সকালে দাড়ি কামাতে গিয়ে মারুফ লক্ষ্য করল তাকে বেশ স্বাস্থ্যবান লাগছে।
ভরাট চেহারার একজন মানুষ। কয়েক রাত ভাল ঘুম হয়নি বলে চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। এই কালিটা না থাকলে তাকে আজ মোটামুটিভাবে একজন প্রেজেন্টেবল মানুষ বলা যেত।
গালে সাবান মাখতে গিয়ে হঠাৎ স্বাস্থ্য ভাল হওয়ার কারণ স্পষ্ট হল। ব্রণ উঠছে। কিছু কিছু ব্রণ আছে সুপ্ত অগ্নিগিরির মত। চামড়ার ভেতর মাথা ড়ুবিয়ে থাকে। মুখ বের করে না, তবে এদের কর্মকাণ্ড ভেতরে ভেতরে চলতে থাকে। তার গলি যে ফুলে ফেপে একাকার হয়েছে এই তার রহস্য।
মারুফ ভূরু কুঁচকে আয়নার দিকে তাকিয়ে রইল। মুখভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি। তার কিছু কিছু আবার পেকে গেছে। থুতনীর কাছের সবগুলি দাড়ি পাকা। তার বয়স বত্রিশ। বত্রিশ বছর বয়সে কারো চুল-দাড়ি এরকম করে পাকে না। তার বেলাতেইবা এরকম হল কেন? প্রকৃতি নানান ভাবে তাকে প্রতারিত করছে। নয়ত তার মত একটি ছেলেকে চার বছর প্রাইভেট টিউশানি করে চলা লাগে?
ডিসপোজেবল শেভিং রেজারটা পুরানো। সব জিনিস কিনতে মনে থাকে, রেজার কিনতে মনে থাকে না। রেজারের কথা মনে পড়ে সকাল বেলা। রহমতকে পাঠিয়ে এই মুহূর্তেই দোকান থেকে রেজার আনানো যায়। তাতে লাভ হবে না। গালে ব্রেড ছোঁয়ানো যাবে না। সুপ্ত অগ্নিগিরি জেগে উঠবে।
তিথির কাছে তাকে যেতে হবে এই অবস্থাতেই। মেরুন রঙের হাফ হাওয়াই শার্ট, সাদা পেন্ট এবং সাদা কেড-এর জুতা পরা যাবে না। খোঁচা খোঁচা দাড়ির সঙ্গে এই পোশাক মানায় না। তাকে পাঞ্জাবি পরতে হবে। আধ ময়লা পাঞ্জাবি।
টেবিলে রহমত চায়ের কাপ রেখে দিয়েছে।
পিরিচ দিয়ে ঢেকে রাখার কথা রহমতের মনে নেই। কোনদিন মনে থাকবে। এর আগে এক লক্ষ বার বলা হয়েছে। চায়ে চুমুক দিতে গেলে অবধারিতভাবে কয়েকটা ভাসমান পিঁপড়া পাওয়া যাবে। সম্ভবত রহমতের ধারণা, চা বানাতে চিনি দুধ যেমন লাগে, পিঁপড়াও লাগে।
রহমত!
উঁ।
চা আরেক কাপ বানিয়ে আন। আর পাঞ্জাবি ইস্ত্রী করিয়ে আন।
রহমত রান্নাঘর থেকে বের হয়ে এল। টেবিলে রাখা চায়ের কাপ নিয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে লম্বা চুমুক দিয়ে চা শেষ করল। এই কাজটা সে রান্নাঘরেও করতে পারত। তা করবে না। একে বিদেয় করে দেবার সময় হয়ে গেছে। তবে সে বিদায় করতে পারবে না। রহমত তার কর্মচারি না। এটা মিজানের ভাড়া বাসা। মিজান তিন মাসের ট্রেনিংএ রাজশাহী আছে বলে সে থাকতে পারছে। মিজান চলে এলে তাকে বিদায়। নিতে হবে কারণ মিজান বিয়ে করেছে। বৌ নিয়ে থাকবে। বৌ চলে এলে বন্ধুর কথা মনে থাকে না।
রহমত, দুপুরে আজ রান্না করবে না। দুপুরে ভাত খাব না
রহমত উত্তর দিল না। রহমতের এই একটাই গুণ। কথাটা কম বলে। রোবট টাইপের। তবে বেকুব ধরনের রোবট। ওরা হুকুম তামিল করতে যায় কিন্তু হুকুমটা কি ঠিকমত শুনে না। ব্যাটাকে পাঞ্জাবি ইশ্রী করতে বলা হয়েছে। সে হয়ত পাঞ্জাবি বাদ দিয়ে পায়জামা ইশ্রী করিয়ে আনবে। এই সম্ভাবনা শতকরা ৬০ ভাগ।
মারুফ সিগারেট ধরিয়ে চায়ের জন্যে অপেক্ষা করছে। সে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছে। আজ সারাদিনে তাকে প্রচুর মিথ্যা কথা বলতে হবে। সহজ মিথ্যা না, জটিল ধরনের মিথ্যা। মিথ্যাগুলি বলা হবে তিথিকে। প্রিয়জনকে মিথ্যা বলা বেশ শক্ত। মনের উপর চাপ পড়ে। অসতর্ক হলে মিথ্যার লজিক এলোমেলো হয়ে যায়। সত্য বলার সময় লজিকের দিকে খেয়াল রাখতে হয় না। মিথ্যা বলার সময় খেয়াল রাখতে হয়। মিথ্যার লজিক হচ্ছে সবচে কঠিন লজিক। বোকা লোক এই জন্যেই মিথ্যা বলতে পারে না।
রহমত চা নিয়ে এসেছে। চায়ের কাপ নামিয়েই সে কাপড় ইস্ত্রী করতে গেল। মারুফ আড়চোখে দেখল পাঞ্জাবিটাই নিয়ে যাচ্ছে। সে খানিকটা নিশ্চিত হয়েই চায়ে চুমুক দিল। আগুন-গরম চা। মনে হচ্ছে মুখের ভেতরটা পুড়ে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। সিগারেট বিস্বাদ লাগছে। আজ দিনটা খুব খারাপ ভাবে শুরু হয়েছে। মাথা ঠাণ্ডা রাখা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। অথচ মাথাটা খুব ঠাণ্ডা রাখা দরকার। তিথিকে সে আজ তার প্যারিসে যাবার কথা বলবে, যা পুরোপুরি মিথ্যা, অথচ এমনভাবে তা বলতে হবে যেন তিথি তা অবিশ্বাস না করে। সামান্যতম অবিশ্বাস করা মানেই অরিজিন্যাল ব্লু-প্রিন্টে গণ্ডগোল হয়ে যাওয়া। এটা কিছুতেই হতে দেয়া যাবে না।
এই মিথ্যা বলায় তার কোন পাপ হবে বলে সে মনে করে না। সে মিথ্যা বলবে সারভাইভেলের জন্যে। অনেক পোকা বেঁচে থাকার জন্যে যে গাছে বাস করে সেই গাছের রঙে নিজের রঙ বদলিয়ে নেয়। এতে পোকাটার কোন পাপ হয় না। তার হবে কেন? তিথি যদি তার প্যারিস যাবার ব্যাপারটা বিশ্বাস করে তাহলেই পরের ধাপটা সহজ হয়ে যায়। সে বলতে পারে—শোন তিথি, প্লেনে উঠার আগে আমি বিয়ের কাজটা সেরে ফেলতে চাই। কারণ আমি চাচ্ছি প্যারিসে পৌঁছার তেরো দিনের মাথায় তুমি আমার সঙ্গে জয়েন কর।
এই মিথ্যায় কারো কোন ক্ষতি হবে না। বরং সবারই লাভ হবে। যে বিয়ে অনেকদিন ধরে ঝুলছে সেই বিয়েটা হয়ে যাবে। তিথি অসুখী হবে না কারণ সে মানুষ হিসেবে প্রথম শ্রেণীর না হলেও উপরের দিকে–দ্বিতীয় শ্রেণী। চারপাশে তৃতীয় শ্রেণীর মানুষের ভীড়ে উপরের দিকে। দ্বিতীয় শ্রেণী–খারাপ কি? কৌশল ছাড়া বিয়ে সম্ভবও হবে না। যার পেশা প্রাইভেট টিউশ্যানী তাকে কে মেয়ে দেবে?
তিথি ঠিক তার জায়গায় বসে আছে। পিজা কিং-এর এক কোণায়। হাতে পানির গ্লাস। মন দিয়ে খবরের কাগজ পড়ছে। মারুফের ধারণা, মেয়েরা ঘরে কখনো খবরের কাগজ পড়ে না। তারা কাগজ পড়ে ঘরের বাইরে অদ্ভুত অদ্ভুত সব জায়গায়। এবং পড়ার সময় জগৎ-সংসার ভুলে যায়। তিথি একবারও তাকাচ্ছে না। পেছন থেকে চুক করে মাথায় টোকা দিলে হয়। তিথি অবশ্যি মাথায় টোকা দিলে রেগে যায়। এই সকাল বেলাতেই রাগিয়ে দিলে মুশকিল হবে। মেয়েরা চট করে রাগ ধুয়ে ফেলতে পারে না। তারা অনেকক্ষণ রাগ পুষে। পাখি পোষার মত রাগ পুষেও তারা আনন্দ পায়।
মারুফ সামনের চেয়ারটায় বসল। তিথি খবরের কাগজ থেকে চোখ না তুলেই বলল, দাড়ি রাখছ নাকি?
মেয়েদের বোধহয় দৃশ্যমান চোখ ছাড়াও কয়েক জোড়া অদৃশ্য চোখ আছে। না তাকিয়েই কি করে দেখল? মারুফ বলল, ।
দাড়িতে তোমাকে ভাল দেখাচ্ছে। নূর সাহেবের মত লাগছে।
নূর সাহেবটা কে?
আসাদুজ্জামান নূর–অভিনয় করে।
ও আচ্ছা।
তিথি খবরের কাগজ ভাঁজ করতে করতে বলল, তোমার জরুরী কথাটা কি চট করে বলে ফেল। আমাকে উঠতে হবে।
মারুফের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। সে শুকনো গলায় বলল, উঠতে হলে ঊঠ। জরুরী কথা আরেকদিন বলা যাবে।
রেগে গেলে না-কি?
না, রাগিনি।
মুখ গম্ভীর করে রেখেছ কেন?
আমার মুখটাই গম্ভীর টাইপের। খুব হাসিখুশি অবস্থাতেও আমাকে দেখলে মনে হবে কয়েকরাত ঘুম হচ্ছে না। ডিসপেপসিয়ায় ভুগছি এবং আমার পিঠে কার্বাঙ্কল হয়েছে।
পিঠে কি হয়েছে?
কার্বাঙ্কল।
সেটা কি?
মারুফ কফি দিতে বলল। পিজা কিং—ওর ছেলেটাকে পাঠালো এক প্যাকেট সিগারেট আনতে। তিথি হাসিমুখে বলল, তোমার জরুরী কথাটা কি আমাকে বলে ফেল তো।
থাক।
থাকবে কেন? বল।
মারুফ হাই তুলতে তুলতে বলল, আমি একটু বাইরে যাচ্ছি।
এইটাই তোমার জরুরী কথা?
হুঁ।
বাইরে কোথায়? চাঁদপুর না কুমিল্লা?
কফির কাপ দিয়ে গেছে। সিগারেট আনেনি। আগে সিগারেট না ধরিয়ে চা বা কফির কাপে চুমুক দিতে কুৎসিত লাগে। হঠাৎ মুখ মিষ্টি হয়ে যায়। মারুফ বিমর্ষ ভঙ্গিতে কফিতে চুমুক দিতে দিতে বলল, ব্রিসভেন যাচ্ছি।
সেটা কোথায়?
ফ্রান্সের একটা ছোট শহর।
বল কি! কবে?
আঠারো তারিখ। শেষ রাতের ফ্লাইট। তিনটা কি সাড়ে তিনটায়।
কোন মাসের আঠারো তারিখ? এই মাসের?
হ্যাঁ।
কি সর্বনাশ! আর তে মোটে দশ দিন আছে।
দশদিন না, ন দিন। আজকের দিনটা বাদ দাও।
তিথির নিজেকে সামলাতে সময় লাগছে। সে খানিকটা ঝুঁকে এসে বলল, তুমি তো সারাজীবন চেয়েছ আমেরিকা যেতে, এখন আমেরিকা বাদ দিয়ে ফ্রান্স?
কি করব–আমেরিকা যাবার সুযোগ পেলাম না—। হাতে যা পেয়েছি তাই সই। কানা মামা যখন পাওয়া যাচ্ছে না তখন অন্ধমামা।
কতদিনের জন্যে যাচ্ছ?
পিএইচ.ডি. করতে যতদিন লাগে–ধরে নাও চার বছর।
মারুফের সিগারেট চলে এসেছে। সে সিগারেট ধরিয়েছে। এতগুলি মিথ্যা কথা এক নাগাড়ে বলায় কেমন ক্লান্ত লাগছে। দ্রুত কয়েকটা সিগারেট টেনে শক্তি সঞ্চয় করতে হবে।
তিথি খুশি খুশি এবং আনন্দিত চোখে তাকিয়ে আছে। এরকম চোখের মেয়ের কাছে মিথ্যা বলাও কষ্টের ব্যাপার। মিথ্যাটা কাঁটার মত বুকে বিঁধে থাকে। তিথি বলল, এ তো খুব আনন্দের ব্যাপার। তুমি এমন মুখ কালো করে আছ কেন?
অনেক ঝামেলা বাকি আছে। ভিসা হয়নি। পাসপোর্ট রিনিউ করতে হবে। এর মধ্যে দেশে গিয়ে মাকে দেখে আসতে হবে।
দেশে যাবে কবে?
আজ রাতের ট্রেনে চলে যাব। একদিন থেকে পরশু আসব। কপড়-চোপড়ও বানাতে হবে। ভাল কাপড় তো কিছুই নেই।
আমি দেখে-শুনে তোমার জন্যে কাপড় কিনে দেব। চল আজই চল।
তোমার না-কি কাজ আছে বলছিলে? এমন কোন কাজ নেই।
কাঁচা বাজার করব ভেবেছিলাম। পরে যাব। চল, গুলশান মার্কেট যাই। ওখানে সুন্দর সুন্দর শার্ট পাওয়া যায়।
আজ থাক। টাকা আনিনি।
চল পছন্দ করে আসি, পরে কিনবে।
চল।
মারুফ কফির বিল দিল। দশটাকার একটা ময়লা নোট দোকানের ম্যানেজারের কাছ থেকে বদলে নিয়ে যে সিগারেট এনে দিয়েছে তাকে বখশীশ দিল।
তিথি বলল, তুমি একটু হাল তো তোমাকে দেখে খুব খারাপ লাগছে। মনে হচ্ছে তোমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ছে।
আকাশ ভেঙে পড়ার মতই। তিথি, রিকশা নেবার আগে চল খানিকক্ষণ হাঁটি। তোমার সঙ্গে কিছু কথা আছে। কথাগুলিই জরুরী। এতক্ষণ যা বললাম তা জরুরী না।
ঢাকার রাস্তাগুলি এখন আর হেঁটে বেড়ানোর জন্যে নয়–গাদাগাদি ভিড়। পাশাপাশি গল্প করতে করতে দুজন যাবে, তা হবে না। যেতে হবে একজনের পেছনে একজন এবং সারাক্ষণই টেনশান থাকবে এই বুঝি সামনের লোকটা হারিয়ে গেল।
যন্ত্রণার উপর যন্ত্রণা। তিথির পেছনে তখন থেকে এক ফুলওয়ালী হাঁটছে। আফা, মালা নেন না, আফা, মালা নেন না। ফুলের মালার মত একটি উঁচু শ্রেণীর পণ্যদ্রব্য বিক্রি করলেও এদের আবার আচরণ নিম্ন শ্রেণীর। এরা জোকের মত লেগে থাকে। না কিনে উপায় নেই।
তিথি মারুফকে বলল, এই, ফুলওয়ালীর হাত থেকে আমাকে বাঁচাও তো। অসহ্য লাগছে। শাড়ি ধরে টানছে, গায়ে হাত দিচ্ছে।
মারুফ পেছন ফিরে ফুলওয়ালীর দিকে তাকিয়ে হাসল। কিছু বলল না। ফুলওয়ালী এতে আরো উৎসাহ পেল। যদিও তার বাড়তি উৎসাহের প্রয়োজন ছিল না।
তিথি বলল, মারুফ তুমি কি দয়া করে একটা রিকশা নেবে? এই ভিড়ে আমি হাঁটতে পারছি না।
আর একটু। এই রোডের শেষ মাথা পর্যন্ত গিয়েই রিকশা নেব।
এখন নিতে অসুবিধা কি?
কোন অসুবিধা নেই। এরকম ভিড়ের রাস্তায় তো আর হাঁটব না। শেষ হ্যাঁঁটা হেঁটে নিচ্ছি। এই দেশের ভিড়েরও যে এমন সৌন্দর্য আছে তা আগে লক্ষ্য করিনি।
কি সৌন্দর্য? আমি তো কোন সৌন্দর্য দেখছি না। আমি শুধু দেখছি লোকজন এসে আমার ঘাড়ে পড়ে যাচ্ছে।
মারুফ বলল, শুধু যে লোকজন আমাদের ঘাড়ে পড়ে যাচ্ছে তা না। আমরাও লোকজনদের ঘাড়ে পড়ে যাচ্ছি এবং নির্বিকার ভঙ্গিতেই পড়ছি। এসো এখন রিকশা নেয়া যাক।
ফুলওয়ালী মেয়েটা নেই। এতক্ষণ পেছনে পেছনে এসে হঠাৎ কোথায় উধাও হয়ে গেল। তিথি ভেবে রেখেছিল ফুলওয়ালীকে পাঁচটা টাকা দেবে। মেয়েটা এতক্ষণ যখন লেগেছিল তখন আরেকটু কেন থাকল না?
মারুফ বলল, তুমি এইখানে দাঁড়াও আমি ওপাশ থেকে রিকশা ঠিক করে নিয়ে WIFI
আমিও যাই তোমার সঙ্গে?
না না। তুমি গেলে হবে না। মেয়েছেলে সঙ্গে দেখলেই বেশি ভাড়া চাইবে।
অল্প কয়েকটা টাকা বাঁচাবার জন্যে এত কষ্ট করার দরকার কি?
অল্প কয়েকটা টাকাই-বা শুধু শুধু দেব কেন?
মারুফ রাস্তা পার হল, সে সাবধানী চোখে রিকশা খুঁজছে। যে কোন একটা রিকশা নিলেই হয় না। রিকশাওয়ালা দেখে বিচার-বিবেচনা করে ভাড়া ঠিক করতে হয়। রিকশাওয়ালা এখানে মানুষ না, ইনজিন। যে ইনজিন গাড়ির বনেটের ভেতর ঢাকা থাকে না, চোখের সামনে দেখা যায়। এমন একটা ইজিন খুঁজে বের করতে হবে–যে ক্লান্ত না হয়ে দীর্ঘ সময় প্যাডেল ঘুরাবে। যার কৌতূহল প্রায় থাকবেই না। যে পেছনে ফিরে তাকাবে না। পেছনে কি কথাবার্তা হচ্ছে তা শোনার চেষ্টা করবে না।
তিথি দাঁড়িয়ে আছে তো দাঁড়িয়েই আছে। মারুফের রিকশা আর ঠিক হচ্ছে না। সামান্য একটা রিকশা ঠিক করতে কারোর এতক্ষণ লাগে?
রোদ কড়া হয়ে উঠেছে। আলো চোখে লাগছে। তিথি তার হ্যান্ডব্যাগ খুলল। আছে–সানগ্লাসটা আছে। সাধারণত দেখা যায়, যেদিন সানগ্লাসটার সবচে বেশি দুরকার সেদিনই সেটা আনা হয় না। মারুফ মনে হয় শেষ পর্যন্ত রিকশা ঠিক করতে পেরেছে। তিথি সানগ্লাস পরে অপেক্ষা করছে।
রিকশার হুড ফেলা। মারুফের হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। অন্যসময় সিগারেটের ধোঁয়ার পাশে বসতে খারাপ লাগে। আজ লাগছে না। এমন কি সিগারেটের কটু গন্ধটাও ভাল লাগছে।
মারুফ বলল, তিথি শোন। খুব মন দিয়ে শোন। আমার জরুরী কথাগুলি আমি এখন বলব।
রিকশায় বসে বলার দরকার কি? কোথাও গিয়ে বসি, তারপর বল। না, রিকশাতেই শোন। জরুরী কথা চলন্ত অবস্থাতে শোনাই ভাল। বল।
দাঁড়াও, সিগারেটটা শেষ করে নিই। তারপর বলি।
তিথি লক্ষ্য করল, মারুফকে কেমন যেন চিন্তিত লাগছে। জরুরী কথা সে কি বলবে তা তিথি আঁচ করতে পারছে। এই কথার জন্যে তাকে চিন্তিত হতে হবে কেন?
তিথি শোন—
শুনছি।
আমার হাতে সময় খুব অল্প। রিকশাতেও বেশি সময় তোমার সঙ্গে থাকতে পারব না। আবার দেশেও বেশি দিন নেই। বুঝতে পারছ?
পারছি।
যে স্কলারশীপ নিয়ে যাচ্ছি সেটাও গরীবি ধরনের স্কলারশীপ। টাকা জমিয়ে যে একবার দেশে আসব সে উপায়ও নেই। কাজেই দেশ ছেড়ে বাইরে থাকব প্রায় চার বছরের জন্যে। এই সময়টা আমার জন্যে অল্প সময় না। আনেকখানি সময়।
তা তো বটেই।
আমি চাই যে, যাবার আগে বিয়ে করে তারপর যাব। যাতে আমার স্ত্রী আমি যাবার তিন-চার মাসের ভেতর আমার সঙ্গে জয়েন করতে পারে।
আইডিয়া ভাল। সবচে ভাল হয় সে যদি একসঙ্গে তোমার সঙ্গে যেতে পারত।
সেটা অবশ্যই ভাল হত কিন্তু প্রথম কথা হচ্ছে এই মুহূর্তে আমার কাছে একটা বাড়তি টিকেট কেনার টাকা নেই। কারণ আমার নিজের টিকেটই নিজেকে কিনতে হচ্ছে।
ওরা টিকেট কেনার টাকা দিচ্ছে না?
না। পৌঁছার পর ওরা টিকেটের টাকাটা রিইমার্স করবে, তার আগে না।
ও আচ্ছা।
মারুফ আরেকটা সিগারেট ধারতে ধরাতে বলল, তিথি, এখন আমি আমার বক্তব্যের শেষ অংশে চলে এসেছি–মন দিয়ে শোন।
শুনছি।
আমাকে বিয়ে করলে করতে হবে চার থেকে পাঁচদিন সময়ের মধ্যে। লোকজনকে খবর দিয়ে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে ফরম্যাল বিয়ে করব সেটা সম্ভব না। বুঝতে পারছ?
পারছি।
বিয়ের কথা বলার জন্যে একশ বার তোমার বাবা-মার সঙ্গে দেখা করা, তাদের বুঝানো–তাও সম্ভব না। পুরো ব্যাপারটা তোমাকেই ম্যানেজ করতে হবে। তুমি তোমার বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন সবাইকে বলে ঠিকঠাক করে রাখবে। একজন কাজীকে খবর দিয়ে রাখবে। আমি যাব আর বিয়ে করে চলে আসব। এটা কি সম্ভব হবে?
তিথি বলল, হবে। তুমি এত টেন্স হয়ে থেকো না তো। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে–কি ভয়াবহ সর্বনাশ হয়ে গেছে। সব ব্যবস্থা আমি করে রাখব। তোমাকে কিছু ভাবতে হবে না।
মারুফ বলল, আর ধর, তোমার বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন এরা যদি রাজি না হল তাহলে আমরা কোর্টে বিয়ে করব। কি বল?
কেউ অরাজি হবে না। আমি যা বলব তাই হবে।
তাহলে তো ভালই।
তিথি বলল, ও কি? তুমি আবার সিগারেট ধরালে যে!
টেনশান হেনশান… তুমি বুঝবে না।
কোন টেনশন না তুমি হাসি মুখে বসে তো।
মারুফ হাসি মুখে থাকার চেষ্টা করছে পারছে না। তার আজ আজিজ সাহেবের অফিসে ঠিক এগারোটার সময় যাবার কথা। আজিজ সাহেবের দুই ছেলেকে সে পড়ায়। পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে ছোটখাট কাজ করে দিতে হয়। এতে বাড়তি কিছু আয় হয়। অন্য সবার মত আজিজ সাহেবও তাকে পছন্দ করেন এবং বিশ্বাস করেন। মারুফ তাকে বলেছে তার খোজে একটা ভাল নীলা পাথর আছে। দাম অনেক কিন্তু সে সস্তায় বেচে দেবে কারণ চোরাই মাল। দশ হাজার টাকা হলেই ছেড়ে দেবে। আসল বাজারে এর দাম ত্রিশ থেকে চল্লিশ হাজার। আজিজ সাহেব সেই পাথর দেখতে চেয়েছেন। মারুফ আজ এগারোটার সময় তাকে পাথর দেখাবে।
মজার ব্যাপার হল মারুফ পাথরের ব্যাপারে কিছুই জানে না। একজন নীলা। বিক্রি করতে চায় এইটা তার তৈরি গল্প। আজিজ সাহেবের পাথরের প্রতি আগ্রহ দেখে গল্পটা বলেছিল। আগ্রহ যে এত বাড়াবাড়ি ধরনের তা বুঝতে পারে নি। বুঝতে পারলে ফট করে এই গল্প করত না। অবশ্যিই পাথরের গল্পের একটা ভাল দিক এখন দেখা যাচ্ছে। আজিজ সাহেব যদি এখন দশ হাজার টাকা দিতে রাজি থাকেন তাহলে বিয়ের খরচটা উঠে যায়।
এই মুহূর্তে মারুফ আজিজ সাহেবের ব্যাপারটা নিয়েই ভাবছে। কি ধরনের কথাবার্তা হতে পারে তার একটা রিহার্সেল সে মনে মনে করছে।
আরে মারুফ সাহেব, আপনার এগারোটার সময় আসার কথা এখন প্রায় বারোটা বাজে। জিনিস এনেছেন?
না।
না কেন?
ব্যাটা এখন হাতছাড়া করতে চাচ্ছে না। টাল বাহানা করছে বলছে বেচবে না। মনে হয় অন্য কোন পাটি পেয়েছে।
আপনি জিজ্ঞেস করেন নি–দিতে চাচ্ছে না কেন?
জিজ্ঞেস করেছিলাম। কিছু বলে না।
মারুফ সাহেব, আপনি এক কাজ করুন পনেরো হাজার টাকা নিয়ে যান। জিনিস নিয়ে আসুন। একটা ভাল নীলার আমার অনেক দিনের শখ।
বাদ দিন। সামান্য একটা পাথর পনেরো হাজার টাকা। টাকা কি এত সস্তা।
পাথর সামান্য না। নীলা ডেনজারাস পাথর। দশ হাজারে কেন দিতে রাজি হচ্ছিল সেটাই বুঝছি না। আপনি একটা কাজ করুন। কুড়ি হাজার টাকা নিয়ে যান দেখুন–কত তে আনতে পারেন।
তিথি বলল, আচ্ছা তখন থেকে তুমি এমন চুপ করে আছ কেন? কি ভাবছ?
কিছু না। কটা বাজে দেখতো।
দশটা।
আর এক ঘণ্টা তোমার সঙ্গে থাকব। এগারোটার সময় আমার এক জায়গায় যেতে হবে।
মারুফকে এখন খুব হাসি খুশি দেখাচ্ছে। সে শীষ দেবার চেষ্টা করছে। তিথি বলল, শীষ দিও না তো–একজন তরুণীকে পাশে বসিয়ে শীষ দিতে দিতে যাওয়া খুব খারাপ।
মারুফ শীষ দেয়া বন্ধ করল না।