সকালে সংসারের টুকটাক দেখাশুনা বিধি ব্যবস্থা ছাড়াও খেয়েদেয়ে কলেজ যেতে হয়। তাছাড়া সল্টলেক থেকে বেথুন কলেজ যেতেও বেশ সময় লাগে। কোন কোনদিন তো ট্যাক্সিতেও ওদের যেতে হয় ঠিক সময়ে পৌঁছবার জন্য। তাই ইচ্ছা থাকলেও সময় হয় না।
তাছাড়া আরো একটা ব্যাপার আছে।
এতো গ্যাস সিলিন্ডার পাঠাবার জন্য ফোন করা না যে কনজিউমার নাম্বার বলে দিলেই কথা বলা শেষ। দুর্বা আর সুনন্দার সঙ্গে কথা বলতে হলে হাতে বেশ একটু সময় চাই। ওদের সঙ্গে কথা বলা শুরু করলে তো দু-পাঁচ মিনিটে শেষ করা যায় না। তাছাড়া ইচ্ছাও করে না অত তাড়াতাড়ি রিসিভার নামিয়ে রাখতে।
কথা হয় সন্ধ্যের পর এবং সব সময় শিবানীর বাড়ি থেকে। সুব্রতবাবু ও বাবাই এখনই যেন কিছু সন্দেহ করতে না পারে, তার জন্যও সতর্ক থাকতে হয়।
হ্যালো।
মাসীমা, আমি আপনার শিল্পী।
দুর্বা হাসতে হাসতেই বলে।
শিবানীও হাসতে হাসতে বলেন, এক্ষুনি ভারতী ঘরে পা দিয়েই বলছিল, হ্যাঁরে, দুর্বাকে ফোন কর। অমি বললাম, এই চিঠিটা পড়েই ফোন করছি।…
চিঠি পড়া শেষ হয়েছে নাকি…
চিঠি পড়ার পর তোমাকে যেই ফোন করতে যাচ্ছি, ঠিক তখনই টেলিফোন রিং বাজলো।
দেখেছেন মাসীমা, কি রকম টেলিপ্যাথি। যে মুহূর্তে আপনারা আমার কথা…
হ্যাঁ, মা, তাইতো দেখছি।
শিবানী মুহূর্তের জন্য থেমে বলেন, তুমি একটু ভারতীর সঙ্গে কথা বলো। তা নয়তো ও এখুনি আমার সঙ্গে ঝগড়া শুরু করবে।
দূর্বা একটু হেসে বলে, আপনারা জীবনে কখনও ঝগড়া করেছেন?
না, করিনি কিন্তু এখন তোমার সঙ্গে একটু বেশি কথা বললেই ও ঠিক ঝগড়া করবে।
শিবানী থামেন, শুরু করেন ভারতী।
দুর্বা, তুমি তো সেদিন দেখেছ শিবানীর হ্যান্ড ফ্রী সেট।
হ্যাঁ, মাসীমা, দেখেছি।
তাই বলছি, তোমার সব কথাই শুনেছি। সত্যি বলছি, এই সন্ধ্যের পর তো আমাদের দুজনের হাতেই প্রচুর সময়। তাই তোমার সঙ্গে কথা না বলে আমরা থাকতে পারি না।
শিবানী ওদের কথার মাঝখানেই বলেন, তোমার সঙ্গে কথা বলা আমাদের নেশায় দাঁড়িয়ে গেছে।
দুর্বা বলে, রোজ আপনাদের সঙ্গে কথা না বললে আমারও একদম ভাল লাগে না।
ভারতী চাপা হাসি হেসে বলেন, তার মানে এই দুই বুড়ীকে তোমার একটু একটু ভাল লেগেছে?
একটু একটু মানে? দারুণ ভাল লেগেছে। আপনারা দুজনেই যেমন চার্মিং আর গ্রেসফুল, সেইরকমই অ্যাফেকশনেট। ভাল না লেগে পারে।
কিন্তু তুমি তো আমাদের দুজনকে একেবারে হিপানোটাইজ করেছ।
দুর্বা একটু জোরেই হেসে ওঠে। বলে, আমি কী পি. সি. সরকার যে আপনাদের হিপনোটাইজ করব?
না, মা, তুমি পি. সি. সরকার না; তোমার রূপ-গুণ-স্বভাব-চরিত্র আমাদের মুগ্ধ করেছে।
অত বললে ঠিক আমার অহংকার হবে।
আচ্ছা সুনন্দা কি করছে?
বাবা তো এখানে নেই। সুতরাং মা নিশ্চয়ই টি.ভি.তে সিরিয়াল দেখছে। সময় তো কাটাতে হবে।
সত্যিই তো ওকে সময় কাটাতে হবে।
মা দুপুরে একদম ঘুমুতে পারে না। সারা দুপুর গল্প-উপন্যাস পড়ে বলে সন্ধের পর আর পড়তে চায় না।
ঠিকই তো। সব সময় কি পড়তে ভাল লাগে?
বাবা কলকাতায় থাকলে কথায়-বার্তায় মা-র সময় কেটে যায় কিন্তু বাবা দিল্লী বা হায়দ্রাবাদ গেলেই…
সিরিয়াল দেখা শেষ হলে সুনন্দা যদি পারে তাহলে যেন একবার ফোন করে। চার-পাঁচদিন ওর সঙ্গে কথা হয় নি।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, মা ঠিকই ফোন করবে।
হ্যাঁ, কিছুক্ষণ পরে সুনন্দাও ফোন করেন।
কী হলো? আমাদের দাদা এখানে নেই বলে টি, ভি, দেখছিলে?
কী করব বলো শিবানীদি? তোমাদের দাদা থাকলে তবু ঝগড়া-টগড়া করে বেশ সময় কেটে যায় কিন্তু…
বাজে কথা বলল না। দাদার সঙ্গে তোমার ঝগড়া হয়, এই কথা আমাদের বিশ্বাস করতে হবে?
তোমাদের দাদা কি এমন মহাদেব যে তার সঙ্গে ঝগড়া হবে না?
শিবানী হাসতে হাসতে বলেন, সুনন্দা, শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করো। দাদার কথা বলার সময় এখনও তত নতুন বউদের মত লজ্জায় তোমার সারা মুখ লাল হয়ে যায়।
ওনার কথায় সুনন্দা হো হো হেসে ওঠেন। বলেন, সত্যি তোমরা কলেজে প্রফেসরী করো বলে কত আজেবাজে কথাও কত সুন্দর করে বলতে শিখেছ দেখছি।
আর কিছু বদনাম দেবে না?
আচ্ছা, আচ্ছা, আর ঝগড়া করো না। এবার বলো ভারতীদি, কি কাছে আছে?
কাছে আছে মানে?
শিবানী মুহূর্তের জন্য চাপা হাসি হেসে বলেন, কাছে আছে মানে? ও তো প্রায় আমার ঘাড়ের উপর চেপে আছে। তোমার বা তোমার মেয়ের সঙ্গে যে এটুকু প্রাইভেট প্রাণের কথা বলব, সে সুযোগও আমার নেই।
সত্যি তোমরা দুজনে আছো ভাল।
এবার ভারতী বলেন, সুনন্দা, আমাদের দু’জনের তো আর কোনভাবে ভাল থাকার উপায় নেই।
সুনন্দা বলেন, কেন?
ঠাকুরপো তো অনেক দিন থেকে নিরুদ্দেশ আর আমার বুড়ো ভোলানাথ বাড়িতে ফিরেই মুখের সামনে একখানা বই নিয়ে ধ্যানস্থ। তাই…
অমন স্বামী পেয়ে বেঁচে গেলে ভারতীদি।
তাই নাকি?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
.
এইভাবেই দিন যায়। কখনো কখনো সময় সুযোগ হলে ভারতী আর শিবানী ওদের ওখানে যান। এই মাস দুয়েকের মধ্যে দুর্বাও দু’বার সল্টলেকে ওদের কাছে এসেছে। তার মধ্যে একদিন সুনন্দাকেও সঙ্গে এনেছিল; তবে সেদিন ওরা বেশিক্ষণ থাকেনি। লেকটাউনে অসুস্থ ছোট মাসীকে দেখতে গিয়েছিল সুনন্দা মেয়ের সঙ্গে। বাড়ি ফেরার পথে মাত্র ঘণ্টা খানেক ছিল ভারতী আর শিবানীর কাছে।
সেদিনই ভারতী বলেছিলেন, সুনন্দা, আজ নিছকই বুড়ী ছুঁয়ে গেলে। এর পর এসে সারাদিন কাটাবে আমাদের কাছে।
হ্যাঁ, সত্যি, এর পর একবার সারাদিন কাটাবো তোমাদের সঙ্গে।
মনে থাকবে তো?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে থাকবে।
প্রায় মাস খানেক পরের কথা। সেদিন রবিবার। অন্যান্য রবিবারের মত সেদিনও ভারতী আর শিবানী উল্টোডাঙায় মুচি বাজারে যাবার উদ্যোগ করছেন, ঠিক সেই সময় টেলিফোন।
হ্যালো!
মাসীমা, মা কথা বলবেন।
হ্যাঁ দাও।
সুনন্দা রিসিভার হাতে নিয়ে একটু হেসে বলে, শিবানীদি, আজ একটু চাল বেশি নিও। দুপুরে আমরা দুজনে যাব।
সত্যি তোমরা আসছো?
তবে কী ঠাট্টা করছি।
কখন আসবে?
ভাবছি, মোটামুটি, দশটার মধ্যে রওনা হয়ে…
তার মানে এগারোটার মধ্যে আসবে।
হ্যাঁ, তাই মনে হয়।
এসো, এসো, খুব আড্ডা দেওয়া যাবে।
শিবানীদি, এখন রাখছি। একটু পরেই তো দেখা হবে, কী বলো।
কথা শেষ করেই শিবানী জানলার সামনে দাঁড়িয়ে গলা চড়িয়ে বলেন, এই ভারতী, শিগগির আয়। দারুণ খবর আছে।
এক মিনিটের মধ্যেই ভারতী শিবানীর কাছে এসে বলেন, কী দারুণ খবর আছে রে?
শিবানী কোন মতে হাসি চেপে বলে, তোর ভাবী বেয়ান আর ভাবী পুত্রবধূ আসছে।
সত্যি?
তবে কি তোকে মিথ্যে বলছি?
উনি মুহূর্তের জন্য না থেমেই বলেন, এক্ষুনি সুনন্দা ফোন করে বলল, এগারটার মধ্যে আমাদের এখানে পৌঁছবে।
ভারতী একটু চিন্তিত হয়ে বলেন, আজতো তোর দাদা আর বাবাইও বাড়ি আছে।
শিবানী একটু হেসে বলেন, ভালই তো! আজই সব দেখাশুনা হয়ে যাবে।
হ্যাঁ, তা অবশ্য ঠিক।
আর সময় নষ্ট না করে চল বাজার থেকে ঘুরে আসি।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি নন্দকে গাড়ি বের করতে বলছি।
.
মেয়েকে নিয়ে সুনন্দা গাড়ি থেকে নামতেই ভারতী মুচকি হেসে গলা চড়িয়ে বলেন, এই শিবানী, শাঁখ বাজিয়ে মালা পরিয়ে সুনন্দাকে ঘরে নিয়ে যা।
সুনন্দাও হাসতে হাসতে বলে, ভারতীদি, যদি বেশি বাড়াবাড়ি করো, তাহলে আজ আমি বাড়িই ফিরব না।
শিবানী দুর্বার একটা হাত ধরে বলেন, শিল্পী, চলো, আমরা ভিতরে যাই। ওরা দু’জনে রোদ্দুরে দাঁড়িয়ে ঝগড়া করুক।
হ্যাঁ, মাসীমা, সেই ভাল।
ওদের পিছন পিছনেই ভারতী সুনন্দাকে নিয়ে ভিতরে যান। সবাই মিলে ড্রইংরুমে বসতেই শিবানী বলেন, সত্যি বলছি ভারতী, তোমরা সারাদিনের জন্য এসেছ বলে খুব ভাল লাগছে। আজ আমরা প্রাণ ভরে আড্ডা দেব।
উনি মুহূর্তের জন্য না থেমেই ঠোঁটের কোনে হাসি লুকিয়ে বলেন, প্রতিদিন শুধু ভারতীর মুখ দেখতে কী ভাল লাগে?
দুর্বা সঙ্গে সঙ্গে দু’হাত দিয়ে ভারতীর গলা জড়িয়ে ধরে শিবানীর দিকে তাকিয়ে বলে, এমন সুইট আর লাভলি বন্ধুর মুখ দেখতেও ভাল লাগে না?
না।
এক নিঃশ্বাসেই শিবানী বলেন, ওকে দেখতে দেখতে টায়ার্ড হয়েছি বলেই তো তোমার সুন্দর মুখোনা দেখতে চাই।
ভারতীও দুর্বাকে বলেন, জানো মা, দিন রাত্তির শিবানীর মুখ দেখতে আমারও আর ভাল লাগে না। তাইতো তোমাকে একটু দেখার জন্য, কাছে পাবার জন্য চাতকের মত হা করে বসে থাকি।
সুনন্দা সঙ্গে সঙ্গে হাসতে হাসতে বলেন, এতই যখন আমার মেয়েকে তোমাদের কাছে পেতে ইচ্ছে করে, তখন তোমরা ওকে রেখে দিচ্ছো না কেন?
ওনার মুখের কথা শেষ হতে না হতেই ভারতী আর শিবানী এক সঙ্গে বলেন, হ্যাঁ, ওকে আমরা রেখেই দেব।
ওদের কথাবার্তায় দুর্বা লজ্জিত বোধ না করে থাকতে পারে না। ও উঠে দাঁড়িয়ে বলে, মা, আমি ভিতরে যাচ্ছি। তোমরা কথা বলল।
সারদা ট্রেতে চার কাপ কফি এনে ওদের তিন জনের হাতে দিতেই শিবানী বলেন, সারদা, মাসীমাকে প্রণাম করো।
সারদা ওনাকে প্রণাম করতেই সুনন্দা একটু হেসে বলেন, তোমার রান্না খেয়ে আমার মেয়ে তো প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
মাসীমা, আপনার মেয়ে এত ভাল যে রান্না খারাপ হলেও ও প্রশংসা না করে থাকতে পারবে না।
না, সারদা, তা বলো না।
শিবানী বলেন, সারদা, শিল্পী বোধহয় আমার ঘরে আছে। ওকে ওখানেই কফি দাও।
সারদা চলে যায়।
কফির কাপে দু’একবার চুমুক দিয়েই সুনন্দা বলে, শিবানীদি, সত্যি করে বলো তো কোন ছেলের খোঁজ পেলে কিনা।
শিবানী কোনমতে হাসি চেপে একটু গম্ভীর হয়ে বলেন, হাতে উপযুক্ত ছেলে না থাকলে কি সেদিন অত জোর দিয়ে বলতে পারতাম, মেয়ের বিয়ের জন্য তোমাকে চিন্তা করতে হবে না?
ভারতী কোন কথা বলেন না। মুখের সামনে হাত রেখে হাসি লুকিয়ে রাখেন।
সুনন্দা সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করেন, ছেলেটি আমার মেয়ের উপযুক্ত হবে তো?
তা তো হবেই।
ছেলেটি কত দূর লেখাপড়া করেছে? কি করে?
শিবানী ওনার একটা হাত ধরে বলেন, অত ব্যস্ত হচ্ছো কেন? পরে সবই বলব, সবই জানবে।
কফির কাপে শেষ চুমুক দিয়েই সুনন্দা বলেন, দেখো শিবানীদি, মেয়েটা এত কাল পড়াশুনা করছিল বলে বিয়ের কথা বিশেষ চিন্তা করিনি কিন্তু ওর এম, এ. পরীক্ষা শেষ হতেই বিয়ের চিন্তায় পাগল হয়ে যাচ্ছি।
উনি না থেমেই একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, তোমরা বিশ্বাস করো, মেয়েকে যতক্ষণ পর্যন্ত ভাল ছেলের হাতে তুলে দিতে না পারছি, ততক্ষণ আমি শান্তিতে…
শিবানী ওনার দুটো হাত ধরে বলেন, প্লীজ, তুমি অত চিন্তা করো না। তোমার মেয়ে ঠিকই ভাল ছেলের হাতে পড়বে।
হঠাৎ ভারতী প্রশ্ন করেন, আচ্ছা সুনন্দা, কী রকম ছেলের সঙ্গে দুর্বার বিয়ে দিতে চাও?
দেখো ভারতীদি, ছেলেটিকে যে ডাক্তার এঞ্জিনিয়ার বা কলেজের লেকচারার হতেই হবে, তেমন কোন কথা নেই। তবে ময়না স্পষ্ট বলে দিয়েছে, সে আই-এ-এস বা আই-পি-এস ছেলেকে বিয়ে করবে না।
ভারতী আর শিবানী হাসতে হাসতে বলেন, তাই নাকি?
সুনন্দাও একটু হেসে বলেন, আমার মেয়ে তো ওর বাবাকে সোজাসুজি বলে দিয়েছে, যারা পেট মেটা ক্যাবলা চণ্ডী কনস্টেবল নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, তাদের আমি বিয়ে করব না।
ভারতী জিজ্ঞেস করেন, ওর বাবা কি বললেন?
ওর বাবা বললেন, ময়না, ওরাই তো দেশ চালায়।
সুনন্দা না থেমেই হাসতে হাসতে বলেন, আমার মেয়েও সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেয়, ওরা দেশ চালাবে চালাক কিন্তু আমাকে চালাবার সুযোগ দেব না।
ভারতী উঠে দাঁড়ায়; বলেন, শিবানী, তোরা কথা বল। আমি দুর্বার কাছে যাচ্ছি। ও বেচারী অনেকক্ষণ একলা আছে।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, তুই যা।
ভারতী চলে যেতেই সুনন্দা আবার শুরু করেন।
জানো শিবানীদি, ময়নার বাবার সঙ্গে হায়দ্রাবাদে একজন বাঙ্গালী আই-এ-এস অফিসারের সঙ্গে আলাপ পরিচয় হয়েছে। ছেলেটি বুঝি দেখতেও বেশ ভাল আর যথেষ্ট উচ্চ শিক্ষিত।
শিবানী মন দিয়ে ওনার কথা শোনেন।
ছেলেটি আগে দিল্লীর হিন্দু কলেজে লেকচারার ছিল। তারপর এখন সে অন্ধ্র ক্যাডারের আই-এ-এস। ছেলেটির মা লেডি শ্রীরাম কলেজের লেকচারার আর বাবা বেশ নাম করা আর্কিটেক্ট।
তার মানে বেশ ভাল পরিবারের ছেলে।
তা হলে কী হয়? মেয়ে তো ওর বাবাকে সোজাসুজি বলে দিলো…
জানো সুনন্দা, আমাদের বেথুনে অনেক আই-এ-এস আর আই-পি-এস এর মেয়ে পড়ে; এই সব মেয়েদের প্রায় সবারই বিয়ে হচ্ছে আই-এ-এস বা আই পি-এস ছেলেদের সঙ্গে কিন্তু অন্য মেয়েরা এসব ছেলেদের বিয়ে করতে বিশেষ আগ্রহী না।
হ্যাঁ, আমিও মেয়ের কাছে সেইরকমই শুনি।
শিবানী একটু হেসে বলেন, আমিও তোমার মেয়ের জন্য কোন আই-এ-এস বা আই-পি-এস ছেলের কথা ভাবিনি।
ভাই, তুমি একটু খুলে বলল না, কোন ছেলের কথা ভেবে তুমি আমাকে আশ্বস্ত করেছ?
যে ছেলেটির কথা ভাবছি, সে সত্যি ভাল ছেলে। যেমন রূপ, তেমনই তার গুণ।
ছেলেটির স্বভাব-চরিত্র ভাল তো?
হ্যাঁ, ভাই, সেদিক থেকে তোমার চিন্তার কিছু নেই।
শিবানী না থেমেই বলেন, ছেলেটিকে আমি একেবারে ছোটবেলা থেকেই দেখছি। তাইতো জোর গলায় বলতে পারি, ওর মত ভাল ছেলে আজকাল বিশেষ দেখা যায় না।
বাঃ! খুব ভাল কথা।
সুনন্দা সঙ্গে সঙ্গেই বলেন, ওদের কি খুব বড় সংসার? অনেক ভাই-বোন?
শিবানী একটু হেসে বলেন, না; ঐ ছেলেটিই মা-বাবার এক মাত্র সন্তান।
ছেলেটির মা-বাবা কেমন মানুষ?
আমার তো খুবই ভাল লাগে। আমার বিশ্বাস, তোমার মেয়ে ওদের চোখে মণি হয়ে থাকবে।
সুনন্দা সঙ্গে সঙ্গে ওনার দুটি হাত ধরে বলেন, প্লীজ, তুমি ছেলেটিকে দেখার ব্যবস্থা করো। এই ছেলে আমি কিছুতেই হাতছাড়া হতে দেবো না।
শিবানী সঙ্গে সঙ্গে গলা চড়িয়ে বলেন, এই ভারতী, শিগগির আয়।
ভারতী ঘর থেকে বেরিয়ে এসেই বলেন, কি হয়েছে যে অমন করে…
আরে, শোন, শোন।
শিবানী হাসতে হাসতেই বলেন, সুনন্দা জানতে চাইলে বলে আমি ছেলেটির বিষয়ে মোটামুটি সব খবরই বললাম।…
কী বললি?
বললাম, ছেলেটির যেমন রূপ, তেমনই গুণ স্বভাব-চরিত্রও ভাল।
আর কী বললি?
আর বললাম, ছেলেটি মা-বাবার একমাত্র সন্তান; শিল্পী ঐ সংসারে বেশ সুখে-শান্তিতেই থাকবে।
কিন্তু আমাকে ডাকলি কেন?
শিবানী কিছু বলার আগেই সুনন্দা বলেন, আমি ওকে বললাম, ছেলেটিকে, দেখাবার ব্যবস্থা করতে।
শিবানী একটু হেসে বলেন, সুনন্দা এই ছেলে হাত ছাড়া করতে চায় না।
ভারতী খুব জোরে একবার নিঃশ্বাস ফেলে একটু হেসে শিবানীকে বলেন, বেশ তো। ছেলেটি যখন হাতে আছে, তখন তুই ওকে দেখাবার ব্যবস্থা করে দিল।
ঠিক সেই সময় ‘ও ছোট মা’ ‘ও ছোট মা’ বলে চিৎকার করতে করতে বাবাই এসে হাজির।
ভারতী কোনমতে হাসি চেপে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়িয়েই বলেন, ও সারদা, রান্না হলো?
বাবাই দু’হাত দিয়ে শিবানীর গলা জড়িয়ে ধরে বলে, ছোট মা, কখন খেতে দেবে? তোমার দাদা আর আমি যে খিদের জ্বালায় মরে যাচ্ছি।
শিবানী দু’হাত দিয়ে ওর মুখোনা ধরে বলেন, হ্যাঁ, বাবাই সোনা, এক্ষুনি খেতে দেব। সত্যি গল্প করতে করতে অনেক…।
কথা শেষ না করেই উনি সুনন্দাকে দেখিয়ে বাবাইকে বলেন, বাবাই সোনা, আমাদের বিশেষ বন্ধু সুনন্দাকে প্রণাম করো।
বাবাই ওনাকে প্রণাম করে, সুনন্দা ওকে আশীর্বাদ করেই শিবানীকে বলেন, তোমার ছেলে তোমাকে ছোট মা বলে কেন?
শিবানী গর্বের হাসি হেসে বলেন, হ্যাঁ, ভাই, আমার ছেলে আমাকে ছোট মা বলে।
আলতো করে বাবাইয়ের গাল টিপে উনি বলেন, কি আর বলব! ছেলে ভুল করে ভারতীর পেটে জন্মেছে।
দুর্বা তখনই শিবানীর ঘর থেকে বেরিয়ে ড্রইংরুমের দিকে পা বাড়িয়ে বলে, ও মাসীমা, আবার কার সঙ্গে গল্প শুরু করলেন?
আয় মা, আয়।
দুর্বা কাছে আসতেই শিবানী ওর একটা হাত ধরে বলেন, শিল্পী, এই হচ্ছে আমার ছেলে বাবাই সোনা।
দুর্বা মুহূর্তের জন্য বাবাইকে দেখেই বলে, মাসীমা, ইনি দিল্লী থেকে কবে এলেন?
শিল্পী, যে ছেলে দিল্লী থাকে, সে হচ্ছে তাতাই সোনা। ‘
সরি! সত্যি গণ্ডগোল হয়ে গেছে।
দুর্বা সঙ্গে সঙ্গেই একটু হেসে বলেন, মাসীমা, তার মানে ইনি হচ্ছেন আই আই-টি’র এম. টেক-ওয়ালা আপনাদের ভেরি ভেরি গুড বয়!
ওর কথা শুনে শিবানীও হাসেন, বাবাই হাসে। কিন্তু সুনন্দা মেয়েকে বুকুনি দেন–এই ময়না, এইভাবে কেউ কথা বলে?
দুর্বা চোখ দুটো বড় বড় করে বলে, ও মা, সত্যি আমি খারাপ কিছু বলিনি। অমি শুনেছি, ইনি দারুণ ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট করে আই-আই-টি থেকে এম. টেক পাশ করেছেন আর অসম্ভব ভাল ছেলে।
শিবানী বলেন, আচ্ছা, আচ্ছা, হয়েছে।
ওর কথা শুনে ওয়ালা আপনাদের মলীমা, তার মানে ইনি
এবার উনি বাবাইকে বলেন, বাবাই সোনা, এই হচ্ছে সুনন্দার মেয়ে দুর্বা। এত ভাল গান গাইতে পারে যে আমি ওর নাম রেখেছি শিল্পী।
বাবাই কয়েক মুহূর্ত অপলক দৃষ্টিতে ওকে দেখেই একটু হেসে দু’হাত জোড় করে বলে, নমস্কার!
নমস্কার!
দুর্বাও হাসি চেপে কয়েক মুহূর্তের জন্য ওকে দেখে।
শিবানী উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, এই ভারতী, সব রেডি তো? আমি কী দাদাকে ডাকতে যাবো?
ভারতী রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে বলেন, হ্যাঁ, শিবানী তোর দাদাকে আসতে বল।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি যাচ্ছি। সুব্রতবাবুকে নিয়ে ড্রইংরুমে পা দিয়েই শিবানী বলেন, সুনন্দা, আমার দাদা।
সুনন্দা প্রণাম করতেই উনি বলেন, থাক, থাক, হয়েছে বৌমার কাছে আপনার আর আপনার মেয়ের কথা প্রায় রোজই শুনি।
দুর্বা একটু দূরে দাঁড়িয়েছিল। শিবামী ওকে টেনে এনে সুব্রতবাবুর সামনে এনে বলে, দাদা, এই আমার শিল্পী।
দুর্বা ওকে প্রণাম করতেই সুব্রতবাবু ওর মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করে একটু হেসে বলেন, মা, বৌমার কাছে শুনেছি তুমি অসাধারণ গান গাও।
মাসীমা স্নেহ করেন বলে অনেক বেশি বাড়িয়ে বলেছেন। আমি একটু-আধটু গান গাই ঠিকই কিন্তু অসাধারণ কখনই না।
দেখো মা, আমার বৌমা তো সে ধরনের মেয়ে না। উনি কখনই অহেতুক কিছু বাড়িয়েও বলবেন না, ছোট করেও কিছু দেখাবেন না। বৌমা অসম্ভব ব্যালান্সড় মেয়ে।
ওনার কথা শুনে সুনন্দাও হাসেন, দুর্বাও হাসে।
সুব্রতবাবু একটু হেসে বলেন, মা, আজ যখন সৌভাগ্যক্রমে তোমার সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হলো, তখন একটা গান না শুনিয়ে যেও না।
দুর্বা একটু মুখ নীচু করে বলে,, নিশ্চয়ই গান শুনিয়ে যাবো।
সবাই মিলে এক সঙ্গে খেতে বসেও কত কথা, কত গল্প আর হাসাহাসি হয়। অন্যরা বুঝতেও পারে না। কিন্তু এইসব গল্পগুজব আর হাসাহাসির মধ্যেই বাবাই মাঝে মাঝেই কয়েক মুহূর্তের জন্য দুর্বার শ্রীমণ্ডিত মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কখনও কখনও দুর্বাও ওকে না দেখে পারে না। আবার এরই মধ্যে কয়েকটা দুর্লভ মুহূর্তের জন্য ওদের দুজনের দৃষ্টি বিনিময় হতেই লজ্জায় ওরা। দৃষ্টি গুটিয়ে নেয়।
খাওয়া-দাওয়ার পর সবার মনেই খুশির জোয়ার। আবার সবাই জমায়েত হন ড্রইংরুমে। সেখানেও আড্ডা জমে যায়।
হঠাৎ সারদা এসে ভারতাঁকে বলে, ও বড়মা, আপনারা তো কেউ কিছু বলছেন না।
ও একটু হেসে বলে, অন্য রবিবার তা চারটে বাজতে না বাজতে চায়ের জন্য আপনারা অস্থির হয়ে ওঠেন। আর আজ পাঁচটা বাজতে চললো কিন্তু তবু…
দেয়ালে টানানো ঘড়িটার দিকে তাকিয়েই শিবানী হাসতে হাসতে বলেন, সত্যিই তো পাঁচটা বাজতে মাত্র মিনিট দশেক বাকি। যাও, যাও, চটপট কফি করো।
দুর্বা একটু হেসে বলে, দোষ হয় আমাদের মত ছেলে মেয়েদের। আমরা নাকি আড্ডা দিতে বসলে কোনদিকে কোন হুঁস থাকে না কিন্তু আজ দেখলাম, আড্ডায় মেতে গেলে আমাদের গুরুজনদেরও কোনদিকে খেয়াল থাকে না।
ভারতী গম্ভীর হয়ে বলেন, ওরে আদরিণী, আমরা আড্ডা দিই হাজার রকম দায় দায়িত্ব কাজকর্ম মিটিয়ে কিন্তু তোমরা?
দুর্বা সঙ্গে সঙ্গে এক হাত দিয়ে ওনার গলা জড়িয়ে গেয়ে ওঠে।
মোদের যেমন খেলা তেমনি যে কাজ
আনিস নে কি ভাই।
তাই কাজকে কভু আমরা না ডরাই।।
খেলা মোদের
বাঁচা মরা,
খেলা ছাড়া কিছুই কোথাও নাই।।
খেলতে খেলতে ফুটেছে ফুল।
খেলতে খেলতে ফল যে ফলে।।
খেলারই ঢেউ জলে স্থলে।
ভয়ের ভীষণ রক্ত রাগে
খেলার আগুণ যখন লাগে।
ভাঙাচোরা জ্বলে যে হয় ছাই।।
মোদের
যেমন খেলা
তেমনি যে কাজ
জানিস নে কি ভাই।
গান শেষ হতেই সবাই হৈ হৈ করে ওঠেন, শুধু বাবাই নীরব। ওর চোখে মুখে খুশি ফুটে উঠলেও মুখে কিছু বলতে পারে না। সুব্রতবাবু দুর্বার দুটি হাত ধরে বলেন, মা জননী, তোমার মতো মেয়েকে তো ছেড়ে থাকা মুস্কিল।
শিবানী এক মুহূর্তের জন্য ভারতীর দিকে তাকিয়েই বলেন, দাদা, ছেড়ে থাকা মুসকিল মানে? আপনি কি অবিবাহিতা দুর্বাকে আটকে রাখবেন?
হ্যাঁ, বৌমা, ওকে আটকে রাখবো তোমাদের বাবাইসোনার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে।
ওনার মুখের কথা শেষ হতে না হতেই বাবাই আর দুর্বা ছিটকে বেরিয়ে যায় ওখান থেকে।
সুনন্দা সুব্রতবাবুর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বলেন, দাদা, আপনি যে আজ আমাকে কি নিশ্চিন্ত করলেন, তা বলতে পারবো না। শুধু কায়মনোবাক্যে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি, ময়না যেন আপনাদের সবাইকে সুখী করতে পারে।
বৌমা, আপনার মেয়েকে…
দাদা, দয়া করে আপনি বলবেন না। আমি তো শিবানীদিরই বয়সী।
আচ্ছা, আচ্ছা, তুমিই বলব।
উনি একবার নিঃশ্বাস নিয়েই বলেন, বৌমা, মেয়েকে দেখে আর কথাবার্তা বলে যদি সত্যি আনন্দ আর শান্তি না পেতাম, তাহলে কি আমি ওকে মা জননী বলতাম?
এবার উনি সুনন্দার মাথায় হাত দিয়ে বলেন, বৌমা, আমার মা জননী আমাদের কাছে সুখে শান্তিতেই থাকবে। কোন চিন্তা নেই।
ভারতী আর শিবানী আনন্দে খুশিতে দু’জনে দু’জনকে জড়িয়ে ধরেন আর শুধু হাসেন।
হঠাৎ শিবানী ওনাকে ছেড়ে দিয়েই সুনন্দার হাত ধরে টান দিয়ে হাসতে হাসতে বলেন, ওহে মহারানী, দেখলে, কেমন ঘটকালি করলাম?
উত্তরের অপেক্ষা না করেই উনি আবার বলেন, আমার প্রাপ্যটার কথা ভুলে যেও না।
সুব্রতবাবু বলেন, বৌমা, আমার মা জননীকেই তো তোমরা পাচ্ছো। আর কি প্রাপ্য চাও?
শিবানী চাপা হাসি হেসে বলেন, দাদা, আপনি আমাকে পথে বসিয়ে দিলেন। ভেবেছিলাম, শিল্পীর মা-বাবার ঘাড় ভেঙে অন্তত দশ ভরির একটা ভাল হার…
সবাই হাসেন।
সুব্রতবাবু গলা চড়িয়ে বলেন, মা জননী, কোথায় গেলে?
খুব ধীর স্থির পদক্ষেপ দুর্বা শিবানীর শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ওনার সামনে এসে দাঁড়ায়। মুখ নীচু করে বলে, আপনি কিছু বলবেন?
মা জননী, ছেলের কথায় রাগ করোনি তো?
দু’এক মিনিট দূর্বা কোনকথা বলতে পারে না। মুখ নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর হঠাৎ ওনার দিকে তাকিয়েই চোখের জল ফেলতে ফেলতে বলে, কোন মা কি ছেলের কথায় রাগ করতে পারে?
ওর চোখের জল দেখে সবার চোখই ভিজে ওঠে কিন্তু কারুর মুখ দিয়ে একটি শব্দও বেরোয় না। সবাই যেন কয়েক মুহূর্তের জন্য বোবা হয়ে যান।
দুর্বা আবার ওনার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, আমি আপনাকে কি বলে ডাকব?
সুব্রতবাবু দু’হাত দিয়ে ওর মুখোনা ধরে বলেন, মা জননী, তুমি শুধু তোমার বাবাকেই বাবা বলবে আমাকে তুমি ছেলে বলে ডাকবে।
ছেলে!
ব্যস! সঙ্গে সঙ্গে দুর্বা ওনার বুকের উপর মুখোনা রেখেই আনন্দে খুশিতে গর্বে চোখের জল ফেলে।
দুর্বার ছেলেও মা জননীর চোখের জল দেখে নিজেকে সংযত রাখতে পারেন।
সারদা পাশেই দাঁড়িয়েছিল কিন্তু তবুও শিবানী চিৎকার করে ওঠেন, শিল্পী আর ওর ছেলে ছাড়াও আমাদের সবাইকে কফি দাও।
সারদা একটু পরেই সবাইকে কফি দিয়েই বলে, বাবাই সোনা কোথায় গেল?
শিবানী বলেন, ও যেখানেই থাক, ওকে ধরে আনো এখানে।
হ্যাঁ, সারদা তাতাইয়ের ঘর থেকে ওকে টেনে আনে।
শিবানী বলেন, আয় বাবা, আমার কাছে আয়।
সবার মনেই কত কথা, কত গুঞ্জন কিন্তু কারুর মুখ দিয়েই কোন কথা বেরোয় না।
কফির কাপে শেষ চুমুক দিয়েই দুর্বা সুব্রতবাবুর এক হাত দু’হাতের মধ্যে নিয়েই বলে, ছেলে, তুমি গান শুনতে চেয়েছিলে, তাই শুরু করছি–
কেন তোমরা আমায় ডাকো
পাই নে সময় গানে গানে।
পথ আমারে শুধায় লোকে
পথ কি আমার পড়ে চোখে,
চলি যে কোন দিকের পানে
গানে গানে।
দাও না ছুটি, ধর ত্রুটি,
নিই নে কানে।
মন ভেসে যায় গানে গানে।
আজ যে কুসুম-ফোঁটার
বেলা,
আকাশে আজ রঙের মেলা,
সকল দিকেই আমায় টানে
গানে গানে।
কেন তোমরা
আমায় ডাকো,
আমার মন না মানে।
গান শেষ হতেই ভারতী দুর্বাকে কাছে টেনে নিয়ে এক গালে চুমু খেয়ে বলেন, সত্যি, তোমার গান শুনে মন যে কোথায় চলে যায়…
শিবানী বলেন, শিল্পী, তোমার কাছে এইসব গান শুনে আর মনে হয় না, আমরা এই ক্ষুদ্র পৃথিবীর বাসিন্দা।
হঠাৎ সারদা বেশ গলা চড়িয়ে বলে, ও বড়মা, দারুণ মেঘ করেছে। মনে হচ্ছে এখুনি ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামবে।
ভারতী যেন বকুনি দিয়ে বলেন, বর্ষাকালে বৃষ্টি হবে, তা অত বলার কি আছে? সুনন্দারা তো গাড়ি নিয়েই এসেছে। অত চিন্তার কি আছে?
শিবানী হাসতে হাসতে বলেন, আর যদি তেমন বৃষ্টি হয় যে গাড়িও চালানো যাবে না, তাহলে ওরা আজ এখানেই থাকবে। ওরা তো জলে পড়েনি।
সুব্রতবাবু বলেন, ঠিক বলেছ বৌমা।
ওনার মুখের কথা শেষ হতে না হতেই শুরু হলো তুমুল বৃষ্টি আর ঝোড়ো হাওয়া।
এক মুহূর্ত দেরি না করে দুর্বা গলা ছেড়ে গেয়ে ওঠে
পাগলা হাওয়ার বাদল-দিনে
পাগল আমার মন জেগে ওঠে।
চেনাশোনার কোন
বাইরে
যেখানে পথ নাই নাই রে
যেখানে অকারণে যায় ছুটে।
পাগলা হাওয়ার বাদল-দিনে
পাগল আমার মন জেগে ওঠে।…
দুর্বা গান থামিয়েই হেসে ওঠে।
মা জননী, থামলে কেন? গানটা শেষ করো।
ছেলে পুরো গানটা শোনাতে হবে?
নিশ্চয়ই।
দুর্বা হাসতে হাসতেই আবার শুরু করে।
ঘরের মুখে আর কি রে
কোনো দিন সে যাবে ফিরে।
যাবে না, যাবে না–
দেয়াল যত সব গেল টুটে।
বৃষ্টি-নেশা-ভরা সন্ধ্যবেলা
কোন্ বলরামের আমি চেলা,
আমার স্বপ্ন ঘিরে
নাচে মাতাল জুটে।
যত মাতাল জুটে।
যা না চাইবার
তাই আজি চাই গো,
যা নাপাইবার
তাই কোথা পাই গো।
পাব না,
পাব না,
মরি অসম্ভবের পায়ে
মাথা কুটে।
পাগলা হাওয়ার বাদল-দিনে
পাগল আমার মন জেগে ওঠে।
গান শেষ হতেই দুর্বা দুহাত দিয়ে সুব্রতবাবুর মুখোনা ধরে গালে চুমু খেয়ে বলে, ছেলে, আজ আসি। মা-র কাছে আসতে ভুলে যেও না।
তারপর ওনাকে প্রণাম করেই দুর্বা প্রণাম করে ভারতী-শিবানীকে।
সঙ্গে সঙ্গে ভারতী বলেন, দেখছিস শিবানী, তোর শিল্পী কি এক চোখা? ওনাকে আদর করলো আর আমরা কি গঙ্গার জলে ভেসে এসেছি?
তোমাদের দুটো করে ছেলে আর আমার একটা ছেলে। আমি তো ওকে বেশি আদর করবই।
দুর্বা হাসতে হাসতেই বলে, সারদা মাসী, গুড নাইট। এর পর যেদিন আসব,
সেদিনও আজকের মতো ইলিশ মাছ খাওয়াবে।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, খাওয়াবো।
সুনন্দাও সবার কাছ থেকে বিদায় নেন। ওরা দুজনেই যাবার জন্য পা বাড়াতেই হঠাৎ দুর্বা পিছন ফিরে কোনমতে হাসি চেপে সবাইয়ের দিকে চেয়ে বলে, এই যে দুই মায়ের আদরের বাবাই সোনা, গুড নাইট! সী ইউ এগেন।
দুর্বা প্রায় লাফ দিয়ে গাড়িতে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি স্টার্ট দেয়। আস্তে আস্তে চলতে শুরু করে। দু’এক মিনিটের মধ্যেই দৃষ্টির বাইরে চলে গেল।
সুব্রতবাবু বললেন, সী কেম, সী স’, সী কংকার্ড!
হ্যাঁ, দাদা, ও ঠিক কাল বৈশাখীর ঝড়ের মতো আমাদের সবাইকে উড়িয়ে নিয়ে গেল।