নান্টুর চায়ের দোকানে রাজনৈতিক আলোচনা নিষিদ্ধ। দক্ষিণ দিকের দেয়ালে সে বড়ো করে নটিশ ঝুলিয়েছে–কোনো রাজনীতির আলাপ করিবেন না। রাজনীতির আলোচনার জন্যে কেউ চায়ের দোকানে যায় না। সেখানে আজানের সময়টা বাদ দিয়ে সারাক্ষণই গান বাজে। হিন্দী গান নয়–পল্লীগীতি। নান্টু পল্লীগীতির বড়ো ভক্ত। চায়ের স্টলটি মোটামুটি চালু। সন্ধ্যার আগে আগে এখানে পেঁয়াজু ভাজা হয়। পেঁয়াজু খাবার জন্যে অনেকে আসে। নীলগঞ্জ থানার সেকেণ্ড অফিসার সেপাই পাঠিয়ে রোজ এক টাকার পেঁয়াজু কিনিয়ে নেন। নান্টু অন্যদের টাকায় দশটা দেয় কিন্তু থানাওয়ালাদের জন্যে বারটা।
আজ নান্টুর দোকানে গান হচ্ছিল না। পেঁয়াজুও ভাজা হচ্ছিল না। ভাজাভাজির কাজ যে করে তার জলবসন্ত হয়েছে। নান্টুর মেজাজ এ জন্যেই ঠিক নেই। মেজাজ ঠিক না থাকলে গান-বাজনা জমে না। নাট্ গান বাজায় নিজের জন্যে, কাস্টমারের জন্যে নয়। তাছাড়া তার নিজের শরীর বেজুত লাগছে। তারও সম্ভবত জলবসন্ত হবে। অনেকেরই হচ্ছে। সে ঠিক করল রাত আটটার ট্রেন চলে গেলেই দোকানের ঝাঁপ ফেলে দেবে। কিন্তু আটটার ট্রেন আসতে আজ অনেক দেরি করল। থানার ঘড়িতে নটার ঘন্টা পড়ারও অনেক পরে ট্রেনের বাতি দেখা গেল।
নান্টু দোকানের ঝাঁপ ফেলে বাইরে এসে অবাক হয়ে দেখল জহুর আলিকে। মাথা নিচু করে হাঁটছে। জহুর আলি ছাড়া পেয়েছে নাকি? তার ধারণা ছিল যাবজ্জীবন হয়েছে। নান্টু এক বার ভাবল ডাক দেয়। কিন্তু মনস্থির করতে করতে জহুর আলি জুমাঘরের আড়ালে পড়ে গেল। জহুর আলির হাতে একটা দুই ব্যাটারির টর্চ। সে মাঝে মাঝে টর্চের আলো ফেলছে। চেহারা আগের মতই আছে। একটু অবিশ্যি ভারি হয়েছে। হাঁটছে মাথা নিচু করে কুঁজো হয়ে। আগে বুক ফুলিয়ে হাঁটত।
নান্টু একটা বিড়ি ধরাল। ভালো লাগল না। মাথা ঝিমঝিম করে উঠছে। অর্থাৎ জ্বর আসছে। জ্বর আসার প্রথম লক্ষণই হচ্ছে প্রিয় জিনিসগুলো বিস্বাদ লাগে। পান মুখে দিলে পানটাকে এখন ঘাসের মতো লাগবে। নান্টু বিড়ি ফেলে দিয়ে গণপতির দোকান থেকে এক খিলি পান কিনল। গণপতি বলল, স্টল বন্ধ করে দিলেন?
হুঁ।
রফিকের নাকি বসন্ত?
জলবসন্ত।
ও, আমি শুনলাম আসল জিনিস।
নান্টু পানের পিক ফেলে বলল, জহুর আলি ছাড়া পেয়েছে।
গণপতি চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, কার কাছে শুনলেন?
দেখলাম নিজের চোখে।
নান্টু বাড়ির পথ ধরল। অলকা ডিসপেনসারির কাছে তার সাথে দেখা হল সাইফুল ইসলামের। সাইফুল ইসলাম রাত দশটার দিকে তার স্টলে এক কাপ চা আর একটা নিমকি খায়। নান্টু বলল, দোকান বন্ধ আজকে।
এত সকালে?
শরীরটা ভালো না, জ্বর।
ও।
নান্টু মুখ থেকে পানটা ফেলে দিল। বিস্বাদ। জ্বর তাহলে সত্যি-সত্যি আসছে। সাইফুল ইসলাম সিগারেট ধরাল। নান্টুর বমি-বমি লাগছে। ধোঁয়াটাও অসহ্য লাগছে। নান্টু একদলা থুথু ফেলে বলল, জহুর আলি ছাড়া পেয়েছে, জানেন নাকি?
জহুর আলি কে?
নান্টু কিছু বলল না। এ নতুন লোক। দু বছর আগে এসেছে। এরা কিছুই জানে না। সাইফুল ইসলাম আবার জিজ্ঞেস করল, জহুর আলিটা কে?
নান্টু জবাব দিল না। তার মাথা ঘুরছে। পানের মধ্যে জর্দা ছিল নিশ্চয়ই।
জহুর আলিটা কে?
আপনে চিনবেন না। বাদ দেন।
বলেন না শুনি।
নান্টু বড় বিরক্ত হল। সাইফুল ইসলামকে কথাটা বলাই ভুল হয়েছে। এই লোকটি পিছলা ধরনের। ঘ্যানঘ্যান করতে থাকবে। নান্টু চাপা স্বরে বলল, পরে শুনবেন। এখন বাড়িতে যান।
এত সকালে বাড়িতে গিয়ে করব কী?
যা ইচ্ছা করেন। গান-বাজনা করেন।
গান-বাজনা কি অৰ্ডারি জিনিস? বললেই হয়? সিগারেট খাবেন?
নাহ্।
খান-না রে ভাই। নেন একটা।
বললাম তো–না।