মোফাজ্জল করিম সাহেব ফজর ওয়াক্তে ঘুম থেকে উঠেন।
হাত মুখ ধোয়ার আগেই চুল ধরিয়ে ভাতের হাড়ি চাপিয়ে দেন। ওজু করে নামাজ শেষ করতে করতে চাল ফুটে যায়। মাড় গেলে আগুন-গরম ভাতে তিন চামুচ ঘি ঢেলে খাওয়া শুরু করেন। খাওয়া শেষ হতে হতে সূর্য উঠে যায়। তিনি রওনা হয়ে যান স্কুলে। স্কুল তাঁর বাড়ি থেকে আড়াই মাইল। বর্ষাকালে নৌকায় অনেক ঘুরপথে যেতে হয়। দুই থেকে আড়াই ঘণ্টার মত লাগে। স্কুলে পৌঁছতে হয় আটিটার আগে। যারা এবার এস.এস.সি দিচ্ছে তাদের স্পেশাল কোচিং হয়। আটটা থেকে দশটা। তাঁর উপর দায়িত্ব হল অংক এবং ইংরেজীর। আগে শুধু অংক করাতেন। নলিনীবাবু দেখতেন ইংরেজী। নলিনীবাবুর হাঁপানির টান খুব বেড়ে যাওয়ায় কিছুদিন ধরেই আসছেন না। করিম সাহেবের উপর ডাকল দায়িত্ব পড়ে গেছে। খুব চাপ যাচ্ছে। স্কুল থেকে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা। সন্ধ্যায় বাসায় ওসি সাহেবের এক শলা পড়তে আসে। মহা মূৰ্খ। এক মাস টেন্দ পড়াবার পর জিজ্ঞেস করলেন, আমি বাড়ি যাই ইংরেজী কি? সে পাঁচ মিনিট চিন্তা করে বলল I am home going. তিনি প্রচন্ড থাবড়া দিলেন। সে আগের চেয়েও গম্ভীর গলায় বলল, I home going. তাঁর ইচ্ছা করছিল শক্ত আছাড় দেন। একে বলে। পন্ডশ্রম।
আজ করিম সাহেব ঘুম থেকে উঠে দেখেন পুষ্প তার আগেই উঠে বসে আছে। কেরোসিনের চুলায় চাল ফুটছে। তিনি খুশী গলায় বললেন, তুই এত সকাল সকাল উঠলি যে। রাতে ঘুম ভাল হয় নাই?
হয়েছে।
সকালে উঠে ভাল করেছিস মা। সুন্দর করে কয়েকটা পরোটা বানিয়ে ফেল। উনি রাতে না খেয়ে ঘুমিয়েছেন। ক্ষিধে নিয়ে ঘুম ভাঙ্গবে। গোত পরোটা দিবি। আর একটা ডিম ভেজে দিম।
তুমি থাকবে না বাবা?
না। একদিন কামাই হয়ে গেছে। অংক হল প্রাকটিসের ব্যাপার। পরপর দুই দিন কামাই দিলে সব ভুলে যাবে। সব গরু গাধার দল।
একা একা উনার কাছে নাশতা নিয়ে যাব বাবা?
হুঁ।
আমার কেন জানি ভয়-ভয় করে। কি গম্ভীর। কাল রাতে একটা কথাও বললেন না। আমি জানি আজও বলবেন না। নাশতাও খাবেন না। তাছাড়া আমার। পরোটাও ভাল হয় না বাবা।
তুই একটা ভুল করছিস মা। এই সব মানুষ খাওয়া-খাদ্য নিয়ে মোটেই মায়া ঘামায় না। তুই পোলাও-কোৰ্মা দিলে যেভাবে খাবেন, ডাল-ভাত দিলেও একইভাবে খাবেন। কিছুক্ষণ পর তুই যদি জিজ্ঞেস করিস, কি দিয়ে খেলেন? বলতে পারবে না। হা করে তাকিয়ে থাকবে।
পুষ্প হেসে ফেলল।
করিম সাহেব বললেন, হাসছিস কেন?
তুমি যেভাবে কথা বলছ তাতে মনে হয়–এই রকম মানুষ তুমি কত দেখেছ! আসলে এই প্রথম দেখছ।
দেখতে হয় না মা। আন্দাজ করা যায়।
ভদ্রলোককে তোমার কি খুব পছন্দ হয়েছে?
পছন্দ হবে না, কি বলিস তুই? নিজে যা ভাল মনে করেন তাই করেন। কাল রাতের কথা চিন্তা কর–অন্য কেউ হলে কি করত? শরীর যত খারাপই হোক দুমুঠ ভাত খেত। আমাদের খুশী করার জন্য করত। উনি তা করলেন না। কে খুশী হল কে হল না তা নিয়ে মাথাব্যথা নেই।
পুষ্প হাসতে হাসতে বলল, উনি যদি খারাপ কিছু করেন, তুমি তারও একটা ভাল ব্যাখ্যা বের করবে।
তাতো করবই। কারণ খারাপ কিছু করার ক্ষমতাই এঁদের নেই। সৃষ্টিশীল মানুষ হচ্ছে ঈশ্বরের মত। ঈশ্বর যেমন মন্দ কিছু করতে পারে না, এঁরাও পাবেন না।
উনাকে দেবতা ডাকলে কেমন হয় বাবা?
ডাকতে পারিস কোন অসুবিধা নেই, তবে মনে মনে ডাকাই ভাল। রেগে যেতে পারেন। এই জাতীয় মানুষদের রাগ বেশী থাকে।
বাবা নামাজ শেষ করে আস। তোমার ভাত হয়ে গেছে। শুকনো মরিচ ভেজে দেব?
দে।
ভাত খেতে খেতে তিনি পুষ্পকে একগাদা উপদেশ দিয়ে গেলেন। বার বার খোঁজ নিয়ে আসবি উনার ঘুম ভাঙ্গল কি না। ঘুম ভাঙ্গতেই চা দিবি, তারপর বলবি আমার কথা।
তোমার কথা কি বলব?
ঐ যে স্কুলে গেলাম, সন্ধ্যার পর ফিরব। উনি দুপুরে কি খেতে চান জিজ্ঞেস করবি। মতির মার খোঁজ নিবি। আমি জেলে পাড়ায় বলে যাব ওরা মাছ দিয়ে যাবে।
বাবা উনি যদি বলেন, তোমাদের এখানে খাব না। বাবুর্চির ব্যবস্থা করতে বলেছিলাম–সেই ব্যবস্থা করে দাও।
তাহলে বলবি, বাবা এসে ব্যবস্থা করবেন। বুঝিয়ে-সুঝিয়ে শান্ত করবি।
বুঝিয়ে-সুঝিয়ে কি ভাবে শান্ত করব? উনিতো ছেলেমানুষ না।
এই ধরনের মানুষের স্বভাব-চরিত্রে ছেলেমানুষ থাকে।
কোত্থেকে যে তুমি এইসব ধারণা পেয়েছ কে জানে।
উনি তো ঘরে আছেনই। আমার কথা অক্ষরে অক্ষরে মিলিয়ে নে।
আচ্ছা মিলিয়ে নেব।
আর শোন মা, উনি যদি ঘুরতে-টুরতে যেতে চান। নিয়ে যাবি।
কাদার মধ্যে কোথায় ঘুরবেন?
কাদা পানি এই সব নিয়ে এঁদের কোন মাথা ব্যথা নেই। আমরা সাধারণ মানুষরা এইসব নিয়ে মাথা ঘামাই। এই বুঝি পায়ে কাদা লেগে গেল, এই বুঝি হাত নোংরা হল। যাদের মন পরিষ্কার তারা শরীরের নোংরা নিয়ে মাথা ঘামান না। মন যাদের নোংরা, শরীর পরিষ্কারের জন্যে তাদের চেষ্টার শেষ নাই।
আমি তো এই দলে পড়ে যাচ্ছি বাবা। নোংরা আমি সহ্য করতে পারি না। আমার মন কি নোংরা?
করিম সাহেব থমত খেয়ে গেলেন। হাত ধুতে ধুতে বললেন, এইটা একটা কথার কথা বললাম। আমি রওনা হয়ে যাচ্ছিগো মা। মতির মাকে খবর দিতে ভুলবিনা।
পিরিচ দিয়ে ঢাকা চায়ের কাপ হাতে দরজার ওপাশে পুষ্প বেশ কিছুক্ষণ হল দাড়িয়ে আছে। কেন জানি তার অসম্ভব ভয় করছে। সে প্রায় অস্পষ্ট গলায় বলল, আপনার চা। ভেতরে আসব?
শওকত সাহেব কিছু বললেন না। নিজে উঠে দরজা খুলে দিলেন। পুষ্প ঢুকল। তিনি বললেন, কেমন আছ পুষ্প? তাঁর গলার স্বর এত আন্তরিক যে পুষ্প হকচকিয়ে গেল। শওকত সাহেব চায়ের কাপ হাতে নিতে নিতে বললেন, কাল রাতে আমি তোমাকে একটা ভুল কথা বলেছিলাম। আমি বলেছিলাম ধুতুরা ফুল বিষাক্ত। এটা ভুল। ধুতুরা ফুল বিষাক্ত না। শাদা এবং নীল মেশানো ফুল। খুব সুন্দর। ধুতরার ফল বিষাক্ত। ফুল নয়।
পুষ্প নীচু গলায় বলল, আমি জানি।
জান তাহলে রাতে বললে না কেন?
পুষ্প আগের চেয়েও মৃদু গলায় বলল, বলেছি। মনে মনে বলেছি।
মনে মনে বলেছ মানে?
পুষ্প মুখ নীচু করে বলল, কেউ যখন ভুল কথা বলে তখন আমি মনে মনে বলি, কথাটা ভুল। মুখে কিছু বলি না।
কাউকেই বল না?
খুব যারা প্রিয় তাদের বলি।
এরকম খুব প্রিয় মানুষ তোমার কজন আছে?
পুষ্প জবাব দিল না। তিনি আবার বললেন, প্রশ্নটার জবাব দাও। মনে মনে বলতে হয় না সরাসরি বলা যায় এমন প্রিয় মানুষ তোমার কজন আছে?
নেই।
তোমার বাবা। তিনিতে আছেন।
পুষ্প চুপ করে রইল। তিনি শান্ত গলায় বললেন, বাবা কি তোমার খুব প্রিয় নন?
হ্যাঁ প্রিয়, খুবই প্রিয়।
তবু ঠিক সে রকম প্রিয় নয়? তাই-কি?
স্যার আমি আপনার জন্যে নাশতা নিয়ে আসি। রাতে খান নি, আপনার নিশ্চয়ই খুব ক্ষিধে পেয়েছে।
এত ব্যস্ত হবার কিছু নেই। তুমি বসতো। তোমার সঙ্গে খানিকক্ষণ গল্প করি। দাঁড়িয়ে আছ কেন? বস। আরাম করে বস।
পুষ্প তবু দাঁড়িয়েই রইল। সে এখনো চোখ তুলে তাকাচ্ছে না। তিনি মেয়েটাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছেন। এমন কিছু কি তিনি করেছেন যাতে সে এতটা। ভয় পেয়েছে। তিনি আবারো বললেন–পুষ্প বস।
পুষ্প বসল।
তার বসা দেখে তিনি চমকে উঠলেন। স্বপ্নে পুষ্প ঠিক এই ভাবেই বসেছিল। এমন ভঙ্গিতেই মুখ ফিরিয়ে রেখেছিল।
মেয়েটার ভয় ভাসিয়ে দেয়া দরকার। মজার কিছু কথা বলে তাকে জানিয়ে দেয়া দরকার যে তিনি ভয়াবহ কোন মানুষ না। এই মেয়ে একবারও হাসে নি। হাসলে তাকে কেমন দেখায়?
পুষ্প।
জি।
গত রাতে তোমাদের বাড়ির বারান্দায় বসে একটা ব্যাপার নিয়ে ভাবছিলাম। ব্যাপারটা তোমাকে বুলি। গত রাতে বারান্দায় বসে বসে আমি কত বিচিত্ৰ শব্দ শুনলাম কিন্তু ব্যাঙ ডাকতে শুনলাম না। খুবই অবাক হলাম। তারপর ভেবে ভেবে এর একটা কারণও বের করলাম। কারণটা সত্যি কি না তুমি বলতো। দেখি তোমার কেমন বুদ্ধি।
পুষ্প খুব আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে। মেয়েটাকে আজ এত সুন্দর লাগছে। কেন? অসহ্য সুন্দর। এক রাতে সে নিশ্চয়ই বদলে যায় নি। তাহলে কি তাঁর দেখার চোখ বদলে গেছে। স্বপ্নটার কারণে এটা হচ্ছে তো?
তিনি পুষ্পের চোখে চোখ রেখে বললেন, কাল পূর্ণিমা ছিল বলে আমার ধারণা। ফকা ফকা জোৎস্না। ব্যাঙ ডাকে ডাঙ্গায় উঠে। চাদের আলোর তাদের দেখা যায়। ব্যাঙগুলি ডাকছিল না, কারণ তারা ভাবছিল ডাকলেই, শব্দ শুনে শেয়ালের পাল এসে উপস্থিত হবে। চাঁদের আলোয় তারা বুঝে ফেলবে কোথায় ব্যাঙরা আছে। শেয়াল এসে এদের কপাকপ খাবে। এই ভয়ে ব্যাঙের দল চুপ করে ছিল। তোমার কি ধারণা আমার যুক্তি ঠিক আছে?
পুষ্প কথা বলল না। তাকিয়ে রইল।
তিনি বললেন, আমার যুক্তি ঠিক নেই?
মনে হয় ঠিক।
মোটেই ঠিক নেই। আমি তোমাকে ভুল যুক্তি দিয়েছি শিয়াল দেখে ব্যাঙ ভয় পাবে কেন? লাফ দিয়ে পানিতে নেমে যাবে।
পুষ্প বলল, তাহলে তারা ডাকছিল না কেন?
আকাশে মেঘ হলে কিংবা মেঘ হবার সম্ভাবনা থাকলেই ব্যাঙ ডাকে। চাদের আলো থাকা মানে–মেঘ নেই। কাজেই ওরা চুপ করে ছিল। বুঝতে পারছ?
জি পারছি।
পুষ্প এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সে খুব অবাক হয়েছে।
তিনি বললেন, তোমার বাবা কোথায়?
উনি স্কুলে গেছেন। সন্ধ্যার পর ফিরবেন।
আচ্ছা পুষ্প তোমাদের এই জায়গায় দেখার মত কি আছে?
কিছুই নেই।
একেবারে কিছু নেই তা কি হয়। কিছু নিশ্চয়ই আছে।
নদীর ঐ পাড়ে পুরানো মঠ আছে।
মই কি জিনিস?
আমি নিজেও জানি না–বজলুর রহমান চাচা দেখে এসে বলেছিলেন–এই জিনিস পৃথিবীর অন্য কোন দেশে থাকলে তারা এটাকে পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য বানিয়ে ফেলত। জিনিসটা বাংলাদেশের মত গরীব দেশে আছে বলে কেউ খবরও রাখে না।
মেয়েটার ভয় সম্ভবত কেটে গেছে সহজ ভাবেই কথা বলছে।
শওকত সাহেব বললেন, বজলুর রহমানের কথার উপর কোন রকম গুরুত্ব দেয়া ঠিক না পুষ্প।
পুষ্প বলল, তা আমি জানি। কিন্তু উনি এত ভাল মানুষ যে কথা শুনলেই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে।
ভালমানুষ কি করে বুঝলে?
পুষ্প জবাব দিল না। কিন্তু তার মুখে এই প্রথম হাসি দেখা গেল। মেয়েটা খুব সুন্দর করে হাসে।
শোন পুষ্প, উনি ভাল মানুষ কি-না তা কিন্তু তুমি জান না। উনার আচার ব্যবহার কাণ্ডকারখানা তোমার পছন্দ হয়েছে–তাই তাকে ভাল মানুষ ভাবছ।
উনি কি ভাল মানুষ না?
খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে শওকত সাহেব বললেন, যে সব সৎগুণ থাকলে আমরা মানুষকে ভাল মানুষ বলি তা তার নেই। তবে তার চরিত্রে কিছু মজার ব্যাপার আছে। যে কারণে আমিও তাকে পছন্দ করি। তাঁর বিস্মিত এবং মুগ্ধ হবার ক্ষমতা অসাধারণ। এইটিই তাঁর একমাত্র গুণ।
পুষ্প উঠে দাঁড়াল।
আপনার নাশতা নিয়ে আসি।
এক মিনিট দাঁড়াও। আমার ধারণা তুমি মনে মনে বলেছ–আপনার কথাটা ভুল তাই না?
জ্বি–আমি বলেছি।
আচ্ছা যাও নাশতা নিয়ে আস।
পুষ্প থেমে থেমে বলল, আমি কি আপনার সঙ্গে যাব? মঠ দেখানোর জন্যে?
না। কাউকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে আমার ভাল লাগে না।
আপনিতো জানেন না কোথায়।
খুঁজে বের করে নেব। তাছাড়া মঠ দেখতেই হবে এমন কোন কথা নেই। আমি কিছু দেখার জন্যে আসিনি। যাও নাশতা নিয়ে এসো।
নাশতা খেয়ে তিনি খাতা খুলে বসলেন। বেরুতে ইচ্ছা করছে না। জানালার পাশেই টেবিল। দৃষ্টি বাইরে চলে যাচ্ছে। কি সুন্দর আকাশ। আকাশে আবার মেঘ জমতে শুরু করেছে। বর্ষা দেখার জন্যে আসলে গ্রামেই আসা উচিত। জানালার পাশে, বিরাট একটা আতা গাছ। তিনি গাছগাছালি বিশেষ চেনেন না। কিন্তু আতা গাছ চেনেন। ছেলেবেলায় যে বাড়িতে ছিলেন, সে বাড়িতে দুটি আতা গাছ ছিল।
তিনি অনেকক্ষণ আতা গাছের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ছেলেবেলার বন্ধুকে যেন অনেকদিন পর দেখলেন। আতা গাছের ডালে কাকের বাসা। সেই বাসায় কাকের ছানা দেখা যাচ্ছে। তাতো হওয়ার কথা না। আষাঢ় মাস ঝড় বৃষ্টির মাস। পাখিদের এই সময় বাচ্চা ফুটানোর কথা না। প্রকৃতি এই ভুল করবে না। তিনি কি চোখে ভূল দেখছেন?
কে বলেছিল কথাটা–কোন লেখকের লেখার টেবিল জানালার পাশে থাকা। উচিত না। জানালার পাশে টেবিল থাকলে তারা কখনো লিখতে পারেন না।
আসলেই বোধ হয় তাই। লেখকের লেখা উচিত চার দেয়ালের ভেতরে আবদ্ধ থেকে। তখনি তারা মনের জানালা খুলে দিতে পারেন।
তিনি প্রথম লাইনটি লিখলেন।
তিনি তাঁর পাণ্ডুলিপি অসংখ্যবার কাটবেন–কিন্তু প্রথম লাইনটি বদলাবেন না।
প্রথম লাইনটি হচ্ছে–পাখি হিসেবে কাক বেশ অদ্ভুত।
লাইনটি তার পছন্দ হচ্ছে না। পছন্দ না হলেও উপায় নেই। এই পাণ্ডুলিপির প্রথম লাইনটি–গ্রহণ করা ছাড়া গতি নেই।
কি লিখবেন সব ঠিক করা আছে। ঘটনা সাজানো আছে। এই লেখায় কি বলতে চান তাও তিনি জানেন। দিনের পর দিন এই লেখাটি নিয়ে তিনি ভেবেছেন। চরিত্রগুলি এখন আর চরিত্র নেই–রক্ত মাংসের জীবন্ত মানুষ। বলতে গেলে গত ছমাসে এই চরিত্রগুলির কারো না কারো সঙ্গে তাঁর রোজই দেখা হয়েছে।
শুরুতে লেখার গতি মন্থর ছিল, কিছুক্ষণের ভেতর গতি বেড়ে গেল। অতি দ্রুত কলম চলতে লাগল। এক বৈঠকে যে করেই হোক পঁচিশ পৃষ্ঠার মত লিখে ফেলতে হবে। চরিত্রগুলিকে বেঁধে ফেলতে হবে। যেন এরা কিছুতেই বেরিয়ে। যেতে না পারে।
বিকেল পাঁচটায় লেখার টেবিল থেকে উঠলেন। বৃষ্টি এখনো নামেনি। আকাশ অন্ধকার হয়ে আছে। তিনি অত্যন্ত ক্ষুধার্ত এবং ক্লান্ত বোধ করছেন। দুপুরে কিছু খান নি।
পুষ্প ঠিক দুটার সময় খাবার নিয়ে এসেছিল। তিনি রূঢ় গলায় বলেছেন, আমি লিখতে বসেছি। খবর্দার আমাকে বিরক্ত করবে না।
পুষ্প কঁদো কঁদো গলায় বলল, আপনি দুপুরে খাবেন না?
লেখার টেবিল ছেড়ে উঠলেই খাব। তোমাকে আসতে হবে না। আমি তোমাকে ডেকে আনব। কিন্তু তুমি আর আসবে না। লেখার সময় বিরক্ত করলে
আমি খুব রাগ করি।
পুষ্প আর বিরক্ত করেনি। কিন্তু বেশ কয়েকবার এসে উকি দিয়ে গিয়েছে। একজনকে অভুক্ত রেখে সে নিজেও খাবার নিয়ে বসতে পারে নি।
শওকত সাহেব লেখা কাগজগুলি সুটকেসে ঢুকিয়ে ফেললেন। তিনি এখন হাঁটতে বের হবেন। বৃষ্টির পানি এসে লেখাগুলি আবার নষ্ট না হয়।
এই অবেলায় ভাত খেতে বসার কোন মানে হয় না। রে চার পাঁচটা টিনের কৌটা দিয়ে দিয়েছে। একটায় পনির, দুটা কোটায় বিস্কিট, একটিতে কাজু বাদাম। রাত জেগে লেখার সময় তাঁর ক্ষিধে পায়। ক্ষিধের রসদ। পনিরগুলি টুকরো করে কাটা। দু স্লাইস পনির এবং কয়েকটা কাজু বাদাম মুখে দেয়া মাত্র ক্ষিধে কমে গেল। তিনি ঘর থেকে বের হয়ে এলেন। তার মিনিট দশেকের ভেতর আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামল। শোঁ শোঁ শব্দে বাতাস বইতে লাগল। পুষ্প ছুটে গেল দোতলায়। ঘর তালাবন্ধ। মানুষটা গেল কোথায়? সত্যি সত্যি ঝড় হচ্ছে।
আষাঢ় মাসে এমন ঝড় কি হওয়ার কথা?
কাল বৈশাখী হবে বৈশাখে। আশ্বিন মাসে আশ্বিনা ঝড়। আষাঢ় মাসে প্রবল বৃষ্টিপাত ছাড়াতো কিছু হবার কথা না। শওকত সাহেব খানিকটা দিশাহারা হলেন। ঝড়ের প্রথম ঝাপ্টার সময় তিনি একটা পুকুর পাড়ে। আশে-পাশে কোন জনমানব নেই। খুঁটিতে বাধা একটা গুরু তারস্বরে চিৎকার করছে। পুকুরপাড়ে পাকা কালি মন্দির। সেই মন্দিরের দরজা তালাবন্ধ। উত্তর দিকে ধান ক্ষেত। কি ধান এগুলি? আউস ধান নিশ্চয়। মন্দিরের পাশ দিয়ে কাঁচা রাস্তা গিয়েছে নদীর দিকে। ঝড়ের সময় রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা কি ঠিক হবে? মাথার উপর গাছের ডাল ভেঙ্গে পড়তে পারে। খোলা মাঠে থাকাইতো সবচে ভাল। আউসের ক্ষেতে নেমে পড়বেন?
বৃষ্টি নেমেছে মুষল ধারে। বৃষ্টির পানি কন কনে ঠাণ্ডা। সূচের মত গায়ে বিধছে। তিনি ভিজে পুরোপুরি জবজবে হয়ে গেছেন। চশমার কাচ বৃষ্টির পানিতে অস্পষ্ট হয়ে আছে। এখন চশমা থাকা না থাকার মধ্যে কোন বেশ কম নেই। তিনি চশমা খুলে হাতে নিয়ে নিয়েছেন। এখন একজন অন্ধের সঙ্গে তাঁর কোন তফাৎ নেই।
ঝড়ের আরেকটা প্রবল ঝাপ্টা এল। বাতাসের কি প্রচণ্ড শক্তি। তাঁকে প্রায় উড়িয়ে নিয়ে যায়। হুই হুই হুই…
তিনি এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন। কেউ কি ডাকছে তাকে? শিষ দেয়ার মত তীক্ষ্ণ শব্দ হচ্ছে বাতাসের। এই শব্দ ছাপিয়ে মানুষের গলা ভেসে আসার কথা না। হুই হুই, ভদ্ৰলোক! হুই।
হ্যাঁ তাকেই ডাকছে। গামছা পরা একজন কে এগিয়ে আসছে। অতি দ্রুত আসছে।
আপনে কোন দেশী বেকুব? ঝড়ের সময় নাইরকেল গাছের নীচে?
তাইতো? তিনি এতক্ষণ কয়েকটা নারিকেল গাছের নীচেই দাড়িয়ে আছেন। তিনি সরে এলেন। বেশীদূর সরতে পারলেন না–বাতাস তাকে ধানক্ষেতে নিয়ে ফেলল। হাতের মুঠিতে ধরা চশমা মট করে ভেঙ্গে গেল। হাত জ্বলা করছে। কেটেছে নিশ্চয়ই। কতটা কেটেছে কে জানে?
নারকেল গাছের নীচ থেকে যে তাকে সরতে বলল, দেখা গেল সেই খুটিতে বাধা গরুটির মালিক। গরু ছেড়ে দিয়ে সেও পলকের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। শওকত সাহেব কাদা পানিতে মাখা হয়ে বৃষ্টি এবং ঝড় কমার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলেন। ঝড় পুরোপুরি থামার জন্যে তাঁকে আধঘন্টার মত অপেক্ষা করতে হল। এই আধঘন্টায় ময়নাতলা গ্রামের উপর ছোটখাট তাণ্ডব ঘটে গেল। বেশ কিছু কাচা বাড়ি ধ্বসে গেল। কয়েকটা বাড়ির টিনের চাল উড়ে গেল। ময়নাতলা হাই স্কুলের প্রাইমারী সেকশানের কোন চিহ্নই রইল না।
শওকত সাহেব বাড়ির দিকে রওনা হয়েছেন। চশমা নেই বলে কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না। চশমা থাকলেও খুব যে লাভ হত তা না। ঘন অন্ধকার। আকাশ এখনো মেঘে মেঘে ঢাকা। ঘন ঘন বিজলি চমকাচ্ছে। যে ব্যাঙের ডাক শোনা যাচ্ছে না বলে অনেক গবেষণা করেছেন–সেই ব্যাঙের ডাক এখন চারদিক থেকেই শোনা যাচ্ছে। সেই ডাকের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ঝিঝির ডাক।
হারিকেন হাতে কে যেন আসছে। শওকত সাহেব অপেক্ষা করতে লাগলেন। লোকটি কাছে এসে অবাক হয়ে বলল, আপনে কে?
আমার নাম শওকত।
কোন বাড়ির?
মোফাজ্জল করিম সাহেবের বাড়িতে থাকি।
আপনেতে যাইতেছেন উল্টা পথে। এই পথ গেছে সোহাগী নদীর ঘাটলায়।
কি নদী বললেন?
সোহাগী।
নদীর নাম ছোট গাঙ না?
আমরা মুখের কথায় বলি ছোট গাঙ। ভাল নাম সোহাগী।
শুনে খুশী হলাম। আপনি কি আমাকে মোফাজ্জল করিম সাহেবের বাড়িতে নিয়ে যাবেন? চশমা ভেঙ্গে যাওয়ায় কিছুই দেখছি না।
দেখনের কিছু নাই। আপনে ডাইনের রাস্তা ধইরা নাক বরাবর যান।
শওকত সাহেব নাক বরাবর রওনা হলেন। জোনাকী পোকাগুলি আজ নেই। থাকলে খানিকটা আলো কি আর ওদের কাছ থেকে পাওয়া যেত না? ঝড় সম্ভবত বেচারীদের উড়িয়ে নিয়ে গেছে।
পুষ্প কখন থেকে হারিকেন হাতে বারান্দায় দাড়িয়ে আছে। ভয়ে তার আত্মা শুকিয়ে গেছে। এত বড় একটা ঝড় সে খালি বাড়িতে পার করেছে। বিকট শব্দে আতা গাছের একটা ডাল ভেঙ্গেছে। সে ভেবেছিল পুরো বাড়িটাই বুঝি ভেঙ্গে পড়ে গেছে। তার চেয়েও বড় ভয় এই ঝড়ে বিদেশী মানুষটা কোথায় ঘুরছে। কোন বিপদ-আপদ হয়নি তো? বাবাই বা কোথায়? নৌকায় থাকলে নিৰ্ঘাৎ নৌকা ডুবে গেছে।
পুষ্পের গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছা করছে। তাদের বাড়ি গ্রামের এক প্রান্তে। আশে-পাশে কোন বাড়ি-ঘর নেই যে সে ছুটে গিয়ে বলবে–আমার বড় বিপদ। আমাকে একটু সাহায্য করুন।
শওকত সাহেব নিঃশব্দে উপস্থিত হলেন। পুষ্প হারিকেন উচিয়ে ধরল। তিনি লজ্জিত ও বিব্রত গলায় বললেন, ঝড়ের মধ্যে পড়ে গিয়েছিলাম। চশমা টশমা ভেঙ্গে একাকার করেছি।
পুষ্প কিছুই বলল না।
চিনতে পারছ তো আমাকে? কাদা মেখে ভূত হয়ে আছি। তোমাদের বাড়িতে ডেটল জাতীয় কিছু আছে? হাত কেটে ফেলেছি।
পুষ্প হারিকেন উচু করে ধরেই আছে। কিছু বলছে না। মনে হচ্ছে সে একটা ঘোরের মধ্যে আছে।
তুমি বোধ হয় খুব দুঃশ্চিন্তা করছিলে। এমন ঝড় শুরু হবে কল্পনাও করিনি। তবে মজার ব্যাপার কি জান-–I enjoyed it. শুধু তাই না–I enjoyed it thoroughly. করিম সাহেব কোথায়? উনি ফেরেননি?
না।
তুমি পুরো ঝড়ের সময়টা একা ছিলে?
জি। আপনি কুয়াতলায় আসুন। কাদা ধুয়ে তুলুন। আমি সাবান এনে দিচ্ছি। হাত কতটা কেটেছে?
বেশী না।
দেখি।
তিনি হাত মেলে ধরলেন। অনেকখানিই কেটেছে। রক্তে মাখামাখি হয়ে আছে।
কূয়াতলা কোন দিকে? আমি এখন প্রায় কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। হারিকেনটা ভালমত ধর।
পুষ্প বলল, চশমা ছাড়া এখন আপনার চলবে কি করে?
স্যুটকেসে আমার আরেকটা চশমা আছে।
শওকত সাহেব মাথায় প্রায় তিন বালতি পানি ঢেলে ফেললেন। পুষ্প বলল, আর পানি দেবেন না ঠাণ্ডা বাধিয়ে বসবেন।
তিনি হাসিমুখে বললেন, পানিটা গরম, গায়ে ঢালতে খুব আরাম লাগছে। বৃষ্টির পানি কি যে ঠাণ্ডা ছিল কল্পনাও করতে পারবে না। মনে হচ্ছিল শীতে জমে যাচ্ছি। শোন পুষ্প, তোমাকে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না–তুমি খুব কড়া করে এক কাপ চা বানাও।
পুষ্প নড়ল না। সে তোয়ালে হাতে দাঁড়িয়ে আছে। পুষ্প আবার বলল, আর পানি ঢালবেন না। আপনি নিৰ্ঘাৎ অসুখ বাধাবেন।
আমার কিছু হবে না। আমি হচ্ছি ওয়াটার। যখন ক্লাশ টেনে পড়ি তখন একবার বন্ধুদের সঙ্গে বাজি ধরে পৌষ মাসের শীতে পুকুরের পানিতে সারারাত গলা ডুবিয়ে বসেছিলাম। যদি অসুখ না বাধাই তাহলে একশ টাকা পাব। এই ছিল বাজী। বাজীতে জিতে একশ টাকা পেলাম এবং ওয়াটার গ্রুপ টাইটেল পেলাম। এদিকে আমার বন্ধুরা যারা সারারাত পুকুর পাড়ে বসেছিল তাদের প্রত্যেকের ঠাণ্ডা লেগে গেল। একজনতো নিউমোনিয়ায় মর মর হল।
যে পুষ্প এতক্ষণ গম্ভীর হয়েছিল সে খিল খিল করে হেসে উঠল।
তিনি বললেন, তুমি দেখি হাসতেও পার। আমি ভেবেছিলাম তুমি হাসতে পার না।
পুষ্প বলল, আপনি কি সত্যিই ওয়াটার প্রফ টাইটেল পেয়েছিলেন? সত্যি পেয়েছিলাম। একটা রাবার স্ট্যাম্প বানিয়ে ছিলাম যেখানে লেখা–
Md. Shawkat
W. P.
- P. মানে ওয়াটার প্রুফ। বুঝলে পুষ্প, কেন জানি খুব আনন্দ লাগছে। কারণটা ধরতে পারছি না।
পুষ্প বলল, আমি বলব কারণটা কি?
বল তোত।
ঝড়ের সময় আপনি খুব ভয় পেয়েছিলেন। ভেবেছিলেন মারা যাচ্ছেন। যখন দেখলেন মারা যাননি এবং ঝড় শেষ হয়েছে তখন আনন্দে মন ভরে গেল।
যুক্তিতে তুমি ভালই দিয়েছ। ভেরি গুড়। আই লাইক ইট। তোমার বুদ্ধি তে ভালই।
আপনি কি ধরেই নিয়েছিলেন বুদ্ধি খারাপ হবে?
খারাপ হবে ধরিনি। এভারেজ বুদ্ধি ধরেছিলাম। ভালও না। খারাপও না।
আপনি কি নিজেকে খুব বুদ্ধিমান মনে করেন।
হ্যাঁ করি। তুমি কর না?
হ্যাঁ আমিও করি।
ওয়াটার প্রুফ টাইটেল রাখা তাঁর সম্ভব হল না। গোসল শেষ করে গা মুছতে গিয়ে মনে হল জ্বর আসছে। হাত-পা কেমন জানি করছে। মাথা ভারভার হয়ে গেছে। পুরোপুরি নিশ্চিত হবার জন্যে নিজের ঘরে ঢুকে সিগারেট ধরালেন। সিগারেট বিস্বাদ লাগল। তিনি বিছানায় শুয়ে পড়লেন। গায়ে চাদর টেনে দিলেন। চাদরে শীত মানছে না। পুষ্পকে বলতে হবে কল-টম্বল দিয়ে যেতে।
কম্বলের কথা মনে আসতেই–দুলাইনের কবিতাও মনে এসে গেল।
ভঞ্জের পিসি তাই সন্তোষ পান
কুঞ্জকে করেছেন কম্বল দান।
এখন এই কবিতা মাথার ভেতর ক্ৰমাগত ঘুরপাক খেতে থাকবে। কিছুতেই মাথা থেকে তাড়ানো যাবে না।
ভঞ্জের পিসি তাই সন্তোষ পান
কুঞ্জকে করেছেন কম্বল দান।
স্বাতীকে এই কবিতা তিনি শুনাতেন। অতি দ্রুত আবৃতি করতেন। স্বাতী কিছু না বুঝেই হাত তালি দিত এবং খিলখিল করে হাসত। হামাগুড়ি দিয়ে তার কাছে এগিয়ে আসত। একবার স্বাতী খাটে বসে আছে–তিনি ঘরে ঢুকে দ্রুত কবিতা পড়লেন। স্বাতী হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে আসতে গিয়ে খাটি থেকে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেল।
রেনু ছুটে এসে মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে–চিৎকার করে উঠল–কি হয়েছে? আমার মেয়ের কি হয়েছে?
রেনুর সেই হাহাকার এখনো বুকে বিধে আছে। কবিতার সঙ্গে সঙ্গে সেই হাহাকারও মনে আসে।
ভঞ্জের পিসি তাই সন্তোষ পান
কুঞ্জকে করেছেন কম্বল দান।
একি যন্ত্রণা! লাইন দুটি আরো গভীরভাবে মাথায় বসে যাচ্ছে। এক সময় মাথা থেকে ছড়িয়ে পড়বে শরীরে। শরীরের রক্ত কণিকাগুলিও তাল মিলিয়ে আবৃত্তি করতে থাকবে।
পুষ্প চা নিয়ে ঢুকেছে।
তিনি পুষ্পের দিকে তাকালেন। পুষ্প চায়ের কাপ টেবিলে রেখে তার দিকে এগিয়ে আসছে। মেয়েটি কি এখনো তাকে ভয় পায়? হা নিশ্চয়ই পায়। সহজ স্বাভাবিক সম্পর্ক এখন আর তাঁর কারো সূঙ্গেই নেই। By pains men come to greater pains. বড় হবার জন্যে মানুষকে নানা ধরনের কষ্ট করতে হয়। তারপর দেখা যায় তার জন্যে আরো বড় কষ্ট অপেক্ষা করছে।
পুষ্প তুমি আমাকে একটা কম্বল দিতে পার?
পুষ্প হানা কিছুই বলল না। খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে তাঁর কপালে হাত রাখল। না–মেয়েটা তাকে খুব বেশী ভয় এখন পায় না। ভয় পেলে এত সহজে কপালে হাত রাখতে পারত না।
পুষ্প।
জ্বি।
কবিতা শুনবে?
পুষ্প চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল। কিছুই বলল না।
তিনি নীচু গলায় বললেন–
ভঞ্জের পিসি তাই সন্তোষ পান
কুঞ্জকে করেছেন কম্বল দান।
পুষ্প কপাল থেকে হাত সরিয়ে, আবার কপালে অন্য হাত রাখল। গা মনে হল পুড়ে যাচ্ছে। সে কি করবে বুঝতে পারছে না। বাবা এখনো ফিরেনি–ময়নাতলা স্কুলের দপ্তরি ইউনুসকে দিয়ে চিঠি লিখে পাঠিয়েছেন–আমার ফিরিতে কিঞ্চিৎ বিলম্ব হইবে। ঝড়ে স্কুলগৃহের বিপুল ক্ষতি হইয়াছে। হেড মাস্টার সাহেবের অফিসকক্ষের কাগজপত্র বিনষ্ট হইয়াছে। একটা ব্যবস্থা না করিয়া আসিতে পারিতেছি না। এদিকে হেডমাস্টার সাহেব প্ৰাতঃকালে নেত্রকোনা গিয়াছেন, এখনো ফিরেন নাই।
শওকত সাহেব চোখ খুলে আবার বন্ধ করে ফেললেন। আলো চোখে লাগছে।
পুষ্প।
জি।
কুঞ্জ কে জান?
জি-না।
জীর্ণ দেউল এক, এক কোণে তারি;
অন্ধ নিয়াছে বাসা কুঞ্জ বিহারী।
আমি আপনার জন্যে একটা লেপ নিয়ে আসি।
বাতি নিভিয়ে দিয়ে যাও পুষ্প। বাতি চোখে লাগছে। আমার মনে হয় তুমি আমার কবিতা শুনে ভয় পাচ্ছি। ভাবছ আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। সে রকম কিছু হয়নি। জ্বর আসার মুহূর্তে কি করে জানি এই কবিতাটা মাথার ভেতর ঢুকে গেছে–কিছুতেই তাড়াতে পারছি না। তোমার এ রকম হয় না?
হয়।
পুষ্প নিচে নেমে এল। ইউনুসকে পাঠাল, ভবেশ বাবুকে খবর দিয়ে আনতে। তিনি হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করেন। চিকিৎসক হিসেবে তাঁর কোনরকম খ্যাতি নেই। নিজেই বলেন, ওষুধপত্র যা ছিল সব শেষ। আবার ঢাকায় গিয়ে আনতে হবে। এখন আছে এক প্যাকেট চিনির গুড়া। ভগবানের নাম নিয়ে ঐ দিয়ে দি। ভগবানের অসীম লীলা। এতেই রোগ আরোগ্য হয়।
ভবেশ বাবু তৎক্ষণাৎ এলেন।
রুগীর কপালে হাত দিয়ে বললেন, হোমিওপ্যাথির কম না। জল চিকিৎসা। মা জননী প্রচুর জল দিয়ে শরীর ঠাণ্ডা করা লাগব। জলের ব্যবস্থা করেন। শীতল জল।
শওকত সাহেব টকটকে লাল চোখে তাকালেন। সব কেমন এলো মেলো হয়ে যাচ্ছে। কি একটা জরুরী কথা বলা দরকার। কথাটা মনে পড়ছে না। তবে কবিতার দুচরণ এখন আর মাথায় ঘুর ঘুর করছে না।
ভুবেশ বাবু, মাথায় পানি ঢালতে শুরু করলেন।
ঘুমে শওকত সাহেবের চোখ জড়িয়ে আসছে। এখন আরাম বোধ করছেন। পাশ ফিরে ঘুমুতে ইচ্ছা করছে। পাশ ফেরা যাবে না। পাশ ফিরলে কানে পানি ঢুকবে।
ভবেশ বাবু বললেন, একটু কি আরাম লাগছে স্যার?
লাগছে।
হরে হরে, কৃষ্ণ কৃষ্ণ–জল চিকিৎসার উপর চিকিৎসা নাই। জল হইল আপনার সর্বরোগ গ্ৰাসিনী। জলে যে সব প্রাণী বাস করে তাদের এই কারণে কোন রোগ বালাই হয় না। নিরোগ জীবন যাপন করে।
শওকত সাহেব বললেন, আপনি জানতেন কি ভাবে? এরা অসুস্থ হলেতো আপনাকে খবর দেবে না। ইচ্ছা থাকলেও এদের ক্ষমতা নেই।
স্যার আপনি একেবারেই কথা বলবেন না। চুপ করে থাকেন।
শরীরটা ভাল বোধ হচ্ছে–এই জন্যে কথা বলছি | জ্বর মনে হচ্ছে কমেছে ভবেশ বাবু আপনার কাছে থার্মোমিটার আছে?
আজ্ঞে না। আমি হোমওপ্যাথি করি। থার্মোমিটার এলোপ্যাথ ডাক্তারদের যন্ত্র। আমি নীতিগত ভাবে ব্যবহার করি না।
জ্বর বুঝেন কি ভাবে?
গায়ে হাত দিয়ে বুঝি।
গায়ে হাত দিয়ে আমার জ্বর আপনার কত মনে হয়েছিল?
একশ চারের উপরে ছিল। এখন একশ দূই।
শওকত সাহেব পুষ্পের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমার ঐ হ্যান্ড ব্যাগ খুলে দেখ–প্লাষ্টিকের একটা বক্স আছে। ওষুধ পত্র এবং থার্মোমিটার থাকার কথা।
থার্মোমিটার পাওয়া গেল। দেখা গেল জ্বর সত্যি সত্যি একশ দুই। শওকত সাহেব বললেন, ভবেশ বাবু আপনি ভাল চিকিৎসক।
এই কথাটা স্যার আপনি কাগজে লিখে দিয়ে নাম সই করে যাবেন। সার্টিফিকেটের মত সাথে রাখব।
পুষ্প বলল, আরো পানি ঢালবেন চাচা?
ভবেশ বাবু বললেন, অবশ্যই–পানি জ্বর ধুইয়া নিয়ে যাইতেছে। সেই সঙ্গে রোগের যে বিষ ছিল–সেই বিষ।
ভবেশ বাবু।
আজ্ঞে স্যার।
আপনাদের এখানে যে নদী আছে তার নাম কি?
নদীর নাম সোহাগী।
আমিতো জানতাম–ছোটগাঙ।
আগে তাই ছিল–বজলুর রহমান বলে এক পাগল কিসিমের লোক নাম বদলায়ে দিল।
কি ভাবে বদলালো?
মজার ইতিহাস। সভা মিছিল করে একটা হুলুস্থুল করেছেন। রোজ সকালে। উঠে নদীর ধার দিয়ে দৌড়াতেন আর চিৎকার করতেন–সোহাগী, সোহাগী, সোহাগী। স্কুলে ছাত্রদের গিয়ে বলেছেন–তোমরা এই নাম চারদিকে ছড়ায়ে দিবে। তারপর আপনের গান বাঁধলেন সোহাগী নাম দিয়ে।
গানের লাইন মনে আছে?
আজ্ঞে প্রথম কয়েকটা চরণ আছে।
বলুনতো দেখি।
ও নদী ততার কানে আমি চুপে বলিলাম।
সোহাগী তোর নামরে নদী, সোহাগী তোর নাম।
এখন সবাই কি নদীটাকে এই নামেই ডাকে?
জি ডাকে। সবাই ডাকে।
শওকত সাহেব ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন–আসলে সবাই বোধ হয় মনে মনে চাচ্ছিল–এই নদীর সুন্দর একটা নাম হোক। যেই মুহূর্তে নাম পাওয়া গেল–সবাই সঙ্গে সঙ্গে গ্রহণ করল।
ভবেশ বাবু বললেন, আর জল ঢালতে হবে না বলে মনে হয়। জ্বর আরো কমেছে। এখন জ্বর হচ্ছে একশ এক। পুষ্প মা, থার্মোমিটারটা দিয়ে দেখতে ঠিক বললাম কি-না।
শওকত সাহেব বললেন, দেখতে হবে না। আপনার কথা বিশ্বাস করলাম।
আজ্ঞে না। পরীক্ষা হয়ে যাক।
পরীক্ষা করা হল। ভ্রর ঠিকই একশ এক।
রুগীকে এখন ঘুমাইতে হবে। পুষ্প মা, রুগীকে একা কইরা দাও। কেউ থাকলেই রুগী কথা বলবো। ঘুম হবে না।
তারা বের হয়ে আসার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই শওকত সাহেব ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুম ভাঙ্গল রাত এগারোটার দিকে। চোখ মেলেই দেখলেন–বিছনার পাশে পুষ্প বসে আছে। একটু দূরে চেয়ারে পা তুলে মোফাজ্জল করিম সাহেব বসে আছেন। তাঁর মুখ ভয়ে পাংশু বৰ্ণ।
মোফাজ্জল করিম সাহেব বললেন, স্যার আপনার শরীর এখন কেমন?
ভাল। শরীর ভাল। আমি আপনাদের দারুণ উদ্বেগে রেখেছি দয়া করে ক্ষমা করবেন।
কিছু খাবেন স্যার? খাওয়ার রুচি হয়েছে?
না। তবে একেবারে খালি পেটে থাকা বোধ হয় ঠিক হবে না। এক গ্লাস দূধ। খেতে পারি।
এশার নামাজ শেষ করে করিম সাহেব খেতে বসলেন।
পুষ্পও বসল তাঁর সঙ্গে। করিম সাহেব বললেন, তোর উপর দিয়ে আজ খুব ঝামেলা গেছে। পুষ্প কিছু বলল না।
ভবেশ বাবুকে বুদ্ধি করে খবর দিয়ে খুব ভাল কাজ করেছিস মী। ভবেশ। বাবু চিকিৎসা কিছু জানেন না। কিন্তু এরা প্রাচীন মানুষ অনেক টোটকা ফোটকা জানেন। সময়মত পানি না ঢাললে অবস্থা হয়ত আরো খারাপ হত। তুইতো কিছু খাচ্ছিস না মা।
আমার খেতে ভাল লাগছে না।
তোর আবার জ্বর আসেনিতো? দেখি বাঁ হাতটা আমার কপালে ছোঁয়াতো।
জ্বর নেই বাবা।
না থাকুক ছোঁয়াতে বলেছি ছোঁয়া।
পুষ্প বাবার কপালে হাত রাখল। করিম সাহেব বললেন, হাততো সোহাগী নদীর পানির মত ঠাণ্ডা।
বলেছিলাম তো, জ্বর নাই।
হুঁ। তাই দেখছি। এদিকে আরেক কাণ্ড হয়েছে উনার আসার খবর দিকে দিকে রটে গিয়েছে। কলমাকান্দার সার্কেল অফিসার চিঠি দিয়ে লোক পাঠালেন–উনাকে নিয়ে তাঁর বাসায় যেন এক কাপ চা খেতে যাই। আমি বলেছি ঠিক আছে।
নিজ থেকে ঠিক আছে বললে কি জন্যে–উনিতে যাবেন না তুমি জানাই।
যেতে পারে। এরা ঘন ঘন মত বদলায়–কাল সকালেই হয়ত বলবেন, করিম সাহেব এক জায়গায় বসে থাকতেতো আর ভাল লাগছে না। চলুন একটু ঘুরা ফেরা করি।
কোনদিনও এই কথা বলবেন না। মাঝখানে তুমি অপমান হবে।
আমাদের স্কুলের সেক্রেটারীর বাসায়ও গিয়েছিলাম–বললাম উনার কথা। মহামূৰ্খ নামও শুনে নাই। যাইহোক বললাম তরফদার সাহেব একটি সম্বৰ্ধনা স্কুলের তরফ থেকেতো দেয়া লাগে। উনি বলেন সম্বর্ধনা দিয়ে কি হবে? মন্ত্ৰী টন্ত্রী হলে সাহায্য পাওয়ার ব্যাপার ছিল। মুখের কথাবার্তা আর কি। যাই হোক শেষকালে রাজি হয়েছেন। তিনশ টাকা সংস্থান করেছেন। একটা হাতে লেখা মানপত্র দেয়া হবে। স্কুলের সব টিচাররা মিলে উনাকে নিয়ে চটা খাবে। এক কাপ চা, সিঙ্গারা, মিষ্টি আর ধর একটা করে কলা।
তোমাদের স্কুলের অর্ধেকটা উড়িয়ে নিয়ে গেছে ঝড়ে আর তোমরা উনার সম্বৰ্ধনায় পয়সা খরচ করবে?
স্কুল উড়িয়ে নিয়ে গেছে। আবার হবে–উনাকে পাব কোথায়?
খাওয়া শেষ করে করিম সাহেব কুয়াতলায় হাত ধুতে গেলেন। পেছনে পেছনে পুষ্পও এলো চাঁদ উঠেছে। চাঁদের আলোয় আবছা করে সব দেখা যাচ্ছে। পুষ্প থালাবাসন ধুচ্ছে করিম সাহেব একটু দূরে বসে সিগারেট টানতে টানতে মেয়েকে দেখছেন। তাঁর বড় মায়া লাগছে। মেয়েটা কষ্টে পড়ে গেছে। একা কত কি দেখতে হচ্ছে। মতির মাকে কাল যে ভাবেই হোক জোগাড় করতে হবে।
পুষ্প।
জি বাবা।
কয়েকজন গ্রাম্য গাতককে খবর দেয়া দরকার। সন্ধ্যাবেলা একদিন এইখানে একদিন আসর করলে, উনি খুব পছন্দ করবেন।
উনাকে না জিজ্ঞেস করে কিছুই করো না বাবা।
জিজ্ঞেস করেই করব। আমাদের কত বড় সৌভাগ্য চিন্তা করে দেখতে মা–উনার মত মানুষ এই বাড়িতে আছেন। আমাবতত বিশ্বাসই হয় না। ওসি সাহেবকে বলেছি একটা বড় বজরা নৌকা যদি দু এক দিনের জন্যে জোগাড় করতে পারেন।
উনাকে পেলে কোথায়?
স্কুল ঘর ঝড়ে উড়ে গেছে শুনে দেখতে গেছেন। তখন বললাম। ওসি সাহেব উনার বিশেষ ভক্ত, লেখা পড়েছেন।
কুয়াতলা থেকে দোতলার ঘর দেখা যায়। শওকত সাহেবের ঘরের বাতি নেভানো। সেই ঘরের দিকে পিতা এবং কন্যা অনেকক্ষণ আকিয়ে রইল।