শিলিগুড়ির হোটেল সিনক্লেয়ার থেকে দুপুরের রোদে ঝকঝকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যাচ্ছিল। দূর প্রসারিত নীলবর্ণ পাহাড়ের আড়াল থেকে সাদা কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে হঠাৎ তাকালে মনে হবে যেন শূন্যে ভেসে আছে। যেন-বা রুপোলি মেঘ। বহুবার দেখেছে দীপনাথ। আবারও দেখছে।
রওনা হতে আর বেশি দেরি নেই। হোটেলের লাগোয়া ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসের অফিসের লাউঞ্জে একটু আগেই সে দেখে এসেছে এ কে বোসের নামের লেবেল মারা একটা বেডিং আর দুটো ঢাউস বিদেশি ফাইবার গ্লাসের সুটকেস নামানো হয়েছে। সে বুঝতে পারছে না মালপত্রগুলো নিয়ে তাকেই এয়ারলাইনসের গাড়িতে যেতে হবে কি না। এয়ারলাইনসের লাউঞ্জে মালপত্র রাখার অর্থটা তাই দাঁড়ায়। বোস আর তার স্ত্রীর জন্য রাঙ্গাপানি টি এস্টেটের অ্যামবাসাড়ার গাড়ি এসে গেছে। দীপনাথ বুঝতে পারছে না বাগডোগরায় সে নিজে যাবে কীসে। অ্যামবাসাডারে, না এয়ারলাইনসের। গাড়িতে? বস্তুত আজকাল এসব সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার তার নেই। সিদ্ধান্ত নেয় বোস। বোসের ইচ্ছাই তার সিদ্ধান্ত। তবে এ ব্যাপারগুলো নিয়ে আর ভাবে না দীপনাথ। মেনে নিতে নিতে মন ভোতা হয়ে গেছে।
পরশু গ্যাংটকে কার্পেট কেনা নিয়ে বোস ও তার স্ত্রীর মধ্যে একচোট ঝগড়া হয়ে গেছে। ভদ্রমহিলার খরচের হাত সাংঘাতিক। সেই ঝগড়ার জের এখনও চলছে কি না কে জানে! যদি চলে তবে বোস স্বভাবতই চাইবে দীপনাথ তাদের সঙ্গে অ্যামবাসাডারেই এয়ারপোর্টে যাক। সেক্ষেত্রে বোস বসবে সামনের সিটে ড্রাইভারের পাশে, দীপনাথকে বসতে হবে শ্রীমতী বোসের পাশে একটু জড়সড় হয়ে পিছনের সিটে এবং পুরো রাস্তাটাই কোনও কথাবার্তা হবে না। বড় জোর শ্রীমতী বোস বলবে, যা-ই বলুন গ্যাংটক ভীষণ নোংরা, তার চেয়ে কালিম্পং অনেক ভাল। কিংবা, আপনি কিন্তু এবারও শিলিগুড়ির হংকং মার্কেট দেখালেন না।
হোটেলেব লাউঞ্জে বসে না থেকে দীপনাথ দুপুরের রোদে বাইরে দাঁড়িয়ে ক্ষণেক কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখে নিচ্ছে। ছেলেবেলায় বহুবার দেখেছে সে। তার বড়ভাই শ্রীনাথ আর ছোট সোমনাথ যখন মা বাবার কাছে মানুষ হচ্ছে তখন বড়পিসি তাকে এনে রেখেছিল শিলিগুড়িতে। তখন সারাদিন কাঞ্চনজঙ্ঘা জেগে থাকত ঠিক এইভাবে। তার যৌবন নেই, জরা নেই। কিংবা হয়তো আছে। কিন্তু পাহাড়ের যৌবন বা জরা এতটাই দীর্ঘস্থায়ী যে মানুষের আয়ুতে বেড় পায় না। কিন্তু আজও সে বাল্যকালের সেই যৌবনোদ্ধত পাহাড়টিকে দেখে খুব আনন্দিত হয়। সবকিছুর চেয়ে আজও তার বেশি প্রিয় পাহাড়। উঁচু, একা, মহৎ।
দীপনাথ নিজে পাহাড়ের ঠিক বিপরীত মানুষ। কোনও উচ্চতা নেই, মহত্ত্ব নেই। কলকাতার এক কৌটো তৈরির ছোট্ট কারখানায় সে প্রায় বছর আষ্টেক ম্যানেজারি করেছে। বাঙালির সেই প্রতিষ্ঠানটি প্রথম থেকেই ধুকছিল। মালিক তেমন গা করত না। শ্রমিকরা ছিল ভয়ংকর তেড়িয়া। অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার ছিল দীপনাথের চিরশত্রু এবং মালিকের স্পাই। দীপনাথের খবরদারির মধ্যেই কারখানায় নিয়মিত চুরি হত। এ সবই সহ্য করে মুখ বুজে পড়ে ছিল সে। এমনকী অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারের উসকানিতে সে একবার যোবলা ঘণ্টা ঘেরাও হয়ে থাকে, আর একবার তিন-চারজন ওয়ার্কারের হাতে তাকে মারধর খেতে হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত টেকা গেল না। কারখানার বুড়ো মালিক ডেকে বললেন, তোমার হাতে দিয়ে এতদিন তো দেখলাম, এবার ছেড়ে দাও, নতুন কারও হাতে দিয়ে দেখি যদি চালাতে পারে। দীপ জানে কারখানায় নতুন করে টাকা না ঢাললে, আপাদমস্তক ঢেলে না সাজালে কিছুতেই কিছু হওয়ার নয়।
বছরখানেক আগে চাকরি খুইয়ে সে ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াল খানিক। তারপর জুটল বোসের সঙ্গে। মস্ত এক গুজরাটি ফার্মের ব্রাঞ্চ ম্যানেজার বোস অতি ধূর্ত ও অভিজ্ঞ। দীপনাথ যে কাজের লোক নয় সেটা বোধহয় সে এক নজরেই বুঝে নিয়েছে। কিন্তু সেটা স্পষ্ট করে বলেনি আজও। তবে দীপনাথকে যে সে সঙ্গী এবং সাহায্যকারী হিসেবে খুবই পছন্দ করে তাতে সন্দেহ নেই। কোম্পানি থেকে দীপনাথ ভাউচারে মাসিক ছয় থেকে সাতশো টাকা পায়। তাকে খাতায় সই করতে হয় না, অফিসে বসতে হয় না, ডিউটি আওয়ার্স বা ছুটির দিন বলেও কিছু নেই। অর্থাৎ তাকে কোম্পানির চাকরিতে বহাল করা হয়নি। কেবল ফুরনের লোক হিসেবে পোষা হচ্ছে। বোসকে বিস্তর টুর করতে হয়, সঙ্গে থাকে দীপনাথ। এসব খরচ অবশ্য কোম্পানিই দেয়। বোস কারও সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সময় দীপনাথের যে পদের উল্লেখ করে সেটাও গোলমেলে। বোস তাকে নিজের সেক্রেটারি বলে চালায়। ধৈর্যশীল এবং উপায়ান্তরহীন দীপনাথ তবু বোসের সঙ্গে লেগে আছে। সবদিন তো সমান যায় না। কৌটোর কারখানার ম্যানেজার হিসেবেও সে ছয়-সাতশো টাকার বেশি পেত না। কোনওদিন চুরি করেনি এক পয়সাও। করলে মাসিক আয় বেড়ে হাজার দুয়েকে দাঁড়াতে পারত। চুরি দীপনাথ এখনও করে না। আর সেটা জানে বলেই বোধহয় বোস তাকে এখনও খাতির করে। আপনি-আজ্ঞে করে কথা বলে।
কাল গ্যাংটক থেকে ফিরে দীপনাথ বোস এবং তার বউকে হোটেলে পৌঁছে দিয়ে নিজে ফিরে গিয়েছিল হাকিমপাড়ায়, পিসির বাসায়। বছরখানেক আগে পিসি মারা গেছে। অতিবৃদ্ধ পিসেমশাই আর পিসতুতো ভাইরা আছে। দীপনাথ গেলে বাড়ির সবাই আন্তরিক খুশি হয় এখনও। কাল অনেক রাত পর্যন্ত ভাইদের সঙ্গে আড্ডা দিয়েছে। সব ব্যর্থতার গ্লানি ফুকারে উড়ে গিয়েছিল গানে, গল্পে, ঠাট্টায় আর পুরনো দিনের কথায়। ছেলেবেলার কয়েকজন বন্ধুও এসে জুটেছিল। এসেছিল প্রীতমের মেজো ভাই শতম। কয়েকটা ঘণ্টা বড় আনন্দে কেটেছে। আজ দুপুর থেকে আবার সে বোসের রহস্যময় সেক্রেটারি। অর্থাৎ ফাইফরমাশ খাটার লোক, ফুরনের ভবিষ্যৎহীন খাটনদার।
শতম তার জিপগাড়িতে সিনক্লেয়ার হোটেলে পৌঁছে দিয়ে গেল দীপনাথকে। চলে যাওয়ার আগে হঠাৎ বলল, মেজদা, আমার দাদার জন্য কিন্তু বউদিই দায়ী। দাদা বোধহয় বাঁচবে না, এই শেষ সময়টায় যদি আমাদের কাছে তাকে আসতে দিত বউদি, তবে দাদা বোধহয় একটু আনন্দে মরতে পারত। তুমি বউদিকে একটু বুঝিয়ে বোলো।
পিসতুতো ভাইরা দীপনাথকে মেজদা বলে ডাকত। সেই থেকে সে প্রায় সকলেরই মেজদা। এই ডাকের ভিতরে পুরনো দিনের গন্ধ আছে, জড়িয়ে আছে আত্মীয়তা। মেজদা ডাকের মধ্যে আজও গভীর ভালবাসা খুঁজে পায় দীপনাথ।
মনটা খারাপ হয়ে আছে সেই থেকে। বিলুর সঙ্গে প্রীতমের বিয়ের সম্বন্ধ এনেছিল পিসিমাই। কিন্তু প্রীতমের মতো সাদা সরল ভাল মানুষের সঙ্গে বিলুর মতো বারমুখো মেয়ের যে মিল হয় না সেটা প্রথম থেকেই বুঝেছিল দীপ। কিছু বলেনি তুব। গরমিল কতটা হয়েছিল তা হিসেব করার অবশ্য অবসর হল না। তার আগেই, জীবনের শুরুতেই আস্তে আস্তে নিভে যাচ্ছে প্রীতম। এখনও একবার শিলিগুড়িতে আসার জন্য সে ছটফট করে। কিন্তু বিলু আসতে দেয় না। শেষ চেষ্টা হিসেবে প্রীতমের এখন আকুপাংচার চলছে। একটু উন্নতি হয়তো দেখা যাচ্ছে, কিন্তু সেটুকুর ওপর ভরসা রাখতে ভয় পায় সবাই।
দীপ আর-একবার লাউঞ্জে ঢুকে খোঁজ নিল বোস সাহেবদের কতদূর। যদি এয়ারলাইনসের গাড়ি ছেড়ে যায় তবে তাকে বোসের সঙ্গে আমরাসাডারেই যেতে হবে। কিন্তু এখন কিছুটা সময় সে বোসের সঙ্গ এড়িয়ে চলতে চায়। সঙ্গে গেলেই হাজারও কথার জবাব দিতে হবে। একা থাকলে মুখ বুজে কিছুক্ষণ চিন্তা করার অবকাশ পাবে সে।
রিসেপশনিস্ট বোসের ঘরে ফোন করল। তারপর দীপনাথকে বলল, আপনি মালপত্র নিয়ে এয়ারলাইনসের গাড়িতেই চলে যান।
দীপনাথ একটা শ্বাস ছাড়ল। তা হলে বোধহয় দাম্পত্য ঝগড়া মিটেছে। সে কিছুক্ষণ একা হতে পারবে।
বস্তুত হোটেলের রিসেপশনিস্ট থেকে এয়ারলাইনসের কর্মচারী পর্যন্ত সবাই দীপনাথের চেনা। কারণ বোসের টিকিট কাটা, হোটেল বুক করা, গাড়ি ভাড়া করা থেকে যাবতীয় অনভিপ্রেত কাজ তাকেই করতে হয়।
দীপনাথ এয়ারলাইনসের অফিসের দিকে আসতে আসতেই দেখল এয়ারলাইনসের গাড়ি ছেড়ে গেট দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। দীপনাথ ‘দত্ত!’ বলে দু হাত তুলে চেঁচাতে চেঁচাতে দৌড়োতে লাগল। যেন তার সর্বস্ব চলে যাচ্ছে।
দত্ত বোধহয় গাড়ির আয়নায় দেখতে পেয়েছিল তাকে। চেনা লোক। জানালা দিয়ে মুখ বার করে পিছু ফিরে হাসল। তারপর গাড়িটা ধীরে ধীরে ব্যাক করিয়ে আনল।
দত্তর চোখে গগলস, মুখখানা দারুণ সুন্দর। দুর্দান্ত স্মার্ট ছেলে। বলল, আমি তো আপনাকে এতক্ষণ খুঁজছিলাম। উঠে পড়ুন।
দীপনাথ লাউঞ্জে ঢুকে প্রকাণ্ড ভারী সুটকেসগুলো প্রায় ঘেঁচড়ে নিয়ে এল নিজেই। এটুকু পরিশ্রমেই হাঁফাচ্ছিল। দত্ত বিরক্ত গলায় পোর্টারদের হাঁক দিয়ে বলল, ক্যা দেখ রহে হো? সাবকা মাল উঠা দো।
দীপনাথের কাছে একস্ট্রা খরচের পয়সা নেই। অন্য দিন থাকে। আজ নেই। স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া হওয়ার পর থেকেই বোস গোমড়ামুখো হয়ে আছে, অনেক কিছু করণীয় কাজও করছে না। কাজেই পোর্টারদের মাল তোলার ব্যাপারে একটু ভয় খেল দীপ। টিপস দিতে হবে নিজের গাঁট থেকে।
গতকাল পিসির বাড়ি যাওয়ার সময় দশ টাকার মিষ্টি নিয়ে গিয়েছিল। দীপের কাছে আজকাল দশ টাকা মানে অনেক টাকা। সে যে ফুরনের কাজ করে তা তো কেউ জানে না। পিসতুতো ভাইরা বা পিসেমশাই জানে, সে একটা বড় ফার্মের ব্রাঞ্চ ম্যানেজারের সেক্রেটারি। গালভরা কথা।
পোর্টারদের অবশ্য ঠেকাতে পারল না দীপ। তারা হাতাহাতি করে মালগুলো বাসের পিছনে তুলে দিল ফটাফট। চোখ বুজে তিনটে টাকা দিয়ে দিতে হল। এয়ারলাইনসের কুলিভাড়া সাংঘাতিক। এক পিস মালে এক টাকা।
বাসে কুল্লে দশ-পনেরোজন যাত্রী। তার মধ্যেও তিন-চারজন এয়ারলাইনসের লোক। বাস ছাডবার আগে কেতাদুরস্ত দত্ত হাসিমুখে এগিয়ে এসে বাসের টিকিট দেয়। চারটে টাকা। দীপনাথ চোখ বুজে টাকাটা দিল। এসব খরচের হিসেব দিয়ে বিল করলে টাকাটা সে পেয়ে যাবে ঠিকই। কিন্তু এসব ছোটখাটো হিসেব বিল করতে তার লজ্জা করে।
জানালার ধারে বসে বাইরে চেয়ে থাকে দীপ। সামান্য একটা কুয়াশার ভাপ উঠে কাঞ্চনজঙ্ঘা আবছা হয়েছে। প্রচণ্ড ঠান্ডা বাতাস চলন্ত বাসের জানালা দিয়ে এসে এফেঁড় ওফেঁড় করছিল তাকে! তবু জানালাটা বন্ধ করল না দীপ। এই জায়গার বাতাসটা তার প্রিয়। এই জায়গা প্রিয় প্রীতমেরও। প্রীতম কি শেষ হয়ে যাওয়ার আগে কোনওদিন ফিরে আসতে পারবে এখানে?
বহুকাল আগে হাকিমপাড়ার কাঁচা নর্দমার ধারে তার হাতে ঘুসি খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছিল প্রীতম। বয়সে কয়েক বছরের ছোট ছিল প্রীতম। রোগা এবং দুর্বল। কী নিয়ে ঝগড়া হয়েছিল তাদের তা আজ মনে নেই। শুধু মনে আছে মাটিতে পড়ে প্রীতমের প্রাণান্তকর চেঁচানি। অসহায় আক্রোশে প্রীতম কাঁদতে কাঁদতে তাকে বলছিল, তুই আমার বাঁ হাতটা খা, আমার বাঁ পাটা খা। প্রীতম খারাপ গালাগাল জানত না। কোনওদিন সে শালা’ কথাটাও বলেনি। তাদের পারিবারিক শিক্ষাই তার জিভকে শুদ্ধ রেখেছিল। কিন্তু সেদিন প্রীতমের সেই গালাগাল শুনে হেসে বাঁচেনি দীপ। ও কি একটা গালাগাল হল? বাঁ হাত খা! বাঁ পা খা!
আজ বহুকাল পরে সেই কথা মনে পড়ায় চোখে জল আসছিল দীপের। না কি ঠান্ডা বাতাস লেগে চোখ জলে ভরে আসছে! একজন দয়ালু যাত্রী পিছন থেকে হাত বাড়িয়ে জানালার কাচটা টেনে বন্ধ করে দিল। দীপ আর কাচটা খুলল না। দত্ত প্রায় এরোপ্লেনের মতোই জোর গতিতে গাড়িটা উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এত বাতাস সইবে না।
এয়ারপোর্টে নামতেই আবার ব্যস্ততা। দার্জিলিঙে বরফ পড়ছে এবার। প্রচণ্ড শীতে মুহ্যমান উত্তরবঙ্গ। এয়ারপোর্টে ভিড় তাই তেমন নয়। সে মালপত্র ওজন করাল, কেবিন টিকিট নিল। প্লেনে মাত্র একটি সারিতেই রয়েছে দুটো সিট। সাধারণত বোস সস্ত্রীক সেই দুটো সিটেই জায়গা নেয়। কিন্তু মালপত্র ওজন করানোর সময় দীপের হঠাৎ মনে পড়েছে গ্যাংটকে দেড় হাজার টাকায় কেনা কার্পেটটা মালপত্রের সঙ্গে নেই। এয়ারলাইনসের অফিসে ফোন করে জানল যে, সেটা লাউঞ্জেও পড়ে নেই। মহার্ঘ কার্পেটটার গতি কী হল তা বুঝতে পারছিল না দীপ। ঝগড়ার মূলেও সেটাই। কার্পেটটা ভাজ করে সুটকেস বা বেডিং-এও ঢুকবে না। ঢুকলেও তা টের পেত দীপ। কারণ এই বেডিং বা সুটকেস তাকে বহুবার গোছাতে হয়েছে। তাই সে আন্দাজ করল কার্পেটটা ওরা সঙ্গে নিচ্ছে না। রাগ করে হয়তো ফেলে রেখেই যাচ্ছে। তার মানে, ওদের ঝগড়া মেটেনি। তাই যদি হয় তবে দুই আসনের সারিতে ওরা কিছুতেই পাশাপাশি বসবে না। দীপকে হয় বোস বা শ্ৰীমতী বোসের সঙ্গে বসতে হবে।
বোসরা এখনও আসেনি। লাউডস্পিকারে জানান দিচ্ছে, প্লেন আসতে দেরি হবে। কলকাতা থেকেই ছাড়বে পঁয়তাল্লিশ মিনিট দেরিতে। একটু বিরক্ত হয় দীপ। এই পঁয়তাল্লিশ মিনিট বেড়ে বেড়ে শেষ পর্যন্ত দু’ঘণ্টায় দাঁড়াতে পারে। এই অভিজ্ঞতা তার আছে। তার খুব ইচ্ছে আজ, কলকাতায় ফিরেই প্রীতমকে দেখতে যায়। অবশ্য বোস যদি সময়মতো তাকে অব্যাহতি দেয়।
দীপ এক কাপ কফি খাবে বলে রেস্টুরেন্টে ঢুকল। বেশ কয়েকজন সাহেব-মেম বসে বিয়ার খাচ্ছে। সামনের দিকে কয়েকজন সাহেব-মেমের খুব জটলা আর উঁচু গলার কথা শোনা যাচ্ছিল। তাদের মাঝখানে একজন প্রৌঢ় নেপালি দাঁড়িয়ে। তার গায়ে বিদেশি জার্কিন, পরনে কর্ডের প্যান্ট, চোখে গগলস। প্রথমটায় চিনতে পারেনি দীপ। একবার তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। কফি এলে গভীর তৃপ্তিতে চুমুক দিল সে। কিন্তু মনটা খচখচ করছে। আবার তাকাল এবং সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত স্মৃতি মথিত করে উঠে এল পরিচয়। তেনজিং নোরকে!
তেনজিং যখন এভারেস্টে উঠেছিল তখন দীপ বোধহয় স্কুলের বেশ নিচু ক্লাসে পড়ে। শিলিগুড়িতে সে বহুবার তেনজিংকে দেখেছে। দুটি কিশোরী মেয়েকে নিয়ে তেনজিংকে তখন চারদিকে সংবর্ধনা নিতে ছুটতে হচ্ছে। জন্মগত বিনয় ও অহংকারহীনতা তেনজিংকে ভারী জনপ্রিয় করেছিল। আজও তাকিয়ে সে তেনজিং-এর মুখে সেই সবল হাসি দেখতে পায়। এই লোকটা এক মস্ত পাহাড়ে উঠেছিল। দীপ কোনওদিন সেইসব দুরারোহ পাহাড়ে উঠবে না। তার গতি নীচের দিকে। নীচের দিকে।
সমস্ত কৈশোরকাল তার সমস্ত রং আর গন্ধ নিয়ে ঘিরে ধরে দীপকে। সে উঠে কোটের পকেট থেকে ছোট নোটবই আর ডটপেন বের করে এগিয়ে যায়। সাহেব-মেমরা রাস্তা দিল। সোজা গিয়ে তেনজিং-এর সামনে, খুব কাছাকাছি দাঁড়ায় দীপ। হাত বাড়াতেই তেনজিং শক্ত পাঞ্জায় চেপে ধরে তার হাত। এ লোকটা পাহাড়ে উঠেছিল। খুব উঁচু, একা মহৎ এক শুভ্র পাহাড়ে। বাঁ হাতের নোটবইটা বাড়িয়ে যখন দীপ বলল, অটোগ্রাফ প্লিজ’ তখনই বুঝতে পারল রুদ্ধ আবেগে তার গলা বসে গেছে।
তেনজিং খুব বিনয়ের সঙ্গে সই দিয়ে দেয়। কিছু বলার ছিল না দীপের। সে ফের এসে টেবিলে বসে। কফি ঠান্ডা হয়ে এসেছে। সে এক চুমুকে সেটা খায়। নোটবইটা খুলে একবার সইটা দেখে। এইভাবে সই নেওয়ার অভ্যাস তার কোনওকালে নেই। তেনজিং বিখ্যাত মানুষ বলেও নয়। কেবল সেই শৈশবের দারুণ সুন্দর স্মৃতি আর পাহাড়ে ওঠার এক অসম্ভব স্বপ্নই তাকে এই কাজে প্ররোচিত করেছে। পাহাড়ের মতো সুন্দর আর কী আছে পৃথিবীতে? কে আছে তার মতো সুখী যে পাহাড়ে ওঠে?
একদিন দীপ তার সব কাজকর্ম ফেলে রেখে একা বেরিয়ে পড়বে। হাঁটতে হাঁটতে চলে যাবে কোনও মস্ত দুরারোহ পাহাড়ের পাদদেশে। তারপর শুরু করবে তার ধীর ও কষ্টকর আরোহণ। কোনওদিনই শীর্ষে পৌঁছাবে না সে। অনাহারে, শীতে, পথশ্রমে একদিন ঢলে পড়বে পাহাড়েরই কোলে। বড় একা, নিঃসঙ্গ মৃত্যু ঘটবে তার। কিন্তু বড় সুখী হবে সে।
আচমকাই বোস কাচের দরজা ঠেলে হনহন করে তার টেবিলে চলে এল। একা। বসেই বলল, বিয়ার চলবে?
না।–দীপ স্বপ্নভঙ্গের পর কিছুটা নরম স্বরে বলে। তারপর ভদ্রতাবশে জিজ্ঞেস করে, মিসেস বোস কোথায়?
বোস তার বিয়ারের অর্ডার দিয়ে বলে, স্টলে বোধহয় কিছু কিনছে। শি ইজ অলওয়েজ বায়িং অ্যান্ড বায়িং হেল।
বোস ছ’ ফুটের ওপর লম্বা। কিন্তু চেহারাটা শক্তিমানের নয়। বরং খানিকটা ভুড়ি এবং যথেষ্ট চবিওলা দশাসই চেহারাটা দেখলে একটু মায়াই হয়। মনে হয় এত বড়সড় চেহারাটা টানছে কী করে লোকটা? বোসের বয়স দীপের মতোই ত্রিশ পেরোনো। অর্থাৎ যথেষ্ট যুবক। তবু আরাম আমোদ এবং উচ্ছঙ্খলতার দরুন তার চুলে পাক ধরেছে, চোখের দৃষ্টিতে একটা ঘোলাটে ভাব এসেছে। লোকটা প্রচণ্ড অহংকারী। হালকা পেপারব্যাক ছাড়া আর কিছু পড়ে না বলে ওর মানসিকতাও এক জায়গায় থেমে আছে।
চোঁ করে বিয়ারের গ্লাস শেষ করে বোস। তারপর বলে, প্লেন লেট শুনছি!
হ্যাঁ। পঁয়তাল্লিশ মিনিট বলছে। তবে বেশিও হতে পারে।
বোস অন্য দিকে চেয়ে থাকে ভ্রু কুঁচকে বলে, আপনি দমদমে নেমে ওকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে যাবেন। আমি অফিস হয়ে যাব।
দীপ স্বস্তির শ্বাস ছাড়ল। মিসেস বোসকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েও সে প্রীতমের কাছে যাওয়ার যথেষ্ট সময় পাবে।
রেস্টুরেন্ট থেকে লাউঞ্জে ঢুকবার আগে পকেট থেকে এম্বাকেশন কার্ডগুলো বের করে ভ্রু কুঁচকে খানিকক্ষণ দেখে দীপ। সমস্যা একটা থেকেই যাচ্ছে। দুটো সিট পাশাপাশি, একটা আলাদা। ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে বোস এবং তার বউ কিছুতেই পাশাপাশি বসবে না। সেক্ষেত্রে তাকে হয় বোস বা তার বউয়ের সঙ্গে বসতে হবে। একা চুপচাপ বসে কিছুক্ষণ আপনমনে থাকার কোনও আশাই নেই।
লাউঞ্জে খুব একটা ভিড় নেই। সব মিলিয়ে ষাট-সত্তরজন লোক হবে। বড়সড় বোয়িং ৭৩৭ বিমানটি আজ ফাঁকাই যাবে। তবু একা আলাদা বসার কোনও সুযোেগই পাবে না দীপ। ভেবে তার মনটা ভার লাগছিল। কিছুই নয়, মাত্র পঁয়তাল্লিশ মিনিট সময়, তবু ওই সময়টুকু নিজের জন্য চুরি করার যেন বড় প্রয়োজন ছিল। প্লেনটা যখন উঠবে তখন কয়েক পলক এক অসম্ভব অবিশ্বাস্য অ্যাঙ্গেল থেকে সে আর-একবার প্রাণমন ভরে দেখে নেবে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে। দেখবে বিপুল কালো শরীরে মহিষাসুর পাহাড়গুলিকে। তারপর চোখ বুজে পাহাড়ের কথা ভাববে বাকিটা সময়।
ওপাশের স্টলে কয়েকজন দাঁড়িয়ে। পিছন থেকেও নির্ভুলভাবে মিসেস বোসকে চিনতে পারে দীপ। ইদানীং ভদ্রমহিলা কিছু উগ্র হয়েছেন। পরনে ঢোলা প্যান্ট এবং গায়ে খুব আঁটসাঁট একটা লাল পুলওভার। গলায় জড়ানো কালো নকশাদার একটা স্কার্ফ। বব চুলের ওপর একটা মস্ত বেতের টুপি। কাছাকাছি এগিয়ে যেতেই একটা অসম্ভব সুন্দর সুগন্ধ পায় দীপ। গন্ধটা মোহাচ্ছন্ন করে ফেলার ক্ষমতা রাখে।
মিসেস বোস চকোলেট থেকে পেপারব্যাক পর্যন্ত বিস্তর জিনিস ইতিমধ্যেই কিনে ফেলেছেন। হাতের মস্ত হাতব্যাগটা খুলে অত্যন্ত অসাবধানে এবং অগোছালো হাতে অন্তত গোটা কুড়ি-পঁচিশ একশো টাকার নোট এক খামচায় বের করে এনে দাম দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু টাকাগুলো গোছানো অবস্থায় ছিল না বলে দু-একটা নোট পড়ে গেল মেঝেয়। মিসেস বোস নিচু হয়ে কুড়োতে যাচ্ছিলেন, দীপ তা করতে দিল না। অত্যন্ত স্মার্ট ভঙ্গিতে নিজেই কুড়িয়ে দিল। নিচু অবস্থায় খুবই কাছাকাছি হল দু’জনের মুখ। মিসেস বোস বললেন, থ্যাংক ইউ।
দীপ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে খুব দয়ালু হাতে মিসেস বোসের নোটগুলো সাজিয়ে ভাঁজ করে দেয় এবং বলে, প্লেন লেট। কফি খাওয়ার সময় আছে।
আমি এখন খাব না। ওই গরিলাটা আগে বেরোক, তারপর দেখা যাবে।
মিসেস বোস লম্বায় প্রায় সাড়ে পাঁচ ফুট। অর্থাৎ দীপের চেয়ে মাত্র ইঞ্চি তিনেক খাটো, রংটা তেমন পরিষ্কার নয়, কিন্তু ভারী ঢলঢলে আহ্লাদী এবং সুশ্রী চেহারা। বয়স নিতান্তই কম বলে একটা সতেজ আভা শরীর থেকে বিকীর্ণ হয়। দীপ জানে মিসেস বোসের অনেকগুলো মারাত্মক দোষ আছে, কিন্তু গুণের মধ্যে এই সতেজ ভাবটুকু অবশ্যই ধরতে হবে। যতবারই সে এই মেয়েটির কাছাকাছি হয় ততবারই তার অনুভূতি হতে থাকে, হাতের নাগালে একটা সাংঘাতিক হাই-ভোল্টেজ বৈদ্যুতিক তার দুলছে। ছুঁলেই ঘঁাত করে মেরে দেবে। দীপ তার নিজের স্বাসের পরিবর্তন টের পায়। খাস কিছু গাঢ় ও ঘন এখন। সে বলল, উনি এখনই বেরোবেন বলে মনে হয় না, বিয়ার নিয়ে বসেছেন। কিন্তু রেস্টুরেন্টে একজন খুব ইন্টারেস্টিং লোক রয়েছেন। তেনজিং নোরকে। দেখবেন তাকে?
দ্যাট এভারেস্ট হিরো? ওঃ, ওকে আমি দেখেছি।
বলে মিসেস বোস তাঁর মস্ত হাতব্যাগটা খুলে কেনা জিনিসগুলো ভরবার চেষ্টা করতে থাকেন। স্বভাবতই দীপকে হাত লাগাতে হয়। মিসেস বোসের হাতব্যাগে জিনিস ভরে দিতে দিতে সে আনমনে তেনজিং-এর কথা ভাবছিল। বহু বছর আগে পৃথিবীর উচ্চতম পর্বতে উঠেছিল লোকটা। আজ পরের প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা ব্যাপারটাকে অতটা গুরুত্ব দিয়ে দেখছে না। তেনজিং-এর পর এভারেস্টে আরও অনেকে উঠেছে। কে তেনজিং-এর কথা অত করে মনে রাখবে? এভারেস্টের সেই মহিমাও তো আর নেই।
মিসেস বোস লাউঞ্জের একটা চেয়ারে বসে বলেন, এর আগের বার যখন এসেছিলাম, মনে আছে? আমাদের সঙ্গে প্লেনে বম্বের তিন-চার জন ফিলমস্টার ছিল? শিলিগুড়ির কোন ফাংশনে আসছিল যেন!
দীপ পাশের চেয়ারটা ফাঁক রেখে পরের চেয়ারটায় বসেছে। বলল, শিলিগুড়িতে ওরা প্রায়ই আসে। এখানে বছরে দশ-বারোটা ফাংশন হয়। কলকাতার চেয়েও বম্বের ফিলমস্টাররা শিলিগুড়িতে বেশি আসে।
ও। তা হলে এবার তারা নেই কেন?
এবারও আছে। তিলক ময়দানে বিরাট ফাংশন হচ্ছে।
ইস, তা হলে আর-একদিন থেকে গেলে হত।
মিস্টার বোসকে বলুন না!
ঠোঁটটা খুব তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে উলটে মিসেস বোস বলে, ওকে বলতে বয়ে গেছে। অদ্ভুত আনসোশ্যাল লোক একটা। আপনিই দেখলাম ওর সঙ্গে মানিয়ে চলতে পারেন, আমার তো অ্যাডজাস্ট করতে ভীষণ অসুবিধে হয়।
দীপ খুব উদার গলায় বলে, কেন? মিস্টার বোস তো বেশ লোক।
মিসেস বোস চকোলেট বারের রাংতা খুলতে খুলতে বলেন, পুরুষদের কাছে পুরুষরা তো ভাল হবেই। খারাপ যত মেয়েরা।
ঠিক তা বলিনি।–দীপ একটু দ্বিধার ভাব দেখায়।
মিসেস বোস টুকুস করে এক টুকরো চকোলেট দাঁতে কেটে বলেন, পুরুষদের আসল চেহারা বোঝা যায় বেডরুমে। বাইরে সে যত বড় একজিকিউটিভই হোক না কেন, বেডরুমে তার মুখোশ খুলে যায়। বাইরের লোক তো সেটা দেখতে পায় না।
কথাটা হয়তো ঠিকই। দীপ তাই এই বিপজ্জনক প্রসঙ্গ আর ঘাটে না। চুপ করে থাকে। বোসের অল্পবয়সি সুন্দরী স্ত্রটি চকাস-টকাস শব্দ করে চকোলেট খান বটে, কিন্তু তার মুখ দেখে বোঝা যায় চকোলেটের স্বাদ উনি একটুও উপভোগ করছেন না। ভদ্রমহিলার আসল ভ্রু বলতে কিছু নেই। লোমগুলো খুবই নিপুণভাবে উপড়ে ফেলা হয়েছে। কপালের দিকে উঁচু করে কৃত্রিম ভ্রু আঁকা। ফলে চোখের ওপরে অনেকটা মাংসের ডেলা বেরিয়ে আছে। কাছ থেকে দেখলে দৃশ্যটা তেমন সুন্দর নয়। যা হোক, মিসেস বোস এখন তার আঁকা ভ্রু কুঁচকে খুব বিরক্তির সঙ্গে সামনের দিকে চেয়ে কিছু ভাবছেন। বোধহয় মিস্টার বোস সম্পর্কে খুবই খারাপ ধরনের কিছু কথা। দীপ একবার কার্পেটটার খোঁজ নেবে কি না ভাবল। কিন্তু জিজ্ঞেস করতে ঠিক সাহস পেল না।
লাউডস্পিকারে ফ্লাইট টু টুয়েন্টি টু-র যাত্রীদের সিকিউরিটি এনক্লোজারে যেতে অনুরোধ জানানো হচ্ছে। অর্থাৎ প্লেন আর খুব বেশি দেরি করবে না। ঘোষণাটি খুব নিরুত্তাপ মুখে শুনলেন মিসেস বোস, কিন্তু নড়লেন না। অবশ্য তাড়াহুড়ো নেই, হাতে এখনও অঢেল সময় আছে।
দীপ নিঃশব্দে উঠে গিয়ে বাইরে দাঁড়ায়। ওপাশের রানওয়ে দিয়ে পর পর এয়ারফোর্সের চারটে ন্যাট গোঁ গোঁ করে বিদ্যুতের গতিতে ছুটে উড়ে গেল। তারপর ফাঁকা রোদে মাখা মস্ত মাঠটা পড়ে রইল উদোম হয়ে। উত্তরে নীলবর্ণ বিশাল পাহাড়ের সারি। কাঞ্চনজঙ্ঘার রং ধূসর সাদাটে হয়ে আকাশের পিঙ্গলতায় প্রায় মিশে গেছে। তবু তার ভাঙাচোরা শীর্ষদেশের একপাশে একটা সমতল ধারে সোনালি রোদ ঝলকাচ্ছে আয়নার মতো। মুহূর্তে সব ভুলে গেল দীপ। তার ভিতর থেকে আর-একজন দীপ বেরিয়ে গিয়ে আস্তে আস্তে পাহাড়ের দিকে দীর্ঘ চলা শুরু করল।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে দীপ। পিঙ্গল আকাশে হঠাৎ রুপোলি প্লেনটা দেখা যায়। লাউডস্পিকারে শেষবারের মতো সিকিউরিটি চেক-এর জন্য যাত্রীদের ডাকা হচ্ছে। দীপ লাউঞ্জে এসে দেখে তার কিটব্যাগটা অনাদরে পড়ে আছে চেয়ারের পাশে। মিসেস বা মিস্টার বোসকে দেখা যায় না। সে একবার রেস্টুরেন্টে উঁকি দিল। নেই। সিকিউরিটির বেড়া ডিঙিয়ে ওরা সামনের লাউঞ্জে চলে গেছে নিশ্চয়ই। নিশ্চিত হয়ে সে সিকিউরিটির কাঠের খাঁচায় গিয়ে ঢোকে।
প্লেনে উঠে বোস আর তার বউ একটু ইতস্তত করছিল। তারপর যা হওয়ার তাই হল। বোস গিয়ে আলাদা সিটে বসল। দীপকে বসতে হল মিসেসের পাশে। স্বভাবতই মিসেস বোস জানালা দখল করেছেন।
যাত্রীর সংখ্যা খুবই কম। প্লেনের অর্ধেক সিটও ভরতি হয়নি। প্লেনের ভিতরে মৃদু সুবাস ভেসে বেড়াচ্ছে। লাউডস্পিকারে একঘেয়ে ঘোষণার শেষে নিয়মমাফিক মিউজিক বাজতে থাকে এবং খাবারের ট্রে হাতে আসে হোস্টেস। ঠিক পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মাথায় প্লেন নিয়মমাফিক নামবে দমদমে। এই একঘেয়েমির হাত থেকে কচি মুক্তি পায় মানুষ। এই যে কয়েক হাজার ফুট উঁচুতে আকাশের হৃদয়ে ঢুকে পড়া তা মানুষ টেরই পায় না এইসব আধুনিক বিমানে। মিউজিক, এয়ার হোসটেস, খাবার, চা বা কফি, নরম কুশন ইত্যাদি দিয়ে কেবলই অন্যমনস্ক করে রাখা হয় যাত্রীদের। এক-আধবার নিয়ম ভেঙে প্লেনে আগুন লাগে, ইঞ্জিন বিগড়োয়, আর তখন মৃত্যুভয়ে হিম হয়ে যায় মানুষ। কিংবা কখনও-সখনও বেপরোয়া কোনও হাইজ্যাকার বন্দুক বার করে প্লেনকে নিয়ে যায় কোনও অচেনা দুর-দুরান্তে। সেসব বিরল ঘটনা। নইলে দুনিয়াভর অধিকাংশ বিমানই নিয়ম মাফিক ওড়ে এবং নামে। নিয়ম ভেঙে আজ অন্তত একজন হাইজ্যাকার উঠে দাঁড়াক বন্দুক হাতে। বলুক, এ প্লেনকে সোজা নিয়ে চলো কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে।
এক কাপ কফি ছাড়া দীপ আর কিছুই খেল না। কফি ভাল করে শেষ হওয়ার আগেই পায়ের নীচে চলে এল কলকাতা। দিগন্তে আর কোনও পাহাড়ের চিহ্নও রইল না।
এয়ারপোর্টে বোসের বশংবদ ড্রাইভার সহ গাড়ি অপেক্ষা করছিল। কিন্তু গাড়িতেও ওরা স্বামী-স্ত্রী নিজেদের ঝগড়াকে জানান দিতে আলাদা বসে। সামনে বোস, পিছনে তার বউ আর দীপ। দীপের মাথা থেকে পাহাড় খসে গেছে, এমনকী বোসের বউয়ের গা থেকে আসা সুবাসটিও সে টের পাচ্ছে না। ট্রলি থেকে লাগেজ বুটে মাল তোলার সময় সে লক্ষ করেছে মস্ত ফাইবার গ্লাসের বিদেশি সুটকেসটার একটা কবজা ভাঙা। আজকাল প্লেনে মাল নেওয়াটাই আহাম্মকি। এয়ারপোর্টের পোর্টাররা দুমদাম করে সেগুলো আছড়ে ফেলে বা তোলে। কোনও মায়াদয়া দায়িত্ববোধ নেই। কবজা ভাঙার জন্য সে দায়ী নয় বটে কিন্তু সুটকেসটা সারানোর দায়িত্ব তার ওপর পড়তে পারে ভেবে একটু তটস্থ বোধ করছিল দীপ। এসব ছোটখাটো জিনিস লক্ষ করাই আসলে তার কাজ। দীপ আজকাল ধরেই নিয়েছে, সে হল বোসের মোসাহেব, হেড চাকর, বাজার সরকার। এবং স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সংযোগ-রক্ষাকারী দালাল। তবু নিজের ওপর তেমন কোনও গভীর ঘেন্না হয় দীপের। কারণ সে জানে, একদিন এইসব তুচ্ছতা থেকে সে মুক্তি পাবে। যেদিন পাহাড় ডাকবে।
বোস গণেশ অ্যাভেনিউ অফিসের সামনে নেমে গেল।
দীপ একবার ভাবল, সামনের সিটে গিয়ে বসবে। কিন্তু সেটা কেমন দেখাবে তা বুঝতে না পেরে তার নড়তে চড়তে সাহস হচ্ছিল না। বোস নেমে যেতেই মিসেস বোস চাপা স্বরে বলেন, হামবাগ। কাজ না আরও কিছু! জাস্ট অ্যাভয়েড করার জন্য অফিসের নাম করে কেটে পড়ল।
দীপ কথা বলে না। বলার নেই। মাঝে মাঝে তাকে কেবল শুনে যেতে হয়। কলকাতায় পা দিয়েই বোসের বউ একটা মস্ত রোদ-চশমা চোখে দিয়েছেন। বাইরের দিকে চেয়ে থেকেই দীপকে উদ্দেশ করে বললেন, আপনার কি অন্য কোনও কাজ জোটে না, দীপনাথবাবু? ওই গরিলাটার সঙ্গে লেগে থেকে নিজের ফিউচারটা নষ্ট করছেন কেন? হি উইল ড়ু নাথিং ফর ইউ।
দীপ চালাক হয়েছে। সে জানে এসব দুর্বল মুহূর্তের সুযোগ নিয়ে মিস্টার বোস সম্পর্কে একটিও নিন্দের কথা তার বলা ঠিক হবে না। একদিন বোস আর তার বউ আমে-দুধে মিশে যাবে, আর সেদিন এই নিন্দের কথা বাঁশ হয়ে ফিরে আসবে। তাই সে খুব উদাসভাবে বলে, বোস সাহেবের ওপর আপনি খুব চটেছেন। রেগে গিয়ে কাউকে ঠিক বিচার করা চলে না।
একটু অধৈর্যের গলায় মিসেস বলেন, প্লিজ! আমার লাইফটা নষ্ট হয়েছে, আপনারটাও নষ্ট করবেন না।
দীপ কঁচুমাচু হয়ে বলে, আসলে দেশে চাকরির খুব একটা স্কোপও তো নেই দেখছেন।
ওসব বাজে কথা। ভাববেন না যে, আমি একজন হামবাগ মানিসেন্ট্রিক একজিকিউটিভের স্ত্রী বলে কোনও খবর রাখি না! ইন ফ্যাক্ট আমি নিতান্ত মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে। সোসাইটিতে কী হচ্ছে।
হচ্ছে সব খবর রাখি। মাত্র কয়েক বছর আগেও আমি লেফটিস্ট ছিলাম, অ্যাকটিভ পলিটিকস করতাম।
দীপ একটু অবাক হয়ে নতুন করে মিসেস বোসের দিকে তাকায় এবং কথাটা মিলিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে।
মিসেস বোসের রোদচশমাটার জন্য তেমন কিছু বুঝতে পারছিল না দীপ। খুব কৌতুকের সঙ্গে সে প্রশ্ন করে, এসব কথা কি মিস্টার বোস জানেন?
ঠোঁট উলটে মেয়েটা বলে, আমি ওকে কিছু বলিনি। জানলে জানে। আমি পরোয়া করি না। কিন্তু আমার প্রশ্ন, আপনি এভাবে ওর সঙ্গে লেগে আছেন কেন? আফটার অল আপনার তো কাজের কিছু এক্সপেরিয়েন্স আছে বলে শুনেছি।
দীপ মৃদু স্বরে বলে, আমি একটা কৌটো তৈরির কারখানায় কাজ করতাম। টেকনিক্যাল কাজ নয়, অ্যাডমিনস্ট্রেশনের। খুবই ছোেট লুজিং কনসার্ন। সেই অভিজ্ঞতার তেমন কোনও দাম নেই।
মিসেস বোস খুব দৃঢ় স্বরে বলেন, টেকনিক্যাল নো হাউ ই আসল জিনিস। যদি আপনি সেটা শিখে নিতেন তা হলে আজ এই গরিলাটাকে তোয়াজ করে চলতে হত না। আজকাল একটা সামান্য ইলেকট্রিক মিস্ত্রি বা থার্ডগ্রেড ছুতোরও বসে থাকে না। যে সামান্য তালাচাবি সারাতে পারে, ঝালা দেওয়ার কাজ জানে, ছুরি কঁচি শান দেয় বা লেদ চালায় তাবও কাজের অন্ত্র নেই। একটুখানি টেকনিক্যাল কাজের জ্ঞান আর বেঁচে থাকার ইচ্ছে থাকলেই হল। আপাব কি কোনওটাই নেই?
দীপ একটু হাসে। মাথা নেড়ে বলে, বেঁচে থাকার ইচ্ছেটা তো জৈব জিনিস। সেটা ছাড়তে পারিনি বলেই এখনও মিস্টার বোসর সঙ্গে লেগে আছি।
কিন্তু তাতে বাঁচবেন না। ও নিজেই আমাকে অনেকবার বলেছে, দীপনাথ ইজ গুড ফর নাথিং। ওর উন্নতি করার ইচ্ছেটাই নেই। তার মানে ও আপনাকে অলরেডি ক্যানসেল করে বেখেছে। আর আপনি যতটা মনে করেন ওর ততটা ক্ষমতাও নেই। গুজরাটিরা অত্যন্ত কাশিং বিজনেসম্যান। তাই ওর হাতে রিক্রুটিং পাওয়ার তেমন কিছু দিয়ে রাখেনি। ব্রাঞ্চ ম্যানেজার কথাটা খুব গালভরা, কিন্তু পাওয়ার বলতে কিছু নেই, চিসিশন বা পলিসি মেকিং নেই, অ্যাডভাইস দেওয়ার ক্ষমতা নেই। আপনি অনর্থক এখানে চাকরির আশা করছেন।
দীপ বোসের বউকে আর-একটু ভাল করে দেখল। কম বয়স, বামপন্থী চিন্তাধারার অবশিষ্ট কিছু রেশ, কিছু আবেগ, স্বামীর ওপর রাগ এবং তার ওপর করুণা এইসব মিলিয়ে এ মেয়েটা এখন যা বলছে তা নিজেও বিশ্বাস করে না। দীপ এই সমাজকে খুব ভাল না চিনলেও খানিকটা বুকে নিয়েছে। সে জানে মিস্টার বোস চাকরি দেওয়ার মালিক না হলেও তার কথার দাম আছে। গুজরাটি ভাল ব্যবসায়ী বলেই বোসকে কখনও!টাবে না। বোস ইটান জোন-এ কোম্পানির কোমরের জোর অনেকখানি এনে দিয়েছে। বোসর বউ সেটা স্বীকার করুক বা না করুক। সে তাই মৃদু স্বরে বলে, বোস সাহেবের ক্ষমতা নেই এমন কথা আপনাকে কে বলল? কথাটা পুরোপুরি সত্য নয়। তা ছাড়া নতুন করে টেকনিক্যাল না হাউ শেখার বয়সও আমার নেই!
আপনার বয়স কত?
ত্রিশের কিছু ওপরে। সঠিক হিসেব নেই, উইদিন থার্টিথ্রি।
ওটা কোনও বয়স নয়। আপনি তো খুব ফিট দেখতে।
তবু বয়সটা ফ্যাক্টর। শেখার পক্ষে ফ্যাক্টর।
বাড়িতে কে কে আছে?
অলমোস্ট কেউ না।
স্ত্রী?
বিয়ে করিনি।
তাই বলুন! একটা বয়স পর্যন্ত বিয়ে না করে থাকলে পুরুষরা একটু খ্যাপাটে হয়ে যায়।
আমি কি খ্যাপাটে?
নয়তো কী? প্লেন থেকে নামাবার সময় আমি লক্ষ করেছি আপনি মিস্টার বোসের অ্যাটাচি কেসটা হাত থেকে প্রায় কেড়ে নিলেন। আপনার আত্মমর্যাদাবোধ নেই কেন? ওর অ্যাটাচি আপনি কেন বইবেন?
দীপ খুব হাসে। হাসতে হাসতে বলে, আপনি মিস্টার বোসের ওপর খুব চটেছেন আজ?
মিসেস বোস একটু চুপ করে থাকেন। কমনীয় মুখশ্রী এখন আর ততটা কমনীয় দেখাচ্ছে না। চোয়ালে যথেষ্ট দৃঢ়তা। খুব আস্তে করে বলেন, আই অ্যাম স্টিল ডেডিকেটেড টু মাই আইডিয়ালস। আমি কোনও বড়লোককেই সহ্য করতে পারি না। বিশেষ করে ওর মতো হামবাগ স্লেভ একজিকিউটিভদের। আমি ওকে জাংকারপট করে ছাড়ব। তার কিছু না পারি ওর সমস্ত সেভিংসকে উড়িয়ে দেওয়ার পথ আমার ভোলা আছে। আমি ওকে ভিখিরি করে ছেড়ে দেব।
দীপ টের পায় মিসেস বোসের কোমল অঙ্গ থেকে একটা অস্বাভাবিক তাপপ্রবাহ আসছে। ভারী অস্বস্তি বোধ করে সে। এবং খুবই ঠান্ডাভাবে বসে থাকে।