শুধু সেদিনই নয়। ছবি এমনি, কেমন মায়াময়ী; চোখজোড়া স্বপ্নাচ্ছন্ন, গতি ধীর মন্থর। অতি কাছে থাকলেও অনেক দূরে। দেখলে মনে হয় চেতনাজগতে তার বাসস্থান বটে কিন্তু এক অদৃশ্য অচেনা লোকেরই সে বাসিন্দা। যখন একলা থাকে কি এক ভাবনায় নিমগ্ন, কাছে গেলেও টের পায় না। এক ডাকে শোনে না। হঠাৎ স্বরটা কানে গেলে হকচকিয়ে যেন জেগে ওঠে। কথা বলে কদাচিৎ কিন্তু বলতে শুরু করলে নিজের কথাগুলো শেষ করে চুপ হয়ে যায় একদম। মুখ নিচু করে রাখে, নয় স্থিরদৃষ্টিতে থাকে চেয়ে। সরল বোকা-বোকা চাউনি।
কাছে যাওয়ার সুযোগ আছে অথচ কাছে গেলেও নাগাল পাওয়া যায় না, এর আকর্ষণ বড় তীব্র বড় মধুর। সেই সোনার শেকলে কখন বাঁধা পড়ে গেলাম বলতে। পারব না। প্রতিদিন অন্তত একবার ওখানে না গেলে ভালো লাগে না এইমাত্র বুঝি। ছবি কখন নিঃশব্দ পদে আমার স্কেচে আমার ড্রয়িংয়ে অলস মুহূর্তের হিজিবিজি আঁকাবুকির মধ্যে প্রবেশ করেছে, সেও বহুদিন অজ্ঞাত ছিল।
একদিন দেখি পরিচয় হওয়ার পর থেকে যত নারীমূর্তি এঁকেছি, প্রত্যেকটিতেই ওর আদল, কোনোটায় মুখের গড়ন, কোনোটায় দেহের ভঙ্গি, কোনোটায় চোখের দৃষ্টি। আমি সজ্ঞানে কোনোদিন ওকে আঁকতে চেয়েছি বলে মনে পড়ে না। অথচ এমন, এর অর্থ কী। অলৌকিক কিছু নয়, হবে নিশ্চয়ই রহস্যময়।
এ রহস্য যন্ত্রণারও জন্ম দেয় তা একদিন বুঝলাম। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল চৌকাঠের পাশের ফাঁকে হাত ঢুকিয়ে চাপানিটা খুলে ভেতরে যাই। কুয়োর কাছের ডালিম গাছের কয়েকটি কাক তাছাড়া বাড়িটা নিরলা নিঝুম। অনেক সময়ই এরকম থাকে কাজেই তা অস্বাভাবিক কিছু নয় কিন্তু আজকে বারান্দার সিঁড়ি মাড়িয়ে উঠতে আমার হৃৎপিণ্ডটা ঢিঢ়ি করতে থাকে। আশ্চর্য এ কি অভিজ্ঞতা! আমার মস্তিষ্কের শিরা বেয়ে শিরশির করে রক্ত উঠছে কেন? চোখদুটো ক্রমে ঝাঁপসা হয়ে আসছে! তাড়াতাড়ি স্টুডিওতে গেলাম, হাতের কাগজপত্রগুলো রেখে দাঁড়িয়ে পড়ি, এ কি আমি কাঁপছি! কম্পিত বুকে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে দেখি মেঝের ওপর ছবি ঘুমোচ্ছে! শিথিল বসন গভীর ঘুমে সে মগ্ন! সুডৌল পরিপূর্ণ দেহ! সুন্দর ঠোঁটজোড়া!
এতক্ষণ যা টিটি করছিল এবার এক নিমেষে তা দাউদাউ করে জ্বলে উঠল।
আমি কি করি এখন আমি কি করি? সারা দেহে উথলে ওঠা থরথর যন্ত্রণার ভার যে আর সইতে পারছিনে।
এক অদ্ভুত ঝড়ের ওপর আমার কোনো হাত নেই, সে জেগেছে হয়তো নিজের নিয়মেই কাজেই ভীরুতার প্রশ্ন অবান্তর। আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলাম। ছবির শিয়রের কাছে বসে এবার আমি স্তব্ধ হয়ে থাকি। কিন্তু সেও কয়েক মুহূর্তের জন্য। ওর মাথার চুলের দিকে ডান হাতটা এগিয়ে নিতে চাইলে হৃৎপিণ্ডের তলা থেকে উঠে আবার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে সেই কাঁপুনি।
নারীর দেহ বিধাতার অপূর্ব সৃষ্টি কথাটা শুনেছি; কবিতায় চিত্রে সঙ্গীতে ভাস্কর্যে তার স্তবগাথা মনে মায়াজালের বিস্তার করেছে। কিন্তু সেই নারীদেহ যে নীরবে জ্বলতে থাকা গনগনে ধাতুর মতো অগ্নিপিণ্ড, বাইরে অনেকের সংস্পর্শে এলেও তা কোনদিন উপলব্ধি করিনি। মোহভরা দৃষ্টিতে তাকিয়েছি শুধু। ছবিও তো অনেকবার কাছে এসেছে? কিন্তু অন্যের উপস্থিতিতে যা ছিল প্রচ্ছন্ন আজকের নির্জনতার সুযোগে তাই ফণা তুলে দাঁড়িয়েছে। একে কি করে দমিয়ে রাখব? অথচ ও টের পেলে নিমেষে আমার মুখোশটা খুলে পড়বে এবং যদি বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হই সেই বিপর্যয়কে কি মেনে নিতে পারব?
পারি বা না পারি সেই হবে ভালো। ঝরনার উৎসমূলে যাওয়ার এই মাহেন্দ্রক্ষণকে ভীরুতার জন্য হারালে অনুশোচনার অবধি থাকবে না।
শিয়র থেকে উঠে যাওয়ার পর ডানপাশে বসে ওর বুকের ওপর থেকে একটা হাত তুলে নিই। গোলগাল সাধারণ একটা হাত কিন্তু কি অদ্ভুত এর জাদু! আমার শিরায় শিরায় দ্বিগুণ বেগে বহ্নি ছড়িয়ে দিল। কিন্তু এটা হয়তো নয়। আমার চোখের সামনে উন্নত জগতের সেই পবিত্র যুগল তীর্থ যার অমৃতধারা মানবজাতিকে বাঁচিয়ে রেখেছে। একে নিপীড়িত লুণ্ঠন করাই প্রত্যেক পুরুষের ধর্ম, আমি কি একনজর দেখতেও পারব না? এতকাল ধরে শূন্য ছিলাম এই আশ্চর্য!
কাপড়ে টান লাগতেই ছবির চোখের পাতা খুলে গেল এবং আমাকে দেখতে পেয়ে ধড়মড় করে উঠে বসল।
ছি! ছি! জাহেদ ভাই তোমাকে আমি অন্যরকম, কিন্তু ওর কথা শেষ হতে দিলাম না, বুকের কাছে টেনে গভীরভাবে জড়িয়ে ধরলাম।
ছবি কিছুক্ষণ নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করে কিন্তু, অসমর্থ হয়ে দুই চোখের পানি ছেড়ে দিল।
তোমার কোনো ক্ষতি করব না, লক্ষ্মী, আমি তোমাকে ভালোবাসি।
ভালোবাসা! অনিরুদ্ধ জ্বালাময় কণ্ঠে ছবি বলল, এরই নাম ভালোবাসা! এ তো চুরি, ডাকাতি! ছাড় দাদা এক্ষুণি ফিরতে পারে।
ও আবার নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চাইলে আমি বললাম, আর একটু থাক! তুমি জানো ছবি আমার জীবন সার্থক হলো! এরপর যদি মরেও যাই কোনো ক্ষোভ থাকবে না। আমি এখন পূর্ণ, আমি সুখী। সুখ পেলাম কয়েক মুহূর্তের জন্য। কিন্তু এইটুকু সুখ নিয়েই চিরকাল বাঁচতে পারি!
ভেতরটা সত্যি প্লাবিত হয়ে গেছে শরবনে নিশুতি রাত্রির নিঃশব্দ জোয়ারের মতো। আলতোভাবে ওকে ছেড়ে দিলাম।
ছবি তৎক্ষণাৎ উঠে গেল না। সে কাঁদছে। দুই গাল বেয়ে দরু গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুধারা। ওর চুলে হাত দিয়ে আদর করতে করতে বললাম, এত কাঁদছ কেন তুমি? আমি অপরাধী; কিন্তু তুমি বিশ্বাস করো এর ওপর আমার কোনো হাত ছিল না!
ও তেমনি নিমগ্ন তেমনি নতমুখ।
ছি! আর কেঁদো না লক্ষ্মী! তুমি যা বলবে এখন আমি তাই মেনে নেবো!
ছবি ঝট করে ফিরে চাইল! বলল, তুমি আর এসো না এখানে, কখনো এসো না!
কথাটা শেষ করা মাত্র উঠে দাঁড়িয়ে সে চলে যাচ্ছিল, আমি ডাকলাম, ছবি! ছবি!
না! না! না!
উঠে গিয়ে দেখি ছোট রান্নাঘরটার মেঝেতে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে সে কাঁদছে।
পেছনে-পেছনে ওর কাছে গিয়ে আমি বললাম, ছি ছি ছবি! এমন করো না!
তুমি আর এখানে এসো না জাহেদ ভাই, সত্যি বলছি আর এখানে এসো না!
আমার ব্যবহার ওর কান্নার উৎসকে এমনভাবে নাড়া দেবে তা ভাবতে পারি নি। কেমন অপ্রস্তুত হয়ে যাই। ওর মনে কি এমন দুঃখ যে ক্রোধের বদলে রোদনই হলো। আত্মরক্ষার অস্ত্র? আমি তো এমন কিছু চাইনি যা দেওয়া ওর পক্ষে অসম্ভব? অবশ্য বিয়ের ব্যাপারে একেকজন মেয়ের এক-একটি আদর্শবোধ থাকে এবং পাত্র হিসেবে আমি নিকৃষ্ট তা স্বীকার করি। কিন্তু সে যে আমার সঙ্গে কোনরকম সম্পর্ক গড়ে তুলতে নারাজ, তাতে অন্যভাবেও প্রকাশ করতে পারত?
সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা বৃথা। যে কোনো কারণেই হোক, অশ্রুর বাঁধ যখন একবার ভেঙেছে, তখন সমস্ত বেদনার ভার কমিয়ে না দিয়ে শান্ত হবে না।
স্টুডিওতে ফিরে এলাম। কয়েকটি ছবির কল্পনা বিজলি চমকানোর মতো একসঙ্গে মাথায় খেলে গেল। শায়িতা রমণী, ক্রন্দসী যৌবন, বিষের পেয়ালা হাতে একটি তরুণী। অপেক্ষার সময় নেই। ইজেলে ক্যানভাস চাপিয়ে দিয়ে রঙের প্যালেট ও তুলি টেনে নিলাম। শায়িতা রমণী ছবিটাই প্রথম আঁকব। ডান হাঁটুটা ত্রিভুজের মতো উঁচিয়ে রাখা কপালের উপর উপুড়-করা বাঁ হাতখানা, চিত হয়ে শুয়ে আছে। পটভূমিতে আবছা-মতো একটি শিউলি গাছের ডালপালা, ফুলের সম্ভার।
কতক্ষণ কাজ করেছি খেয়াল ছিল না, জামিলের কণ্ঠস্বরে ফিরে চাই! উনি ঘরে ঢুকতে বললেন, এই যে তুমি এখানে! ছবি আঁকছ নাকি?
হ্যাঁ, চেষ্টা করছি। তার মুখের রেখাগুলো পাঠ করতে করতে বললাম, কোথায় গিয়েছিলেন?
কত জায়গায় যেতে হয় সে কথা বলে লাভ কি? ইজেলটার কাছে হাঁটু গেড়ে বসে কম্পপাজিশনটা দেখতে দেখতে জামিল বললেন, কিন্তু ভাই আজ মনটা বড় খারাপ হয়ে গেছে।
কেন কি ব্যাপার জানি না, আমার মুখটা হয়তো নিমেষে ফ্যাকাশে হয়ে গেল তাহলে ছবি কি সব বলে দিয়েছে। কিন্তু ওর কথার ধরনে তো তা মনে হয় না?
জানো তো ছবির খাতিরেই আমি বেঁচে আছি, এতো দুঃখ কষ্টের মধ্যেও নেতিয়ে পড়ি না। কিন্তু ওকে মনমরা দেখলে ঝুপ করে একেবারে নৈরাশ্যের খাদে পড়ে যাই।
কেন কি হয়েছে! আমার কণ্ঠস্বরে বিস্ময়ের ভাব। তুলিটা তুলে চেয়ে থাকি তার দিকে।
কি হয়েছে বলা মুশকিল। স্ক্রিয়াশ্চরিত্রম দেব ন জানন্তি। কোনদিন কিছু বলবে না। কিন্তু মাঝে মাঝে কাঁদবে। আজকেও তার সেই রোগ উঠেছে। আর এজন্যই তো
জামিল হঠাৎ একটা হোঁচট খেয়ে যেন চুপ হয়ে গেলো। আমি বললাম, কি বলুন না?
না। দরকার নেই। ছবির স্কেচটার ওপর দিয়ে চোখদুটো ঘুরিয়ে নিয়ে বললেন, বেশ হয়েছে তো। সুন্দর হবে! কি আঁকছ?
বললাম, শায়িতা রমণী।
নামটাও সুন্দর! হঠাৎ জামিল বলে উঠলেন, ও হ্যাঁ, আজকে কিন্তু না খেয়ে যেতে পারবে না। ইলিশ মাছ এনেছি। সর্ষে ইলিশ চমৎকার রান্না করে ছবি। খেলে ভুলতে পারবে না। অবিশ্যি আজকে মন খারাপ ওর!
আমি বললাম, কি দরকার খাওয়ার। প্রত্যেকদিন এমন জুলুম করতে ভালো লাগছে না!
জুলুম আবার কি হে? আমি যেমন তুমি তেমন। একবাড়ির লোক বৈ তো নয়। অবিশ্যি মেসে তোমাদের খাওয়ায় ভালো।
না, তা নয়। আমি সেদিক থেকে কথাটা বলছি না। এখনকার পান্তাও আমার ভালো লাগে। বিশেষত ছবির রান্না সত্যি চমৎকার!
হ্যাঁ এইবার পথে এসো। খেয়ে যাবে কিন্তু আমি একটু রান্নাঘর থেকে আসছি!
জামিল বেরিয়ে গেলো। তার সঙ্গে কথা বললেও সারাক্ষণ একই আলোড়ন আমার মনে জেগে ছিল, আমি সত্যি ছোটলোক এবং লম্পট, নইলে নিজের দুর্বলতার জন্য তার এমন জায়গায় আঘাত করতে পারতাম না।
কিন্তু আমি কতটুকু দোষী সেটাও তো অস্পষ্ট প্রেমে শুরু প্রেমে স্থিতি ও প্রেমেই বিলয়, আমার যখন এই ধারণা তখন কেউ এর কানা কড়ির মূল্য স্বীকার করতে না চাইলে তার দায়িত্ব আমি কি করে নেব? সামান্য স্পর্শ সে তো কিছু নয়। প্রেমের আগুনে নিঃশেষ, নিজেকে আত্মতি দেয়াই তো চিরন্তন রীতি? সব দিতে হবে, সব। বলতে হবে তা’কে, আমার যে সব দিতে হবে সে তো আমি জানি। আমার যত বিত্ত প্রভুর আমার যত বাণী!
হায় রাধার মতো মেয়েরা ভালোবাসতে জানে না আর! একজনই জন্মেছিল আর জন্মাবে না কোনদিন! ক্লিওপাট্রা লুপ্তস্মৃতি, লায়লী শিরি উপাখ্যানমাত্র। নারী আসলে রক্ষিতা, প্রকৃতির রক্ষিতা; তার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধা সন্তান-উৎপাদন করবে বলে, এর বাইরে ভুলেও এক পা বাড়াতে চায় না।
ছবি আঁকায় মগ্ন কিন্তু মনের হদিস মিলছিল না বলে নীল আকাশে হেমন্তের লঘুমেঘের মতো ধীরে ক্ষোভ জমে উঠল। তুলি রেখে দিই, ইজেলটা গুটিয়ে ফেলি। রান্নাঘরের দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। অগোছালো বেশ ছবি কাঠের চামচেটা ফুটন্ত ভাতের হাঁড়ির ভেতরে দিয়ে আস্তে আস্তে নাড়ছিল। আমার উপস্থিতি ওর গোচরে এলো না। একটু উচ্চেঃস্বরেই জিজ্ঞেস করলাম, দাদা কোথায় গেলেন ছবি?
আচমকা ফিরে চাইল সে। বলল, বাইরে।
কান্নার রেখায় স্নান ওর স্নিগ্ধ মুখখানা, কিন্তু তবু সুন্দর। আমি বললাম, আমি আসি এখন ছবি, দাদাকে বলো।
খেয়ে যেতে বলেছে, ফিরে এসে না দেখলে রাগ করবেন।
তুমি বলো একটা জরুরি কাজ ছিল তাই চলে গেলাম। কথাটা বলতে ইচ্ছে হয়েছিল; কিন্তু আর মুহূর্তমাত্র দেরি না করে বাইরে বেরিয়ে এলাম। ছবি বুঝুক আমারও খানিকটা তেজ আছে।
জেদ জিনিসটা ভালো নয় শুনতাম! এবং সেজন্যই তাকে ভালো করে ধরলাম। এদেশে ভালো হওয়ার সব পথই বন্ধ কিন্তু খারাপ হওয়ার জন্য রাস্তার অভাব নেই। এতদিন সে রাস্তা মাড়াইনি। মনে হয়েছে অর্থহীন, অনাবশ্যক। কিন্তু অন্ধকার মেসের ছোট্ট চৌকিটার ওপর শুয়ে আজকে ভাবি, শিল্পী হতে চাইলে শুধু স্বর্গ নয় নরককেও দেখা দরকার।
স্যাঁৎসেঁতে একটা বড় রুমের চারধারে চারটি চৌকি আমরা চারজন থাকি। একজন ডাক্তার একজন সাংবাদিক এবং মুজতবা আর আমি চিত্রী। চারজনই শিক্ষানবীশ; কিন্তু সেই শিক্ষা যে কোন লাইনে গড়াচ্ছে সেটাই বিবেচ্য। ডাক্তার করিম এক নার্সের পেছনে লেগে আছে, সাংবাদিক আবার কবিতাও লেখে বিশেষ করে বাচ্চাদের ছড়া। সেই সূত্রে একটি নাচিয়ে বালিকার সাথে পরিচয় আর তারই তাপে সে দগ্ধ নিয়ত এবং মুজতবা তো একাই এক শো। কোথায় ঘোরে কোথায় খায় সেই জানে। রাত একটা-দুটোর আগে কদাচিৎ ফিরে আসে।
একটা জিনিস শুধু জানি ওরসে হলো ন্যড আঁকতে সে পারদর্শী। ওর মতে দেহ বিশেষ করে নারীদেহই হচ্ছে সবকিছুর গোড়া, সৃষ্টির নাড়িনক্ষত্র জানতে চাইলেও এখন থেকেই শুরু করতে হবে। ভাস্কর আর চিত্রী তো এক মুহূর্তের জন্যও তা বাদ দিতে পারেন না।
ওর বড় বেতের বাক্সটা এমনি সব উলঙ্গ ছবিতে ভর্তি। তারা বন্ধ করে রাখে। বন্ধু-বান্ধব চাইলেও দেখায় না। কারণ এগুলি হজম করা যার তার পক্ষে সম্ভব নয়।
শিল্পী মাত্রই অহঙ্কারী এবং আত্মপ্রচারে উৎসাহী। দ্বিতীয়টা সম্বন্ধে মুজতবা আপাত উদাসীন হলেও তার মধ্যে প্রথমটার উচ্চতা এত বেশি যে প্রথম পরিচয়ের ক্ষণে রীতিমতো ধাক্কা খেয়ে ফিরতে হয়; নিজের চারপাশে সর্বদাই সে একটি দুর্ভেদ্য রহস্যের পরিমণ্ডল সৃষ্টি করে রাখে এবং এখানেই যেন তার আত্মতৃপ্তি। কোথায় কাজ করতে যায় বহুবার জিজ্ঞেস করেছি কিন্তু জবাবে মিলেছে কুঞ্চন। এসব জানা সত্ত্বেও একবার অনুরোধ করেছিলাম, আমাকে নিয়ে যাও না ভাই তোমার সঙ্গে একদিন কাজ করে দেখি!
সিগারেটের টুকরোটা ওর নিজস্ব কায়দায় আঙুল ছটকে জানালার বাইরে ছুঁড়ে বলেছিল, আদার বেপারির জাহাজের খবর কেন। এমনিতেই তো ভালো আছি।
বন্ধুদের কোনো মর্যাদা তুমি দিলে না সেজন্য আমি সত্যই দুঃখিত!
একটা কথা বলি জাহেদ রাগ করিসনে। শিল্পীদের মধ্যে কখনো বন্ধুত্ব হয় না, এ আমি বিশ্বাস করি। একজন শিল্পী যখন অন্য একজনের কাজকে প্রশংসা করে তখন বুঝতে হবে সে মনের কথাটি বলছে না। এ নিছক প্রতারণা।
হতে পারে। আমি বললাম, তবু সবক্ষেত্রে একই সূত্র দিয়ে সবকিছুকে বাতিল করা বোধ হয় ঠিক নয়।
এখানে ব্যতিক্রম আমার চোখে পড়েনি। আমরা পরস্পর কুৎসা রটনাতেই এত ব্যস্ত যে এমন কি ছবি আঁকবার সময় পাচ্ছিনে। ছাত্র আছ এখনও ঠিক বুঝতে পারছ না। বেরিয়ে এসে দেখবে সব পরিষ্কার। সে জন্য যার যার কাজ করে যাওয়াই সঠিক পন্থা। আমি শিল্পী হিসেবে পরিচিত হতে চাই এবং নামও কিনতে চাই; কিন্তু তার জন্য জয়নুলের কাজকে খাটো করে দেখবার প্রয়োজন আছে বলে মনে করিনা। আমাদের চিত্রশিল্পের ভিত্তি গড়েছেন তিনি, তার কাকের পাখা থেকেই পরবর্তী উত্তরাধিকারের জন্ম এবং আগামীকাল সে বিচারে ভুল করবে না, তাকে পিতা বলেই স্বীকৃতি দেবে। কিন্তু আজ? আজ তার সমালোচনা করতে পারাটাই যেন কৃতিত্ব! একটু থেকে মুজতবা বলল, কিন্তু সেই অন্ধদের জানা উচিত শুধু দুর্ভিক্ষের স্কেচের জন্যই জয়নুল চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন!
আমাদের সঙ্গে কাটা কাটা কথা বলাই ওর অভ্যেস কিন্তু সেদিন কেন জানি বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল তাই বিস্তারিত সংলাপ।
আমি নরম হয়ে বললাম, তোমার কাজ সত্যি আমার ভালো লাগে এবং বন্ধু হিসেবেই এখন বলছি। আমাকে একদিন তোমার সঙ্গে নিয়ে গেলে কৃতজ্ঞ থাকব!
বেশ চলো এদিন! ও বলেছিল, কিন্তু ওখানে গিয়ে কাঁচুমাচু করলে চলবে না, বলে রাখছি।
ঠিক আছে। কাঁচুমাচু করব কেন। আমি একেবারেই নিরীহ প্রকৃতির, এ তোমার ভুল ধারণা!
দেখা যাবে! বলতে-মুজতবার ঠোঁটের তলে একটুখানি বাঁকা হাসি ফুটে উঠেছিল। ওর গর্ব অপরিমেয়।
এবং তা অকারণে নয় আজ ওর সঙ্গে এসে অনুভব করলাম। বেলা মাত্র আড়াইটে উজ্জ্বল দিন কিন্তু যেখানে আমাকে নিয়ে এলো, সেখানে অমন দিনে দুপুরে আসাটা যথেষ্ট সাহসের পরিচয়। ওর আত্মম্ভরিতার মতোই বলে উঠলাম, এখানে তুমি আস!
কেন খুব খারাপ জায়গা নাকি? রসিকতা করে মুজতবা বলল, পতিতালয় প্রতিভার আঁতুড়ঘর এটাই জানিসনে কি ছবি আঁকবি!
দুপুরেও লোকজনের আনাগোনা কম নয়। এক জায়গায় বাইরেই দুজন বালার সঙ্গে ঘেঁষাঘেঁষি করছে কয়জন। আমরা বড় গলিটা পেরিয়ে এলাম। দুই দেওয়ালের ফাঁক দিয়ে যাওয়া ছোট্টপথে আরেকটা মোড়ে আসতেই দেখি দরজায় দাঁড়িয়ে একটি মেয়ে হাসছে। দাঁতে মিশি, ঠোঁটে পানের রং মুখে পাউডার আধভেজা চুলগুলো কোমর অবধি ছেড়ে দেওয়া। দেখতে বেশ পারঙ্গমা। কিন্তু হাসিটাই মারাত্মক। শান দেওয়া ছুরি নয়। ধারালো তুর্কি চাকুর মতো, বসিয়ে দেওয়া মানে খতম। নারীর এ রূপ আমার অকল্পনীয় ছিল। মনে মনে প্রমাদ গুণি। ঘরে ঢোকার পর দাঁড়িয়ে থেকেই মুজতবা বলল, আমার বন্ধু জাহেদ, ভালো আর্টিস্ট। আর ইনি রাধারানি!
পথের আলো থেকে ঘরের আড়ালে এসে বাঁচালাম আমি, কিন্তু তবু চোখ তুলে তাকাতে পারছিলাম না। রাধা বিশ্রী ভঙ্গিতে আমার মাথার চুলগুলো হাতে নাড়া দিয়ে বলল, নাগর! এই বুঝি প্রথম আসা হলো! খুব লজ্জা হচ্ছে, না?
মুজতবা চৌকির ধারে বসে পড়ে হাসছিল। সে বলল, আস্তে সখি। ওভার ডোজে বিপদ হতে পারে।
রাধা তৎক্ষণাৎ গিয়ে কোলে উঠল ওর, দুই হাতে গলাটা জড়িয়ে ধরবার পর গালে একটা চুমু খেয়ে বলল, কালকে আসনি কেন? আমার খুব রাগ হয়েছিল!
মুজতবা দুই হাতের তালুতে ওর গাল দুটো চেপে ধরে বলল, মাঝে মাঝে ফাঁক দেওয়াই তো ভালো। টানটা বজায় থাকে!
না সে আমার ভালো লাগে না; রাধা আহ্লাদীর মতো বলল, আমি সব সময় চাই! তুমি যদি নিয়ে যাও আমি এখান থেকে পালিয়ে যাব।
সর্বনাশ। আমার জানটা থাকবে তখন?
কেন থাকবে না? কারও সাধ্যি নেই তোমার গায়ে হাত তোলে।
না। সে হয় না, রাধা! এমনিতেই ভালো আছি! তোমার বাবু হতে পারাটাই তো যথেষ্ট।
ওর গলায় ঝুলতে ঝুলতে রাধা কথাগুলো শোনে, এরপর অভিমান ভরে একটা ঠমক মেরে ছেড়ে দিল। আমি বসে ছিলাম। ক্ষিপ্রগতিতে এসে তেমনিভাবে আমাকে জড়িয়ে বলল, আমার নতুন নাগর! এসো তোমার লজ্জা ভাঙিয়ে দিই।
মুজতবা এতটা নীচে নেমে গেছে এই জিনিসটা ভাববারও ফরসুৎ ছিল না। প্রতি মুহূর্তে একটার পর একটা চরম আঘাত। আমার এতদিনকার ধ্যান-ধারণার স্তম্ভগুলো একে একে ভেঙে পড়তে থাকে। তবে কি সমাজ সংস্কৃতি রুচি নৈতিকতা সবই মিথ্যে? পরলোক পাগলের প্রলাপ, ধর্ম বলতে কিছু নেই, পাপ পুণ্য বাজে উপাখ্যান?
তুমি একটু বাড়াবাড়ি করছ রাধারানি। একটা সিগারেট ধরিয়ে মুজতবা বলল, প্রথম দিনেই–
আমার গলা জড়িয়ে রাধা ওকে ধমকে মেরে উঠল, চুপ। কথাটি বলো না কাপুরুষ। নতুন নাগর আমার অনেক ভালো।
মুজতবা কীর্তনের সুরে গেয়ে উঠল, রাধা আমার রাগ করেছে। সুহাসিনি বিনোদিনী (এবে) বদনজুড়ে মেঘ ভরেছে। রাগ করেছে, রাগ করেছে, রাধা আমার রাগ করেছে।
কিন্তু বিনোদিনী তার নতুন অতিথিকে যেভাবে জড়িয়ে সোহাগ করতে থাকে তাতে রাগের চেয়ে অনুরাগের পরিচয়টাই ছিল বেশি এবং তার উত্তাপে নাগরটি উষ্ণ হয়ে উঠল বটে কিন্তু খুব যে আরাম বোধ করেছে এমন নয় বরং পরিস্থিতির আকস্মিকতায় কতকটা অপ্রস্তুত হয়ে মুষড়ে পড়েছে। তার শ্বাসরোধ হওয়ার জোগাড়। শরীরে শক্তি কম নেই, ইচ্ছে করলে ঝটকা মেরে ফেলে দিতে পারত। কিন্তু শত হলেও নারী কোমল পদার্থ, গায়ের জোরে তার বাঁধন কেটে সব সময় মুক্ত হওয়া সম্ভব নয়।
অনেকক্ষণে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যখন উঠে দাঁড়ালাম তখন আমার কপালে বিরক্তির রেখা। মাথার চুলগুলোতে আঙুল চালিয়ে ঠিক করতে করতে বললাম, যা দেখালে একদম খাসা! এটা তোমারই উপযুক্ত জায়গা, মুজতবা। আমি চলোম।
মুজতবা দাঁত বার করে হাসছিল, বলল, এজন্যই তোকে আমি আনতে চাইনি। এতক্ষণে বুঝলি?
হ্যাঁ বুঝলাম বৈকি! ভালো মতোই বুঝলাম!
হঠাৎ রাধা আমার গলাটা দুহাতে জড়াবার পর সামনা-সামনি দেহটা চেপে মুখের কাছে মুখ তুলে বলল, আমাকে ভালো লাগছে না নাগর? কি চাও তুমি বলো? নাচ গান অন্য কিছু?
না না কিছু লাগবে না। তোমার কাছে কিছুই আমার চাওয়ার নেই।
মুজতবা তেমনিভাবে হাসতে হাসতে বলল, রাধা তুমি বড্ড বেরসিক। তোমার কাছে প্রথম অভিসার মিষ্টি খাওয়ালে না, নতুন নাগর কি করে থাকবে বলো! এই নাও মিষ্টি ও কিছু মালপানি আনাও। আজকে সহজে যাচ্ছিনে!
দশ টাকার একটা নোট সে বাড়িয়ে দিলে। আমি কটমট করে তাকাই এবং পরক্ষণে বেরিয়ে আসতে চাইলে মুজতবা খপ করে ধরে ফেলে আমার হাতটা, বলল, যাচ্ছ কোথায় বন্ধু। মডেলের ওপর কাজ না করেই চলে যাবে? সে হবে না, বসো!
তুমি এতবড় ছোটলোক তা জানলে নিশ্চয়ই আসতাম না! আমার কথাটা শুনে মুজতবা প্রচণ্ড হা হা শব্দে হেসে উঠল। এরপর পিঠ চাপড়ে বলল, ছেলেমানুষ! ছেলেমানুষ!