০৩. ললিপপ
দশটা বাজার কয়েক মিনিট আগে ঘরের বাতি নিভিয়ে সবাই শুয়ে পড়ল। ঘরে সুমসাম নীরবতা, মনে হয় বুঝি কেউ নেই। মানুষ ঘুমিয়ে পড়লে একটু নাড়াচাড়া করে, নিশ্বাসের শব্দ হয়, কেউ কেউ ঘুমের মাঝে একটা দুইটা কথা বলে। কিন্তু যখন কেউ ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকে তখন তারা টু শব্দটাও করে না, তাই ঘরে একটু শব্দও নেই।
আলো নিভিয়ে দেয়ার পর ঘরের ভিতরে প্রথমে ঘুটঘুটে অন্ধকার থাকলেও আস্তে আস্তে চোখে অন্ধকার সয়ে এসে এখন বেশ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। ছয়টা বাক্সের মতন ঘরের মাঝে ছয়টা মশারি টানানো এবং তার ভিতরে ছয়টি মেয়ে ঘুমের ভান করে শুয়ে আছে। নিতু শুয়ে শুয়ে শুনতে পায় বারান্দা দিয়ে প্রথমে গুম গুম শব্দ করে একজন হেঁটে গেল, নিশ্চয়ই খোরাসানী ম্যাডাম। এরপর খ্যাস খাস শব্দ করে সেন্ডেল ঘষে আরেকজন, সম্ভবত হোস্টেল সুপারিনটেন্ড যাকে দেখলে মনে হয় তার শরীরের মাঝে নল ঢুকিয়ে কেউ একজন তাকে চুষে খেয়ে নিয়ে ছিবড়েটা ফেলে গেছে। নিতু বিছানায় শুয়ে কয়েকবার এপাশ ওপাশ করল এবং ঘুমানোর চেষ্টা করল তারপর বুঝতে পারল আসলে সে ঘুমাতে পারবে না। নতুন জায়গায় সবাই ঘুমাতে দেরি হয় কিন্তু নিতর সমস্যাটা অন্য জায়গায়। সে যখন খুব ছোট তখন তার জন্মদিনে তার মা তাকে একটা টেডি বিয়ার উপহার দিয়েছিলেন, পেট-মোটা তুলতুলে নরম হালকা বাদামি রংয়ের টেডি বিয়ারটাকে বুকে জড়িয়ে সে সাথে সাথে তার নাম দিয়েছিল ভোটকা। মিয়া। নিতু কখনো তার এই ভোটকা মিয়াকে কাছ ছাড়া করে নি। রাতের বেলা বুকে জড়িয়ে ঘুমিয়েছে, তার সাথে কথা বলেছে। এই প্রথম আজ রাতে তার সাথে ভোটকা মিয়া নেই, নিতুর মনে হচ্ছে তার নিজের শরীরের একটা অংশ হারিয়ে গেছে। ভোটকা মিয়া ছাড়া সে ঘুমাবে কেমন করে? নিতু তখন হঠাৎ করে তার বিছানায় উঠে বসল। কী করতে হবে সে বুঝতে পেরেছে, ভোটকা মিয়াকে উদ্ধার করে আনতে হবে।
বিকাল বেলা যখল খেলাধূলার নামে তাদের ওপর অত্যাচর করা হচ্ছিল, মাঠের এক মাথা থেকে অন্য মাথায় দৌড়াদৌড়ি করতে হচ্ছিল, খোয়া বাঁধানো পথে লাফাতে হচ্ছিল তখন সে পুরো এলাকাঁটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করেছে। স্কুলের সামনে সিঁড়ির কাছে যেখানে তার রাক্ষসী খোরাসানী ম্যাডামের সাথে দেখা হয়েছে সেখান থেকে লাথি মেরে তার ভোটকা মিয়াকে ফেলে দেয়া হলে সেটা কোনদিকে যেতে পারে আন্দাজ করে খুঁজে দেখেছে। স্কুলের সীমানার কাছাকাছি একটা বড় ঝাপড়া গাছে ভোটকা মিয়া আটকা পড়ে আছে। খোরাসানী ম্যাডাম অবিশ্যি চেষ্টা করেছিল লাথি মেরে স্কুলের সীমানার বাইরে পাঠিয়ে দিতে কিন্তু ঝাপড়া গাছটা বাঁচিয়েছে। বিকেল বেলা যখন খেলাধূলার নামে তাদেরকে দৌড়িয়ে নেয়া হচ্ছিল নিতু তার মাঝেও চেষ্টা করেছিল কোনোভাবে সরে গিয়ে ভোটকা মিয়াকে উদ্ধার করে আনতে কিন্তু পারে নি। এখন রাত হয়েছে, একটু পরে সবাই ঘুমিয়ে যাবে তখন গিয়ে ভোটকা মিয়াকে উদ্ধার করে আনা যাবে।
নিতু নিঘুম বিছানায় শুয়ে রইল। কান পেতে শুনতে পেল ঝুন ঝুন দুই বোন গলা নামিয়ে ফিসফিস করে কথা বলছে। মিতুলের বিছানা থেকে নিয়মিত নিশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে, মনে হয় এর মাঝেই ঘুমিয়ে পড়েছে। রেবেকার বিছানা থেকে মনে হল খুব চাপা কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছে, মেয়েটা মনে হয় কাঁদছে। এখানে যারা আছে সবার মনের ভিতরেই তো দুঃখ, সারাদিন চেপে চুপে রাখে কাউকে বুঝতে দেয় না। যখন রাত্রে ঘুমাতে আসে তখন মনে হয় নিজের কাছেই সেটা নিজে প্রকাশ হয়ে যায়। নিতু তার মাঝে নিশ্বাস বন্ধ করে শুয়ে রইল।
এভাবে আরো অনেকক্ষণ সময় কেটে গেল। নিতর যখন মনে হল সবাই ঘুমিয়ে গেছে তখন সে খুব সাবধানে বিছানা থেকে নেমে এল। বিছানার নিচে জুতো রাখা ছিল সাবধানে সেগুলি পায়ে লাগিয়ে নেয় তারপর পা টিপে টিপে দরজার দিকে এগুতে থাকে। দরজার ছিটকানিটা বেশ শক্ত করে লাগানো টেনে খুলতে গিয়ে সেটা খুট করে শব্দ করে ফেলল—সাথে সাথে মিতুল ঘুম ভেঙ্গে জেগে উঠে চাপা স্বরে জিজ্ঞেস করল, কে?
আমি। নিতু ফিসফিস করে বলল, আমি নিতু।
ও! বাথরুমে যাবে?
উঁহু।
মিতুল এবারে পুরোপুরি জেগে উঠে বলল, তাহলে?
আমার টেডি বিয়ারটা আনতে যাচ্ছি।
এবারে মিতুল লাফিয়ে বিছানায় উঠে বসল। চাপা গলায় যতটুকু জোরে কথা বলা সম্ভব ততটুকু জোরে বলল, কী বলছ তুমি? তোমার কী মাথা খারাপ হয়ে গেছে?
নিতু আর কথা না বাড়িয়ে দরজা খুলে বের হয়ে গেল। মিতুল পিছনে পিছনে ছুটে এসে চাপা গলায় বলল, দাঁড়াও নিতু! দাঁড়াও! যেও না।
কিন্তু নিতু তার কথা না শুনে বারান্দা দিয়ে ছুটে যেতে থাকে। মিতুল কী করবে বুঝতে না পেরে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে রইল। বারান্দায় আলো জ্বলছে বের হলে কেউ না কেউ দেখে ফেলতে পারে তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। ভয়ে মিতুলের শরীর কাঁপতে থাকে, নিতু নূতন এসেছে তাই এখনো বুঝতে পারছে না। তাদের হোস্টেলের বড় গেট রাত্রে তালা দেওয়া থাকে বের হওয়ার কোনো উপায় নেই। সেটা একটা বিশাল সৌভাগ্য না হয় মাঝে মাঝেই কোনো না কোনো মেয়ে এখান থেকে পালানোর চেষ্টা করত আর তাহলেই হতো সর্বনাশ। খোরসানী ম্যাডামের ভয়ংকর—কুকুর সিংঘিকে রাতের বেলা ছেড়ে দেওয়া হয়। স্কুল কম্পাউন্ডের ভিতর কেউ এলে তাকে একেবারে টুকরা টুকরা করে ছিঁড়ে ফেলবে। এই স্কুলের মাঝে কে বেশি ভয়ংকর খোরাসানী ম্যাডাম না কি তার কুকুর সিংঘি সেটা নিয়ে মাঝে মাঝে তর্ক বিতর্ক হয়। দিনের বেলা সিংঘিকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়। বিশাল কুকুরটী তখন ধারালো দাঁত বের করে স্কুলের মেয়েদের দিকে তাকিয়ে থাকে, কেউ কাছাকাছি এলে মেঘের গর্জনের মতো শব্দ করে শেকল ছিঁড়ে লাফিয়ে পড়ার চেষ্টা করে। কোনোভাবে যদি শেকল ছিঁড়ে বের হয়ে আসে তখন কী হবে সেটা চিন্তা করে মিতুলের মতো অনেকেরই হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসে।
মিতুল নিশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল, নিতু নামের এই নূতন পাগলাটে মেয়েটা গেট বন্ধ দেখে এখন নিশ্চয়ই ফিরে আসবে, কিন্তু সে ফিরে এল না আর তাই দেখে মিতুলের মনে হল সে ভয়ে, আতংকে আর দুশ্চিন্তায় বুঝি হাঁটু ভেঙ্গে পড়ে যাবে! কী হয়েছে মেয়েটার? কোথায় গিয়েছে?
নিতু ঘর থেকে বের হয়ে বারান্দা ধরে গিয়ে সিঁড়ি দিয়ে সাবধানে এক তলায় নেমে এল। চারিদিকে আলো জ্বলছে কেউ দেখে ফেললে সর্বনাশ হয়ে যাবে। গেটের সামনে এসে নিতু অবাক হয়ে আবিষ্কার করল সেখানে এত বড় একটা তালা ঝুলছে, বের হবার কোনো উপায় নেই। এতগুলি মেয়েকে তালা মেরে আটকে রাখা হয় ব্যাপারটা নিজের চোখে দেখেও তার বিশ্বাস হয় না। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে কী করবে সেটা নিয়ে খানিকক্ষণ চিন্তা করে সে আবার খুব সাবধানে নিঃশব্দে উপরে উঠে এল। বারান্দার রেলিং টপকে সে খুব সাবধানে কার্নিশে নেমে এল। কার্নিশ ধরে সে শুড়ি মেরে হেঁটে যেতে থকে বাথরুমের কাছাকাছি পানির পাইপ নিচে নেমে গেছে, সে সেই পাইপ বেয়ে নেমে যাবে। আধো আলো আধো অন্ধকারে গুড়ি মেরে কার্নিশের ওপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে শেষ পর্যন্ত বাথরুমের কাছে পৌঁছাল, যে রকম ভেবেছিল ঠিক সে রকম সত্যি সত্যি কয়টা পানির পাইপ নিচে নেমে গেছে। নিতু সাবধানে একটা পাইপ ধরে পিছলে পিছলে নিচে নেমে এল। পাইপ বেয়ে নামা খুব সহজ, কিন্তু কীভাবে উঠে আসবে কে জানে? এখন অবিশ্যি সেটা চিন্তা করে লাভ নেই।
নিচে নেমে এসে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে নিতু কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। সে এখানে এসেছে এখনো পুরো একদিন হয় নি, স্কুলটা এখনো ভালো করে চেনা হয় নি। কোন দিক দিয়ে গেলে সবচেয়ে সহজ হবে সে ভালো করে জানে না। তার মাঝেও সে আন্দাজ করে নিয়ে সাবধানে হাঁটতে শুরু করে। স্কুল কম্পাউন্ডের মাঝে মাঝে লাইট জ্বলছে, সে সেগুলি এড়িয়ে অন্ধকারে অন্ধকারে হেঁটে যেতে থাকে। নিশুতি রাত কোথাও কেউ নেই, তার মাঝে একা একা যেতে তার কেমন জানি ভয় করতে থাকে। দিনের বেলা সে ভূত বিশ্বাস করে না, কিন্তু এই রাত্রি বেলা সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার, সে যতগুলি ভূতের গল্প পড়েছিল হঠাৎ করে সবগুলি গল্প তার এক সাথে মনে পড়ে গেল।
নিতু অন্ধকারে নিজেকে আড়াল করে সাবধানে হেঁটে যেতে থাকে। হোস্টেলটা পার হয়ে খানিকটা ফাঁকা জায়গা, তারপর একটা টিউবওয়েল, টিউবওয়েল্টা পার হয়ে এগিয়ে গেলে বেশ কয়েকটা গাছ, তারপর স্কুল বিল্ডিং, তারপর আরো কিছুগাছ সেগুলি পার হয়ে গেলে স্কুলের মাঠ তার অন্যপাশে স্কুলের সীমানার উঁচু দেওয়াল। সেই দেওয়ালের কাছে বড় একটা ঝপড়া গাছে তার ভোটকা মিয়া আটকা পড়ে আছে। নিতু যখন স্কুলের মাঠের কাছাকাছি এসেছে ঠিক তখন সে একটা চাপা গর্জন শুনতে পেল এবং কিছু বোঝার আগেই হঠাৎ করে কী যেন তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। নিতু মাটিতে আছাড় খেয়ে পড়ে ভয়ে আতংকে সে একটা চিৎকার দিয়েই দিচ্ছিল কিন্তু শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলে নেয়, অন্ধকারে ভালো করে দেখা যায় না কিন্তু তার মাঝেও বোঝা যাচ্ছে বিশাল একটা কুকুর তাকে মাটিতে চেপে ধরে রেখেছে, চোখগুলি জ্বলছে আগুনের মতে, ধারালো দাঁত বের হয়ে আছে আর চাপা স্বরে গর্জন করছে, মনে হয় এক্ষুনি বুঝি ধারালো দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে ফেলবে তাকে।
কুকুরটা দেখে নিতুর শরীরে প্রাণ ফিরে এল, ফিক করে হেসেও ফেলল সে, চাপা স্বরে বলল, ও মা! একটা কুকুর! কী সুইট। আমি ভেবেছিলাম ভূত!
কুকুরটা তীক্ষ্ণ চোখে নিতুর দিকে তাকিয়ে থাকে, নিতু হাত দিয়ে অবলীলায় কুকুরটাকে উপর থেকে সরিয়ে উঠে বসে সেটার গলা জড়িয়ে ধরে বলল, আয় আমার কাছে আয় পাগল কোথাকার। কী ভয় দেখিয়েছি আমাকে।
একটু আগে যে কুকুরটা একটা ভয়ংকর প্রাণী ছিল হঠাৎ করে নিতুর আদর পেয়ে সেটা কেমন জানি বাচ্চা শিশুর মতো হয়ে উঠে। লেজ নাড়িয়ে দুই পা নিতর শরীরে তুলে তাকে দুই একবার চেটে ফেলল। নিতু খিলখিল করে হেসে ফিস ফিস করে বলল, খবরদার পাজী কুকুর, আমাকে কি লজেন্স পেয়েছিস নাকি? চাটছিস কেন? দেব একটা চড়!
নিতু কুকুরটার গলা ধরে মুখে আদর করে হাত বুলিয়ে দেয় তারপর ফিস ফিস করে বলে, আর আমার সাথে। একা একা যা ভয় পাচ্ছিলাম। এখন আমার আর কোনো ভয় নাই। যদি ভূত আসে তাহলে তুই ধাওয়া করে তাড়িয়ে দিবি। পারবি না?
কুকরটা গররর আওয়াজ করে নিতকে জানিয়ে দিল সে পারবে। তাকে এখন পর্যন্ত কেউ কখনো আদর করে নি। কেউ যদি তাকে আদর করে সে তার জন্যে জীবন দিয়ে দেবে।
কুকুরটাকে পাওয়ার পর নিতুর সাহস একশ গুণ বেড়ে গেল। কিছুক্ষণের মাঝেই অন্ধকারে গুড়ি মেরে সে হেঁটে হেঁটে স্কুল সীমানার কাছাকাছি পৌঁছে গেল। এদিক সেদিক তাকিয়ে সে ঝাপড়া গাছটার নিচে এসে দাঁড়ায়। আবছা অন্ধকারে ওপরে তার ভোটকা মিয়াকে দেখা যাচ্ছে, কী রকম অসহায়ভাবে সে ঝুলে আছে। নিতু ফিস ফিস করে বলল, ভয় নাই ভোটকা মিয়া, আমি এসে গেছি!
ঝাঁপড়া গাছটায় ওঠা খুব সহজ হল না, নিচে কয়েকটা ডাল ছিল বলে রক্ষা, হাঁচড়-পাচড় করে কোনোভাবে নিতু গাছে উঠে গেল, অন্ধকারে ডাল বেয়ে বেয়ে সে ভোটকা মিয়ার কাছে পৌঁছে যায়, ছোট একটা ডালে আটকে ছিল সাবধানে সেখান থেকে ছুটিয়ে নিয়ে এসে বুকে চেপে ধরে ফিসফিস করে বলল, আমার ভোটকা মিয়া! আমি খুব সরি যে তোকে এই রাত্রিবেলা অন্ধকারে গাছের উপর ফেলে রেখেছিলাম। তুই তো নিজেই দেখেছিস রাক্ষসী মহিলা কী ডেঞ্জারাস! তোকে যে লাথি মেরেছিল তুই ব্যথা পাস নি তো? আহারে আমার সোনামণি! আর কেউ তোর গায়ে হাত দিতে পারবে না। আর এখন গিয়ে আমরা ঘুমিয়ে যাই। ঐ দেখ নিচে আমার নূতন বন্ধু! কী সুন্দর দেখেছিস কুকুরটা? একটা নাম দিতে হবে কী নাম দেয়া যায় বল দেখি?
নিতু কখনো মনে মনে কখনো ফিসফিস করে ভোটকা মিয়ার সাথে কথা বলতে বলতে গাছ থেকে নেমে এল, নিচে কুকুরটা তার জন্যে অপেক্ষা করছিল, আবার তার শরীরের উপর সামনের দুই পা তুলে দিয়ে লেজ নাড়তে নাড়তে নিতুকে চেটে দিল। নিতু আবার খিল খিল করে হেসে বলল, আহ্! কী যন্ত্রণা! আমাকে কি ললিপপ পেয়েছিস নাকি যে চেটে দিচ্ছিস? দেব একটা থাবড়া।
কুকুরটা অবিশ্যি থাবড়াকে ভয় পেল না, লেজ নাড়তে নাড়তে নিতুকে ঘিরে ঘুরতে লাগল, কখনো কারো কাছে আদর পায় নি, নিতুর আদর পেয়ে একেবারে গলে গিয়েছে। নিতু কুকুরটার গলা জড়িয়ে বলল, তুই এত চাটাচাটি করিস— তোর নাম হওয়া উচিত ললিপপ। ঠিক আছে? পছন্দ হয়েছে নামটা? ললিপপ?
কুকুরটা দুই পা তুলে কুঁই কুঁই শব্দ করে নূতন নামটা তার কত পছন্দ হয়েছে সেটা জানানোর চেষ্টা করল।
নিতু যখন তার ঘরে ফিরে এসেছে তখন রাত সাড়ে বারটা বাজে। মিতুল ভয় পেয়ে কী করবে বুঝতে না পেরে একে একে সবাইকে ডেকে তুলেছে। সবাই দরজার কাছে দাঁড়িয়েছিল এবং যখন দেখল নিতু তার টেডি বিয়ারটিকে বুকে জড়িয়ে ধরে একেবারে অক্ষত দেহে ফিরে আসছে তারা এত অবাক হল যে
বলার মতো নয়। সত্যি কথা বলতে কী যেটুকু অবাক হল খুশি হল তার চাইতে অনেক বেশি। নিতুকে জাপটে ধরে মিতুল বলল, তুই-তুই-তুই মানে তুমি—
আমি কী?
আমি শীওর ছিলাম কুকুরটা তোমাকে দেখে ফেলবে তারপর ধরে কাচা খেয়ে ফেবে। খোরাসানী ম্যাডামের বাঘের মতো একটা কুকুর আছে। কাউকে পেলে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলে!
যা! নিতু হেসে বলল, কী সুইট কুকুরটা।
রেবেকা চাপা গলায় বলল, সুইট! তুই দেখেছিস কুকুরটাকে?
দেখব না কেন! কুকুরটাকে পেয়ে গেলাম বলেই তো বেশি ভয় পাই নাই। আমার সাথে ছিল সারাক্ষণ। নাম দিয়েছি ললিপপ।
ললিপপ! রুনু (কিংবা ঝুনু। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারে না। তুই—মানে তুমি, মানে তুই নাম দিয়েছিস ললিপপ?
হ্যাঁ। কুকুরকে আমার যা ভালো লাগে!
ভালো লাগে? ঝুনু (কিংবা রুনু) চোখ কপালে তুলে বলল, তোর ভয় লাগে না?
নিতু আবার হেসে ফেলল, বলল, ধুর বোকা! কুকুরকে ভয় লাগবে কেন? ভয় লাগলে লাগতে পারে মানুষকে পশুপাখিকে কোনো ভয় নাই। কুকুর হচ্ছে ছোট বাচ্চার মতো। আদর করলেই বাধ্য হয়ে যায়।
তানিয়া মাথা নেড়ে বলল, তুমি বলছ যে সিংঘি তোমার বাধ্য হয়ে গেছে?
সিংঘি! নিতু অবাক হয়ে বলল, এত সুইট একটা কুকুরের নাম দিয়েছে সিংঘি? কী সর্বনাশ!
ঠিক এই সময়ে বারান্দায় খ্যাস খ্যাস করে সেন্ডেলের শব্দ হল এবং সাথে সাথে সবাই নিঃশব্দে নিজেদের বিছানায় ঢুকে গেল। সেন্ডেলের শব্দ তাদের ঘরের সামনে এসে থেমে যায় তারপর আবার ফিরে গেল, ঠিক কোন ঘর থেকে কথাবার্তা আসছে চিমশে যাওয়া তাড়ানো হোস্টেল সুপার মনে হয় ধরতে পারল না।
নিতু রাতে ভোটকা মিয়াকে বুকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ল, ফিস ফিস করে বলল, বুঝলে ভোটকা মিয়া তোমার আর ভয় নাই! দিনের বেলা তোমাকে অবিশ্যি লুকিয়ে থাকতে হবে, কিন্তু সেটা আর কঠিন কী? তুমি চুপ করে লুকিয়ে থেকো—কোনো শব্দ করো না। এখন অনেক রাত হয়েছে ভোটকা মিয়া, ঘুমিয়ে যাও।
নিতু ঘুমানোর জন্যে চাদরটা গায়ে টেনে আনতে গিয়ে হঠাৎ আবিষ্কার করল তার কাপড়ের একটা অংশ ছেড়া। শুধু ছেড়া নয়, ছিঁড়ে আলাদা হয়ে গেছে। ভোটকা মিয়াকে উদ্ধার করতে যাওয়ার সময় কোনো এক জায়গায় ছিঁড়ে রয়ে গেছে। নিতুর বুকটা হঠাৎ ধ্বক করে উঠল।
ঠিক এই রকম সময়ে হোস্টেলের বুয়া রবোট মহিলা জমিলার মা তার বিছানায় বসে ঠক ঠক করে কাপতে কাপতে আয়াতুল কুরসি পড়ছিল। বাথরুমে যাওয়ার জন্যে ঘর থেকে বের হয়ে সে স্পষ্ট দেখেছে একটা পরী আকাশ থেকে নেমে দেওয়ালের কাছে আঁপড়া ছাতিম গাছটিতে এসে বসেছে। খিল খিল করে হাসছে। হাসতে হাসতে নাচতে নাচতে গাছ থেকে নেমে আসছে। আর কী আশ্চর্য, সেই পরী যাদু করে খোরাসানী ম্যাডামের ভয়ংকর কুকুরটাকেও বশ করে ফেলেছে। যে কুকুরটা কাউকে পেলে কামড়ে টুকরো টুকরো করে ফেল্লার কথা সেটা সেই পরীর সাথে খেলছে! তাকে ঘিরে ঘিরে নাচছে।
জমিলার মা ভয়ে জ্ঞান প্রায় হারিয়ে ফেলছিল, তার মাঝে অনেক কষ্ট করে নিজেকে শান্ত করে ঘরের মাঝে ফিরে গিয়ে বিছানায় বসে রইল।