পর্ব–২
দ্য ক্লেরিকুজিও অ্যান্ড পিপি ডি লিনা
০৩.
ক্লেরিকুজিও ফ্যামিলির দুর্দান্ত উত্থান ঘটে সিসিলিতে। এ উত্থানের ইতিধ্যেই অতিবাহিত হয়েছে শত বর্ষেরও বেশি সময়। আর এই দীর্ঘ সময়ে প্রথমার্ধের প্রায় কুড়িটি বছর কেটেছে কেবল যুদ্ধে আর যুদ্ধে। একটি বনের সামান্য একটি অংশের অধিকার নিতে ক্লেরিকুজিও হারিয়েছে তার অসংখ্য লোক। তেমনি অপর প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষও খুইয়েছে তাদের আপনজন, ভালোবাসার মানুষ।
ক্লেরিকুজিও উত্থানের পরবর্তী সময়ের ঘটনা। প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠীর প্রধান ছিলেন ডন পিয়েত্রো ফোরলেঞ্জার। ক্লেরিকুজিও গোষ্ঠীর সাথে দীর্ঘ বিবাদ ফ্যাসাদের মধ্য দিয়ে ফোরলেঞ্জার পঁচাশিটি বছর অতিবাহিত হয়। এ বয়সে এসে তিনি পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েন। সময় তার শেষ হয়ে এসেছিল। চিকিৎসকও তার জীবনের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিলেন বড়জোর এক সপ্তাহ বাঁচবেন তিনি। এক সময়ের প্রচণ্ড দাপটে ফোরলেঞ্জার শেষ দিনগুলো কাটবে কেবল বিছানায় শুয়ে থেকে তাও আবার চিকিৎসকের বেঁধে দেয়া সময়ের প্রহর গুনতে গুনতে। অসহায়ের মতো শুধু স্মৃতি হাতড়ে বেড়ানো ছাড়া কিই বা করার আছে তার?
কিন্তু এক সপ্তাহ অর্থাৎ সাতটি দিনও যেন অনেক বেশি মনে হলো প্রতিদ্বন্দ্বী ক্লেরিকুজিও’র লোকজনের। ফোরলেঞ্জার অসহায়ত্বের সুযোগ নিল তারা। আকস্মিক ক্লেরিকুজি ওর লোক তার শয্যাকক্ষে প্রবেশ করে ফোরলেঞ্জাকে আতঙ্কিত করে তুলল। তারপর আঘাতের পর আঘাত করে নির্মম মৃত্যু উপহার দিল। এ সময় অসহায় অবস্থা পক্ষাঘাতগ্রস্ত বৃদ্ধ ফোরলেঞ্জা আত্মরক্ষায় কেবল যন্ত্রণাকাতর চিৎকারই দিতে পেরেছিলেন এর বেশি কিছু নয়। তারপর চিরদিনের জন্য বিদায়।
ডন ডোমেনিকো ক্লেরিকুজিও প্রায়ই এই পুরনো গল্পের অবতারণা করতেন। এই হত্যাকাণ্ডকে তিনিও মন থেকে সায় দিতে পারেননি কোনো দিন। তিনি বলতেন, সেকালের হত্যাকাণ্ডের ধরন ছিল অত্যন্ত নির্মম ও বোকার মতো। একথা বলে তিন মূলত বোঝাতে চাইতেন– অসহায়ের ওপর আক্রমণ বা হিংস্রতা সম্পূর্ণরূপে বৃথা-দম্ভ মূল্যহীন বীরত্বের অহং। অস্ত্রের ব্যবহার ছাড়া কোনো আক্রমণেরই মূল্য নেই- এটা সবসময়ই একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত।
ডন ডোমেনিকো ক্লেরিকুজিও আসলে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, তৎকালীন ক্লেরিকুজিওদের এমন বৃথা দম্ভের নীতিই তাদের পতন ঘটিয়েছিল।
ইতালিতে মুসোলিনি ও তার ফ্যাসিবাদী সংগঠনগুলো পূর্ণ ক্ষমতায় আসার পর তারা বুঝতে পেরেছিলেন সর্বপ্রথম মাফিয়াদেরই ধ্বংস করতে হবে। এই পরিকল্পনার বাস্তবায়ন করতে তারা কিছু আইনের পরিবর্তন করেন এবং অত্যন্ত শক্তিশালী সশস্ত্র বাহিনী নামিয়ে দেয়া হয়। যার ফলে মাফিয়াদের মেরুদণ্ড নড়বড়ে হয়ে যায়। শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর তুমুল অভিযানে হাজার-হাজার নিরপরাধ মানুষকেও মূল্য দিতে হয়। অনেকেই কারাবরণ করে, আবার মাফিয়াদের সাথে নির্বাসনে যেতে হয় অনেককে, অনেকের মৃত্যুও হয়।
মুসোলিনির কৌশলে ইতালির মাফিয়া সংগঠনগুলোর বিনাশ ঘটলেও একমাত্র ক্লেরিকুজিও গোষ্ঠীটি ফ্যাসিবাদী আইন ও এর সেনা মোতায়েনের বিষয়টিকে মেনে নিতে পারেনি। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে তারা শুরু করে প্রচণ্ড বিদ্রোহ। স্থানীয় ফ্যাসিস্ট নেতাদের একে একে হত্যা করতে থাকে, ফ্যাসিস্ট গ্যারিসনে হামলা চালায়। ক্লেরিকুজিওদের এমন তৎপরতাকে আরো প্রবল করে মুসোলিনি। পালামোতে দেয়া এক ভাষণে তিনি বলেন, ইংল্যান্ড থেকে আমদানি করা তার বোলার হ্যাট ও ছাতা চুরি করে নিয়েছে এই দস্যুরা।
মাফিয়াদের দমন করতে এটি ছিল সে সময় মুসোলিনির অত্যন্ত ফলপ্রসূ রটনা ও একই সাথে অবমাননাকর উক্তি। অবশ্য এর জন্য মুসোলিনি বেশ হাস্যাস্পদ হয়েছিলেন সিসিলিতে, তবে তাদের ধ্বংসের সূত্রপাতও হয়েছিল এ থেকে। এর পরপরই সিসিলি প্রদেশে সশস্ত্র বাহিনী ব্যাপক অভিযান শুরু করে। এ অভিযান ঠেকাতে ক্লেরিকুজিও গোষ্ঠীর পাঁচ শতাধিক সদস্যের মৃত্যু ঘটে। আরো প্রায় পাঁচশ সদস্য ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী একটি অনুর্বর অঞ্চলে নির্বাসনে যেতে বাধ্য হয়। পরবর্তীতে সে অঞ্চলকে দণ্ডিত অরাধীদের উপনিবেশ পেনাল কলোনি হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়।
সেই অভিযানে প্রচণ্ড ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়েও বেঁচে যান শক্ত প্রাণের ক্লেরিকুজিও। তার পরিবারের কয়েক সদস্যও একই সাথে রক্ষা পায়। ক্লেরিকুজিও, তার সন্তান ডোমেনিকো ক্লেরিকুজিও ও তার পরিবারের অন্যান্য সদস্য আমেরিকায় নিরাপদে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন।
কিন্তু যে মাফিয়া ডন ক্লেরিকুজিও’র রক্ত ডোমেনিকোর শরীরে সে কি এত সহজে ছাড়তে পারে পরম্পরা? ডোমেনিকো ক্লেরিকুজিও’র রক্তও পূর্বপুরুষের ধারাতেই আত্মপ্রকাশ করল। আমেরিকায় সে গড়ল তার আপন সাম্রাজ্য। পূর্বপুরুষর ঘটনা, ইতিহাস ঘাত-প্রতিঘাতের অভিজ্ঞতায় ডোমেনিকো ক্লেরিকুজিও হলেন আরো ধূর্ত, আরো কৌশলী ও শক্তিশালী। তবে তিনি মনে করতেন, আইন-শৃঙ্খলাহীন রাষ্ট্র সব সময়ই শক্রস্বরূপ, আর এদিক থেকে আমেরিকা তার পছন্দের। তিনি আমেরিকা ভালোবাসেন।
আমেরিকান বিচারকদের উদ্দেশে তিনি একটি প্রবাদ বাক্য প্রায়ই বলতেন। একজন নিরপরাধী ব্যক্তির শাস্তি হওয়ার চেয়ে একশ অপরাধীর মুক্তি দেয়া ভালো। সুন্দরের কাছে আঘাত ম্লান আসলে ক্লেরিকুজিও একজন উদ্দীপনাময় দেশপ্রেমিক হয়ে ওঠেন। আমেরিকাকে তিনি নিজের দেশ হিসেবেই মনে করেন– আমেরিকার বাইরে কোনো দেশের প্রতিই তার কোনো আগ্রহ নেই। আমেরিকার প্রতি ভালোবাসায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ক্লেরিকুজিও সেই ছেড়ে আসা পূর্বপুরুষের দেশ সিসিলির চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন ও খাঁটি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। সে দেশের সব রাজনৈতিক ও বিচার বিভাগের বিভিন্ন সংস্থাকে ক্লেরিকুজিও প্রচুর অর্থ দিয়ে বন্ধুত্ব নিশ্চিত করতে সমর্থ হন।
ব্যবসায় ডন কখনো একটি কিংবা দুটি ক্ষেত্রে সন্তুষ্ট ছিলেন না। আমেরিকা জুড়ে সবচেয়ে উন্নত ব্যবসাগুলোয় তিনি সরাসরি অন্তর্ভুক্ত হন। বিভিন্ন কনস্ট্রাকশন ইন্ডাস্ট্রি, পরিত্যক্ত যন্ত্রাংশের পুনর্গঠন, বিভিন্ন পরিবহন ব্যবস্থায় ডন সহজাত অংশীদারিত্ব গ্রহণ করেন। তবে তার এসব ব্যবসার চেয়ে গ্যাম্বলিং থেকে আয় এর বহুগুণ। এটা ছিল ডনের ভালোবাসা। পাশাপাশি মাদকদ্রব্যের ব্যবসা থেকেও জুয়ার চেয়ে কোনো অংশেই কম আসত না। তবে এক্ষেত্রে খুব একটা আস্থা ছিল না তার। জুয়ার প্রতি ভালোবাসার কারণেই ডন পরবর্তীতে তার পরিবারের লেকজনকেও এতে জড়িত হতে সম্মতি দিয়েছেন। ক্লেরিকুজিও এই ক্ষেত্রটি থেকে নিতেন মাত্র পাঁচ শতাংশ।
আমেরিকায় ডন সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পঁচিশ বছরে ক্লেরিকুজিও’র পরিকল্পনা ও স্বপ্ন সত্য হতে শুরু করে। গ্যাম্বলিং আমেরিকায় এখন প্রতিষ্ঠিত, ক্রমেই বৈধতা পেতে শুরু করেছে। এটা এখন সবারই শ্রদ্ধার এবং সবার কাছেই এর গুরুত্বও বাড়তে শুরু করেছে দিন দিন। এমনকি সরকারও অনেক সময় লটারির মাধ্যমে গ্যাম্বলিংয়ে উৎসাহিত করছে। তবে এক্ষেত্রে পুরস্কার দেয়া হচ্ছে একে একে টানা কুড়ি বছর ধরে। যার ফলে মোটের ওপর কোনো অর্থ দিতে হচ্ছে না আয়োজক প্রদেশগুলোর কর্তৃপক্ষকে। তবে মোট পরিমাণ অর্থের সুদের ওপর নামমাত্র একটা কর প্রদান করতে হয়। ট্যাক্স ফাঁকি দেয়ার এ এক মজার জুয়া। ডন ডোমেনিকো এ বিষয়ে খুঁটিনাটি সবই জানেন। কারণ তার পরিবারের কেউ এমনই এক প্রতিষ্ঠানের একটির মালিক। এ কোম্পানি বিভিন্ন রাজ্যে দীর্ঘদিন ধরে সফলতার সাথে লটারি পরিচালনা করে আসছে। ডন সেখান থেকেই জেনেছেন সব।
অন্যান্য স্পোর্টসের ওপর জুয়া যখন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বত্রই প্রায় প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, ডন তখন গ্যাম্বলিংকে শুধুমাত্র নাভাদায় বৈধ প্রতিষ্ঠা দিতে সক্ষম হয়েছেন। তবে তিনি জানেন নাভাদার গ্যাম্বলিং বিভিন্ন স্পোর্টসের ওপর গ্যামলিংয়ের চেয়ে পৃথক। কোনো ফুটবল ম্যাচের ওপর জুয়ার দান ধরে একদিনে বিলিয়ন ডলার আয় হতে পারে তবে তা মাত্র একদিনের জন্য। ডনের গ্যাম্বলিং বৈধতা পেলে এমন আয় হতে পারে প্রতিদিন। ডন জানেন গ্যাম্বলিং গোটা যুক্তরাষ্ট্রে বৈধতা একদিন পাবে অবশ্যই হয়তো সেই সোনালি দিন পর্যন্ত তিনি এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকবেন না। তবে তার পরবর্তী প্রজন্ম উপভোগ করবে নিঃসন্দেহে।
রেনেসাঁ যুগের প্রিন্সের সাথে ডন ক্লেরিকুজিও’র তুলনা করা চলে নির্দ্বিধায়। ১৪শ থেকে ১৬শ শতাব্দী পর্যন্ত ইউরোপের শিল্প ও সাহিত্যের যে পুনভুদয় ঘটিয়েছিলেন সে সময়ের শ্রদ্ধাভাজনরা। যার জন্য আজও তারা স্থান পেয়েছেন ইতিহাসে। শ্রদ্ধায় যাদের জন্য আমাদের এখনও মাথা নত হয়ে আসে, ঠিক তেমনি নিশ্চিতভাবেই ডনও একটি সভ্য সমাজের সভ্য এই সারা পৃথিবীর দ্রষ্টা। গাছ যেমন ফুলের সৌরভে মানুষকে মাতিয়ে রাখো ফল দেয়, ছায়া দেয়, তেমনই বৃক্ষের সহস্র বীজ ডন এ পৃথিবীতে বুনে যাচ্ছেন। একে একে এসব গাছ বড় হবে– ফুল দেবে, ফল দেবে, ছায়া দেবে– এসব বীজ বিনষ্ট হবে না কখনো।
.
যদি পুরো আমেরিকায় মাফিয়া সম্রাটদের পবিত্র চার্চ হিসেবে ক্লেরিকুজিও ফ্যামিলিকে গণ্য করা হয়ে থাকে তবে সে চার্চের ডন ডোমেনিকো ক্লেরিকুজিও হচ্ছেন পোপ। তার এই খ্যাতি শুধু তার বুদ্ধিমত্তার জন্য নয়, তার দৃঢ়তার জন্যও।
ডন ক্লেরিকুজিও তার দৃঢ় নৈতিকতার জন্য তার পরিবারের কাছেও সমান শ্ৰদ্ধার। পরিবারের প্রত্যেকটি পুরুষ, মহিলা এবং শিশু তার যে কোনো নির্দেশের প্রতি দায়িত্বশীল। যে কোনো ব্যাপারে অনুশোচনাই হোক, বাধ্যবাধকতাই হোক কিংবা বৈরী পারিপার্শ্বিকতা হোক– ডনের আদেশের প্রতি অনুগত হতেই হবে। যদি কেউ তার বিরোধিতা করতে চায় তবে সে কথাগুলো কেবল বাতাসেই উড়ে বেড়াবে। ডন ঘৃণা করেন সমাজবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞানের মতো যত বিষয়। তিনি একজন গোঁড়া ক্যাথলিক– তার বিশ্বাস, কর্মের ফল পেতে হবে এ পৃথিবীতেই, আর ক্ষমা, এর পর। তিনি বিশ্বাস করেন, সবাইকে তাদের ঋণ শোধ করে যেতে হবে এবং বিশ্বে তার বিচারে তিনি অত্যন্ত কঠোর।
তার আনুগত্য প্রথমেই তার প্রতি, যার রক্ত শরীরে প্রবহমান। দ্বিতীয়ত, তার প্রভুর প্রতি (তিনি কি তার বাড়ির নিজস্ব প্রার্থনালয়ে অবস্থান করছেন না?) এবং তৃতীয়ত, ক্লেরিকুজিও ফ্যামিলি যে ভূখণ্ডে বর্তমানে সমস্ত বাধ্যবাধকতার শিকার এটি হতে পারে তার সমাজ, সরকার, সর্বোপরি দেশ।
ডন ক্লেরিকুজিও সিসিলিতে জন্মগ্রহণ করেন যেখানে সমাজ ও সরকার ছিল পরস্পরের শত্রু। তার মুক্তচিন্তার ধারণাটি বেশ পরিষ্কার- কেউ তার রোজগার, আয়ের জন্য মর্যাদা ও আশা বেচে তার ইচ্ছা পূরণ করতে পারে। অপরদিকে শ্রদ্ধার সাথে, মর্যাদার সাথে পূরণ করতে পারে তার রোজগার চাহিদা।
ডন প্রায়ই বলেন, তোমার পরিবার হচ্ছে তোমার সমাজ, তোমার প্রভু তোমার ফলদানকারী এবং তোমার অনুসরণকারী তোমাকে রক্ষা করবে।
ডন তার সাম্রাজ্য শুধু এই জন্য প্রতিষ্ঠা করে নি যে তার সন্তান এবং নাতি-নাতনিরা কেবল তা ভোগ করবে এবং মানবতাবোধ থেকে সরে আসতে থাকবে কিংবা একসময় পরিবারের কোনো অস্তিত্বই থাকবে না। ডন এমনভাবে তার সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছেন যেন তার ফ্যামিলির নাম এবং ভাগ্য চার্চের মতোই মানুষের মনে পবিত্রতার সাথে ঠাই পাবে। তিনি ভাবেন রুটি রোজগার ছাড়া এই বিশ্বে আরো অনেক কিছু করার আছে মানুষের, যা পরবর্তীতে (মৃত্যুর পর) যাবতীয় অপরাধের ক্ষমার জন্য নিজেকে উপস্থাপন করবে ঈশ্বরের কাছে।
ডন ডোমেনিকো তার পরিবারকে ক্ষমতার শীর্ষে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন। এর জন্য তাকে হতে হয়েছে কখনো বর্গিয়ানের মতো হিংস্র এবং ম্যাকিয়াভেলির মতো সূক্ষ্ম। সেই সাথে আমেরিকান বিজনেস সম্পর্কে ব্যাপক জ্ঞান অর্জন করতে হয়েছে তাকে। তব এত সব কিছুর পরও তাকে তার অনুসারীদের ভালোবাসতে হয়েছে বাবার মতো। পুণ্য করলে তার ফলও ভোগ করা যায় আর পাপে করতে হবে প্রায়শ্চিত্য এটাই সত্য, জীবনের পরম বাস্তবতা।
অবশেষে ডনের পরিকল্পনায় দেখা গেল ক্লেরিকুজিও ফ্যামিলি ক্ষমতার এমন এক পর্যায়ে উঠে এসেছে, সেখান থেকে আর কোনো অপরাধের সাথে তাদের জড়িত থাকা সম্ভব নয়, কেবলমাত্র ভয়াবহ ঘটনার সম্মুখীন না হওয়া পর্যন্ত। তবে ক্লেরিকুজিও সাম্রাজ্যের মাফিয়া প্রধান যেমন ব্যায়রন কিংবা ব্ৰুগলিওনরা (ইতালীয় শব্দ) ডনের যে কোনো বিপদে পাশে এসে দাঁড়াবে। এটাও ডনেরসুদূর প্রসারী পরিকল্পনার ফল। এর জন্য ডন সমস্ত মাফিয়া প্রধানদের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছেন, তাদের জেল থেকে মুক্ত করেছেন, ইউরোপে অনেকের প্রাপ্ত অবৈধ অপরাধের নিশ্চিত শাস্তি থেকে মুক্ত করেছেন, আমেরিকায় সমঝোতার মাধ্যমে তাদের মাদক চোরাচালানের নিরাপদ পথ তিনি অনায়াসেই তৈরি করেছেন মাফিয়া দলগুলোর জন্য। পৌর এলাকাতেও তাদের ঠাঁই হয়েছে বিনা বাধায়।
ডন ফ্লেরিজিওর জ্যেষ্ঠ পুত্র জর্জিও একজন অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ। বর্তমানে ফ্যামিলির অন্যতম ক্ষমতাবান। কালো টাকাকে সাদা করার পদ্ধতি যেন তার নখদর্পণে। একাজ সে এমন ভাবে করে থাকে যেন কোনো স্বর্গীয় ধোপা টাকাগুলো ক্রমেই ধুয়ে দিচ্ছে আর তা বৈধ ও সভ্যতার কল থেকে কেবল বেরিয়েই যাচ্ছে। এই হচ্ছে জর্জিও, যে তার বাবার সাম্রাজ্যকে বাবার পরিকল্পনানুসারে নিয়ন্ত্রণের জন্য সদাসচেষ্ট। সবচেয়ে বড় কথা, ক্লেরিকুজিও ফ্যামিলির ওপর জনগণের তীক্ষ্ণ ও অশুভ দৃষ্টি এড়ানোর জন্য জর্জিও কঠোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আর এ কারণেই ফ্যামিলির অস্তিত্বও বহাল রয়েছে গতানুগতিক। ফ্যামিলির ওপর অনবরত তীক্ষ্ণদৃষ্টি, অপবাদ, ফ্যামিলিকে ঘিরে ভয়াবহ ও বিপজ্জনক যেসব তৎপরতা চলছে তা অত্যন্ত সফলতার সাথেই মোকাবেলা করছে জর্জিও। পাশাপাশি ফ্যামিলির একটা সুখ্যাতি প্রতিষ্ঠাতেও সে সম্পূর্ণ সফল।
ক্লেরিকুজিও ফ্যামিলির গাঁথা-গল্প-অপরাধের ঘটনা এফবিআই কিংবা পুলিশের নথিতে একের পর এক যুক্ত হলেও সংবাদ মাধ্যমে তা কখনোই প্রকাশ হয়নি। এমনকি সেসব সাহসী প্রকাশনা বা ম্যাগাজিনেও এই পরিবারকে নিয়ে কখনো দুকলম লেখা হয়নি। এই সংস্থাগুলো অবশ্য আমেরিকার অন্যান্য মাফিয়া দলের বিরুদ্ধে বিস্তর লিখেছে। যারা এই মাধ্যম এবং পুলিশকে মোটেও পাত্তা দেয়নি তাদের অবনতিই হয়েছে। অথচ জর্জিও’র মেধা, কৌশল ফ্যামিলিকে রেখেছে নিরাপদে।
তাই বলে ক্লেরিকুজিও ফ্যামিলি যে দাঁতহীন বাঘ এটা মনে করা হবে বোকামি। জর্জিও’র ঘোট দুভাই ভিনসেন্ট এবং পেটি– এরা বড় ভাইয়ের মতো চালাক না হলেও, ডনের রক্ত আছে তাদের শরীরে। ব্রঙ্কসের সীমাবদ্ধ গণ্ডীতে তারা পূর্ণ শক্তি নিয়ে বসবাস করছে। সর্বদা ইতালীয় সংস্কৃতিতে শক্তির সঞ্চয় হচ্ছে তাদের দিন দিন। ব্রঙ্কসের এই পরিসরটি দুভাইয়ের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এমন চল্লিশটি ব্লক যা যে কোনো পুরনো ইতালির সংস্কৃতির ওপর ছবি নির্মাণে সহায়ক পরিবেশ। সেখানে নেই কোনো দীর্ঘ দাড়িঅলা হাসিডিক ইহুদি, নেই কৃষ্ণাঙ্গ কিংবা এশীয়, অথবা নেই কোনো বোহেমীয় জাতির জনগণ নেই তাদের সাথে সম্পৃক্ত কোনো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান কিংবা লেনদেন। সেখানে কোনো চায়নিজ রেস্তোরাঁ নেই। ক্লেরিকুজিও ব্রঙ্কসের পুরো রিয়েল এস্টেট নিয়ন্ত্রণ করেন তার নিজ কর্তৃত্বে।
ছোটখাটো এই ইতালীয় উপনিবেশে দেখা যাবে ইতালীয় কিছু পরিবারের লম্বা চুলের তরুণ যুবক গিটার হাতে মেতে রয়েছে আপন উচ্ছলতায়। তবে খুব শিগগিরই ক্যালিফোর্নিয়ায় তাদের আত্মীয়-স্বজনের কাছে গছিয়ে দেয়া হবে। প্রতি বছর ইতালির সিসিলি থেকে ক্লেরিকুজিও ফ্যামিলির পরিধি বৃদ্ধি করতে নতুন নতুন পরিবার আসছে সতর্কতার সাথে তাদের অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে ক্লেরিকুজিও সাম্রাজ্যের কোনো আস্তানায়। সারা বিশ্বে ব্রঙ্কস এনক্লেভ ঘিরে রয়েছে হাজারো অপরাধের গুঞ্জন, কিন্তু এই ব্রঙ্কস এনক্লেভে বিন্দুমাত্র অপরাধ সংঘটনের নজির নেই ব্রঙ্কস এনক্লেভ সদা পবিত্র, যেন শান্তির স্বর্গধাম।
পিপি ডি লিনা ব্রঙ্কস এনক্লেভের মেয়র থেকে লাস ভেগাসে ক্লেরিকুজিও ফ্যামিলির ব্রুগলিওন হিসেবে নিযুক্ত হয়েছে। কিন্তু তারপরও সে ক্লোরিকুজিওর সরাসরি নির্দেশের অনুগত। তাকে এখনো ডনের বিশেষ মেধার ওপর নির্ভর করে থাকতে হয়।
তবে পিপি ব্রুগলিওন হিসেবে অত্যন্ত যোগ্য। তার ক্ষমতা গ্রহণের পর্বটিও শুরু হয়েছে সময়ের চেয়ে একটু আগেই- অর্থাৎ মাত্র সতেরো বছরে। যখন তার শরীরের গঠনও তেমন শক্ত হয়নি তখন থেকেই পিপি ক্লেরিকুজিও’র ক্ষমতার ছোটখাটো ছটা পেতে শুরু করে।
পিপি শারীরিকভাবে বেশ শক্ত-সামর্থ্য, তার উচ্চতা ও গঠন যে কোনো লোকের সমীহ আদায় করার মতো। সেই সাথে অবশ্যই তার এক্সপ্লোসিভ ও আগ্নেয়াস্ত্র চালনায় রয়েছে নিখুঁত দক্ষতা। জীবনকে উপভোগ করার মতো প্রাণশক্তি ও উচ্ছলতা পিপির যেন সহজাত। মানুষ মুগ্ধ হয় তার এই প্রাণময়তায়, তার সাহসিকতায় অভিভূত হয় নারী। এদের মধ্যে সেই সিসিলীয় বংশোদ্ভূত মানুষই হোক কিংবা আমেরিকার মুভি তারকা। কাজের প্রতি পিপি অত্যন্ত একনিষ্ঠ, কিন্তু তা সত্ত্বেও সে বিশ্বাস করে জীবনটা আনন্দের, উপভোগের।
পিপির দুর্বল দিকগুলোর মধ্যে অতিরিক্ত মদপান আর নিয়মিত গ্যাম্বলিং— নারীর প্রতি রয়েছে তার অতিমাত্রায় দুর্বলতা। এসব কারণে ডন যে তাকে সর্বদা প্রশ্রয় দিয়ে থাকেন তা নয়– তবে পিপির এই উচ্ছল জীবনে খুব একটা অন্যায় হয়ে দাঁড়াল না ডন। পিপির এসব দুর্বল দিক তাকে কখনো সমস্যায় ফেলেনি বরং তাকে করেছে আরো শক্তিশালী, আরো বলবান।
তার প্রাণময়তা, উপভোগের জীবন তাকে ক্যরিয়ার গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে, কারণ সে ডনের ভগ্নীপুত্র। সে হচ্ছে রক্তের এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো পিপি ফ্যামিলির ঐতিহ্য ভঙ্গ করে দিয়েছে নতুন দিকের সূচনা।
প্রত্যেক মানুষের জীবনেই থাকে কিছু কিছু ভুল। পিপির জীবনও বাদ যায়নি। তার যখন কুড়ি বছর বয়স সে প্রেমে পড়েছিল বিয়েও করেছিল সেই প্রেমিকাকে। তবে সে মেয়ে ছিল পিপি ডি লিনার মতো একজন যোগ্য ছেলের সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত।
ন্যালিনি জেসাপ ছিল লাস ভেগাসে জানা হোটেলের একজন সামান্য ড্যান্সার। পিপি ন্যালিনি সম্পর্কে প্রায়ই গর্ব করে বলে, সে কোনো শো-গার্লের মতো তার শরীর প্রদর্শন করে না। ভেগাস স্ট্যান্ডার্ডে ন্যালিনি বেশ বুদ্ধিমতী নারী। বইপড়ুয়া মেয়ে, রাজনীতিতে তার রয়েছে আগ্রহ। সবচেয়ে বড় কথা হলো, ন্যালিনি ক্যালিফোর্নিয়া পুরনো দিনের স্যাকরামেন্টো ওয়াসপ সংস্কৃতির একটি মেয়ে তার গোড়াপত্তনও সেখানেই।
পিপি ও ন্যালিনির মধ্যে পার্থক্য ছিল বিস্তর– দুজন যেন দুই মেরুর। পিপির পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ ছিল না তেমন। কদাচিৎ সে বইয়ে চোখ বুলাত। গান-বাজনা, নাটক-থিয়েটারের প্রতিও তার খুব এটা আগ্রহ নেই। পিপি যেন একটা ঝাড়ের মতো, অপরদিকে ন্যালিনি একটি ফুল। পিপি উচ্ছল, প্রাণবন্ত, কখনো ভয়ঙ্করও, বিপরীতে ন্যালিনি স্বভাবগত নম্র, ভদ্র। ন্যালিনির সাথে কখনোই তার সহকর্মী শোগার্ল কিংবা ড্যান্সারদের বিবাদ হয়নি। বরং সহকর্মীদের সাথে তার রয়েছে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক অবসর সময়ে তারাই ন্যালিনির ভালো সঙ্গী।
একটি বিষয়ে ন্যালিনির সাথে পিপির মিল রয়েছে বেশ। সেটি হলো ড্যান্স। পিপি ডি লিনার ক্ষেত্রে ড্যান্সেও রয়েছে ডন ক্লেরিকুজিও’র নেতিবাচক মনোভাব। তবে পিপি যখন বলরুমে ড্যান্সের উদ্দেশ্যে নেমে পড়ে, তখন ভুলে যায় সব। এই একটি মাত্র ক্ষেত্রে পিপি নিজেকেও ঠিক বুঝতে পারে না। ড্যান্স যেন তাকে টানে এক অদৃশ্য ভালোলাগায়। অথচ কবিতা, গান, সাহসিকতা, স্নেহশীলতা, যৌনাচারে সূক্ষ্ম বিশুদ্ধতা– এমন যে কোনো বিষয়েই পিপি নিজেকে অনায়াসেই সংযত রাখতে পারে।
ন্যালিনি জেসাপের ক্ষেত্রে এই ড্যান্স তার অন্তরতম আত্মায় আলোর ঝলক ফেলে। অভাবনীয় সুখ পায় ন্যালিনি যখন পিপির সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে ঘণ্টাব্যাপী নাচতে থাকে। এই ঘনিষ্ঠতা তাদের মধ্যে তৈরি করে ভালোবাসার আবেগ উভয়ের যৌন সম্পর্কে তৈরি হয় স্বর্গীয় সেতুবন্ধন দুজনের মাঝে সহানুভূতির আত্মিক সম্পর্কের যোগাযোগ শুরু হয়। এই স্বর্গীয় সুখের সময়টুকুতে তারা চোখে চোখে, কথার মাধুরীতে মেতে ওঠে। এই সময়টি আসে কখনো ন্যালিনির অ্যাপার্টমেন্টে অথবা ভেগাসে হোটেলের কোনো ড্যান্স ফ্লোরে।
খুব গুছিয়ে গল্প করতে পারে পিপি এবং তার ভাণ্ডারও বেশ সমৃদ্ধ। ন্যালিনির প্রতি তার আবেগ ব্যক্ত করতে, ন্যালিনির ভক্তি কুড়াতে পিপি মাঝে মাঝেই হয়ে ওঠে একজন তোষামোদকারী হয়ে ওঠে একজন রসিক প্রেমিক। ন্যালিনি যখন কিছু বলে পিপি মুগ্ধ হয়ে শোনে। ন্যালিনির কোলে মাথা রেখে পিপির চোখ দুটো নিবদ্ধ হয় তার চোখে আগ্রহ নিয়ে শুনতে থাকে। যখন ন্যালিনি তাকে বইয়ের কোনো কথা শোনায়, থিয়েটারের গল্প বলে, রাজনীতির কথা বলে, বলে গণতন্ত্রের উত্থানের কথা, কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার আদায়ের কথা, দক্ষিণ আফ্রিকার চলমান যুদ্ধের কথা, এমনকি তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোর অভাবপীড়িত, দুর্গত মানুষের কথা পিপি তখন মনে মনে গর্ববোধ করে স্ত্রীর অসীম জ্ঞান ও বুদ্ধির জন্য। পিপি ন্যালিনির কথায় রোমাঞ্চ বোধ করে, যা এতদিন অবধি পিপির জন্য ছিল কেবল বাইরের বিষয়।
পিপি ও ন্যালিনির মধ্যে ভাবের এই আদান-প্রদানে উভয়ে উভয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয়, ভালোবাসার সম্পর্ক হয় আরো দৃঢ় উভয়ের মধ্যে যৌন সম্পর্কের সূত্রপাতও হয় এ থেকে। এ থেকে ন্যালিনি কেবল বুঝতে পারে একজন সুন্দর মনের প্রেমিককে, তার ভালোবাসার মানুষ স্বামী পিপিকে। সত্যিকারের আরেক ভুবনের পিপি ন্যালিনির কাছে রয়ে যায় আবৃত। ন্যালিনি শুধু বুঝতে পারে তার স্বামী তাকে কত ভালোবাসে, যে তার জীবনের উৎকৃষ্ট উপহারস্বরূপ।
ন্যালিনির যখন মাত্র আঠারো বছর তখন তাদের বিয়ে হয়। বিয়ের প্রায় এক সপ্তাহ পর তারা মিলিত হয়েছিল। ন্যালিনি অবশ্য তখন পিপি সম্পর্কে তেমন কিছুই জানত না। পিপির বয়স ছিল আটাশ এবং সত্যিই যে সে ন্যালিনিকে ভালোবাসত– একটুকুই বুঝত ন্যালিনি। ন্যালিনিকে বিয়ের পর পিপিও ক্রমে সেই পুরনো সংস্কৃতির মূল্যবোধে বেড়ে উঠতে থাকে। তারা উভয়েই একটি পরিবারে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে।
ন্যালিনি ছিল অরফ্যানের, অপরদিকে পিপি ক্লেরিকুজিও পরিবারের হলেও ন্যালিনির সংস্পর্শে তার ভালোবাসায় ক্রমেই হারিয়ে গিয়েছিল– ক্লেরিকুজিও বিমুখ হয়ে উঠেছিল। তাকে বিয়ে করে পিপি বুঝতে পেরেছিল তাদেরকে ক্লেরিকুজিও পরিবার মেনে নেবে না। পরিবারের মুখোমুখি হওয়ার চেয়ে সেখান থেকে সরে আসাই সমীচীন মনে করে পিপি। গোপনে ভেগাসের এক প্রার্থনালয়ে তারা বিয়ে করে।
পিপির সমস্ত জল্পনা-কল্পনা, ভয় ও সন্দেহ দূর করে ক্লেরিকুজিও মেনে নেন তাদের। তিনি প্রায়ই একটি কথা বলতেন, একজন মানুষের প্রাথমিক কর্তব্যই হচ্ছে তার জীবনযাপনের জন্য নিজের রোজগারটুকুতে সক্ষম হওয়া। কিন্তু এর জন্য তার যদি না থাকে স্ত্রী কিংবা পুত্র?– এমন প্রশ্নে ডন বেশ অসম্মানবোধ করতেন। তিনি কখনোই এমন পরামর্শ দেননি যে, ক্লেরিকুজিও পরিবারে স্বাধীন বিয়েকে মেনে নেয়া হবে না। মোটের ওপর পিপির শরীরেও ছিল ক্লেরিকুজিও ধারার রক্ত।
পিপি-ন্যালিনির বিয়ে মেনে নিলেও মন থেকে সায় দিতে পারেনি ডন ক্লেরিকুজিও। তিনি যে তাদের বিয়েতে সন্তুষ্ট ছিলেন না তা তার খুঁতখুঁতে কিছু মন্তব্য থেকে বোঝা যায়। তিনি বলতেন তারা সাগরের তলদেশে গিয়ে যেন নেচে বেড়ায়। তা সত্ত্বেও ডন ক্লেরিকুজিও তাদের বিয়ে উপলক্ষে দিয়েছিলেন মুক্ত হস্তে অঢেল। ডন একটি কোম্পানির মালিকানা দিয়েছিলেন পিপিকে তাদের বিয়ে উপলক্ষে যা থেকে প্রতি বছর আয় ছিল এক লাখ ডলার। এই আয় পিপির সে সময়ের সব আয়কে ছাড়িয়ে গিয়েছিল– এটা ডনের দৃষ্টিতে পিপির পদোন্নতি। তবে পিপি পশ্চিমে ক্লেরিকুজিও পরিবারের ব্রুগলিওন হিসেবে বহাল ছিল আগের মতোই। এক্ষেত্রে তার পদবির কিংবা দায়িত্বের কোনো হেরফের হয়নি। তাকে ব্রঙ্কস এনক্লেভ থেকে কেবল সরে যেতে হয়েছিল।
ব্রঙ্কস এনক্লেভে পিপিকে ছেড়ে যেতে হয়েছিল শুধু ন্যালিনি জেসাপকে বিয়ে করার জন্য। ব্রঙ্কস এনক্লেভে ন্যালিনি একজন বিদেশিনী, এজন্য ভিন্ন গোত্রের মানুষ– মুসলিম, কৃষ্ণাঙ্গ, ইহুদি এবং এশীয়দের মতোই তারও উপস্থিতি ব্রঙ্কস এনক্লেভে নিষিদ্ধ, যেন অচ্ছুত কোনো সম্প্রদায়। আর এ সম্প্রদায়ের জায়গা ক্লেরিকুজিও’র ইতালীয় উপনিবেশ ব্রঙ্কসে অন্তত নেই। ন্যালিনির কারণেই ক্লেরিকুজিও’র মুগুর হওয়া সত্ত্বেও, স্থানীয় একটি মাফিয়া দলের প্রধান ব্যারন হওয়া সত্ত্বেও পিপিকে হারাতে হয়েছে কুওগে তার স্বাভাবিক জীবনযাপন।
ডন শুধু তাদের বিয়ে উপলক্ষে যথাযথ পুরস্কার দিয়েই খালাস। এক্ষেত্রে তাদের বিয়েকে উৎসবমুখর করতে এগিয়ে এসেছিলেন জানাদু হোটলের মালিক, ডনের আরেক কাছের লোক আলফ্রেড গ্রোনিভেল্ট। পিপি-ন্যালিনির বিয়ে উপলক্ষে গ্রোনিভেল্ট তার হোটেলে আয়োজন করেছিলেন ছোট একটি ডিনার পার্টি। সে পার্টির অন্যতম আয়োজন ছিল বর ও কনের সৌজন্যে সারা রাত নাচের। এ থেকেই বছরখানেকের মধ্যে গ্রোনিভেল্টের সাথে পিপির তৈরি হয়েছিল অত্যন্ত সুসম্পর্ক তারা একে-অপরের শ্রদ্ধাভাজনও হয়ে উঠেছিলেন ক্রমেই।
পিপি-ন্যালিনির দীর্ঘ বৈবাহিক জীবনে এসেছে দুটি সন্তান– একজন ছেলে আর আরেকজন মেয়ে। ধর্মীয় বোধে উদ্দীপ্ত ককসিফিজিও পিপির জ্যেষ্ঠ পুত্র— ক্রস নামেই সে বেশি পরিচিত। তার যখন দশ বছর বয়স অবিকল সে দেখতে হয়েছিল তার মায়ের মতো। শরীরে ছিল লাবণ্য এবং আচার-আচরণে ছিল তার মেয়েলীপনা। এখন অবশ্য শারীরিক সৌষ্ঠব, সাহসিকতায় সে তার বাবার মতোই।
ক্রসের ছোট তার বোন ক্লডিয়া। নয় বছর বয়সে ক্লডিয়া পেয়েছিল বাবার চেহারা। তবে আচারে-গুণে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে মা ন্যালিনির মতো। বাবার চেয়ে মায়ের প্রতিই তার ভালোবাসা বেশি। মায়ের মতো বইপড়া, মিউজিক, থিয়েটারের প্রতি রয়েছে তার ভালোবাসা এবং মহানুভবতায়, তেজস্বীতায় ন্যালিনি জেসাপের মতোই তার চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। ক্রস যেমন তার বাবা পিপির ভক্ত, তেমনি অপরদিকে ক্লডিয়া তার মায়ের ভক্ত।
এগারো বছর আগেও ডি লিনা পরিবারটি ক্লেরিকুজিও পরিবার থেকে পৃথক হয়ে বেশ সুখে কাটাচ্ছিল জীবন। পিপি ভেগাসে ব্রুগলিওন হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলে, একই সাথে জানাদু হোটেলের কালেক্টরের দায়িত্বও পালন করতে থাকে; আর ডন ক্লেরিকুজিও’র মুগুর হিসেবে তো সে ছিলই। ধীরে ধীরে পিপি ধনী হয়ে ওঠে, জীবনযাপনে আসে উন্নতির ধারা– অবশ্য এর সবকিছুই ছিল ডনের বদৌলতে। তবে তার জীবনযাপন ঘিরে থাকে পরিবারের ছোঁয়া। মদপান আর জুয়া থেকে নিজেকে মুক্ত করতে না পারলেও তার সুখের জীবন অতিবাহিত হয় স্ত্রী ন্যালিনির সাথে নেচে, সন্তানদের সাথে খেলে। সন্তানদের মানুষ করতে পিপি ও ন্যালিনি আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যায়।
তবে সুখ যে মানুষের দীর্ঘস্থায়ী হয় না পিপি তা বেশ অনুধাবন করত। সে তার এতদিনের বিপদসঙ্কুল জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে জানতে পেরেছিল– সামনেও তার জন্য হয়তো অপেক্ষা করছে কোনো অপ্রীতিকর, অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। এর কারণ একমাত্র তার জীবনের সফলতা। আর তাই পিপি তার ছেলে ক্রসকেই অবলম্বন মনে করতে শুরু করল। সে মনে-প্রাণে আকাক্ষা করল তার ভবিষ্যৎ মানুষটিই যেন তার সহযোগী হয়ে ওঠে। অথবা সে ব্যতিক্রমও খুঁজতে থাকল এর এমন একজন মানুষ তার কাছে আকাক্ষিত হয়ে উঠল যার ওপর সম্পূর্ণরূপে আস্থা রাখা যায়।
এসব চিন্তা থেকেই পিপি ক্রসের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠল। শুরু হলো প্রশিক্ষণ পিপি তাকে শেখাল জুয়ার বিভিন্ন কলা-কৌশল, তাকে ঘনঘন গ্রোনিভেল্টের সাথে ডিনারে নিয়ে যেতে লাগল পিপি। গ্রোনিভেল্টের সংস্পর্শে নেয়ার উদ্দেশ্য ক্রস যাতে ক্যাসিনোর ব্যতিক্রমী ও বিভিন্ন ধারা গ্রোনিভেল্টের কাছ থেকে রপ্ত করতে পারে। গ্রোনিভেল্ট সবসময়ই ক্রসের জন্য ছিলেন মুক্ত। ক্রসকে তিনি বলতেন, প্রতি রাতেই হাজার হাজার লোক আমার ক্যাসিনোর সাথে প্রতারণা করতে জেগে বসে থাকে।
পিপির কাছ থেকে ক্রস শিখেছিল শিকারের কৌশল। শিখেছিল কিভাবে, কোন লক্ষ্যে আঘাত করলে জন্তু-জানোয়ার কুপোকাত হবে তাদের রক্তের গন্ধ সম্পর্কে ধারণা দিয়েছিল পিপি। বিভিন্ন জানোয়ারের রক্ত পিপি ক্রসের হাতে লাগিয়ে তাকে ধারণা দিয়েছিল। মুষ্টিযুদ্ধের প্রশিক্ষণও বাবার কাছ থেকে পায় ক্রস। বন্দুকের ব্যবহার এবং এর যত্নের কলা-কৌশল শিখিয়েছিল পিপি।
নেভেদার পার্বত্যাঞ্চলে ক্লেরিকুজিও ফ্যামিলির রয়েছে বিশাল হান্টিং লজ। ছুটির দিনগুলোতে পিপি ও তার পরিবার প্রায়ই বেড়াতে যেত। এ সময় ন্যালিনি যখন বইয়ের মধ্যে ডুবে থাকত তখন পিপি সন্তান দুটিকে নিয়ে মেতে উঠত শিকারের খেলায়। এসব শিকারে ক্রস এমনভাবে হাত পাকিয়ে নিয়েছিল যে, ভালুক, হরিণ এমনকি পাহাড়ি সিংহ কিংবা কোনো হিংস্র প্রাণী খুব সহজেই ধরাশায়ী হতে লাগল ক্রসের নিশানার কাছে। বাবা পিপি ডি লিনার ছেলের যোগ্যতায় ধীরে ধীরে আস্থা জন্মাতে লাগল। পিপি বুঝতে পারল ছেলের দৌরাত্ম্য। সেই সাথে বুঝল জন্তু-জানোয়ারের প্রতি তার যত্নবান। হওয়ার মনোভাবও। পিপির কাছে ক্রস যেন ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যেও শান্ত মস্তিষ্কের ছেলে– কোনো শিকারে ক্রস কখনোই উত্তেজিত নয়– অত্যন্ত ধীর ও লক্ষ্যে আঘাত হানতে বেপরোয়া মনোযোগ।
ক্লডিয়া ছিল এসবে একেবারেই আগ্রহহীন। বন্দুকের গুলি খেয়ে যখন কোনো হরিণ লাফিয়ে উঠত ক্লডিয়া যেন মর্মাহত হতো। এমনই কিছু অবসর যাপনে ক্লডিয়া আর তার বাবা-ভাইয়ার সাথে যেত না, বরং লজে মায়ের সাথেই বসে গল্প করে কাটত। ক্লডিয়ার মাছ ধরতেও ছিল আপত্তি।
পিপি ছেলের প্রতিই বেশি মনোযোগ দিতে শুরু করল। তাকে চরিত্রের মূল বিষয়গুলো শেখাত পিপি। ক্রসের উদ্দেশ্যে বলত– কখনো খুব সামান্যতেই রেগে যাবে না, আর নিজের সম্পর্কে কিছুই বলবে না কখনো। তোমার কাজের মাধ্যমেই তুমি আদায় করে নেবে অন্যের সমীহ, কথার মাধ্যমে নয়। সব সময় শ্রদ্ধা করবে তোমার রক্তের সম্পর্ককে। গ্যাম্বলিংকে কখনোই পেশা হিসেবে নয়, এটাকে মনে করবে তোমার শান্তি, বিনোদন হিসেবে। ভালোবাসবে তোমার বাবাকে, মাকে, বোনকে কিন্তু নিজের স্ত্রীর চেয়ে অন্য কোনো নারীর ভালোবাসায় থাকবে সদাসতর্ক। তোমার স্ত্রী, হতে পারে এমন একজন নারী যে তোমার সন্তানের জন্য বিরক্তিকর হয়ে উঠতে পারে– আর যদি তা তোমার ক্ষেত্রে হয়ই তবে তোমার জীবন হয়ে উঠবে দুর্বিষহ– তুমি ব্যর্থ হবে তাদের দুমুঠো খাওয়াতেও।
বাবার কথার অন্যথা করেনি ক্রস– পদে পদে সে মনে রেখেছে পিপির উপদেশ। ক্রসের সাথে তার মা ন্যালিনির চেহারার অদ্ভুত মিল থাকার কারণে পিপি ছেলেকে ভালোবাসে খুব। ক্রসের মাঝে ন্যালিনির উপস্থিতি খুঁজে পায় পিপি।
ক্লেরিকুজিও ফ্যামিলির পরবর্তী প্রজন্ম যে একটি বৈধ, আইনসম্মত সমাজের মধ্যে মিশে যাবে– ডন ক্লেরিকুজিও’র এমন স্বপ্নে পিপির কোনো বিশ্বাস নেই। এটা যে ভালো ফলাফলের দিগন্ত রচনা করবে- এমন বিশ্বাসও পিপি করে না কখনো। তবে সে বৃদ্ধদের অতিকৌশলী বুদ্ধিকে স্বীকার করে, তবে তা-ও কেবল গ্রেট ডন ক্লেরিকুজিও’র প্রতি। আসলে সব বাবাই চায় সন্তানরা যেন তাদের সাথেই কাজ করে, তাদের অনুসারী হয়ে ওঠে। রক্তের সম্পর্ক এক হবেই– এটা লঙ্ঘন করা যায় না— সত্য কথা।
আর এ ক্ষেত্রে পিপি তা সঠিক বলেই প্রমাণ করেছে। ডন ক্লেরিকুজিও’র দৃঢ় পরিকল্পনার পরও, তার আপন নাতি ডেন্টি তার নিজস্ব পরিকল্পনা প্রণয়নে ব্যস্ত। ফেলে আসা সিসিলীয় রক্তের দুরন্তপনার ধারা ডেন্টির শরীরে, ক্ষমতার জন্য ব্যাকুল। সে কখনো সমাজের ও ঈশ্বরের বিধি-বিধান লঙ্ঘনে ভীত নয়।
ক্রসের যখন সাত বছর বয়স এবং ক্লডিয়ার ছয়, ক্রস ছিল ছোটবেলায় বেশ আক্রমণাত্মক। ছোট বোন ক্লডিয়াকেও ছাড়ত না। পাঞ্চিংয়ের অভ্যাস করত ক্লডিয়ার পাকস্থলি বরাবর আঘাত করে বাবা-মার সামনেই সে এমন দুরন্তপনার সাহস দেখাত। ক্লডিয়া দক্ষ ভাইয়ের হাত থেকে বাঁচার জন্য কেঁদে ফেলত। ক্রসের এই আচরণকে দমন করতে পিপি তখন ভিন্ন কৌশলের আশ্রয় নিত।
ক্রসকে তার পাঞ্চিং অভ্যাস থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিত পিপি প্রথম। এতেও যদি ক্রস না থামত, তখন পিপি, তার ঘাড় ধরে শূন্যে ঝুলিয়ে রাখত– এমনটা প্রায়ই করত পিপি। অথবা ক্লডিয়াকে নির্দেশ দিত— যেভাবে ক্রস তাকে আঘাত করেছে, ঠিক সেভাবে ক্লডিয়া যেন আঘাত করে। ক্রসের জ্বালাতনে অতিষ্ঠ হয়ে পিপি তাকে ওয়ালে পাঞ্চ করার নির্দেশ দিত– এতে সে এক-দুবারের বেশি করতে পারত না। এক সময় সে ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত হয়ে পড়ত। কিংবা ন্যালিনি তাদের ওপর অতিষ্ঠ হয়ে কখনো রেগে উঠত। কিন্তু পিপি তখন একটি সিগারেট ধরিয়ে শান্ত কণ্ঠে ক্রসের উদ্দেশে বলত, সব সময় তুমি তোমার বোনকে মারছ। এবার থেকে তুমি তাকে যত মারবে ক্লডিয়া আমার কাছ থেকে ততবার একটি করে ডলার পাবে। এরপর ক্রস ক্ষেপে গিয়ে আবারো ক্লডিয়াকে আঘাত করতে শুরু করত, আর পিপি ক্লডিয়াকে সাথে সাথেই দিত একটি করে ডলার। অবশেষে হিংসায় হোক, কিংবা ক্লান্ত হয়ে ক্রস থামতে বাধ্য হতো।
উপহারে উপহারে ভরে দিয়েছিল পিপি তার স্ত্রীকে, কিন্তু সেসব উপহার যেন ন্যালিনিকে পরিণত করেছিল পিপির ক্রীতদাসীতে– পিপির হয়ে জীবন চলার পথে সেগুলো ছিল ছদ্মবেশ ধারণের উপকরণ। হিরের আংটি, পশুর লেসের মূল্যবান মোলায়েম কোট, ইউরোপ সফরসহ বিভিন্ন মূল্যবান উপহার ছিল ন্যালিনির জন্য অযাচিত। ভেগাস ন্যালিনির পছন্দ নয় বলে পিপি তার জন্য স্যাকরামেন্টোতে কিনে দিয়েছিল অবকাশ যাপনের একটি বাড়ি। আর সেই সাথে দিয়েছিল একটি গাড়িও। স্যাকরামেন্টোর বাড়িটিতে পিপি নিজেই শোফারের ইউনিফর্ম পরে স্ত্রী ন্যালিনিকে নিয়ে গিয়েছিল। বিয়ের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে পিপি তাকে দিয়েছিল বর্গিয়া কালেকশনের মূল্যবান একটি অ্যান্টিক রিং। এত কিছু দেয়ার পরও পিপি একটি বিষয়ে ছিল বেশ কৃপণ। পিপি ন্যালিনিকে কখনোই ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করতে দেয়নি।
এই একটি বিষয় ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে পিপির ছিল যথেষ্ট উদারতা– পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা ছিল ন্যালিনির। ইতালীয় স্বামীদের মতো পিপি স্ত্রীর প্রতি সন্দেহপ্রবণ ছিল না কখনোই। যদিও ব্যবসায়িক কাজে নিতান্ত প্রয়োজনে তাকে বিদেশে যেতে হতো, তবে তার মন পড়ে থাকত স্ত্রীর প্রতি প্রচণ্ড ভালোবাসায়। পিপি ছাড়া ন্যালিনি অবশ্য ইউরোপের বেশ কিছু দেশ ঘুরেছে– পিপি বাধা দেয়নি। সেসব সফরে ন্যালিনির সফরসঙ্গী হয়েছিল তার বান্ধবীরা। ন্যালিনির দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ছিল লন্ডনের মিউজিয়াম ঘুরে দেখার, প্যারিসের ব্যালে আরো ইতালির অপেরা উপভোগ করার। তার এসব স্বপ্ন, ইচ্ছা পিপি পূরণ করেছে দ্বিধাহীন।
পিপির মধ্যে স্ত্রীর প্রতি সন্দেহের বিন্দু-কণাও না পেয়ে অভিভূতই হয়েছিল ন্যালিনি। তবে কয়েক বছরের মধ্যেই ন্যালিনি এও বুঝতে পেরেছিল যে ভেগাসের এই পরিমণ্ডলে পিপিকে ছাপিয়ে কোনো লোকই তার প্রতি সহান ভূতি কিংবা ভালোবাসা জানাতে আসবে না। এমন কোনো মানুষ নেই সেই তল্লাটে যে এমনকি পিপির স্ত্রীর বন্ধুও হতে পারে।
পিপি-ন্যালিনির বিয়ে এবং তাদের দীর্ঘ দাম্পত্য জীবন নিয়ে উন ক্লেরিকুজিও ছিলেন সন্দিহান। তিনি একবার মন্তব্য করেছিলেন, তারা কি মনে করে যে তাদের সারাটা জীবন নেচে নেচেই কাটিয়ে দিতে পারবে?
এ প্রশ্নের প্রমাণিত উত্তর হবে না। ন্যালিনি এমন কিছু সেরা নাচিয়ে ছিল যে একেবারে তারকা বনে যাবে। তার পাগুলো ছিল ড্যান্সের জন্য অনুপযুক্ত। তাছাড়া পার্টি গার্ল হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে তার ছিল মারাত্মক রকমের অনীহা। আর এসব কিছুই স্থায়িত্ব পায় পিপির সাথে তার বিয়ে হওয়ার পর।
বিয়ের প্রথম চার বছর ন্যালিনি ছিল খুব সুখী। সন্তানদের যত্ন-আত্তি, পড়াশোনা আর ইউনিভার্সিটি অব নেভেদার ক্লাস নিয়ে ব্যস্ত ছিল সে। কিন্তু পিপি তার এ সুখে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। রাজ্যের সার্বিক পরিস্থিতির কথা ভেবে বেশি দিন সেখানে থাকতে তার ছিল দ্বিধা। পিপি বুঝতে পেরেছিল– যে কোনো সময় তাদের জীবনে নেমে আসতে পারে বিপদের কালো মেঘ। সে জানত রাজ্যের উছুল কৃষ্ণাঙ্গরা কোনো কিছু না ভেবেই কেড়ে নিতে পারে অনেক কিছু। ন্যাটিভ আমেরিকানদের সম্পর্কেও খুব ভালো ধারণা ছিল না তার– সে যে কেউ হোক না কেন, পিপি-ন্যালিনি ও তাদের সন্তানকে একেবারে সাগরের তলদেশে নামিয়ে দিতে কুণ্ঠাবোধ করবে না মোটেও। আরো তাছাড়া বই এবং মিউজিক সম্পর্কেও পিপির খুব একটা আগ্রহ ছিল না বিধায় ন্যালিনির এই ইচ্ছায় বাদ সাধল পিপি।
সন্তানদের প্রতি ন্যালিনির মনোভাব ছিল বেশ কঠোর। তাদের সভ্য করে গড়ে তুলতে পিপির প্রতি অভিযোগ করে বলত ছেলেমেয়েদের শাসন না করলে পরে নিজেই তাদের আচার-আচরণে হতবুদ্ধি হয়ে পড়বে। শিশুরা পশুর মতো হয়ে উঠছে। এ অবস্থায় তাদের শাসন না করলে, কিভাবে তাদের এই আচরণ-ব্যবহার শোধরাবে? ন্যালিনির এ অভিযোগের পরও পিপি তার সন্তানদের গায়ে কখনো টোকাটাও দেয়নি।
তাদের বিয়ের চতুর্থ বছরে সন্তানদের প্রশিক্ষণ দিতে ন্যালিনির জন্য পিপি মিস্ট্রেস নিযুক্ত করল। আর এ নিয়োগও ছিল উল্লেখ করার মতো। এদের একজন লাস ভেগাসের, একজন নিউইয়র্কের এবং আরেকজন লস অ্যাঞ্জেলেসের। এই তিন মিস্ট্রেসের কাছে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ নিয়ে ন্যালিনি হয়ে উঠল দক্ষ।
সন্তান মানুষ করতে শুধু ন্যালিনিই নয় পিপিও যোগ দিল একই সাথে। কঠোর পরিশ্রম আর ভালোবাসায় সন্তানদের জীবনও হয়ে উঠল মধুর। সন্তানদের লেখাপড়া, গান-নাচে দক্ষ করে তুলতে ন্যালিনিও তাদের পেছনে অতিবাহিত করতে লাগল ঘন্টার পর ঘণ্টা। পিপির উন্নত মনোভাবে তাদের দাম্পত্য জীবনও হয়ে উঠল মধুর। পিপির যত গুণ হচ্ছে, তার জীবনীশক্তি ও পশুর মতো উচ্ছলতা। কোনো স্বামী-স্ত্রীর বিবদমান সম্পর্ককে সহজ করতে এমন গুণ অবশ্যই ফলপ্রসূ।
পিপি-ন্যালিনির যেমন তাদের সন্তানের প্রতি ছিল প্রচণ্ড ভালোবাসা, সন্তানদেরও ছিল ঠিক তেমনই তাদের বাবা-মার প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা। তারা ভালোবাসত তাদের মাকে আর শ্রদ্ধাপূর্ণ অনুসরণ করত বাবাকে। ন্যালিনিকে ভালোবাসার কারণ মা হিসেবে সে সন্তানদের কাছে ছিল খুব মিষ্টি স্বভাবের, নম্র, সুন্দরী তো বটেই, সেই সাথে একেবারেই নির্ভরযোগ্য। অপরদিকে বাবা ছিল বেশ দৃঢ় ও শক্তিশালী।
বাবা ও মা খুব ভালো শিক্ষকে পরিণত হয়েছিল। মায়ের কাছে তারা শিখত সামাজিক রীতি-নীতি, ভালো আচার-ব্যবহার, নৃত্য, পোশাক পরিচ্ছদের নিয়ম-কানুনসহ জীবন চলার পথের বিভিন্ন আদব-কায়দা। বাবা তাদের শেখাত কিভাবে ছেলেমেয়েরা তাদের শারীরিক বিপদ-আপদ থেকে নিজেদের রক্ষা করবে, এথলেট হিসেবে শারীরিক গঠনের কলা-কৌশল, আর এসবের সাথে গ্যাম্বলও। বাবার কাছে এসব বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিতে ছেলেমেয়েদের বেশ কষ্ট হতো, কিন্তু কখনোই বাবার প্রতি তারা বিরক্ত বোধ করত না। এর কারণ পিপিও তার সন্তানদের ওপর জোর করে চাপিয়ে দিত না কিছু যা কিছু সে করত অত্যন্ত নিয়ম-শৃঙ্খলার মাঝে। রাগ হতো না সে কখনো, শেখাত স্নেহের সাথে। বন্ধুর মতো।
ক্রস ছিল একেবারে ভয়-ভীতিহীন দুর্দান্ত চঞ্চল এবং স্বভাবগত নমনীয়। এদিক থেকে ক্লডিয়া তার ভাইয়ের মতো শারীরিক আচরণে খুব একটা উৎসাহিত না হলেও নিশ্চিতভাবেই ছিল একটু একগুঁয়ে।
কিছুদিনের মধ্যেই একটি বিষয়ে ন্যালিনির খটকা লাগল। প্রথম প্রথম বিষয়টিকে তেমন একটা গুরুত্ব দেয়নি সে। কিন্তু পরে সে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি। তাসের বিভিন্ন রকমের খেলা যেমন পোকার, ব্ল্যাক জ্যাক, জিন এসব যখন বাচ্চাদের শেখাত পিপি, ন্যালিনি তেমন গা করেনি। কিন্তু খেলাগুলো শেখাতে গিয়ে পিপি তাদের যখন কার্ডের ফাঁক-ফোকর চুরিবিদ্যা, প্রতারণামূলক দিকগুলো তুলে ধরত, তাদের বরাদ্দকৃত অর্থ যখন সে কৌশলে, নিয়ে নিত তখন ক্ষেপে যেত ন্যালিনি। ক্রসের চেয়ে এ বিদ্যায় ক্লডিয়া এগিয়ে গিয়েছিল অনেক বেশি পারদর্শীও হয়ে উঠেছিল বেশ। পিপি অবশ্য পরে ছেলে-মেয়ের সাথে যে প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছিল তা সবিস্তারে বর্ণনা করত। ন্যালিনি তখন রাগ হয়ে পিপিকে বলত–আমি মনে করি, তুমি ছেলে-মেয়ের জীবন নিয়ে খেলছ, যেভাবে তুমি খেলছ আমার সাথে। পিপি তখন প্রতিউত্তরে বলত, এটাও তাদের শিক্ষার একটা অংশ। ন্যালিনি বলত, এটা কোনো ভালো শিক্ষা নয়, দুর্নীতির প্রশিক্ষণ। তখন পিপি বলত– আমি চাই সন্তানরা যাতে জীবনের বাস্তব দিকগুলো শেখে এবং এখন থেকেই তার প্রস্তুতি নেয়। কিন্তু ন্যালিনি তা চাইত না। ন্যালিনির ইচ্ছে— সন্তানরা যাতে জীবনের সুন্দর দিকগুলোর প্রতি উৎসাহিত হয়ে ওঠে।
পিপির টাকা রাখার একটি ওয়ালেট ছিল। তা সবসময় পরিপূর্ণ থাকত পর্যাপ্ত পরিমাণ অর্থে। ন্যালিনি মনে করত, একজন ট্যাক্স কালেক্টর হিসেবে এটা অসম্ভব কিছু নয়, তবে সন্দেহও যে হতো না, তা নয়। এটা সত্য যে পিপি একটি বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মালিক একটি কালেকশন এজেন্সি। কিন্তু এ থেকে পিপির যা আয়, তার চেয়ে তারা অনেক বেশি সচ্ছল, ধনী— বিষয়টি প্রায়ই ন্যালিনিকে ভাবিয়ে তুলত।
অবকাশ যাপনে কিংবা অন্যান্য ভ্যাকেশনে তারা কখনো যেত পূর্বে, কখনো ক্লেরিকুজিও’র বিস্তৃত পরিবারের আশপাশের কোনো অঞ্চলে। সেসব জায়গায় তীক্ষ্ণ ধীসম্পন্ন ন্যালিনি দেখত সবাই তাদের প্রতি কতটা শ্রদ্ধাশীল এই শ্রদ্ধা একেবারেই ভিন্ন। কখনো কখনো পিপি সেই পরিমণ্ডলের লোকজনের সাথে দীর্ঘ সময় ধরে গোপনীয় আলোচনায় ডুবে যেত– সেখানে ন্যালিনির প্রবেশাধিকার থাকত না। এসব দেখে বিস্মিত হতো ন্যালিনি। তার মনে বিভিন্ন প্রশ্নের অবতারণা হতো।
আরেকটি ছোট বিষয় নিয়েও ন্যালিনির মনে প্রশ্ন জাগত। সেটা হচ্ছে পিপির প্রায়ই অর্থাৎ প্রতি মাসেই অন্তত একবারের জন্য হলেও ব্যবসায়িক কারণে বাইরে সফর। কিন্তু ন্যালিনি এসব সম্পর্কে কখনোই বিস্তারিত কিছু জানতে পারেনি। পিপিও এ বিষয়ে কখনো কিছু বলত না। সে বৈধভাবেই লাইসেন্সকৃত আগ্নেয়াস্ত্র ও বহন করত– একজন কালেক্টর হিসেবে বড় পরিমাণ অর্থ লেনদেন বিষয়ে অস্ত্র সাথে রাখাটা অযৌক্তিক নয়– অন্তত ন্যালিনি এ ব্যাপারে এমন একটি যুক্তি মনে মনে দাঁড় করিয়েছে। পিপি যথেষ্ট সতর্ক মানুষ। তার আগ্নেয়াস্ত্রের কোনো অংশই পিপি ন্যালিনি কিংবা সন্তানদের হাতের নাগালে রাখত না, বুলেটগুলো তালাবন্দি করে রাখত পৃথক এক স্থানে।
এভাবেই বছর চলে যাচ্ছিল আর পিপিরও ব্যবসায়িক সফর বাড়ছিল ক্রমেই। ন্যালিনি বেশিরভাগ সন্তানদের নিয়েই একাকী থাকতে লাগল সময়। যতই দিন যাচ্ছিল, পিপি-ন্যালিনির মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কে অবনতি ঘটছিল ক্রমেই। স্বামী-স্ত্রীর যৌন সম্পর্কে দেখা দিয়েছিল টানাপোড়েন। পিপি যেন তার স্বভাবসুলভ কামনা সম্ভোগ থেকে দূরে সরে পড়ছিল– হয়ে উঠছিল সংযত এবং সহানুভূতিশীল। দুজনার দূরত্ব বেড়ে গেল আরো বেশি।
একজন মানুষের পক্ষে তার সহজাত প্রবৃত্তি অত্যন্ত আপনজনের কাছে, অন্তত যার সাথে সে তার জীবনের সবচেয়ে সান্নিধ্য সময় অতিবাহিত করেছে, সেই প্রিয়তমা স্ত্রীর কাছে লুকিয়ে রাখা অসম্ভব। ন্যালিনির চোখে ধরা পড়ল পিপি যেন নিজেকে লুকাতে ব্যস্ত সে তার উচ্ছলতাটুকুও ঢেকে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। পিপি প্রকৃতির উচ্ছ্বাস লঙ্ঘন করেছে কখনো, কিন্তু ন্যালিনিকে এড়িয়ে যেতে পারেনি। তবে তার এই লুকানো প্রবণতাকে ঢাকতে নিজের স্বভাবজাত উচ্ছ্বাস, উচ্ছলতা প্রকাশের চেষ্টা করত সেটা ছিল। নিছক মেকি– ছদ্মবেশ। স্ত্রীর প্রতি তার আচরণ ছিল আগের মতোই অমায়িক, তবে ন্যালিনি পেত বিপদের আভাস–স্বাভাবিক মনে হতো না তাকে।
পিপির ছোটখাটো কিছু নির্বুদ্ধিতা তাকে মানুষের কাছে আরো গ্রহণযোগ্য করে তুলত আনন্দ পেত অনেকে এই নির্বুদ্ধিতায়। কিছু কিছু বিষয়ে সে বোকার মতো আনন্দ করত কিংবা কষ্ট পেত। আর তার এই অনুভূতি সহানুভূতি হতো অনেক মানুষ কিংবা অনেকের অনুভূতি-উপলব্ধিকে সে তাদের মতো করেই নিত। একবার এক দম্পতিকে ইতালীয় এক রেস্তোরাঁয় ডিনারের নিমন্ত্রণ করে সে। দম্পতিটি ইতালীয় খাবারত দামের কারণে বেছে বেছে খেতে শুরু করে। পিপি এ অবস্থা দেখে নিজের খাবার আর শেষ করতে পারেনি।
ন্যালিনিকে পিপি ভেগাসে তার কালেকশন এজেন্সি সম্পর্কে, তার কাজ সম্পর্কে সম্যক ধারণা দিয়েছে। ভেগাসের বড় বড় হোটেলগুলো তার ক্লায়েন্ট। এই হোটেলগুলোয় যে গ্যাম্বলিং চলে তার নির্দিষ্ট একটা আয় পিপির এই এজেন্সিকে দিতে হয়। জুয়াড়িদের কাছ থেকে আয়ের অংশ নেয়া দুরূহ বিধায় পিপি নতুন কৌশলে গ্যাম্বলিং মেকার অর্থাৎ যারা গ্যাম্বলিংয়ের পয়েন্ট লিপিবদ্ধ করে, তাদের কাছ থেকে আদায় করে নেয়।
একটি বিষয়ে পিপি ন্যালিনিকে প্রায় বলত, জোর করে কখনো ভালো কিছু আদায় সম্ভব নয়- অব্যাহত চলতে থাকা বিশেষ কিছু বিষয় বা ক্ষেত্র ছাড়া। যারা ঋণ শোধ করবে, এটা তাদেরও একটি মান-সম্মানের বিষয়। আসলে, প্রত্যেকেই যার যার কাজে দায়িত্বশীল এবং এই দায়িত্বশীলতাই তাকে রক্ষা করে যদি সে প্রতিনিয়ত বাধ্যবাধকতার মুখোমুখি না হয়।
বিশেষ করে চিকিৎসক, আইনজীবী কিংবা করপোরেশনের প্রধান কর্মকর্তারা এক্ষেত্রে তাদের সম্মান বজায় রাখতে প্রশংসনীয় আচরণ করে থাকে– মোটামুটি দর কষাকষিকে পারতপক্ষে এড়িয়ে চলে। তাদের কছ থেকে অর্থ আদায় করে নেয়াটা কঠিন নয়। আচরণ যদি তাদের নেতিবাচক হয়, তবে তাদের কর্মক্ষেত্রে গিয়ে একটু উচ্চবাচ্য করলেই হলো– তাদের ক্লায়েন্টরা শুনবে, জানবে তাদের ভদ্রতার পোশাকের নিচে ভিন্ন জগতের কথা। এজন্য সাধারণত তারা সতর্কতার সাথেই লেনদেন করে থাকে।
তবে যারা ছোটখাটো ব্যবসা করে, তারা এক ডলারে জুয়ার দানে লাগায় এক পেনি। আবার এদের মধ্যে অনেকে একটু বেশিই চালাক—- তারা এমনভাবে চেকে অর্থের পরিমাণ লেখে, যা বাউন্স হবার সম্ভাবনাই বেশি। এটা একটা চমৎকার কৌশল। যেমন জুয়ার দানে এই শ্রেণীর লোক একটি দশ হাজার ডলারের চেক প্রদান করল কিন্তু দেখা গেল তার ব্যাংকের একাউন্টে রয়েছে আট হাজার। এই ক্ষেত্রে তার ব্যাংক একাউন্টটি পিপি পূর্বেই দেখে নেয় এবং চেকটি যাতে বাউন্স না হয় সে জন্য দশ হাজার পূরণ করতে অতিরিক্ত দুহাজার ডলার জমা করে ফেলা হয় তার নামে। দান ধরা লোকটি হেরে গেলে তার একাউন্ট অনায়াসেই শূন্য করা যায়। এমন সব কাহিনী ন্যালিনিকে শুনিয়ে হেসে উঠত পিপি।
এক রাতে পিপি ন্যালিনিকে তার জীবনের একটি মজার কাহিনী বলেছিল– কাহিনীটি ছিল পিপির কাছে হাস্যকর। জানাদু হোটেলের কাছে ছোট একটি শপিং মলের মতো কালেকশন এজেন্সিতে বসে কাজ করছিল পিপি। অফিসে বসেই শুনতে পেল গুলির শব্দ। সাথে সাথে বেরিয়ে এলো সে। দেখল পাশের একটি জুয়েলারি দোকান থেকে মুখোশধারী দুজন ডাকাত পালিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় কোনো কিছু চিন্তা না করেই পিপি তার বৈধ আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ল। তবে ডাকাত দুটি তাদের জন্য অপেক্ষমাণ গাড়িতে লাফিয়ে উঠে পালিয়ে যেতে সক্ষম হলো। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশ এসে পৌঁছল ঘটনাস্থলে এবং আশপাশের মানুষের কাছে জিজ্ঞেসাবাদের পর তারা পিপিকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে গেল– যদিও নিশ্চিতভাবেই তারা জানত পিপির অস্ত্রটি লাইসেন্সকৃত। কিন্তু গায়ে পড়ে এমন আচরণ একটি অপরাধ বলেই বিবেচিত। অবশ্য আলফ্রেড গ্রোনিভেল্ট থানায় গিয়ে তাকে ছাড়িয়ে আনেন।
গল্পটি বলতে বলতেই পিপি নিজের কাছেই প্রশ্ন করল, আমি জঘন্য কাজটি কেন করেছিলাম? আলফ্রেড আমাকে বলেছিল, আমার মধ্যে নাকি শিকারে তীব্র আকাঙ্ক্ষা কাজ করেছিল তখন। কিন্তু আমি তা বুঝতে পারিনি। এই আমিই কি ডাকাতদের গুলি করেছিলাম? সমাজ রক্ষায় আমি কি এ কাজ করেছিলাম? যে উদ্দেশ্যেই হোক আমার অপরাধের সাজা তারা আমাকে গ্রেফতার করে দিয়েছিল। এই আমাকেই তারা থানায় আটকে রেখেছিল।
কিন্তু এই ছোট ঘটনাটিই, পিপির চরিত্রের একটি সামান্যতম অংশের এই খুনে মনোভাব ন্যালিনির মনে দাগ কেটেছিল। পিপির চরিত্রের গোপনীয় এই সত্যটি ন্যালিনিকে ওলট-পালট করে দিয়েছিল। পরবর্তীতে যা অবশেষে ন্যালিনিকে ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে …
.
সান্তাডিও ফ্যামিলির ড্যানি ফিউবার্টা। নিজের উপার্জনের ওপর লোন নিয়ে নিউইয়র্ক ট্রাভেল এজেন্সি নামে একটি পরিবহন সংস্থা চালাচ্ছে সে আপন মালিকানায়। লুপ্তপ্রায় সান্তাডিও ফ্যামিলির এই সদস্যটির আয়ের বেশিরভাগ অর্থই আসে ভেগাসে অভ্যাগত অতিথিদের সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা করে। অফিসিয়াল পদবিতে যাকে বলা হয় জাঙ্কেট মাস্টার। ড্যানি ফিউবার্টার পদবি এটি।
বিভিন্ন শহরের গ্যাম্বলারদের জন্য ভেগাসে অবকাশ যাপনের সুবন্দবস্ত করে থাকে একজন জাঙ্কেট মাস্টার। ফিউবার্টার কাজটিও তেমনই–গ্যাম্বলারদের ধরে রাখতে সে তার পরিবহন সংস্থার ব্যবহার তো করেই, ভেগাসের হোটেলগুলোর সাথেও তার রয়েছে চুক্তি। ফিউবার্টার রয়েছে নিজস্ব একটি ৭৪৭ জেট। প্রতি মাসে এতে সে বহন করে দুই শতাধিক যাত্রী, যারা কেবল ভেগাসের জানাদু হোটেলে আসে শৌখিন গ্যাম্বলার হয়ে।
ফিউবার্টার দেয়া এই বিশেষ প্যাকেজ সুবিধায় গ্রাহককে দিতে হয় কেবল হোটেল রেন্ট। একটি ফ্ল্যাটের ভাড়া মোটে এক হাজার ডলার। আর এর বিনিময়ে ফিউবার্টার গ্রাহকরা পায় নিউইয়র্ক থেকে ভেগাসে বিমানের ফ্রি রাউন্ড ট্রিপ, যাতায়াতকালে বিমানের ফ্রি খাওয়া-দাওয়া, হোটেলে ফ্রি কক্ষ এবং খাদ্য ও পানীয়। ফিউবার্টা সবসময় তার গ্রাহকদের খুশি করতে সচেষ্ট গ্যাম্বলিংয়ে উচ্চতর পর্যায়ে খেলার সুবিধাসহ প্রতিদিন ক্যাসিনোয় গ্রাহকরা পায় নিশ্চিতভাবে চার ঘণ্টা করে সময়। ফিউবার্টার গ্রাহকরা হোটেল জানাদুর ক্যাশে ক্রেডিট কার্ডের সুবিধাও পেয়ে থাকে।
ফিউবার্টার সবচেয়ে বড় সম্পদ হলো সমাজের ভয়ানক অপরাধীদের সথে তার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। এদের মধ্যে রয়েছে ব্যাংক ডাকাত, মাদক ব্যবসায়ী, সিগারেট চোরাচালানিসহ নিউইয়র্কের নিকৃষ্ট পেশাজীবীর লোক। আর এই লোকগুলোই ফিউবার্টার সবচেয়ে ভালো গ্রাহক। আসলে এই পেশাজীবীর লোকজন তাদের কর্মকাণ্ডের জন্যই সবসময় মারাত্মক মানসিক চাপের মধ্যে দিন অতিবাহিত করে। এই একঘেয়ে জীবন থেকে কিছুটা সময়ের জন্য মানসিক পরিতৃপ্তি পেতে তারা জানাদু হোটেলে তাদের অবকাশ যাপনের জন্য ছুটে আসে। কালো পথে উপার্জিত তাদের প্রচুর কালো টাকা জুয়ায় উড়িয়ে দেয়, কিংবা আয়ও করে এ থেকে— গ্যাম্বল যেন তাদের মানসিক তৃপ্তির এক অসাধারণ উপায়।
জানাদু হোটেলে প্রতিদিন দুশ যাত্রী সরবরাহ করতে পারলে ড্যানি ফিউবার্টা তার কমিশন হিসেবে পায় কুড়ি হাজার ডলার। অনেক সময় জানাদু হোটেলের তরফ থেকে কিছু বোনাস অর্থও পেয়ে থাকে সে। যদি ফিউবার্টার কাস্টমাররা গ্যাম্বলিংয়ে প্রচুর পরিমাণ অর্থ হেরে যায় তাহলে এই অর্থের একটা ভাগও সে পায় বোনাস হিসেবে। অর্থাৎ প্রতিদিন ফিউবার্টা তার প্যাকেজ থেকে পায় বিশাল পরিমাণের একটা অংক। তবে দুর্ভাগ্যবশত ফিউবার্টাও গ্যাম্বলিংয়ে মারাত্মক রকমের আসক্ত। আর এর ফলে তার আয়ের অধিকাংশই তাকে খোয়াতে হয় জুয়ায় অনেক সময় তার আয়ের অতিরিক্তও চলে যায়
তবে, যার রয়েছে এমন আয়ের সুবিধা, গ্যাম্বলিংয়ে ব্যাপক হারের পরও এই ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে তার বেগ পেতে হয় না। নতুন ভাবে পুনরায় সচ্ছলতার পথ ফিউবার্টা সফলতার সাথেই বের করে নেয় আবারও সচ্ছল হয়ে ওঠে। তবে ক্যাসিনোর জাঙ্কেট মাস্টারের দায়িত্ব পালনকালে ফিউবার্টা আগেই তার ক্যাসিনো কাস্টমারদের ক্রেডিট কার্ড কিংবা ব্যাংক একাউন্ট পরীক্ষা করে নেয়।
ফিউবার্টার রয়েছে একেবারেই উপযুক্ত একটি সশস্ত্র পাণ্ডা দল। তাদের সাথে সে একবার জানা হোটেলের আট লাখ ডলার চুরির পরিকল্পনা করে। এ প্রেক্ষিতে সে তার চার জন লোককে গার্মেন্টের মালিক সাজিয়ে অত্যন্ত উচ্চ রেটিংয়ের নকল ক্রেডিট কার্ড দিয়ে হোটেলে পাঠায়। আর এদের বিস্তারিত জীবন বৃত্তান্ত ফিউবার্টা তার এজেন্সি থেকে সরবরাহ করে, যাতে অন্তত জানাদু হোটেল কর্তৃপক্ষের কাছে তা গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়। ফিউবার্টা তার এজেন্সির রিপোর্টে জানায়– এই চার ব্যক্তির প্রত্যেকের ক্রেডিট কার্ডের লিমিট দুই লাখ ডলার করে। যার ফলে তারা ক্যাসিনোতে অংশগ্রহণে সক্ষম।
ক্যাসিনোতে এই চারজনের উচ্ছ্বাস-উদ্যম যেন মাতিয়ে রাখে। তাদের এই উৎসবপূর্ণ অবস্থা দেখে গ্রোনিভেল্ট বলেছিলেন– ওহ, এ যেন এক পিকনিকের আমেজ।
ফিউবার্টার এই অর্থ চুরির পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে তার লোকজনকে হোটেলে থাকতে হয়েছিল দুদিন। এই দুদিনে ফিউবার্টা ও তার দলের রুম সার্ভিস বিল হয়েছিল প্রচুর। তারা ডিনারে আমন্ত্রণ জানাত সুন্দর সুন্দর মেয়ের দলকে।
গিফট শপগুলোতে নামের সই-স্বাক্ষর করেই সেই রূপসীদের পাঠিয়ে দেয়া হতো। ক্যাসিনো থেকে তারা নিত সব সময় ব্ল্যাক টিপস।
দুটো ভাগে ভাগ করেছিল ফিউবার্টা তার দলকে। ক্যাসিনোয় একটি দল খেলত ডাইসের বিরুদ্ধে, আর অপর দলটি পক্ষে। এ উপায়ে তারা হেরেও যেত। আর তাই হারতে হারতে এক সময় তারা দশ লাখ ডলারের দান বসাত। এটা করার কারণ ছিল, ফিউবার্টা এই দান দেখে এক পর্যায়ে ক্যাশ যাচাইয়ের জন্য যেতে উদ্যত হবে। আসলে এ সবই ছিল অভিনয়। ফিউবার্টার লোকজনের ভাব দেখে মনে হতো তারা যেন মারাত্মকভাবে ডুবে গেছে জুয়ায়। অত্যন্ত নিখুঁতভাবে তারা এ অভিনয় চালিয়ে যেত- ডাইসের কাছে গিয়ে তারা যেন প্রার্থনা করতে শুরু করত। দান হেরে গেলে মারাত্মক মুষড়ে যেত এবং জিতলে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠত।
এভাবেই শেষদিন অর্থাৎ দ্বিতীয় দিন তারা ফিউবার্টার কাছে ক্যাশ করানোর জন্য তাদের পুরনো চিপসগুলো দিয়ে নতুন চিপস সংগ্রহ করল। এই হাস্যকর অবস্থার যখন সমাপ্তি ঘটল তখন দেখা গেল সিন্ডিকেট আট লাখ ডলারের ধনী– যারপরনাই খুশিও হয়েছিল তারা এই আয়ে।
ড্যানি ফিউবার্টা, এই অভিনব কৌশলের পরিকল্পনাকারী। দুদিন শেষে তার ঝোলায় ভরেছিল চার লাখ ডলার আর অবশিষ্ট অংশের অংশীদার সেই চার-ডাকাতও তাদের পাওনা বুঝে পেয়ে খুশি হয়েছিল। বিশেষ করে ফিউবার্টা প্রতিশ্রুতি মোতাবেক যখন তার ডাকাত দলের সদস্যদের ফ্রি খাদ্য, মদপান, সুন্দরী ললনা এসব শর্ত পূরণ করেছিল তখন তাদের বসের ওপর নির্ভরতা বেড়ে গিয়েছিল আরো বেশি।
কিন্তু ফিউবার্টার এই ডাকাতির সব কিছুই ধরা পড়েছিল গ্রোনিভেল্টের কাছে। দুদিনব্যাপী ডাকাতির পরের দিন গ্রোনিভেল্ট সব কিছুই জনসমক্ষে প্রকাশ করে ফেলেন। জনদু হোটেলের সার্ভিলেন্স ক্যামেরায় ধারণ করা হয়েছিল এসব— এই ক্যামেরায় বাদ যায়নি ফিউবার্টার ক্যাসিনো জাঙ্কেটর কর্মকাণ্ডও। সার্ভিলেন্স ক্যামেরাকে তিনি আখ্যা দিয়েছিলেন আকাশের চোখ। অবশ্য গ্রোনিভেল্ট এই সার্ভিলেন্স ক্যামেরাগুলো চালু করে দিয়েছিলেন মূল অপারেশনের দশ মিনিট আগে– ক্যাসিনোর ক্যাশে অস্বাভাবিক অর্থ হ্রাসের বিষয়টি আঁচ করতে পেরে তিনি তৎপর হয়েছিলেন।
গত কয়েক বছরে জানাদু হোটেলে এমন অনেক ঘটনাই ঘটেছে। গ্রোনিভেল্ট বেশ অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছিলেন। বিশেষ করে ফিউবার্টার ডাকাতি চক্রান্তটি ছিল বিগত বছরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় ধরনের ঘটনা। দীর্ঘ দিন ধরে একের পর এক এমন অর্থচুরির ঘটনায় গ্রোনিভেল্ট উপায়ন্তর না দেখে অবশেষে সার্ভিলেন্স ক্যামেরার সাহায্য নিতে বাধ্য হন। গুরুতর অপরাধ ধরা পড়ার পরও তিনি ফিউবার্টার বিরুদ্ধে তেমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি, তাকে ভালোবাসতেন গ্রোনিভেল্ট। এর কারণ মানুষটি জানাদু হোটেলের আয়ের অন্যতম উৎস। তাছাড়া গ্রোনিভেল্টও যে মাঝে মাঝে নকল আইডি প্রদর্শন করেন, তা ফিউবার্টা বেশ ভালোই জানে। বিষয়টি তার কাছ থেকে ফাঁস হয়ে যাওয়ারও ভয় আছে। তবে ফিউবার্টার সেই ডাকাতি পরিকল্পনার সমস্ত তথ্য গ্রোনিভেল্ট প্রথমে পিপি ডি লিনাকে জানান। পিপি ফিউবার্টাকে চেনে কিন্তু সেই চার সদস্য সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না। গ্রোনিভেল্ট পৃথক পৃথক গোপন ক্যামেরা ও স্থির চিত্র ধারণ করে পিপির কাছে ছবি ও ভিডিও ফুটেজগুলো দেন।
গ্লোনিভেন্টের কাছে তথ্য ও প্রমাণগুলো পেয়ে পিপি মাথা নেড়ে বলল, ড্যানি কি করে ভাবল যে এমন এক অপরাধ করে সে পার পেয়ে যাবে? আমি তাকে জানাদু হোটেলের একজন স্মার্ট প্রতিনিধি ভেবেছিলাম।
সে একজন জুয়াড়ি গ্রোনিভেল্ট বললেন। তারা মনে করে তাদের কার্ডগুলো সব সময়ই জয়ের কার্ড। একটু থামলেন। তারপর বললেন, ড্যানি হয়তো তোমাকে ফুসলানোর চেষ্টা করবে। সে হয়তো বলবে সে এসবের কিছুই জানে না। তবে মনে রেখো, ফিউবার্টাকে প্রমাণ করতে হবে এ বিষয়ে। সে হয়তো বলবে, সে যে এই বিপুল পরিমাণে অর্থের হেরফের করেছে, তা তাদের আইডির ওপর ভিত্তি করেই। অবশ্য একজন জাঙ্কেট মাস্টারকে যে কোনো অংশগ্রহণকারী ব্যক্তির সমস্ত তথ্য প্রমাণ করতে হয়।
পিপি গ্রোনিভেল্টের কথায় হাসল। গ্রোনিভেল্টের গায়ে হাত রেখে তাকে আশ্বস্ত করে বলল, চিন্তা করো না, সে আমাকে ফুসলাতে পারবে না।– এ কথায় পিপি ও গ্রোনিভেল্ট উভয়ে হেসে উঠল। ড্যানি ফিউবার্টা যদি অপরাধী হয়েও থাকে, তা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাকে দায়ী করা হচ্ছে তার ভুলের জন্য।
কুওগে ক্লেরিকুজিও পরিবারের সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনার জন্য পিপি পরদিনই নিউইয়র্কের উদ্দেশে রওনা হলো।
.
প্রহরী-সুরক্ষিত প্রধান ফটক পেরিয়ে ইট বিছানো রাস্তার ওপর দিয়ে নিজেই। গাড়ি ড্রাইভ করে এগিয়ে যাচ্ছিল পিপি। রাস্তার দুধারে হেঁটে দেয়া ঘাসের মসৃণ সবুজ খোলা মাঠ। চারপাশের দেয়ালগুলোয় কাঁটাতারের বেড়া, তাতে রয়েছে বৈদ্যুতিক সংযোগ এবং স্বয়ংক্রিয় কিছু আগ্নেয়াস্ত্র।
ম্যানসন পর্যন্ত পৌঁছেই পিপি দেখতে পেল একেবারে ফটক বরাবর দাঁড়িয়ে আছে একজন গার্ড, এর অর্থ এখন এখানে শান্তিপূর্ণ অবস্থা বিরাজ করছে।
ম্যানশনের কাছে পৌঁছতেই বেরিয়ে এলো জর্জিও। পিপিকে অভিনন্দন জানাল সে। তারপর পিপিকে নিয়ে হেঁটে এলো পাশের একটি বাগানে। বাগান ভরা টমেটো ও শসার গাছ, সুন্দরভাবে বিন্যস্ত লেটুস ও তরমুজের পৃথক পৃথক ক্ষেত। তবে এত বড় এই বাগানে নেই কোনো ফুলের গাছ। ফুলের জন্য এখানে কোনো জায়গাই রাখেননি ক্লেরিকুজিও।
বাগানেরই এক পাশে মনোরম পরিবেশে পেতে রাখা কাঠের টেবিল। টেবিল ঘিরে বসে রয়েছে ক্লেরিকুজিও ফ্যামিলির সদস্যরা। দিনের প্রথমার্ধের লাঞ্চের সময়। ভন স্বয়ং উপস্থিত রয়েছেন নির্ধারিত আসনে। সত্তর বছরের বার্ধক্য তাকে ছোয়নি– উজ্জ্বল, সতেজ এবং সকালের রক্তিম আভা ঘিরে ছিল। তার পূর্ণ অবয়বে। দূর থেকে ভেসে আসছিল ডুমুর জাতীয় ফল দিয়ে তৈরি পানীয়ের মিষ্টি সুবাস।
ডন তার দশ বছরের নাতি ডেন্টিকে কিছু একটা খাওয়াচ্ছিলেন স্নেহের সাথে। ক্রসের সমবয়সি ডেন্টি। বয়স অনুপাতে সুস্বাস্থ্যেরও অধিকারী, তবে সবেমাত্র বালক হিসেবে দাম্ভিকতাই যেন তার প্রধান ভূষণ। ডন নিজ হাতে তাকে খাইয়ে দিচ্ছিলেন, আর আলোড়িত ডেন্টি বিভিন্ন মুখভঙ্গিমা আর আহাদি বিলাপ বকে যাচ্ছিল। দাদু-নাতির এ তামাশা দেখে বিব্রত বোধ করছিল ভিনসেন্ট এবং পেটি।
পিপি টেবিল ঘিরে একটি শূন্য চেয়ার দখল করে বসল। ডেন্টির খাওয়ার পর্ব শেষ না হওয়া অবধি মিটিং শুরু হওয়ার সম্ভাবনা নেই। অবশেষে ডেন্টির মা রোজ ম্যারির হস্তক্ষেপে সে পর্বের সমাপ্তি ঘটল। ডেন্টি যখন তার মায়ের সাথে হেঁটে চলে যাচ্ছিল ডন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন ডেন্টির দিকে হয়তো খানিকটা উদাসও হয়ে পড়েছিলেন। অবশেষে ফিরে এলেন, তাকালেন পিপির দিকে। তবে ডেন্টির রেশ তখনও ছিল তার মননে– কুলরক্ষক ভবিষ্যতের ডন ডেন্টির উদ্দেশে একটা দীর্ঘশ্বাসই ফেললেন ক্লেরিকুজিও।
পিপির উদ্দেশে বললেন, ওই ফিউবার্টা, রাসকেলটার সম্পর্কে কি ভাবছ তুমি? আমরা তাকে দিয়েছি জীবিকা। আমাদের খরচেই তাকে আমরা পেটুক বানিয়ে তুলছি।
জর্জিও স্বভাবসুলভ শান্ত কণ্ঠে বলল, আত্মসাৎকৃত অর্থগুলো যদি সে ফিরিয়ে দেয় তবেই সে আগের মতো আমাদের হয়ে কাজ করতে পারবে। জর্জিও’র এই ছিল ফিউবার্টার জন্য একমাত্র ক্ষমা পাওয়ার পথ।
এটা কোনো ছোট অংকের টাকা নয়, ডন বললেন, টাকাটা তার কাছ থেকে অবশ্যই আমাদের ফিরিয়ে নিতে হবে। ডন পিপির মতামত জানতে চাইলেন।
ফিউবার্টার উদ্দেশ্যে গালাগাল করে পিপি বলল, আমি চেষ্টা করতে পারি তবে তার মতো মানুষ তাদের দুঃসময়ের জন্যও একটি পেনিও জমা করে রাখে না।
ভিনসেন্ট ফিউবার্টার উদ্দেশে বিড়বিড়িয়ে শ্রাগ করল। বলল, দেখি ছবিগুলো দেখাও তো পিপি এক এক করে ছবিগুলো দেখাতে লাগল। ভিনসেন্ট এবং পেটি গভীর মনোযোগে দেখছিল সেই অস্ত্রধারী চার ডাকাতের ছবি। কিছুক্ষণ পর উজ্জ্বল হয়ে উঠল ভিনসেন্টের মুখ। সে বলল, আমি এবং পেটি তাদের চিনি।
পিপি উল্লসিত হয়ে বলল, দারুণ! তাহলে তোমরা এখনই ওই চারজনের তথ্য খুঁজে বের করো। ডনের উদ্দেশ্যে পিপি প্রশ্ন করল, ফিউবার্টার ব্যাপারে কি করা যায়?
ডন বললেন, তারা আমাদের উদ্দেশ্যে ঘৃণা প্রদর্শন করেছে। তারা কি জানে না আমাদের পরিচয়? যারা নির্বোধ, শক্তিহীন তারা যাবে পুলিশের কাছে। ভিনসেন্ট এবং পেটির উদ্দেশে ডন বললেন, তোমরা পিপিকে সহযোগিতা করো। আমি তাদের কাছ থেকে আমাদের অর্থ ফেরত পেতে চাই। আর ওই বিচ্ছগুলো তাদের উপযুক্ত শাস্তি পাবে।
ডনের নির্দেশ ও মনোভাব উপস্থিত সবাই বুঝল। পিপির চেহারা ফ্যাকাশে বর্ণ ধারণ করল। সবাই বুঝতে পারল ডনের উপযুক্ত শাস্তির অর্থ পাঁচ জনের অবধারিত মৃত্যু।
ডন সভা থেকে উঠে গেলেন। শরীর ধরে রাখতে এ সময়টায় তিনি বাগানে কিছুটা সময় পায়চারি করে কাটান। সে উদ্দেশ্যেই সরে পড়লেন তিনি।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল জর্জিও, আমাদের সময় অনুপাতে এই বৃদ্ধ অত্যন্ত কঠোর। তার যতগুলো কঠোর দিক আছে তার চেয়ে এই নির্দেশটি আমাদের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ।
অবশ্যই। তবে এতে ভিনি এবং পিটি যদি না জড়াত, তবেই হয়তো ভালো হতো, পিপি বলল। ভিন্স, তুমি কি বলো?
ভিনসেন্টও দ্বিধান্বিত। জর্জিও’র উদ্দেশ্যে বলল, বুড়োর সাথে তোমাকেই এ বিষয়ে আলাপ করতে হবে। ভিনসেন্ট যুক্তি দিয়ে বুঝাল জর্জিওকে যে, তাদের কাছ থেকে এমনিতে একটি পেনিও আদায় করা যাবে না। তাদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করতে আমরা তাদের সাথে চুক্তি করব, তারা যেন এই পরিমণ্ডল থেকে বেরিয়ে যায় এবং উপার্জন করে যেন আমাদের অর্থ ফিরিয়ে দেয়। এছাড়া যদি তাদেরকে আগেই মাটি চাপা দেয়া হয় তবে একটি পেনিও আদায় করা সম্ভব হবে না।
ভিনসেন্ট যথেষ্ট বাস্তববাদী। সে কখনোই রক্তের জন্য পিপাসু নয়। এর চেয়ে অন্য কোনো বাস্তব উপায়ে সমাধান বের করতেই তার উৎসাহ বেশি।
ঠিক আছে, আমি না হয় বাবাকে বুঝাব যে তারা প্রকৃত দোষী নয়। তারা ছিল কেবল সাহায্যকারী। কিন্তু ফিউবার্টার ঘাড়ে যে চেপে যাবে আরো বড় অপরাধ, তার নিয়তি ঠেকাবে কিভাবে?
পিপি এবার মুখ খুলল, জাঙ্কেট মাস্টারকে এ খবরটি এখনই জানিয়ে দিতে হবে।
কাজিন, পিপি, জর্জিও ঈষৎ হেসে ফেলল। বলল, এর জন্য তুমি কেমন বোনাস আশা করছ?
কাজিন বলে সম্বোধন করলে পিপি মনোক্ষুণ্ণ হয়, ঘৃণা করে সে এই পরিবারকে, বিশেষ করে জর্জিও ডাকলে তার মাথায় রক্ত চড়ে যায়। কারণ সে পিপির সাথে কেবল কোনো বিষয়ে সমঝোতায় আসার সময় এ সম্বোধন করে থাকে। ভিনসেন্ট এবং পেটি কাজিন ডাকলে পিপির ততটা খারাপ লাগে না। সে জানে তারা কোনো রকম আকর্ষণ কিংবা উদ্দেশ্য ছাড়াই কাজিন বলে ডাকে।
জর্জিও’র প্রশ্নের জবাবে পিপি বলল, ফিউবার্টার বিষয়টি আমার। ধরো তোমরা আমাকে কালেকশন এজেন্সি দিয়েছ। এই সুবাদে আমি জানাদু থেকে একটা মজুরি পাই। তবে এখন যদি আমাকে প্রাপ্ত অর্থ ফিরিয়ে দিতে বলা হয়, তা হবে অত্যন্ত কঠিন– আর তাই আমারও উচিত হবে সেখান থেকে একটা অংশ নেয়া, যেমনটি ভিন্স এবং পেটি তাদের নির্ধারিত ক্ষেত্র থেকে পেয়ে থাকে।
সেটা ঠিক, জর্জিও বলল। কিন্তু এ বিষয়টি তো তোমার কালেকটিং মাকারের মতো নয়। তাছাড়া তুমি পঞ্চাশ শতাংশ আশা করতে পারো না।
না, না, তা তো নয়ই, পিপি বাধা দিয়ে উঠল। বলল, আমি কেবল একটা উদাহরণ দিলাম। আমাকে একটু আমার ঠোঁটটা তত ভেজাতে দাও!
পিপির কথায় হেসে উঠল সবাই। পেটি জর্জিওকে উদ্দেশ্য করে বলল, মূল্যহীন কথা বলল না। আর তাছাড়া তুমি চাও না যে আমি এবং ভিনসেন্ট বাটালি হই।
ব্রঙ্কস এনক্লেভের পূর্ণ দায়িত্বে রয়েছে পেটি– এনক্লেভের প্রধান কর্মকর্তা পেটির বড় গুণ হচ্ছে সমাজের নিচু স্তরের লোকজনদের ধনী করে তোলার জন্য সে সচেষ্ট অনুপ্রেরণা যুগিয়ে থাকে সবসময়। এ প্রক্ষিতে তার অংশও পেটি মাঝে দিয়ে দেয়।
তোমরা হচ্ছ পেটুক ধরনের লোক, জর্জিও তিরস্কারের হাসি হাসল। বলল, তবে আমি বুড়োর জন্য কুড়ি শতাংশের সুপারিশ করব।
পিপি জানে জর্জিও’র এই কুড়ি শতাংশের মানে হবে দশ কিংবা পনের শতাংশ। এমন কৌশলের অবতারণা জর্জিও’র অনেক পুরনো দিনের অভ্যাস।
ভিনসেন্ট পিপিকে প্রশ্ন করল, তা নির্ণয় করব? এর মানে ফিউবার্টা কিংবা তার লোকদের যার কাছ থেকে যত টাকাই আদায় করা হোক না কেন, তা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেবে- এটা একটা বন্ধুত্বপূর্ণ ইঙ্গিতও বটে। অর্থাৎ যাদের কপালে অবধারিত মৃত্যুর পরোয়ানা জারি করেছেন ডন, তাদের বেঁচে থাকার একটা সুযোগ করে দিতে চায় তার পুত্ররা, সেই আত্মসাৎকৃত টাকা উদ্ধার করে। এতে প্রাণে বেঁচে যাবে ফিউবার্টা ও তার চার সদস্য, আর আর্থিক লাভ হবে ডনপুত্রদের। ভিনসেন্ট বুঝতে পারল পিপির কথার সারমর্ম।
পিপি ভিনসেন্টকে আশ্বস্ত করে বলল, নিশ্চিন্ত থাকো ভিন্স। আমিই তা নির্ধারণ করে দেব।
ছোট্ট ডেন্টির দিকে চোখ গেল পিপির। সে দেখল ডনের হাত ধরে ডেন্টি বাগানে হেঁটে বেড়াচ্ছে। ততক্ষণে টেবিলে বসা সবার চোখ সেদিকেই স্থির হলো। পিপি জর্জিও’র মন্তব্য শুনতে পেল আকস্মিক। জর্জিও বলল, ডেন্টি এবং আমার বাবার এই একাকী হেঁটে বেড়ানোটা এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। স্বপ্নের মতো মনে হয়। অথচ বাবা কখনো আমার সাথে এমন বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করেননি। তাদের দিকে তাকিয়ে উদাসভাবে জর্জিও বলল, তারা সব সময় গিসগিসিয়ে কি যেন অনবরত বলে চলেছে। এক দিক থেকে এটা ভালোই, বুড়ো যথেষ্ট স্মার্ট ও জ্ঞানী, ছোট ডেন্টি তার কাছে শিখবে অনেক কিছু।
পিপির চোখে পড়ল ডেন্টি যেন মাথা উঁচিয়ে ডনের দিকে তাকিয়ে কিছু বলছে। তাদের এই কথোপকথনকে মনে হলো ডন এবং ডেন্টি যেন এমন কিছু গোপন পরামর্শ করছে, যা পৃথিবী এবং স্বর্গের কর্তৃত্বপূর্ণ কোনো বার্তার আদান-প্রদান।
অত্যন্ত সতর্ক পিপি ডি লিনা, সতর্ক তার পরিকল্পনা। অল্প সময়ের মধ্যেই পিপি ড্যানি ফিউবার্টার কেস দক্ষতার সাথে সম্পাদন করতে শুরু করল। এর জন্য সে শুধু গরিলার মতো ছোটাছুটি করেই ক্ষান্ত হয়নি, তাকে হতে হয়েছে রীতিমতো দক্ষ কারিগর। প্রতিটি ক্ষেত্রে পিপি মনোস্তাত্ত্বিক বিষয়ের অবতারণা করেছে শক্তি প্রয়োগ করে নয়। তবে ফিউবার্টা ও তার সঙ্গীদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করতে প্রাথমিক অবস্থায় পিপিকে তিনটি সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। তার লক্ষ্য প্রথমত, তাকে আত্মসাৎকৃত সমস্ত টাকা উদ্ধার করতে হবে। দ্বিতীয়ত, ভিনসেন্ট এবং পেটির সাথে সতর্কতামূলক সমন্বয় সাধন করতে হবে (অবশ্য এই পর্বটি খুব কঠিন নয়। পেটি এবং ভিনসেন্ট উভয়েই তাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে দক্ষ। দুই দিনের মধ্যেই তারা তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিনিধিদের নামিয়ে দিল অপরাধীদের অনুসরণ করতে। কৌশলে অপরাধীদের কাছ থেকে তাদের অপরাধের স্বীকারোক্তিও নেয়া হলো। তারপর শুরু হলো ক্ষতিপূরণ আদায়ে মোলকলার প্রয়োগ) এবং তৃতীয়ত, ড্যানি ফিউবার্টাকে হত্যা।
ফিউবার্টাকে হত্যা করার কৌশল পিপি অন্যরকমভাবেই চিন্তা করে রেখেছে। সড়ক কিংবা অন্য কোনো দুর্ঘটনায় ফিউবার্টার মৃত্যু পিপির জন্য সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি। আর এর জন্য পিপি তাঁকে বিাঞ্চলীয় একটি চায়নিজ রেস্তোরাঁয় নিমন্ত্রণ করবে। তার আগে কৌশলে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে পিপি নিজের প্রতি তার আস্থা অর্জন করে নেবে। হলোও তাই। পিপির নিমন্ত্রণ উপেক্ষা করতে পারল না ফিউবার্টা। সে জানে, পিপি জানা হোটেলের পক্ষে কালেক্টর হিসেবে নিয়োজিত। চায়নিজ হোটেলে নিমন্ত্রণ পিপি যে ব্যবসায়িক স্বার্থেই করছে, এটুকু বুঝতে অসুবিধে হয়নি ফিউবার্টার।
চায়নিজ হোটেলে মুখোমুখি হলো দুজন। স্বাভাবিক, সাবলীল ও ধীর ছিল পিপির আচরণ। রেস্তোরাঁর ওয়েটার আসার অপেক্ষায় ছিল তারা। এর মঝে পিপি বলল, গ্রোনিভেল্টের কাছ থেকে আমি জেনেছি সব। ক্রেডিট কার্ডধারীর শনাক্তের দায়িত্ব বরাবর তোমার। আর এ প্রেক্ষিতে সেদিনের সেই চার অপরাধীর দায়ভারও তোমাকেই বহন করতে হবে।
পিপির দাবি বেমালুম অস্বীকার করল ফিউবার্টা। পিপি একটু ঝুঁকে এলো ফিউবার্টার মুখোমুখি। আলতো করে কাঁধ চাপড়ে পিপি কমরেডের মতো বলল, কাম-অন ড্যানি, কেন মিছেমিছি ভান করছ? গ্লোনিভেন্টের কাছে একেবারে চলমান প্রমাণ রয়েছে। তাছাড়া সেই চারজন তাদের অপরাধ স্বীকার করেছে। একটু থেমে স্বাভাবিক হলো পিপি। আগের মতোই ধীর কণ্ঠে বলল, তুমি কিন্তু দারুণ বিপাকে জড়িয়ে পড়েছ। তবে ইচ্ছে করলে আমি তোমাকে মুক্তি দিতে পারি, যদি তুমি টাকাগুলো ফিরিয়ে দাও। হতে পারে আমি তোমাকে তোমার সেই পুরনো জাঙ্কেট ব্যবসায় পুনরায় ফিরিয়ে আনতে পারি।
এই কথাগুলোর সত্যতা প্রমাণ করতে পিপি চারটি ছবি তুলে ধরল ফিউবার্টার সামনে, এরা হচ্ছে তোমার সেই সাঙ্গ-পাঙ্গ, পিপি বলল। এবং এরা এদের সব দোষ উগরে দিয়েছে। আর সব অপরাধ এখন চেপেছে তোমার ঘাড়ে। এ অবস্থায়, তুমি যদি তোমার ভাগের চার লাখ ডলার ফিরিয়ে দাও, এটাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। সবার কাছে তুমি পরিষ্কার হয়ে যাবে।
ফিউবার্টা ছবিগুলো দেখে বলল, আমি অবশ্য এই ছবির চার ব্যক্তি সম্পর্কে জানি। কিন্তু এরা হচ্ছে প্রচণ্ড রকমের কঠিন লোক তারা কখনোই এমন কথা বলবে না।
পিপি এবার বলল, যে তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন, তিনি স্বয়ং ক্লেরিকুজিও।
হায় কপাল! ড্যানির কণ্ঠে উৎকণ্ঠা। সরাসরি অস্বীকার করে সে বলল, আমি তখন জানতামই না যে সেই চার ব্যক্তি হোটেলে আছে।
এখন তো জানলে, সাড়াশির মতো চেপে ধরেছে যেন পিপি। বলল, তারা যদি তাদের টাকাগুলো ফেরত না দিত তবে তুমি আরো বিপদে পড়তে।
তোমার সামনে থেকে আমার উঠে যাওয়াটাই ভালো, অপ্রস্তুত হলো ফিউবার্টা।
উঁহু, পিপির শান্ত অথচ কঠিন স্বরে দমানোর চেষ্টা। পিপি বলল, লাভ করতে পারবে না। চারদিকে লাঠি, তাছাড়া পিকিংয়ের হাঁসগুলো কিন্তু বেশ! দেখো, আমি খুব বড় কোনো চুক্তির প্রস্তাব করছি না। সবারই জীবনে এরকম কিছু ভুল হয়ে থাকে, ঠিক? তোমারও হয়েছে। তুমি শুধু টাকাগুলো ফিরিয়ে দাও।
আ-আমার কাছে তার কোনো অবশিষ্টই নেই। আমতা, আমতা করে বলল ফিউবার্টা।
আকস্মিক উত্তেজিত হলো পিপি এতক্ষণ সময়ের কথোপকথনে এটাই তার প্রথম ক্ষুব্ধ আচরণ। পিপি বলল, তোমার অন্তত এতটুকু শ্রদ্ধা দেখানো উচিত ছিল। ঠিক আছে, তুমি এক লাখ দাও আপাতত, বাকি তিন লাখের জন্য আমরা তোমাকে সময় ও ব্যবস্থা দুটোই করে দেব।
অক্টোপাসের আকরে আটকা পড়েছে ফিউবার্টা– পালাতে পারবে না। চিন্তার রেখা কপালে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠছে। মুখ শুকিয়ে যেন ছোট গোল পিঠের মতো হয়ে গেছে। বেশ কিছুটা সময় নীরব থেকে আকস্মিক বলে উঠল, আমি পঞ্চাশ হাজার ফিরিয়ে দিতে পারি।
এই তো, দারুণ, চমৎকার। উল্লসিত হলো পিপি। তবে বাকি অংশের জন্য তুমি তোমার চলমান জাঙ্কেট থেকে প্রাপ্য অর্থ ছেড়ে দেবে। ঠিক আছে?
আমি রাজি। ফিউবার্টা প্রতিউত্তরে বলল।
আর চিন্তা করো না। এবার নাও, সামনের খাবারগুলো উপভোগ করো। একথা বলেই পিপি একটি প্যানকেকের মধ্যে হাঁসের মাংস এবং মিষ্টি সসের মিশ্রণ দিয়ে রোল তৈরি করল। ফিউবার্টার হাতে রোলটি দিয়ে বলল, বিষয়টি খুব ভয়ানক, ড্যানি। ঠিক আছে, আগে খাও তারপর হবে ব্যবসার আলাপ।
তৃপ্তির সাথে খেল পিপি চায়নিজ খাবার। খাওয়ার শেষে চকলেট আইসক্রিমের স্বাদও নিল দুজনে। তারপর পকেট থেকে ডলার বের করে চুকিয়ে দিল বিল। অফিসিয়াল ওয়ার্কিং আওয়ার শেষে ফিউবার্টার ট্রাভেল এজেন্সি থেকে পঞ্চাশ হাজার ডলার পাবার আশায় চায়নিজ ছেড়ে বেরিয়ে গেল তারা দুজনে। পিপি যথাবিহিত সম্মান দেখিয়ে এগিয়ে দিল ফিউবার্টাকে।
ড্যানি ফিউবার্টা তার আটচল্লিশ বছরের জীবনে সহজভাবে কখনোই কিছু করেনি। চরম অবস্থায় না পৌঁছানো অবধি সে সহজে ছাড় দেয়নি কোনো ক্ষেত্রে। পিপির সাথেও তেমনই আচরণ করল ফিউবার্টা। চায়নিজে পিপির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসার পর সেই যে ডুব দিল আর দেখা মিলল না তার। তবে একটি ম্যাসেজ ঠিকই পাঠিয়েছে পিপিকে। পিপির কাছে পাঠানো বার্তায় সে লিখেছে– জানাদু হোটেলের কাছে সে যে ঋণী হয়ে পড়েছে, সেই ঋণ শোধে অর্থ সংগ্রহের জন্য তাকে এলাকা ছেড়ে যেতে হলো।
ফিউবার্টার এ আচরণে পিপি বিস্মিত হয়নি। এমন ক্ষেত্রে সে যে তার পুরনো অভ্যাসের অবতারণা করবে, তা আর নতুন কি? তবে পিপি বুঝতে পারল, ফিউবার্টার কাছে কোনো অর্থ নেই এবং ভিনসেন্ট ও পেটি তাদের নিজ দায়িত্বে ফিউবার্টার চার সঙ্গীর কাছ থেকে ডলার আদয় না করা পর্যন্ত কোনো বোনাস প্রাপ্তিও হবে না।
ফিউবার্টার খোঁজে পিপি ব্রঙ্কস এনক্লেভের কিছু লোক লাগিয়ে দিল। তাকে অপরাধী হিসেবে আখ্যা দিয়ে ঘোষণা করা হলো– ফিউবার্টা ক্লেরিকুজিও’র মোস্ট ওয়ান্টেড লোক। পিপির তৎপরতা তন্নতন্ন করে খুঁজতে লাগল এনক্লেভের লোকজন এ গলি, সে গলি, উপশহর, শহরতলি– সম্ভাব্য সব জায়গায়। কিন্তু লাভ হলো না তেমন।
এভাবেই কেটে গেল একটি সপ্তাহ। দিনের পর দিন, সপ্তাহ পেরিয়ে যেতে লাগল, আরো সেই সাথে বাড়তে লাগল পিপির ক্ষুব্ধতা।
সপ্তাহ পেরিয়ে এলো আরেক সপ্তাহ। কিন্তু কোনো ফল এলো না। তবে পিপি অত্যন্ত অসহিষ্ণু হয়ে উঠল। তার ধৈর্যের সমস্ত বাধ যেন ভাঙল। আগের চেয়ে আরো ভয়ানক হয়ে উঠল তার মানসিকতা।
এদিকে ড্যানি ফিউবার্টা আত্মগোপন করে ছিল আপার ওয়েস্ট সাইডের একটি ছোট হোটেলে। ব্যাপারটি আঁচ করতে পেরেছিল একজন ক্লেরিকুজিও প্রতিনিধি। ফিউবার্টার সম্ভাব্য খোঁজ পেয়ে সৈন্যটি জানাল পিপিকে। পিপি সেখানে এসে পৌঁছল তাৎক্ষণিক। কিন্তু ততক্ষণে ফিউবার্টা হোটেল ছেড়ে বেরিয়ে গেছে। ফিউবার্টার খোঁজে পিপি তখন মরিয়া। আকস্মিক শব্দে পিপি বিস্মিত হলো। ফিউবার্টার আসলে আগ্নেয়াস্ত্র চালনায় কোনো অভিজ্ঞতাই নেই। খুব দ্রুত কিছু একটা ঘটিয়ে ফেলতে চেয়েছিল ফিউবার্টা। তাই যখন সে পিপিকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়তে লাগল–বুলেটগুলো লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে ছড়িয়ে পড়ছিল। অবশ্য ততক্ষণে পিপিও ফিউবার্টাকে লক্ষ্য করে যে কয়টি গুলি ছুঁড়েছিল, তার পাঁচটিই বিদ্ধ করেছিল তাকে।
তবে ঘটনাটি দুর্ভাগ্যজনকভাবে পিপির বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিল। কয়েকটি বিষয়ের কারণে পিপি বিপদে পড়ে যায়। বিষয়গুলো হলো– এক. ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী তো ছিলই। দুই, ঘটনার পর পালিয়ে যাওয়ার মুহূর্তেই টহল পুলিশের উপস্থিতি। তিন. পিপি এমন হত্যাকাণ্ডের প্রস্তুতি নিয়ে সেখানে পৌঁছেনি। সে চেয়েছিল, নিরাপদ কোনো স্থানে ফিউবার্টার সাথে আরো এক দফা আলোচনায় বসবে। চার বিষয়টি এড়িয়ে যেতে পারত পিপি। কিন্তু, প্রত্যক্ষদর্শীরা স্পষ্ট সাক্ষী দিয়েছিল প্রথমেই গুলি চালায় পিপি। আর এটাই এখন ঘটনার প্রধান অপরাধের সূত্র যে, প্রথম গুলিটি যাবে যার কাছ থেকে অইনত সেই সবচেয়ে ভয়ানক ও অপরাধী ব্যক্তি। পিপি অবশ্য তর অস্ত্রে সাইলেন্সর সংযুক্ত করেছিল। সে ভেবেছিল, নিরাপদ কোনো স্থানে আলোচনাকালে প্রয়োজনে ফিউবার্টাকে হত্যা করে সরে পড়বে।
ফিউবার্টাকে হত্যার পর পালিয়ে যাওয়ার সময় টহল পুলিশের উপস্থিতিতে পিপি আর কোনো চেষ্টাই করল না। এমনকি নিজের পালিয়ে যাওয়ার রাস্তা পরিষ্কার করতে সে কোনো কর্মকর্তাকে হত্যাও করল না। এ বিষয়ে ডন ক্লেরিকুজিও’র স্পষ্ট ও কঠোর নির্দেশ পিপি সেই বিশৃঙ্খল মুহূর্তেও পালন করেছিল, সম্মানের সাথে। ডনের নির্দেশ ছিল, কখনো, কোনো অবস্থাতেই যেন আইনের কোনো কর্মকর্তাকে হত্যা করা না হয়। পিপি অক্ষরে অক্ষরে পালন করল তা। পুলিশ দেখে থমকে দাঁড়াল সে, তারপর তার হাতের অস্ত্রটি রাখল পায়ের কাছে লাথি মেরে অস্ত্রটি পৌঁছে দিল পুলিশ কর্মকর্তাদের দিকে। অত্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করল পিপি। কিন্তু স্পষ্ট অস্বীকার করল পথের ওপর পড়ে থাকা মৃত মানুষটির সাথে তার কোনো সম্পর্কের কথা।
এমনভাবে ঘটনাগুলো ঘটে গেল, যেন সবকিছুই ছিল পূর্ব পরিকল্পিত। কোনো দৈব ঘটনা নয়, আকস্মিক ঘটনা নয়। পিপির জীবনটাই এমন। সে যতই পরিকল্পনা করুক, সম্ভাব্য বিপদ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে যত্নশীল হোক– সমস্যা তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরবেই। দুর্ভাগ্য যেন তার নিত্য সঙ্গী। পুলিশ কাস্টোডিতে বসে পিপির এ মুহূর্তে মনে হচ্ছে যেন, সে অস্বচ্ছ ভাগ্যের ঘূর্ণি আবর্তে ক্রমেই তলিয়ে যাচ্ছে। তবে এ চিন্তায় ভেঙে পড়েনি সে। বরং সে জানে, এমন অবস্থায় তাকে থাকতে হবে যথাসম্ভব শান্ত-মস্তিষ্ক। আরেক ভরসা ক্লেরিকুজিও ফ্যামিলি– তারা তাকে ঘূর্ণি আবর্ত থেকে তুলে এনে তীরে নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করবে।
তীরে তরী ভেড়াতে সম্ভাব্য পদক্ষেপগুলো নিমেষেই ভাসতে লাগল পিপির মনে– প্রথমেই পিপির জামিন লাভের জন্য নিয়োগ করা হতে পারে উঁচু দরের উকিল তারপর হবে আইনি মারপ্যাঁচ। বিজ্ঞ বিচারক ও আইনজীবীরা অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সাথে, সাহসিকতার সাথে পিপিকে সুরক্ষার জন্য উপস্থাপন করবে একে একে যুক্তি তর্ক। এসব যুক্তি তর্কে পিপির বিরুদ্ধে হয়তো দাঁড়াবে প্রত্যক্ষদর্শীরা। আইনজীবীরা তাদের দেখা ঘটনাকে ভিত্তিহীন বলে প্রমাণ করার চেষ্টা চালাবে। তাদের স্মৃতিশক্তি নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে। এমনকি যে আমেরিকান আইনজীবী তাদের পেশায় বিশ্বস্ত, অনুগত বলে পরিচিত, তারাও হয়তো পিপিকে সরাসরি অপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত করবে না– কিঞ্চিৎ উৎসাহী হবে কর্তৃপক্ষকে পরাজিত করতে।
ক্লেরিকুজিও ফ্যামিলির পক্ষে দীর্ঘজীবনে পিপি ডি লিনার এটাই প্রথম আদালতে উপস্থিতি এবং সবচেয়ে বিব্রতকর অবস্থা তার জন্য এই যে, আদালতে মামলা চলাকালীন পিপির সাথে তার স্ত্রী ও সন্তানদেরও উপস্থিত থাকতে হবে। এই নিরপরাধ পরিবারের জন্য একটি আনন্দদায়ক রায়ের ব্যবস্থা আইনজীবীরা অবশ্যই করবে।
পিপি ডি লিনার বিরুদ্ধে যে মামলার রায় যাবে না এ বিষয়ে নিঃসন্দেহ সে। তারপরও এক অজানা আশঙ্কা।
রায়ের দিন সেই পুলিশ কর্মকর্তারা পিপি ডি লিনাকে ঘটনাস্থলেই দেখেনি বলে সাক্ষী দিল। পিপির বিরুদ্ধে সাক্ষী দেয়ার জন্য উপস্থিত হয়েছিল পাঁচজন প্রত্যক্ষদর্শী। তাদের তিনজন আইনজীবীদের চাপে পিছিয়ে গেলেও অপর দুজন পিপির বিরুদ্ধে কঠিন অবস্থান নিয়েছিল। তবে তারাও একসময় নিজেদের একরোখা মনোভাব থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়। তারা বুঝতে পারে, এ মামলার আইনজীবীরা, এমনকি পুলিশ, বিচারক সবাই একই সূত্রে গাঁথা।
যে হোটেলে ফিউবার্টা আশ্রয় নিয়েছিল, তার মালিকও ক্লেরিকুজিও’র সামন্ত। পিপির পক্ষে সাক্ষী দিতে গিয়ে সে বলল ফিউবার্টা হোটেলের বিল পরিশোধ না করে পালিয়ে যেতে উদ্যত হলে সে তার পিছু নেয়, এ সময় কোত্থেকে যেন বুলেট এসে লাগে তার গায়ে। তবে তার হত্যাকারী যে পিপি নয়, এটা নিশ্চিত। ফিউবার্টা নামে লোকটির হত্যাকারী অন্য কেউ।
আকস্মিক একটা হোঁচট খেল পিপি। তার শরীর শিথিল হয়ে এলো। চারদিকে যেন নেমে এলো ঘোর। পলকেই পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দর্য উধাও হয়ে গেল। শুধু পিপিই নয়, ন্যালিনি নিজেও এমন এক অসারতা অনুভব করতে লাগল। ন্যালিনি মোটেও কিছু রেখে-ঢেকে বলেনি। পিপিকে একজন খুনি হিসেবে আখ্যা দিয়ে সাফ বলে দিয়েছিল তাকে বিছানার পাশে নিয়ে কখনোই আর শুতে পারবে না। তার কোনো আনন্দে অংশীদার হতে পারবে না।
তবে পিপি মানসিকভাবে কিছুটা শান্তি পেয়েছিল এই ভেবে, ন্যালিনির কাছে তার জীবনের এই কালো অধ্যায় আর বেশি দিন লুকাতে হবে না। এই লুকোচুরির খেলায় পিপি খুব অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছিল।
ন্যালিনির ডিভোর্স কথাটি তখনও পিপির মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। যতটা সম্ভব নিজেকে শান্ত করার চেষ্টায় বিভোর সে। এভাবেই বেশ কিছুটা সময় কেটে গেল। এক পর্যায়ে স্বাভাবিক হলো পিপি। শান্ত কণ্ঠে বলল, ঠিক আছে, তাহলে আমরা ডিভোর্সের পথেই এগুবো। এক পলক থামল সে, তারপর বলল, আমি আমার সন্তানদের হারাতে চাই না।
আমি তোমার সম্পর্কে স্পষ্টই সব জেনে ফেলেছি। প্রতিউত্তরে বলল ন্যালিনি। তোমার মুখোমুখি আর হতে চাই না আমি এবং আমার সন্তানদেরও তোমার মতো মানুষের সাথে থাকতে দেব না।
এবার পিপি সত্যিই বিস্মিত হলো। এই কি সেই ন্যালিনি যে প্রয়োজন ছাড়া কখনোই কিছু বলেনি। যে কখনো মুখরাও ছিল না কিংবা পিপির ঘাড়ে কখনোই চাপিয়ে দেয়নি কিছু জোর করে। সেই শান্ত, সহিষ্ণু রমণী আজ পিপি ডি লিনার মতো একজন দাপটে ব্যক্তির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কথা বলছে, তাও আবার দাবির সুরে সত্যিই হতবাক পিপি।
মনে মনে একরোখা হয়ে উঠলেও পরক্ষণেই সে পরিহার করল সেই মনোভাব। তার মনে হলো নারীমাত্রই তাদের পরিণাম সম্বন্ধে উদাসীন। পিপির মস্তিষ্কে উদয় হতে লাগল বিভিন্ন ধরনের ভাবনা। সে উপলব্ধি করল এগার বছরের ক্রস এবং দশ বছরের ক্লডিয়াকে তাদের মায়ের মতো করে গড়ে তুলতে পারবে না। তাছাড়া এ-ও বুঝতে পারল, তার সাথে ক্রসের ঘনিষ্ঠতা আছে সত্য, কিন্তু দুই সন্তানই ন্যালিকে খুব ভালোবাসে।
এমন ভাবনা থেকেই মনে মনে সে ন্যালিনির প্রতি উদারতা দেখাতে সম্মত হলো। প্রকৃত অর্থে তার কাছ থেকে পিপি পেয়েছে একটি গোছানো সংসার, সন্তান, পায়ের নিচে শক্ত এক খণ্ড মাটি যা সব পুরুষেরই জীবনের চরম চাওয়া-পাওয়া। ন্যালিনি যদি তার জীবনে না আসত তবে কে জানে পিপির জীবনের স্রোত কোন দিকে প্রবাহিত হতো?
আগের মতো শান্ত কণ্ঠে বলল, আচ্ছা, ঠিক আছে, এ প্রসঙ্গটি বাদ দাও। এই বিচ্ছেদের মুহূর্তে পরস্পরের মধ্যে যেন তিক্ততার সৃষ্টি না হয়। তারপর আরো স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করল পিপি। বলল, জাহান্নামে যাক আমাদের এই বারোটি বছর। এ সময়টি ছিল আমাদের সুখের, আনন্দের। এই ছোট্ট পরিসরে আমরা পেয়েছি দুটি ফুটফুটে সন্তান– এ সবের জন্য তোমাকে ধন্যবাদ। কিছুক্ষণের জন্য থামল পিপি। তারপর আবারো ন্যালিনির কঠোর চেহারার দিকে তাকাল।
বলল, কাম অন ন্যালিনি, আমিও তো তাদের বাবা হিসেবে খারাপ ছিলাম না। তারাও আমাকে ভালোবাসে। আর তুমি যা চাও, সেভাবেই আমি তোমাকে সাহায্য করতে চাই। তুমি বরং ভেগাসেই থেকে যাও। আর আমি তোমাকে জানাদু হোটেলেই একটি দোকান দেয়ার ব্যবস্থা করছি, কাপড়, জুয়েলারি কিংবা অ্যানটিক, যে কোন প্রকারের। এ থেকে প্রতি বছর তুমি দুহাজার গ্রান্ড আয় করতে পারবে। এর ফলে আমরা খুব অল্প সময়ের জন্য হলেও আমাদের সন্তানদের সাথে শেয়ার করতে পারব।
আই হেইট ভেগাস। সব সময় আমি ভেগাসকে ঘৃণা করে এসেছি।
এতক্ষণে মুখ খুলল ন্যালিনি। আমার শিক্ষকতার ডিগ্রি আছে এবং স্যাকরামেন্টোতে আমি একটা কাজও জুটিয়ে নিয়েছি। ইতিমধ্যে বাচ্চারা সে স্কুলে যাওয়া-আসাও শুরু করেছে।
এবার পিপির অবাক হওয়ার পালা। এতক্ষণে সে বুঝতে পারল এই নারী ছিল ভেতরে ভেতরে সর্বদাই তার বিরোধী এবং মারাত্মক। নারী সম্পর্কে পিপির এত দিনের ধারণাকে ভুল বলে প্রমাণিত করল ন্যালিনি। তার কাছে নারী কখনোই ভয়াবহ বলে কিছু ছিল না। সে যে নারীই হোক না কেন। স্ত্রীকে তো সে ভয়াবহ মনে করেইনি, মিসট্রেস থেকে শুরু করে মা, চাচি, খালা কিংবা কোনো বন্ধুর স্ত্রী, এমনকি ডনের কন্যা রোজ ম্যারিকেও তার কখনো সাংঘাতিক কিছু মনে হয়নি। পিপি তার এই দীর্ঘ জীবনে এমনই এক পৃথিবীতে বাস করে এসেছে, যেখানে নারীরা কখনোই শত্রু হিসেবে আবির্ভূত হয়নি।
ন্যালিনির আচরণে ধাক্কা খেলেও, চট করে বদলে গেল পিপি। কেউ যখন তাকে নিয়ে খেলতে আরম্ভ করে, কিংবা তার বন্ধুত্বকে অস্বীকার করে– এমনকি তার উচ্চাসকে দমাতে চেষ্টা করে তখন সে আর আত্মসংবরণ করতে পারে না। মাথায় আগুন ধরে যায়। ন্যালিনির আচরণেও তার এমন হলো।
স্পষ্ট জানিয়ে দিল পিপি, আমি স্যাকরামেন্টো গিয়ে আমার সন্তানদের সাথে দেখা করতে পারব না। পিপি ভীষণভাবে চটে গেল। তবে নিজেকে সংযত রেখে গম্ভীরভাবে কথাগুলো বলল সে। ন্যালিনি যে গোপনে এতদূর এগিয়েছে, পরিকল্পনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে– একথা ভেবে পিপি সবচেয়ে বেশি আশ্চর্য হয়েছে।
পিপি বলল, একটু আগেই বলেছ যে তুমি আমার সম্পর্কে জেনে গেছ। তাই বলছি, সতর্ক হও। স্যাকরামেন্টো যাও, আর সমুদ্রের তলদেশে যেখানে ইচ্ছে সেখানে যাও, আমার আপত্তি নেই। তবে তুমি কেবল একজনকে নিয়ে যেতে পারবে। অপরজন থাকবে আমার কাছে।
খুব শীতল দৃষ্টিতে ন্যালিনি তাকাল পিপির দিকে। বলল, আদালতই এর রায় দেবে। আমার মনে হয় তোমার একজন লয়ার নিয়োগ করা উচিত, যে আমার লয়ারের সাথে আলোচনা করবে।
বিস্ময়ে বিস্ময়ে হতবাক পিপি। যতই সময় যাচ্ছে সে যেন নতুন থেকে নতুন ভুবনে প্রবেশ করছে, আর আশ্চর্য হচ্ছে। ন্যালিনির এমন উপদেশে পিপি যখন বিস্ময়ে হা হয়ে গেছে তখন ন্যালিনি হেসেছে তার ক্রুর হাসি।
তুমি উকিলও নিয়োগ করেছ!পিপির বিস্ময়। তুমি? আইনের ভয়ও দেখালে?
এবার আর বিস্ময় নয়, নিজেকে আরেক দফা পরিবর্তন করল পিপি। অকস্মাৎ উচ্চস্বরে হেসে উঠল। দীর্ঘ সময় ধরে পিপির এ হাসি যেন উন্মাদের মতো, ভয়াবহ বিপদের আশঙ্কাযুক্ত। ন্যালিনি চমকে গেল কিছুটা। প্রচণ্ড ঘৃণাবোধ হলো তার পিপির প্রতি। মনে হলো সে এক বিকারগ্রস্ত মানুষ।
বারো বছর ধরে সে এই মানুষটির সাথে কাটিয়েছে। প্রেমিক সেজে তার শরীরের একটু উষ্ণতা পেতে এই লোকটিই তার কাছে কত অনুনয়-বিনয়ই না করেছে, অবশেষে তার কাছে সঁপে দিয়েছে সে নিজের দেহ, মন, প্রাণ। হায় কপাল! একটুও বুঝতে পারেনি সে। চুড়ান্ত মুহূর্তে এসে আজ ন্যালিনি বুঝতে পারল সব– কেন সবাই পিপিকে শ্রদ্ধা করে এত, কেন তাকে ভয় পায় সবাই।
পিপির সার্বিক আচরণে ন্যালিনি যতটা না পেয়েছে ভয়, তার চেয়ে অনেক বেশি পেল কষ্ট। আর খুব সহজেই পিপির প্রতি তার ভালোবাসাও নিঃশেষ হয়ে গেল। বারোটা বছরের সমস্ত স্মৃতি, সমস্ত ভালোলাগা ভালোবাসা যেন নিমেষেই মিলিয়ে গেল ন্যালিনির মন থেকে।
শান্ত কণ্ঠে পিপি বলল, তুমি যা-ই সিদ্ধান্ত নাও না কেন, আই ডোন্ট কেয়ার। জাজের সিদ্ধান্তেও আমার কিছু যায়-আসে না। যদি সোজা পথে আসো, তবে আমার কাছেও অনুরূপ আচরণ পাবে। যদি বাঁকা হতে চাও তবে তোমার কপালে দুর্ভোগ আছে।
এই প্রথমবারের মতো ন্যালিনির মনে হলো পিপির সারা অঙ্গ যেন বিশ্রী রকমের পেশিবহুল বিদঘুটে। অথচ এই শক্ত-সমর্থ শরীরের প্রতি এক সময় ন্যালিনির ছিল প্রচণ্ড আগ্রহ, অপার ভালোবাসা। পিপিকে ভালোবাসার আরেকটি কারণ হলো তাদের বারো বছরের এই দাম্পত্য জীবনে পিপি কখনোই ন্যালিনির সাথে উচ্চ স্বরে কথা বলেনি, ন্যালিনির কোনো ব্যয়ে কৌতুক করেও কখনো কিছু বলেনি এবং এটাও সত্য, পিপি ছিল সন্তানদের জন্য সত্যিকার একজন ভালো বাবা। তাদের প্রতি তখনই পিপি রেগে যেত, যদি ক্রস কিংবা ক্লডিয়ার মধ্যে কেউ মায়ের অবাধ্য হতো।
কিছুটা নমনীয় হয়ে আসছিল ন্যালিনি কিন্তু পিপি যেন ক্রমেই হয়ে উঠছিল কঠোর। চেহারার বিকৃতি ঘটতে শুরু করেছিল। প্রচণ্ড রকমের মানসিক বিপর্যস্ত পিপির চিবুকে যেন অতিরিক্ত কিছু মাংস যোগ করে দিয়েছে কেউ। ন্যালিনির মনে হলো পিপির কপালে যেন কেউ খাজ কেটে তৈরি করে দিয়েছে রেখা। চিকন ঐ-জোড়া কপালের ভাঁজে মিশে ফর্সা করে ফেলেছে অংশটুকু। মাথার চুলগুলো যেন রুক্ষ মেজাজের সাথে ঘোড়ার মতো ঝরঝরে হয়ে উঠছে। সুন্দর নিষ্পাপ চোখ দুটোতে আগুনের লহমা– তাতে বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট নেই নমনীয়তার ভাব।
ন্যালিনির কণ্ঠ ভিজে এলো। বলল, আমি জানতাম তুমি আমাকে ভালোবাস। কিন্তু কিভাবে তুমি আমার সাথে এতটা রুক্ষ আচরণ করতে পারছ? ন্যালিনি নিজেকে আর সামলাতে পারল না, কেঁদে ফেলল।
ন্যালিনির অশ্রুতে কিছুটা হলেও ভিজল পিপি, আমি, যা বলছি, শোনো। বলল, লয়ারের সাথে নয়, তুমি যদি কোর্টে যাও, তবে সব কিছু লক্ষ্মন করেই তোমাকে যেতে হবে। আর এখনই তুমি আমাদের সন্তানদের দুজনকে পাচ্ছ না। শোনো ন্যালিনি, আমাকে খেপিও না, আমি তা চাই-ও না।
একটু থেমে পিপি আবার বলল, আমি বেশ বুঝতে পারছি, তুমি আমার সাথে আর কোনো মতেই থাকতে চাইছ না। সব সময় আমি মনে করতাম তোমার মতো একজন নারী পেয়ে আমার জীবন ধন্য হয়েছে। সারা জীবন তোমাকেই আঁকড়ে থাকব। তোমাকে সুখ দিয়ে ভরে দেব তুমিও সুখী করবে আমাকে। আর আজ আমার সেই ভালোবাসার মানুষটিই আমার কাছ থেকে তো সরছেই, আমাকে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে আদালতের কাঠগড়ায়।
কয়েক পলক থামল পিপি। কণ্ঠ ভারী হয়ে এলো, আমি এখন বার্ধক্যে। পরিবার ছাড়া আমি থাকতে চাই না।
তোমার আছে ক্লেরিকুজিও পরিবার, ন্যালিনি বলল।
হ্যাঁ, তা আছে, প্রতিউত্তর পিপির, তোমার এটা মনে করা উচিত। যাই হোক, আমি আমার বার্ধক্য জীবন একাকী কাটাতে চাই না।
হাজার হাজার লোক আছে তোমার, ন্যালিনি বলল, নারীও আছে।
তারা আমার সহযোগী নয়। কোনো একজন আছেন, যিনি তাদের জীবনের সিদ্ধান্ত দেন। আর অনেকে তাদের অস্তিত্বে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। আমি তাদের মতো হতে চাই না।
উপহাসের স্বরে ন্যালিনি বলল, তুমিও তাদের পক্ষে ভেটো দাও!
ঠিক তাই হয়তো করা উচিত, হেসে ফেলল পিপি। ন্যালিনির দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ।
ন্যালিনি বলল, ঠিক আছে যখন তোমার ইচ্ছে, তুমি সন্তানদের দেখে আসতে পারবে। তবে দুজনই থাকবে আমার কাছে।
একথা শুনে পিপি ন্যালিনির দিকে পেছন ফিরে দাঁড়াল এবং বলল, তোমার যা ইচ্ছে হয় করো। বলেই পিপি চলে যেতে উদ্যত হলো।
দাঁড়াও, ন্যালিনির ডাকে ঘুরে দাঁড়াল পিপি। তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল ন্যালিনি কিছুক্ষণ। প্রাণহীন এক ফ্যাকাশে মুখ দেখে ন্যালিনির খুব মায়া হলো। বলল, ঠিক আছে, সন্তানদের কেউ যদি তোমার সাথে যেতে চায়, আমি মেনে নেব।
পিপি উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল। নিমেষেই যেন সমস্ত বিপর্যস্ত ভাব উবে গেল তার চেহারা থেকে। পিপির মনে হলো জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে খুব কঠিন। কোনো সমস্যার সমাধান হলো এই মাত্র।
চমৎকার, চেঁচিয়ে উঠল পিপি। তোমার শিশুটি ইচ্ছে হলেই ভেগাসে এসে আমার সাথে দেখা করবে। আর আমারটাও যাবে স্যাকরামেন্টো তোমার সাথে দেখা করতে। দারুণ হবে। চলো, আজ রাতেই আমরা প্রস্তুতি নিয়ে ফেলি।
ন্যালিনি পিপিকে নতুন জীবন শুরু করার জন্য আরেক দফা শেষ প্রস্তাব দিতে কার্পণ্য করল না। বলল, চল্লিশ বছর এমন কোনো বয়স নয়। তুমি আবার নতুন করে শুরু করতে পারো।
পিপি মাথা নেড়ে বলল, কখনোই না। তুমিই ছিলে আমার জীবনে একমাত্র নারী! তুমি ছিলে আমার কাছে সেই ভারতীয় বধূদের মতো। আমি তোমাকে বিয়ে করেছিলাম একটু দেরিতেই। তবে আমি জানি আমি আর কখনোই বিয়ে করব না। ঠিক যেভাবে তোমাকে আমি ধরে রাখতে পারিনি, সেভাবে নতুন করে কোনো কিছুই শুরু করা হবে না আমার।
হয়তোবা, ন্যালিনির সন্দিগ্ধ উত্তর। আর তুমি আমাকে পুনরায় ভালোও বাসতে পারবে না।
তবে তোমাকে হত্যা করতে পারব। ন্যালিনির দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল পিপি। কথাটি কৌতুক করেই বলল সে।
কিন্তু পিপির চোখের দিকে তাকিয়ে বিশ্বাস করল ন্যালিনি। সে বুঝতে পারল এটা পিপির একটা ক্ষমতার সূত্র। যদি সে কাউকে হুমকি দেয়, তাতে বাস্তবতার মিশেল তো থাকেই।
তবে প্রসঙ্গ পাল্টে ন্যালিনি আবারো পিপির উদ্দেশ্যে বলল, মনে রেখো, যদি সন্তানরা দুজনই আমার সাথে থাকতে চায় তবে তুমি বাধা দিতে পারবে না।
তারা তাদের বাবাকেও ভালোবাসে, পিপির নিশ্চিত উত্তর। সে বলল, তাদের যে কোনো একজন থাকবে এই বুড়ো মানুষটির সঙ্গে।
ডিনার পর্ব শেষ হলো। সারাটা ঘরে ছিল বরফ শীতল ঠাণ্ডা। অপরদিকে বাইরের আবহাওয়া যেন মরুভূমির তপ্ত প্রবাহ। এমনই এক পরিমণ্ডলে আজ হতে চলেছে দুটি জীবনের চূড়ান্ত ফয়সালা।
এগার বছরের ক্রস আর দশ বছরের ক্লডিয়া। বাবা-মায়ের পরিণাম ভোগ করতে হবে তাদেরও, বাবা-মায়ের বিচ্ছেদের রেশ পোহাতে হবে তাদেরও। তারাও একরকম প্রস্তুত। ইতিমধ্যেই সব কিছু খুলে বলা হয়ে গেছে ক্রস এবং ক্লডিয়াকে। এখন শুধু তাদের মতামতের অপেক্ষা- কে যাবে কার সাথে।
সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার, বাবা-মায়ের ডিভোর্সের এই সিদ্ধান্তে ক্রস কিংবা ক্লডিয়ার চোখে-মুখে কোনো ভাবান্তর নেই। ভাবনা কেবল এই, তারা কার সাথে যাবে, বাবা, না-কি মায়ের সাথে?
ক্রস হ্যান্ডসাম। তার মায়ের মতোই সুন্দর। তবে তার ভেতরে যে দৃঢ়তা, তা বাবার মতো। এ মুহূর্তে সে সম্পূর্ণরূপে ভীতিহীন। দৃঢ়তার সাথে ক্রস বলল, আমি মার সাথেই থাকছি।
ক্লডিয়া একটু ঘাবড়ে গিয়েছে– কি বলবে সে? ভেবে পাচ্ছে না। তবে ক্রসের মতামত শুনে এই ছোট্ট শিশু ক্লডিয়া বলল, আমি ক্রসকে ছেড়ে যাব না।
হোঁচট খেল, পিপি সাথে বিস্মিতও হলো। ক্রস ছিল পিপির সবচেয়ে কাছের। ন্যালিনির চেয়েও বেশি। ক্রস হচ্ছে সেই ছেলে যে পিপির সাথে হতো শিকারের সঙ্গী। সে বাবার সাথে কার্ড খেলতে পছন্দ করত– খেলত গলফ এবং বক্সিং। ন্যালিনির বই পড়া কিংবা মিউজিক শোনায় তার কোনো আগ্রহই ছিল না। এই সেই ক্রস! পিপি ভেবেছিল অন্তত ক্রস তাকে ফেলে যাবে না।
বিস্মিত হলো ক্লডিয়ার অত্যন্ত কৌশলী উত্তরে। এ মেয়েটি অনেকটাই তার নিজের মতো দেখতে অবশ্যই স্মার্ট। তবে সে যে তার মায়ের দিকটাই টানবে, এটা যুক্তিযুক্ত। এর কারণ– ন্যালিনি যা করে ক্লডিয়া তাই ভালোবাসে। বাবার কর্মকাণ্ডের প্রতি তার আগ্রহ নেই বললেই চলে। এমন সন্তান নিয়ে পিপি কি করবে?
গভীরভাবে লক্ষ্য করতে লাগল পিপি তার সন্তানদের। মনে মনে গর্বিত হলো সে। অন্তত সন্তানরা তাদের মাকে চিনতে পেরেছে।
ন্যালিনি আজ সেজেছে বিশ্রী কালো পোশাকে কালো ট্রাউজারের সাথে কালো পুলওভার। মাথার সোনালি চুলগুলোও ঢেকে দিয়েছে কালো হেডব্যান্ড বেঁধে। চিকন, লম্বাটে দেখাচ্ছে ন্যালিনির মুখ– কালোর মাঝে সাদা এক লম্বাটে বৃত্ত।
এ অবস্থায় সচেতন পিপি— অন্তত শিশুদের সামনে তার নির্দয় আচরণ ও অভব্যক্তি থেকে স্বভাবসুলভ স্বাভাবিক থেকে পিপি শিশুদের উদ্দেশে বলল, সব কিছুর পরও আমি তোমাদের মধ্য থেকে অন্তত একজনকে পেতে চাই। কথা দিচ্ছি, ইচ্ছে করলেই তোমরা যে কোনো সময় দুজন দুজনের সাথে দেখা করতে পারবে। তোমরা আমাকে এই ভেগাসে একা ফেলে যেও না।
স্থির দৃষ্টি হেনে দুজনই তাকিয়ে থাকল বাবার দিকে। পিপি ন্যালিনির দিকে তাকাল। কণ্ঠে অনুনয়ের স্বর। বলল, এ ব্যাপারে তোমাকেই সহযোগিতা করতে হবে। তোমাকেই নির্ধারণ করতে হবে কাকে তুমি নেবে।
উত্তেজিত হয়ে উঠল পিপি, আমাকেই কেন ছাড়তে হবে সব?
তুমি কিন্তু কথা দিয়েছিলে– তাদের দুজনই যদি আমার সাথে যেতে চায় তবে তুমি বাধা দেবে না। ন্যালিনি মনে করিয়ে দিল পিপিকে তার প্রতিশ্রুতির কথা।
পিপির অনুভূতিগুলো যেন কেমন হয়ে যাচ্ছে। কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না যে সব কিছু শেষ হয়ে যাবে অল্প সময়ে। তবে সে জানে তার সন্তানরা তাকে ভালোবাসে। মাকে ভালোবাসে একটু বেশি, এই যা। তার অর্থ এই নয় যে শিশুরা যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা একেবারে সঠিক। অবজ্ঞাভরে ন্যালিনি বলল, এর পর আর কিছুই বলার থাকে না। তুমি যেখানে কথা দিয়েছ
পিপি বুঝতে পারছে না তার সামনে দাঁড়ানো মানুষগুলোর চোখে তাকে কেমন দেখাচ্ছে। তবে সে নিজেকে যতটা সম্ভব সংযত রাখার চেষ্টা করেছে। কথায়-আচরণে স্বাভাবিকই থাকার চেষ্টা চালিয়ে গেছে, যেন নিজের বিরুদ্ধে নিজের যুদ্ধ। কিন্তু অপর পক্ষের আচরণ কেন এত কঠিন?
সংযত কণ্ঠেই পিপি বলল, আমি তো আমার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করিনি। আমি শুধু তোমার সহযোগিতা চেয়েছি। শেষ চেষ্টাটুকুতেও কি তোমার এত আপত্তি?
ন্যালিনি অনমনীয়। মাথা নেড়ে বলল, নাহ, তুমি অসম্ভব হয়ে উঠছ। আমাদের শেষ পর্যন্ত আদালতের দ্বারস্থই হতে হবে।
পিপি এবার বুঝতে পারল এই মুহূর্তে তার কি করা উচিত। খুব ধীর কণ্ঠে যেন ফোয়ারা ছুড়ল পিপি ন্যালিনির উদ্দেশে, তুমি যা চাইছ, আমার জন্য তা কঠিন কোনো ব্যাপারই নয়। তুমি তোমার পথে যেতে পারো। তবে আজকের এ বিষয়টি মনে রেখো। মনে করে দেখো আমাদের জীবনের কথা। একটু ভেবে দেখো–তোমার পরিচয় কি, আরো আমিইবা কে? আমি তোমার কাছে কাকুতি করে ভিক্ষে চেয়েছি। এই চাওয়া আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা ভেবেই। ক্রস আমার মতো, পক্ষান্তরে ক্লডিয়া পেয়েছে তোমার গুণ। ক্রস আমার সাথেই থাকবে ভালো, আর ক্লডিয়া তোমার সাথে, তোমার পরিমণ্ডলে। এটাই হচ্ছে আমার চাওয়ার উদ্দেশ্য।
কয়েক পলক থামল পিপি। তারপর বলল, সন্তানরা যে আমার চেয়ে তোমাকেই বেশি ভালোবাসে এটা জেনেও কি তোমার জন্য যথেষ্ট হয়নি?
পিপির এ কথায় যেন ঘরের সমস্ত পরিবেশ রুদ্ধ হয়ে গেল। থেমে গেল পিপির থমথমে গলা। সে চায় না যে সে যা বলছে তা তার সন্তানরা বুঝুক। তবে ন্যালিনি বুঝতে পারল। সব কিছু উড়ে গেল, পিপির ওপর যে ভীতি ভাব ছিল তা-ও সরে গেল। ন্যালিনি যেন ছোঁ মেরে টেনে নিল ক্লডিয়াকে তার বুকের মাঝে।
আর ক্লডিয়া তাকিয়ে রইল তার ভাই ক্রসের দিকে। মিনতিভরে শুধু একবার ডাকল, ক্রস…।
ক্রসের মুখমণ্ডলে ছিল উদাসীন সৌন্দর্য। মায়ের দিক থেকে ঘুরে দাঁড়াল ক্রস। তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল বাবার দিকে। পাশে গিয়ে দাঁড়াল সে। শান্ত কণ্ঠে বলল, আমি তোমার সাথেই যাব, ড্যাড। উচ্ছ্বসিত পিপি কৃতজ্ঞ চিত্তে ক্রসের হাত তুলে নিল নিজ হাতে।
অনাকাক্ষিত এ দৃশ্যে হতবাক ন্যালিনি ডুকরে কেঁদে উঠল। বলল, যখন তোমার ইচ্ছে হবে আমাকে দেখতে এসো, ক্রস। স্যাকরামেন্টোয় তোমার একটা আলাদা বেডরুম থাকবে সাজানো। সেটা কেউই ব্যবহার করবে না।
যা ঘটার ছিল— ঘটল না, ঘটল উল্টোটা। অন্তত ন্যালিনি কয়েক মুহূর্ত আগেও ভাবেনি যে ক্রসকে তার ছেড়ে যেতে হবে!
কিন্তু পিপি যেন উচ্ছ্বসিত। যেন ফিরে পেয়েছে তার জীবনের সব কিছু। মনের একটা ভারী বোঝা যেন নেমে গেল মুহূর্তেই। বোধশক্তিও লোপ পেল তার। অকস্মাৎ বলে উঠল, আমাদের এবার সেলিব্রেট করা উচিত।
একটু থেমে আবার বলল, এটা সত্য যে আমাদের বিচ্ছেদ হয়ে গেল। তবে এখন থেকে একটি সুখী পরিবারের বদলে আমাদের দুটি সুখী পরিবার হব এবং পরবর্তী যে কটা দিন বাঁচব, সুখেই থাকব।
পিপির এ কথা শুনে কঠিন মুখে তাকিয়ে থাকল সবাই তার দিকে। নিজেকে সামলে সে বলল, ঠিক আছে, যা ঘটেছে তা তো ঘটেছেই। আমরা সুখী হবার চেষ্টা করব।
প্রথমে দুবছর ভেগাস-স্যাকরামেন্টো যোগাযোগ মোটামুটি নিয়মিত ছিল। এরপর থেকে ক্লডিয়া আর কখনোই ভেগাসমুখো হয়নি। ক্রস কিন্তু অব্যাহত রেখেছিল ন্যালিনি ও তার বোন ক্লডিয়াকে দেখতে যাওয়া। ক্রসের যখন পনের বছর বয়স, তখন থেকে তার স্যাকরামেন্টো সফরও কমে যায়। শুধু ক্রিসমাসের ছুটিতেই সে যেত মা ও বোনের সাথে দেখা করতে।
এভাবেই দুই শহরে পৃথক থেকে বাবা ও মা তাদের প্রাপ্ত সন্তান নিয়ে কাটিয়ে যাচ্ছিল। ক্লডিয়া যতই বেড়ে উঠতে লাগল, তার মধ্যে ধীরে ধীরে দেখা গেল মায়ের গুণ। সে ভালোবাসে স্কুল, ভালোবাসে বই পড়তে, থিয়েটার তার পছন্দ, মায়ের মতো সে-ও ভালোবাসে ফিল্ম কিংবা মিউজিক। মোট কথা, মায়ের সব পছন্দ, ভালোলাগাগুলো তার মধ্যে দেখা গেল। আর ন্যালিনি তার মাঝে দেখতে পেল বাবার তেজোদীপ্ত চরিত্র ও উচ্ছ্বাস। বেশ সুখী ছিল মা ও মেয়ে স্যাকরামেন্টোতে।
সে তার বন্ধু-বান্ধব নিয়ে এক প্রকার সুখী জীবনই কাটিয়ে যাচ্ছিল। ইতিমধ্যেই তার পদোন্নতি হলো। একটি পাবলিক হাই স্কুলের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রিন্সিপাল হলো ন্যালিনি।
অপর দিকে পিপি ও ক্রস ও কাটিয়ে যাচ্ছিল সুখী জীবন। তবে ন্যালিনি ক্লডিয়ার চেয়ে ভিন্ন ভিন্ন তাদের জীবন পদ্ধতি, ভিন্ন তাদের প্রেক্ষাপট। পিপি তার মতো করে গড়ে তুলছিল ক্রসকে। ক্রস যখন হাই স্কুলে, তখন পিপি বুঝতে পারল, এথলেটে সে তার সব বন্ধুদের চেয়ে অনেক এগিয়ে আর লেখাপড়ায় ঠিক ততটাই পিছিয়ে। হাই স্কুলের পাট চুকিয়ে ক্রস আর কলেজের লেখাপড়ায় আগ্রহী হলো না। তাছাড়া তার মধ্যে আরেকটি বিষয় ছিল লক্ষ্য করার মতো একজন সুদর্শন যুবক হয়েও ক্রসের নারীর প্রতি তেমন একটা আসক্তি ছিল না।
ক্রস তার বাবার সাথে উপভোগ করছিল জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র। পিপির যে কোনো সিদ্ধান্ত যতই খারাপ হোক না কেন ক্রস যেন উৎসাহিত হয়ে উঠত, উপভোগ করত। ক্লডিয়ার কাছে যেমন তার মা তেমনি পিপিও ক্রসের কাছে। একজন ভালো বাবা, একজন ভালো বন্ধু হয়ে উঠল। ক্রসের মাঝে পিপি বিলিয়ে দিল তার সবটুকু তৈরি করল সম্পূর্ণ তার মতো করে।
ক্রস মেতে উঠল জানাদু হোটেলের কাজকর্ম নিয়ে। শো-গার্লদের প্রতি তার ছিল খুব সাধারণ প্রবৃত্তি। এসব ক্ষেত্রে অবশ্য পিপি তার পুত্রের ওপর জোর করে কোনো বাধা-নিষেধ আরোপ করেনি। তবে তার ইচ্ছে ক্রস যাতে ক্লেরিকুজিও পরিবারে তার অবস্থান করে নেয়। আর ডন ক্লেরিকুজিও’র একটি উদ্ধৃতির প্রতি পিপির দারুণ বিশ্বাস। ডন প্রায়ই বলতেন, প্রত্যেকটি মানুষের জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে তার রুটিটুকু আয় করে নেয়া।
ছেলের ভবিষ্যৎ চিন্তা করেই পিপি তাকে কালেকশন এজেন্সির অংশীদার করে নিল। তাছাড়া প্রায়ই ক্রসকে নিয়ে সে যেত গ্লোনিভেন্টের সাথে ডিনার করতে। এই সাক্ষাতে, আলাপ-আলোচনায় যাতে গ্রোনিভেল্ট তার দিকে শুভ দষ্টি দেয়। এভাবে ধীরে ধীরে ক্রস গ্রোনিভেল্টের গলফ সঙ্গীতে পরিণত হলো। ক্রসের মাত্র সতের বছর বয়সে যেভাবে গলফের বল নির্দিষ্ট গর্তে পৌঁছে দিত, দেখে মুগ্ধ হতে গ্রোনিভেল্ট। আর তাই সে ক্রসকেই তার পার্টনার করত প্রায় সময়। দুপার্টনার মিলে জিততে শুরু করল একের পর এক চ্যালেঞ্জ। পিপি উচ্ছ্বাস নিয়ে তাদের এই জয়ের আনন্দ উপভোগ করত, গর্বিতও হতো।
গ্রোনিভেল্টকে জয় করার পর পিপি ক্রসকে নিয়ে গেল নিউইয়র্কে ক্লেরিকুজিও পরিবারে। সে দিনটি ছিল ৪ এপ্রিল- ক্লেরিকুজিও পরিবারের সার্বিক হলিডে। অর্থাৎ এই দিনটিতে ফ্যামিলির সমস্ত বিয়ে এবং মৃত্যুবার্ষিকী একসাথেই পালন করা হয়। আর এই দিনে উপস্থিত হয় ক্লেরিকুজিও ফ্যামিলির সব সদস্য। ক্রসের শরীরের ক্লেরিকুজিও’র রক্ত। তারও অধিকার আছে এ অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার।
ক্রমেই ক্রস তার বাবার সাথে থেকে শিখছিল নতুন নতুন সব বিষয়। প্রতি সপ্তাহে একবার পিপি জানাদু ক্যাসিনোয় তার আট হাজার ডলারের জন্য যায়। এবার ক্রসকেও নিয়ে গেল সাথে। ক্রস বসে বসে দেখছিল আর সব আয়ত্ত করে নিচ্ছিল। পিপি তাকে গ্যাম্বলিংয়ের সমস্ত কলা-কৌশল শিখিয়ে দিচ্ছিল। ক্রসকে শিখিয়েছিল, যদি কখনো মন সায় না দেয়, যেন গ্যাম্বলিং টেবিলে না বসে ক্রস। দিনে যাতে দুঘণ্টা আর সপ্তাহে তিন দিনের বেশি যাতে কিছুতেই না খেলে। আর জিদ করে যেন কখনোই বড় দান না বসায়।
একজন বাবা হয়ে ছেলেকে পৃথিবীর এই ঘৃণ্যতম বিষয় শেখানোটা অনেকের দৃষ্টিতেই ঠিক পছন্দসই হলো না। তবে পিপির যুক্তি, কালেকশন এজেন্সির জুনিয়র পার্টনার হিসেবে ক্রসের জন্য এই শিক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি পিপি তার ছেলের জন্য নিজেই করতে চায়।
কতটুকু শিক্ষা পেল ক্রস? এবার তার যাচাইয়ের পালা। পিপি তাকে পাঠাল ক্যালিফোর্নিয়ায় মাফিয়া ব্ৰুগলিওনের কাছে। এখান থেকে কালেকশন করাটা খুব সহজ নয়। ক্রসকে শিখিয়ে দেয়া হয়েছিল, সে যাতে জোর করে সেখান থেকে আদায়ের চেষ্টা না করে। প্ররোচনার মাধ্যমেই যেন চেষ্টা করা
ক্যালিফোর্নিয়ার এই ব্ৰুগলিওনের ক্ষমতা পিপির মতো নয়। ছোটখাটো একটা প্রতিনিধি ক্লেরিকুজিও’র। মাত্র হাজার গ্রান্ড জানাদু হোটেলে প্রেরণ করে সে। ক্লেরিকুজিও’র নাম ফলাও করার মতোও সে নয়।
খুব খারাপ সময় ক্রস মাফিয়া ব্যারনকে পাকড়াও করল। ফ্যালকো নামের এই ব্যারন বা ক্ৰগলিওন প্রথমে ক্রসের কথা শুনল তারপর অকস্মাৎ তার অস্ত্রটি সোজা কেড়ে নিয়ে গেল ক্রসের কণ্ঠনালি বরাবর। বলল, আর একটি কথাও যদি তোমার মুখ থেকে বের হয় তবে গুলি করে তোমার ওই টনসিল এফোঁড়-ওফোঁড় করব।
এমন অবস্থাতেও ক্রস বিস্মিত হলো তার নিজের মতো করে। অত্যন্ত স্বাভাবিক ছিল তার অভিব্যক্তি। ভয়ের চিহ্নমাত্রও ছিল না তার চেহারায়। স্বাভাবিক কণ্ঠেই বলল, মাত্র পঞ্চাশ গ্রান্ডের জন্য এ অবস্থা? আমার বাবা এটা পছন্দ করবে না।
কে তোমার বাবা? ফ্যালকোর অস্ত্রটি আগের মতোই ক্রসের কণ্ঠ বরাবর ধরে জিজ্ঞেস করল।
পিপি ডি লিনা, প্রতিউত্তরে কৌতুক করে বলল ক্রস। এই ফিফটি গ্রান্ডের সমাধা না হলে বাবা আমাকে গুলি করবে।
ফ্যালকো হেসে ফেলল। তার অস্ত্রটি রেখে দিল যথাস্থানে। বলল, ঠিক আছে, তাকে বলো আমি নিজেই ভেগাসে গিয়ে পরিশোধ করে আসব।
আসার আগে আমাকে জানিও কিন্তু। আমি তোমাকে তোমার প্রচলিত আচরণ মোতাবেক অভ্যর্থনা জানাব। পুনরায় ক্রসের কৌতুকপূর্ণ উত্তর।
পিপিকে চিনতে পারল ফ্যালকো। তবে ক্রসের চেহারায় এমন কিছু একটা ছিল যা ফ্যালকোকে খুব সহজেই নিরস্ত্র করতে বাধ্য করল। ক্রসের মধ্যে ছিল না ভয়ের লেশমাত্র ভাব, অত্যন্ত শীতল তার প্রতিউত্তর এবং ছোটখাটো রসালো কথাবার্তা, ক্রসের এমন সপ্রতিভ আচরণ যেন বন্ধুত্বের আহ্বান। তবে এ ঘটনা থেকে ক্রস শিক্ষা পেল যে ভবিষ্যতে কোনো সংগ্রহে তার সাথে অবশ্যই থাকতে হবে একটি অস্ত্র এবং দেহরক্ষী।
ক্রসের এই সাহসিকতার কাহিনী শুনে খুশি হলো পিপি! এক ছুটির দিনে ক্রসকে উৎসাহ দিতে জানাদু হোটেলে করা হলো ছোট একটি আয়োজন। গ্রোনিভেল্ট বাপ-বেটা দুজনকেই অভিনন্দন জানালেন। উপহার দিল দুজনকেই চমৎকার দুটি সুট। ক্রসকে পৃথকভাবে দিলেন ব্ল্যাক টিপসের একটি পার্স।
গ্রোনিভেল্টের বয়স তখন আশি। মাথার চুলগুলো সব পেকে গেছে। তবে শরীরের সতেজতা হারায়নি তখনও। ক্রসের হাতে পার্সটি তুলে দিয়ে গ্রোনিভেল্ট বলেছিলেন, এভাবে যদি জয় না আসে তবে এটি আমি ফেরত নেব। এবার মন দিয়ে শোনো, তোমার সামনে মাত্র একটি সুযোগ। আমার হোটেলের কয়েকটি ক্ষেত্র আছে। এর মধ্যে একটি বড় গলফ কেস। জুয়াড়িরা সুদূর জাপান থেকে এখানে আসে গলফের ওপর দান ধরতে। আমাদের আছে ভোজন রসিকদের জন্য অত্যাধুনিক রেস্তোরাঁ আর আছে সুন্দরী শো-গার্ল, যারা চলচ্চিত্র এবং সঙ্গীত জগতের তারকা। আমাদের আছে সুন্দর টেনিস কোর্ট, সুইমিং পুল এবং হোটেলের নিজস্ব বিমান। এ বিমান তোমাকে সাত সমুদ্র ঘুরিয়ে আনবে– এ সবই ফ্রি। এর জন্য তোমার ওই পার্সের পাঁচ গ্র্যান্ডও খরচ করতে হবে না। শুধু জুয়াড়ি হবে না।
তিনদিনের ছুটিতে ক্রস সম্পূর্ণরূপে সময় দিল গগ্ৰানিভেল্টকে। কাটাল গ্রোনিভেল্টের উপদেশ অনুসরণ করে। এই তিন দিনের প্রতিটি সকাল ক্রস কখনো গ্রোনিভেল্ট, কখনো তার বাবা কিংবা জানাদু হোটেলের উঁচু দরের বোর্ডারদের সাথে গলফ খেলে কাটাল। গ্রোনিভেল্ট ক্রসের প্রত্যেকটি স্ট্রোক লক্ষ্য করে দেখল, সে যখন উঁচু করে নির্দিষ্ট গর্তের দিকে স্টেক করে তখনই তার লক্ষ্য হয় সুনিপুণ। এটা উপলব্ধি করার সাথে সাথে গ্রোনিভেল্ট বিস্ময় ও আনন্দের সাথে চেঁচিয়ে উঠল, ইস্পাতের মতো স্নায়বিক অবস্থা।
খুব কাছে চলে এলো ক্রস গ্রোনিভেল্টের । কয়েক বছরের মধ্যে ক্রস বুঝতে পারল পিপি এবং গ্রোনিভেল্টের মধ্যে কতটা আন্তরিক সম্পর্ক। উভয়েই উভয়ের খুব ভালো বন্ধু। প্রতি সপ্তাহ অন্তর তাদের অন্তত একবার দেখা হওয়া চাই-ই। দিনে অবসর না হলেও অন্তত ডিনারে। তাছাড়া পিপির কর্মকাণ্ড সম্পর্কেও সে অন্তত গ্ৰোনিভেল্টের পরামর্শ নেবেই, যদিও ব্যবসায়িক প্রতিটি পদক্ষেপ ক্লেরিকুজিও ছাড়া নেয়া হয় না। অপর দিকে গ্রোনিভেল্টও জানাদু হোটেলের সমস্ত কর্মকাণ্ড সম্পর্কে পিপির সাথে শেয়ার করে দ্বিধাহীন চিত্তে। তবে ভিলাগুলোর ব্যাপারে অবশ্য গ্রোনিভেল্টের যত রাখ-ঢাক।
এদিকে ক্রস সতর্কতার সাথে উপলব্ধি করল, গ্রোনিভেল্ট তার প্রতি বেশ আগ্রহী। ক্রসের জন্য সে অতিরিক্ত একটা প্রশ্রয় যেন তুলে রাখে। বৃদ্ধ বয়সেও গ্রোনিভেল্টের নারী আসক্তি ছিল। ক্রস তা অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বুঝতে পারল। জানা হোটেলের স্বত্বাধিকারী গ্রোনিভেল্টের পেন্থ হাউস সুইটে যে প্রায়ই শো-গার্লদের আনাগোনা ছিল তা বুঝতে পেরেছিল ক্রস। প্রথম দিকে বিষয়টি গোপন রাখলেও পরে বন্ধু ভেবেই, ক্রসের কাছে প্রকাশ করেছিল সব, পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল শো-গার্লদের সাথে। তবে এ বিষয়ে ক্রস সুদর্শন হওয়া সত্ত্বেও খুব একটা আগ্রহী ছিল না। বরং মেয়েরাই ছিল তার প্রতি দুর্বল।
গ্রোনিভেল্টের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক সৃষ্টির পর থেকে ক্রস প্রায়ই একান্তে আলোচনা করত ব্যবসায়িক দিক সম্পর্কে। এমনই এক আলোচনায় একদিন শিক্ষকের মতো নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছিলেন গ্রনিভেল্ট। জানা হোটেলের ক্যাসিনো এবং এর বিভিন্ন খুঁটিনাটি দিক সম্পর্কে দীক্ষা নিচ্ছিল ক্রস। আলোচনার এক পর্যায়ে ক্রস একটু দ্বিধা নিয়েই জানতে চাইল, জানা হোটেলের যেসব মেয়ে কাজ করছে তাদের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে অর্থাৎ জানাদু হোটেলে তাদের কাজের সম্পর্ক কিংবা গ্রোনিভেল্টের সাথেই তাদের সম্পর্কটা আদতে কেমন?
হেসে ফেললেন গ্রোনিভেল্ট। ক্রসের কথার প্রতিউত্তরে বললেন, হোটেলের বিভিন্ন শো-তে এই মেয়েদের আমি বিনোদনের জন্য ছেড়ে দেই। আবার কিছু কিছু মেয়ের সাথে আমি আচরণ করি পুরুষের মতো। এখন তুমি যদি তোমার ভালোবাসাপূর্ণ জীবনের জন্য আমার কাছে উপদেশ চাও, তাহলে তোমাকে আমি বলতে বাধ্য হব যে, একজন বুদ্ধিমান, নির্ভরশীল মানুষ হিসেবে নারীদের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই।
একটু থামলেন গ্রোনিভেল্ট। তারপর আবার শুরু করলেন, তোমাকে অবশ্যই দুটি ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। নাম্বার ওয়ান এবং একই সাথে অত্যন্ত বিপজ্জনক হচ্ছে সেসব মেয়ে যাদের বয়স ও সঙ্গতি উভয়েরই অভাব বর্তমান। দ্বিতীয়ত, সেই সব মেয়ে যারা তোমার চেয়েও বেশি উচ্চাকাঙ্ক্ষী।
এসব বলছি, তাই বলে আবার ভেবে বসো না যে আমি একেবারে হৃদয়হীন। আমি ইচ্ছে করলে একটি মেয়েকে এমন অবস্থায় ফেলে দিতে পারি। তবে সেটা আমাদের কাজ নয়। আমি অবশ্যই নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি, কারণ বিশ্বের যে কোনো পার্থিব বিষয়ের মধ্যে জানাদু হোটেল আমার সবচেয়ে ভালোবাসার জিনিস। তবে হ্যাঁ, আমার যে সন্তান নেই, তার জন্য আমার আক্ষেপ আছে। এ কথা আমি তোমার কাছে অস্বীকার করব না।
তাহলে তোমার মতে, এটাই পার্ফেক্ট লাইফ। ক্রস বলল। তুমি কি তাই ভাবছ? গ্রোনিভেল্টের রসিকতাপূর্ণ প্রশ্ন। বেশ, আমি তাহলে এর জন্য বিল চুকিয়ে যাব।
কুওগে ব্যাপক টানাহেঁচড়া শুরু হয়ে গেল ক্রসকে নিয়ে। ক্লেরিকুজিও ফ্যামিলির মেয়েদের মধ্যেই ক্রসকে নিয়ে এই উত্তেজনা।
ক্রসের বয়স তখন মোটে কুড়ি। হ্যান্ডসাম তো বটেই, সুদর্শন, টানটান শক্ত শরীর বয়স অনুপাতে এমন পুরুষ সঙ্গীর স্বপ্ন সব মেয়েরাই দেখে থাকে। ক্রসকে দেখে ক্লেরিকুজিও ফ্যামিলির সবাই কৌতুক করে বলেছিল, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে সে দেখতে তার মায়ের মতো হয়েছে, বাবার মতো নয়…! এমন রসিকতা অবশ্য তাকে হেয় করার জন্য নয়, কিংবা তার বাবার উদ্দেশ্যেও নয়।
ইস্টার সানডের দিন, যখন সবাই সানডে উৎসবে মেতে ছিল, কাজিন ডেন্টির কাছ থেকে ক্রস জানতে পারল ফ্যামিলিতে তার বাবার প্রকৃত অবস্থান সম্পর্কে।
বিশাল প্রাচীর ঘেরা বাগান– যেন দিগন্ত জুড়ে। শেষ নেই যেন এ প্রাচীরের। বাগানের বেশিরভাগ অংশ জুড়ে ফ্যামিলির সদস্যদের অবাধ বিচরণ। ক্রস এবং ডেন্টি লক্ষ্য করছিল দূর থেকে। হঠাৎ ক্রসের চোখে পড়ল একটি চমৎকার মেয়ে। তাকে ঘিরে রয়েছে একদল যুবক।
অপরদিকে ক্রস লক্ষ্য করল, পিপি একটি বাফেট টেবিল থেকে বারকোশে করে মাংসের কাবাব নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে একদল যুবতীর দিকে। দেখা গেল, সুন্দরী মেয়েটি পিপিকে দেখে যেন সংকুচিত হয়ে পড়েছে। নারী মহলে বাবা যে প্রিয় তা ক্রস জানে। পিপির কুৎসিত দিকগুলোর সাথে সাথে তার চমৎকার রসবোধ, তেজস্বীতা এবং ব্যক্তিত্ব যে কোনো নারীকে খুব সহজেই কাবু করে ফেলে।
ক্রসের সাথে সাথে ডেন্টিরও চোখ পড়ল মেয়েটির দিকে, আর সাথে সাথেই বলে উঠল, চমৎকার মেয়ে। ক্রসের উদ্দেশ্যে বলল, চলো, তার সাথে পরিচয় করিয়ে দিই।
কাছে গিয়ে মেয়েটির দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য ডেন্টি ডাকল, লিলা, এসো পরিচয় করিয়ে দিই। এ হচ্ছে আমাদের কাজিন ক্রস।
ডেন্টি কিংবা ক্রসেরই সমবয়সি লিলা। তবে তার শারীরিক কাঠামোয় এখনও নারীত্ব ফুটে ওঠেনি। এই বয়ঃসন্ধিক্ষণ কিংবা তার নব যৌবনের এই সময়ের কারণেই লিলার সৌন্দর্যে যেন একটা খুঁত রয়ে গেছে কোথাও। মধুরঙা চুল লিলার, ত্বকে যেন সদা সতেজতার আভা। সে তুলনায় মুখমণ্ডল পরিপূরক নয় মনে হবে যেন এখনো পরিপূর্ণ গঠনই হয়নি তার।
লিলার পরনে ছিল অ্যাঙ্গোরা সোয়েটার। এই পরিধেয়টি তার সফেদ ত্বককে করে তুলেছে স্বর্ণাভ। মুখোমুখি হতেই যেন ক্রস লিলার প্রেমে পড়ে গেল।
কিন্তু ক্রস যখন তার সাথে কথা বলতে আগ্রহী হলো, লিলা কেন যেন এড়িয়ে গেল তাকে। ক্রস ও ডেন্টির কাছ থেকে সরে লিলা গিয়ে বসল আরেক টেবিলে।
মর্মাহত হলো ক্রস। ডেন্টিকে বলল, আমার মনে হয় সে আমাকে ঠিক পছন্দ করেনি। মুখে একটা শুষ্ক হাসি টেনে ক্রসকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করল ডেন্টি। ধূর্ততার সাথে অপর এক দল সমবয়সি যুবকদের দিকে হাত উঠিয়ে অভিবাদন জানাল।
কোকড়ানো ঘন-কালো চুল ডেন্টির। অনেকটা ডন ক্লেরিকুজিও’র মতো। আর তা প্রদর্শনের জন্য সে ক্যাপ পরলেও অভিনব কায়দায় কিছুটা বের করে রাখে, যেমন রেখেছে এ মুহূর্তে। বেশ খাটো আকৃতির, উচ্চতা পাঁচ ফুটের দু এক ইঞ্চি বেশি হতে পারে বড়জোর। তবে তার আত্মবিশ্বাস, দৃঢ়তা প্রখর। আর এর মূলে রয়েছে স্বয়ং ডন ক্লেরিকুজিও’র প্রচ্ছন্ন নির্ভরতা ও ভালোবাসা। এ বয়সেও ডন প্রায়ই ডেন্টিকে নিয়ে মুক্ত বাতাসে হাঁটতে বের হন।
ক্রসের উদ্দেশ্যে ডেন্টি বলল, মেয়েটির নামের শেষে রয়েছে এনাকস্তা! ক্রস তার স্মৃতি হাতড়ে নামটি মনে করার চেষ্টা করল। মনে পড়ল তার বছর খানেক আগে এক এনাকস্তা পরিবার ট্র্যাজেডির মুখে পড়েছিল।
মিয়ামি হোটেলের এক কক্ষে পরিবারটির কর্তা এবং তার বয়োজ্যেষ্ঠ পুত্রকে কেউ যেন হত্যা করেছিল। মনে করতে পারল ক্রস। কিন্তু এই ঘটনার সাথে মেয়েটির সম্পর্ক কি?
ডেন্টি ক্রসের চিন্তাযুক্ত সংকুচিত মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। তার কাছ থেকে কোনো প্রশ্ন কিংবা উত্তর আশা করছিল ডেন্টি।
বিস্মিত ক্রসের সপ্রশ্ন কণ্ঠে বলল, এর মানে?
তুমি তো তোমার বাবার হয়েই কাজ করছ, তাই না? ডেন্টির সহজাত প্রশ্নঃ হ্যা! ক্রসের বিস্ময়বোধ যেন বাড়ছে।
লিলার সাথে নিশ্চয়ই সম্পর্ক গড়তে চাও? মুচকি হেসে বলল ডেন্টি। তুমি দুর্বল হয়ে পড়েছ।
ক্রস জানে এর উত্তর দেয়াটা বিপজ্জনক হতে পারে। ডেন্টির এ প্রশ্নের কোনো উত্তর দিল না ক্রস।
ডেন্টি এবার বলল, তুমি কি জানো না তোমার বাবার কাজটা কি?
সে একজন মানি কালেক্টর। তাৎক্ষণিক জবাব দিল ক্রস।
ডেন্টি মাথা নেড়ে নেতিবাচক উত্তর দিল। বলল, তোমার জানা দরকার। তোমার বাবা ফ্যামিলির জন্য মানুষদের একেবারেই সরিয়ে ফেলে।
এক ঝটকা ঝড়ো হাওয়ায় সব কিছু যেন পরিষ্কার হয়ে গেল। ক্রস এত দিনে বুঝতে পারল, কেন তার মা বাবাকে পছন্দ করত না। কেন বন্ধুরা বাবাকে এত শ্রদ্ধা করত, শ্রদ্ধা করত ক্লেরিকুজিও পরিবারকে। ক্রসের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল, কেন তার বাবার সার্বক্ষণিক অস্ত্র এবং দেহরক্ষীর প্রয়োজন হয়।
ক্রস স্পষ্ট মনে করতে পারছে তার বাবার হত্যা মামলার রায়ের ঘটনা। এটি প্রায় ভুলেই যেতে বসেছিল ক্রস। বিশেষ করে সেদিন রাতে বাবা যখন তার হাতটি নিজের হাতে তুলে নিয়েছিল গভীর স্নেহে, ক্রস ভুলে গিয়েছিল সব। তবে এসব ভেবেও বীতশ্রদ্ধ হলো না সে তার বাবার প্রতি। বরং উষ্ণ এক আবেগ যেন আরো ঘনীভূত হলো। উপলব্ধি করতে পারল, এখন যতই নগ্ন হোক না কেন, বাবার সুরক্ষায় তাকেই এগিয়ে যেতে হবে।
ডেন্টির ওপর ভয়ানক ক্ষুব্ধ হলো ক্রস। বাবার এই গোপনীয় সত্যতা সে তাকে না বললেও পারত।
ডেন্টির উদ্দেশে বলল, না, আমি সে সব জানি না এবং তুমিও কিছুই জানো না। কেউই জানে না কিছু।
ভয়ানক ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল ক্রস। সংযত করার চেষ্টা করল নিজেকে। কিছুটা সময় থামল মাত্র কয়েক পলক। তারপর রসিকতা করে বলল, তোমার ওই ফাঁক-ইন হ্যাটটি কোত্থেকে পেলে?
.
ইস্টার সানডের ইস্টার এগ হান্টিং ইভেন্টে বাচ্চাদের সাথে তুমুল হৈচৈয়ের মধ্যে মেতে ছিল ভার্জিনো ব্যালাজো। শিশুদের সাথে এ খেলায় এমনভাবে মগ্ন হয়ে গিয়েছিল, যেন সে জন্মসূত্রেই একজন ভাড়। আর শিশুরাও মজে গিয়েছিল তার ভাঁড়ামিতে। তাকে ঘিরে ধরেছিল সবাই। ছোট্ট শিশুগুলোকে ফুলের মতো দেখাচ্ছিল– ছোট ছোট মুখ, ডিমের খোলসের মতো সাদা ত্বক, মাথায় গোলাপি সুদৃশ্য টুপি আর বাহারি পোশাক– চমৎকার এক দৃশ্যের অবতারণা। ব্যালাজো শিশুদের হাতে ধরিয়ে দিচ্ছিল খর ভর্তি একটি করে ছোট বাক্স, বিনিময়ে শিশুরা ব্যালাজোর গালে এঁকে দিচ্ছিল একটি করে চুমু। বাক্স নিয়েই শিশুরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছিল ব্যালাজোর সামনে থেকে।
বেশ পরিপাটি হয়ে ইস্টার সানডের এ উৎসবে এসেছে ভার্জিনো ব্যালাজো। তার পরনের সুটটি লন্ডনের তৈরি, জুতো জোড়া ইতালির, শার্ট ফ্রান্সের। চুলগুলো কাটিয়েছে ম্যানহাটানের মাইকেল এঞ্জেলোতে। তাকে দেখে যে কেউ মনে করবে অত্যন্ত আশীর্বাদপুষ্ট সুখী জীবন তার। সুখী তার মেয়েও। সার্বক্ষণিক বাবার পাশে রয়েছে। শিশুদের সাথে আনন্দে মেতে রয়েছে সে-ও।
ত্বরিত-চঞ্চলা ব্যালাজো কন্যা লুজিলি। সবাই তাকে সেইল করে ডাকে। আঠার বছরের কুমারী সেইল এ অনুষ্ঠানে তার বাবার সহযোগী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে খোশ মেজাজে। পরনে তার রয়েছে সাদা রঙের ব্লাউস আর শর্টস। ঘোলাটে ফিকে ত্বক। মাথার চুলগুলো প্যাচিয়ে প্যাচিয়ে এমনভাবে গোলাকার করেছে, দূর থেকে দেখেই মনে হবে যেন মাথায় পরেছে কোনো মুকুট।
সুন্দরী সেইল, তার ওপর অর্ধবক্ষা। সামান্য দূরের কিছু যুবক হা করে তাকিয়ে রয়েছে তার দিকে। কেউ কেউ যৌবনের উন্মাদনায় সাড়া পেতে সিটি বাজিয়ে আহ্বানও জানাচ্ছে। সেদিকে খেয়াল নেই তার। হয়তো খেয়াল করেছে কিন্তু পাত্তা দেয়নি। প্রয়োজন মনে করেনি।
হঠাৎ করে সেইলর চোখ গেল বাগানের এক কোণায়। সেখানে ঝগড়া বাধিয়ে বসেছে ক্রস এবং ডেন্টি। দীর্ঘ সময় ধরেই চলছে তাদের চুড়ান্ত পর্যায়ের বাদানুবাদ, বিতর্ক হয়তো হাতাহাতিও। সেইলর মনে হলো ক্রস যেন আঘাত পেয়েছে; কুঞ্চিত হয়ে গেছে তার মুখমণ্ডল।
খরভর্তি একটি বাস্কেট ছিল সেইলর হাতে। সেটি নিয়েই তুরিত ছুটে গেল ক্রস ও ডেন্টির দিকে। তাদের অপ্রীতিকর অবস্থার মাঝখানে গিয়ে উপহাস করে বলল, তোমাদের মধ্যে কে ডিম শিকারে আগ্রহী? চমৎকার মোহিত হাসি সেইলর। হাসি মুখে তার হাতের বাস্কেটটি তুলে ধরল তাদের দিকে। অপ্রত্যাশিত এই সুন্দরীর আগমন দুজনকেই হতভম্ব করে ফেলল। দুজনেই তার দিকে তাকিয়ে রইল বিস্ময়ের দৃষ্টিতে।
সকালের সোনালি আলো সেইলর ত্বকেও যেন ছড়াচ্ছিল স্বর্ণ আভা। দুষ্টুমিতে ভরা চোখ দুটো নাচছিল। ব্লাউসের উপরাংশের দুধরঙা স্তনের আবৃত্ত যুগল তাদের ছন্দপতন ঘটাল। আমন্ত্রণ জানাল সেইলের কুমারিত্ব।
ঠিক এমনই এক মুহূর্তে একটি ছোট্ট শিশুর তীক্ষ্ণ চিৎকার ভেসে এলো। মোহভঙ্গ হলো সবার। তাকাল শিশুটির দিকে। লাল ও নীল রঙের ছোপ দেয়া বিশাল আকৃতির একটি ডিম পেয়েই শিশুটির এই চিৎকার। সেই বিশাল আকৃতির ডিমটি সে তার খরপূর্ণ বাস্কেটে পুরে রাখার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠল। এই চেষ্টা করতে গিয়ে তার মাথার সুন্দর গোলাপি টুপিটি বারবার চোখ মুখ ঢেকে দিচ্ছিল। বিরক্ত হয়ে পড়েছিল সে। এই গলঘর্ম প্রচেষ্টার এক পর্যায়ে ডিমটি গেল ভেঙে। আর তা থেকে ফুড়ুৎ করে উড়ে গেল একটি ছোট পাখি। আর সাথে সাথেই শিশুটির চিৎকারও যেন ধাওয়া করল পাখিটির পিছু পিছু।
কৌতুককর এ পরিস্থিতি অনেক সময় ধরেই লক্ষ্য করছিল পেটি। লন পেরিয়ে ছুটে এলো সে। কোলে তুলে নিয়ে তাকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করল।
আসলে এই পাখি উড়ে যাওয়ার এমন পরিকল্পনা তারই। আর এ মুহূর্তে শিশুটিকে সান্ত্বনা দেয়ার হাস্যকর ধরন দেখে উপস্থিত সবাই হেসে উঠল।
সবাইকে হাসতে দেখে শিশুটি তার মাথা থেকে খসে যাওয়া হ্যাটটি এক হাতে চেপে ধরে চেঁচিয়ে উঠল। কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে পেটির উদ্দেশ্যে বলতে লাগল, তুমিই আমার সাথে দুষ্টুমি করেছ। পেটি অসহায়ের মতো তাকাল শিশুটির দিকে। আরেক দফা হেসে উঠল সবাই। শিশুটি তার কোল থেকে নেমে দৌড়ে যাচ্ছিল। পেটিও পিছু নিল তার। অসম্ভব মন খারাপ হয়েছিল তার। কাছ থেকে ক্ষমা পাওয়ার জন্য পিছু পিছু ছুটতে লাগল পেটি। অবশেষে তাকে ধরে কোলে তুলে নিল। তাকে শান্ত করতে দিল একটি রত্ন খচিত ইস্টার এগ। শিশুটি তা পেয়ে খুব খুশি হলো, পেটির গালে দিল সস্নেহে একটি চুমু।
সবার দৃষ্টি যখন পেটি এবং ছোট শিশুটির দিকে নিবদ্ধ তখন সেইল শক্ত করে ধরল ক্রসের হাত। ম্যানশন থেকে শখানেক দূরের এক আড়ালে টেনিস কোর্টের দিকে নিয়ে গেল তাকে। তিন দিকে দেয়াল ওঠানো খেলোয়াড়দের বিশ্রামের জন্য তৈরি টেনিস কুটিরে গিয়ে বসল দুজন। ম্যানশনের হৈ হট্টগোল থেকে বেশ খানিকটা নির্জন। এখানে তাদের দুজনের একান্ত সান্নিধ্যে কেউ ব্যাঘাত ঘটাতে আসবে না।
কারো নজরে তেমন একটা না পড়লেও ডেন্টির শ্যেনদৃষ্টিকে এড়াতে পারল না তারা। ডেন্টির চেয়ে ক্রস অনেক বেশি আকর্ষণীয়। এ বিষয়ে ডেন্টির একটা হিংসাবোধও আছে ভেতরে ভেতরে। তবে এ মুহূর্তে সে তার। এই হ্যান্ডসাম কাজিনকে নিয়ে গর্বিত। তবে সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার, এতক্ষণে সে বুঝতে পারল তার হাতে রয়েছে সেইলের সেই বাস্কেটটি। মনে মনে হেসে উঠল ডেন্টি– সেইল কৌশলে তার বাস্কেটটি বসিয়ে দিয়েছে ডেন্টির হাতে, আর ক্রসের হাতে তুলে দিয়েছে তার নিজ হাত।
ম্যানশনের আড়ালে টেনিস কুটিরে দুজন খুব কাছাকাছি হলো। সেইল ক্রসের মুখে ছোঁয়াল সেইলের নরম দুটি হাত। ক্রসের ঠোঁট স্পর্শ করল সেইলের ঠোঁট। উত্তেজনা বৃদ্ধি পেতে লাগল ক্রমেই। ধীরে ধীরে সরে গেল। পার্থিব যত বিষয়। সম্পূর্ণ মনোসংযোগ ঘটল চুম্বনরত ঠোঁটের মাধ্যমে শিহরিত শিরায় শিরায়, উপশিরায়। চঞ্চল হয়ে উঠল ক্রসের হাত। নিখুঁতভাবে সেইলের সমস্ত শরীরের আস্বাদের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠল। শেষ অবধি সংযত করতে না পেরে সেইলের কুমারী স্তনে উঠে এলো ক্রসের একটি হাত। তৎক্ষণাৎ ঝটকা মেরে সরিয়ে দিল সেইল। দুষ্টু হাসিতে ক্রসের দুষ্টুমিকে পরাস্ত করল যেন।
বলল, আজকের এই চুম্বনের জন্য আমি প্রতীক্ষায় ছিলাম দীর্ঘ দিন, আমার দশ বছর বয়স থেকে। এত দিন পর পেলাম এই শুভ দিন।
সেইলের চুম্বনের রেশ ক্রসের মন থেকে সরেনি তখনো। তারপরও সেইলের আকস্মিক এই উক্তিতে সে প্রশ্ন করল, কেন?
কারণ তুমি দারুণ সুন্দর এবং পার্ফেক্ট। সেইলের সহজ উত্তর। ক্রসের মুখ থেকে তার হাত দুটো সরিয়ে নিল। তারপর চোখের দিকে টানা দৃষ্টি হেনেই ক্রসের হাতে রাখল তার হাত।
বলল, আজকের মতো এমন ভুল একটি দিনের জন্যও আমার হয়নি।
একটু থেমে আবার সে বলল, আমাদেরও কি একটি সুন্দর পরিবার হতে পারে না?
ক্রস নিরুত্তর। তবে স্বাভাবিক। সেইলের কপালে কুঞ্চিত রেখা দেখা গেল মাত্র কয়েক পলকের জন্য। আকস্মিক বলল, আচ্ছা, তুমি তোমার বাবার সাথে কেন থাকছ?
ঠিক এমন একটি বিষয়ের জন্যই তুমি হয়তো আমাকে এখানে আনতে পেরেছ? সপ্রতিভ উত্তর ক্রসের।
বিষয়টি এতক্ষণে পরিষ্কার হলো সেইলের। পাল্টা প্রশ্ন করল ক্রসের উদ্দেশ্যে, তাই বুঝি ডেন্টির সাথে ঝগড়া বাধিয়ে বসেছিলে? সেইল বলল, সে কি তোমাকে খুব আঘাত দিয়ে কিছু বলেছে?
না, ডেন্টি সঠিক ছিল, ক্রস বলল প্রতিউত্তরে। শিশুদের মতো তর্ক করছিলাম আমরা। ডেন্টি একজন সাক্ষাৎ জোকার, ঠিক আমার পেটির মতো।
জোকার না কচু! খুব উগ্র সে, সেইলের প্রতিবাদী উত্তর। তারপর আবার আকস্মিক ক্রসের ঠোঁটে চুমু দিল সেইল। বলল, প্রচুর অর্থ করেছে আমার বাবা। কেন্টাকিতে একটি বাড়ি কিনেছে। ১৯২০ রোলস রয়েস গাড়িও কিনেছে। এমনিতেই তার রয়েছে তিনটি অ্যান্টিক গাড়ি, আবার কেন্টাকিতে ঘোড়াও কেনার পরিকল্পনা করছে। তুমি বরং কালই আমাদের ওখানে বেড়াতে চলো– আমাদের গাড়িগুলোও দেখতে পাবে। আর তাছাড়া তুমি ছোটবেলা থেকে আমার মায়ের রান্না পছন্দ করতে।
সম্ভব নয়। আগামীকালই আমাকে ভেগাসে ফিরে যেতে হবে। বলল ক্রস। আমি সেখানে জানাদু হোটলে কাজ করি।
ক্রসের হাত ধরে একটা হ্যাঁচকা টান দিল সেইল, অ ভেগাস। আমার মতে একটি বিরক্তিকর শহর ভেগাস।
কিন্তু আমার কাছে সেরা, পাল্টা জবাব ক্রসের। তুমি যদি সেখানে না-ই গিয়ে থাকো, তবে এত ঘৃণা কেন?
কারণ সেখানকার মানুষ তাদের কষ্টের উপার্জন নিমেষেই শেষ করে আসে, ঘৃণামিশ্রিত শিশুসুলভ অভিব্যক্তি প্রকাশ করে বলল সেইল। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে আমার বাবা গ্যাম্বলের আগে-পাছে নেই। এমনকি সেই শো গার্লদের প্রতিও আগ্রহী নয়।
হেসে ফেলল ক্রস। বলল, আমি এত কিছু জানি না। আমি কেবল গলফ কোর্টে ছুটাছুটি করি। ক্যাসিনোর অভ্যন্তরে কি ঘটে না ঘটে সে সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই।
সেইল জানে ক্রস তার সাথে মজা করছে। তারপরও সে বলল, আচ্ছা আমি যেদিন কলেজের পাট চুকিয়ে বের হবে, সে দিন যদি তোমাকে ইনভাইট করি, তুমি আসবে?
অবশ্যই, ক্রস আশ্বাস দিল। এমন বিষয়ে ক্রস সেইলের চেয়ে অনেক বেশি অভিজ্ঞ। মেয়েটির এই সরলতায় মুগ্ধ হলো ক্রস। মুগ্ধ হলো এখনো তার হাত দুটি যেভাবে সেইল ধরে রেখেছে, তা ভেবে। তবে ক্রস বুঝতে পেরেছে সেইলের এই আমন্ত্রণ তাদের অর্থ, গাড়ি-বাড়ি, প্রতিপত্তি প্রদর্শনেরই দাবি। ক্রস এ-ও বুঝতে পারল, সেইলের এই মিষ্টি স্পর্শ, প্রাণহীন মেকি চুম্বন ও তার নারীত্ব দিয়ে ক্রসকে জয় করার প্রচেষ্টা।
ক্রস এবার বলল, আমাদের বোধ হয় এবার ম্যানশনের দিকে যাওয়া উচিত।
টেনিস কুটির থেকে বেরিয়ে এলো দুজন। দুজনে দুজনার হাত ধরে এগিয়ে চলল পিকনিক এরিয়ার দিকে। সেইলের বাবা তাদের দিকে তাকিয়ে প্রথমে মুখ বাঁকিয়ে ফেলল। তারপর এক আঙুল বাকিয়ে ছিঃ! ছিঃ! লজ্জা বলেই হো হো করে হেসে ফেলল। এগিয়ে গেল তাদের দিকে, জড়িয়ে ধরল দুজনকেই।
এই দিনটির কথা ক্রসের মনে গেঁথে থাকবে দীর্ঘদিন। শুধু এ জন্যই নয় যে সে সেইলের ঘনিষ্ঠতা পেয়েছে। ক্রসের মনে এই ইস্টার সানডের দিনটি আরেকটি কারণে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। কারণ এ দিনই ডেন্টির কাছে সে তার বাবার প্রকৃত স্বরূপ জানতে পেরেছে। সেই সাথে ছোট্ট শিশুটির সেই ডিম ভেঙে পাখি উড়ে যাওয়ার ঘটনাও দাগ কেটেছে ক্রসের মনে।
ক্রস এবং পিপি ইস্টার সানডের পর দিনই ফিরে গেল ভেগাসে। তবে তাদের মানসিক সম্পর্কে এবার দেখা দিল একটু ভিন্নতা। পিপি নিশ্চিতভাবেই বুঝতে পারল যে এত দিনের গোপন তথ্যের অনেক কিছুই ক্রসের কাছে ফাঁস হয়ে গেছে। আরো তাই নিজের দুর্বল মনকে শক্ত করতে ক্রসের প্রতি সে মনোযোগী হলো আর বেশি। তবে ক্রস বিস্মিত হলো, এত নেতিবাচক তথ্যের পরও বাবা সম্পর্কে মনোভাবের এতটুকু পরিবর্তন হয়নি। এখনও তাকে আগের মতোই ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে ক্রস। বাবা ছাড়া সে যেন তার পৃথিবী কল্পনাও করতে পারে না, যেমন কল্পনাতীত ক্লেরিকুজিও পরিবার ছাড়া গ্রোনিভেল্ট ছাড়া এবং জানাদু হোটেল ছাড়া। এ সবই ক্রসের জীবনে জড়িয়ে আছে ওতপ্রোতভাবে এবং সত্যিকার অর্থেই সে সুখী এই জীবনধারায়।
তবে কেমন যেন এক অসহিষ্ণুতা বাসা বেঁধেছে ক্রসের মনে-বুঝে উঠতে পারছে না সে কিছুতেই। এটুকু তার মনে এসেছে যে, হয়তো নতুন কোনো পদক্ষেপ নিতে হবে তাকে। কি সেই পদক্ষেপ, জানে না সে।