আজ জুলাই মাসের এক তারিখ, সোমবার।
যুথীর অফিসে জয়েন করার তারিখ। সে হাতে যোলদিন সময় পেয়েছিল। এই ষোলদিনে সে অনেকগুলি কাজ করেছে। New Age computer নামের এক প্রতিষ্ঠানে এক হাজার টাকা দিয়ে নাম লিখিয়েছে। সপ্তাহে তিন দিন সন্ধ্যা সাতটা থেকে নয়টা পর্যন্ত ক্লাশ। তারা ছয় মাসে নাকি কম্পিউটারে ওস্তাদ বানিয়ে দেবে। নিউ এজ কম্পিউটারের মালিক আব্দুস সোবাহান কোরানে হাফেজ। তিনি বললেন, মা শুনেন। কম্পিউটার হলো মানব সস্তানের মতো। তার যত্ন করবেন। তাকে আদর করবেন। সে আদরের কাঙাল। শিশুদের যেমন পোষ মানাতে হয়, তাকেও পোষ মানাতে হবে। তারপর তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে কাজ আদায় করতে হবে।
হাফেজ সাহেবের কথাবার্তা যুথীর পছন্দ হলো। সে একদিন ক্লাশ করেছে। তার কাছে মনে হয়েছে, হাফেজ সাহেব শিক্ষক হিসেবে ভালো।
সে একজন গানের টিচারের সাথেও কথা বলেছে। তার নাম অশোক মিত্ৰ। তিনি বাড়ি বাড়ি গিয়ে গান শেখান। তবলা সঙ্গে নিয়ে যান বলে ছাত্রের বড়িতে তবলা না থাকলেও সমস্যা নাই। অশোক বাবু মাসে এক হাজার টাকা নেবেন এবং সপ্তাহে একদিন শুক্রবার গান শেখাবেন এমন কথা হয়েছে। যুথীর গান শেখা এখনো শুরু হয় নি।
যুথী চারটা ছেলেমেয়েকে পড়াত। এদের প্রত্যেককে এক প্যাকেট চকলেট দিয়ে বিদায় নিল। চাকরির প্রথম বেতনের টাকা পেয়ে সে তাদের সবাইকে নিয়ে পিৎজাহাটে খাবে, এই কথা বলে এল।
চাকরিতে জয়েন করতে যাবার আগে বাবা-মাকে পা ছুঁয়ে সালাম করল। আজহার বললেন, সোনার হরিণ সহজে ধরা যায় না। তোর ওপর ময়মুরুব্বির দোয়া আছে বলে ধরে ফেলেছিস। চেষ্টা করবি যেন হরিণ ছুটে না যায়।
যুথীর মা শাড়ির আঁচলে মুখ ঢেকে কাঁদতে শুরু করলেন। আজহার বললেন, শুভযাত্রার সময় চোখের পানি ফেলছি। মূর্খামীর সীমা থাকা দরকার। কাঁদতে হয় বাথরুমে দরজা বন্ধ করে ভেউ ভেউ করে।
টুনু ট্যাক্সি ক্যাব ভাড়া করে এনেছে। প্রথমদিন ভাড়া ট্যাক্সিতে করে যুথী যাচ্ছে। আজ অফিস শেষে অফিসের গাড়ি বাসা চিনে যাবে, তখন অফিসের গাড়িতেই আসা-যাওয়া হবে! টুনু বলল, আমি তোর সঙ্গে যাই। অফিসটা দেখে আসি।
যুথী বলল, ভাইয়া আজ না। আরেক দিন। আজ আমার খুব লজ্জা লাগছে।
অফিসে পা দেওয়া মাত্র বড় সাহেব ডেকে পাঠালেন; আজ তাঁর সামনে কোনো গল্পের বই নেই। চোখে চশমা। ওইদিন চোখে চশমা ছিল না। হালকা সবুজ রঙের শার্টে তাকে আগের দিনের চেয়েও সুন্দর লাগছে।
যুথী আপনার নাম?
জি।
ভালো আছেন?
জি স্যার ভালো আছি।
জয়েন করতে এসেছেন?
জি।
আমাদের কিছু সমস্যা হয়েছে। আপনাকে নিতে পারছি না। অ্যািপয়েন্টমেন্ট লেটারে উল্লেখ করা আছে, কোনো কারণ দর্শানো ছাড়া আমরা অ্যাপিয়েন্টমেন্ট লেটার বাতিল করতে পারি। আপনার বায়োডটা আলাদা রেখে দিতে বলেছি। কোনো স্কোপ হলে আপনাকে খবর দেব। বুঝতে পারছি আপনাকে অসুবিধায় ফেলেছি। সরি ফর দ্যাট।
বড় সাহেব ড্রয়ার খুলে কাগজপত্র বের করে পড়তে শুরু করলেন। হঠাৎ তাকে অনেক ব্যস্ত মনে হলো।
যুথী বড় সাহেবের ঘর থেকে বের হলো। তার উচিত মাথা নিচু করে কেউ কিছু বুঝতে পারার আগেই অফিস থেকে বের হয়ে যাওয়া। কেন জানি এই কাজটা সে করতে পারছে না। তার ইচ্ছা করছে। সারা দিন অফিসে বসে থাকতে। অফিস ক্যানটিনে চা খেতে। জহির সাহেবকে খুঁজে বের করে তার সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করতে।
জহিরকে দেখা গেল। সে চট করে চোখ সরিয়ে নিয়ে করিডরের দিকে চলে যাচ্ছিল। যুথী গলা উঁচিয়ে ডাকল, জহির সাহেব!
জহির দাঁড়াল। যুথী তার কাছে এগিয়ে গেল। সহজ গলায় বলল, কেমন আছেন?
জহির বলল, জ্বি ভালো।
মনে হচ্ছে আপনি আমাকে চিনতে পারেন নি। আমার নাম যুথী।
আমি আপনাকে চিনেছি।
আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারকে মৃত ঘোষণা করা হয়েছে। নিশ্চয়ই শুনেছেন?
জি আমি জানি।
আমার পোষ্টে কি কাউকে নেওয়া হয়েছে?
আগে যিনি ছিলেন তিনি জয়েন করেছেন।
যুথী বলল, প্রচণ্ড রাগ লাগছে। কী করা যায় বলুন তো? বড় সাহেবের অফিসঘরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া তো সম্ভব না।
আমার রুমে কিছুক্ষণ বসবেন?
আপনার কি ধারণা আপনার ঘরে কিছুক্ষণ বসলে আমার রাগ কমবে?
এক কাপ চা খান!
থ্যাংক য়্যু। আরেকদিন এসে চ খেয়ে যাব।
আপনাকে এক মাসের বেতন দেওয়ার কথা। এই বিষয়ে কি বড় সাহেবের সঙ্গে কথা বলবেন?
না! চলুন আপনার ঘরে বসি, এক কাপ চা খাই। গফুর ভালো চা বানায়। ওকে বলুন আমাকে এক কাপ চা দিতে।
চা খেতে খেতে যুথী বলল, এই মুহুর্তে অপমানটা আমার গায়ে লাগছে না। কিন্তু বাসায় যখন ফিরুব, সবাই জানবে, তখন অপমানটা গায়ে লাগবে। অভাবী। সংসার তো। কুড়ি হাজার টাকা বেতনের চাকরি অনেক বড় ব্যাপার। সোনার হরিণের চেয়েও বেশি। প্লাটিনাম হরিণ।
জহির বলল, মালিকপক্ষের সঙ্গে কথা বলবেন? ঠিকানা দেব?
যুথী দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, না। আমি আরেক কাপ চা খাব।
দুকাপ চা পুরোপুরি শেষ করে যুথী উঠল। সে ঠিক করুল আজ সন্ধ্যার আগে বাসায় ফিরবে না। সারাদিন পথে পথে ঘুরবে। পার্কে বসে বাদাম খাবে। হাফ প্লেট চটপটি খাবে।
গফুরকে দশ টাকা বখশিশ দিয়ে যুথী বের হলো। গফুর অত্যন্ত বিরক্ত হলো। এত কম বখশিশ মনে হয় তাকে এর আগে কেউ দেয় নি।
নিউ এজ কম্পিউটারে একবার যেতে হবে। টাকাটা ফেরত পাওয়া যায় কি না সেই চেষ্টা। মনে হয় না ফেরত পাওয়া যাবে; গানের টিচার বাতিল করতে হবে। পুরনো টিউশনি ফেরত পাওয়া যায় কি না সেই চেষ্টাও করতে হবে। আজ একদিনে তার অনেক কাজ।
অনেকক্ষণ ধরে কে যেন বেল টিপছে। বাসায় সালমা ছাড়া কেউ নেই। ঠিকা কাজের মেয়ে কাজ শেষ করে চলে গেছে। সম্ভবত টুনু এসেছে। সালমা দরজা খুললেন। অপরিচিত একটা মেয়ে। ষোল-সতেরোর বেশি বয়স হবে না। চামড়ার একটা সুটকেস আর কাধে ঝোলানো ব্যাগ নিয়ে ভীতমুখে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটা সুন্দর। যে-কোনো কারণেই হোক ভয়ে তার চোখমুখ শুকিয়ে আছে। মনে হয় অনেকক্ষণ কেঁদেছে। চোখ ফোলা এবং লাল। মেয়েটা শাড়ি পরে এসেছে। শাড়ি খানিকটা এলোমেলো। মনে হয় শাড়ি পরায় সে অভ্যস্থ না।
সালমা বললেন, কী চাও?
মেয়েটা বলল, ও নাই?
সালমা বললেন, ওটা কে?
টুনু ভাই।
টুনু ভাইয়ের সঙ্গে তোমার কী?
দরকার আছে।
মেয়েটা ফুঁপিয়ে উঠল। সালমা বললেন, আমি টুনুর মা। টুনুর সঙ্গে তোমার কী দরকার?
আমাকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছে। আমার কোথাও যাবার জায়গা নাই।
সালমা বললেন, টুনু তোমাকে জায়গা দিবে কী জন্যে? টুলুর সঙ্গে তোমার কী?
ওর সঙ্গে আমার কোর্টে বিয়ে হয়েছে। আগস্ট মাসের সাত তারিখ।
কী বলছ পাগলের মতো! নাম কী তোমার?
লাইলি। আমি কি আপনাকে কদমবুসি করব?
আসো ভিতরে। টুনু আসুক। তখন ফয়সালা হবে।
সালমার হাত-পা কাঁপতে লাগল। এইসব তিনি কী শুনছেন?
বাসা থেকে তোমাকে কে বের করে দিয়েছে? তোমার বাবা-মা?
না, আমার মামা। আমার বাবা-মা দুজনই মারা গেছেন। আমি মামার সঙ্গে থাকি। আমি এক গ্ৰাস পানি খাব।
সালমা পানি এনে দিলেন। এবং মোবাইল টেলিফোনে আজহারকে ঘটনা জানালেন।
আজহার কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, মেয়ের পাছায় কষে একটা লাথি দিয়ে বাসা থেকে বের করে দাও। টুনু হারামজাদা বাসায় ফিরুক, আমি তাকে লাথি দিয়ে বের করব। লাইলি-মজনু খেলা আমার বাড়ির বাইরে হবে। আমি এক্ষুনি রওনা হচ্ছি। বাসায় এসে যেন মেয়েকে না দেখি। যদি দেখি তাহলে তোমাকে বের করে দেব।
সালমা বসার ঘরে ঢুকলেন। বেতের চেয়ারে মেয়েটা বসে আছে। তার ভাবভঙ্গি মোটেই ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাবে। লাইলি বলল, আমি আরেক গ্লাস পানি খাব।
সালমা বললেন, যত ইচ্ছা পানি খাও, তারপর বাসা থেকে চলে যাও। টুনুর বাবা আসছেন। উনি ভয়ঙ্কর রাগী মানুষ। কী করে বসেন তার নাই ঠিক।
লাইলি বলল, আমি কোথায় যাব?
সেটা তো আমি জানি না। বিয়ে করার সময় তো আমাকে জিজ্ঞেস করে বিয়ে করোনি।
ও না আসা পর্যন্ত আমি যাব না। আমার কোথাও যাবার জায়গা নেই।
টুনুর বাবা এলে কী হবে তুমি কল্পনাও করতে পারছি না।
আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে টুনু ভাইয়ের জন্যে অপেক্ষা করি?
যা ইচ্ছা করো। শুধু ঘরে থাকবে না।
সুটকেস এবং ব্যাগটা এখানে থাকুক?
কোনো কিছুই থাকবে না।
ঘণ্টাখানিকের মধ্যে আজহার উপস্থিত হলেন। রাগে তাঁর মুখ গনগন করছে। বুকে ব্যথা শুরু হয়ে গেছে। টুনুর গলা টিপে ধরতে পারলে শান্তি পেতেন। টুনুর খোঁজ নেই।
আজহার বললেন, ঘরের স্টিলের ডান্ডাওয়ালা একটা ছাতা আছে না? ছাতা বের করে রাখে। ঐ ডান্ডা আজ তোমার ছেলের পিঠে ভাঙিব। তারপর কানে ধরে বহিষ্কার। আমার ঘাড়ে চেপে বসে থাকার দিন তার শেষ। এখন সে চরে খাবে।
সালমা বললেন, একগ্লাস লেবুর শরবত করে দেব? খুব ঘামছ।
দাও লেবুর শরবত। শরীরে বল করি। মেয়েটাকে দেখলাম। ইঁদুরের মতো মুখ।
সালমা বললেন, ইঁদুরের মতো মুখ তো না। সুন্দর চেহারা।
তাহলে কি দেবীর মতো মুখ? তুমিও কি তোমার ছেলের মতো দেবীদর্শন করে ফেললে? ঘরে বসে থেকে কী করবে! যাও দেবীর আশেপাশে ঘোরাঘুরি করো।
তুমি কি খেয়ে এসেছ?
না।
আবার অফিসে যাবে?
বাসায় যে অবস্থা, অফিসে কী যাব!
গোসল করে আসো। ভাত খাও। শুয়ে কিছুক্ষণ রেস্ট নাও।
আর রেস্ট! আমার জীবন থেকে রেস্ট উঠে গেছে।
সালমা বললেন, যুথীকে কি খবরটা জানাব?
আজহার বললেন, না। প্রথম চাকরিতে জয়েন করেছে। এখন তাকে ডিসটার্ব করা যাবে না।
আজহার সদর দরজার দিকে এগুলেন। সালমা বললেন, কোথায় যাও?
আজহার বললেন, আরেকবার দেবীদর্শন করে আসি।
সালমা ক্ষীণ গলায় বললেন, মেয়েটাকে বাসায় নিয়ে আসো। সারা দিন নিশ্চয়ই না খেয়ে আছে।
আজহার বললেন, আরেকবার এই ধরনের কথা বললে তোমাকেও ছাতাপিটা করব। মাতাপুত্র একসঙ্গে ছাতার নিচে।
লাইলি আগের জায়গাতেই আছে। আগে দাঁড়িয়ে ছিল, এখন স্যুটকেসের ওপর বসে আছে। শাড়ির আঁচলে তার মুখ ঢাকা। মাঝে মাঝে শরীর কেঁপে উঠছে। বলে বোঝা যাচ্ছে সে কাঁদছে। তাকে ঘিরে আছে চার-পাঁচজন কৌতূহলী মানুষ। তাদেরকে দেখে মনে হচ্ছে দৃশ্যটা দেখে তারা আনন্দ পাচ্ছে।
আজহার ফিরে এসে গোসল করলেন। ভাত খেলেন। বিছানায় শুয়ে পর পর দুটা বিড়ি টেনে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলেন। তাঁর ঘুম ভাঙল সন্ধ্যাবেলায়। টুনু তখনো ফেরে নি। তিনি মেয়েটির খোঁজ নিতে গেলেন। মেয়েটি নেই।
রেহানা শুভ্ৰকে নিয়ে বারান্দায় বসেছেন। ছেলের সঙ্গে কীভাবে কথা শুরু করবেন। বুঝতে পারছেন না। কখনো তার এরকম হয় না। শুভ্ৰ যে এরকম একটা কাণ্ড করতে পারে তা তার মাথাতেই কখনো আসে নি। শুভ্রর বাবার সঙ্গে কথা বলা যাচ্ছে না। তিনি জাপানে। চার দিন পর ফিরবেন।
রেহানা বললেন, শুভ্ৰ, তুমি অচেনা অজানা একটা মেয়ে নিয়ে বাসায় উপস্থিত হয়েছ?
শুভ্র বলল, মেয়েটার যে অবস্থা মা, যে-কেউ তাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যেত। পুরো ঘটনোটা বলি, আগে শোনো। বলব?
রেহানা হ্যাঁ না কিছু বললেন না। শুভ্ৰ নিজে থেকেই শুরু করল। যুথী আজ সন্ধ্যায় তাদের বাসায় আমাকে চা খেতে বলেছে। টেলিফোনে বলে নি, চিরকুট পাঠিয়েছে। আমি তার বাসার কাছে গিয়ে দেখি একটা মেয়ে সুটকেসের ওপর এলিয়ে পড়ে আছে। প্রায় অচেতন অবস্থা। তাকে ঘিরে নানান ধরনের মানুষের জটিল।
রেহানা বললেন, ভিড় ঠেলে তুমি ভেতরে ঢুকলে এবং মহান ত্ৰাণকৰ্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হলে। মেয়েটাকে পাজাকোলা করে গাড়িতে তুলে বাসায় নিয়ে এলে?
শুভ্র বলল, পাজাকোলা করে আনতে হয় নি মা। আমি যখন বললাম, আপনি কি আমার সঙ্গে আমার বাড়িতে যাবেন? সে সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল। চারপাশের লোকগুলি এমন অদ্ভুত, ওরা হাততালি দেওয়া শুরু করল।
রেহানা বললেন, ওরা হয়তো ভেবেছে বাংলা ছবির কোনো দৃশ্যের শুটিং হচ্ছে। সেরকম ভাবাই স্বাভাবিক। দর্শকদের মধ্যে আমি থাকলে আমিও হাততালি দিতাম। যাই হোক, আমি ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বলেছি। মেয়েটিকে যেখান থেকে আনা হয়েছে ড্রাইভার তাকে সেখানে রেখে আসবে।
শুভ্ৰ বলল, মা, মেয়েটি ভয়ঙ্কর বিপদে পড়েছে। বিপদ কেটে গেলে সে নিজের জায়গায় ফিরে যাবে।
রেহানা বললেন, বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মেয়ে ভয়ঙ্কর বিপদে আছে। তাদের সবাইকে তুমি এখানে নিয়ে আসবে?
শুভ্ৰ বলল, বাংলাদেশের সব বিপদগ্ৰস্ত মেয়েকে আমি চিনি না মা। একে চিনি।
একেও তুমি চেনো না। হঠাৎ দেখেছ, তুলে নিয়ে এসেছ।
শুভ্ৰ বলল, আমি তাকে নিয়ে এসেছি, এখন আমি তাকে বলব চলে যেতে?
রেহানা বললেন, তোমাকে কিছুই বলতে হবে না। যা বলার আমি বলব। তুমি তোমার ঘরে চলে যাও। গান শোনো কিংবা টিভি দেখো। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক-এর নতুন কপি আজ দুপুরেই এসেছে। সেটাও পড়তে পার।
শুভ্র বলল, মা শোনো। তুমি যদি সত্যি সত্যি মেয়েটাকে বাসা থেকে বের করে দাও, আমিও কিন্তু বের হয়ে যাব।
বের হয়ে যাবে?
হ্যাঁ।
কোথায় যাবে?
তা জানি না, কিন্তু বের হয়ে যাব।
রেহানা বারান্দা থেকে উঠে নিজের ঘরে ঢুকলেন। টেলিফোনে সব ঘটনা শুভ্রর বাবকে জানালেন।
মেরাজউদ্দিন বললেন, মেয়েটাকে এই মুহূর্তে বের করে দাও। তোমার ছেলে যদি বের হয়ে যায় তাহলে যাবে। ঢাকা শহর হলো ভয়াবহ অরণ্য। অরণ্যে বাস করার যোগ্যতা তার নেই। সে ফিরে আসবে। শিক্ষাসফর শেষ করে ফিরবে। এটাই লাভ। কোনো টাকা পয়সা সে যেন সঙ্গে না নেয় এটা খেয়াল রাখবে।
রাত আটটায় রেহানা শুভ্রকে এবং মেয়েটাকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলছেন।
শুভ্র বলল, মা আমি যাচ্ছি, কিন্তু তুমি আমার ওপর রাগ করে থেকে না। রাগ করার মতো কিছু করি নি। মেয়েটাকে দেখে খুবই কষ্ট লেগেছিল। আমরা তো বিচ্ছিন্ন কেউ না। সবাই সবার সঙ্গে যুক্ত। আমরা বৃহৎ মানবগোষ্ঠীর অংশ। একই Species, হোমোসেপিয়ানস।
রেহানা বললেন, বক্তৃতা দিয়ে না। তোমার বক্তৃতা শোনার মতো মনের অবস্থা আমার না। ড্রাইভারকে বলো কোথায় তোমাদের নামিয়ে দিতে হবে, সে নামিয়ে দিয়ে চলে আসবে।
ড্রাইভার লাগবে না। মা, যাই। তোমাকে বিরাট একটা সমস্যায় ফেলেছি, সরি।
রেহানা বললেন, তোমার সঙ্গে কি মানিব্যাগ আছে?
শুভ্ৰ বলল, আছে!
রেহানা কঠিন গলায় বললেন, মানিব্যাগ রেখে যাও।
রাস্তায় নেমেই লাইলি বলল, এতক্ষণ খুব ভয় লাগছিল। এখন কোনো ভয় লাগছে। বরং মজা লাগছে।
শুভ্র বলল, মজা লাগছে?
হুঁ। খুব ক্ষিধে লেগেছে। সকালে দুটা রুটি আর আলুভাজি খেয়েছি। সারা দিন কিছু খাই নি। ঐ দোকানে গরম গরম সিঙ্গারা ভাজছে! আসুন সিঙ্গারা খাই।
শুভ্র বলল, তোমার কাছে কি টাকা আছে? আমার কাছে কোনো টাকা নেই।
আমার কাছে সাতশ পঁচিশ টাকা আছে; পাশের বিরিয়ানি হাউসে যাবেন? বিরিয়ানি খাবেন?
তোমার খেতে ইচ্ছা করলে চলে যাই। তবে আমি কিছু খাব না।
আমার এখন এই অবস্থা পৃথিবীর সব কিছু খেয়ে ফেলতে ইচ্ছা করছে। আমার সবচেয়ে পছন্দের খাবার কী জানেন? মাছ মাংস কিছু না। রসুনের ভর্তা। রসুন পুড়িয়ে শুকনা মরিচ দিয়ে ভর্তাটা বানানো হয়। আমার এখন রসুনভার্তা দিয়ে ভাত খেতে ইচ্ছা করছে।
যুথী রাত আটটায় প্রচণ্ড জ্বর নিয়ে বাসায় ফিরেছে।
আজহার বাসার সামনের বারান্দায় টুল পেতে উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন, তোকে না। অফিসের গাড়ি নামিয়ে দেবে! রিকশায় করে এসেছিস কেন?
যুথী বলল, অফিসের গাড়ির চাকা পাংচার হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে আমার নিজের চাকরিও পাংচার।
আজহার বললেন, তার মানে কী?
এখন মানে টানে বলতে পারব না; আমার মাথায় পানি ঢালতে হবে, প্ৰচণ্ড জ্বর।
জ্বর হলো কেন?
যুথী বলল, ভাইরাসঘটিত জ্বর না বাবা, চাকরি পাংচার হবার কারণে জ্বর।
সালমা মেয়ের কপালে হাত দিয়ে চমকে উঠলেন। ভীত গলায় বললেন, তোর গা তো পুড়ে যাচ্ছে রে!
যুথী বলল, পুড়ে যাওয়াই ভালো। গা পুড়ে কয়লা হয়ে যাবে। সেই কয়লা দিয়ে আগুন করে তোমরা চা খাবে। এবং গীত গাইবে—
পুড়ল কন্যা উড়ল ছাই
তবেই কন্যার গীত গাই।
আজহার বললেন, জ্বর মেয়ের মাথায় উঠে গেছে। বাথরুমে নিয়ে যাও, ননষ্টপা মাথায় পানি ঢালতে থাকে। মেয়েকে শক্ত করে ধরে। মাথা এলিয়ে পড়ে যাচ্ছে তো। আমি ডাক্তার নিয়ে আসি।
মাথায় পানি ঢালতে ঢালতেই দিনে বাসায় যে নাটক হয়েছে সালমা মেয়েকে জানালেন। যুথী বলল, বড় ধরনের অন্যায় করেছ মা। কতটা সমস্যায় পড়লে একটা মেয়ে সুটকেস হাতে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে উপস্থিত হয় এটা বুঝতে পারছ না?
সালমা বললেন, টুনু কত বড় অন্যায় করেছে এটা বুঝতে পারছিস না? সে বাপের ঘাড়ে বসে খাচ্ছে। আয় নাই, রোজগার নাই, এরমধ্যে গোপনে বিয়েও করেছে।
যুথী বলল, ভাইয়া ভুল করা বা অন্যায় করার মতো মানুষ না। খুব যারা ভালো মানুষ, যেমন আমি, আমরা হলাম গিনি সোনা। গিনি সোনা কী জানো?
গিনি সোনা হলো বাইশ ভাগ সোনা দুভাগ তামা। আর ভাইয়ার পুরোটাই সোনা।
সালমা বললেন, আমি কী?
যুথী বলল, তুমি হলে গিনির উল্টা—নিগি। বাইশ ভাগ তামা আর দুভাগ সোনা।
তোর বাবা কী?
বাবার মধ্যে সোনার কোনো কারবার নেই, উনার সবটাই তামা।
আজহার ডাক্তার নিয়ে এসেছেন। থার্মোমিটারে জ্বর পাওয়া গেল একশ তিন। ডাক্তার প্যারাসিটামল এবং ঘুমের ওষুধ দিল। ভিজিট নিল না। সে এবছরই ইন্টার্নি পাশ করে তাজ ফার্মেসিতে বসা শুরু করেছে। সে ঘোষণা দিয়েছে প্রথম তিনমাস কোনো ভিজিট নেবে না; আজহারের গোপন ইচ্ছা তার সঙ্গে যুথীর বিয়ে হোক। ডাক্তারের চেহারা সুন্দর। সে তার নিজের লাল রঙের একটা গাড়ি চালিয়ে ফার্মেসিতে আসে। ডাক্তারের নামটাও আজহারের পছন্দ। ভারিক্কি নাম-আমিরুল ইসলাম চৌধুরী। পুরুষের তিন শব্দের ভালো নাম আজহারের অত্যন্ত পছন্দ।
যেসব ডাক্তার ভিজিট নেয় না। তারা রোগীর বাড়িতে চা-বিসকিট খায়, কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে। এই ডাক্তার সেরকম না। প্রেসক্রিপশন লিখেই সে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে হকে বলল, আপনার বান্ধবী নীপা আমার খালা হন। দূরসম্পর্কের খালা।
যুথী সঙ্গে সঙ্গে বলল, তাহলে আপনি অবশ্যই আমাকে খালা ডাকবেন।
আজহার বিরক্ত গলায় বললেন, এইসব কী ধরনের কথা? ডাক্তার সাহেব, কিছু মনে করবেন না। জ্বর মাথায় উঠে যাওয়ায় যুথী আবোলতাবোল বকছে।
ডাক্তার বলল, যুথী খালার কথায় আমি কিছুই মনে করছি না।
শুভ্ৰ লাইলিকে নিয়ে গেছে নীপাদের বাড়িতে। ঘটনা শুনে নীপা বলেছে—একটা মেয়ে বিপদে পড়েছে, সে যতদিন ইচ্ছা আমার এখানে থাকবে। দুটা গেস্টরুম খালি পড়ে আছে, কোনো সমস্যা নেই। যুথীর সঙ্গে কথা বলে আমিই সমস্যার সমাধান করে দেব। আপনি এটা নিয়ে আর ভাববেন না। আপনি বাড়িতে চলে যান। গাড়ি দিচ্ছি। গাড়ি আপনাকে নামিয়ে দেবে।
শুভ্ৰ বলল, গাড়ি লাগবে না; আমি হেঁটে হেঁটে যাব। আকাশে মেঘ জমেছে। বৃষ্টি হবে। আমি বৃষ্টিতে ভিজব। অনেকদিন বৃষ্টিতে ভিজি না।
রাত বাজে বারোটা। আজহার এখনো স্টিলের ছাতা হাতে বারান্দায় বসে আছেন। টুনুর প্রতীক্ষা। তার দেখা নেই। সে মনে হয়। ঘটনা আঁচ করতে পেরে পালিয়ে গেছে। যুথী মরার মতো ঘুমাচ্ছে। সালমা মেয়ের পাশে জেগে বসে আছেন। লাইলি মেয়েটা কোথায় আছে। এই নিয়ে হঠাৎ দুশ্চিন্তা শুরু করেছেন। পুরো বিষয়টা ভুলে থাকতে চেষ্টা করছেন। পারছেন না। তাঁর মন বলছে টুনু মেয়েটাকে বিয়ে করে নি। হয়তো ভাব হয়েছে। এই মেয়ের সঙ্গে টুনুর ভাব কীভাবে হলো সেও এক রহস্য।
লাইলি দীর্ঘ সময় নিয়ে গোসল করেছে। নীপার দেওয়া নাইটি পরেছে। পোশাকটা অশ্লীল ধরনের। লাইলির লজ্জা লাগছে, আবার ভালোও লাগছে।
নীপা বলল, এসো ছবি দেখি। বাড়িতে হোম থিয়েটার আছে। হোম থিয়েটারে ছবি দেখতে অন্যরকম মজা। বাবা যখন বাড়িতে থাকেন, তখন আমরা দুজনে মিলে হোম থিয়েটারে ছবি দেখি।
লাইলি বলল, হোম থিয়েটার কী?
হোম থিয়েটার হলো মিনি সিনেমাহল। Sixty two inches, টিভিতে ছবি দেখা। চারদিকে সাউন্ড বক্স দেওয়া। বসার সিটিগুলিও সিনেমা হলের সিটের মতো। একসঙ্গে বিশজন মিলে সিনেমা দেখার ব্যবস্থা। ভয়ের ছবি দেখবে?
দেখক।
সাইনিং ছবিটা দেখেছ? স্ট্যানলি কুব্রিকের?
চমৎকার ছবি। আমি একবার দেখেছি। আরেকবার দেখতে কোনো সমস্যা নাই।
আপনার বাবা কোথায় থাকেন?
উনি জাহাজে জাহাজে থাকেন। আর আমার মা বাবার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর প্রেমে পড়ে তার সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছেন। আমি উনাকে ডাকতাম মজুচাচা। খুব মজা করতেন, এইজন্যে মজুচাচা। মা এখন মজুচাচার সঙ্গে অস্ট্রেলিয়াতে থাকেন। মায়ের একটা ছেলে হয়েছে। ছেলের নাম মা আমাকে রাখতে বলেছিলেন। আমি রেখেছি। তার নাম দিয়েছি বন্ধু! নামটা সুন্দর না?
লাইলি তাকিয়ে আছে। নীপা নামের মেয়েটা কত সহজেই না নিজের কথা বলে যাচ্ছে। সে কি কোনোদিন এভাবে কথা বলতে পারবে? বিশাল যারা বড়লোক তারা মনে হয়। এভাবেই কথা বলে। আর যারা তার মামার মতো অভাবী মানুষ, তাদের কথাগুলিও হয় অভাবী।
শুভ্ৰ সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে সিমেন্টের বেঞ্চে বসে আছে। জায়গাটা অন্ধকার না। স্ট্রীট ল্যাম্পের আলো আছে। বসে থাকতে শুভ্ৰয় খারাপ লাগছে না। কিছুক্ষণ আগে একপশলা বৃষ্টি হয়েছে। শুভ্রর শার্ট ভিজেছে। বাতাসে ভেজা শার্ট থেকে ঠান্ডা গায়ে লাগছে। গা কেঁপে উঠছে। তার কাছে মনে হচ্ছে সে অতিরিক্ত ঠান্ডা কোনো এসি ঘরে বসে আছে। তার বাবার অনেকগুলি অফিসের একটা এরকম ঠান্ডা। চিকেন ফেদার কোম্পানির এমডির অফিস।
চিকেন ফেদার নামটাও শুভ্রর দেওয়া। এবং কাগজেকলমে শুভ্ৰ সেই অফিসের এমডি; যদিও মাত্র দুবার সেই অফিসে গিয়েছে।
শুভ্ৰ হঠাৎ একটু নড়েচড়ে বসল। তার বেঞ্চের এক কোনায় অল্পবয়েসী। একটা মেয়ে এসে বসেছে; বাচ্চা মেয়ে। পনেরো-ষোল বছরের বেশি বয়স হবে। না। মেয়েটা এত রাতে পার্কে কী করছে কে জানে! তবে মেয়েটা বেশ সহজস্বাভাবিক। তার সঙ্গে লাল রঙের ভ্যানিটিব্যােগ। সে ব্যাগ খুলে একটা লিপষ্টিক বের করল। আয়না বের করল। এখন সে আয়োজন করে ঠোঁটে লিপষ্টিক দিচ্ছে। এত রাতে মেয়েটা সাজগোজ শুরু করেছে কেন কে জানে! শুভ্র আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে। এখন সে কপালে একটা লাল রঙের টিপ দিয়ে শুভ্রর দিকে তাকিয়ে বলল, ভাইজান দেখেন তো টিপটা মাঝখানে পড়ছে?
শুভ্ৰ বলল, হ্যাঁ।
মেয়েটা শুভ্রর দিকে পুরোপুরি ফিরে বলল, এই পরথম টিপ মাঝখানে পড়ছে। সবসময় আমার টিপ হয় ডাইনে বেশি যায়, নয় বাঁয়ে বেশি যায়। এর ফলাফল খুব খারাপ। ফলাফল কী জানেন?
না।
ফলাফল সতিনের সংসার।
শুভ্র বলল, এত রাতে তুমি এখানে কী করছ?
মেয়েটা অবাক হয়ে বলল, এত রাইতে এইখানে কী করি আপনে বুঝেন না?
শুভ্র বলল, না। তবে তোমার উচিত বাসায় চলে যাওয়া। ঢাকা শহরে অনেক দুষ্টলোক থাকে। তুমি যদি চাও আমি তোমাকে বাসায় পৌঁছে দিতে পারি।
মেয়েটা বলল, আমার চড়নদার লাগে না। আপনে পার্কে আসছেন কী জন্যে? মেয়েমানুষের সন্ধানে আসেন নাই?
শুভ্ৰ অবাক হয়ে বলল, মেয়েমানুষের সন্ধানে কেন আসব? আমার মা আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছেন। কাজেই আমি পার্কে বসে আছি।
মেয়েটি বলল, আমারও আপনার মতো অবস্থা। আমার বাবা-মাও আমারে বাইর কইরা দিছে। বলছে, রোজগার কইরা খা। আমি রোজগারে বাইর হইছি। এখন বুঝেছেন?
শুভ্র বলল, না। তোমার নাম কী?
ফুলকুমারী।
বাহ, নামটা তো খুব সুন্দর।
ব্যবসার জন্যে এই নাম নিছি। আসল নাম মর্জিনা।
শুভ্ৰ বলল, তোমার কিসের ব্যবসা?
মর্জিনা বলল, কিসের ব্যবসা আপনার না জানলেও চলবে। খাওয়াদাওয়া করেছেন?
দুপুরে খেয়েছি। রাতে কিছু খাই নি।
ক্ষিধা লাগছে?
হ্যাঁ। মানিব্যাগ রেখে এসেছি তো। ক্ষিধে লাগলেও কিছু খেতে পারব না।
চলেন আমার সাথে।
শুভ্ৰ বলল, কোথায় যাব?
মর্জিনা বলল, আপনারে খানা খাওয়াব। খাবেন গরিবি খানা?
খাব।
বাপজান রান্ধে। সে ভালো বাবুর্চি। আগে রিকশা চালাইত। ঠ্যাং কাটা পড়ায় ঘরেই থাকে। আমার জন্যে রান্ধে। তার হাতের পাক খাসির মাংস যদি খান জীবনে ভুলবেন না। আপনার নাম কী?
শুভ্র।
দুজন হাঁটছে। শুভ্র যাচ্ছে মেয়েটার পেছনে পেছনে। তার যে এতটা ক্ষিধে লেগেছে তা সে বুঝতে পারে নি।
মর্জিনা বলল, আপনার সাথে আমি ভাই পাতাইলাম। ঠিক আছে?
শুভ্র বলল, অবশ্যই ঠিক আছে। এবং আমার ধারণা তুমি খুবই ভালো একটা মেয়ে। অচেনা একজনকে ভাত খাওয়ানোর জন্যে নিয়ে যাচ্ছ।
অচেনা হবেন কী জন্যে? আপনার সাথে ভাই পাতাইলাম না? আমার কী ধারণা জানেন, বাসায় গিয়া দেখব বাপজান খাসি পাকাইছে। খাসি আর পোলাও।
এরকম ধারণা হলো কেন?
মর্জিনা বলল, আল্লাপাক মানুষ বুইঝা রিজিক বাটে। আপনেরো খাইতে নিতেছি—এইটাও আল্লাপাকের ইশারা।
তুমি খুব আল্লাহভক্ত মেয়ে?
জি ভাইজান।
তোমার বাসা কোথায়?
প্রায় চইলা আসছি। আমরা পাইপের ভিতর থাকি। তিনটা পাইপ ভাড়া নিছি। একটাত বাপজান থাকে, একটাত আমি, আরেকটা থাকে খালি। তয়। বিছানা পাতা আছে। শীতলপার্টি আছে, কোলবালিশ আছে, হাতপাখা আছে।
শুভ্র বলল, পাইপের বাসা ব্যাপারটা কী?
গেলেই দেখবেন। বড় বড় পাইপের ভিতর সংসার।
মর্জিনার বাবা ইয়াকুব সত্যি সত্যি খাসির মাংস এবং পোলাও রান্না করেছে। মর্জিনা শুভ্রর দিকে তাকিয়ে বলল, ভাইজান, আমার কথা সত্য হইছে?
শুভ্ৰ বলল, হয়েছে। মর্জিনা বলল, আরাম কইরা খান। খায়া পাইপের ভিতর ঘুম দেন। ঝুম বৃষ্টি নামব। দেহেন আসমানের অবস্থা।
খেতে খেতে শুভ্ৰ ইয়াকুবকে বলল, আপনার রান্না অসাধারণ। খাসির মাংসের এই স্বাদ অনেকদিন আমার মুখে লেগে থাকবে। আপনি একটা রেস্টুরেন্ট দেন না কেন?
ইয়াকুব বলল, বাবা, টাকা থাকলে রেস্টুরেন্ট দিতাম। মূল জিনিসই নাই। মূল ছাড়া বিদ্যা কাজে লাগে না। তবে বাবা, একসময় আমার টাকা ছিল। পদ্মার ধারে টিনের ঘর ছিল। দুইটা গাভি ছিল। নৌকা ছিল। ধানী জমি ছিল কুড়ি বিঘা। বসতবাড়িতে আমগাছ ছিল এগারোটা, কাঁঠাল গাছ দশটা, গাব গাছ ছিল তিনটা। জাম্বুরা গাছ নয়টা…
মর্জিনা বলল, বাপজান, গাছের হিসাব বন্ধ করো।
ইয়াকুব বলল, গাছের হিসাব দিতে ভালো লাগে। মনে হয় এখনো সব আছে।
শুভ্র বলল, আপনার ঘরবাড়ি কোথায় গেছে?
পদ্মায় ভাইঙা নিয়া গেছে। তবে এখন খবর পাইছি বিরাট চর জাগছে। যাদের ঘর ভাঙছে, সরকার তারারে চরে জমি দিতেছে। ইচ্ছা করে একবার চেষ্টা নেই। আগের জমির দলিল সবই আমার কাছে আছে।
শুভ্র বলল, চেষ্টা নিতে সমস্যা কী?
মর্জিনা বলল, একটাই সমস্যা। আমরা গরিব। চরের দখল কোনোদিন গরিবে পায় না। এই আলোচনা বাদ। ভাইজান, পান খাইবেন?
শুভ্র বলল, পান আমি খাই না, কিন্তু আজ খাব।
হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি নামল। পান মুখে দিয়ে শুভ্ৰ পাইপের বিছানায় ঘুমুতে গেল। মর্জিনা মাথার কাছে কুপি এবং ম্যাচ রেখে বলল, ভাই পাতাইলে ভাইরে কিছু দিতে হয়। ধরেন ভাইজান, বিশটা টাকা রাখেন।
শুভ্র বলল, থ্যাংক য়্যু।
সে আগ্রহ করে টাকাটা নিল। পাইপের বিছানায় রাতে তার খুব ভালো ঘুম হলো।
সিঁথির কালীচরণ ঘোষ রোড কি
ইনারি নামে নামকরণ হয়েছে।
কালীচরণ ঘোষ৩ (২৩.৬.১৮৯৫ –
এনার নামে কি কালীচরণ ঘোষ রোড সিঁথিতে