ঠিক এই রকমই একটা ঘটনা ঘটেছিল লালবাহাদুরের সঙ্গে। শাস্ত্রীজি তখন দপ্তরবিহীন মন্ত্রী হলেও দেশের লোক বুঝতে পেরেছেন, ইনিই আগামী প্রধানমন্ত্রী। শাস্ত্রীজি কলকাতা এলেন। সঙ্গে আমিও আছি। বিকেলের দিকে আমার পত্রিকার অফিসে যাবেন ঠিক আছে।
দমদমে প্রায় প্রধানমন্ত্রীর মতই অভ্যর্থনা জানানো হল শাস্ত্রীজিকে। এয়ারপোর্ট থেকে সোজা তুষারকান্তি ঘোষের বারাসতের বাড়িতে মধ্যাহ্ন ভোজ। বহু গণ্যমান্য লোকই নিমন্ত্রিত। তার মধ্যে কয়েকজন অতি উচ্চপদস্থ পুলিশ অফিসারও আছেন।
বুফে লাঞ্চ। খেতে খেতেই ঘুরে ফিরে কথাবার্তা চলছে। আমি আর শাস্ত্রীজি কথা বলছিলাম। এমন সময় কলকাতা পুলিশের এক অতি বিখ্যাত ও কুখ্যাত অফিসার পাশে এসে শাস্ত্রীজিকে বললেন, স্যার, আপনি কী সত্যি সত্যিই–পত্রিকার অফিসে যাবেন?
অল্প কথার মানুষ শাস্ত্রীজি জবাব দিলেন, হাঁ, যাব।
স্যার, আমার মনে হয় ঐসব ছোটখাট আজেবাজে কাগজের অফিসে আপনার মত মানুষের যাবার কী দরকার?
শাস্ত্রীজি আমাকে দেখিয়ে বললেন, একে চেনেন?
হাঁ, ইনি একজন রিপোর্টার।
শাস্ত্রীজি সঙ্গে সঙ্গে বললেন, এ্যাণ্ড এ ফ্রেণ্ড অব মাইন। আমি এরই আমন্ত্রণে যাচ্ছি। তাছাড়া আমি যখন আপনার পরামর্শ চাইব, তখন শুধু আপনি আপনার পরামর্শ দেবেন।
অফিসারটি মুখ চুন করে গণ্যমান্যদের ভীড়ের মধ্যে মিশে গেলেন।
***
আর একটি ঘটনা বলব। দেশরক্ষা মন্ত্রণালয়ে কৃষ্ণ মেননের অধীনে রাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেল রঘুরামাইয়া। এক ছুটির দিনের সকালে মেননের বাড়িতে মেননের সঙ্গে গল্প করছিলাম আমি আর ব্লিৎস-এর বৈদেশিক সম্পাদক রমেশ সঙ্গভি। হঠাৎ রঘুরামাইয়া ঘরে ঢুকেই মেননকে বললেন, স্যার, খুব জরুরী কথা ছিল।
মেনন প্রশ্ন করলেন, জরুরী মানে?
মানে ব্যক্তিগত। রঘুরামাইয়া আমাদের দিকে দেখে বললেন, একটু প্রাইভেটলি….
মেনন এবার প্রশ্ন করলেন, এনিথিং কনসার্নিং গভর্ণমেন্ট?
নো স্যার!
তাহলে এদের সামনেই বল।
আমরা বাইরে যেতে চাইলাম। কিন্তু কৃষ্ণ মেনন কিছুতেই যেতে দিলেন না। শেষে কোন গত্যন্তর না দেখে রঘুরামাইয়া অত্যন্ত দ্বিধা ও সঙ্কোচের সঙ্গে বললেন, স্যার, এবার ইউরোপে গিয়ে হঠাৎ আমার এক বান্ধবীর সঙ্গে দেখা হয়। তারপর আমরা দুজনে একসঙ্গে কয়েক জায়গা ঘুরেছি…।
কৃষ্ণ মেনন হাসতে হাসতে বললেন, তা ঐ বান্ধবীর সঙ্গে কী আমার বিয়ে দিতে চাও?
রঘুরামাইয়ার মুখে হাসি নেই। মুখ নীচু করে তিনি কোন মতে বললেন, স্যার, মেয়েটা বলছে সে আমার স্ত্রী হয়ে আমার বাড়িতেই থাকবে, কিন্তু স্যার আমার তো স্ত্রী আছেন।
কৃষ্ণ মেনন এবার গম্ভীর হয়ে বললেন, শোন রঘুরামাইয়া, পণ্ডিতজী আমাকে ডিফেন্স মিনিস্টার করেছেন ডিফেন্স প্রবলেম সমাধানের জন্য। তুমি তোমার বান্ধবীর দাবী মেনে নেবে কি নেবে না, সে বিষয়ে আমার পক্ষে কিছু বলা সম্ভব নয়। ইফ ইউ প্লীজ, জাস্ট ক্রশ দ্য রোড এ্যাণ্ড মিট পণ্ডিতজী…
রঘুরামাইয়া মাথা নীচু করে দরজার দিকে পা বাড়াতেই মেনন বললেন, আই এ্যাম নট হিয়ার টু সলভ দ্য প্রবলেমস্ অব প্লে-বয়েজ অব ইণ্ডিয়ান পলিটিক্স।
তখন আমার জীবনে অমাবস্যার অন্ধকার। ম্যাট্রিক পাশ করে কলেজের খাতায় নাম লেখাবার সঙ্গে সঙ্গেই সকাল-বিকেল-সন্ধ্যায় তিনটি টিউশানি শুরু। বিনা পারিশ্রমিকে লোকসেবক-এর রিপোর্টার হলাম বছর খানেক পর।
তখন আমার দিন শুরু হয় ভোর পাঁচটায়। সওয়া পাঁচটার মধ্যে ঠনঠনিয়ায় এসে দুনম্বর বাস ধরি। ছটা নাগাদ পৌঁছাই ভবানী পুরের গিরীশ মুখার্জী রোডের গিরীশ ভবনে। আটটা-সওয়া আটটায় বেরিয়ে নটা-সওয়া নটায় ফিরে আসি বাসায়। বাবা চাল-আলু ধুয়ে কয়লার উনুন সাজিয়ে রেখে ভোরবেলায় বেরিয়ে যেতেন। আমি বাসায় এসে উনুন ধরিয়ে ভাত চাপিয়ে দিয়েই স্নান করি। তারপর সিদ্ধ ভাত খেয়েই মাইল দেড়েক দৌড়ে কলেজে যাই।
দুপুরের পর কলেজ থেকে বেরিয়েই সোজা জনক রোড। দিদির বিয়ের ঋণ শোধ করার জন্য মল্লিক মশায়ের ম্যাট্রিক ক্লাশের ছেলেকে পড়াই। সেখান থেকে হাজরা পার্ক বা ওয়েলিংটন স্কোয়ারের জনসভা আর মেট্রোপল হোটেলের প্রেস কনফারেন্স শেষ করেই সীতারাম ঘোষ স্ট্রীটে দুজন ছাত্রকে পড়াতে যাই একখানি টালির ঘরে বিনা ভাড়ায় থাকার জন্য। লোকসেবকে পৌঁছাই রাত আটটা-সাড়ে আটটা নাগাদ। অধিকাংশ দিনই আমি আর অজিতদা (বসু মল্লিক) বারোটা নাগাদ পদব্রজে বাসার দিকে রওনা দিই। বাসায় পৌঁছতে পৌঁছতে মোটামুটি একটা-দেড়টা। এরপর ডিনার এক আনার ছাতু আর দুপয়সার ভেলিগুড়।
বছরখানেক পর লোকসেবক-এর উদার সমাজতন্ত্রী কর্তৃপক্ষ আমাকে মাসিক দশ টাকা মাইনে মঞ্জুর করলেন এবং তাও পাই পাঁচ-সাত কিস্তিতে। চার বছর পর লোকসেবক থেকে রিটায়ার করলাম পঁচিশ টাকায়।
ঢুকলাম এক দেশপ্রেমিকের নিউজ এজেন্সীতে। সেখানকার প্রবীণ রিপোর্টাররা দার্জিলিং গেলে স্কচ হুইস্কী খাবার জন্য দৈনিক পঞ্চাশ টাকা ভাতা পেলেও আমার মত কিছু ছেলেকে বেগার খাঁটিয়ে নিতে খদ্দর-ধারী দেশপ্রেমিক কর্তৃপক্ষ বিন্দুমাত্র দ্বিধা করতেন না। এক বছর পর পঞ্চাশ টাকা ভাতা পেতে শুরু করলেও জনৈক কর্তৃপক্ষের সম্ভাব্য ও ভাবী জামাইদেরই এ প্রতিষ্ঠানে সুযোগ আছে, অন্যদের নয়।
ছাড়লাম নিউজ এজেন্সী। চার বছর ধরে খ্যাত ও অখ্যাত পত্রিকায় রিপোর্টারী করলাম দিনমজুরের মত। প্রকাশিত রিপোর্টের দৈর্ঘ্যের ভিত্তিতে পারিশ্রমিক পাই কোন মাসে পঞ্চাশ, কোন মাসে একশো। উপরি আয়ের জন্য নিউজ এডিটরের বাড়িতে নিত্য হাঁটাহাঁটি করে দশ টাকায় ফিচার বা প্রবন্ধ লিখি।
সেসব দিনের কথা মনে পড়লেও চোখে জল আসে। বছরে এমন দু-একটা রিপোর্ট লিখতাম যা নিয়ে হৈচৈ পড়ে যেত। কর্তৃপক্ষ খুশি হয়ে পঞ্চাশ-একশো টাকা প্রাইজ দিতেন কিন্তু আমি স্থায়ী কর্মচারী না বলে অন্য রিপোর্টারের নামে টাকাটা দেওয়া হত। পুরো টাকাটা আমি পেতাম না। চীফ রিপোর্টার মদ্যপানের জন্য অর্ধেক টাকা রেখে বাকি অর্ধেক আমাকে দিতেন। বিধাতা পুরুষের এমনই বিচার যে অর্থের অভাবে আমি অনেক সময় আমার সন্তানকে বার্লি পর্যন্ত দিতে পারতাম না। কিন্তু আমারই পরিশ্রমের পয়সায় আরেকজন সাংবাদিক নির্বিবাদে মদ্যপান করতেন।
কলকাতার দশ বছরের সাংবাদিক জীবনে কত অপমান, কত অবিচার সহ্য করেছি, তা লিখলে মহাভারত হয়ে যাবে। সে ইতিহাস আর লিখতে চাই না। আজ মনে হয়, এই অপমান, অবিচার, অত্যাচারের জন্যই আমার মনের মধ্যে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠেছিল এবং সর্বনাশের মুখোমুখি হয়েও অদৃষ্টের সঙ্গে জীবন-মরণ লড়াইয়ের জন্য মাত্র একশো টাকা মাইনের প্রতিশ্রুতিকে অবলম্বন করে আমি একদিন দিল্লী রওনা হলাম।
প্রথম আশ্রয় স্টেশন, তারপর বিড়লা ধর্মশালা। দু-তিন দিন পর ঐ বিড়লা ধর্মশালার পাবলিক টেলিফোন থেকে দুআনা দিয়ে টেলিফোন করলাম প্রধানমন্ত্রীর সরকারী বাসভবন তিনমুর্তি ভবনে। মনে মনে জানতাম, প্রধানমন্ত্রী নেহরুর সঙ্গে আমার দেখা করা আদৌ সম্ভব নয়। তাই বললাম, শ্ৰীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করতে চাই।
আপনি কাল নটার পর ফোন করবেন।
পরের দিন সকালে আবার বিড়লা ধর্মশালার কয়েনবক্স থেকে দুআনা দিয়ে টেলিফোন করলাম তিনমূর্তি ভবনে।
আপনি কাল সকাল সাড়ে নটায় আসুন।
অখ্যাত হিন্দী দৈনিকের একশো টাকার বিশেষ সংবাদদাতাকে শ্ৰীমতী গান্ধী এত সমাদর করবেন, তা ভাবতে পারিনি। মুগ্ধ হয়ে গেলাম ওঁর ব্যবহারে। চলে আসার আগে বললাম, আমাদের ইংরেজি সাপ্তাহিকের জন্য ইন্টারভিউ চাই।
একটু হেসে শ্ৰীমতী গান্ধী বললেন, দু-তিন দিন পর এসো।
দু-তিন দিন পর আবার তিনমূর্তি ভবনে গেলাম। ঘণ্টাখানেক ধরে ওঁর সঙ্গে কথা বললাম। চলে আসার আগে বললাম, আরেকদিন এসে আপনার কয়েকটা ছবি তুলতে চাই।
আবার সেই স্নিগ্ধ হাসি হেসে শ্ৰীমতী গান্ধী বললেন, ঠিক আছে, একদিন টেলিফোন করে চলে এসো।
কয়েক দিন পর আমাদের ফটোগ্রাফার সুদর্শনকে নিয়ে গেলাম তিনমূর্তি ভবনে। ঘরে-বাইরে নানাভাবে অনেকগুলি ছবি তোলা হল। অনেকগুলি ছবির সঙ্গে ইন্টারভিউ ছাপা হল পরের সপ্তাহেই।
একদিন সকালে তিনমূর্তি ভবনে গিয়ে দুকপি কাগজও দিয়ে এলাম। সেদিন শ্রীমতী গান্ধী নিজেই বললেন, আবার এসো।
বিনা কাজে তিনমূর্তি ভবনে যেতে সাহস হয় না। মাস তিনেক পর আবার একদিন সকালে তিনমূর্তি ভবনে হাজির হলাম। একতলার ড্রইংরুমের বাঁ দিকের সোফায় বসে শ্ৰীমতী গান্ধীর সঙ্গে কথা বলছিলাম। এমন সময় হঠাৎ দেখি, সিঁড়ি দিয়ে নেহরু সিগারেট টানতে টানতে নামছেন। উঠে দাঁড়ালাম। নেহরু ইন্দিরার কাছে এগিয়ে আমাকে দেখিয়ে প্রশ্ন করলেন, হু ইজ দিস বয়, ইন্দু।
শ্ৰীমতী গান্ধী বললেন, এ জার্নালিস্ট ফ্রম ক্যালকাটা।
তারপর নেহরু আমার কাঁধে হাত দিয়ে অফিস ঘরের দিকে যেতে যেতে প্রশ্ন করলেন, কী নাম তোমার?
তখন কায়দা করে ভট্টাচারিয়া বলা শিখিনি। তাই বিশুদ্ধ বাংলার উচ্চারণ করে বললাম, নিমাই ভট্টাচার্য।
অফিস ঘরে ঢুকেই জিজ্ঞেস করলেন, কোন্ কাগজে কাজ কর?
আমি আমার অখ্যাত হিন্দী দৈনিকের নাম করলাম।
মুখ বিকৃত করে বললেন, হুইচ পেপার?
আমি আবার সেই অখ্যাত হিন্দী দৈনিকের নাম বললাম।
স্পষ্ট বুঝলাম, উনি জীবনেও সে পত্রিকার নাম শোনেননি। তাই–কুঞ্চিত করে প্রশ্ন করলেন, ডু দে পে?
হ্যাঁ, স্যার, আমি একশো টাকা মাইনে পাই।
আমার উত্তর শুনে নেহরু দপ করে জ্বলে উঠলেন, হাউ মাচ?
স্যার, একশো টাকা!
রাগে লাল হয়ে নেহরু আপন মনে বললেন, ননসেন্স! কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থাকার পর উনি হঠাৎ প্রশ্ন করলেন, তুমি কী ব্যাচেলার?
না স্যার।
তুমি বিবাহিত?
হ্যাঁ স্যার।
ছেলেপুলে হয়েছে?
হ্যাঁ স্যার।
আমার কথা শুনে আরো রেগে গেলেন, তুমি বিবাহিত, তোমার ছেলেমেয়ে আছে আর তুমি তোমার কাগজ থেকে মাত্র একশো টাকা মাইনে পাও?
হ্যাঁ স্যার।
কফি খাবে?
হ্যাঁ খাব।
বেল বাজিয়ে অর্ডালীকে ডেকে হুকুম করলেন, কফি আনো।
অর্ডালী বেরিয়ে যেতে উনি একবার আমার দিকে তাকালেন। আমার চোখ-মুখের চেহারা দেখেই বুঝলেন, আমি পেটভরে খেতে পাই না। সত্যি, তখন আমি পেটভরে খাবার মত রোজগার করি না। একশো টাকা মাইনের আশী টাকা কলকাতা পাঠাই। তখন জনপথের অন্নপূর্ণা ক্যাফেটেরিয়ায় আট আনায় জনতা লাঞ্চ পাওয়া যেত। আমি বেয়ারদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে বেলা তিনটে-সাড়ে তিনটের সময় সেই লাঞ্চ খাই। এতে খরচ হয় পনেরো টাকা। হাতে থাকে পাঁচ টাকা। তার থেকে খাম কিনে অফিসে খবর পাঠাই একদিন অন্তর। বাড়িতেও চিঠিপত্র লিখি। এ সব খরচ করে হাতে থাকে এক টাকা-দেড় টাকা। সে পয়সা দিয়ে রোজ সকালে এক কাপ চা পর্যন্ত হত না। সকালে জলখাবার বা রাত্রে কিছু খাওয়া তো স্বপ্নাতীত ছিল। সুতরাং আমার চেহারা দেখেই নেহরুর বুঝতে কষ্ট হল না, আমি ক্ষুধার্ত। উনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, স্যাণ্ডউইচ খাবে?
আমি বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে বললাম, হ্যাঁ খাব। তাছাড়া দ্বিধা করব কেন? মনে মনে ভাবলাম, ষাট কোটি মানুষের যিনি ভাগ্যবিধাতা, তাঁর কাছে মিথ্যা কথা বলব কেন?
নেহরু সঙ্গে সঙ্গে আবার বেল বাজালেন। অর্ডারলী আসতেই বললেন, কফির সঙ্গে স্যাণ্ডউইচ কাজু-টাজুও এনো।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই স্যাণ্ডউইচ, কাজু, পেস্ট্রি আর কফি এলো। আমি ক্ষিদের জ্বালায় এক নিশ্বাসে সবকিছু খেয়ে নিলাম।
নেহরু উঠে দাঁড়ালেন। আবার আমার কাঁধে হাত দিয়ে বাইরে এলেন। হাঁটতে হাঁটতে বললেন, সময় পেলেই চলে এসো।
হাজার হোক বহুকাল পরে সকালে পেটে কিছু পড়েছে। তাই হাসতে হাসতে বললাম, আমার মত সাধারণ মানুষের পক্ষে কী যখন তখন আপনার কাছে আসা সম্ভব। আমাকে তো ঢুকতেই দেবে না।
নেহরু কোন কথা না বলে আমাকে নিয়ে রিসেপশনে গিয়ে সামনের একজন অফিসারকে বললেন, এই ছেলেটিকে আসতে যেন কেউ বাধা না দেয়। আর হ্যাঁ, এ এলে চা-কফি-টফি খেতে দিও। বলে নেহরু হাসি মুখে আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অফিস ঘরে দিকে চলে গেলেন। তখন আমার মুখেও হাসি।
নেহরু ভিতরে চলে যেতেই অফিসারটি আমার নামধাম নিয়ে বললেন, যখন ইচ্ছে আসবেন। আপনার কোন অসুবিধে হবে না।
একশো টাকা মাইনের সংবাদদাতা হলেও সেদিন আমি হঠাৎ জয় করার আনন্দ নিয়ে তিনমুর্তি ভবন থেকে বেরিয়ে এলাম।
এরপর থেকে আমি মাঝে মাঝেই সকাল বা বিকেলের দিকে তিনমূর্তি ভবনে যাই। কোন দিন নেহরুর সঙ্গে দেখা হয়, কোন দিন হয় না, কিন্তু তিনমূর্তি ভবনে গিয়ে যেটা নিয়মিত উপভোগ করি তা হচ্ছে মৌজ করে চা-কফি স্যাণ্ডউইচ-কাজু খাওয়া। কিছুদিন যাতায়াত করার পর সিগারেটও পেতাম। তারপর একদিন নেহরু হঠাৎ কালীবাবুকে সামনে দেখে আমাকে দেখিয়ে বললেন, লুক আফটার দিস নটি বেঙ্গলী জার্নালিস্ট!
চুড়িদার-শেরওয়ানী পরা এই বেঁটে-খাটো মানুষটিকে তিনমূর্তি ভবনের মধ্যে ঘোরাঘুরি করতে দেখতাম কিন্তু জানতাম না উনি বাঙালী। আর জানতাম না তিনমূর্তি ভবনের স্থায়ী বাসিন্দা ও সমস্ত অতিধি অভ্যাগতদের খাওয়া-দাওয়ার দায়িত্ব ওর। কালীবাবুর সঙ্গে ভাব হবার পর আমাকে দেখে কে! ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত হয়ে তিনমূর্তি ভবনে পৌঁছেই কালীবাবুকে স্মরণ করি। আমি কিছু বলার আগেই কালীবাবু বলেন, আজ আপনাকে চিকেন রোস্ট খাওয়াব। কোন দিন আবার আসার আগে আমার পকেটে কিছু সিগারেট দিয়ে দেন।
কয়েকটা মাস বেশ কেটে গেল। ইতিমধ্যে আমার পত্রিকার বেনিয়া মালিক আমার কাজে খুশি হয়ে তিরিশ টাকা মাইনে বাড়িয়ে দিলেন। খুশি না হবার কারণ ছিল না। একশো টাকা মাইনের বিনিময়ে আমি নিয়মিত শুধু এক্সকুসিভ খবরই দিতাম না, দিল্লীর নিদারুণ শীত-গ্রীষ্মের মধ্যেও পায়ে হেঁটে হেঁটে একশো কপি ইংরেজি সাপ্তাহিক ভিআইপিদের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিতাম। মাইনে বাড়ার কিছু দিনের মধ্যেই প্রেস কার্ডও পেলাম। টেম্পোরারি কার্ডের দৌলতে পার্লামেন্ট যাতায়াত আগে থেকেই চলছিল। প্রেস কার্ড পাবার পর নানা মন্ত্রণালয়েও যাতায়াত শুরু করলাম।
পার্লামেন্ট হাউস আর সাউথ ব্লকে যাতায়াত শুরু করার পর তিনমূর্তি ভবনে যাতায়াত কমে গেল। কখনও পার্লামেন্ট হাউসে, কখনও সাউথ ব্লকে নেহরুর সঙ্গে দেখা হয়। সব সময়ই উনি হেসে কথা বলেন, আমার খবরাখবর জিজ্ঞেস করেন। আমি অনুপ্রাণিত বোধ করি।
একদিনের ঘটনা মনে পড়ছে। পার্লামেন্ট হাউসের প্রেস গ্যালারী থেকে বেরিয়ে এসে প্রেস রুমের সামনে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি। আরো অনেক সাংবাদিক ওখানে দাঁড়িয়ে জটলা করছিলেন। দু-চারজন অবাঙালী সাংবাদিক ছাড়া কেউই আমার সঙ্গে কথা বলতেন না। নগণ্য পত্রিকার তুচ্ছ সাংবাদিকের সঙ্গে কী খ্যাতনামা পত্রিকার সাংবাদিকরা কথা বলতে পারেন? তখন দিল্লীতে যে দু-একজন বাঙালী সাংবাদিক ছিলেন, তারা কখনও ভুল করেও আমার সঙ্গে কথা বলতেন না।
সেদিন কয়েকটি পার্লামেন্টারী কমিটির ইলেকশন ছিল। মন্ত্রী এম. পি-রা প্রেস রুমের পাশের কমিটি রুমে ভোট দিতে এলে তাদের অনেকেই সাংবাদিকদের সঙ্গে একটু-আধটু কথাবার্তা হাসি-ঠাট্টা করছিলেন। আমার পরিচিত মন্ত্রী এম. পি-রা আমার সঙ্গেও কথা বলছিলেন। সারাদিনই এইভাবে চলেছে। দুটো-আড়াইটের মধ্যে প্রায় সব এম. পি. ভোট দিয়ে চলে গেছেন। বারান্দায় সাংবাদিকদের ভীড়ও কমে এসেছে। এমন সময় হঠাৎ নেহরু ভোট দিতে এলেন।
কমিটি রুমে ভোট দিয়ে নেহরু বেরিয়ে আসতেই এম. পি ও সাংবাদিকরা সসম্ভ্রমে পাশে সরে দাঁড়ালেন। নেহরু ওদের দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন। ওরাও হাসলেন। অনেকে হাত জোড় করে নমস্কার করলেন। তারপর আমি দু-এক পা এগুতেই উনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, এখানে দাঁড়িয়ে কী করছ?
আমি হেসে বললাম, এমনি আঁড়িয়ে আছি।
নেহরু শিফট-এর দিকে না গিয়ে আমার কাঁধে হাত দিয়ে কথা বলতে বলতে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে নিজের ঘরে ঢুকলেন। আমি ওঁর ঘরের দরজা থেকে আবার ওপরে আসতেই সবার আগে বাঙালী সাংবাদিকরা এগিয়ে এসে আমার সঙ্গে প্রথম কথা বললেন। অন্য সাংবাদিকরাও এগিয়ে এলেন। অনেকেই প্রশ্ন করলেন, পণ্ডিতজী তোমাকে চিনলেন কী করে? অনেকে প্রশ্ন করলেন, কী বললেন প্রাইম মিনিস্টার? ওদের সবাইকেই আমি বললাম, উনি আমাকে স্নেহ করেন। তাই আমাকে আমার খবরাখবর জিজ্ঞেস করছিলেন। কথাটা বিশ্বাস করতে কারুরই ইচ্ছা করছিল না কিন্তু চোখের সামনে যা দেখলেন তাকে অবিশ্বাস করাও সম্ভব ছিল না। দিল্লীর সাংবাদিকরা সেদিনই আমাকে প্রথম সহকর্মীর মর্যাদা দিলেন।
ঐ কয়েক মিনিটের জন্য নেহরু আমার কাঁধে হাত রেখে কথা বলার জন্য দিল্লীর রাজনৈতিক শেয়ার মার্কেটে আমার দাম চড়চড় করে বেড়ে গেল। পার্লামেন্টের সেন্টাল হলের আড্ডাখানায় আমি আর উপেক্ষিত না। অনেক এম. পি ও সাংবাদিকরা প্রায় জোর করে কফি খাওয়ান, হাসিঠাট্টা-গল্পগুজব করেন। এখানে ওখানে যাবার সময় অনেক সাংবাদিকই আমাকে তাদের গাড়িতে লিফট দেন। ঐ পরশপাথর নেহরুর ছোঁয়ায় আমার জীবন কেমন বদলে গেল।
.
আমরা ছোটবেলায় গান্ধীজি, পণ্ডিতজী (নেহরু), সুভাষচন্দ্র, প্যাটেল, মৌলানা আজাদ, রাজেন্দ্রপ্রসাদ, সরোজিনী নাইডু, জিন্না, ডাঃ প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ, খান আবদুল গফুর খান ( সীমান্ত গান্ধী) প্রভৃতি নেতার নাম নিত্য শুনতাম। বিয়াল্লিশের আন্দোলনের সময়ই জয়প্রকাশ, লোহিয়া, অচ্যুত পটবর্ধন, আচার্য নরেন্দ্র দেব, অরুণা আসফ আলী প্রভৃতির নাম আগুনের মত ছড়িয়ে পড়ল। অবিভক্ত বাংলায় ফজলুল হক, নাজিমুদ্দীন, সুরেন্দ্র মোহন ঘোষ ছাড়াও স্বমহিমায় শ্যামাপ্রসাদ নেতা ছিলেন। মোটামুটি এদের নামই সত্যি। খবরের কাগজ বেরুত।
খুব ছোটবেলায় যে নেতাদের সান্নিধ্যে আসি তারা হলেন সুভাষচন্দ্র, শ্যামাপ্রসাদ ও ফজলুল হক। তখন আমরা থাকি রিপন স্কুল-কলেজের পাশের গলি অখিল মিস্ত্রী লেনে। বিকেলবেলায় নিত্য খেলাধূলা করতে যাই শ্ৰদ্ধানন্দ পার্কে। হঠাৎ এক একদিন দেখতাম, লরী থেকে মঞ্চ তৈরির সাজসরঞ্জাম নামল। দেখতে দেখতে চোখের সামনে আধঘণ্টার মধ্যে দশ-বিশটা পার্টস জোড়া দিয়ে সুন্দর মঞ্চ তৈরি হল। মঞ্চে ওঠার সুন্দর ঘোরানো সিঁড়ি, মঞ্চের চারপাশে রেলিং। তবে মঞ্চ বড় হত না। একজন বা বড়জোর দুজনের বসার জায়গা হত মঞ্চের উপরে। তখন একজন বা দুজনের বক্তৃতার জন্যই সভা হত। আজকাল বক্তা ও নেতার সংখ্যা অসংখ্য বলে মঞ্চের চেহারাও বদলে গেছে। সুভাষচন্দ্রের প্রায় সব জনসভাই শ্ৰদ্ধানন্দ পার্কে হত। আমরা বাচ্চারা মঞ্চের পাশেই থাকতাম। তারপর হঠাৎ জ্যোতিষ্কের মত হাজির হতেন সুভাষচন্দ্র। পিছন পিছন পিতৃবন্ধুও আমাদের গ্রামের প্রতিবেশী অমূল্যদা সুভাষবাবুর প্রাইভেট সেক্রেটারি। অমূল্যদা ও রিপন কলেজের কয়েকজন সুভাষভক্তের কল্যাণে ঐসব মিটিং-এ আমিই সুভাষবাবুকে মালা পরাতাম। আহা! সে কী গর্বের ও আনন্দের কয়েকটি অবিস্মরণীয় মুহূর্ত!
কেন জানি না, বাবা মাঝে মাঝেই সুভাষচন্দ্রের এলগিন রোডের বাড়িতে যেতেন। আমি তখন এত ছোট যে বাসায় আমাকে একলা রেখে যাওয়া সম্ভব নয় বলে বাবা সব সময়ই আমাকে সঙ্গে নিতেন অমূল্যদার সঙ্গে কথাবার্তা বলার পর বাবা কখনও কখনও সুভাষবাবু সঙ্গেও দেখা করতেন। এই সুযোগে আমিও সুভাষবাবুর একটু আদর খেতাম। এ ছাড়াও বাবা আমাকে কখনও কখনও সারা দিনের জন্য বেলাদির (সুভাষচন্দ্রের প্রিয় ভাইঝি ও বাবার ছাত্র হরিদাস মিত্রের স্ত্রী) কাছে রেখে যেতেন বলে ছোটবেলায় বিস্ময়ভরা দুটি চোখ দিয়ে খুব কাছ থেকেই সুভাষচন্দ্রকে দেখতাম।
বাবার সঙ্গে শ্যামাপ্রসাদের কাছেও গেছি বহুবার। ওঁরই পরামর্শে আমি বৃত্তি পরীক্ষা দিয়ে মাসিক তিনটাকা বৃত্তি পাওয়ায় উনি খুবই খুশি হন এবং আমাকে যথেষ্ট স্নেহ করতেন। খবরের কাগজের রিপোর্টার হওয়ায় উনি খুব খুশি হয়েছিলেন।
এ ছাড়া ছোটবেলায় অন্য যে রাজনীতিবিদের কাছে যাবার সুযোগ পেয়েছি তিনি গরীব বাঙালীর অকৃত্রিম বন্ধু ফজলুল হক। হকসাহেব সুভাষচন্দ্র বা শ্যামাপ্রসাদের মত অত সুপুরুষ ছিলেন না ঠিকই, কিন্তু যেমন দীর্ঘকায় ছিল তাঁর দেহ, তেমনই সীমাহীন ছিল তার ঔদার্য। ফজলুল হক সাহেবকে প্রথম দেখি স্কুলের ঈদ উৎসবে। তখন সেকুলার স্টেটের জন্ম হয়নি বলে আমরা ছোটবেলায় সমান আনন্দে স্কুলের সরস্বতী পূজায় প্রসাদ আর ঈদের মিষ্টি খেতাম। এর পর কোন আবেদন-নিবেদন করার ব্যাপারেই বাবার সঙ্গে হকসাহেবের বাড়ি যাই।
হকসাহেবের কথা আজকের পশ্চিমবঙ্গের মানুষ ভুলে গেছে বলেই দু-একটা কথা না লিখে পারছি না। বাবা অত্যন্ত গোড়া ব্রাহ্মণ ছিলেন। মুসলমান-খৃস্টানদের পছন্দ না করলেও ফজলুল হক সাহেবকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও পছন্দ করতেন। ঐ ছোটবেলাতেই হক সাহেবের প্রতি বাবার এই মনোভাব দেখেই বুঝতাম, মানুষটি কত মহৎ ছিলেন।
পি-টি-আই-এর ভূতপূর্ব ম্যানেজার নৃপেনদার কাছে অনেক নেতা সম্পর্কে অনেক গল্প শুনলেও মনে আছে শুধু একটি। নৃপেনদা তখন রিপোর্টার, হকসাহেব তখন বাংলার প্রধানমন্ত্রী। একদিন সকালে নৃপেনদা হকসাহেবের পার্ক সার্কাসের বাড়ি গেছেন। যথারীতি বহুজনে তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন এবং হকসাহেব নৃপেনদার সামনেই সবার সঙ্গে কথা বলছেন। সব শেষে এলেন সাদা থান পরা এক বিধবা। হকসাহেবের বন্ধুর স্ত্রী। এসেছেন মেয়ের বিয়ের জন্য কিছু সাহায্যের আশায়। হকসাহেবের কাছে কোন টাকা না থাকায় অত্যন্ত বিব্রত বোধ করলেন কিন্তু অসহায় বিধবাকে ফিরিয়ে দিলেন না। কাবুলিওয়ালাকে ডেকে তার কাছ থেকে ধার করে হকসাহেব ঐ বিধবাকে সাহায্য করলেন। শ্যামাপ্রসাদ আর ফজলুল হকের মত আর কেউ এমন ভাবে বাঙালীকে ভালবেসেছেন ও নির্বিচারে বাঙালীকে সাহায্য করেছেন বলে শুনিনি এবং বিশ্বাসও করি না।
তখন দেশে এত বড় বড় নেতা ছিলেন কিন্তু নেহরু আর সুভাষচন্দ্রের মত এমন গ্ল্যামার ও জনপ্রিয়তা আর কারুর ছিল না। দেশ যখন স্বাধীন হল তখন সুভাষচন্দ্র নেতাজী হয়ে কোথায়, তা কেউ জানে না। নেহরু হলেন প্রধানমন্ত্রী। তাইতো রিপোর্টারদের কাছে তিনি অস্বাভাবিক আকর্ষণীয় ও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলেন।
প্রধানমন্ত্রী নেহরু কলকাতায় এলে তার জনসভা বা সাংবাদিক সম্মেলনে কখনই আমার মত তরুণ রিপোর্টারদের যেতে দেওয়া হত না। দমদম এয়ারপোর্টে প্রধানমন্ত্রীর পোঁছানো বা অনুরূপ ছোটখাট অনুষ্ঠানেই নেহরুকে দেখতাম এবং তাতেই নিজেকে ধন্য মনে করতাম। নেহরুকে প্রথম খুব কাছ থেকে কয়েক দিনের জন্য দেখার সুযোগ পেলাম ১৯৫২ সালের নভেম্বরে।
নানা অনুষ্ঠানের জন্য মাঝে মাঝেই কলেজ স্কোয়ারের মহাবোধি সোসাইটিতে যাই। পরিচয় ছিল সেক্রেটারি দেবপ্রিয় বলীসিংহের সঙ্গে। ওর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী জীনরত্নও ভাল ভাবেই চিনতেন। ওদের কাছেই শুনলাম, মহাবোধি সোসাইটির হীরক জয়ন্তী হবে সাঁচীতে এবং ঐ উপলক্ষে বৃটিশ মিউজিয়াম থেকে ভগবান বুদ্ধের দুই পরম প্রিয় শিষ্য সারিপুত্তা ও মোগল্লানের পূতাস্থি ভারতে ফিরে আসছে। শুধু তাই নয়, এই অনুষ্ঠানে উপরাষ্ট্রপতি ডক্টর সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ ও প্রধানমন্ত্রী নেহরু যোগদান করবেন। বড় লোভ হল সাঁচী যাবার– কিন্তু উপায়?
স্থির জানতাম, সাঁচী উৎসব কভার করার জন্য ব্যর্থ সোস্যালিস্ট ও মেরুদণ্ডবিহীন ভূতপূর্ব কংগ্রেসীদের দ্বারা পরিচালিত লোকসেবক থেকে এক পয়সাও পাওয়া যাবে না। তাছাড়া নেহরু ও শ্যামাপ্রসাদ সম্পর্কে ওদের বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। টিউশানির পয়সা কিছু অগ্রিম নেওয়া যায় কিন্তু তা দিয়ে কী সাঁচী যাওয়া যায়?
অসম্ভব।
শ্যামাপ্রসাদ তখন মহাবোধি সোসাইটির সভাপতি। একদিন সকালে চলে গেলাম ওঁর ভবানীপুরের বাড়িতে। প্রণাম করতেই জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছিস?
ভাল।
বাবা কেমন আছেন?
ভাল।
এখনও লোকসেবকেই আছিস?
হ্যাঁ।
কোন খবর-টবরের জন্য এসেছিস?
না।
তাহলে? অন্য কিছু দরকার আছে?
আমি সোজাসুজি বললাম, মহাবোধি সোসাইটির সাঁচী উৎসবে যাবার খুব ইচ্ছে কিন্তু লোকসেবক তো কিছু দেবে না, তাই….
শ্যামাপ্রসাদ বললেন, অর্ধেক ভাড়ায় যাতায়াতের ব্যবস্থা তো হবেই, তাছাড়া এখানে থাকা-খাওয়ার জন্যও কিছু খরচ করতে হবে না। তাহলে হবে তো?
আমি একগাল হেসে বললাম, তাহলে যেতে পারব।
শ্যামাপ্রসাদ তখনই মহাবোধি সোসাইটির সেক্রেটারি দেবপ্রিয় বলীসিংহকে টেলিফোনে আমার বিষয়ে বলে দিলেন।
তখন আমার কী আনন্দ ও উত্তেজনা! ম্যাপ আর রেলের টাইম টেবিল দেখলাম বার বার। ধানবাদ, গয়া, মোগলসরাই, এলাহাবাদ, জব্বলপুর হয়ে ইটারসী যেতে হবে বোম্বে মেলে। সেখান থেকে ভূপাল হয়ে সাঁচী। বাপরে বাপ! সে কী এখানে? ঐ অত দূরে যাব আমি?
তখন বোধ হয় কলকাতা থেকে সাঁচীর ভাড়া ছিল গোটা পঁচিশেক টাকা। তাই এদিক-ওদিক থেকে কুড়িয়েবাড়িয়ে গোটা পঞ্চাশেক টাকা জোগাড় করলাম। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের দেওয়া প্রেস কার্ড তো ছিলই, তাছাড়া লোকসেবক থেকে চিঠিপত্রও নিলাম। এত কম খরচে সাঁচী যাওয়া যাবে শুনে দুজন বন্ধুও জুটে গেল। তাদের একজন প্রেস ফটোগ্রাফার হবার লোভে ক্যামেরা নিয়ে লোকসেবকে আসা যাওয়া করত। সাঁচীর অনুষ্ঠানে প্রেস ফটোগ্রাফার হিসেবে কাজ করার জন্য সেও লোকসেবক থেকে চিঠিপত্র পেয়ে গেল।
এখানে বলা দরকার সুভাষচন্দ্র কংগ্রেস সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশে যেমন চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিলেন, তার চাইতে অনেক বেশী চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয় নেহরু মন্ত্রীসভা থেকে শ্যামাপ্রসাদের পদত্যাগে। নেহরু-লিয়াকত চুক্তির প্রতিবাদে ১৯৫০ সালের এপ্রিলে শ্যামাপ্রসাদ ও ক্ষিতীশ নিয়োগী পদত্যাগ করায় সারা দেশ চমকে গিয়েছিল এবং পদত্যাগের পর ওঁরা দুজনে হাওড়া স্টেশনে যে জন সম্বর্ধনা ওঁরা পান, তার তুলনা হয় না। শ্যামাপ্রসাদ সে বছরই জন সংঘ প্রতিষ্ঠা করেন এবং পার্লামেন্টের ভিতরে ও বাইরে নেহরু নীতির নির্ভীক সমালোচক হিসেবে এক ঐতিহাসিক নজীর সৃষ্টি করেন। ১৯৫০-এর ডিসেম্বরে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল মারা যাবার পর মৌলানা আজাদ বেঁচে থাকলেও ভারতের রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চের অন্যতম নায়ক শ্যামাপ্রসাদই ছিলেন একমাত্র ব্যক্তি, যাকে নেহরু শুধু সমছু না, ভয়ই করতেন। শ্যামাপ্রসাদ তখন কংগ্রেস সরকারের বিভীষিকা। সাম্প্রদায়িকতাবাদীর নিন্দা ও গ্লানি মাথায় করেও শ্যামাপ্রসাদ সারা দেশেই অস্বাভাবিক জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন।
আমি যেদিন সাঁচী রওনা হব, তার আগের দিন বিকেলে পার্ক সার্কাস ময়দানে শ্যামাপ্রসাদের বক্তৃতা দেবার কথা। সরকারের এমন সাহস ছিল না যে ১৪৪ ধারা জারী করে শ্যামাপ্রসাদের সভা বন্ধ করে দেবেন অথচ দুশ্চিন্তার শেষ নেই। রাইটার্স বিল্ডিং, লালবাজার ও কলকাতার রাজনৈতিক মহলে ফিস ফিস করে বলাবলি হচ্ছে, পার্ক সার্কাস ময়দানে শ্যামাপ্রসাদ বক্তৃতা দেবার পর পরই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হাঙ্গামা শুরু হয়ে যাবে। আমার ভয়, শ্যামাপ্রসাদের বক্তৃতার পর পরই যদি দাঙ্গা-হাঙ্গামা শুরু হয়, ফলে যদি উনি সাঁচী যেতে না পারেন, তবে আমার সাঁচী যাওয়া হবে না।
মিটিং শুরু হবার অনেক আগেই পার্ক সার্কাস পৌঁছে আমি অবাক। যেমন অভূতপূর্ব জনসমাগম, সেই রকম পুলিশী ব্যবস্থা। চারদিকে থমথমে ভাব। আতঙ্কিত মন নিয়েই রিপোর্টারদের টেবিলে বসলাম। শ্যামাপ্রসাদ এলেন। অনন্য বাগ্মীতার সঙ্গে বক্তৃতা দিলেন নেহরুর পাকিস্তান নীতি, কাশ্মীর নীতির তীব্র সমালোচনা করে। শান্তিপূর্ণ ভাবেই সভা শেষ হল। শ্যামাপ্রসাদ মঞ্চ থেকে নেমে গাড়িতে ওঠার জন্য গেটের দিকে যাচ্ছেন দেখেই আমিও দৌড়ে গেলাম। শ্যামাপ্রসাদকে ঘিরে বহু মানুষের ভীড়। তার মধ্যে আমিও আছি। গাড়িতে ওঠার আগে উনি পিছন ফিরে তাকালেন। ভাগ্যক্রমে আমার দিকে দৃষ্টি পড়তেই উনি জিজ্ঞেস করলেন, তুই কাল রওনা হচ্ছিস তো?
হ্যাঁ।
আমি দিল্লী হয়ে সাঁচী যাব। ওখানে পৌঁছেই আমার সঙ্গে দেখা করিস।
আমি মাথা নেড়ে বললাম, হ্যাঁ।
তারপর একদিন সত্যি সত্যি বোম্বে মেলে চেপে অনেক ছোট-বড় স্টেশন পার হয়ে ইটারসী পৌঁছলাম। সেখান থেকে ভূপাল হয়ে সাচী। প্রেস ক্যাম্পে পৌঁছেই জানতে পারলাম, কয়েক ঘণ্টা আগেই শ্যামাপ্রসাদ এসে গেছেন। একটু পরেই ওঁর ক্যাম্পে গেলাম। প্রণাম করতেই জিজ্ঞেস করলেন, প্রেস ক্যাম্পে জায়গা পেয়েছিস তো?
হ্যাঁ।
ওখানে অসুবিধে হলে আমার তাঁবুতে চলে আসতে পারিস। এখানে অনেক জায়গা আছে।
না না, ওখানে কোন অসুবিধে হবে না।
গণিতশাস্ত্রের বিখ্যাত অধ্যাপক দেবপ্রসাদ ঘোষ পাশেই বসেছিলেন। উনি বললেন, অফিসে গেলেই খাবারের কূপন দিয়ে দেবে। নিয়ে নিস।
হ্যা নেব।
এবার শ্যামাপ্রসাদ বললেন, কলকাতায় টেলিফোন করতে হলে আমার এখানে চলে আসিস।
হ্যাঁ, আসব।
প্রেসে টেলিগ্রাম না করে শ্যামাপ্রসাদের তাবু থেকেই টেলিফোন করে রোজ লোকসেবকে খবর পাঠাতাম।
পরের দিন সকালে নেহরু আর রাধাকৃষ্ণণ এলেন। শ্যামাপ্রসাদ রাধাকৃষ্ণণকে নিয়ে সাঁচীর ঐতিহাসিক স্তূপ দেখতে যাবার সময় আমাকেও সঙ্গে নিলেন এবং তিনিই রাধাকৃষ্ণণের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন! সৌভাগ্যক্রমে পরবর্তী কালে আমি রাধাকৃষ্ণণের পরম স্নেহভাজন হই এবং তাঁর মৃত্যুর পূর্বে পর্যন্ত আমার সঙ্গে নিয়মিত দেখাশুনা ও যোগাযোগ ছিল।
শ্যামাপ্রসাদ আর রাধাকৃষ্ণণের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে সাঁচীর স্তূপ দেখলাম।
ভগবান বুদ্ধ নিজে সাঁচী না এলেও সম্রাট অশোকের জন্য সাঁচী বৌদ্ধ সভ্যতা ও শিল্পের অনন্য নিদর্শন হয়ে আছে। সাঁচীর স্তূপ নির্মাণের আগেই সম্রাট অশোকের স্ত্রী এর কাছে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের জন্য মঠ তৈরি করেছিলেন এবং সে জন্যই বোধ হয় অশোক এখানে এই স্তূপগুলি নির্মাণ করেন। বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারের জন্য সম্রাট অশোকের পুত্র মহেন্দ্র এখান থেকেই সিংহল যাত্রা করেন।
মোগল সম্রাট আউরঙ্গজেব অনেক সৌধ, অনেক মঠ-মন্দির ধ্বংস করলেও সাঁচীর স্তূপগুলি ধ্বংস করেননি। ভূপাল থেকে মাইল তিরিশেক দূরে হওয়ায় বোধ হয় তাঁর দৃষ্টি পড়েনি। যাই হোক মোগল আমলে ও তার পরবর্তী কালের দীর্ঘ অবহেলায় সাঁচীর এই অনন্য ও ঐতিহাসিক স্তূপগুলো মাটির তলায় হারিয়ে যায়। ১৮১৮তে এগুলির সন্ধান পাওয়া গেলেও এর প্রায় একশো বছর পরে উদ্ধারকার্য শুরু হয়। ইতিমধ্যে বহু বিদেশী প্রত্নতাত্ত্বিক দুহাতে চুরি করেন সাঁচীর অসাধারণ শিল্পকার্যের বহুকিছু। সম্রাট অশোক সারা দেশে প্রায় ৮৪ হাজার স্তূপ নির্মাণ করেন এবং তার মাত্র আটটি এই সাঁচীতে হলেও এগুলি বৌদ্ধ স্থাপত্য ও শিল্পের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত। অনেক কিছু হারিয়ে যাবার পরও আজো যা আছে তা দেখে বিস্মিত হতে হয়। মুগ্ধ হতে হয় তোরণগুলি দেখে। ( দিল্লীতে ইউনেস্কো UNESCO সম্মেলনের জন্য যখন বিজ্ঞান ভবন তৈরি হয় তখন নেহরু ও রাধাকৃষ্ণণের পরামর্শ অনুযায়ী এর প্রধান প্রবেশ-পথ সাঁচীর তোরণের মত করে তৈরি করা হয়।)
মহাবোধি সোসাইটির প্রধান অনুষ্ঠান শেষ হবার কিছু পরে শ্যামাপ্রসাদের তাঁবুতে যেতেই উনি বললেন, কাল আমরা বিদিশা আর উদয়গিরি যাব। তুই যাবি নাকি?
আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই যাব।
প্রায় রামভক্ত হনুমানের মত হাত জোড় করে তাঁবুর এক কোণায় দাঁড়িয়ে ছিলেন ভূপালের মুখ্যমন্ত্রী ডঃ শঙ্কর দয়াল শর্মা। (ইনিই পরবর্তী কালে মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও কংগ্রেস সভাপতি হন। ) ওর দিকে তাকিয়ে শ্যামাপ্রসাদ বললেন, শঙ্করদয়াল, কাল আমার আর নেহরুর সঙ্গে নিমাই-এর যাবারও ব্যবস্থা করে।
ডাঃ শৰ্মা সঙ্গে সঙ্গে ঘাড় কাত করে বললেন, হ্যাঁ স্যার, সব ব্যবস্থা করে দেব।
নেহরু আর শ্যামাপ্রসাদের সঙ্গে বিদিশা ও উদয়গিরি যাব শুনে আমি যেন মনে মনে হাতে স্বর্গের ছোঁয়া পেলাম।
সাঁচীর উৎসবের পর রাধাকৃষ্ণণ দিল্লী ফিরে গেলেন জরুরী কাজে। পরের দিন সকালে নেহরু, শ্যামাপ্রসাদ ও লেডী পেথিক লরেন্সের সঙ্গে অন্যান্য অনেকের মত আমিও উদয়গিরিতে হিন্দু ও জৈনদের কীর্তি দেখলাম, সম্রাট অশোকের অমর সৃষ্টি বিদিশা মহানগরীর ধ্বংসস্তূপের মধ্যেও আজো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে কত কী! ভগবান যীশুর জন্মের নব্বই বছর আগে এই শহরেই তো রাষ্ট্রদূত হেলিওড়োরাস আসেন এবং পরবর্তী কালে হিন্দুধর্ম গ্রহণ করেন।
ভারতবর্ষের ইতিহাসের সেই স্বর্ণযুগের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু ঘুরলাম নেহরু আর শ্যামাপ্রসাদের সঙ্গে। মনে পড়ছে কয়েকটা টুকরো টুকরো ঘটনা–
উদয়গিরির পাহাড়ের সামনে গাড়ি থামল। নেহরু চটপট এগিয়ে গেলেও পিছিয়ে পড়লেন শ্যামাপ্রসাদ। একে ভারী শরীর, তার ওপর হাই ব্লাড প্রেসারের রুগী। মহা বিপদে পড়লেন চীফ কমিশনার ভগবান সহায় ( পরবর্তী কালে কেন্দ্রীয় সরকারের ক্যাবিনেট সেক্রেটারি ও রাজ্যপাল ), মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ শৰ্মা ও অন্যান্য সঙ্গীরা। প্রধানমন্ত্রী নেহরুর পাশে পাশে থাকা উচিত মনে হলেও শ্যামাপ্রসাদকে উপেক্ষা করার সাহস নেই। তাই তারা একবার নেহরুর কাছে গিয়েই আবার দৌড়ে ফিরে আসেন শ্যামাপ্রসাদের পাশে। শ্যামাপ্রসাদ নিজেই উদ্যোগী হয়ে ওদের বললেন, আমার জন্য এত দৌড়াদৌড়ি করছ কেন? যাও যাও, প্রাইম মিনিস্টারকে দেখ।
শ্যামাপ্রসাদ বললেই কী ওরা তাকে ফেলে নেহরুর কাছে যেতে পারে? তাই ভগবান সহায় রইলেন নেহরুর পাশে আর ডাঃ শৰ্মা রইলেন শ্যামাপ্রসাদের কাছে।
পাহাড়ের ওপর ওঠার পর নেহরু পিছন ফিরে দেখলেন, শ্যামাপ্রসাদ বেশ খানিকটা পিছনে রয়েছেন। নেহরু হঠাৎ দৌড়ে গিয়ে শ্যামাপ্রসাদের হাত থেকে ছড়িটা কেড়ে নিয়ে এলেন। তারপর শ্যামাপ্রসাদ পাহাড়ের ওপর আসতেই নেহরু হাসতে হাসতে বললেন, ডক্টর মুখার্জী, ইওর স্টিক এ্যারাইভড়, বাট ইউ ডিডনট!
শ্যামাপ্রসাদ গম্ভীর হয়ে বললেন, আমার ছড়ি সব সময়ই তোমাকে সঠিক পথ দেখিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে তাড়াতাড়ি পৌঁছে দেবে।
নেহরু চুপ।
সাঁচীতে এবং এই উদয়গিরি-বিদিশায় দুটি দিন নেহরু ও শ্যামা প্রসাদকে খুব কাছ থেকে দেখে স্পষ্ট বুঝেছিলাম, নেহরু শ্যামাপ্রসাদকে অত্যন্ত সমীহ করে চলতেন। আর শ্যামাপ্রসাদ? নেহরুকে নিশ্চয়ই অপমান করতেন না কিন্তু অগ্রাহ্য করতেন। চীফ কমিশনার, মুখ্যমন্ত্রী, ভারত সরকারের বড় বড় অফিসাররা শ্যামাপ্রসাদকে বাঘের মত ভয় করতেন।
পরবর্তী কালে নেহরুকে ও নানা দলের বহু বিখ্যাত নেতাদের ঘনিষ্ঠ ভাবে দেখেছি। বিরোধী দলগুলির প্রায় সব বিখ্যাত ও বিশিষ্ট নেতারাই নেহরুকে দেখলে কুঁকড়ে যেতেন। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন শ্যামাপ্রসাদ।
দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের তৈরি গুহা দেখে বেরিয়ে আসতেই নেহরু দেখলেন, একটু দূরে একটা সুন্দর ছোট্ট গ্রাম্য মেয়ে ঘোমটা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নেহরু তাড়াতাড়ি ওর কাছে গিয়ে ঘোমটা সরিয়ে দিয়েই হাসতে হাসতে সঙ্গীদের ইংরেজিতে বললেন, আমি যদি ওর সমবয়সী হতাম তাহলে এখান থেকে আমি নড়তে পারতাম না। নেহরুর কথায় সবাই হো হো করে হেসে উঠলেন।
আবার আমরা গাড়িতে উঠতে যাচ্ছি। আমি নেহরুর পাশে পাশে হাঁটছি। হঠাৎ উনি আমাকে প্রশ্ন করলেন, ভাল করে ইতিহাস পড়েছ?
না, তেমন ভাল করে পড়িনি।
ভাল করে ইতিহাস পড়বে। ইতিহাস না জানলে কী সাংবাদিকতা করা যায়?
পরবর্তী কালে দিল্লী গিয়ে নেহরুর ঘনিষ্ঠ হবার সুযোগ পাবার পর পরই ওঁরই লেখা ডিসকভারি অব ইণ্ডিয়া খুব ভাল করে পড়ে নিই।
.
নেহরু ও আমার মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য থাকলেও তিনমূর্তি ভবনের সেই অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতার পর আমার সব ভয়, দ্বিধা কেটে গেল। তাছাড়া ভয় করব কেন? আমি কী অন্যায় করেছি? সিংহের সঙ্গে খেলা করতে মুষিক কী দ্বিধা করে? শুধু স্নেহ আর আশীর্বাদ ছাড়া তার কাছে আমার কোন প্রত্যাশা ছিল না বলেই আমি প্রাণ খুলে তাঁর কাছে গেছি। তাছাড়া এ সংসারে কিছু কিছু মানুষ থাকেন, যার ভালবাসতে ভালবাসেন। নেহরু এই রকমই একজন অনন্য ব্যক্তি ছিলেন। শুধু মানুষকে না, পশুপক্ষী, গাছপালাকেও তিনি ভালবাসতেন।
মনে পড়ে সকালবেলার দিকে তিনমূর্তি ভবনে গিয়ে কত দিন নেহরুর সঙ্গে পিছন দিকের লনে গেছি। সাউথ ব্লকের অফিসে রওনা হবার আগে নেহরু প্রতিদিন তার গৃহবাসী জীবজন্তুদের আদর করতেন। কত দেশের কত রকমের জীবজন্তু ছিল পিছন দিকের লনে। কেউ হিংস্র, কেউ বিষাক্ত, কেউ চঞ্চল, কেউ লাজুক। তা হোক, নেহরু নির্বিচারে তাদের সঙ্গে খেলা করতেন। শতসহস্র কাজ থাকলেও উনি ওদের আদর করতে ভুলতেন না। কোন কোন জীবজন্তু দেখে আমাদের ভয় বা ঘৃণা হত কিন্তু নেহরুর মনে ভয়ও ছিল না, ঘৃণাও ছিল না। একদিন একটা বাঘের বাচ্চা হঠাৎ কোন কারণে রেগে কামড়াতে যেতেই আমরা পিছিয়ে গেলাম কিন্তু নেহরু এক ইঞ্চি নড়লেন না। নেহরু সঙ্গে সঙ্গে বাঘের গালে এক থাপ্পড় দিয়ে বেশ রাগ করেই বললেন, অসভ্য কোথাকার! নেহরু শাসন করতেই বাঘের বাচ্চা ভয়ে মুখ নীচু করে দাঁড়িয়ে রইল। যে ভালবাসে তার শাসন করারও অধিকার আছে–এ কথা বাঘ-ভাল্লুকও জানে। বকুনি দেবার পরই নেহরু হাসতে হাসতে ওকে আদর করলেন। ওদের দেখাশুনা আদর-ভালবাসার পর্ব শেষ হবার পর নেহরু আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, The world is a funny place! like human beings, they, too. have a role to play here.
যে মানুষের মনে এত ভালবাসা, তাঁকে ভয় করব কেন?
একদিন কথায় কথায় বললাম, সারাদিনই তো কাজকর্ম করেন। তারপর যেটুকু সময় পান, তখন পড়াশুনা করেন। একদিন সন্ধেবেলায় আর কিছু না করে গান শুনুন।
গান?
আমি বললাম, হ্যাঁ, রবীন্দ্রনাথের গান।
কে গাইবেন?
আমার এক বিশিষ্ট শিল্পীবন্ধু।
নিশ্চয়ই শুনব।
সঙ্গে সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধীকে ডেকে বললেন, ইন্দু, ভট্টাচারিয়ার এক বন্ধু খুব নাম করা গায়ক। উনি টেগোর সঙ শোনাবেন। তুমি ব্যবস্থা করো।
ইন্দিরা গান্ধী মাথা নেড়ে বললেন, হ্যাঁ, ঠিক আছে।
শিল্পীবন্ধু কলকাতায় থাকেন। দিন-ক্ষণ ঠিক করে তাকে চিঠি লিখব। তাই কবে পণ্ডিতজীর সময় হবে জানবার জন্য দুতিন দিন পরে তিনমূর্তি ভবনে যেতেই শ্ৰীমতী গান্ধী আমাকে বললেন, বাবা বলেছেন বড় পিসীর ( শ্ৰীমতী বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত) জন্মদিনেই গানের আয়োজন করতে।
আমি চিঠি লিখলাম শিল্পীবন্ধু বিমলভূষণকে। বন্ধুবর সানন্দে পণ্ডিতজীকে গান শোনাবার জন্য দিল্লী আসতে রাজী হলেন। নির্দিষ্ট দিনের আগেই উনি দিল্লী এলেন। তারপর অনুষ্ঠানের ঠিক আগের দিন শ্ৰীমতী গান্ধী আমাকে ডেকে পাঠালেন। তিনমূর্তি ভবনে হাজির হতেই দেখি, সি-পি-ডবলিউডি এবং আর্মি সিগনালস্ এর কয়েকজন পদস্থ অফিসারও হাজির। শ্ৰীমতী গান্ধী আমাদের সবাইকে দোতলার ড্রইংরুমে ডেকে বললেন, এখানেই গানের আসর বসবে। মঞ্চ হবে পশ্চিম দিকে। এবার ওদের সামনেই উনি আমাকে বললেন, কী রকম মঞ্চ চাও, মাইক্রোফোনের ব্যবস্থা কি করতে হবে, সব এদের বুঝিয়ে দিও। সামান্য ঘরোয়া অনুষ্ঠান হলেও সে সম্পর্কে নেহরু ও শ্ৰীমতীর গান্ধীর আগ্রহ ও যত্নের ত্রুটি নেই। শিল্পীকে নিয়ে আসার জন্য কখন কখানা গাড়ি চাই তাও জেনে নিলেন শ্রীমতী গান্ধী।
পরের দিন অনুষ্ঠান শুরু হবার ঘণ্টাখানেক আগে পৌঁছতেই শ্ৰীমতী গান্ধী বললেন, সব কিছু ঠিক আছে কিনা দেখে নাও। আর কিছু করতে হলে লোকজনদের বলে দাও। হাজার হোক নেহরুর বাড়ির অনুষ্ঠান। তদারক করছেন শ্ৰীমতী গান্ধী নিজে। সুতরাং কী ত্রুটি থাকবে সেখানে?
অন্য দিনের চাইতে অনেক আগেই নেহরু অফিস থেকে চলে এলেন। পোশাক বদলে নিয়ে আমাদের কাছে আসতেই শিল্পীবন্ধু বিমলভূষণ, সুবোধা ও দীপ্তির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলাম। শ্ৰীমতী গান্ধী নিজে এসে চা দিয়ে গেলেন। এর একটু পর থেকে সেদিনের সান্ধ্যকালীন অনুষ্ঠানের আমন্ত্রিত অতিথিরা আসতে শুরু করলেন। আস্তে আস্তে ড্রইংরুম পূর্ণ হল। বিমলভূষণ মঞ্চে বসলেন। তবলায় দিল্লীর একটি ছেলে, তানপুরায় দীপ্তি। আমি শিল্পীকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে মঞ্চের পাশেই নেহরু ও শাস্ত্রীর কাছে বসলাম। আমাদের কাছেই বসলেন আমার পরম শুভাকাঙ্খী সুবোধা ( ব্যানার্জী)। সেদিন অতিথিদের মধ্যে ছিলেন পণ্ডিত গোবিবল্লভ পন্থ, পণ্ডিত হৃদয়নাথ কুঞ্জুরু, স্যার তেজবাহাদুর সপ্রুর ছেলে পি. এন. সপ্রু, এম. পি, শ্ৰীমতী বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত, শ্ৰীমতী উমা নেহরু, লেডী রমা রাও, বদরুদ্দীন তায়েবজী, এয়ার মার্শাল সুব্রত ও শ্ৰীমতী সারদাঁ মুখাজী, শ্ৰীমতী নয়নতারা সায়গল এবং নেহরু পরিবারের আরো কিছু ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা।
বিমলভূষণ একের পর এক রবীন্দ্রনাথের গান শোনান। আমি হিন্দী-ইংরেজিতে তার মর্মার্থ বলি নেহরু ও শাস্ত্রীজিকে। শ্ৰীমতী গান্ধী এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করতে করতে মাঝে মাঝে আমাদের কাছে এসে বসছেন। কথা ছিল ঘণ্টাখানেক গান হবে কিন্তু আসর এমন জমে উঠল যে অনায়াসে দুঘণ্টা কেটে গেল। তাও কী শেষ হয়? শ্ৰীমতী বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত শ্ৰীমতী সারদা মুখার্জীকে জোর করে টেনে এনে বসিয়ে দিলেন মঞ্চে। শ্ৰীমতী মুখার্জী আর বিমলভূষণের দ্বৈত সঙ্গীত হল।
অনুষ্ঠান শেষে ভুরিভোজন ও গল্প চলল -আরো ঘণ্টাখানেক। সেদিন কালীবাবু না, শ্ৰীমতী গান্ধী নিজেই আমাদের খাওয়ালেন।
তখনও আমার অন্ধকার কাটেনি। একটু পাতলা হয়েছে মাত্র। আমার হিন্দী পত্রিকার শেঠজী তিরিশ টাকা মাইনে বাড়িয়ে একশো তিরিশ দিচ্ছেন। আর দিয়েছেন একখানা সাইকেল। একশো তিরিশের মধ্যে বাড়ি ভাড়া দিই পঞ্চাশ টাকা। বাকি আশী টাকায় পরিবার প্রতিপালন। অনাহারে না হলেও অর্ধাহারে দিন কাটে। সারা চোখে-মুখে অপুষ্টির ছাপ। জামা-কাপড়ের অবস্থাও তথৈবচ। কোন কারণেই গণ্যমান্য-বরেণ্য সাংবাদিকদের পর্যায় পড়ি না। তা হোক। তবু নেহরু আমাকে দূরে সরিয়ে রাখেন না।
.
বিশ্ববিশ্রুত আমেরিকান সাংবাদিক জন গান্থার নেহরুকে বলতেন An Englishnan in India and Indian abroad. কথাটা বর্ণে বর্ণে সত্য। অভিজাত পরিবারের উচ্চশিক্ষিত ইংরেজদের মত নেহরু অত্যন্ত রুচিশীল ছিলেন। তাঁর সমগ্র জীবনধারণের মধ্যে যে রুচির ছাপ ছিল, তা বিলেত ফেরত গান্ধী, প্যাটেল, সুভাষের মধ্যে দেখা যায়নি। তাছাড়া পাশ্চাত্য জগতের বিশিষ্ট মানুষদের মত বিশ্বসংসারের সব ব্যাপারেই তার আগ্রহ ছিল। ফুল-ফল, পশু-পাখি, অরণ্য-পর্বত সমুদ্র, নাচ-গান, শিল্প-সাহিত্য, খেলাধূলা, হাসি-ঠাট্টা এবং আরো হাজার রকম বিষয়ে নেহরুর আগ্রহ ও ভালবাসা ছিল। বড়লাটের বাসভবন, ভাইসরয় হাউস তৈরি হয় ইংরেজ আমলে। তাই সেখানে সেখানে একটা সুইমিং পুলও আছে। পাশ্চাত্য দেশের মানুষ সাঁতার কাটতে ভালবাসেন। চার্চিল, রুজভেল্ট বা ক্রশ্চেভও রাষ্ট্র পরিচালনার গুরুদায়িত্ব বহন করেও নিয়মিত সাঁতার কেটেছেন। ভাইসরয় হাউস বর্তমানের রাষ্ট্রপতি ভবনের সুইমিং পুলে নেহরু ছাড়া আর কোন ভারতীয় নেতা সাঁতার কাটেননি। ক্ষমতা হস্তান্তরকালীন রাজনৈতিক ঘূর্ণীঝড়ের মধ্যেও নেহরু সময় ছিনিয়ে নিয়ে লেডী মাউন্টব্যাটনের সঙ্গে এখানে সাঁতার কাটতেন। পরেও সাঁতার কেটেছেন কিন্তু কম।
বিশ্ববন্দিত বেহালাবাদক ইহুদি মেনুহীন দিল্লী এলেন নেহরুর আমন্ত্রণে। থাকলেন কোথায়? নেহরুর ব্যক্তিগত অতিথি হয়ে তাঁরই শয়নকক্ষের পূর্ব দিকের ঘরে। এয়ারপোর্টে অভ্যর্থনা করতে পাঠালেন কন্যা ইন্দু-ইন্দিরাকে। শিল্পী দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরীকে দিল্লীতে যিনি সবচাইতে বেশী শ্রদ্ধা করতেন, ভালবাসতেন, তার নাম নেহরু। শুভলক্ষ্মী, রুক্মিণী, আরুণ্ডেল, বিসমিল্লা, রবিশঙ্করের মত যশস্বী শিল্পীদের গুণমুগ্ধ ভক্ত ছিলেন নেহরু। উপেক্ষিত চলচ্চিত্র শিল্পীদের সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে যিনি প্রথম সম্মানিত করেন তিনিই এশিয়ান গেমস্-এর অন্যতম জন্মদাতা নেহরু। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পঙ্গু এশিয়ায় প্রথম এশিয়ান গেমস্ দিল্লীতে হয় তাঁরই আগ্রহে ও উৎসাহে এবং এই উপলক্ষ্যে তিনি তাঁর অবিস্মরণীয় বাণীতে বলেছিলেন –Play the game in the spirit of the game. পরবর্তী কালে বিশ্বখেলাধূলার বহু আসরে এই মন্ত্র বার বার উচ্চারিত হয়েছে ও ভবিষ্যতেও হবে। নেহরু প্রাণ দিয়ে ভালবাসতেন গিরিরাজ হিমালয়কে, ভালবাসতেন গিরিরাজ বিজয়ী তেনজিংকে। তাই তো গড়ে তুললেন হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট। শিল্পী, সাহিত্যিক, বৈজ্ঞানিকদের প্রতি তার শ্রদ্ধা ও আস্থা বিস্ময়কর ছিল। নেহরু ছাড়া অন্য কেউ ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হলে আধুনিক শিল্প বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ভারতের এমন বিস্ময়কর অগ্রগতি হত না, এ কথা মুক্তকণ্ঠে বলা যায়। জটিল আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির মধ্যে বিদেশে গিয়েও ছুটে গিয়েছেন জর্জ বার্নার্ডশ-আইনস্টাইনের কাছে। আর পড়াশুনার ব্যাপারে তো বিশ্বগ্রাসী ক্ষুধা ছিল নেহরুর ইতিহাস আর সাহিত্যই ছিল সব চাইতে প্রিয়। টাইমস্ লিটারারী সাপ্লিমেন্টে ভাল ও প্রিয় লেখকদের বইয়ের বিজ্ঞাপন বেরুবার সঙ্গে সঙ্গেই নেহরু প্রকাশককে বই পাঠাতে বলতেন। বিমান ডাকে বই এসে পৌঁছবার সঙ্গে সঙ্গেই সে সব বই পড়তেন। নেহরুর পরিচিত অনেকেই কলকাতা-দিল্লী-বোষে-মাদ্রাজের বিখ্যাত বইয়ের দোকান থেকে সর্বশেষ বই কিনে উপহার দিতেন। বহু দিন তিনমূতি ভবনে দেখেছি, নেহরু বইগুলি নিয়ে নাড়াচাড়া করে বলছেন, কয়েক মাস আগেই বইগুলি পড়েছি। যদি আপত্তি না থাকে তাহলে বইগুলি কোন লাইব্রেরীতে পাঠিয়ে দেব।
যারা ওঁকে ভাল করে চিনতেন না, তারা সবিনয়ে বলতেন, কিন্তু এই বইগুলি তো মাত্র তিন-চার দিন আগেই ইণ্ডিয়াতে এসে পৌঁছেছে।
নেহেরু বলতেন, আমি আসল প্রকাশকদের কাছ থেকেই বই আনিয়ে পড়ি।
এই প্রসঙ্গে একটা ঘটনা মনে পড়ছে।
একদিন কনট প্লেসে ঘুরতে ঘুরতে নেহরুর A Bunch of old Letters কিনে চিঠিগুলো পড়ি। সারা পৃথিবীর বহু বরেণ্য মানুষের চিঠিগুলি পড়ে বহু অজানা কাহিনী জানতে পারি। আর মনে মনে ভাবি, ভারতবর্ষে এই একজন মানুষই আছেন যিনি রবীন্দ্রনাথ, রোমা রোলা, বার্ণাড শ, মাও সে তুং, হ্যাঁরল্ড ল্যানিক, চু তে, পল রবসন, মুস্তাফা, এল নাহাস, রুজভেল্ট, স্যার চার্লস ট্রেভেলিয়ন প্রভৃতি বরণীয় মানুষের সঙ্গে স্মরণীয় চিঠিপত্রের লেনদেন করেছেন। এ ছাড়া বিশিষ্ট ভারতীয় নেতাদের বহু চিঠিপত্র তো ছিলই।
এই সব চিঠিপত্রের মধ্যে সুভাষচন্দ্রের একটা চিঠি পড়লাম। ১৯৩৬-এ দার্জিলিং জেল থেকে সুভাষচন্দ্র এক চিঠিতে নেহরুর ব্যক্তিগত বিষয় লেখার পর লিখেছেন–তোমার লাইব্রেরীতে নীচের বইগুলো থাকলে তার দুএকখানা পাঠাবে। 1. Historical Geography of Europe By Gordon East. 2. Clash of Cultures and Contact of Races By Pitty Rivers. 3. Short History of our Times By J. A. Spender. 4. World Politics 1918-36 B 6, P. Dutt. 5. Science and he Futuro By J. B. S. Haldane. 6. Africa By Fluxloy. 7. Genghis ( Cheuglis ) Khan By Ralph Fox. 8. The Duty of Empire By Barnes.
সরোজিনী নাইডু, সুভাষচন্দ্র বা জয়প্রকাশ নারায়ণ ভাল কিছু পড়লেই নেহরুকে পড়তে বলতেন। তেমনি নেহরুও ম্যাঞ্চেস্টার গার্ডিয়ান বা টাইমসএ ভাল লেখা পড়লে ওঁদের পড়তে দিতেন।
স্বাধীনতা আন্দোলনের সব নেতাই শুধু উচ্চশিক্ষিত ছিলেন না, তারা নিয়মিত পড়াশুনাও করতেন। তবে নেহরু, সুভাষচন্দ্র, সরোজিনী নাইডু বা জয়প্রকাশ নারায়ণের মত স্বদেশ-বিদেশের বই সমান তালে আর বোধ হয় কেউ পড়তেন না। Banch of old Letters এর চিঠিগুলি পড়ে নেহরুর প্রতি আমার শ্রদ্ধা আরো বেড়ে গেল।
একদিন কথায় কথায় দার্জিলিং জেল থেকে লেখা সুভাষচন্দ্রের চিঠিখানির কথা বলতেই নেহরু বললেন, সুভাষ খুব পড়াশুনা করতেন। তারপর একটু থেমে হেসে বললেন, পড়াশুনার ব্যাপারে কখনও সুভাষ আমার মাস্টার হত, কখনও আমি ওর মাস্টার হতাম।
নেহরুর প্রতি আমার শ্রদ্ধা, ভক্তি, ভালবাসা ও কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। আধুনিক ভারতবর্ষের তিনি অনন্যপুরুষ ছিলেন কিন্তু মাঝে মাঝে যখন ভাবাবেগবজিত সাংবাদিকের দৃষ্টি দিয়ে বিচার করি তখন তাঁকে Hamlet of Indian P. litics মনে হয়। To bu or not to be!
মে-জুন মাস। দিল্লীর বাতাসে তখন আগুনের জ্বালা। গাছপালা-পশুপক্ষী থেকে শুরু করে মানুষের পক্ষেও সে দাহ সহ্য করা অসম্ভব। তবু বহুজনকেই সেই অসহ্য গ্রীষ্মের দাহ সহ্য করে রুজির জন্য পথে-প্রান্তরে হাড়ভাঙা খাটুনি খাটতে হয়।
বেলা আড়াইটে-তিনটে হবে। নেহরু মধ্যাহ্ন ভোজ সমাধা করে আবার অফিসে ফিরছেন। গাড়ি সাউথ ব্লকের দরজায় থামল। নেহরু গাড়ি থেকে নেমেই থমকে দাঁড়ালেন একটু দূরের এক দিন মজুরকে দেখে। হাড় গিলগিলে চেহারা। রোদ্দুরে দরদর করে ঘামছে। পিঠে বিরাট একটা কী যন্ত্র। বেচারা বইতে পারছে না– কিন্তু তবু বইতেই হবে। এই হতভাগ্য দিনমজুরকে দেখে নেহরুর মন কেঁদে উঠল। অসহ্য।
সাউথ ব্লকের মধ্যে না ঢুকে নেহরু ওর দিকে এগিয়ে যেতেই কোথা থেকে দৌড়ে এলেন C P w D-র দু-একজন তদারকী কর্মী। নেহরু অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে ওদের জিজ্ঞেস করলেন, এই লোকটির পিঠে কী?
স্যার, এয়ার-কণ্ডিসনার।
এ্যাঁ! দপ করে জ্বলে উঠলেন নেহরু, ননসেন্স! কার এয়ার কণ্ডিসনার?
C P w D-র তদারকী কর্মীরা জানালেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন অফিসারদের জন্য এইসব এয়ার-কণ্ডিসনার এসেছে।
নেহরু আরো রেগে গেলেন, কী? একটা মানুষ এইভাবে জানোয়ারের মত পরিশ্রম করবে, এই অসহ্য গরমে জ্বলে-পুড়ে মরবে আর একজন ঠাণ্ডা ঘরে বসে দিন কাটাবে?
এ প্রশ্নের জবাব কর্মীরা কী দেবেন? ওরা চুপ করে রইলেন।
নেহরু চুপ করে রইলেন না। রাগে গজগজ করে বললেন, না, এ হতে পারে না।
নেহরুর সারা মুখে বিরক্তি। অসন্তোষ। কিসের বিরুদ্ধে যেন বিদ্রোহের ইঙ্গিত তার চোখে-মুখে। অফিসে গিয়েই পররাষ্ট্র সচিবকে ডেকে পাঠালেন। সোজাসুজি বললেন, সমস্ত এয়ার-কণ্ডিসনার বন্ধ করে দিন। একদল মানুষ এই রোদ্দুরের মধ্যে জানোয়ারের মত খাটবে আর একদল অফিসার ঠাণ্ডা ঘরে বসে দিন কাটাবে, তা চলতে পারে না।
পররাষ্ট্র সচিব সব শুনে বললেন, স্যার, সরকারী সিদ্ধান্ত জয়েন্ট সেক্রেটারি থেকে মন্ত্রী পর্যন্ত সবার ঘরেই এয়ার-কণ্ডিসনার থাকবে।
নেহরু চুপ। হয়তো ক্ষণিকের জন্য খুশি হলেন না কিন্তু সরকারী সিদ্ধান্তটি পরিবর্তনের জন্য কিছুই করলেন না। এই হচ্ছে নেহরু। To be or not to be!
ছোট্ট একটা উদাহরণ দিলাম, কিন্তু বহু ক্ষেত্রেই নেহরুর এই দ্বৈত মনোভাব আমাকে বড় দুঃখ দিত। গুণী-জ্ঞানী বা উপযুক্ত ব্যক্তিকে সম্মান দিতে ওঁর কোন দ্বিধা ছিল না। যার মধ্যে গভীরতা ছিল না, যারা বিশেষ শিক্ষিত বা আদর্শবান ছিলেন না, যারা ক্ষমতার অপব্যবহার করতেন, তাদের উনি পছন্দ করা তো দূরের কথা, শত হাত দূরে রাখতেন। অথচ মজার কথা, এই রকমই একজন মানুষ তিনমূর্তি ভবনে সবচাইতে শক্তিশালী ছিলেন। শুধু তিনমূর্তি ভবনে কেন? অতি সাধারণ একজন ব্যক্তিগত সচিব (Private Secretary) হয়েও তিনি নির্বিকার ভাবে নেহরু মন্ত্রীসভার সদস্যদের সঙ্গে যে ব্যবহার (দুর্ব্যবহার!) করতেন, তা অকল্পনীয়।
এম. ও. মাথাই আসলে একজন স্টেনোগ্রাফার ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দূরপ্রাচ্যে এক মার্কিন সেবা প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন এবং প্রচুর অর্থ উপার্জন করেন। নেহরুর সঙ্গে তার সামান্য পরিচয় ছিল এবং যুদ্ধ শেষে সেই পরিচয়ের সূত্র ধরেই নেহরুর ব্যক্তিগত সচিব হিসেবে কাজ শুরু করেন। একে ব্যাচেলার, তার উপর প্রচুর অর্থ আছে বলে মাথাই নেহরুর কাছ থেকে মাইনে নিতেন না। এরপর ঝড়ের বেগে ভারতবর্ষের ইতিহাস মোড় ঘুরতে শুরু করে। ক্যাবিনেট মিশন, ইন্টিরিম গভর্ণমেন্ট ও সব শেষে স্বাধীনতা লাভ। সব সময় নেহরুর পাশে পাশে মাথাই।
আমি মাথাইয়ের প্রথম ছবি দেখি খবরের কাগজের পাতায়। নেহরু লণ্ডনে জর্জ বার্ণার্ড শ’র সঙ্গে দেখা করতে গেছেন এবং শ’র এক পাশে নেহরু অন্য দিকে মাথাই। ছবিতে মাথাইকে দেখে একটুও ভাল লাগেনি। এরপর দেখি নেহরুর সহযাত্রী হিসেবে কলকাতায়। এক কথায় বিচ্ছিরি দেখতে। কালো, বেঁটে, চোখগুলো গোল গোল, মাথাটা একটু বড়, নাক চ্যাপ্টা। যে বুদ্ধিদীপ্ত ঔজ্জ্বল্য না থাকলে নেহরু কাউকে খুব ঘনিষ্ঠ হতে দিতেন না, তার বিন্দুমাত্র ইঙ্গিতও মাথাইয়ের মধ্যে ছিল না। যাই হোক, দিল্লীতে গিয়ে যখন আবার মাথাইকে দেখি, তখন তার চেহারার অনেক উন্নতি হয়েছে। হবে না কেন? তিনমূর্তি ভবনের সুখ স্বাচ্ছন্দ ও ঐশ্বর্য এবং প্রধানমন্ত্রীর সবচাইতে ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত ব্যক্তি হয়ে ভারতবর্ষের রঙ্গমঞ্চে বারো তেরো বছর উপনায়ক হবার সৌভাগ্য অর্জন করলে সবার মুখ চোখের চেহারাই বদলে যাবে। গদীর রসে যে মানুষের চেহারা বদলে যায়, এ কথা আজকাল সবাই জানেন।
যাই হোক, মাথাই স্টেনোগ্রাফারের বিদ্যা ও কয়েক বছর মার্কিনী সান্নিধ্যে থাকায় যেটুকু সাহেবীয়ানা রপ্ত করেছিলেন, তাই সম্বল করে প্রথমে নেহরুর প্রাইভেট সেক্রেটারি এবং পরে স্পেশ্যাল এ্যাসিস্ট্যান্ট হন। চাকরি হিসেবে এমন কিছু আহামরি না। প্রধানমন্ত্রীর কাজে সাহায্য সাধারণ ভাবে সাহায্য করা ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিবালয়ের তদারকী করাই তার কাজ ছিল–অন্য কিছু নয়। প্রধানমন্ত্রীকে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যাপারে সাহায্য ও পরামর্শ দেবার দায়িত্ব মন্ত্রী ও সেক্রেটারিদের। এ ক্ষেত্রে কোন প্রাইভেট সেক্রেটারি বা স্পেশ্যাল এ্যাসিস্ট্যান্টের কোন ভূমিকা থাকার কথা নয়, কিন্তু আশ্চর্যের কথা, মাথাই প্রায় de jure প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বললেও বোধ হয় অত্যুক্তি হবে না।
মাথাই-এর সঙ্গে প্রথম আলাপের দিনটা মনে পড়ে। তিনমূর্তি ভবনে ঘোরাঘুরি করছিলাম। একজন তরুণ মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে বলতে মাথাই একদিক থেকে অন্য দিকে যাচ্ছিলেন। তরুণ মন্ত্রীটি আমাকে দেখেই হেসে হাত বাড়িয়ে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে মাথাই ঐ তরুণ মন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, ছেলেটি মাঝে মাঝেই এখানে আসে। কী করে? তরুণ মন্ত্রীটি আমাকে মাথাই-এর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে উনি আমাদের দুজনকে নিয়ে নিজের অফিস ঘরে ঢুকলেন। মাথাই আমাকে আমার কাজকর্ম সম্পর্কে দু-চারটে প্রশ্ন করলেন। বোধ হয় আমার উত্তরে খুশি হলেন। তারপর বললেন, মাঝে মাঝে আমার ঘরেও উঁকি দিও! আমি খুশি হয়ে বললাম, অনুমতি যখন পেলাম তখন নিশ্চয়ই আসব।
খোস মেজাজে কথাবার্তা বলতে বলতেই মাথাই চেয়ারটা একটু ঘুরিয়ে টেবিলের এক দিকে দুটো পা তুলে দিলেন। এমন সময় হঠাৎ টি. টি. কৃষ্ণমাচারী ঘরে ঢুকে বললেন, হাউ আর ইউ ম্যাক?
( ঘনিষ্ঠ মহলে মাথাই-এর নাম ছিল ম্যাক। যুদ্ধের সময় আমেরিকান সহকমীদের কৃপায় মাথাই-এর এই নতুন নামকরণ হয়।)
মাথাই গুরুগম্ভীর হয়ে বললেন, আমি সব সময়ই ভাল থাকি।
ক্যান আই টক টু ইউ ফর ফিউ মিনি?
কান্ট ইউ সী আই এ্যাম টকিং টু মাই ফ্রেণ্ডস?
মাথাইয়ের উত্তর শুনে আমরা দুজনে লজ্জা পাই। টি. টি. কৃষ্ণমাচারীর মত অহঙ্কারী কেন্দ্রীয় মন্ত্রী খুব কম দেখেছি কিন্তু তাঁকেও নীরবে এভাবে অপমানিত হতে দেখে বিস্মিত হই। টি. টি. কে, মাথা নীচু করে ঘর থেকে বেরুবার সময় মাথাই ওর কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেবার জন্য বললেন, টি. টি. টেল দেম টু সেণ্ড থ কাপ অব কফি।
ঠিক যেন বড়সাহেব তার অতি সাধারণ অধস্তন কর্মচারীকে হুকুম করছেন!
টি. টি. কে. অপমান ও উপেক্ষা করার জন্যই মাথাই আরো খোস মেজাজে আমাদের সঙ্গে গল্পে মেতে উঠলেন।
মাথাই কেবল নেহরু ছাড়া আর কাউকেই প্রায় গ্রাহ্য করতেন না। ধুতি-পাঞ্জাবি পরা লালবাহাদুর শাস্ত্রীকে তিনি নিছক গেঁয়ো মনে করতেন; আবাব কৃষ্ণমেননের প্রখর কূটনৈতিক বুদ্ধি ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিও তিনি সহ্য করতে পারতেন না। পণ্ডিত গোবিন্দবল্লভ পন্থ শারীরিক কারণে কখনই তিনমূর্তি ভবনে যেতেন না এবং প্রয়োজন হলেই নেহরু নিজেই পন্থজীর ৬নং কিং এডওয়ার্ড রোডের ( কর্তমানে মৌলানা আজাদ রোড ) বাংলোয় যেতেন। তাই তার ওপর মাতব্বরী করার সুযোগ হয়নি মাথাই-এর। আর ব্যতিক্রম ছিলেন মোরারজী দেশাই। সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের চেলা বলে নেহরু কোন কালেই মোরারজীকে খুব কাছে টানেননি, আবার মোরারজীও কখনই নেহরুর ঘনিষ্ঠ হবার জন্য ব্যগ্র ছিলেন না। তাই মোরারজীর ওপর ছড়ি ঘোরাতে পারেননি মাথাই। মনে হয় এই দুজনকে উনি একটু ভয়ও করতেন। বোধ করি এই দুজন ছাড়া আর সব নেতার সঙ্গেই মাথাই অত্যন্ত অসৌজন্যমূলক ব্যবহার করতেন। তখন কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা মন্ত্রী ছিলেন গুলজারীলাল নন্দ। ওঁরই উদ্যোগে জন্ম নেয় ভারত সেবক সমাজ। এই ভারত সেবক সমাজ নিয়ে অনেক কেলেঙ্কারী হলেও নন্দজী কোন কারণেই ব্যক্তিগত ভাবে দায়ী ছিলেন না। পঞ্চ বার্ষিকী পরিকল্পনাগুলির রূপায়ণে বেসরকারী মানুষের সহযোগিতার জন্যই এই প্রতিষ্ঠানের জন্ম। এই ভারত সেবক সমাজ নিয়ে মাথাই নন্দজীকে এমন বিচ্ছিরি বিদ্রূপ করতেন যে তা বলার নয়।
তাছাড়া আরো কত ভাবে তাঁকে উপেক্ষা ও অপমান করতেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের কংগ্রেস নেতাদের মাথাই তৃণজ্ঞান করতেন। শুধু তাই নয়, রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্রপ্রসাদ সম্পর্কে যে ধরণের নোংরা এবং অপমানজনক মন্তব্য সবার সামনে করতেন, তা কোন ভদ্র ও রুচিসম্পন্ন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। মজার কথা, মাথাইয়ের বিরুদ্ধে কেউই নেহরুর কাছে নালিশ করতেন না। বোধ হয় সাহস হত না। কিন্তু কেন এই ভয়? কিসের ভয়? সামান্য একজন স্টেনোগ্রাফারের পক্ষে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের উপেক্ষা ও অপমান করার সাহস কীভাবে হয়? কোন্ বিশেষ গুণ বা কাজের জন্য কী তিনি নেহরুকে এভাবে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছিলেন? কেন এবং কোন্ অধিকারে মাথাই বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত ও ফিরোজ গান্ধীকে নিয়ে ঠাট্টা করতেন? পদ্মজা নাইডুকেই বা তাচ্ছিল্য করার দুঃসাহস হত কেমন করে? মাথাই ভাল ভাবেই জানতেন, পদ্মজাকে নেহরু ভালবাসতেন এবং প্রধানমন্ত্রী হবার পর নেহৰু তাঁকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সরোজিনী নাইডুর অনুরোধেই এই বিয়ে হতে পারেনি। বিয়ে না করলেও পদ্মজার সঙ্গে নেহরুর মধুর সম্পর্ক ছিল। সরোজিনী নাইডুর ভাই হারীন চট্টোপাধ্যায় ও পদ্মজার অন্য বোনের সঙ্গেও নেহরুর অত্যন্ত গভীর হৃদ্যতার সম্পর্ক ছিল। তবে মাথাই-এর এত সাহস হয় কী করে? লেডি মাউন্ট ব্যাটনের অনুপ্রেরণায় কী?
মজার কথা, লর্ড ও লেডি মাউন্টব্যাটন মাথাইকে খুবই পছন্দ ও স্নেহ করতেন। এঁদের মধ্যে গভীর ঘনিষ্ঠতা সত্যি বিস্ময়কর। মাউন্টব্যাটন রাজ-পরিবারের মানুষ ছিলেন। যুদ্ধ বিশারদ ও কূটনীতিবিদ হিসাবে তাঁর খ্যাতি ছিল আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে। বিদ্যা, বুদ্ধি, ভিক্টোরিয়ান আভিজাত্য ছিল তার রক্তের সঙ্গে মিশে। এ হেন মানুষ নেহরুর বন্ধু হতে পারেন, কিন্তু মাথাই-এর মত স্টেনোগ্রাফারকে বিশেষ ভাবে স্নেহ করার কোন স্যায়সঙ্গত যুক্তি থাকতে পারে না। মাউন্টব্যাটন-দম্পতি মাথাইকে নিশ্চয়ই বিশেষ কোন কারণে বা স্বার্থের জন্য ভালবাসতেন বলেই বহু জনের ধারণা। সামান্স একজন স্টেনোগ্রাফারের এই রকম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হবার জন্য নিশ্চয়ই নেহরু দায়ী ছিলেন। লণ্ডনে প্রথম ভারতীয় হাই কমিশনার কৃষ্ণমেননের কিছু কাজকর্ম সম্পর্কে তদন্ত করার জন্য নেহরু কেন মাথাইকে পাঠান? কোন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বা পররাষ্ট্র সচিবকে কী লণ্ডন পাঠালে সম্মানজনক হত না? বা উচিত ছিল না। নেহরুর এই ধরণের কাজকর্মের কোন সন্তোষজনক উত্তর পাওয়া যায় না।
আমি মাথাইকে তার স্বর্ণযুগের একেবারে শেষ অধ্যায়ে দেখি। তিনমূর্তি ভবনে ও সাউথ ব্লকের অফিসে তাঁর হাবভাব চালচলন দেখে মনে হত, উনি প্রধানমন্ত্রী না হলেও নিশ্চয়ই উপ-প্রধানমন্ত্রী। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী থেকে শুরু করে তিনমূর্তি ভবনের নিম্নতম কর্মচারীরা পর্যন্ত তাকে সেই ভাবেই দেখতেন ও তাঁর হুকুম তামিল করতেন, কিন্তু কেন? কোন্ অজানা রহস্যের জন্য নেহরুর প্রত্যক্ষ মেহচ্ছায়ায় মাথাই এই ক্ষমতার অধিকারী হন? রহস্য যে ছিল, সে বিষয়ে বহু জনেই একমত।
উদার মহানুভব মানুষ হিসেবে নেহরুর বিশ্বব্যাপী খ্যাতি থাকলেও তার মধ্যেও আশ্চর্যজনক কিছু দৈন্য দেখে আমি হতবাক হয়েছি। গান্ধীজির নেতৃত্বে যারা সংগ্রাম করে দেশের স্বাধীনতা আনেন, তার অনন্য ছিলেন ডক্টর রাজেন্দ্রপ্রসাদ। রাজেন্দ্রপ্রসাদ নিছক ও বিশুদ্ধ গান্ধীবাদী হিসেবে সর্বজনবিদিত। তিনি ষোল আনা কংগ্রেসীও ছিলেন। তাই তো তাকে গণপরিষদের সভাপতি নির্বাচিত করা হয় এবং তিনিই গণতান্ত্রিক ভারতের প্রথম ও দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি। মজার কথা, সৌজন্যের প্রতীক জহরলাল নেহরু এমন মানুষের মৃত্যুর পরও শ্রদ্ধা জানাতে যাননি! শুধু তাই নয়, রাষ্ট্রপতি সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণকেও রাজেনবাবুর প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাবার জন্য পাটনা যেতে বারণ করেছিলেন, কিন্তু রাধাকৃষ্ণণ প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ উপেক্ষা করেই পাটনা গিয়ে রাজেন্দ্রপ্রসাদের প্রতি তাঁর ব্যক্তিগত ও সমগ্র জাতির পক্ষ থেকে শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেছিলেন। একদিনের জন্য নেপাল সফর পিছিয়ে লালবাহাদুর শাস্ত্রীও রাজেনবাবুর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দিলেন। আর নেহরু? কয়েকটি অনুষ্ঠানে যোগ দেবার জন্য তিনি চলে গেলেন দিল্লীর বাইরে। অমন শ্রদ্ধেয় সহকর্মীর মৃত্যুর পরও কেন নেহরু তাঁর রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কাহিনী ভুলতে পারলেন না। নেহরুর মনে এই দৈন্য কোথায় লুকিয়ে ছিল?
এর একটু নেপথ্য কাহিনী আছে। লর্ড মাউন্টব্যাটন ভারতবর্ষকে দ্বিধাখণ্ডিত করেও স্বাধীন ভারতের প্রথম গভর্ণর জেনারেল হলেন। আমার মতে মাউন্টব্যাটনের দ্বিতীয় অবিস্মরণীয় কীর্তি হচ্ছে কাশ্মীর বিরোধকে রাষ্ট্রসঙ্ঘে পৌঁছে দেওয়া এবং এই সর্বনাশা কাজটি এই ভারতপ্রেমিক ইংরেজ সমর-বিশারদ এমন সময় করেছিলেন যখন আরো কয়েক দিন যুদ্ধ চললেই ভারতীয় সেনাবাহিনী পাকিস্তানী দস্যুদের হাত থেকে সমগ্র কাশ্মীরকে উদ্ধার করতে পারত ও জুনাগড় -হায়দ্রাবাদের মত চিরতরের জন্য কাশ্মীর সমস্যার সমাধান হত। এমন দুটি মহান কাজ করার পর মাউন্টব্যাটন আর বেশি দিন ভারতে থাকার প্রয়োজন বোধ করলেন না এবং হাসতে হাসতেই পালামের মাটি থেকেই বিলেত চলে গেলেন। গভর্ণর জেনারেল হলেন পশ্চিমবঙ্গের প্রথম রাজ্যপাল শ্রীচক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী।
রাজাজীর মত বিদ্বান, বুদ্ধিমান ও তীক্ষ্ণ রসবুদ্ধিসম্পন্ন রাজনীতি বিদ শুধু ভারতে কেন, সারা দুনিয়ায় বিরল। গভর্ণর জেনারেল হবার কয়েক দিনের মধ্যেই তিনি নয়াদিল্লীস্থ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের মন জয় করে নিলেন। রুচিবোধ ও রসজ্ঞান দিয়ে রাজাজী জয় করে নিলেন নেহরুকেও। নানা দেশের রাষ্ট্রদূতদের কাছ থেকে রাজাজী সম্পর্কে ভাল ভাল মন্তব্য শুনে নেহরু মনে করলেন, রাজাজী প্রথম রাষ্ট্রপতি হলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারতের প্রভাব বৃদ্ধি পাবে। কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে নেহরু প্রথম রাষ্ট্রপতি পদের জন্য রাজাজীর নাম প্রস্তাব করলেন। সর্দার প্যাটেল ও অন্যান্যরা তাকে মনে করিয়ে দিলেন বিয়াল্লিশের আন্দোলনের সময় রাজাজী কি ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন এবং সে-কথা মনে রেখেই তারা কখনই রাজাজীকে প্রথম রাষ্ট্রপতি হবার সম্মান দিতে পারেন না। কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির অধিকাংশ সদস্যদের সমর্থনপুষ্ট রাজেন্দ্রপ্রসাদই ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি হলেন এবং নেহরু তাঁর রাজনৈতিক পরাজয়ের প্রথম স্বাদ পেলেন। রাজেনবাবু দ্বিতীয়বারের জন্যও রাষ্ট্রপতি হলেন নেহরুর তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও। এই গ্লানি, এই পরাজয়ের কথা নেহরু কোন দিন ভুলতে পারেননি। আর পারেননি হিন্দু কোড বিলের বিরোধিতা করার জন্য। রাজেন্দ্রপ্রসাদ বলেছিলেন, আইন হোক সমগ্র দেশবাসীর জন্য শুধু হিন্দু বা মুসলমানের জন্য নয়। একাধিক বিবাহ অত্যন্ত নিন্দনীয় ঠিকই, কিন্তু তা সমস্ত ভারতবাসীর জন্য নিষিদ্ধ হোক–শুধু হিন্দুদের জন্য নয়। মুসলমান সমাজে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার ভয়ে নেহরু রাজেনবাবুর পরামর্শ গ্রহণ করেননি। হিন্দু কোড বিল নিয়েই দুজনের মধ্যেও অত্যন্ত তিক্ততার সৃষ্টি হয়, কিন্তু গণতন্ত্রের পূজাবী নেহরু মতবিরোধকে ব্যক্তিগত বিরোধ মনে করে রাজেনবাবুর মৃত্যুর পরও কেন শ্রদ্ধা জানাতে পারেননি?
নেহরুর চরিত্রে এই দৈন্য দেখে বহু নেহরু-অনুগ্রাহী ও ভক্তও হতাশ হয়েছিলেন।