০৩. রাত বাজে দুটার মতো

রাত বাজে দুটার মতো।

কথা ছিল সারা রাত সবাই জেগে থাকবে। হৈচৈ করতে করতে যাবে। মনে হচ্ছে সবার উৎসাহে ভাটা পড়েছে। বল্টু গোড়া থেকেই মনমরা ছিল। তার মনমরা ভাব রাত একটার দিকে কাটল। সে মোতালেবের কাছ থেকে ক্যাসেট প্লেয়ার নিয়ে ফুল ভলু্যমে ক্যাসেট চালু করল। বন্যার রবীন্দ্রসঙ্গীত। তবে ক্যাসেটে দোষ আছে। মনে হচ্ছে বন্যার গলায় ল্যারিনজাইটিস। ভাঙা গলায় গান—

সখী বয়ে গেল বেলা
শুধু হাসি খেলা আর কি ভাল লাগে?

চশমাপরা দাড়িওয়ালা এক ভদ্রলোক হঠাৎ পেছন থেকে উঠে এসে কঠিন গলায় বললেন, আপনি কি গান বন্ধ করবেন?

বল্টু বলল, কেন বন্ধ করব?

বন্ধ করবেন, কারণ, রাত দুটা বাজে। এখন গানের সময় না। এখন ঘুমুবার সময়।

আপনার জন্যে ঘুমুবার সময়। আপনি কোলবালিশ নিয়ে শুয়ে পড়ুন। আমাদের এখন জেগে থাকার সময়।

চশমাওয়ালা লোক সমর্থনের আশায় চারদিকে তাকাচ্ছে। কাজেই সমর্থন পাবার আগেই বল্টুকে সাপোর্ট দেবার জন্যে মোতাবেল বলল, গালের পরপরেই আছে নৃত্যানুষ্ঠান। আপনাদের সবাইকে আমন্ত্রণ। আমাদের দলে কয়েকজন নৃত্যশিল্পী আছেন। নইমা, নাচের জন্যে তৈরি হও।

নইমার জন্যে অত্যন্ত অপমানসূচক কথা। তার বিশাল শরীরের দিকে লক্ষ করেই তাকে নৃত্যশিল্পী বলা হচ্ছে। অতিবড় বোকাও এটা বুঝবে। নইমার পাশে নীরা বসেছিল। সে খিলখিল করে হাসতে শুরু করেছে, যেন এই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ রসিকতা সে এইমাত্র শুনল।

চশমাপরা ভদ্রলোক বললেন, আপনারা আমাদের সারারাত বিরক্ত করবেন, তা তো হয় না।

বল্টু বলল, প্রতিরাতেই যে ঘুমতে হবে তার কি কোনো মানে আছে? একটা রাত না ঘুমিয়ে দেখুন কেমন লাগে। খারাপ লাগবে না।

কথাবার্তার এই পর্যায়ে রানা উঠে বলল, নো মিউজিক। গান বন্ধ। অন্য যাত্রীদের সুবিধা-অসুবিধাও আমাদের দেখতে হবে।

সে চশমাপরা লোকের কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল, ওল্ড ব্রাদার, নো অফেন্স। যান, শুয়ে পড়ুন।

মোতালেবের গা জ্বলে গেল। ট্রেন ছাড়ার পর থেকেই রানা এই আলগা মাতব্বরিটা করছে। সহ্যের সীমা অতিক্রম করে যাচ্ছে। কষে এর পাছায় একটা লাথি বসিয়ে দেয়া দরকার। লোকজনের সামনেই দেয়া দরকার, যাতে গাধাটার একটা শিক্ষা হয়। মাতব্বর!

মুনা জানালা দিয়ে বাইরের অন্ধকার দেখছিল। অন্ধকারে দেখার কিছু নেই, তবু ভালো লাগছিল। ভালো বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টিও দেখা যাচ্ছে না। তবে বৃষ্টির শব্দ শুনতে খুব সুন্দর লাগছে। চলন্ত ট্রেন থেকে বৃষ্টির শব্দ যে এত সুন্দর লাগে কে জানত?

রানা এসে খট করে মুনার জানালা বন্ধ করে বলল, নো বৃষ্টিতে ভিজাভিজি। ঘুমা। ঘুমিয়ে পড়া।

রানা এসে বসল। সঞ্জুর পাশে। সঞ্জুকে খুব মনমরা লাগছে। দলের কেউ কোনো কারণে বিষণ্ণ হলে সেটা দেখার দায়িত্বও তার।

কী হয়েছে রে সঞ্জ?

কই, কিছু হয়নি তো।

মন-খারাপ করে বসে আছিস কেন? কী হয়েছে বল।

কিছু হয় নি।

মুনা লাফ দিয়ে ট্রেনে উঠে পড়েছে এইজন্যে মন খারাপ? বাদ দে, বাচ্চা মেয়ে, মিসটেক করে ফেলেছে। হেভি বকা দিয়ে দিয়েছি। তুই যদি মুখ ভোঁতা করে রাখিস—তাহলে মুনা ভাববে তার জন্যে তোর মন খারাপ। এই কাজটা সে করল কী করে তাই আমি এখনো বুঝতে পারছি না। এমন তো না যে বেকুব মেয়ে… নে সঞ্জু, সিগারেট নে।

সঞ্জু সিগারেট নিল। মুনা কী জন্যে লাফ দিয়ে ট্রেনে উঠেছে তা সে না জানলেও অনুমান করতে পারছে। জন্যে তার খুব মায়া লাগছে।

বি হ্যাপি সঞ্জু, বি হ্যাপি। মন খারাপ করে থাকবি না। আমি যাই, টিটির সঙ্গে ম্যানেজ করে আসি। টাকা খাইয়ে আসি।

টাকা খাওয়াবি কেন?

আমাদের মধ্যে দুজন আছে না টিকেট ছাড়া? টাকা না খাওয়ালে হবে কীভাবে? আমি অবশ্যি প্ৰিলিমিনারি আলাপ করে রেখেছি। চোখ-টিপি দিয়ে দিয়েছি। এইসব লক্ষ রাখতে হবে না? নয়তো চিটাগাং নামতেই ঝামেলায় পড়ে যেতাম। আমি ম্যানেজ না করলে এতসব ঝামেলা তোরা মেটাবি কী করে? তোরা তো আবার সব ভদ্রলোক। এই দেখ না, বৃষ্টি হচ্ছে অথচ সবার জানালা খোলা। ঠাণ্ডা লেগে বুকে কফ বসে গেলে অবস্থাটা কী হবে? কোথায় পাব ডাক্তার? কোথায় পাব অষুধ?

রানা ব্যস্ত পায়ে উঠে চলে গেল। রানা চলে যেতেই মুনা আবার তার জানালা খুলে দিল। জানালা খোলার সময় ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে লাজুক ভঙ্গিতে হাসল। সঞ্জও হাসল।

ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে।

জরীর পাশের জানালা খোলা। বৃষ্টির ছাট আসছে। আনুশকা বলল, জরী, তুই ভিজে যাচ্ছিস। জানালা বন্ধ করে দে।

জরী বলল, আমার ভিজতে ভালো লাগছে।

অসুখ বাধাবি; নিউমোনিয়া হবে। আমাদের সব প্রোগ্রাম বানচাল হবে।

সেটাও মন্দ না। মানুষের জীবনে প্রোগ্রাম ছাড়া কিছু কিছু অংশ থাকা দরকার। যে অংশে আগেভাগে কিছু ভাবা হবে না। যা হবার হবে।

আনুশকা হাসিমুখে বলল, এটা কি কোনো দার্শনিক তত্ত্ব?

খুবই সাধারণ তত্ত্ব। দার্শনিক-ফার্শনিক না।

জরী, তুই কিন্তু ভিজে ন্যান্তা-ন্যাত হয়ে গেছিস। জরী হালকা গলায় বলল, তুই একটা প্রসঙ্গ নিয়ে এত কথা বলিস যে রাগ লাগে। কথা বলার তো আরো বিষয় আছে।

আচ্ছা যা, এই প্রসঙ্গে আর কথা বলব না; শুভ্ৰকে দেখছি না কেন রে জরী? শুভ্ৰ কোথায় গেল?

যাবে আবার কোথায়? ট্রেনেই আছে। মনে হয় এক কামরা থেকে আরেক কামরায় সিগারেট হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

ওর এমন একা ঘুরে বেড়ানো ঠিক না। চোখে কম দেখে।

জরী হেসে ফেলল। আনুশকা বলল, হাসছিস কেন?

তোর মাতৃভাব দেখে হাসছি। তোর মধ্যে একটা দলপতি-দলপতি ব্যাপার আছে। সব সময় লক্ষ করেছি, আমরা কোথাও গেলেই তুই দলপতি সেজে ফেলিস; সব চিন্তা-ভাবনা নিজের মাথায়; আমাকে নিয়ে ভাবছিস, আবার শুভ্রকে নিয়ে ভাবছিস; এত কিসের ভাবাভাবি? আমরা সবাই রাজা।

আচ্ছা যা, আর ভাবব না।

না ভেবে তুই পারবি না। ব্যাপারটা রক্তের মধ্যে ঢুকে আছে।

আনুশকা বলল, জানালা পুরোটা খোলা না রেখে হাফ খুলে রাখ। তুই একেবারে গোসল করে ফেলেছিস।

জরী জানালা বন্ধ করে উঠে দাঁড়াল। আনুশকা বলল, যাচ্ছিস কোথায়?

অন্য কোথাও গিয়ে বসব। যেখানে আমার মাতৃসম কেউ থাকবে না। কেউ আমাকে ক্ৰমাগত উপদেশ দেবে না।

স্যরি। এখানেই বোস। জানালা পুরোপুরি খুলে দে। আমি আর কিছু বলব না। ওয়ার্ড অব অনার।

না, তোর পাশে বসব না।

জরী হাঁটতে শুরু করল। দলের পুরুষদের মধ্যে শুধু মোতালেবকে দেখা যাচ্ছে। সে ইতোমধ্যে শোবার ব্যবস্থা করে ফেলেছে। তার পাশের সিটের ভদ্রলোককে অন্য জায়গায় পাঠিয়ে দুটা সিটি দখল করে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়েছে। দূর থেকে দেখলেই বোঝা যায় সে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। অথচ কথা ছিল সারারাত কেউ ঘুমুবে না। জরীর মনে হলো—শেষটায় দেখা যাবে শুধু সে-ই জেগে আছে, আর সবাই ঘুমে। কামরায় গাড়িভরা ঘুম, রজনী নিঝুম।

রাত কত হয়েছে? জরীর হাতে ঘড়ি ছিল। এখন ঘড়ি নেই। কোথাও খুলেটুলে পড়ে গেছে। ভালোই হয়েছে। ঘড়িটা ঐ মানুষের দেয়া। দামি ঘড়ি। লোকটা কৃপণ না। সে তার স্ত্রীকে দামি-দামি জিনিসপত্র দিয়েই সাজিয়েছে। পরনের শাড়িটাও দামি। কত দাম জরী জানে না। লোকটার বোন এই শাড়ি তাকে পরাতে পরাতে বলেছিল, বেস্ট কোয়ালিটি, বালুচরি কাতান।

সেই বেষ্ট কোয়ালিটি বালুচরি। কাতান ভিজে এখন গায়ের সঙ্গে লেপ্টে আছে। জরীর এখন নিজেকে অশুচি লাগছে। মনে হচ্ছে ঐ লোকটা যেন তাকে জড়িয়ে ধরে আছে।

একজন সাধারণ মেয়ের জীবনেও কত অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। জরী কি নিজেই সে এমন একটা কাণ্ড করতে পারবে? বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে আসবে?

যদি পালাতে না পারত তাহলে কী হতো? তাহলে এই রাতটা হতো তাদের বাসররাত। লোকটা তার শরীর নিয়ে কিছুক্ষণ ছানাছানি করে সিগারেট খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ত। আর সে সারারাত জেগে বৃষ্টি দেখত। আচ্ছা, ঢাকায় কি এখন বৃষ্টি হচ্ছে?

ঐ লোকটা কী করছে? ঘুমুতে নিশ্চয়ই পারছে না। কিংবা কে জানে মদ-ফদ খেয়ে হয়তো নাক ডাকিয়ে ঘুমুচ্ছে। তবে সেই ঘুম নিশ্চয়ই সুখের ঘুম না। নিশ্চয়ই ঘুমের মধ্যে তার শরীর জ্বলে যাচ্ছে।

শুভ্ৰ লক্ষ করল, ভেজা শাড়ির এক অংশ চাদরের মতো গায়ে জড়িয়ে জরী হন-হন করে যাচ্ছে। তার একবার ইচ্ছা হলো জরীকে ডাকে। কিন্তু জরীর হাঁটার মধ্যে এমন এক আত্মমগ্ন ভঙ্গি যে, মনে হয় ডাকলেও সে থামবে না। একটা সুটকেসের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে জরীর পড়ে যাবার মতো হলো। সে নিজেকে সামলে নিয়ে হাসল। কার দিকে তাকিয়ে হাসল?

শুভ্রর হাতে একটা জুলন্ত সিগারেট। আজ এক রাতের মধ্যে অনেকগুলি সিগারেট খাওয়া হয়েছে। বমি-বমি লাগছে, বুক জ্বালা করছে এবং মাথা কেমন হালকা লাগছে। এই হালকা বোধ হওয়াটাই কি সিগারেটের নেশা? গাঁজা খেলে লজ্জা বাড়ে, ভাং-এর সরবত খেলে কী হয় এখনো জানা হয় নি।

স্যায়, একটু শুনবেন?

শুভ্র চমকে উঠে বলল, আমাকে বলছেন?

জি, আপনাকেই বলছি।

অপরিচিত একজন মানুষ। লম্বা, রোগী! মাথায় চুলের বংশও নেই। পরনে সাফারি। মেয়েলি গলার স্বয়। চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা! এই লোককে আগে কখনো দেখেছে বলে শুভ্ৰ মনে করতে পারল মন।

আমি কি আপনাকে চিনি?

জি না স্যার।

আপনি আমাকে চেনেন?

ঞ্জি স্যার, চিনি। আপনার বাবা ইয়াজউদ্দিন সাহেব আমাকে পাঠিয়েছেন।

বুঝতে পারছি না। তিনি আপনাকে হঠাৎ করে কীভাবে পাঠাবেন?

আপনার দেখাশোনা করার জন্যে আমি ঢাকা থেকেই গাড়িতে উঠেছি।

শুভ্ৰ শুকনো গলায় বলল, ও আচ্ছা। তাহলে আপনি ঠিকমতই দেখাশোনা করে যাচ্ছেন? বাবাকে খবর পাঠাচ্ছেন কীভাবে, ওয়্যারলেসে?

স্যার, আপনি শুধু শুধু আমার ওপর রাগ করছেন?

আমি আপনার ওপর রাগ করছি না, রাগ করছি বাবার ওপর। আমি কল্পনাও করি নি বাবা একজন স্পাই পাঠাবেন।

স্যার, আপনি ভুল করছেন। আমি স্পাই না, আপনার যাতে কোনো অসুবিধা না হয়। সেজন্যই আমি যাচ্ছি। আমাকে বলা হয়েছে, বড় রকমের কোনো সমস্যায় পড়লেই শুধু আপনাকে আমার পরিচয় দিতে।

শুভ্ৰ মন-খারাপ করা গলায় বলল, আমি কি বড় রকমের কোনো সমস্যায় পড়েছি?

জি স্যার, পড়েছেন।

আমি তা কোনো সমস্যা দেখছি না।

আপনার ঘুমের অসুবিধা হচ্ছে।

আমার ঘুমের অসুবিধা একটা বড় ধরনের সমস্যা। আপনি আমার ঘুমের ব্যবস্থা করেছেন?

জি। তিনটা এয়ার কন্ডিশান্ড কোচ আপনার নামে রিজার্ভ করা আছে। খালি যাচ্ছে। আপনারা ঘুমাতে পারেন।

আমি তার কোনো প্রয়োজন দেখছি না।

সারারাত জেগে থেকে পরদিন জার্নি করলে অসুস্থ হয়ে পড়বেন স্যার। আপনার শরীর তো ভালো না।

যদি অসুস্থ হয়ে পড়ি আপনি নিশ্চয়ই ডাক্তারের ব্যবস্থাও করে ফেলবেন। কাজেই আমি কোনো সমস্যা দেখছি না।

আপনি স্যার শুধু শুধু আমার ওপর রাগ করছেন। আমি হুকুমের চাকর।

আমি আপনার ওপর রাগ করছি না। তবে আবার যদি কখনো আপনাকে আমার পেছনে ঘুরঘুর করতে দেখি তাহলে রাগ করব। খুব রাগ করব। আপনার নাম কী?

স্যার, আমার নাম সুলেমান।

সুলেমান সাহেব, আপনি দয়া করে বিদায় হোন। আমাকে আমার মতো থাকতে দিন।

জি আচ্ছা, লাইটারটা রাখুন। স্যায়।

লাইটায় দিয়ে কী করব?

আপনার সিগারেট নিভে গেছে।

শুভ্র লাইটার হাতে নিজের জায়গায় ফিরে এলো। আনুশকা বলল, শুভ্ৰ, তুমি কি জরীকে দেখেছ? সে কোথায় জানো?

এখন কোথায় জানি না। তবে তাকে যেতে দেখেছি। হনহন করে যাচ্ছিল। একটা সুটকেসের সঙ্গে ধাক্কা খেয়েছে।

ও আমার ওপর রাগ করে। চলে গেছে।

কী নিয়ে রাগ করল?

কোনোকিছু নিয়ে না। রাগটা ওর মনে ছিল। বের হয়ে এসেছে। তুমি কি রাগ ভাঙিয়ে ওকে নিয়ে আসবে?

আমি গেলে ওর রাগ ভাঙবে?

হ্যাঁ, ভাঙবে।

শুভ্র জরীকে খুঁজতে বের হলো। আশ্চর্য কাণ্ড! জরী কোথাও নেই। একজন মানুষ তো হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে পারে না। কোথায় গেল সে? আখাউড়ায় ট্রেন কিছুক্ষণের জন্যে থেমেছিল। জরী কি তখন নেমে গেছে? শুভ্রর বুক কাঁপছে। সে আবার খুঁজতে শুরু করল।

স্যার, আপনি কি কাউকে খুঁজছেন?

না, কাউকে খুঁজছি না। আপনাকে না বলেছি আমার পেছনে ঘুরঘুর করবেন না?

সুলেমান এসে সামনে দাঁড়িয়েছে। সে কি ছায়ার মতো শুভ্ৰকে অনুসরণ করছে?

সুলেমান ইতস্তত করে বলল, ভেজা শাড়িপরা মেয়েটি স্যার বুফেকারে আছে।

ও আচ্ছা, থ্যাংক য়্যু। আপনি কি সারাক্ষণই আমার পেছনে পেছনে আছেন?

আমি স্যার দূর থেকে লক্ষ রাখছি।

আমি কী করছি না করছি সব দেখছেন?

জি স্যার।

আমি যে বুফো কারের ম্যানেজারের গায়ে থুথু দিয়েছি, তাও দেখেছেন?

সুলেমান কিছু বলল না। সে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

শুভ্র একবার ভাবল বলে, এই ব্যাপারটা আপনি দয়া করে বাবাকে বলবেন না। তারপর মনে হলো, এটা বলা ঠিক হবে না। অন্যায় অনুরোধ। অন্যায় অনুরোধ আর যে-ই করুক, সে করতে পারে না।

বুফেকার অন্ধকার। টেবিলগুলির উপর বালিশ এবং চাদর বিছিয়ে বুফেকারের লোকজন শুয়ে আছে। একটি টেবিলই শুধু ছিল। তারই এক কোণায় জড়সড় হয়ে জরী বসে আছে। খোলা জানালায় বুষ্টির ছাট আসছে।

শুভ্র ডাকল, জরী।

জরী খুব স্বাভাবিক গলায় বলল, এসো। বসো আমার সামনে।

একা একা কী করছ?

ভাবছি।

কী ভাবছ?

শৈশব থেকে ভাবা শুরু করেছি। চার বছর বয়স থেকে আরম্ভ করেছি, যেসব স্মৃতি মাথায় জমা আছে সেগুলি দেখার চেষ্টা করছি।

কোন পর্যন্ত এসেছ?

ক্লাস টেন। ক্লাস টেনে এসেই বাধা পড়ল। তুমি উদয় হলে।

শীত লাগছে না?

লাগছে। শীতে মরে যাচ্ছি। মনে হয়। জ্বরও এসেছে। দেখো তো গায়ে জ্বর আছে কি-না।

জরী হাত বাড়িয়ে দিল। কত সহজেই না সে তার হাত বাড়িয়েছে। দ্বিধা নেই, সংকোচ নেই। বরং একধরনের নির্ভরতা আছে।

শুভ্ৰ বলল, তোমার গায়ে জ্বর।

বেশি জ্বর?

হ্যাঁ, বেশি। অনেক জ্বর। তোমার বৃষ্টিতে ভেজা ঠিক হয় নি।

বৃষ্টিতে না ভিজলেও আমার জ্বর আসত। আমি যখন বড় ধরনের কোনো সমস্যা থেকে মুক্তি পাই, তখন আমার জ্বর এসে যায়।

সেই জ্বর কতদিন থাকে?

সে হিসাব করি নি।

ভেজা কাপড় বদলাবে না?

বদলাতে পারলে ভালো হতো। নিজেকে অশুচি লাগছে, তবে নোংর বাথরুমে ঢুকে কাপড় বদলাতে ইচ্ছে করছে না।

তাহলে কী করবে? ভেজা কাপড়ে বসে থাকবে?

হ্যাঁ।

আনুশকা মন খারাপ করে আছে। তুমি নাকি তার সঙ্গে ঝগড়া করেছ?

জরী কিছু বলল না। জানালার অন্ধকারের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বসল। বৃষ্টি থেমে গেছে। আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। জরী হাই তুলতে তুলতে বলল, প্রচণ্ড ঘুম পাচ্ছে। ইস, একটা পুরো কামরা যদি আমার একার থাকত, তাহলে দরজা বন্ধ করে হাত-পা ছড়িয়ে কী আরাম করে ঘুমুতাম!

শুভ্র ইতস্তত করে বলল, আমি একটা পুরো কামরার ব্যবস্থা করতে পারি। করব?

একটা পুরো কামরা শুধু আমার জন্যে?

হ্যাঁ।

কীভাবে করবে?

কীভাবে করব তা তোমার জানার দরকার নেই। করব কি-না সেটাই জানতে চাচ্ছি।

প্লিজ। শুভ্ৰ, করো। কীভাবে করবে?

ম্যাজিক। বড়লোকদের হাতে অনেক ধরনের ম্যাজিক থাকে।

শুভ্ৰ বুফেকারের বাইরে এসে দেখে, সুলেমান মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে। সুলেমান মনে হলো শুভ্ৰকে দেখে লজ্জা পাচ্ছে। সে চলে যেতে চেয়েছিল, শুভ্র বলল, একটা কামরার ব্যবস্থা করুন।

সুলেমান হতভম্ব গলায় বলল, আপনাদের দুজনের জন্যে?

না, একজন শুধু যাবে। তার শরীর খারাপ।

ও আচ্ছা। আমি স্যার ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।

ভয় পাবার কিছু নেই।

একজন ডাক্তারের ব্যবস্থা কি স্যার করব?

আপনি কি ডাক্তারও সঙ্গে নিয়ে এসেছেন?

জি না স্যার। খুঁজে বের করব। এত বড় ট্রেন, একজন-না-একজন ডাক্তার তো থাকবেনই। ডাক্তার কি লাগবে স্যার?

না।

আমার ব্যবহারে অসন্তুষ্ট হবেন না স্যার।

শুভ্ৰ বিস্মিত হয়ে তাকাল। লোকটাকে এখন আর তার এত খারাপ লাগছে। না। কী রকম বিনীত ভঙ্গিতে তাকাচ্ছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *