তৃতীয় অধ্যায় – রতিপরিণয়
মার্কণ্ডেয় বলিলেন;–অনন্তর পূর্ণ রোষাবিষ্ট জগৎপতি ব্রহ্মা, দিধক্ষু অনলের ন্যায় অত্যন্ত প্রজ্বলিত হইয়া উঠিলেন। ১
ঈশ্বরকে বলিতে লাগিলেন; হে শিব! কাম যেমন আপনার সম্মুখে আমাকে শরাঘাত করিল, সেইরূপ ফল পাইবে। ২।
হে দেবাদিদেব! এই কন্দর্প অহঙ্কারে মত্ত হইয়া অতি দুষ্কর কর্ম সাধন পূর্বক আপনার নয়নানলে ভস্মীভূত হইবে। ৩
হে দ্বিজসত্তমগণ! ব্যোমকেশ ও সংযতচিত্ত মুনিগণের সমক্ষে স্বয়ং বিধাতা এইরূপে কামকে শাপ দিয়াছিলেন। ৪
অনন্তর রতিপতি নিদারুণ শাপশ্রবণে ভীত হইয়া অস্ত্র শস্ত্র পরিত্যাগপূর্বক তাহাদিগের সমক্ষে প্রাদুর্ভূত হইলেন। ৫
দক্ষ মরীচি প্রভৃতি ঋষিগণসমক্ষে ব্রহ্মাকে যথার্থ কথা বলিতেও তাহার কণ্ঠস্বর ভয়ে জড়িত হইতে লাগিল। ভয় হইলে কাহারও ধৈর্য্য ও সাহসাদি গুণ থাকে না। ৬
মন্মথ বলিলেন,–হে ব্ৰহ্মন্! আমি ন্যায্যপথানুবর্তী নিরপরাধ; হে লোকেশ! তবে আমাকে কি জন্য অতি দারুণ শাপ দিলেন? ৭।
আপনি আমাকে যে কাৰ্য্য করিতে বলিয়াছেন, প্রভো! আমি তাহাই করিয়াছি; অন্য কিছু করি নাই; তাহাতে আমাকে শাপ দেওয়া আপনার অনুচিত হইয়াছে। ৮।
আপনি যে বলিয়াছিলেন, “আমি, বিষ্ণু এবং মহেশ্বর আমরা সকলেই তোমার বশবর্তী,” আমি তাহারই পরীক্ষা করিয়া দেখিয়াছি মাত্র। ৯
হে ব্ৰহ্মন্! এ বিষয়ে আমার কিছুমাত্র অপরাধ নাই। হে জগৎপতে। নিরপরাধে আমার প্রতি প্রদত্ত এই নিদারুণ শাপ মোচন করুন। ১০
মার্কণ্ডেয় বলিলেন,–তাহার এই কথা শুনিয়া জগৎপতি বিধাতা সেই সংযত-চিত্ত মদনকে অত্যন্ত আনন্দিত করত উত্তর প্রদান করিলেন। ১১
ব্ৰহ্মা বলিলেন,–এই সন্ধ্যা, আমার কন্যা, তুমি আমাকে ইহার প্রতি কামভাবাপন্ন করিতে লক্ষ্য করিয়াছিলে বলিয়া আমি তোমাকে শাপ দিয়াছি। ১২
এখন আমার ক্রোধ-শান্তি হইয়াছে। মনোভব! যেরূপে শাপ মোন হইবে, তাহা তোমাকে বলিয়া দিতেছি। ১৩
মদন! তুমি মহাদেবের নয়নানলে ভস্মীভূত হইয়া পশ্চাৎ তাহার অনুগ্রহে আবার শরীর পাইবে। ১৪
যখন, দেবাদিদেব মহাদেব দারপরিগ্রহ করিবেন; তখন তিনিই তোমাকে শরীরী করিবেন। ১৫
মার্কণ্ডেয় বলিলেন,–লোক-পিতামহ ব্রহ্মা মদনকে এই কথা বলিয়া মানস সম্ভূত মুনিবরগণের সমক্ষেই অন্তর্হিত হইলেন। ১৬
সৰ্ববিধাতা ব্রহ্মা অন্তর্হিত হইলে, মহাদেব, বায়ুবৎ শীঘ্রগামী বৃষভে আরোহণপূর্বক অভিলষিত স্থানে গমন করিলেন। ১৭
বিধাতা অন্তর্হিত হইলে এবং মহাদেব নিজালয়ে গমন করিলে, দক্ষ মদনের পত্নী নির্দেশ করিলেন। ১৮
দক্ষ তাহাকে বলিলেন,–কন্দর্প! এই আমার দেহজাত কন্যা; আমার রূপ গুণ ইহাতে বিদ্যমান; ইনি গুণে তোমার অনুরূপা বটে; ইহাকে বিবাহ কর। ১৯
এই মহাতেজস্বিনী রমণী তোমার সতত সহচারিণী এবং তোমার ইচ্ছানুসারে ধর্মতঃ বশবর্তিনী হইবেন। ২০
মার্কণ্ডেয় বলিলেন,–দক্ষ এই কথা বলিবার পর নিজ শরীরের স্বেদজল-সম্ভূত কন্যাকে সম্মুখে করিয়া তাহাকে রতি নামে অভিহিত করত কন্দর্পের হস্তে সম্প্রদান করিলেন। ২১
মদন, সেই রতি-নাম্নী মনোহরা রমণীকে নিরীক্ষণ করিবামাত্র নিজ শরে বিদ্ধ হইয়া রতি-অনুরাগে মুগ্ধ হইলেন। ২২
সৌদামিনীর ন্যায় অতিশয় গৌরবর্ণা সেই চঞ্চলাপাঙ্গী মৃগনয়না রমণী তাঁহারই অনুরূপ ভাৰ্য্যা হইয়া বড় শোভা পাইলেন। ২৩
মদন তাহার ভ্রুযুগল দেখিয়া সংশয় করিয়াছিলেন যে, বিধাতা কি আমার উন্মাদন নামক শরাসন এই রমণীতে নিবেশিত করিয়াছেন? ২৪
হে দ্বিজবরগণ! মদন, তদীয় কটাক্ষের আশুগামিতা দেখিয়া স্বীয় অস্ত্র গণের আশুগতা বা চারুতার উপর বীতশ্রদ্ধ হইলেন। ২৫
মদন, তাঁহার স্বভাব সুগন্ধ মৃদু নিশ্বাসবায়ু আঘ্রাণ করিয়া মলয় পবনে শ্রদ্ধাহীন হইলেন। ২৬
মদন, ভ্রূরেখা-লাঞ্ছিত পূর্ণচন্দ্রনিভ তদীয় বদন অবলোকন করিয়া সেই মুখ ও প্রকৃত চন্দ্রের পার্থক্য নির্ধারণে সমর্থ হইলেন না। ২৭
ভ্রমরসেবিত সুবর্ণকমলকলিকাকার তদীয় কুচদ্বয়, চুচুকযুগলযোগে শোভা পাইয়াছিল। ২৮
তাহার দৃঢ় পীবর সমুন্নত পরস্পরসংলগ্ন স্তনযুগলের মধ্য হইতে নাভিপৰ্যন্ত লম্বমান, বিরল দীর্ঘ কমনীয় লোমাবলী দেখিয়া বোধ হয়, কাম নিজ কুসুম শরাসনের ভ্রমরপূর্ণ মৌর্ব্বী ভুলিয়া গিয়াছিলেন; নতুবা সেই মৌর্ব্বী ত্যাগ করিয়াইহা দেখিতে এত ব্যগ্র হইবেন কেন? ২৯-৩০
তদীয় গম্ভীর নাভিরঞ্জ মধ্যস্থলে, চারিপাশের চর্ম দ্বারা সংবৃত রন্ধ্র মুখ ক্ষুদ্রায়তন; তাঁহার মুখ ও নয়নযুগল আরক্ত-কমল-সন্নিভ। ৩১
একে তাহার বর্ণ স্বভাবতঃ সুবর্ণসদৃশ, তাহাতে আবার মধ্যদেশে ক্ষীণ; হে দ্বিজবরগণ! কাজেই কাম তাহাকে স্বর্ণবেদীর ন্যায় * দেখিতে লাগিলেন। ৩২ [* অথৰ্ব্ববেদিগণ যজ্ঞীয় বেদীর মধ্যস্থল ক্ষীণ করিয়া থাকেন।]
কাম, কদলীস্তম্ভবৎ আয়ত ও স্নিগ্ধ কমনীয় কোমল ঊরুযুগল, নিজ শক্তি বোধে দেখিতে লাগিলেন। ৩৩
তাহার বিচিত্র পদদ্বয়ের পার্ষ্ণি, পদাগ্র ও প্রান্তভাগ সকলই আরক্ত। মদন, সেই রক্তিমাকে আপনার প্রতি রতির অনুরাগ বোধ করিয়াছিলেন। ৩৪* [*১ “অনুরাগময়ং চিত্ৰম” এই পাঠানুসারে ব্যাখ্যা করা হইল। ২। “অনুরাগময়ং মিত্ৰং” এই পাঠও আছে–তাহার অর্থ “অনুরাগরূপী বন্ধু” এ পাঠ অপেক্ষা প্রথমোক্ত পাঠ স্ফূটার্তযুক্ত।]
হে দ্বিজসত্তমগণ! কিংশুক-কুসুম-সদৃশ নখর-নিকরে ও সূক্ষ্মাগ্র নিস্তল অঙ্গুলীযোগে মনোহর রক্তবর্ণ তদীয় কর-যুগল দেখিয়া মদন ভাবিলেন,–রতি কি আমার অস্ত্রই দ্বিগুণ করিয়া তদ্বারা আমাকে মোহিত করিতে উদযোগ করিয়াছেন। ৩৫-৩৬।
কাম ভাবিলেন;-বুঝি লাবণ্য জল প্রবাহই দ্বিধা বিভক্ত হইয়া ইহার মৃণালযুগলসদৃশ স্নিগ্ধ কোমল আয়ত কমনীয় বাহুযুগলসদৃশ আসিতেছে। তাহার নীলনীরদ-সন্নিভ মদনমোহন মনোহর কেশপাশ, চমরী মৃগীর পুচ্ছস্থিত কেশগুচ্ছের ন্যায় শোভা পাইয়া থাকে। ৩৭
মদন, সেই যতিজন-মনোহারিণী রতি দেবীকে দেখিয়া মহাদেব যেমন গঙ্গাকে গ্রহণ করিয়াছিলেন, সেইরূপ প্রীতি-প্রফুল্লনয়নে তাহাকে গ্রহণ করিলেন। ৩৮
রতিদেবীও সাক্ষাৎ গঙ্গা; কেননা গঙ্গার সকল চিহ্নই তাহাতে বর্তমান, তিনি কান্তিরূপ জলপ্রবাহে পূর্ণ; তাহার কুচাগ্রযুগল কমল-কলিকা; বদন মণ্ডল প্রফুল্লকমল; সুন্দর বাহু মৃণালখণ্ড; ভ্রূভঙ্গী তাহার ক্ষুদ্র তরঙ্গ; কটাক্ষ পাত উত্তুঙ্গলহরী; নয়নযুগল নীলোৎপল; ক্ষীণ লোমাবলী তাহার শৈবাল; নিম্ননাভি তাহার আবৰ্ত্ত; লোকের চিত্তরূপ বৃক্ষ আত্মসাৎ করিতেও তিনি সুপটু; আর দক্ষ-প্রজাপতিস্বরূপ হিমালয় গিরি হইতে তাহার উৎপত্তি। ৩৯-৪২
কাম তখন সাতিশয় প্রমোদ বশত সেই ব্ৰহ্মদত্ত নিদারুণ শাপ বিস্মৃত হইয়া দক্ষকে বলিলেন;–প্রভো! এই সম্পূর্ণ সুন্দর-রূপশালিনী রমণী আমার সহচারিণী হইলে আমি এখন মহাদেবকে মোহিত করিতে পারিব, অন্য প্রাণীর কথা কি বলিব কি? ৪৩-৪৪
হে অনঘ! আমি যে যে স্থান লক্ষ্য করিয়া শরাসন ধরিব, তথায় তথায় ইহাকেও রমণ-মায়াযোগে আমার অনুকূলে চেষ্টা করিতে হইবে। ৪৫
আমি স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালের মধ্যে যখন যেখানে যাইব, এই সতত-চারু হাসিনী তখনই আমার সহগামিনী হইবেন। ৪৬।
হে প্রজাপতি! নারায়ণের যেমন লক্ষ্মী, জলদজালের যেমন সৌদামিনী, তদ্রূপ ইনিও যেন সর্বদা আমার সহচারিণী হন। ৪৭
মার্কণ্ডেয় বলিলেন;–মদন এই কথা বলিয়া নারায়ণ যেমন সাগরোত্থিতা লক্ষ্মীকে গ্রহণ করিয়াছিলেন, সেইরূপ উত্তমা রমণী রতিদেবীকে ঔৎসুক্য সহকারে গ্রহণ করিলেন। সন্ধ্যাকালে মেঘ যেমন মনোহর সৌদামিনীসহ শোভা পায়, ফুট গৌরবর্ণ কামদেব রতিসহ সেইরূপ শোভা পাইলেন। ৪৮-৪৯
এইরূপে সাতিশয় আনন্দযুক্ত রতিপতি,–যোগী যেমন বিদ্যাকে (তত্ত্বজ্ঞান) হৃদয়ে ধারণ (চিন্তা) করেন, তদ্রূপ সেই রতিদেবীকে হৃদয়ে (বক্ষঃস্থলে) ধারণ করিলেন। জলধিনন্দিনী হরিকে পতিরূপে পাইয়া যেমন সন্তুষ্ট হইয়াছিলেন, পূর্ণচন্দ্রবদনা রতিদেবীও শ্রেষ্ঠ স্বামী পাইয়া সেইরূপ সন্তোষ লাভ করিলেন। ৫০
তৃতীয় অধ্যায় সমাপ্ত। ৩