শিক্ষা ব্যবস্থা
ঐ যুগে যখন জ্ঞান-বিজ্ঞান ও বিদ্যা চর্চার ব্যাপক প্রচলন ছিল, তখনই ‘জাহিয” শিক্ষক শ্রেণীর সমালোচনা করেন এবং তাদের দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করেছেন। জ্ঞান-বিজ্ঞানের শ্লথ গতি ও মন্দাভাবের আমলে অবস্থা যে কত শোচনীয় ছিল, তা সহজেই অনুমেয়।
সে যুগের শিক্ষকদের দুরবস্থা সম্পর্কে অবগতির জন্যে আমরা ইব্ন কাসীরের বক্তব্যটুকু উদ্ধৃত করছি, যা তিনি শায়খ মুহাম্মদ ইব্ন জাফর ইব্ন ফিরআউনের জীবনী বর্ণনা প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, প্রায় চল্লিশ বছর পর্যন্ত শায়খ মুহম্মদ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। আমি তার নিকট একাধিক বিষয়ে পড়াশুনা করেছি। ছোট ছোট ছেলেদেরকে তিনি কঠিন কঠিন বর্ণগুলো শিক্ষা দিতেন। যেমন রা” ইত্যাদি। তার কোন সঞ্চয় ছিল না। ছিল না কোন বাসগৃহ বা ধনসম্পদ। খাবারের দােকান থেকে কিনে খেতেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়েই রাত্রি যাপন করতেন।(৩৭)
শিক্ষকদের দুরবস্থার কথাটা আরও পরিষ্কার হয় যখন আমরা অবগত হই যে, সেযুগে মাদ্রাসার একজন ছাত্রের মাসিক বৃত্তি ছিল ১০ দিরহাম। উচ্চতর শ্রেণীর ছাত্রদের বৃত্তি ছিল ২০ দিরহাম এবং একজন শিক্ষকের বেতন ছিল ৮০ দিরহাম।(৩৮) এটি সে সময়ে যখন একটি ছাগল-ভেড়ার বাচ্চার দাম ছিল ২৫০ দিরহাম।(৩৯) অন্য কথায়, এর মূল্য ছিল একজন শিক্ষকের মাসিক বেতনের তিনগুণ। সম্ভবত এটিই ছিল অধঃপতনের যুগে শিক্ষার মন্দা বাজার-কথিত সোনালি বাণীর বাস্তব উদাহরণ।
১. যুগের বৈশিষ্ট্যাবলী
(১) এ যুগের শিক্ষা সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন
জ্ঞান-বিজ্ঞানের কেন্দ্ৰসমূহ : শিক্ষা কেন্দ্ৰসমূহ বাগদাদ, বসরা, কৃফা ও মদীনা থেকে দামেশক, কায়রো, কুদৃস, আলেকজান্দ্ৰিয়া, হামাত, হালাব, আলেপ্পো, হিমস, উসুয়ুত ও ফায়ুম নগরীসমূহে স্থানান্তরিত হয়। ফলে জ্ঞানার্জনকারীদের উপাধির বহর বেড়ে যায়। যথা—দিমাশাকী, হালাবী, কাহেরী, ফায়ুমী, ইস্কান্দরী, মাকদেসী, হামাবী, সুয়ুতী ও হিমসী ইত্যাদি। এই যুগে কায়রো সেই ভূমিকা পালন করছে, যা ইতিপূর্বে বাগদাদ পালন করতো। ফলে আলিম-উলামা ও কবি-সাহিত্যিকগণ কায়রোতে ভিড় জমান।
(২) সাহিত্য ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষকতা
জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা থেকে শাসকবর্গের মনোযোগ প্রত্যাহৃত হল। লেখককে তার গ্রন্থের ওজন পরিমাণ স্বর্ণ দিয়ে পুরস্কৃত করার সেই যুগটি গত হয়ে যায়। খুব অল্প সংখ্যক সুলতান, আমীর, উষীর ও খলীফাই জ্ঞানার্জনের প্রতি, আলিম লোকদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপনের প্রতি অথবা কবিতা শ্রবণে তৃপ্তিলাভের প্রতি গুরুত্ব দিতেন। তাঁরা আরবী সাহিত্যের স্বাদ কী করে আস্বাদন করবেন—যেখানে আরবী ভাষায় তাদের কোন বুৎপত্তিই ছিল না। অবশ্য তাদের কেউ কেউ ইতিহাস শাস্ত্রের প্রতি অনুরাগী ছিলেন। ফলে তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় কতক ইতিহাস গ্রন্থ ও বিশ্বকোষ রচিত হয়েছিল।
(৩) ইতিহাস ও সমাজ বিজ্ঞানের উৎকর্ষ
ইব্ন খালদুনের ‘মুকাদমা” গ্রন্থটি এ শাস্ত্রের শীর্ষস্থানীয় গ্রন্থ। ইতিহাস দর্শনের গুরুত্ব ইব্ন খালদুন যথার্থরূপে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তিনি বলেন— কোন বিশেষ শাস্ত্রের তত্ত্বানুসন্ধানীর জন্যে তার ঘটনা প্রবাহ লেখাই মুখ্য কাজ নয় বরং তার কাজ হল শাস্ত্রের স্থান ও তার প্রকারভেদ নির্ণয় করা। পরবর্তী লেখকগণ সে অনুসারে ক্রমান্বয়ে ঘটনাবলী ও তথ্যাদি সন্নিবেশিত করবেন, যাতে এক সময় এই শাস্ত্র পূর্ণতা লাভ করতে পারে। তখন অবশ্য রাজনৈতিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও সামরিক জ্ঞান-বিজ্ঞানেরও প্রসার লাভ করে।
(৪) গ্ৰন্থাগার ও ঘরবাড়ি ধ্বংস
বড় বড় গ্রন্থাগারের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছিল। কারণ বাগদাদ লুণ্ঠনের সময় মোগল ও তাতাররা গ্রন্থাগারগুলো পুড়িয়ে দিয়েছিল এবং নদীবক্ষে নিক্ষেপ করেছিল। তদ্রুপ স্পেন অধিকার করার পর সেখানকার অধিবাসীরা সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করেছে। ইসলামী উপদলগুলোর পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতের ফলশ্রুতিতেও বহু মূল্যবান গ্ৰন্থ বিনষ্ট হয়েছিল। যেমন মাহমুদ গযনবী মুতাযিলাদের কিতাবগুলো পুড়িয়ে দিয়েছিলেন। তবে সবচাইতে প্ৰলয়ঙ্করী ধ্বংসযজ্ঞ সাধিত হয়েছিল তাতারদের হাতে। তারা নরহত্যায় মেতে উঠেছিল, ঘরবাড়ি ধ্বংস করেছিল, বইপত্র পুড়িয়ে দিয়েছিল এবং যেগুলো তারা লুট করে নিতে পারেনি, সেগুলো নষ্ট করে দিয়েছিল।
(৫) সঙ্কটকালে মানুষ ধর্মের আশ্রয় খোজে
আরবগণ পশ্চিমাঞ্চলের দিকে ছড়িয়ে পড়ে। স্পেনবাসীরা আন্দালুস পুনঃ অধিকার করে নিল। মোগলরা শহরের পর শহর ধ্বংস করে দিল এবং মোগল, তুকী ও বর্বররা শহরগুলোকে নিজেদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করে নিল। অবশ্য কতক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্য আরব সুলতানদের হাতে রয়ে যায়। যেমন ঘটেছে। ইয়ামানে ও মাগরিবে।* তখন মুক্তির আশায় মানুষ ধর্মের দিকে ঝুকে পড়ে। এ পর্যায়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে পশ্চাৎমুখিতা দেখা দিল এবং কতক লোক বাজে বিষয়াদি ও কিসসা, কাহিনীর প্রতি বুকে পড়ল। যেমন ঘটেছিল মহাকাশ বিজ্ঞান, জ্যোতিষশাস্ত্র ও রসায়ন শাস্ত্রের ক্ষেত্রে।
(৬) শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা
মামলুক সুলতানদের আমলে মিসর ও সিরিয়ায় বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি সে সময়ের কথা যখন মামলুক সুলতানগণ ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে সিরিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত মোগল আধিপত্যের প্রভাবাধীন ছিল।
আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া গ্রন্থের ১৪তম খণ্ডে প্রায় ৮০টির অধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এর প্রধানগুলো ও সিংহভাগই ছিল সিরিয়াতে আর অবশিষ্টগুলো কুদ্দস, হালাব, বাআ’লবাক, হিমস, হামাতু ও কায়রোতে ছিল।
ইব্ন কাসীর (র) কায়রোর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর কথা উল্লেখে তেমন কোন গুরুত্ব দেননি। এ কারণে যে, এ গ্রন্থটি হল ইব্ন আসাকির (র)-এর লিখিত “তারীখে দামেশক’ গ্রন্থের পরিশিষ্ট গ্রন্থ। তদুপরি জীবনের বিভিন্ন শাখায় অধঃপতনের প্রেক্ষিতে অধঃপতিত যুগ হিসেবে চিহ্নিত এ যুগের সাথে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আধিক্যের তথ্যটি সামঞ্জস্যশীল মনে হয় না। তবে মোগলদের ধ্বংসযজ্ঞের মুখে বহু বড় বড় আলিম-উলামা সিরিয়া ও মিসরে পালিয়ে গিয়েছিলেন বলে এতদঞ্চলে শিক্ষা প্ৰতিষ্ঠানের সংখ্যাধিক্যের তথ্যটি সত্য প্রতীয়মান হয়। তদুপরি নূরুদ্দীন জঙ্গীর শাসনামল থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্যে প্রচুর সম্পত্তি ওয়াকফ করার বিষয়টিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাধিক্যের সত্যতার প্রমাণ করে। তৃতীয়ত, এ সময়ে শাফিঈ, হানাকী, হাম্বলী ও মালেকী মাযহাব অনুসারীদের মধ্যে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখা দেয়। এই তিনটি কারণে সে যুগে প্রচুর সংখ্যক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান লক্ষ্য ছিল কুরআন ও হাদীস শিক্ষা দেয়া। চিকিৎসা শাস্ত্ৰ, ভাষাতত্ত্ব ও অন্যান্য শাস্ত্রের প্রতি তখন গুরুত্ব কম ছিল।
(৭) জ্ঞান চর্চা শিক্ষকদেরকে উচ্চ পদের যোগ্য করে তোলে
বহু শিক্ষক, উযীর, নায়েব ইত্যাদি বড় বড় প্রশাসনিক পদের তুলনায় কাযী, মুফতী, খতীব, শায়খ, ইমাম, বায়তুল মালের কার্যনিৰ্বাহী, ভাণ্ডার পরিদর্শক, রাষ্ট্রীয় সংরক্ষণাগার পরিদর্শক, দফতরাদি পরিদর্শক, হিসাবরক্ষক, ইয়াতীমদের পরিদর্শক, গ্রন্থাগার পরিদর্শক, ওয়াকফ স্টেট পরিদর্শক ও কারামুক্তি প্ৰাথী দফতরের পরিচালক পদে অধিকসংখ্যক নিয়োগ
———-
(৩৭) ইব্ন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খঃ ১৪, পৃঃ ১১৮।
(৩৮) প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩৩৬। (৩৯) প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩২৫।
* মরক্কো-তিউনিসিয়া অঞ্চল।