। সমাজে পারস্পরিক সঙ্গভাবের ফলে মানুষের চেতনা ক্রমেই শক্তিশালী হতে থাকে এবং স্মৃতি ও অনুভূতিও সমাজের পেষণে পরিশোধিত ও পরিবর্ধিত হতে থাকে। এইজন্যই ব্যক্তির চেতনা হচ্ছে সমাজোৎপন্ন। পরম সত্য (Absolute Truth) বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই। বাস্তবের সঙ্গে মানুষের সংগ্রামের ফলে সত্যের জন্ম হয় এবং সংগ্রামের স্তরে স্তরে উন্নততর বাস্তব অবস্থার সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে সত্যও জটিলতর হতে থাকে। বাস্তবের উন্নতির পাশাপাশি সত্যও উন্নীত হয় এবং তার লক্ষ্যও উচ্চতর হতে থাকে। মানুষ যত দীর্ঘতর হতে থাকবে ততই তার পূর্ণাবয়ব নিজের দৃষ্টিপথে ভেসে উঠবে, এ—কথা প্রতিপন্ন করা যেমন হাস্যকর ও অর্থহীন, তেমনি ‘পরম সত্য’ সমাজলভ্য বলাও মূর্খতার নামান্তর।
মানুষের স্বাতন্ত্র্য অস্বীকার্য নয়। সামাজিক পরিবেষ্টনে পরস্পরের সান্নিধ্যে এসে মানুষের এই স্বাতন্ত্র্য স্ফূর্তি পায়, সমাজের রূপান্তর ঘটে। এই পারস্পরিক যোগাযোগের মূলে রয়েছে মানুষের জীবিকা—সংগ্রাম, অর্থাৎ সমসাময়িক সমাজের উৎপাদনব্যবস্থা। এই উৎপাদনব্যবস্থার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে সমাজ নূতন নূতন রূপ ধারণ করে, সেই সমাজে মানুষের পারস্পরিক সম্বন্ধের পরিবর্তন হয়, স্বাতন্ত্র্যেরও রূপ বদলায়। শ্রেণিবিন্যস্ত সমাজে একটি বিশিষ্ট শ্রেণির, অর্থাৎ শাসকশ্রেণির মধ্যেই এই স্বাতন্ত্র্য ও সামাজিক স্বাধীনতা সীমাবদ্ধ থাকে। অন্য শ্রেণির অর্থাৎ শাসিত ও শোষিত শ্রেণির স্বাতন্ত্র্য বা স্বাধীনতা মুকুরে প্রতিফলিত রূপের মতো অলীক। সুতরাং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের অবাধ স্ফূর্তি একমাত্র শ্রেণিহীন সমাজেই সম্ভব, যেখানে মানুষ বৃহৎ মানবগোষ্ঠীর একজন, বিশেষ শ্রেণিসচেতন জীব নয়। সত্যও কখনো মানুষের দিক থেকে চরম সত্য হতে পারে না, সাময়িক সত্য হতে পারে। বাস্তবের অগ্নিগহ্বর থেকে যে—সত্যের জন্ম হয়, বাস্তবের রূপাবর্তনে সে—সত্যেরও রূপান্তর ঘটে, এক সত্য অন্য সত্যে মূর্তি পরিগ্রহ করে। অভিজ্ঞেয়, জগৎসাপেক্ষ এই জীবন্ত সত্য আদর্শবাদীর নভশ্চারী অজ্ঞেয় ‘পরম সত্য’ নয়। অধ্যাপক হেনরি লেভির ভাষায় বলতে হয় :
If we must answer the question, what is truth? We would say, truth is the summation of man’s experience at any given moment, truth is a lantern that illuminates his next few steps, past truth becomes incomplete as a greater truth replaces it, truth is an instrument for the creation and working out of a human purpose, becoming sharper and more effective as that purpose becomes itself clearer, and as man’s reading of natural process becomes more and more accurate.
—H. Levy : A Philosophy for a Modern Man
সত্য কী? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে বলতে হবে যে, সত্য হচ্ছে কোনো নির্দিষ্ট সময়ে মানুষের অভিজ্ঞতাসমষ্টি, সত্য হচ্ছে সেই প্রদীপ যার শিখা—বিচ্ছুরিত আলোকসম্পাতে মানুষের পরবর্তী চলার পথ দৃষ্টিগোচর হয়, সত্য হচ্ছে মানুষের উদ্দেশ্য ও সৃষ্টির ও সাধনের অস্ত্র, উদ্দেশ্য স্পষ্টতর হবার সঙ্গে সঙ্গে এবং মানুষের প্রাকৃতিক গতি অধ্যয়নের যাথার্থ্যের সঙ্গে যে—অস্ত্র ক্রমে তীক্ষ্নতর ও শক্তিশালী হতে থাকে। সত্য হচ্ছে সংগ্রামরত সামাজিক মানুষের অস্ত্র, বন্ধুর পথ কেটে যে—অস্ত্র সুগম করে দেয়। সত্য হচ্ছে উদ্দেশ্যমুখর, আকাঙ্ক্ষানুরণিত মানবজীবনের সূর্য, যার জ্যোতিঃস্নাত পথে মানুষ দুর্গমতা দূর করে অগ্রসর হয়, উদ্দেশ্য সৃষ্টি করে, সাধন করে। সত্য অপরিবর্তনীয় ও নিরলম্ব নয়। সত্য পরিবর্তনশীল, ক্রমবিবর্ধমান ও সমাজাশ্রয়ী।
প্রকৃতির সঙ্গে সংযুক্ত সংগ্রামে মানুষ যে পরিবর্তনশীল উপায় উদ্ভাবন করেছে তার মধ্যে সর্বপ্রধান উপায় হচ্ছে ভাষা (Language)। একা প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রাম করা সম্ভব নয়, সহযোগিতা আবশ্যক। এই সহযোগিতালাভের একমাত্র উপায় হল ভাষা। কীভাবে সত্য ভাষায় আত্মপ্রকাশ করে?
শব্দ (Word) হচ্ছে ইঙ্গিত বা ধ্বনি। আসন্ন বিপদের সময় একপাল পশু চিৎকার করে ওঠে। একটি পশু চিৎকার করলেই আদিম অনুভূতির বশে সকলেই সন্ত্রস্ত হয়ে পলায়ন করে। সুতরাং চিৎকারের একটি আন্তরিক (Subjective) দিক আছে, সকলেই চিৎকারের সময় ভয় ‘অনুভব’ করে। শব্দের আর—একটি বাহ্যিক (Objective) দিকও আছে। এই চিৎকার ভীতিপ্রদ কোনো কিছুর উপস্থিতি নির্দেশ করে, যার অস্তিত্ব বাস্তব জগতে আছে। কিন্তু পশুর পক্ষে যা চিৎকারে সংকেত করা বা জ্ঞাপন করা সম্ভব, মানুষের পক্ষে তা সম্ভব নয়। সামাজিক মানুষ অর্থনৈতিক সহযোগিতায় এই চিৎকারকে শব্দে পরিণত করেছে। এই শব্দ এখন আর সহজ—প্রবৃত্তি—জাত নয়, খেয়াল ও ইচ্ছাপ্রসূত। অর্থনৈতিক উৎপাদনব্যবস্থার বিশেষ সামাজিক পরিবেষ্টনের সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধ থেকে হল এর উৎপত্তি ও বিকাশ। অতএব ভাষা মানুষের চেষ্টা—নিরপেক্ষ একটি প্রাকৃতিক ব্যাপার মাত্র নয়। ভাষা হল Energia, অর্থাৎ জীবনসংগ্রামে সহযোগিতার ফলে মানুষের সচেতন চেষ্টার প্রকাশ ভাষা মানুষেরই সৃষ্টি, প্রকৃতির অমোঘ বিধান তার মধ্যে নেই। মানুষ কোনো নির্দিষ্ট শব্দের সাহায্যে অন্য সকলের কাছে তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা জ্ঞাপন করতে সক্ষম হয় যেহেতু সকলের অভিজ্ঞতার সঙ্গে তার অভিজ্ঞতার সাদৃশ্য আছে এবং সে—শব্দ সে—অভিজ্ঞতার প্রতীক হিসাবে সকলের দ্বারাই গৃহীত হয়েছে। ঠিক তেমনি মানুষ কোনো নির্দিষ্ট শব্দের দ্বারা তার অনুভূতিকে অন্য সকলের কাছে ব্যক্ত করতে পারে সকলের অনুভূতির সঙ্গে তার অনুভূতির স্বাজাত্য আছে বলে, এবং সে—শব্দ সে—অনুভূতির প্রতীক হিসাবে সকলের দ্বারা গৃহীত হয়েছে বলে। এই সামাজিক বাস্তব (Social Reality) ও সামাজিক ‘অহমিকা’ (Social Egoism), এতে ব্যক্তিত্ব (Individuality) কিছুমাত্র ক্ষুণ্ণ হয় না। এই সামাজিক ‘অহমিকা’ ও উন্নততর সামাজিক বাস্তব আজ ব্যক্তিকে ব্যক্তিত্ব বিকাশের যে প্রশস্ত সুযোগ দিয়েছে, সে—সুযোগকে আধুনিক যুগে অস্বীকার করা হচ্ছে। এই কথা প্রচার করা হচ্ছে যে আধুনিক সভ্যতা মানুষকে পিষে নিংড়ে নিয়ে অন্তঃসারশূন্য করে দিয়েছে, সর্বগ্রাসী সমাজ মানুষের নিজস্বতাকে আত্মসাৎ করে নিয়েছে। উৎপাদনশক্তির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক ক্রমোন্নতির জন্য আজ মানুষ যে কল্পনাতীত অবকাশ পেয়েছে নিজেকে প্রকাশ করবার, নিজের সংকীর্ণ, অনুদারসত্তা প্রসারণের সেসব প্রচণ্ড শক্তিকে আজ নিষ্ক্রিয় ও অপাঙক্তেয় করে রেখেছে সামাজিক উৎপাদন—সম্বন্ধ। তাই আজ মানুষের বিক্ষুব্ধ অন্তর আলোড়ন করে অহমিকার অপমৃত্যুর বিলাপ ধ্বনিত হচ্ছে। এই বিলাপধ্বনি, এই ক্ষোভ ও অভিযোগ হচ্ছে প্রাচুর্যের দিনে আজ বেকার সমস্যা ও কুখাদ্যের যে—অপবাদ তারই প্রতিধ্বনি—‘‘the Ideological counterpart of denunciations and malnutrition and unemployment in a world of plenty.”
ধনতান্ত্রিক সমাজে উৎপাদনশক্তির যে বৃদ্ধি হয়েছে তাতে সামাজিক অহম—এর (Social Ego) প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তিত্ব বিকাশের পথও প্রশস্ততর হয়েছে। কিন্তু সেই বিরাট, বিপুল শক্তির রাশ টেনে রেখেছে প্রচলিত ধনতান্ত্রিক উৎপাদন—সম্বন্ধ (Productive relations)। সমাজের অন্তরে ও বাহিরে এই বিরোধের (Contradiction) প্রতিক্রিয়া হওয়া স্বাভাবিক। বাহ্যিক প্রতিক্রিয়া মূর্ত হয়ে উঠেছে বেকার সমস্যা ও বুভুক্ষার মধ্যে। আন্তরিক প্রতিক্রিয়া অভিব্যক্ত হয়েছে ‘অনুভূতির বুভুক্ষা’ (Emotional Starvation) ও ব্যক্তিত্বের বিনাশ (Crippling of Personalities), এই মর্মভেদী হাহাকারের মধ্যে। দুটিই যুগান্তকারী বিপ্লবের অগ্রদূত।
বিখ্যাত ফরাসি শিল্পী আঁদ্রে জিদকে একবার একজন সমালোচক বলেছিলেন যে ১৯২৫ সালে ফরাসি কঙ্গো (French Congo) ভ্রমণের পূর্বে সামাজিক অন্যায় ও অবিচার সম্বন্ধে তাঁর কোনো ধারণা ছিল না। আঁদ্রে জিদ একথার উত্তরে বলেছিলেন :
This is not so. If I had simply published the whole of my notes and the diary of my journey in the period when I wrote ‘Amyntas’ (1893-96), in the same way as I did for my journey in the Congo, or, to be more exact, if I had given free play in my notes to everything that was on my mind at that time, you would have found in them, for example, the story of the commencement of the exploitation of the Gufsa phosphates, and more than anything else, the story of the sinister and methodical expropriation of the small Arab farmers by the C-bank, none of which left me indifferent. But there you are! It was not my job. I should have thought myself dishonoured as an artist if I had lent my pen to such vulgar cares. That was something for people more competent in such affairs than myself.
”তা নয়। কঙ্গো ভ্রমণ সম্বন্ধে যেমনভাবে আমি আমার ডায়েরি লিখেছিলাম, ঠিক তেমনিভাবে যদি আমার ‘আমিনট্যাস’—এর (১৮৯৩—৯৬) কাহিনিগুলি লিপিবদ্ধ করতাম, যদি সেই সময় আমার মনে যেসব ভাব ছিল সেগুলিকে স্বাধীনভাবে প্রকাশ করতাম, তাহলে তার মধ্যে গাফসা ফসফেট—এর শোষণ শুরু এবং আরবের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের সি—ব্যাঙ্ক কর্তৃক হীন নিয়মিত উৎপাটন প্রভৃতি সবই ব্যক্ত হত, কারণ এর কোনোটির প্রতিই আমি উদাসীন ছিলাম না। কিন্তু সমস্যা এইখানে! এসব আমার কর্তব্য নয়। এইসব নীচ জঘন্য ব্যাপারকে কলম দিয়ে প্রকাশ করবার অর্থ হচ্ছে শিল্পী হিসাবে নিজের মর্যাদা নষ্ট করা। এসব ব্যাপার অন্য বহু উপযুক্ত ব্যক্তির চিন্তার খোরাক জোগাতে পারে, কিন্তু আমার পারে না।”
ফরাসি কঙ্গোতে যাত্রার পূর্বে আঁদ্রে জিদ পৃথিবীকে দেখতেন তাঁর অন্তরের প্রতিচ্ছবিরূপে; একমাত্র তাঁর মনোজগৎই ছিল তাঁর কাছে সত্য ও প্রকৃত, বাস্তব জগৎ তারই প্রতিবিম্ব মাত্র। তাঁর ব্যক্তিগত চেতনার বাইরে জগতের যে বাস্তব অস্তিত্ব রয়েছে তাকে তিনি প্রত্যক্ষরূপে অনুভব করতে আরম্ভ করলেন কঙ্গো ভ্রমণের পর। কঙ্গোতে পর্যন্ত তিনি মানুষের পরিপূর্ণ দৃষ্টি দিয়ে জগৎকে না দেখে, ক্রুদ্ধ, ক্ষুব্ধ, নিপীড়িত ব্যক্তির অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখলেন। জিদএ—সম্বন্ধে নিজেই সুন্দর বিশ্লেষণ করেছেন। ১৮৯৩ সালে যখন তিনি আলজিরিয়াতে ঔপনিবেশিক শোষণ (Colonial exploitation) দেখেছিলেন, তখনও শাসনকর্তা, অর্থনীতিবিদ প্রভৃতি বিশেষজ্ঞদের উপর আস্থা হারাননি। তিনি ভেবেছিলেন যে এসব সমস্যার সমাধান করবার দায়িত্ব ও কর্তব্য এইসব বিশেষজ্ঞদের তাঁর মতো শিল্পীর নয়। জিদ লিখেছিলেন :
I thought that what aroused my indignation must make them indignant also and that they were better qualified than I to denounce and reform abuse, extortion, injustice and error. Then at that time I was still deplorably modest and did not yet understand that when there is no one but the victim to shout ‘Stop thief’, he runs the risk of not being heard. In the Congo it was different. There I could have no illusion that there would be anyone to listen to the cry of the robbed. I had been told so over and over again before I left, in order to dissuade me from going. “Don’t go out there, nobody goes out there for pleasure.” Administrators, traders, missionaries, the only representatives of France, all had their mouths closed, either out of duty or self interest . Here, where I alone was able to speak, I had to speak. I was not anti-imperialist when I left home, and it was not as an anti-imperialist that I denounced the abuses I had witnessed. Yes, it was not till much later that an inescapable logic led me to connect these particular abuses to a whole deplorable system and that I was brought to understand that a system which tolerated, protected and favoured such abuses because it profited from them itself, was bad from top to bottom.
”আমি ভেবেছিলাম যে আমার কাছে যা অপ্রীতিকর মনে হয়েছে তা তাদের কাছেও প্রীতিকর মনে হবে না, এবং এইসব অন্যায়, অবিচার ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবার বা সেগুলিকে সংস্কার করবার যোগ্যতা আছে আমার চাইতে তাদেরই বেশি। সে—সময় আমি অত্যন্ত শোচনীয়ভাবে বিনয়ী ছিলাম এবং তখনও ঠিক বুঝতে পারিনি যে যখন বিপন্নকেই চোর ধরবার জন্য চিৎকার করতে হয় তখন তার সেই অসহায় আর্তনাদ অশ্রুত থাকবারই সম্ভাবনা থাকে বেশি। কঙ্গোতে ঠিক এর বিপরীত ঘটল। এখানে শোষিতের ও পীড়িতের আবেদন একদিন যে সকলে শুনবে, এ—ভ্রান্তি আমার দূর হয়ে গেল। যাতে আমি না যাই সেজন্য আমার যাত্রার পূর্বে বারবার আমাকে এই কথা শোনানো হয়েছিল। ‘যাওয়া উচিত নয়, ওখানে স্ফূর্তির জন্য কেউ যায় না।’ শাসনকর্তারা, ব্যবসায়ীরা, ধর্মপ্রচারকেরা, ফ্রান্সের একমাত্র প্রতিনিধিরা সকলেই নীরব রইলেন, কর্তব্যের খাতিরেই হোক বা নিজের স্বার্থের জন্যই হোক। এখানে একমাত্র আমারই কথা বলবার ক্ষমতা ছিল এবং আমাকে কথা বলতেও হয়েছিল। দেশ থেকে যাত্রার সময় আমি সাম্রাজ্য—বিরোধী ছিলাম না; বা সে—মনোভাব নিয়ে যা দেখেছি তার প্রতিবাদও আমি করিনি। বাস্তবিক, তার অনেক পরে আমি নিজের যুক্তি দিয়ে বুঝি যে এইসব অন্যায় অবিচারের সঙ্গে কোনো একটি বিশেষ জঘন্য সমাজব্যবস্থার প্রত্যক্ষ যোগাযোগ আছে, এবং এ—ও উপলব্ধি করি যে যে—সমাজব্যবস্থা এইসব অন্যায়ের আশ্রয় ও প্রশ্রয় দেয়, সে—সমাজ আগাগোড়া বিষাক্ত, ভয়াবহ।”
এই স্বীকারোক্তির মধ্যে আঁদ্রে জিদের মানসিক ক্রমবিকাশ সুন্দরভাবে প্রকাশ পেয়েছে। নিজের সীমাবদ্ধ চেতনার উপচ্ছায়ার বাইরে কোনো সত্যকে তিনি স্বীকার করতেন না। ক্রমে এই শূন্য ধারণাকে বর্জন করে তিনি বহির্জগতের অস্তিত্বকে স্বীকার করলেন এবং বুঝলেন যে ব্যক্তির চেতনা ও স্বাধীনতার স্ফূর্তির জন্য এই বহির্জগৎকে পরিপূর্ণরূপে উপলব্ধি করা একান্ত আবশ্যক। তিনি বুঝলেন যে স্বাশ্রয়ী জীবনের যে—মুক্তি তা মুক্তি নয়, সত্যকার জীবনকে অস্বীকারের গ্লানিময় ভ্রান্তি। বাস্তবের উত্তপ্ত ভূমির উপর যে—সৌন্দর্য মুকুলিত হয়ে ওঠে তার স্পর্শে অবসাদ আসে না, পূর্ণ জীবনাস্বাদ পাওয়া যায়। অন্তর্জগৎ ও বহির্জগতের মধ্যে অলঙ্ঘনীয় প্রাচীর নেই। মনের নেহাইয়ের উপর পেটা বহির্জগতের আর—একটি রূপ হচ্ছে অন্তর্জগৎ। র্যালফ ফক্স বলেছেন :
Art is one of the means by which man grapples with and assimilates reality. On the forge of his own inner consciousness the writer takes the white-hot metal of reality and hammers it out, refashions it to his own purpose, beats it out madly by the violences of thought.
(Ralph Fox—The Novel and the People)
বাস্তবের আত্মীকরণ ও উপলব্ধির উপায় হচ্ছে শিল্প। শিল্পী তাঁর অভ্যন্তরীণ চেতনার নেহাইয়ের উপর বাস্তবের উত্তপ্ত ধাতুকে দুর্নিবার চিন্তার আঘাতে নূতন রূপ দেন। সেই রূপই তাঁর শিল্পে মূর্ত হয়ে ওঠে। সত্যকার মহৎ শিল্পী যিনি তিনি বাস্তবের সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন সংগ্রাম করবেন এবং সে—সংগ্রাম হবে বিপ্লবী সংগ্রাম, কারণ বাস্তবকে তিনি রূপান্তরিত করবেন। জীবন তাঁর কাছে হবে মুখ্যত সংগ্রাম—মুখর, সৎ ও অসৎ—এর দ্বন্দ্বের ভিতর দিয়ে জয়যাত্রা।
প্রশ্ন হতে পারে যে সেই সংগ্রামের জন্য শিল্পীকে মার্কসপন্থী কেন হতে হবে? র্যালফ ফক্স Times Literary Supplement—এর মার্কিন বিপ্লবী সাহিত্য সম্বন্ধে একটি সম্পাদকীয় মন্তব্য দিয়ে বলেছেন যে মার্কসিজম বা অন্য কোনো দর্শন পছন্দ—অপছন্দের প্রশ্ন নয়, মার্কসিজম শিল্পীর কাছে শুধু যে সামান্যরূপ (Form) হিসাবে গ্রহণযোগ্য—তা নয়, এ—যুগের শিল্পীকে এই মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে জগৎকে দেখতেই হবে। উক্ত Times Literary Supplement—এর সম্পাদকীয় প্রবন্ধে বলা হয়েছে : Art and dogmatism are as the poles opposed… There is no reason why an artist should not be an honest artist and a Marxist at one hand and the same time, so long as the form of his Marxism does not conflict with his deepest knowledge. Every man must of necessity be blinded or blinkered by his ignorances; he can at best but strive for a perpetual new clarification. Form of some sort is inevitable if only as mental machinery; and to the objective view there seems no obvious reason why Marxism should not function as satisfactorily in that subordinate role—so long as it is kept subordinate as any other comparable conception.
শিল্প ও সংস্কারের মধ্যে মেরু—ব্যবধান রয়েছে। একসঙ্গে শিল্পী ও মার্কসপন্থী না—হবার কোনো যুক্তিসংগত কারণ নেই, যদি অবশ্য মার্কসিজম—এর সামান্য রূপের (Form) সঙ্গে শিল্পীর গভীর জ্ঞানের কোনো বিরোধ না হয়। অজ্ঞতার অন্ধকারে মানুষ অন্ধ থাকবেই এবং এই অন্ধকার দূর করবার জন্য সে নিত্যনূতন চেষ্টা করবে। মানসিক আশ্রয় (Instrument) হিসাবে যেকোনো সামান্য রূপের একান্ত প্রয়োজন আছে এবং বাহ্যিক দৃষ্টিতে এই সামান্য রূপের যোগ্যতা মার্কসিজম—এর না—থাকবার কোনো কারণ নেই। টাইমস—এর সমালোচকের মার্কসিজম—এর প্রতি অনুকম্পা থাকলেও তিনি তার আসল গুরুত্বকে উপলব্ধি করিতে পারেননি। মার্কসিজম বা অন্য কোনো ‘ইজম’ পছন্দ—অপছন্দের প্রশ্ন এখানে অবান্তর। বর্তমান সমাজব্যবস্থার মধ্যে যদি প্রগতিমূলক কোনো দৃষ্টি দিয়ে সব বিষয় উপলব্ধি করতে হয়, যদি বর্তমানের সমস্ত বিরোধ ও সংস্কারকে আবর্জনার মতো ঝেঁটিয়ে ফেলতে হয়, তাহলে মার্কসীয় জীবন ও সমাজদর্শন স্বীকার না করে উপায় নেই। কারণ মার্কসিজম সমস্ত বিরোধকে স্বীকার করে তাদের বিরুদ্ধে অনিরুদ্ধ সংগ্রামের ফলে, সমাজ—সভ্যতা ও সংস্কৃতির অগ্রগতির বজ্রবাণী ঘোষণা করে। মার্কসিজম সেই বৈপ্লবিক রাজপথের সন্ধান দেয়, যে—পথে অগ্রসর হয়ে শিল্পী ও মানুষ বাস্তবকে উচ্চতর বাস্তবে রূপান্তরিত করতে পারে, ছোটো ছোটো অলিগলির গোলকধাঁধার মধ্যে মানুষ যেখানে নৈরাশ্যের অবসাদে আচ্ছন্ন হয় না। সেই প্রশস্ত পথই মানুষের একমাত্র বরেণ্য পথ। সামান্য রূপ বা অধেয়, এদের কোনো স্বতন্ত্র নিষ্ক্রিয় সত্তা নেই। আধের থেকে সামান্য রূপের সৃষ্টি এবং সামান্য রূপ ও আধেয় পারস্পরিক প্রতিক্রিয়াতে সক্রিয় থাকে। সে মার্কসিজম কোনো শিল্পীর বা মানুষের জাঁকালো, শোভনীয় পোশাক হতে পারে না। অভিনয়ের চমকপ্রদ আংরাখা নয় মার্কস—ইজম। সমগ্র সত্তা ও জীবন দিয়ে শিল্পী মার্কসিজম উপলব্ধি করবেন। বর্তমান ধনতান্ত্রিক সমাজ যখন চতুর্দিক থেকে শিল্পীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে তাঁকে ক্রুশকাঠে বিদ্ধ করবার জন্য বদ্ধপরিকর হয়েছে, তখন তিনি অবনমিত অন্তঃকরণে পশ্চাৎপদ হবেন না। জীবনের সেই দর্শনকে মনেপ্রাণে উপলব্ধি করবেন, একমাত্র যার অনুপ্রেরণায় বৈরিতাকে ধ্বংস করে অগ্রাভিযান সম্ভব। ধনতান্ত্রিক সমাজের সমস্ত বিরোধী শক্তি যখন আজ বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে শিল্পীর বিরুদ্ধে, মানুষের বিরুদ্ধে, যখন ভদ্রবেশী বর্বর পুঁজিবাদী ও ফ্যাসিস্টদের কন্ঠ থেকে স্পষ্ট উচ্চারিত হচ্ছে—“I Miles, Expedi Crucem”—তখন শিল্পীর ও মানুষের কন্ঠ থেকেও সুস্পষ্ট প্রতিধ্বনি আসুক।
I am defending my honour… as a revolutionary; I am defending my communist ideology, my ideals, the content and significance of my whole life. (Dimitroff’s speech at Leipzig Court—Reichstag Fire Trial).
এই হচ্ছে জীবন্ত মানুষের ভাষা। এখানে মার্কসিজম রঙিন চিত্ত—বিনোদনকারী কিংখাব নয়, সামান্য রূপ নয়, অন্তর ও বাহির দুইয়ের ওতপ্রোত মিলন। এই হচ্ছে মানুষের জয়যাত্রার মহামন্ত্র। সমগ্র সত্তার অণুপরমাণুতে এই মন্ত্র অনুরণিত হয় বলেই তার এই সরল ও সুস্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ। সুতরাং মার্কসিজম শিল্পীর মনের সামান্যরূপ নয়, মার্কসিজম শিল্পীর সমগ্র সত্তার উপলব্ধ সত্য।
মানুষ ও তার সর্পিল ক্রমবিকাশ হচ্ছে মার্কসীয় দর্শনের মর্মকথা। এই মানুষ একদিকে যেমন শিল্পী বা স্রষ্টা তেমনি আর—একদিকে শিল্পের উপাদান। সংগ্রামমুখর এই সক্রিয় মানুষের সঙ্গে সমাজের সম্বন্ধ কী? মানুষের ব্যক্তিক স্বাধীনতার স্বরূপ কী এবং সামাজিক সংগ্রামে তার মূল্য কতটুকু? শিল্পীর স্বাতন্ত্র্য সম্বন্ধে যে অমূলক ধারণা আছে তা দূর করবার জন্য এ—প্রশ্নের উত্তর দেওয়া প্রয়োজন। ব্যক্তির স্বরূপ সম্বন্ধে ফ্রিডরিশ এঙ্গেলস বলেছেন :
History makes itself in such a way that the final result always arises from conflicts between many individual wills, which each again has been made what it is by a host of particular conditions of life. Thus there are innumerable intersecting forces, an infinite series of parallelograms of forces which give rise to one resultant—the historical event. This again may itself be viewed as the product of a power which, taken as a whole, works unconsciously and without volition. For what each individual wills is obstructed by everyone else, and what emerges is something that no one willed. But from the fact that individual wills… do not attain what they want, but are merged into a collective mean, a common resultant, it must not be concluded that their value = 0. On the contrary, each contributes to the resultant and is to this degree involved in it.
”ইতিহাসের গতির এমনই ধারা যে শেষ পর্যন্ত যা ঘটে তা বহু ব্যক্তির সংকল্পের সংঘর্ষের ফল, এবং এই সংকল্পের প্রত্যেকটি আবার জীবনের বহু বিশেষ অবস্থার দ্বারা গঠিত হয়। সুতরাং বহু শক্তির প্রতিচ্ছেদ আছে, বহু সামান্তরিক শক্তি আছে, যার ফল হচ্ছে কোনো ঐতিহাসিক ঘটনা। এই ঘটনা আবার এমন শক্তির দ্বারা সৃষ্টি হতে পারে যার ক্রিয়া নির্জ্ঞাত। কারণ প্রত্যেকের সংকল্পকে অন্য সকলে বাধা দেয় এবং যা আবির্ভূত হয় তা সকলেরই সংকল্পাতীত। কিন্তু যেহেতু ব্যক্তির সংকল্পের পরিণতি সাধারণ ফলে সেহেতু এ—সিদ্ধান্ত করা উচিত নয় যে তার মূল্য শূন্য। উপরন্তু সেই সাধারণ ফলাফলে সকলেরই কিছু কিছু দান আছে, এবং ঠিক ততটুকুই সেই সাধারণ—লব্ধের সঙ্গে প্রত্যেকে জড়িত।”
এঙ্গেলসের এই উক্তি শুধু ঐতিহাসিকের দিক থেকে নয়, শিল্পীর দিক থেকেও প্রণিধানযোগ্য, কারণ শিল্পীর ইচ্ছা ও অনুভূতি বাস্তব জীবনক্ষেত্রে অন্য মানুষের ইচ্ছা ও অনুভূতির সঙ্গে সংগ্রামরত। এই সংগ্রামের ফলে যা আবির্ভূত হয় তা কেউ ব্যক্তিগতভাবে ইচ্ছা করে না, প্রত্যেকের অবচেতন মনে গোপন থাকে। যা সৃষ্ট হয় তা নূতন—“What emerges is something that no one willed”—এবং জগতের সমস্ত মহৎ শিল্পই তা—ই। ব্যক্তির মূল্য এখানে শূন্য হয়ে যায় না, সেই নূতনের আবির্ভাবের জন্য তার শক্তির ও ইচ্ছার সংযোগ থেকে ব্যক্তির মূল্য নির্ধারিত হয়।
শিল্পের উদ্দেশ্য জীবনের সত্যকে উপলব্ধি করে তাকে ব্যক্ত করা। সত্যের এই অভিব্যক্তি বাস্তবের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন নয়, সম্পৃক্ত। সত্য বিমূর্ত, অপরিবর্তনীয় নয়—সত্য মূর্ত, গতিশীল ও পরিবর্তনশীল। মানুষের সক্রিয় সামাজিক জীবনের সংগ্রামের মধ্যেই এই সত্য যুগে যুগে আত্মপ্রকাশ করে আবার অন্তর্ধান করে। সত্য ধ্রুব নয়, কারণ মানুষ ধ্রুব নয়, তার পরিবেষ্টন ধ্রুব নয়, বাস্তব জীবনও ধ্রুব নয়। শিল্প সত্য, কারণ শিল্পী জীবনের পূজারি, বাস্তবের স্রষ্টা। শিল্প সুন্দর কারণ মানুষ সুন্দর, বাস্তব সুন্দর, জীবন সুন্দর। শিল্প মঙ্গলময় কারণ শিল্পী জীবনের যুগান্তকারী রূপকার, উচ্চতর বাস্তবের ও মহত্তর সত্যের স্রষ্টা। সেইজন্য লেনিন বলেছেন, “Truth is formed out of the totality of all aspects of a phenomenon of reality, and then (mutual) relationships.” বাস্তবের সমগ্রতা থেকে সত্যের জন্ম। এই বাস্তব হচ্ছে সামাজিক মানুষের সংগ্রাম—মুখর বিরোধ—আকীর্ণ জীবন। শিল্পী যুগে যুগে সমাজের ও মানবজীবনের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এই বাস্তবের সমগ্র রূপকে উপলব্ধি করে সত্যকে প্রকাশ করেন।