লালুর স্ত্রী গোলাপির মতামতের কোনও প্রশ্নই নেই, তার স্বামীর এখানে থাকা বা না-থাকার যে কী তফাত, তা যেন তার মাথাতেই ঢোকে না। বেচারি দুর্বল মস্তিষ্ক নিয়ে জন্মেছে, যখনই সে কিছু বুঝতে পারে না, সে অসহায়ভাবে তাকিয়ে থাকে, তারপর তার মুখে ফুটে ওঠে ভয়ের ছাপ।
পদ্মাবতী এ সংবাদ শুনে আঁতকে উঠলেন। অনেকদিন ধরেই তাঁর মনে মনে এরকম একটা আশঙ্কা ছিল। লালুর বাবা মাধব কর যৌবন বয়সেই সাধু-সন্ন্যাসীদের দিকে ঝুঁকেছিলেন। হিন্দু পল্লির শ্মশান স্থানে মাঝে মাঝে ভ্রাম্যমাণ সাধুরা আস্তানা গড়ে সেই সাধুদের কাছে বসে থাকতেন মাধব। সাধুদের অলৌকিক শক্তি সম্পর্কে ছিল তাঁর খুব কৌতূহল। সাধুদের পদসেবা করে উনি সেইরকম কিছু শিখতে চাইতেন। একদিন তিনি উধাও হয়ে গেলেন, কোনও সাধুর সঙ্গ নিয়েছেন বলেই ধরে নেওয়া হল। স্ত্রী পুত্রের কথা চিন্তা করলেন না, সংসারের দায়িত্ব ভুলে গেলেন কীসের টানে? তাঁর মৃত্যু সংবাদ পাওয়া যায় পাঁচ বছর পর। এর মধ্যে আর তিনি ঘরমুখো হননি। এক সাধুর চেলা একটা মাটির সরায় ছাই এনে বলেছিল, সেটাই তাঁর চিতাভষ্ম। সেই কথা বিশ্বাস করে তাঁর শ্রাদ্ধ-শান্তি হয়েছিল।
পদ্মাবতীর চিন্তা ছিল, তাঁর ছেলেও যেন তাঁর স্বামীর ধারা না-পায়। সেই জন্যই তিনি লালুকে কখনও জীবিকা অর্জনের জন্য তাড়না করেননি। সে নিজের মনে থাকতে চায় থাক। ঘর না-ছাড়লেই হল। লালুর অবশ্য এ পর্যন্ত সাধু-সন্ন্যাসীদের প্রতি তেমন কিছু ঝোক দেখা যায়নি।
এবার সে অতদূরে যাবে, যদি না-ফেরে? পদ্মাবতী কান্নাকাটি করলেন, কিন্তু লালু যাবেই। যাত্রার দিন পদ্মাবতী দৌড়োতে দৌড়োতে এলেন ছেলের। সঙ্গে। আছড়ে পড়লেন কবিরাজমশাইয়ের পায়ে। কবিরাজ তাঁর কথায় বিশেষ কান দিলেন না। খানিকটা ধমক দিয়েই বললেন, শোনো বাছা, ছেলের বয়স ঢের হয়েছে। এত বড় ছেলে তার মা-বাপের ইচ্ছাতে চালিত হয় না। নিজের ভালো-মন্দ বুঝে নেয়। বেশি বাধা দিলে তেরিয়া হয়ে যায়। আমার সঙ্গে যাবে, আমার সঙ্গেই ফিরে আসবে, এতে চিন্তার কী কারণ আছে? পথে অসুখ-বিসুখ হলে, আমিই তো আছি। ওষুধপত্তর দেব। তবে ভবিতব্যের কথা কে বলতে পারে? নিজের ঘরে বিছানায় শুয়ে সাপের কামড়েও তো মানুষের মৃত্যু হতে পারে, পারে না?
সম্প্রতি গোঁসাই পাড়ায় এরকম একটি ঘটনা ঘটেছে। প্রতি বছরেই বর্ষার সময় এ অঞ্চলে দু-চারজনের প্রাণ যায় সাপের বিষে। ওলাউঠায় একেকটা পল্লিই সাবাড় হয়ে যায়। এ সবই নিয়তির লিখন।
শুভক্ষণে শুরু হল যাত্রা।
চারদিক ঘেরা পালকিতে বড় গৃহিণী, আর তাঁর দাসী বীণা, গ্রামের আরও তিনজন মাতব্বর পদব্রজে, কবিরাজমশাই ঘোড়ায়, আর পিছনে পিছনে পাহারাদার যদু ও তল্পিবাহক লালু।
কয়েকখানা গ্রাম পার হবার পরই লালুর সব কিছু অন্যরকম লাগে। বাতাসও যেন অন্য স্বাদের। পুকুরের জল বেশি মিষ্টি মনে হয়। আকাশে মেঘের নতুন নতুন ছবি ফোটে।
কয়েক মাস একটানা গ্রীষ্মের পর এখন মাঝে মাঝে দু-এক পশলা বৃষ্টি হয়। পুরোপুরি বর্ষা নামতে আরও কিছুদিন দেরি আছে। দূরে কোথাও যাওয়ার জন্য এটাই সঠিক সময়। রাত্রে অত বেশি গরম লাগে না। শীতকালটাও ভালো ঠিকই, কিন্তু শীতের সময় ঘর কোথাও পেতে হলে লেপ-তোষক বহন করতে হয়। গাছতলায় কিংবা উন্মুক্ত স্থানে শোওয়া যায় না। তাতে শীতল বাতাসে সান্নিপাতিক রোগ হতে পারে।
প্রথম রাত্রিটি এই অভিযাত্রীর দল কাটাল এক গ্রামের চণ্ডীমণ্ডপে। নানান কার্য কারণে কিছু মানুষকে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যাতায়াত করতেই হয়। সরাইখানা কিংবা রাত্রিবাসের ব্যবস্থা বেশ দুর্লভ। কোনও কোনও গৃহস্থ বাড়িতে আশ্রয় চাইলে পাওয়া যেতে পারে। অনেকেই মনে করে অতিথির সেবা পুণ্য কাজ। দল বেঁধে গেলে অবশ্য সে সুযোগ নেওয়া হয় না। যে যার ধর্ম অনুযায়ী মন্দির বা মসজিদের চাতালেও শুয়ে থাকা যায়। চণ্ডীমণ্ডপ বা মাদ্রাসাগুলিও এজন্য উন্মুক্ত।
সঙ্গে আনা হয়েছে চাল, ডাল, আলু ও লবণ। অস্থায়ী উনুনে ফুটিয়ে নেওয়া হয়। ভাত। চারজন পালকিবাহক, যদু ও লালুর জন্য রান্না এক হাঁড়িতে। অন্য হাঁড়িতে কবিরাজ ও তাঁর সঙ্গীদের। লালন মানিকচাঁদকে খেতে দেয় ও দলাইমলাই করে। মানিকচাঁদের হ্রেষার শব্দ শুনেই বোঝা যায় সে বেশ তৃপ্তিতে আছে।
বড় গিন্নি সরাসরি কারুর সঙ্গে কথা বলেন না। তাঁর কোনও প্রয়োজনের কথা তিনি তা জানিয়ে দেন দাসীর মারফত।
রাত্রিকালে কিংবা অন্য কোনও সময় পথে বিশ্রামের জন্য থামা হলেই বীণা নেমে আসে পালকি থেকে। ওই ঘেরটোপের মধ্যে গিন্নিমার সামনে আড়ষ্ট হয়ে বসে থাকতে থাকতে সে নিশ্চিত হাঁফিয়ে ওঠে, তা একটু সুযোগ পেতেই সে খোলা হাওয়ায় নিশ্বাস নিতে চায়। পালকি-বেহারা চতুষ্টয় ও লালুর সঙ্গে সে টুকটাক গল্প করে, সাহায্য করে রান্নায়।
জ্যোৎস্না রাতে গাছতলায় বসে সে লালুকে জিজ্ঞেস করে, তুমি তো গান জাননা, এখন গান করতে ইচ্ছা হয় না?
লালু প্রবলভাবে মাথা নাড়ে।
কখনও বীণার একটু দেরি হলেই গিরিবালার তীক্ষ্ণ কণ্ঠে ডাক শোনা যায়, আরে বীণা, কোথায় গেলি?
অদূরে বসে হুঁকো টানতে টানতে কবিরাজমশাই অমনি সন্ত্রস্ত হয়ে বলে ওঠেন, বীণা, দ্যাখ দ্যাখ, বড় গিনি কী চান!
এই সময় নদীনালায় জল বেশি থাকে না। বর্ষার সময় যেসব মাঠ ও পায়ের চলা পথ ডুবে থাকে, এখন সেগুলি জেগে ওঠে। তবু জলপথ এড়িয়ে স্থলপথে বহরমপুরে যাবার জন্য অনেক ঘুরে ঘুরে যেতে হয়। অন্য দু-একটি গ্রামে কবিরাজমশাইয়ের কিছু আদায়পত্তরের কাজ আছে। তাঁর সঙ্গীরাও এই সুযোগে অন্য গ্রামে আত্মীয়-স্বজনের কুশলসংবাদ নিয়ে যেতে চান, তাই একটু ঘুরপথ হয়।
খোকসা, কুমারিখাল, ছেউড়িয়া, শিলাইদহ পার হবার পর এই যাত্রীর দল এসে পৌঁছোল যশোরে। লালুর এই প্রথম নগর দর্শন। সার সার পাকা বাড়ি, মাটির রাস্তার বদলে ইট-বাঁধানো রাস্তা দেখে সে মোহিত হয়ে যায়। তারপরই সে ভাবে, এ সবই তো মানুষের তৈরি! তবে, শহরের মানুষ আর। গ্রামের মানুষ কি আলাদা?
প্রকৃত আলাদা মানুষও লালু দেখতে পেল। শ্বেতাঙ্গ ও শ্বেতাঙ্গিনী। ঘোড়ায় টানা গাড়িও লালু আগে দেখেনি। সাহেব-মেমদের গায়ের রং মুলোর মতন, কারুর কারুর মাথায় চুল লাল। সাহেব ও মেমরা পাশাপাশি হাত ধরাধরি করে হাঁটে। তাদের হিন্দু, মুসলমান বাড়ির মেয়েরা তো এমনভাবে পথ দিয়ে। হাঁটে না।
রাস্তার ধারে টিনের চালায় পরোটা আর কীসের যেন তরকারি বিক্রি হয়, ঘিয়ের গন্ধ ম ম করে। কিছু লোক সেখানেই বসে বসে খায়। সামনে কয়েকটা কুকুর জিভ বার করে জুলজুল করে তাকিয়ে থাকে। ধুলো উড়িয়ে সাহেব-মেমদের জুড়ি গাড়ি চলে যায়, তখন দিশি লোকদের পালকি এক। পাশে সরে দাঁড়ায়।
যশোরে এক রাত্রি কাটিয়ে আবার শুরু হল যাত্রা। এখানে দু-একজন পরামর্শ দিয়েছিল যে, বহরমপুরের বদলে মুর্শিদাবাদ শহরেও যাওয়া যায়, সেখানেও গঙ্গা পাওয়া যাবে। আবার কয়েকজন সাবধান করে দিল। যে, মুর্শিদাবাদে নবাবি আমলের পতনের পর এখনও অরাজকতা চলছে, পথেঘাটে দস্যু-তস্করের উপদ্রব খুব বেশি। বহরমপুরে ইংরেজদের ঘাঁটি। আছে, তারা আইন-শৃঙ্খলা কিছুটা রক্ষা করে।
এই সময় পথে আরও তীর্থযাত্রীদলের সাক্ষাৎ মেলে। দল যত ভারী হয়, ততই মঙ্গল। সব বড় বড় দলেই একাধিক পাহারাদার থাকে। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদেরও লাঠি ধরতে হয়। লালুকেও যদু লাঠি খেলা শিক্ষা দেয় রোজ। সন্ধ্যার সময় যাত্রা বিরতি হলে কিছুক্ষণ যদুর সঙ্গে লালুকে লাঠির পাল্লা দিতে হয়।
অন্য একটি দলে ডুলিতে চাপিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এক মুমূর্ষ বৃদ্ধকে। এঁর গঙ্গা যাত্রা হবে। পবিত্র গঙ্গা নদীতে পা ডুবিয়ে রাখা অবস্থায় কারুর মৃত্যু হলে তাঁর আত্মা সরাসরি স্বর্গে চলে যায়।
কবিরাজমশাই সেই রুগির একবার নাড়ি পরীক্ষা করে দেখে এলেন। তারপর ফিরে এসে নিজের সহচরদের কাছে হাসতে হাসতে বললেন, কী দেইখ্যা আসলাম বলো তো? ওই বুড়ার এখন মৃত্যুযোগ নাই, বায়ু আর পিত্ত প্রবল, কিন্তু আয়ু আছে অন্তত আরও তিন-চার মাস। একবার গঙ্গাযাত্রা করালে তো ফিরায়ে আনার নিয়ম নাই। ও বুড়ার সঙ্গীরা বিপদে পড়ে যাবে। তিন-চার মাস বসে থাকতে হবে গঙ্গার ধারে।
বৃদ্ধের দলে চারজন রমণীও আছে, নানা বয়সের। চারজনই ওই বৃদ্ধের ধর্মপত্নী। তাঁদের হাতের শাঁখা ও সিঁথির সিঁদুর আর কতদিন থাকবে, তা নির্ভর করছে বৃদ্ধের আয়ুর ওপর। তারপর বাকি জীবন সহ্য করতে হবে বৈধব্য যন্ত্রণা। মাঝে মাঝে ওই চার রমণী কী নিয়ে যেন ঝগড়া শুরু করে।
নদী-নালা এড়িয়ে এড়িয়ে চললেও এক জায়গায় একটি ছোট নদী পার হতেই হল।
তবে এ-নদীতে জল বেশি নেই, অল্প অল্প স্রোত আছে। আগে যদু একবার ওপার পর্যন্ত গিয়ে ফিরে এল। হাঁটু জল, মাঝখানটায় কোমর সমান। গিরিবালা পালকি থেকে নামলেন না। দিনেরবেলা তিনি অন্য লোেকদের মুখ দেখান না! কাহাররা জানাল যে, গিন্নিমা সমেত তারা পালকি ওপারে নিয়ে যেতে পারবে। কবিরাজমশাই ঠিক করলেন, তিনি ঘোড়া থেকে নেমে নিজে পার হবেন, অন্যদেরও সেইভাবেই যেতে হবে। লালুর ওপর ভার পড়ল, মানিকচাঁদকে সে পার করাবে।
সবার শেষে লালুর পালা। মানিকচাঁদ কিছুতেই জলে নামতে চায় না। তার লাগাম ধরে টানাটানি করলেও সে সিঁটিয়ে থাকে। অন্য দলের দুজন লোক পেছন থেকে তাকে জোর করে ঠেলে দিল। জলে নেমেও দাপাদাপি করতে লাগল মানিকচাঁদ। ঘোড়ার মতো প্রাণীরা জলে ডুবে যায় না, তবু কেন সে। এত ভয় পাচ্ছে কে জানে।
মাঝ নদীতে গিয়ে মানিকচাঁদ এত লাফালাফি করতে লাগল যে, লাগামটা ধরে রাখাই শক্ত হল লালুর পক্ষে। সে হাবুডুবু খেতে লাগল, কিন্তু লাগাম ছাড়ল না। অন্যরা ওপারে পৌঁছে গেছে, তারা উদগ্রীব হয়ে তাকিয়ে আছে।
এরই মধ্যে লালু দেখল তার পাশে একজন মানুষ। জলে ভাসতে ভাসতে এসে ঠেকেছে তার গায়ে। এক স্ত্রীলোকের মৃতদেহ। বেশি বয়স নয়, তিরিশ বত্রিশ হবে, সারা মুখ ক্ষতবিক্ষত, কীভাবে মৃত্যু হয়েছে কে জানে। দাহ না করে বা কবর না-দিয়ে কেউ ওকে জলে ভাসিয়ে দিয়েছে। লালু আস্তে সেই রমণীকে সরিয়ে ভাসিয়ে দিল স্রোতে।
অতিকষ্টে মানিকচাঁদকে অন্য পারে ভোলার পর কবিরাজমশাই লালুর পিঠে চাপড় দিয়ে বললেন, শাবাশ! লালু, তোর কথা মানিকচাঁদ এত শশানে, তবু তোর সাথেও জলে নামতে চাইছিল না, তা হলে অন্য কেউ তো ওকে বাগে আনতেই পারত না!
তারপরই কবিরাজ একটু ভুরু কুঁচকে বললেন, তোর গা-টা গরম গরম লাগল কেন রে লালু? জ্বর হয়েছে নাকি?
লালু একটু সরে গিয়ে বলল, না, না, কর্তা, ও কিছু না।
আগের রাত থেকেই লালুর গায়ে জ্বর। সে কারুকে কিছু জানাতে চায় না। সে রাত্রে তার আরও জ্বর বাড়ল, তবু মুখ বুজে রইল লালু। তারপর বহরমপুর পৌঁছোবার যখন আর বিশেষ দেরি নেই, আর একদিনের পথ, তখন লালুর ধুম জ্বর, সারা শরীরে জ্বালা, পা দুর্বল হয়ে গেছে, চক্ষেও। ঝাঁপসা দেখছে। তবু তার মধ্যেও হাঁটার চেষ্টা করতে করতে একসময় পড়ে গেল পথের পাশে।
কবিরাজ অনেকটা এগিয়ে গিয়েছিলেন, যদুর ডাক শুনে থামলেন। পিছিয়ে এসে, ঘোড়া থেকে নেমে লালুর দিকে তাকিয়ে রইলেন কয়েক মুহূর্ত। তারপর তার একটা হাত ধরে নাড়ি দেখলেন, বললেন, জিভ বার কর।
ওষুধের পেটিকা খুলে বার করলেন খল। মকরধ্বজ ও মধু মিশিয়ে ঘষলেন খানিকক্ষণ, যদুকে বললেন, খানিকটা কলাপাতা জোগাড় কর।
খল থেকে ওষুধ চেটে চেটে খেতে হয়, কিন্তু কবিরাজের নিজস্ব খল তো অন্যকে দেওয়া যায় না। খলের ওষুধ একটুখানি কলাপাতায় ঢেলে বললেন, খা। চিন্তা নাই, জ্বর কমে যাবে।
যদু ধরে ধরে দাঁড় করাল লালুকে। কবিরাজ তার ঘোরলাগা অবস্থা দেখে একটুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, তুই হাঁটতে পারবি না। ঠিক আছে, তুই ঘোড়ার পিঠে ওঠ, আর বেশি পথ নাই। এটুকু আমি হেঁটেই যেতে পারব।
এই কথাতেই যেন লালুর ঘোর ভেঙে গেল। চক্ষু মেলে, মাথা ঝাঁকিয়ে সে বলল, না কর্তা, আমি পারব, হাঁটতে পারব।
কবিরাজ বললেন, পারবি? তা হলে আস্তে আস্তে আয়।
একটা লাঠিতে ভর দিয়ে কোনওক্রমে হাঁটতে লাগল লালু। সে প্রায় কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। হাঁটু দুমড়ে আসছে মাঝে মাঝে, তবু সে এগোচ্ছে শুধু মনের জোরে।
বহরমপুরে গঙ্গার ঘাটে পৌঁছোতে পৌঁছোতে সন্ধ্যা হয়ে গেল।
পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে অনেক মানুষ এখানেই গঙ্গাস্নানের পুণ্য। অর্জন করতে আসে। তাই সেইসব যাত্রীদের জন্য এখানে বেশ কয়েকটি চালা ঘর তৈরি করা হয়েছে। অবশ্যই ভাড়া লাগে। কয়েকটি দোকানঘরও গজিয়ে উঠেছে, ভিখারি ও সুযোগসন্ধানীও প্রচুর। স্নানের সময় কেউ কেউ তামার পয়সা জলে ছুড়ে দেয়, মা গঙ্গার প্রতি অঞ্জলি হিসেবে। কিছু কাঙালি ছেলে সেই সব পয়সা ডুবে ডুবে তোলে।
কবিরাজমশাই সস্ত্রীক, সবান্ধব একটি বড় চালাঘরে আশ্রয়ের ব্যবস্থা। করলেন। বাকিরা পাশের উন্মুক্ত স্থানেই থাকবে। একটু দূরে দূরে কয়েকটি মাটির উনুন তৈরি করাই আছে। সেখানে রান্নার বন্দোবস্ত হতে পারে। কয়েকটি খাবারের দোকানও আছে, ভাতডাল পাওয়া যায় না বটে, রুটি ডালপুরি-হালুয়া যথেষ্ট মেলে, তিন পয়সায় মোটামুটি পেট ভরে। লালু রাত্রে কিছুই খেল না, ঘুমোতে লাগল অঘোরে।
পরদিন সকালে দেখা গেল লালুর সারা গায়ে লাল লাল গোটা। বেরিয়েছে।
কবিরাজ তার কাছে এসে দাঁড়িয়ে জিভ দিয়ে চুকচুক শব্দ করলেন। তারপর যদু ও পালকিবাহক কাহারদের বললেন, তোরা সরে আয়। ওকে আর ছুঁবি না। এ রোগ বড় ছোঁয়াচে। দুটো কাঙালি ছেলেকে ডেকে আন, আমি ওষুধ দিচ্ছি, ওরা খাইয়ে দেবে। একটা করে পয়সা দেব, ওরাই জলটলও দেবে।
স্নানের পুণ্যলগ্ন এক ঘটিকা থেকে শুরু। ঘাটে থিকথিক করছে মানুষ। কিছু দূরে দুই মুমূর্ষ বৃদ্ধকে জলে পা ডুবিয়ে শুইয়ে রাখা হয়েছে। দুপুরের পর থেকে প্রায় সন্ধ্যা পর্যন্ত চলল স্নান-উৎসব। অনেক পুরুতও এসেছে, তাদের মন্ত্র-উচ্চারণে কার কত গলার জোর যেন তার পরীক্ষা চলেছে।
লালুর গায়ে একটা চাদর চাপা দিয়ে রাখা হয়েছে। তার জ্ঞান নেই। লাল লাল গুটিতে এখন তার মুখও ভরে গেছে।
মধ্য রাত্তিরে যখন সকলেই ঘুমে নিথর, তখন বীণা পা টিপে টিপে আসে লালুর কাছে। এক টুকরো ছেড়া কাপড় জলে ভিজিয়ে সে লালুর জ্বরতপ্ত কপালে পট্টি দেয়।
ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে, কষ্ট হইতাছে খুব? দুই দিন কিছু খাও নাই। ক্ষুধা পায় না? মুড়ি-বাতাসা খাবা?
লালুর মস্তিষ্কও এখন অসাড়। সে উত্তর দেবে কী করে? কিছু শুনতেও পায় না।
লালুর জ্বর এত বেশি যে একটু পরেই জলপট্টিটা শুকিয়ে যায়। আবার ভিজিয়ে দেয় বীণা।
খানিক বাদে সে আবার নিঃশব্দে ফিরে যায়।
লালুকে নিয়ে কবিরাজের দলটি খুব অসুবিধেয় পড়ে গেল। মান সম্পন্ন হয়েছে, কয়েকটি কলস ভরতি নেওয়া হয়েছে জল। এরপর আর অপেক্ষা করার তো কোনও মানে হয় না। কিন্তু ছেলেটাকে ফেলে রেখেই বা যাওয়া যায় কী করে?
পুরো দলটিকেই থেকে যেতে হল আরও দুদিন। এর মধ্যে লালুর আর জ্ঞান ফিরল না। তার পানবসন্ত হয়েছে। শুধু জলবসন্ত হলে তেমন ভয়ের কিছু থাকে না, পানবসন্ত অতি মারাত্মক। এর কোনও চিকিৎসা নেই। লালুর গায়ে অনেক বেশি গুটি উঠেছে, অন্যদের এত হয় না।
তৃতীয়দিন রাত্রে লালুর গলা দিয়ে ঘড় ঘড় শব্দ হতে লাগল, ভোরের দিকে সেই শব্দ কিছুটা মন্থর হতে হতে থেমে গেল একসময়।
যদুরা গিয়ে কবিরাজমশাইকে খবর দিলে তিনি দেখতে এলেন। লালুর মুখে স্পষ্ট মৃত্যুর ছায়া। শরীরের মাড়ি-গুটিগুলো দগদগ করছে। কয়েকটা মাছি ভন ভন করছে তার চোখের ওপর।
কবিরাজ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ছেলেটার কঠিন ফাঁড়া ছিল, আমি আগেই বলেছি। কিন্তু এমন বেঘোরে মৃত্যু হবে তা কে বুঝেছে! সবই নিয়তি। নিয়তি কেন বাধ্যতে।
কাছেই শ্মশান। কিন্তু শীতলা মায়ের দয়ায় যার প্রাণ যায়, তাকে শীতলা মা ছাড়া শ্মশানের চণ্ডালরাও সহজে ছুঁতে চায় না। বেশি পয়সা দিতে হয়।
কবিরাজ বললেন, ছেলেটা এত দূর এল, তবু গঙ্গাস্নানও ওর ভাগ্যে ঘটল না। যদি একবার অন্তত ডুব দিতে পারত।
যদু বলল, কর্তা, ওকে না-পুড়িয়ে জলে ভাসিয়ে দিলে হয় না? তাতেও যদি একটু পুণ্য হয়।
কবিরাজ বললেন, প্রাণ না-থাকলে আর পুণ্য কী! দে, তাই দে।
লালুর দেহ কে জলের কাছে নিয়ে যাবে? ডাকা হল সেই কাঙালি ছেলে দুটোকেই।
তারা বলল, এমনি এমনি বসন্তের রুগিকে জলে ফেলে দিলে কোতোয়ালি থেকে তাদের ডান্ডা পেটা করা হবে। প্রচুর বুড়োবুড়ি এখানে আসে, তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন অক্কা পায়। খরচের ভয়ে কিংবা অবহেলায় তাদের দাহ না-করে জলেই ফেলে দেওয়া হত এতদিন। এখন কোতোয়ালি থেকে তা নিষেধ করে দেওয়া হয়েছে। জলে মড়া ভাসে, তাতে স্নানার্থীদের অসুবিধে হয়।
তবে কলার ভেলায় তুলে মাঝ নদীতে নিয়ে গিয়ে ভাসিয়ে দিলে আপত্তির কিছু নেই। তাদের পয়সা দিলে সে ব্যবস্থা করা যাবে।
লালুর দেহ কলার ভেলায় তোলার পর কবিরাজ বললেন, কিন্তু হিন্দুর ছেলে, তার মুখাগ্নি হবে না? না হলে যে ওর আত্মার মুক্তি হবে না।
তিনি তাঁর এক সঙ্গীকে বললেন, ওহে দত্তজা, এই কায়স্থর ছেলেটা তো তোমাদের স্বজাতি। তুমিই ওর মুখাগ্নি করে দাও।
তখন একটা চ্যালা কাঠে আগুন ধরিয়ে রাঘব দত্ত সেটা লালুর মুখে ঠেসে ধরে একটু মন্ত্রও পড়ে দিল।
কাঙালি ছেলেরা সাঁতরে সাঁতরে ভেলাটা মাঝনদীতে নিয়ে গিয়ে ভাসিয়ে দিল স্রোতে। ভেলাটা দুলতে দুলতে মিলিয়ে গেল।
দলের একজন সঙ্গীর মৃত্যু হলে সকলেরই মন ভারাক্রান্ত হবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অপরাধবোধ হয় না। লালুর প্রতি কোনও অবহেলা তো দেখানো হয়নি, তার চিকিৎসারও কোনও ত্রুটি হয়নি, তার আয়ু ফুরিয়ে গেলে আর কী করা যাবে?
লালুকে জলে ভাসিয়ে দেবার সময় সকলেই দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। শুধু একজন লুকিয়ে লুকিয়ে চক্ষু মুছতে লাগল বারবার। বীণার সঙ্গে লালুর খুব বেশি বাক্য বিনিময় হয়নি, লালু ভালো করে বীণার দিকে চেয়েও দেখেনি, তার মুমুর্ষ অবস্থায় বীণা যে সেবা করেছে, তাও সে টের পায়নি। তবু এই শান্ত, নিরীহ মানুষটি নিঃশব্দে এমনভাবে হারিয়ে গেল, এটা বীণা সহ্য করতে পারছে না, বুকট মুচড়ে মুচড়ে উঠছে অনবরত।
পালকির পরদা একটু ফাঁক করে বীণা দেখতে লাগল নদীর দিকে, যে নদী কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে গেছে মানুষটিকে।
কবিরাজমশাই সদলবলে ফিরে চললেন, চারদিন পর গ্রামে পৌঁছে লালুর মাকে দুঃসংবাদ দিতেই হল।
পদ্মাবতী এসে আছড়ে পড়লেন কবিরাজমশাইয়ের বাড়ির উঠোনে।
কবিরাজ কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখলেন সেই মায়ের কান্না। কী সান্ত্বনা তিনি জানাবেন? বিধবা মায়ের একমাত্র সন্তানকে কেড়ে নিয়ে ভগবানের কোন উদ্দেশ্য সাধন হয় কে জানে। ভগবানের বিচার নিয়ে তো প্রশ্ন করাও যায় না।
তিনি ধীর স্বরে বললেন, বাছা, মানুষের পক্ষে যতখানি সুচিকিৎসা পাওয়া সম্ভব, তা তোমার ছেলে পেয়েছে। আমি আমার ওষুধে কোনও কোনও রুগিকে যমের দরজা থেকেও ফিরিয়ে আনতে পেরেছি, কিন্তু নিয়তির সঙ্গে তো যুদ্ধ চলে না। মা গঙ্গা তাকে গর্ভে নিয়েছেন। তুমি এখন শ্রাদ্ধ-শান্তি করো যাতে পরলোকে গিয়ে তোমাৱ সন্তান শান্তি পায়।
যথা সময়ে পুরোহিত এসে যথাবিহিত শ্রাদ্ধানুষ্ঠান সম্পন্ন করলেন এবং ধুতি-গামছা, স্বর্ণালংকার, ফলমূল, আতপ চাল দক্ষিণা নিলেন। বিধবা সর্বস্বান্ত হয়ে ভোজন করালেন এগারোজন ব্রাহ্মণকে।
তারপর লালুর নাম মুছে গেল। গ্রামের জীবন আগেকার নিয়ম মতনই চলতে লাগল, বিধবা জননীর চোখের জলও শুকিয়ে গেল একসময়।
পুত্রবধূটি কী বুঝল আর কী বুঝল না, তা সে নিজেই জানে। দুজনেই আবার শুরু করে দিল ঘরকন্নার কাজ। তাদের তো বেঁচে থাকতে হবে।