রাত তখন কটা হবে, বলতে পারব না। মনে হয় মাঝ রাত। আমি মাকে স্বপ্ন দেখছিলাম। বিশাল চওড়া, একেবারে ফাঁকা একটা রাস্তায়, আমি আর আমার মা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছি। ভীষণ হাওয়া দিচ্ছে। মায়ের বয়েস যেন অনেকটা কমে গেছে। যেমন ছিল মায়ের প্রথম বয়েসের ছবিতে। মাথায় অনেক চুল ছিল। হাওয়ায় চুল উড়ছে। নীল শাড়ির আঁচল উড়ছে। আমার হাতে একটা সুটকেস। সামনের আকাশে সারি-সারি পাহাড়। পাহাড়ের কোলে ঘন সবুজ বন। কী সুন্দর যে জায়গাটা। পাশে মা। মায়ের মুখে সেই হারিয়ে যাওয়া হাসি।
ঘুম ভেঙে গেল। স্বপ্ন হারিয়ে গেল। কে যেন ভারী গলায় ডাকছেন, বিরাজ, বিরাজ। বিরাজকাকুর একটাই ঘর। খাটে শুয়ে আছি আমি আর শিখা। সোফা কাম বেডে কাকু শুয়ে আছেন চিত হয়ে। ঘুমের ঘোরেই শুনছি, কাকু দরজা খুলছেন। ঘরের আলো জ্বেলেছেন। চোখে আলো লাগছে। দরজা খুলতেই, গলাটা খুব চেনা মনে হল। বিরাজ বিরাজ।
বাবা। বাবার গলা। এত রাতে বাবা এখানে? বাবার কি তাহলে কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই! সারারাত কলকাতার নির্জন পথে-পথে ঘুরতে-ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে, কুকুরের তাড়া খেয়ে, পুলিশের খোঁচা খেয়ে আশ্রয় খুঁজতে এখানে এসেছেন। নাকি সাজাহান এসেছেন ঔরংজীবকে মাঝরাতে খুন করতে। ভয়ে কাঠ হয়ে শুনছি, বিরাজকাকুর গলা,–আয়, আয় ভেতরে।
ভেতরে আসতে গিয়ে বাবার পা টলে গেল। দরজাটা ধরে সামলে নিলেন। ভীষণ একটা শব্দ হল। দরজার সঙ্গে দেওয়ালের ধাক্কা। শিখা ঘুমের ঘোরে চমকে উঠল। বাবা ঘরে ঢুকে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সাজাহান নাটকের পঞ্চম দৃশ্যের সেই সংলাপ বলে উঠলেন, পৃথিবীর কি অন্তিম সময় ঘনিয়ে এসেছে জাহানারা? জাহানারা তো এখন বাড়ি গিয়ে মেক-আপ তুলে ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়েছে। জাহানারার সংলাপ কে বলবে? ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে দুহাত দিয়ে মাথা চেপে ধরে বাবা সেই বিখ্যাত অভিনয়টা আর একবার দেখালেন, সত্যই তো, আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি নাকি? না-না-না। জানি পাগল হব না। ঈশ্বর! এই শীর্ণ দুর্বল, জরাজীর্ণ নেহাতই অসহায় সাজাহানকে দ্যাখো ঈশ্বর! তোমার দয়া হচ্ছে না? দয়া হচ্ছে না? আমি এমন কী পাপ করেছিলাম খোদা। মাথার দুপাশ থেকে হাত দুটো নামিয়ে হাঁটুর সামনে নামাজের ভঙ্গিতে উপুড় করে বাবা ধীরে ধীরে পেছোতে-পেছোতে সোফা কাম বেডে ধপাস করে শরীরটা ফেলে দিলেন। শরীরের ভারে স্প্রিং নেচে উঠল শব্দ করে।
আমার বাবার নামটা ভারী অদ্ভুত ঋভু। বিরাজকাকু খুব ধীরে-ধীরে বাবার নাম ধরে ডাকলেন, ঋভু।
বাবা ফ্যালফ্যাল করে বিরাজকাকুর মুখের দিকে শিশুর মতো তাকিয়ে রইলেন। ষাট পাওয়ারের আলোতে বাবার মুখটা যতখানি দেখতে পাচ্ছি তাতে মনে হচ্ছে, একটি আপনভোলা শিশু যেন, মাঝরাতে খাটের ধারে বসে আছে। ঘুম ভেঙে দেখছে মা কি করছে। বাবার একবার অসুখ করেছিল। যেদিন জ্বর ছেড়ে গেল সেদিন মা বাবাকে খাটের ধারে বসিয়ে গেঞ্জির ওপর তোয়ালে রেখে ঠান্ডা জলে মাথা ধুইয়ে দিলেন। উশকোখুশকো চুলে বাবা বসে আছেন। কিছু দূরেই মা থালায় ঝোল আর রুটি সাজাচ্ছেন। বাবা কেমন খিদে-খিদে মুখে তাকিয়ে আছেন। সেদিনের সেই মুখ আর আজকের এই মুখ। মনটা কেমন খারাপ হয়ে গেল।
বাবা খুব ধীরে ধীরে জিগ্যেস করলেন, কটা বাজল?
বিরাজকাকু বললেন, প্রায় তিনটে।
রাত শেষ হয়ে এল। এখুনি সকাল হবে। তাই না? সকাল হবে না? বাবা জানালার দিকে তাকালেন। যেন আলো খুঁজছেন। আকাশ এখনও অন্ধকার। শেষরাতের তারা সোনার টাকার মতো আকাশে ছড়িয়ে আছে। বাবা বললেন, ঘরের আলো নিভিয়ে দাও। দিনের আলোর পথ করে দাও। কে সেই মূর্খ লণ্ঠন জ্বেলে সূর্য খুঁজছে।
বিরাজকাকু আলোটা তাড়াতাড়ি নিভিয়ে দিলেন।
সেই অন্ধকার ঘরে বাবার সুন্দর গলায় গান শোনা গেল—
আমি সারা সকালটি বসে বসে এই
সাধের মালাটি গেঁথেছি।
আমি, পরাব বলিয়ে তোমারি গলায়
মালাটি আমার গেঁথেছি।
আমি সারা সকালটি করি নাই কিছু,
করি নাই কিছু বঁধু আর
শুধু বকুলের তলে বসিয়ে বিরলে
মালাটি আমার গেঁথেছি।
আগেও দেখেছি আজও দেখলাম শেষরাতে একটা পেঁচা ডাকবেই ডাকবে। ডেকে জানিয়ে দেবে দিন আসছে। রাত যেন টান-টান সভা সাজিয়ে বসে থাকে। জলসাঘরে জাজিমের মতো। ক্রমশ জমতে জমতে একসময় হালকা থেকে হালকা হয়ে মিছিলের মতো সরে যেতে-যেতে একেবারে মুছে যায়। পেঁচার ডাক শুনে বাবা চমকে উঠলেন। গান থেমে গেল। ঘরের চারপাশে তাকালেন। রাত ফিকে হতে চলেছে। বাবার নেশাও ফিকে হচ্ছে। আমাদের দেখতে পেয়েছেন।
বিরাজ তোমার ঘরে এরা কারা। তুমি কি বিয়ে করেছ?
বিরাজকাকু সামান্য হেসে বললেন, এরা তোমারই ছেলে মেয়ে ঋভু। দীপাকে তো তুমি মেরে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়েছ।
বাবার মুখটা কেমন যেন বেঁকে গেল। কি যেন মনে করার চেষ্টা করছেন। সেই রাত। সিঁড়ির ধাপে মা পড়ে আছেন। অসম্ভব রক্ত ঝরছে। চারদিক নিস্তব্ধ। শুধু ঘরের দেওয়ালে একটা ঘড়ি টিকটিক করছে। দূরে কল থেকে বালতিতে জল পড়ছে টিপটিপ করে।
বাবার মুখ দেখে মনে হল, সেই রাত তার চোখের সামনে ফিরে আসছে। মুখটা ভাঙতে ভাঙতে কান্নায় ভেঙে পড়ল। দু-হাতে মুখ ঢেকে বাবা আকুল হয়ে কাঁদছেন। এভাবে আমি কখনও কাউকে কাঁদতে দেখিনি। কিছু ভেঙে ফেলে এ যেন শিশুর অসহায় কান্না।
একটা কাক ডাকছে। দিনের প্রথম কাক। কী তীক্ষ্ণ, কর্কশ আওয়াজ।