০৩. শান্তিনিকেতনে বেশি দিন থাকা হল না

শান্তিনিকেতনে বেশি দিন থাকা হল না। ফিরতে হল অনেক কাজ অসমাপ্ত রেখে। বেলার অসুখ বেড়েছে।

বেলার কথা ভাবলেই কবির মন বিষণ্ণ হয়ে যায়। শুধু তার অসুখের জন্যই নয়। বেলাকে ক্ষয় রোগে ধরেছে। তাকে বাঁচানো যাবে না, এ রোগের চিকিৎসা নেই। কিন্তু শেষের দিনগুলিতে তার শ্বশুরবাড়ির পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কটা বিষিয়ে গেল!

বেলা, মাধুরীলতা, কবির সবচেয়ে প্রিয় সন্তান। যেমন তার রূপ, তেমনই তার হৃদয়ের সৌন্দর্য। কবি নিজে বেলাকে নতুন নতুন বই পড়িয়েছেন, সাহিত্য রচনা করতে শিখিয়েছেন। কত সাধ করে বেলার বিয়ে দিয়েছেন তার এককালের প্রিয় কবি বিহারীলাল চক্রবর্তীর সুযোগ্য পুত্র শরৎকুমারের সঙ্গে।

ভুল হয়েছিল। খুবই ভুল হয়েছিল। কন্যাদের বিবাহ ব্যাপারে কবি বার বার অবিবেচনার পরিচয় দিয়েছেন। তখন ঝোঁক চেপেছিল, আর একটি কবির পরিবারের সঙ্গে কুটুম্বিতা স্থাপন করবেন। বেলা নিছক গৃহবধূ হবে না, সে পরিবারে সাহিত্যের আবহাওয়ায় তার সৃষ্টি প্রতিভা বিকশিত হবে।

কোথায় সাহিত্যের আবহাওয়া? শরৎকুমার কাব্যকলার ধার ধারে না। বিবাহের প্রস্তাব তোলার পর যখন পাত্রপক্ষ থেকে কুড়ি হাজার টাকা পণ চাওয়া হয়, তখন কবি প্রথম ধাক্কা পেয়েছিলেন। তবু চৈতন্যোদয় হয়নি, ঠাকুর পরিবার পণপ্রথার ঘোর বিরোধী, তবু তিনি প্রকারান্তরে সেই দাবি মেনে নিলেন। বেলার সুখের অলীক কল্পনায় কিছুটা মূল্যবোধ বিসর্জন দিতেও রাজি ছিলেন কবি।

সেই শরৎকুমার এখন শ্বশুরকে গ্রাহ্যই করে না। টেবিলের ওপর পা তুলে দিয়ে সিগারেট ফোঁকে, কবিকে দেখলেও পা নামায় না, কথা বলে না, মুখ ফিরিয়ে থাকে অন্যদিকে।

কোন অভিমানে বেলারও ভাবান্তর হয়েছে কে জানে, সে এখন রথী বা প্রতিমার সঙ্গেও দেখা করতে চায় না। তার অসুখের অবস্থায় কোনও রকম খবরাখবরই দেওয়া হয় না জোড়াসাঁকোর বাড়িতে। কবি তবু নিজে নিয়মিত খবর নেন, নিজে দেখা করতে যান।

পাঁচ বছর আগে সারা এশিয়া মহাদেশ থেকে যিনি প্রথম নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, সারা বিশ্ব থেকে যার আমন্ত্রণ আসে, কত মানুষ যাঁর দেখা পেলে ধন্য হয়, সেই কবিকে তাঁর কন্যার শ্বশুরবাড়ির দরজায় উপস্থিত হলেই সহ্য করতে হয় কত রকম অপমান। তবু কবি তাঁর প্রিয়তমা কন্যার শেষ সময়ে দূরে থাকতে পারেন না, বারবার ছুটে ছুটে আসেন।

কবিকে ঠিক বাধা দেওয়া হয় না। সে বাড়ির কেউ অভ্যর্থনাও জানায় না তাঁকে। সবাই যেন সরে যায় আড়ালে। বৈঠকখানায় শরকুমারকে দেখতে পান, সে উত্তর দেবে না জেনেও কবি মৃদুকণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন, শরৎ ভাল আছ?

সিঁড়ি দিয়ে উঠে যান দোতলায়। মেয়ের নোগশয্যার পাশে গিয়ে বসেন।

রূপ ঝরে গেছে মাধুরীলতার। দু চোখে আলো নেই। এককালের মাখনের মতন মসৃণ ত্বক এখন খড়ি-ওঠা। কার হাড় প্রকট। ঢলঢলে হয়ে গেছে সেমিজ, মুখখানি ছাইবর্ণ।

কবি প্রতিবারই এক গুচ্ছ টাটকা ফুল ও নানা ধরনের আতর নিয়ে আসেন। বিছানার পাশে ফুল নামিয়ে রেখে তিনি জিজ্ঞেস করেন, আজও জ্বর বেশি নাকি রে, বেলি?

বেলা শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।

কিশোরী বয়েসে সে কোনও কথা না বললেও সব সময় তাকে মনে হত বাত্ময়। এখন তার ওষ্ঠাধর শুকনো। যেন সব কথা ফুরিয়ে আসছে।

কবি তবু কথা বলে যান। গল্প শোনান। কবিতা শোনান। বেলা সাড়াশব্দ করে না।

কখনও কবি একটুখানি গান গেয়ে ওঠেন। বলেন, এই গানটা তোর মনে আছে, তুই খুব পছন্দ করতি। আমার কঠিন হৃদয়টারে ফেলে দিলেম পথের ধারে/ তোমার চরণ দেবে তারে মধুর পরশ পাষাণ ঢালা…

বেলার চোখ তখন একটু উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সে অস্ফুট কণ্ঠে বলে, বাবা আর একটু গাও।

কবি খুব নিচু গলায় গাইতে থাকেন : আমার অভিমানের বদলে আজ নেব তোমার মালা/ আজ নিশিশেষে শেষ করে দিই চোখের জলের পালা—

বেলার একটি শীর্ণ হাত তিনি ধরে থাকেন মুঠো করে। বিন্দু বিন্দু জল গড়িয়ে পড়ে তার গাল বেয়ে।

কেউ এক পেয়ালা চা বা এক গেলাস সরবত পাঠায় না কবির জন্য। গান শুনতে শুনতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে বেলা।

কবি মাথা নিচু করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসেন।

দুঃখের বহিঃপ্রকাশে যেন দুঃখের পবিত্রতা নষ্ট হয়ে যায়। কবির সব দুঃখ থাকে তার বুকের মধ্যে চাপা। নির্জনে সেই দুঃখ মুক্তি পায় শব্দ সমাহারে কিংবা সুরে।

 

বেলার বাড়ি থেকে ফিরে আসার পর তিনি আবার শত কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু কারওর সঙ্গেই কন্যার অসুখ বিষয়ে আলোচনা করেন না।

তিলক ও অ্যানি বেসান্তের হোমরুল দাবি কবি সমর্থন করেন, সে কথা প্রকাশ্যে জানাবার জন্য প্রবন্ধও লিখেছেন। কিন্তু তার মতে, ইংরেজদের কাছ থেকে শাসন-অধিকার আদায়ের আগে এ দেশবাসীকেও যে তার যোগ্য হয়ে উঠতে হবে। ভারতীয়রা যে এখনও ধর্মতন্ত্রের কাছে বিবেক বাঁধা রেখেছে। তার থেকে মুক্ত হতে

পারলে সমাজে কিছুতেই ঐক্য আসবে না।

রামমোহন লাইব্রেরিতে তিনি সেই প্রবন্ধটি পাঠ করবেন, কেউ কেউ উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন, ভারত প্রতিরক্ষা আইন চালু আছে। এই সময় সরকার বিরোধী বক্তৃতা দিলে তিনিও অন্যান্য নেতাদের মতন গ্রেফতার হতে পারেন। সে সম্ভাবনা কবিও অস্বীকার করলেন না, কিন্তু এখন জেলখানায় যেতে তার আপত্তি নেই।

আজ আর বাড়ি ফেরা হবে না বলেই তিনি বেরুলেন। যথা সময়ে বক্তৃতাও হল, পুলিশ আশেপাশে ঘোরাঘুরি করলেও ধরল না আঁকে। শুধু তো কবি নন, তিনি একজন নাইট খেতাব পাওয়া ভারতীয়, তার গায়ে হাত ছোঁয়াতে গেলে অনেক ওপরওয়ালার অনুমতি নিতে হয়।

এর মধ্যে চলছে ‘ডাকঘর’ নাটকের অভিনয়ের তোড়জোড়। গগনেন্দ্র, অবনীন্দ্র, সমরেন্দ্র এই তিন ভাইয়ের খুব উৎসাহ। অসিত হালদার আর মুকুল দে নামে দুই তরুণ শিল্পীও খুব খাটাখাটনি করছে। অসিতের খুব দুঃখ, সে কোনও পার্ট পায়নি। রিহার্সাল চলতে চলতেই নাট্যকার তার জন্য বখা পাঁচু নামে একটা চরিত্র জুড়ে দিলেন। আশামুকুল নামে এক বালক চমৎকার অভিনয় করছে অমলের ভূমিকায়।

বিচিত্রায় মূল অভিনয়ের দিনে নাটকের মাঝখানেই হল একটি ছোট্ট নাটক।

আগেই কবি অনুভব করেছিলেন যে ডাকঘর নাটকটিতে গানের অভাব রয়ে গেছে। এক সময় আমি চঞ্চল হে, আমি সুদূরের পিয়াসি—এই পংক্তি দিয়ে শুরু করে লিখেছিলেন একটি কবিতা। এর ভাবের সঙ্গে ‘ডাকঘর’-এর বিষয়বস্তুর মিল আছে। তাই এই কবিতায় সুরারোপ করে ইন্দিরাকে আড়াল থেকে গাইতে বলেছিলেন, ইন্দিরা একা গাইতে রাজি না হয়ে ডাক্তার নীলরতন সরকারের মেয়ে অরুন্ধতী ও আরও কয়েকটি মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে নিল।

পেছনের রাস্তা দিয়ে একজোড়া বোষ্টম-বোষ্টমী গাইতে গাইতে যাবে। হ্যাদে গো নন্দরানী, আমাদের শ্যামকে ছেড়ে দাও।’ এ পর্যন্ত হবার পর বিরতির ড্রপ সিন।

কবি অন্য কোনও ভূমিকা নেননি, শুধু গায়কের ভূমিকা। মাথায় মাত্র একটা গেরুয়া রঙের পাগড়ি পরে বাউল সেজে একবার মাধব দত্তের ঘরের পাশ দিয়ে নাচতে নাচতে গেয়ে গেলেন, গ্রাম ছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ আমার মন ভুলায় রে। আর একবার অন্তরাল থেকেও তার গান, ‘বেলা গেল তোমার পথ চেয়ে। তবু, বিরতির সময় তার মনে হল, বিষয় অনুযায়ী আর একটা গান দরকার।

গ্রিনরুমের একটা টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে দাড়িয়ে তিনি অতি দ্রুত রচনা করতে লাগলেন একটা গান। সময় একেবারে নেই, তিনি লিখছেন ঝড়ের বেগে, সঙ্গে সঙ্গে গুনগুনোচ্ছেন সুর, যেন কোনও দৈবশক্তি ভর করেছে তার ওপর, বাণী ও সুর একসঙ্গে বেরিয়ে আসছে। নন্দলাল বসুকে বললেন, তিনি ইঙ্গিত না দিলে যেন পর্দা না ভোলা হয়, আশামুকুলকে হাতছানি দিয়ে ডেকে বললেন, এই গানটা চটপট তুলে নে, তোকে গাইতে হবে।

ভয়ে আশামুকুলের মুখ শুকিয়ে গেল। একবার মাত্র শুনে পুরোটা গান মুখস্থ করে সঠিক সুরে সে গাইতে পারবে না। সে কাঁচুমাচু হয়ে বলল, গুরুদেব, আমাকে মাপ করুন।

গুরুদেব বললেন, পর্দা তুলে দাও!

তার পর নিজেই আড়াল থেকে গাইলেন, ‘ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে’।

অভিনয়ের শেষে এই সদ্যরচিত গানটির জন্য সবাই ধন্য ধন্য করতে লাগল, শুধু একজন বলল, গুরুদেব গানটি চমৎকার হয়েছে ঠিকই। বাউল গানের সুরটিও ভাল মানিয়েছে। কিন্তু তাড়াহুড়োতে একটা মারাত্মক ভুল করে ফেলেছেন। কী বলুন তো?

কবি তখনও ঠিক বুঝতে পারলেন না।

সেই ব্যক্তিটি আবার বলল, চাবি ভাঙলে কি ঘর খোলা যায়? তবে তো আরও সর্বনাশ। ঘর খুলতে গেলে তালা ভাঙতে হয়!

কবি স্মিত হাস্যে বললেন, ঠিকই ধরেছিস তো!

ঘরের চাবির সঙ্গে নিয়ে যাবি বেশ সাবলীল মিল। ঘরের তালা লিখলে অন্য মিল খুঁজতে হত। বন্দিশালা? যাওয়ার পালা? ঠিক জুতসই হচ্ছে না। কবি আর বদলালেন না। ধরা যাক, এটা আর্যপ্রয়োগ!

কবি অবশ্য আর্ষপ্রয়োগ’ শব্দটা নিজে উচ্চারণ করলেন না। তা হলে তো নিজেকে ঋষি বলে জাহির করতে হয়!

নিপাতনে সিদ্ধও বলা যেতে পারে।

মজার ব্যাপার এই, কবি এর পর অনেকবার লক্ষ করেছেন, অনেকেই এ গানটা শুনে তালা ভাঙা আর চাবি ভাঙার তফাতটা বুঝতে পারেন না।

কিছু কিছু মানুষ সব কিছুই ঠিকঠাক বাস্তবতার সঙ্গে মিলিয়ে নিতে চায, যেন কল্পনা বা দুর্বোধ্যতার স্থান নেই তাদের জীবনে।

কলকাতায় কংগ্রেসের অধিবেশনের পর আবার ডাকঘরের অভিনয় হল বিশিষ্ট অতিথিদের জন্য। দেখতে এলেন গান্ধীজি, তিলক, মদনমোহন মালব্য, অ্যানি বেসান্ত প্রমুখ।

এই সবের মাঝে মাঝে কবির নিজেরও শরীর খারাপ হচ্ছে, আবার বেলাকেও দেখতে যাচ্ছেন।

আমন্ত্রণ এসেছে অস্ট্রেলিয়া থেকে। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দিতে হবে।

গান্ধীজি প্রস্তাব পাঠিয়েছেন, হোমরুল আন্দোলনের জন্য তিনি জনসাধারণের কাছ থেকে যে দান গ্রহণ করেছেন, তার থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা তিনি রবীন্দ্রনাথকে দিতে চান। সেই টাকায় রবীন্দ্রনাথ আমেরিকায় ঘুরে ঘুরে ভারতের আন্দোলনের কথা প্রচার করুন, বিশ্ব জনমত গড়ে তুলুন।

প্রথম আমন্ত্রণ বিষয়ে বিবেচনা করার সময় নিলেও গান্ধীজির প্রস্তাব তিনি প্রত্যাখ্যান করলেন সবিনয়ে। জনসাধারণ দান করেছেন রাজনৈতিক আন্দোলন চালাবার জন্য, সে টাকা গ্রহণ করা কবির পক্ষে সম্ভব নয়। বিদেশে রাজনৈতিক প্রচারকের ভূমিকা নিতেও তিনি অপারগ।

দুপুরবেলা একা একা চলে যান অসুস্থ মেয়ের কাছে। তাকে শোনান ডাকঘর’ অভিনয়ের গল্প। মালব্যজি কেঁদে ফেলেছিলেন, তিলক কবির দু’হাত জড়িয়ে ধরে কপালে চুঁইয়েছিলেন, অ্যানি বেসান্ত উচ্ছসিত, গান্ধীজি মুখে কিছু না বললেও তাঁর পত্রিকায় লিখেছেন দীর্ঘ প্রশংসা।

উঠে আসবার আগে গাইলেন নতুন গান, ‘মাতৃমন্দির পুণ্য-অঙ্গন কর মহোজ্জল আজ হে’। জগদীশচন্দ্র বসু-বিজ্ঞান-মন্দিরের প্রতিষ্ঠা করেছেন, সেই উপলক্ষে লেখা।

হঠাৎ বেলার অবস্থার যথেষ্ট উন্নতি হল। সে উঠে বসে, হাঁটা চলা করে। খাওয়াতে অরুচি অনেকটা কমেছে, মুখের রং-ও যেন কিছুটা ফিরেছে মনে হয়। কবি খানিকটা নিশ্চিন্ত হয়ে আমেরিকায় যাত্রার ব্যবস্থা করতে লাগলেন, গান্ধীজির প্রস্তাব মতো নয়, নিজেরই

উদ্যোগে।

এর মধ্যে সি এফ অ্যান্ড্রুজ এক দুঃসংবাদ নিয়ে এলেন।

অ্যান্ড্রুজ রবীন্দ্রনাথেরও ভক্ত, গান্ধীজিরও ভক্ত। শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ে তিনি পড়াবারও দায়িত্ব নিয়েছিলেন, কিন্তু বেশি সময় পান না, প্রায়ই নানা দিকে ছুটোছুটি করতে হয়। যেখানেই ভারতীয়দের ওপর কোনও অবিচার ও অত্যাচার হচ্ছে, সেখানেই তিনি চলে যান প্রকৃত সত্য যাচাই করতে। এমনকী দক্ষিণ আফ্রিকাতেও যান বারবার।

অ্যান্ড্রুজ কয়েকটি বিদেশি পত্রপত্রিকার কর্তিকা পেয়েছেন, যাতে ছাপা হয়েছে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে এক বিশ্রী, অসত্য, অলীক অপবাদ। দিল্লি থেকে ছুটে এসে অ্যান্ড্রুজ সেগুলি দেখালেন কবিকে।

ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার অভিযোগে কয়েকজন ভারতীয়কে গ্রেফতার করা হয় আমেরিকায়, তাদের নামে মামলা চলে সানফ্রান্সিস্কোতে। সেই মামলার অন্যতম আসামি এক বাঙালি, তাঁর নাম ডঃ চন্দ্রকান্ত চক্রবর্তী। আমেরিকায় বসে ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী দল সংগঠন করার জন্য তিনি নাকি অর্থসাহায্য পেতেন জার্মানি থেকে। ইংরেজদের সঙ্গে এখন জার্মানির ঘোর যুদ্ধ চলছে, তাই জার্মানি ভারতীয় বিপ্লবীদের সহায়তা করতে উৎসাহী, যেমন রুশ সরকারকে বিপর্যস্ত করার জন্য জার্মানি লেনিনকেও সাহায্য করেছে।

উক্ত চন্দ্রকান্ত চক্রবর্তী জানালেন যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগ ছিল, আগেরবার রবীন্দ্রনাথ আমেরিকায় এসে তাঁদের কার্যক্রম সমর্থন করেছেন, বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন এ ব্যাপারে সাহায্য পাবার জন্য। আমেরিকা থেকে তাঁর সুইডেনেও যাবার কথা ছিল, কিন্তু সেখানে গ্রেফতার হতে পারেন এই আশঙ্কায় তাড়াতাড়ি দেশে ফিরতে হয়। বিপ্লবীদের তহবিল থেকে রবীন্দ্রনাথকে দেওয়া হয়েছে বারো হাজার ডলার!

সর্বৈব মিথ্যা যাকে বলে।

শুধু আমেরিকা নয়, জাপানি পত্রপত্রিকাতেও এই অভিযোগের বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে, তার অনেকগুলিতেই বিদ্রুপের সুর। সে সব পড়ে কবি কিছুক্ষণ বসে রইলেন হতবাক হয়ে।

কিন্তু এর প্রতিকার তো করতেই হবে। অ্যান্ড্রুজ তৎপর হয়ে যোগাযোগ করলেন বাংলা সরকার ও ভারত সরকারের সঙ্গে। রবীন্দ্রনাথ এক দীর্ঘ চিঠি পাঠালেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসনকে। চিঠি পৌছতে যদি দেরি হয়, তাই পাঠানো হল একটি টেলিগ্রাম।

সানফ্রান্সিস্কোতে মামলার শুনানির সময় আমেরিকান সরকারের পক্ষের অ্যাটর্নি যখন রবীন্দ্রনাথের নামে অভিযোগ সম্বলিত দলিল আদালতে পেশ করেন, তখন আসামিপক্ষের উঁকিল জিজ্ঞেস করেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও কি তাহলে একজন আসামি? অ্যাটর্নি সাহেব উত্তর দিলেন, না, তা নয় বটে, আমরা তাড়াতাড়িতে ওঁর নামটা জুড়ে দিতে ভুলে গেছি।

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রবীন্দ্রনাথের চিঠি ও তারবার্তা পাবার পর খোঁজখবর শুরু হয়। তখন সেই অ্যাটর্নি সাহেব জানান যে, না, সত্যিই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অভিযুক্ত নন, তিনি আসামিপক্ষের উঁকিলের প্রশ্নের উত্তরটি দিয়েছিলেন রসিকতা করে। কাগজওয়ালারা সেই বাক্যটি তুলে দিয়েছে, তারা রসিকতাও বোঝে না! ভারত সরকারের পক্ষ থেকেও মন্তব্য করা হল যে স্যার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিরুদ্ধে ওই সব

অভিযোগের কোনও প্রমাণ নেই, সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।

এই মামলার সময় জানা গেল আরও রোমহর্ষক ঘটনা, ঘটে গেল সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড।

আমেরিকায় ভারতীয় বিপ্লবীদের মধ্যে কবিকে নিয়ে তীব্র মতভেদ ছিল। একদল মনে করত, কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে তাদের পক্ষে আনা দরকার, তাকে প্রচারের কাজে ব্যবহার করলে সুফল পাওয়া যাবে অনেক।

অন্য দলের মতে, এই কবি বিভিন্ন বক্তৃতায় পূর্ব-পশ্চিমের আদানপ্রদান বিষয়ে যেসব কথা বলছেন, তা ভারতীয় জাতীয়তাবোধের বিরোধী। তিনি ইংরেজদের অপশাসন বিষয়ে কিছু বলেন না।

এই মতভেদ এমনই তীব্র যে দ্বিতীয় দলের কারুর কারুর মনে হল, কবির কথা বলা একেবারে বন্ধ করে দিতে পারলেই কম ক্ষতি হবে। কবি যখন সানফ্রান্সিস্কোর একটি হোটেলে অবস্থান করছিলেন, তখন একজন বিপ্লবী গেল তাঁকে খুন করতে, অন্য দলের একজন ছুটে গেল সেই আততায়ীকে বাধা দিতে। হোটেলের লবিতে দু’জনের তর্ক বেধে গেল, দু’জনকেই সরে যেতে হল।

মামলার সময় সেই প্রসঙ্গ আসার উপক্রম হতেই আসামিপক্ষের একজন ফস করে একটা পিস্তল বার করে গুলি করল তার এক সহযাত্রীকে। সঙ্গে সঙ্গে আদালতের মার্শালও গুলি চালিয়ে শেষ করে দিল দ্বিতীয় জনকে। দুই নিহত বিপ্লবীর নিস্তব্ধ শরীরে গুপ্ত রয়ে গেল প্রকৃত সত্য।

একবার গুজব যখন রটেছে, তা সম্পূর্ণ প্রশমিত হবার আগে আমেরিকায় যাবার আর প্রশ্নই ওঠে না। কবি যাত্রার সব আয়োজন বাতিল করে দিলেন।

এরই মধ্যে আর একটি দুঃসংবাদ এল, জাপান থেকে ভারতে ফেরার পথে কবির আর একজন প্রিয় ইংরেজ বন্ধু পিয়ার্সন গ্রেফতার হয়েছেন পিকিঙে। শান্ত, নির্বিরোধী, মধুর স্বভাবের মানুষ পিয়ার্সন, এখানকার ছাত্রদের ভালবেসে শান্তিনিকেতনকেই করে নিয়েছেন নিজের বাসস্থান। তাঁর মুক্তির জন্যও উদ্যোগ নিতে হল কবিকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *