০৩. মোনালিসা

২১.

মোনালিসা।

হঠাৎ করেই সোফি বের হওয়ার সিঁড়িটার সামনে থম্‌কে দাঁড়ালো, ভুলে গেলো লুভর থেকে চলে যাবার কথাটা। তার এজন্যে দুঃখ হতে লাগলো যে, এনাগ্রামটার মর্মোদ্ধার সে নিজে করতে পারেনি। সোফির দক্ষতা জটিল জটিল সব ক্রিপ্টো বিশ্লেষণের উপর, তাই তার চোখ সহজ সরল শব্দের খেলাটা এড়িয়ে গেছে। তারপরও তার মনে হলো, তার উচিত ছিলো এটা বের করার। হাজার হলেও, তার কাছে এনাগ্রাম কোন অপরিচিত কিছু ছিলো না, বিশেষ করে ইংরেজিতে।

যখন সে খুব ছোট ছিলো, তার দাদু প্রায়ই তার ইংরেজি বানানের দক্ষতা পরীক্ষা করার জন্য এই এনাগ্রাম খেলাটা ব্যবহার করতেন। একবার তিনি ইংরেজি শব্দ Planets লিখে এর অক্ষরগুলো দিয়ে সোফিকে বিরানব্বইটি অন্য ইংরেজি শব্দ লিখতে বললেন। এই অক্ষরগুলো দিয়ে আসলেই, বিস্ময়করভাবে এতোগুলো শব্দ লেখা যায়। সোফি তিন দিন ব্যয় করে, ডিকশনারি ঘেঁটে সবগুলো শব্দ বের করতে পেরেছিলো।

আমি কল্পনাও করতে পারছি না, লেখাগুলোর দিকে তাকিয়ে ল্যাংডন বললো, কীভাবে আপনার দাদু মারা যাবার আগে মিনিটখানেকের ভেতরে এরকম একটি এনাগ্রাম তৈরি করতে পারলেন!

সোফি ব্যাখাটা জানতো, আর এটা বুঝতে পেরে তার খুব খারাপ লাগলো। আমার এটা দেখা উচিত ছিলো! সে তার দাদুর কথা স্মরণ করলো—একজন শব্দ খেলার আসক্ত ব্যক্তি এবং শিল্পকলাপ্রিয় মানুষ তরুণ বয়সে বিখ্যাত সব চিত্রকর্ম দিয়ে এনাগ্রাম তৈরি করে খুব আনন্দ পেতেন। সত্যি বলতে কী, একবার তাঁর তৈরী একটা এনাগ্রাম তাঁকে বেশ সমস্যায় ফেলে দিয়েছিলো, তখন সোফি একটা বাচ্চা মেয়ে। আমেরিকান এক আর্ট ম্যাগাজিনের সাথে সাক্ষাতের সময়, সনিয়ে আধুনিক কিউবিজম আন্দোলনের প্রতি তার অপছন্দের কথা প্রকাশ করেছিলেন পিকাসোর মাস্টারপিস les Demoiselles d ‘Avignor-কে Vile meaningless doodles-এর যথার্থ  এনাগ্রাম হিসেবে বর্ণনা করে। পিকাসোর ভক্তরা এতে খুশি হতে পারেনি।

আমার দাদু এই Monalisa এনাগ্রামটি সম্ভবত অনেক আগেই তৈরি করেছিলেন, ল্যাংডনের দিকে চেয়ে সোফি বললো। আর আজরাতে তিনি এটা বাধ্য হয়েই একটা কোড হিসেবে ব্যবহার করেছেন। সে তার দাদুর শীতল কণ্ঠটা শুনতে পেলো।

লিওনার্দো দা ভিঞ্চি!

মোনালিসা!

কেন তিনি তাঁর চুড়ান্ত মুহূর্তের কথায় এই বিখ্যাত চিত্রকর্মটির উল্লেখ করে গেছেন, সে ব্যাপারে সোফির কোন ধারণাই ছিলো না। কিন্তু একটা সম্ভাবনার কথাই কেবল ভাবতে পারলো সে। বিব্রতকর একটা কিছু।

এগুলো তাঁর অন্তিম কথা নয় …

সে কি মোনালিসা দেখতে যাবে? তাঁর দাদু কি সেখানে কোন মেসেজ রেখে গেছেন? আইডিয়াটা মনে হচ্ছে যথার্থই ন্যায়সঙ্গত। হাজার হোক, বিখ্যাত চিত্রকর্মটি ঝুলে আছে সল দে এতা-এ-একটা আলাদা কক্ষে, কেবলমাত্র গ্র্যান্ড গ্যালারির ভেতর দিয়েই সেখানে প্রবেশ করা যায়। সোফি টের পেলো, যে ঘরটির দরজা খোলা রয়েছে সেটা থেকে কেবল বিশ মিটার দূরে তার দাদুর মৃতদেহটা পড়ে আছে।

তিনি মারা যাবার আগে খুব সহজেই মোনালিসাকে দেখে যেতে পারতেন।

সোফি ইমার্জেন্সি সিঁড়িটার দিকে ফিরে তাকালো, সিদ্ধান্তহীনভাবে। সে জানে তার উচিত ল্যাংডনকে এক্ষুণি জাদুঘর থেকে বের করে নেয়া। তারপরও তার মনে হতে লাগলো বিপরীত কিছু করার। সোফি তার শৈশবে দাদুর সাথে লুভরের ডেনন উইংয়ে বেড়াতে আসার কথাটি মনে করতেই বুঝতে পারলো, তার দাদু যদি তার কাছে গোপন কিছু বলার থেকেই থাকে, তবে সেটা দা ভিঞ্চির মোনালিসার চেয়ে খুব কম জায়গাই রয়েছে এই পৃথিবতে।

সে এখান থেকে অল্প দূরেই আছে, তার দাদু সোফির নরম হাতটা ধরে ফিস ফিস্ করে কথাটা বলেছিলো। তখন জাদুঘরটা সবার জন্য বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো,

ফাঁকা জাদুঘরটা তাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিলেন তিনি।

সোফির বয়স তখন মাত্র ছয়। বিশাল বড় ছাদ আর চমঙ্কার ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে তার মনে হয়েছিলো, সে খুব ছোট আর নগন্য। ফাঁকা জাদুঘরটা তাকে ভীত করে তুলেছিলো। যদিও সেটা দাদুকে বুঝতে দেয়নি সে।

সামনেই সল দে এতা, লুভরের সবচাইতে বিখ্যাত ঘটাতে প্রবেশ করতেই তার দাদু তাকে বলেছিলেন। দাদুর দারুণ উত্তেজনা থাকা সত্ত্বেও সোফি চাইছিলো বাড়ি ফিরে যেতে। সে বইতে মোনালিসার ছবি দেখেছিলো, তার একদম পছন্দ হয়নি। সে বুঝতেই পারতো না, কেন সবাই তাকে নিয়ে এতো মাতামাতি করে।

সেস্ত, এনুয়ে, সোফি গজ গজ করে ফরাসিতে বলেছিলো।

বোরিং, দাদু ইংরেজি শব্দটা বলে শুধরিয়ে দিয়েছিলেন, স্কুলে ফরাসি, বাড়িতে ইংরেজি।

লো লুভর, সেস্তু পা শেজ মেয়ে! সে চ্যালেঞ্জ করে বলেছিলো।

তিনি ক্লান্ত একটা হাসি দিয়েছিলেন। ঠিক বলেছো তুমি। তাহলে মজা করার জন্য ইংরেজি বলা হোক।

সোফি ঠোঁট উল্টিয়ে হাটতে শুরু করেছিলো। সল দে এতা-এ ঢোকা মাত্রই তার চোখ সংকীর্ণ একটা ঘর নিরীক্ষণ করে খুঁজে পেলো সেই সম্মানজনক স্থানটি ডান দিকের দেয়ালের ঠিক মাঝখানটা। সেখানে বুলেটপ্রুফ গ্লাসের পেছনে একটা ছবি টাঙানো ছিলো। তার দাদু দরজার দিকে এসেই একটু থেমে গিয়ে ছবিটার দিকে ঘুরে বলেছিলেন, যাও, সোফি। খুব বেশি মানুষ তাকে একা দেখার এই দূর্লভ সুযোগটা পায় না।

সোফি আস্তে আস্তে এগিয়ে গিয়েছিলো। মোনালিসা সম্পর্কে এতো কিছু শোনার পর, তার মনে হচ্ছিলো, সে যেনো রাজকীয় কোনো কিছুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বুলেট প্রুফ গ্লাসটার সামনে এসে দাঁড়াতেই সোফি নিঃশ্বাস নিয়ে সোজা ছবিটার দিকে তাকিয়েছিলো।

সোফি নিশ্চিত ছিলো না, তার কী রকম অনুভূতি হবে, কিন্তু তার তেমন কিছুই হয়নি। কোন বিস্ময় না। তৎক্ষণাৎ কোন উত্তেজনাও বোধ করেনি। বিখ্যাত চেহারাটা, বইতে যেমন দেখেছে, তেমনি দেখাচ্ছিলো সেটা। নিরবে দাঁড়িয়ে ছিলো সে যা তার কাছে অনন্ত কালের অপেক্ষা করার মতো মনে হয়েছিলো। সে কিছু একটা ঘটার প্রতীক্ষা করছিলো।

তো, তোমার কি মনে হচ্ছে? তার দাদু তার পেছনে এসে ফিসফিস্ করে বলেছিলেন। সুন্দর, চোখটা?

সে তো দেখি খুবই ছোট।

সনিয়ে হেসে ছিলেন। তুমিও তো ছোট, কিন্তু সুন্দর।

আমি সুন্দর নই, সে মনে মনে ভেবে ছিলো। সোফি তার লাল চুল আর চেহারায় ছিট-ছিট দাগগুলো ঘৃণা করতো। তার ক্লাসের সব ছেলেদের চেয়েও সে বড়সড় ছিলো। সে মোনালিসার দিকে আবার ফিরে তাকিয়ে মাথা নেড়ে ছিলো। বইতে তাকে যেমন দেখায়, দেখতে তার চেয়েও বেশি খারাপ। তার চেহারাটা …ব্রুমোয়া।

কুয়াশাচ্ছন্ন, তার দাদু বলেছিলেন।

কুয়াশাচ্ছন্ন, সোফিও কথাটা আবার বলে ছিলো।

এটাকে বলে পেইন্টিংয়ের ফুমেতো স্টাইল। তিনি সোফিকে বলেছিলেন। আর এভাবে আঁকা খুবই কঠিন কাজ। লিওনার্দো দা ভিঞ্চি অন্য যে কারোর চেয়ে এক্ষেত্রে সেরা ছিলেন।

তারপরও সোফি ছবিটা পছন্দ করেনি। তাকে দেখে মনে হচ্ছে, সে কিছু একটা জানে… যেমন স্কুলের বাচ্চারা গোপন কিছু জানে, সেরকম।

তার দাদু জোরে জোরে হেসে ছিলেন, অনেকটা, এজন্যেই সে এতো বিখ্যাত। লোকজন অনুমান করতে পছন্দ করে, কেন সে হাসছে।

তুমি কি জানো, কেন সে হাসছে?

হয়তো। তার দাদু মিটিমিটি হেসে বলেছিলেন। একদিন আমি এসবের সবটাই তোমাকে বলবো।

সোফি তার পাটা মাটিতে সজোরে আঘাত করেছিলো। আমি তো তোমাকে বলেছিই, রহস্য আমার ভালো লাগে না!

প্রিন্সেস, তিনি হেসে বলেছিলেন। এ জীবন রহস্যে পরিপূর্ণ। তুমি একবারে এগুলোর সবটা জানতে পারবে না। আমি উপরে ফিরে যাচ্ছি, সোফি ল্যাংডনকে বললো, তার কণ্ঠটা সিঁড়ি ঘরে প্রতিধ্বনিত হলো।

মোনালিসার কাছে? ল্যাংডন ভুরু কুচকে বললো। এখনই?

সোফি ঝুঁকিটা বিবেচনা করলো। আমি সন্দেহভাঁজন খুনি নই। আমি আমার সুযোগটা নেবোই। আমার দাদু আমাকে কী বলতে চাচ্ছেন, সেটা আমার জানা দরকার।

এ্যামবাসির ব্যাপারটা কি হবে?

ল্যাংডনকে একজন ফেরারি বানিয়ে এখন আবার তাকে পরিত্যাগ করার কথাটা ভেবে সোফির খুব অপরাধবোধ হতে লাগলো, কিন্তু তার অন্য কোন উপায়ও ছিলো না। সে নিচের সিঁড়ির কাছে একটা লোহার দরজার দিকে ইঙ্গিত করলো।

এই দরজাটা দিয়ে বেড়িয়ে যান, আর জ্বলজ্বলে বহির্গমনের সাইনগুলো অনুসরণ করুন। আমার দাদু আমাকে এখানে নিয়ে আসতেন। আমি এ জায়গাটা চিনি। বাইরে বের হবার জন্য এই একটাই পথ আছে। সোফি তার গাড়ির চাবিটা ল্যাংডনের কাছে হাতে দিয়ে দিলো। আমারটা লাল রঙের, কর্মচারীদের লটে পার্ক করা আছে। আপনি কি জানেন এ্যামবাসিতে কীভাবে যাওয়া যায়?

হাতের চাবিটার দিকে তাকিয়ে ল্যাংডন মাথা নাড়লো।

শুনুন, সোফি বললো, তার কণ্ঠটা খুব নরম শোনাচ্ছে। আমার মনে হয়, আমার দাদু মোনালিসাতে আমার জন্য একটা মেসেজ রেখে গেছেন—তাঁকে কে খুন করেছে, হয়তো সেই ব্যাপারে কোন কু আছে। অথবা, কেন আমি বিপদে আছি সেটা বলা আছে। অথবা আমার পরিবারের কী হয়েছিলো। আমাকে সেটা দেখতেই হবে।

কিন্তু তিনি যদি আপনার বিপদের কথাটা বলতেই চাইতেন, তবে তিনি মারা যাবার আগে সেটা ফ্লোরে লিখে গেলেন না কেন? কেন এই জটিল শব্দ-শব্দ খেলা?

আমার দাদু আমাকে যা-ই বলতে চাইছেন, আমার মনে হয় না, তিনি চান সেটা অন্য কেউ জানুক। এমন কি পুলিশও না। স্পষ্টতই, তার দাদু নিজের সমস্ত শক্তি দিয়েই তার কাছে একটা মেসেজ পৌঁছাতে চাইছিলেন। তিনি সেটা কোডের আকাড়ে লিখে গেছেন। সোফির গোপন আদ্যক্ষরও সংযুক্ত করে দিয়েছেন। আর শেষে তাকে বলে গেছেন রবার্ট ল্যাংডনকে খুঁজে বের করতে একটি প্রজ্ঞাময় আদেশ। আমেরিকান সিম্বোলজিস্ট এই কোডটার মর্মোদ্ধার করতে পারবে এই ধারণায়। খুবই অদ্ভুত শোনাচ্ছে, সোফি বললো, আমার মনে হয়, তিনি চেয়েছেন অন্য কেউ পৌঁছানোর আগেই আমি মোনালিসার কাছে যাই।

আমিও আসছি আপনার সাথে।

না! আমরা জানি না গ্র্যান্ড গ্যালারি কততক্ষণ খালি থাকবে। আপনাকে যেতেই হবে।

ল্যাংডনকে মনে হলো দ্বিধাগ্রস্ত, যেনো তার একাডেমিক কৌতূহলটা এখন হুমকির সম্মুখীন।

এক্ষুণি যান। সোফি তার দিকে চেয়ে একটা বিদায়ী হাসি দিলো। আমি এ্যামবাসিতে গিয়ে আপনার সাথে দেখা করবো, মি. ল্যাংডন।

ল্যাংডনকে দেখে মনে হলো খুশি হয়নি। আমি আপনার সাথে সেখানে দেখা করতে পারি একটা শর্তে, সে জবাব দিলো, তার কণ্ঠ কাঁপছে।

সোফি একটু থেমে চোখ তুলে তাকালো। সেটা কি?

আপনি আমাকে ল্যাংডন বলা বন্ধ করবেন।

সোফি মিষ্টি হেসে ল্যাংডনের দিকে তাকিয়ে বললো, গুড লাক, রবার্ট।

 

ল্যাংডন সিঁড়ির একেবারে শেষ ধাপে নেমে আসলো। সেখানে তেল আর পাস্টারের ঝাঝালো গন্ধটা তার নাকে এসে লাগলো। সামনে এগোতেই চোখ পড়লো SORTIE/ EXIT লেখা একটা সাইন। সেটা সঙ্কীর্ণ একটা করিডোরের দিকে ইঙ্গিত করছে। ল্যাংডন সেদিকেই পা বাড়ালো।

হলওয়ে দিয়ে যেতে যেতে ল্যাংডন ভাবতে লাগলো, যদি এই মুহূর্তে ক্যামবৃজের বিছানা থেকে জেগে উঠতো সে আর আজকের পুরো ঘটনাটাই হতো অদ্ভুত একটা স্বপ্ন! আমি লুভর থেকে চুপিসারে বেড়িয়ে যাচ্ছি… একজন ফেরারী হয়ে।

সনিয়ের চাতুর্যপূর্ণ এনাগ্রামটি এখনও তার মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। ল্যাংডন অবাক হয়ে ভাবলো, সোফি মোনালিসাতে কী এমন খুঁজে পাবে…অবশ্য যদি কিছু পায়। সে একদম নিশ্চিত যে, তার দাদু তাকে বিখ্যাত চিত্রকর্মটি আরেকবার পরিদর্শন করার জন্য ইঙ্গিত করে গেছেন। কিন্তু ল্যাংডনের কাছে এটা হেঁয়ালী বলেই মনে হলো।

পি,এস, রর্বাট ল্যাংডনকে খুঁজে বের করো।

সনিয়ে ল্যাংডনের নাম ফ্লোরে লিখে সোফিকে আদেশ করে গেছেন তাকে খুঁজে বের করতে। কিন্তু কেন? এজন্যে কি, যাতে ল্যাংডন এনাগ্রামটার মর্মোদ্ধার করতে তাকে সাহায্য করতে পারে?

এটা একেবারেই মনে হচ্ছে না।

হাজার হোক, সনিয়ের এটা ভাবার কোন কারণ নেই যে, ল্যাংডন একজন দক্ষ এনাগ্রাম বিশেষজ্ঞ। আমরা এমনকি কখনও দেখাও করিনি। তাছাড়া, সোফি ইতিমধ্যেই ফিবোনাচ্চি সংখ্যামটা বের করতে পেরেছে, আরেকটু সময় পেলে বাকী মেসেজটার মর্মোদ্ধারও সে করতে পারবে। এগুলোর জন্য তো তার ল্যাংডনের কোন সাহায্যের দরকার নেই।

সোফি এনাগ্রামটা নিজে নিজেই বের করতে পারতো। হঠাৎ করেই ল্যাংডন এ ব্যাপারে একদম নিশ্চিত হয়ে গেলো। সে বুঝতে পারলো, সনিয়ের এরকম করার কারণটা কী।

আমি কেন? ল্যাংডন অবাক হয়ে হলের দিকে এগোলো। কেন সনিয়ের মৃত্যুকালীন ইচ্ছা হলো তাঁর বিচ্ছিন্ন হওয়া নাতনী আমাকে খুঁজে বের করুক?

হঠাৎ অন্য একটা ভাবনা খেলে গেলো ল্যাংডনের মনে। সে একটু থেমে পকেট হাতড়ে কম্পিউটার প্রিন্ট-আউটটা বের করলো। সনিয়ের মেসেজটার শেষ লাইনটার দিকে তাকালো সে।

পি,এস, রবার্ট ল্যাংডনকে খুঁজে বের করো।

দুটো অক্ষরের দিকে সে চোখ স্থির করলো।

পি, এস।

হুট করেই ল্যাংডনের মনে হলো, সে সনিয়ের উদ্দেশ্যটা বুঝতে পারছে। অনেকটা বজ্রপাতের মতো সিমোলজি আর ইতিহাস তার উপর পতিত হলো। আজ রাতে সনিয়ে যা যা করেছেন, তার সবটাই এখন স্পষ্ট বলেই তার কাছে মনে হচ্ছে। ল্যাংডনের চিন্তাভাবনাগুলো খুব দ্রুত সবকিছু মিলিয়ে একটা অর্থ দাঁড় করাতে শুরু করলো। ঘুরে, যেখান থেকে সে এসেছিলো, সেখানে আবার তাকালো।

সময় আছে কি?

সে জানতো, এতে অবশ্য কিছু যায় আসে না।

কোন রকম ইতস্তত না করেই, ল্যাংডন সিঁড়ি ভেঙে দ্রুত উপরে উঠতে শুরু করলো।

 

২২.

বেদীর দিকটা ভালো করে দেখে নিয়ে সাইলাস হাটু গেঁড়ে প্রার্থনা করার ভান করলো। সেন্ট-সালপিচ, বেশির ভাগ চার্চের মতোই বিশালাকার রোমান ক্রসের আকাড়ে নির্মাণ করা হয়েছে। এটার লম্বা কেন্দ্রীয় অংশটি মূল অংশ সরাসরি বেদীর দিকে চলে গেছে। সেখান থেকে ট্রানসেপ্ট নামের আরেকটা ছোট অংশ আড়া আড়ি চলে গেছে। মূল অংশটি এবং এর সাথে আড়াআড়ি ছোট অংশটাকে চার্চের প্রাণ কেন্দ্র হিসেবে বিবেচনা করা হয় …সবচাইতে পবিত্র এবং আধ্যাত্মিক স্থান।

আজ রাতে নয়, সাইলাস ভাবলো। সেন্ট সালপিচ তার সিক্রেটটা অন্য কোথাও লুকিয়ে রেখেছে।

ডান দিকে চেয়ে সে দক্ষিণ দিকের ক্রুশাকৃতির অংশটার দিকে তাকালো। তার শিকাররা যে বস্তুটার কথা তাকে বলেছিলো, পদ্রীর আসনের ওপাশে খোলা জায়গাটার দিকে সেটা দেখতে পেলো সাইলাস।

এইতো এটা।

ধূসর গ্রানাইট ফ্লোরের পাথরের মধ্যে শক্ত করে লাগিয়ে রাখা পালিশ করা পিতলের একটা ডোরা কাটা দাগ চক্ করছে…সোনালী রেখাটা চার্চের ফ্লোরটাকে আড়াআড়িভাবে বিরক্ত করে আছে। দাগটার মধ্যে কিছু চিহ্ন দেয়া আছে, অনেকটা রুলার-স্কেলের মতো। এটা সূর্য ঘড়ির কাঁটা। সাইলাসকে বলা হয়েছিলো যে, এটা একটা প্যাগান জ্যোর্তিবিদ্যার যন্ত্র, অনেকটা সূর্যঘড়ির মতো দেখতে। পর্যটক, বিজ্ঞানী, ইতিহাসবিদ এবং প্যাগানরা বিশ্বের বিভিন্ন জায়গা থেকে সেন্ট সালপিচের এই বিখ্যাত রেখাটি দেখতে আসতো।

রোজ লাইন।

আস্তে আস্তে সাইলাস দাগটা লক্ষ্য করে ঘরের ডান থেকে বাম দিকে তাকালো। তার সামনে বেঢপ আকৃতির একটা কোণ, চার্চের সাথে একেবারেই অসামঞ্জস্যভাবে স্থাপিত। মূল বেদীটা এ-মাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত দাগ কাটা, যেনো সুন্দর কোন চেহারায় কাটা দাগের মতো। দাগটা চার্চের প্রস্তুটাকে এপাশ-ওপাশ ভাগ করে ফেলেছে। অবশেষে, উত্তর দিকের কোণায় পাদ্রীর আসনের কাছে গিয়ে থেমেছে। সেখানে এটা সবচাইতে অপ্রত্যাশিত একটা স্থাপত্যের গোড়ায় গিয়ে মিলেছে।

একটা বিশাল মিশরীয় অবিলিস্ক।

এখান থেকে, চকে রোজ লাইনটা নব্বই ডিগ্রি বাঁক নিয়ে সোজা অবিলিস্কের দিকে চলে গেছে। তেত্রিশ ফুট দূরে গিয়ে অবশেষে থেমেছে।

রোজ লাইন, সাইলাস ভাবলো। ভ্রাতৃসংঘ কি-স্টোনটা রোজ লাইনে লুকিয়ে রেখেছে।

আজ রাতে প্রথম দিকে সাইলাস যখন তার টিচারকে বলেছিলো যে, প্রায়োরি কি স্টোনটা সেন্ট সালচিপের অভ্যন্তরে লুকিয়ে রাখা হয়েছে, টিচার তখন সন্দেহ করেছিলেন। কিন্তু সাইলাস যখন খুলে বললো যে, ভ্রাতৃসংঘের সবাই তাকে ঠিক একই কথা বলেছে, ঠিক একই জায়গার বর্ণনা দিয়েছে, টিচারের কণ্ঠে তখন আতিশয্যের বহিপ্রকাশ পাওয়া গিয়েছিলো। তুমি রোজ লাইনর কথা বলছো!

টিচার সাথে সাথেই সাইলাসকে সেন্ট সালপিচের অদ্ভুত স্থাপত্যের খ্যাতি সম্পর্কে বলেছিলেন—একটা পিতলের ডোরা কাটা দাগ চার্চের ভেতরের জায়গাটাকে নিখুঁতভাবে উত্তর-দক্ষিণ অক্ষে বিভক্ত করেছে। এটা এক ধরনের প্রাচীন সূর্য ঘড়ি, যা প্যাগান মন্দিরের অবিচ্ছেদ্য বৈশিষ্ট, আর ঠিক এই জায়গাটাতেই এক সময় একটা প্যাগান মন্দির অবস্থিত ছিলো। সূর্যের রশ্মি, দক্ষিণ দিকের চচকে দেয়াল থেকে প্রতিদিন একটু একটু করে দাগ ধরে এগিয়ে যায়, যা সময়ের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়।

উত্তর-দক্ষিণ ডোরা কাটা দাগটাই রোজ লাইন নামে পরিচিত। শত শত বছর ধরে রোজ বা গোলাপের প্রতীকটা মানচিত্রের দিক নির্দেশনার সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলো। কম্পাস রোজপ্রায় সব মানচিত্রেই আঁকা থাকে যা উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিমকে নির্দেশ করে। আগে এটা উইন্ড-রোজ হিসেবে পরিচিত ছিলো। এটা বত্রিশটা বায়ু প্রবাহের দিক নির্দেশ করতে যা আটটা অর্ধেক বায়ু প্রবাহ আর ষোলোটা এক চতুর্থাংশ বায়ু প্রবাহ থেকে উদ্ভুত। যখন বৃত্তের মধ্যে এটা আঁকা থাকে তখন কম্পাসের এই বত্রিশটা বিন্দু ঐতিহ্যবাহী বত্রিশটা গোলাপের পাপড়ির সাথে মিলে যায়। আজকের দিনেও নেভিগেশনের মূল যন্ত্রপাতিকে বলা হয় কম্পাস রোজ। এটার দক্ষিণ দিকের নির্দেশনাটা এখনও একটা তীরের মাথা দিয়ে চিহ্নিত করা হয়…খুব সাধারণভাবে সেটা ফ্লার-দ্য-লিস প্রতীক হিসেবেই পরিচিত।

একটি ভূ-গোলকে রোজ লাইনকে মধ্য রেখা অথবা দ্রাঘিমাংশ হিসেবেও ডাকা হয়দক্ষিণ-মেরু থেকে উত্তর-মেরু পর্যন্ত যে কোন কাল্পনিক রেখাকেই দ্রাঘিমাংশ বলা হয়। অবশ্য, ভূ-গোলকে সীমাহীন সংখ্যক দ্রাঘিমা রেখা রয়েছে, কারণ ভূ-গোলকের উত্তর দক্ষিণ দিকে কল্পনা করা যে কোন বিন্দু থেকেই দ্রাঘিমা রেখা টানা যায়। প্রাচীন। কালে এই রেখাগুলোকেই রোজলাইন হিসেবে ডাকা হতো শূন্য দ্রাঘিমা রেখা—যে রেখা থেকে অন্য দ্রাঘিমা রেখাগুলো মাপা হয়।

আজকের দিনে এই লাইনটাই হলো ইংল্যান্ডের গৃনিচ।

কিন্তু সবসময় এটা এখানে ছিলো না।

প্রধান মধ্যরেখা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবার অনেক আগে শূন্য দ্রাঘিমা রেখাটি প্যারিসে অবস্থিত ছিলো, আর সেটা ছিলো সেন্ট সালপিচেই। সেন্ট সালপিচের পিতলের ডোরা কাটা দাগটাই পৃথিবীর প্রথম প্রাইম মেরিডিয়ান বা প্রধান মধ্যরেখার স্মৃতি বহন করে আছে। আর যদিও গৃনিচ ১৮৮৮ সালে প্যারিস থেকে এই সম্মানটা ছিনিয়ে নেয়, তারপরও, আসল রোজ লাইন এখনও এখানে দেখা যায়।

আর এজন্যেই বিংবদন্তীটা সত্যি, টিচার সাইলাসকে বলেছিলেন। বলা হয়ে থাকে প্রায়োরি কি-স্টোনটা রোজ লাইন চিহ্নের নিচে লুকিয়ে রাখা হয়েছে।

সাইলাস, হাটু গেঁড়েই চার্চের চারপাশটা একটু দেখে নিলো, নিশ্চিত হলো, কেউ নেই। পরক্ষণেই, তার মনে হলো, কয়্যার বেলকনি থেকে নিঃশ্বাসের শব্দ ভেসে আসছে। সে ওদিকটায় কয়েক মুহূর্ত ভালো করে লক্ষ্য করলো কিন্তু কিছুই দেখতে পেলো না।

আমি একা।

এবার সে বেদীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ক্রুশ এঁকে বাম দিকে ঘুরে পিতলের ভোরা কাটা দাগটা অনুসরণ করে অবিলিস্কের উত্তর দিকে চলে গেলো।

 

ঠিক এই সময়ে রোমের লিওনার্দো দা ভিঞ্চি আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের রানওয়েতে টায়ারের ঘর্ষণ হলে বিশপ আরিঙ্গারোসার অন্যমনস্কভাবটা কেটে গেলো।

আমি এসে গেছি, তিনি ভাবলেন, যথেষ্ট স্বাচ্ছন্দে আছেন ভেবে খুশি হলেন।

বেনভেনুতে এ রোমা, ইন্টারকমে ঘোষণাটা এলো। নড়েচড়ে বসে আরিঙ্গাবোসা তার কালো আলখেল্লাটা একটু শক্ত করে বেঁধে নিয়ে বিরল একটা হাসি হাসলেন। এই সফরটা করতে পেরে তিনি খুব সুখী অনুভব করছেন।

আমি অনেকদিন ধরেই রক্ষণাত্মক ছিলাম। আজ রাতে, এই নিয়মটা বদলে গেছে। মাত্র পাঁচ মাস আগে, আরিঙ্গারোসা তাঁর ধর্মীয় বিশ্বাসের ভবিষ্যতটা নিয়ে বেশ ভীত ছিলেন। এখন, যেনো অনেকটা ঈশ্বরের ইচ্ছায়, সমাধানটা নিজেই উপস্থিত হয়েছে।

স্বর্গীয় হস্তক্ষেপ।

যদি প্যারিসের সব কিছুই পরিকল্পনা মাফিক এগোয়, আরিঙ্গাবোসা খুব জলদিই এমন কিছুর অধিকারী হয়ে উঠবেন, যা তাঁকে খৃস্টান বিশ্বে সবচাইতে শক্তিশালী মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে।

 

২৩.

সোফি সলদে এতা-এর বিশাল কাঠের দরজার বাইরে এক দমে এসে পড়লো—এই ঘরেই মোনালিসা থাকে। ভেতরে ঢোকার আগে, হলের দিকে সে আনমনে তাকালো। বিশ গজ অথবা এরকমই হবে, যেখানে তার দাদুর মৃতদেহটা এখনও স্পট-লাইটের নিচে পড়ে রয়েছে। যে সুতীব্র অনুশোচনা তাকে আঁকড়ে ধরেছে, সেটা খুবই শক্তিশালী আর হঠাৎ করেই এসেছে। গভীর দুঃখবোধের সাথে সাথে তার অপরাধবোধও হলো। লোকটা এই দশ বছরে তার কাছে অসংখ্যবার আসতে চেয়েছে। তারপরও সোফি ছিলো অনড়—তাঁর দেয়া চিঠি-পত্র আর প্যাকেটগুলো না খুলেই ড্রয়ারে রেখে দিতো। সাক্ষাৎ করার ব্যাপারে একদমই রাজি হতো না। তিনি আমার সাথে মিথ্যে বলেছেন। ক্রমাগতভাবে গোপন করে গেছেন। আমার কীইবা করার ছিলো? তাই সোফি তাঁর কাছ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতো।

আজ তার দাদু মৃত। এখন সোফির সাথে তিনি কবর থেকে কথা বলছেন।

মোনালিসা।

সে বিশাল কাঠের দরজাটার কাছে পৌঁছে সেটা ধাক্কা দিলে খুলে গেলো। সোফি একটু থমকে দাঁড়ালো। বিশাল আয়তক্ষেত্র কক্ষটি তাকিয়ে দেখলো, এটাও নরম লাল আলোতে স্নাত হয়ে আছে। সল-দে এতা হলো জাদুঘরের অন্যতম বিরল কস-দ্য সেক্—একেবারে শেষ মাথায় আর গ্র্যান্ড গ্যালারির মাঝামাঝিতে অবস্থিত। এই দরজাটাই এখানে ঢোকার একমাত্র প্রবেশ পথ। এটার মুখোমুখি, দূরের দেয়ালটাতে, বত্তিচেল্লির পনেরো ফুটের একটি চিত্রকর্ম আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছে। এটার নিচে, কাঠের ফ্লোরটার মাঝখানে, একটা বিশাল আটকোনা পালঙ্ক সদৃশ্য বেঞ্চিটা দর্শকদের বিশ্রামের আকাঙ্খ মিটিয়ে থাকে, তাদের ক্লান্ত পা দুটোকে বিশ্রাম দেয়, সেই সাথে লুভরের মূল্যবান সম্পদসমূহ অবলোকন করার সুযোগও তৈরি করে।

ভেতরে ঢোকার আগেই সোফি জানতো, কিছু একটা ফেলে এসেছে। ব্ল্যাক লাইটটা। সে হলের দিকে তাকালো, সেখানে তার দাদু স্পট-লাইটের নিচে পড়ে আছেন, চারিদিকে ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রপাতি ভরা। যদি সেখানে তিনি কিছু লিখে থাকেন, তবে সেটা নিশ্চিতভাবেই ওয়াটারমার্ক স্টাইলাস দিয়ে লিখেছেন তিনি।

একটা গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে সোফি দ্রুত সেই জায়গাটাতে চলে গেলো। তার দাদুর দিকে না তাকিয়েই সে পিটিএস যন্ত্রপাতিগুলোর দিকে নজর দিলো। একটা ছোট আলট্রাভায়োলেট পেন-লাইট খুঁজে পেলো সে। পেন-লাইটটা সোয়েটারের পকেটে ভরে সল দে এতা-এর খোলা দরজার দিকে চলে গেলো।

সোফি ঢুকতেই অপ্রত্যাশিত একটা শব্দ শুনতে পেলো, কারোর পায়ের আওয়াজ। সেটা তার দিকেই আসছে। এখানে অন্য কেউ আছে! লাল আলো থেকে আচমকাই একটা ভূতুরে অবয়ব আবির্ভূত হলো। সোফি লাফিয়ে পেছনে সরে গেলো।

এইতো তুমি! ল্যাংডন সোফির কাছে এসে চাপা কণ্ঠে বললো।

সোফির স্বস্তিটা ছিলো ক্ষণস্থায়ী। রবার্ট, আমি তোমাকে এখান থেকে বের হয়ে যেতে বলেছিলাম! ফশে যদি—

তুমি কোথায় ছিলে?

আমি ব্ল্যাক লাইট আনতে গিয়েছিলাম, নিচু স্বরে বললো। জিনিসটা পকেট থেকে বের করে আনলো সে। যদি আমার দাদু আমার জন্যে কোন মেসেজ রেখে যান-–

সোফি, শোনো। ল্যাংডন নিঃশ্বাস নিতে নিতে সোফির নীল চোখের দিকে চোখ স্থির করে বললো, পি,এস অক্ষর দুটো…তোমার কাছে কি অন্য কোন অর্থ বহন করে? অন্য কোন মানে আর কি?।

তাদের কথাবার্তা প্রতিধ্বনিত হয়ে নিচের হলে চলে যেতে পারে এই ভয়ে সোফি তাকে টেনে সল দে তা-এর ভেতরে নিয়ে এসে বিশাল দরজাটা নিঃশব্দে বন্ধ করে দিলো। আমি তোমাকে বলেছি তো, আদ্যক্ষরটির অর্থ প্রিন্সেস সোফি।

আমি জানি, কিন্তু তুমি কি এই অক্ষরগুলো অন্য কিছুতে দেখেছো? তোমার দাদু কি পি,এস অক্ষর দুটো অন্য কিছুতে ব্যবহার করেছিলেন, অন্য কোনভাবে? মনোগ্রাম হিসেবে, অথবা ব্যক্তিগত কোন জিনিসে?

প্রশ্নটা তাকে ভাবিয়ে তুললো। রবার্ট কিভাবে এটা জানতে পারলোর সোফি পিএস অক্ষর দুটো অবশ্যই আরো একবার দেখেছিলো। এক ধরনের মনোগ্রাম হিসেবে। সেটা ছিলো তার নবম জন্ম দিনের ঠিক আগে। সে গোপনে তার পুরো ঘরটা তল্লাসী চালিয়েছিলো জন্ম দিনের লুকানো উপহারের খোঁজে। এরপর থেকে, সোফি তার কাছ থেকে কোনো কিছু লুকিয়ে রাখাটা সহ্য করতে পারতো না। এই বছর আমার দাদ আমার জন্যে কি উপহার এনেছেন? সে কাপবোর্ড ও ড্রয়ার খুঁজে দেখে ছিলো। আমি যা চাচ্ছি সেই পুতুলটা কি তিনি এনেছেন? কোথায় সেটা রেখেছেন?

সারা বাড়িতে কিছু না পেয়ে সোফি তার দাদুর শোবার ঘরে তল্লাশী চালাবার সাহসও অর্জন করেছিলো। ঘরটা তার খুব কাছেই ছিলো, কিন্তু দাদু নিচের ঘরের সোফায় শুয়ে ছিলেন।

আমি খুব দ্রুতই কাজটা করে নেবো!

পায়ের পাতা উঁচু করে কাঠের ফ্লোরটা পেরিয়ে চুপি চুপি দাদুর ক্লোসেটের কাপড় সরিয়ে দেখেছিলো সে। কিছুই ছিলো না। তারপর, বিছানার নিচে দেখে ছিলো। তাঁর দাদুর ব্যুরোর দিকে এগিয়ে একের পর এক ড্রয়ার খুলে সেগুলো তন্নতন্ন করে দেখে ছিলো। আমার জন্যে কিছু একটা আছেই! নিচের ড্রয়ারটাতেও সে কোন পুতুলের চিহ্ন খুঁজে পায়নি। রেগেমেগে শেষ ড্রয়ারটা খুলে সে দেখতে পেয়ে ছিলো কতগুলো কালো রঙের পোশাক, যা কখনও তার দাদুকে পরতে দেখেনি। ড্রয়ারটা বন্ধ করার সময় ড্রয়ারের পেছনে একটা কিছু চমকাতে দেখে ছিলো সে। দেখতে ছিলো পকেট ঘড়ির চেইনের মতো। কিন্তু সে জানতো তিনি ওসব পরেন না। জিনিসটা কি সেটা বুঝতে পেরে তার হৃদস্পন্দন বেড়ে গিয়ে ছিলো।

একটা নেকলেস!

সোফি খুব সযত্নে চেইনটা ড্রয়ার থেকে বের করে এনে ছিলো। তার বিস্ময় বেড়ে গেলো যখন সে দেখতে পেলো চেইনটার শেষ মাথায় একটা সোনার চাবি। ভারি এবং চৰ্চকে। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে সে ওটা হাতে তুলে নিলো। সে জীবনে কখনও এরকম চাবি দেখেনি। বেশির ভাগ চাবিই সমতল, উঁচু-নিচু দাঁত বিশিষ্ট। কি এটার কলামটা ত্রিভূজাকৃতির আর সেটার উপর অনেকগুলো ছোট-ছোট দাগ। এটার বড় সড় সোনার মাথাটি ক্রুশ আকৃতির। কিন্তু সেগুলো সাধারণ ক্রুশের মতো নয়। সবগুলো বাহুই সমান, অনেকটা যোগ চিহ্নের মতো। ক্রুশটার মাঝখানে একটা অদ্ভুত প্রতীকদুটো অক্ষর এমনভাবে একটার সাথে আরেকটা লেগে আছে যেনো কোনো ফুলের ছবি।

পি এস, সোফি ফিসৃফিস্ করে বলেছিলো। এটা কি হতে পারে?

সোফি? তার দাদু দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন। চমকে গিয়ে চাবিটা হাত থেকে ফেলে দিয়েছিলো সে। সোফি চাবিটার দিকেই চেয়ে ছিলো, তার দাদুর দিকে তাকাতে ভয় পাচ্ছিলো। আমি…আমার জন্মদিনের উপহার খুঁজছিলাম, সে বলেছিলো। সে জানতো, তাঁর বিশ্বাসের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে ফেলেছে সে।

তার দাদুর নিরবে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকাটা তার কাছে অনন্ত কালের মতো মনে হচ্ছিলো। শেষে তিনি একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে ছিলেন। চাবিটা তুলে নাও, সোফি।

সোফি চাবিটা তুলে নিয়ে ছিলো।

তার দাদু সামনে এগিয়ে এসে বলেছিলেন, সোফি, অন্য লোকদের একান্ত নিজস্ব ব্যাপার-স্যাপারগুলো তোমার সম্মান করার দরকার রয়েছে। খুব ধীরে তিনি হাট গেঁড়ে মাটি থেকে চাবিটা তুলে নিয়ে ছিলেন। এই চাবিটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদি তুমি এটা হারিয়ে ফেলো … তার দাদুর শান্ত কণ্ঠটা সোফিকে আরো বেশি ঘাবড়ে দিয়ে ছিলো।

আমি দুঃখিত গ্র্যঁ-পেয়া। সত্যি আমি দুঃখিত। সে একটু থেমে বলে ছিলো, আমি ভেবেছিলাম এটা আমার জন্মদিনের একটা নেকলেস।

তিনি তার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে ছিলেন। আমি এটা আবারো বলছি, সোফি, কারণ এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অন্য লোকের ব্যক্তিগত ব্যাপারগুলোকে তোমার সম্মান করা শিখতে হবে।

হ্যাঁ, গ্র্যঁ পেয়া।

এ ব্যাপারে আমরা পরে কথা বলবো। এখন, বাগানে আগাছা সাফ করতে হবে।

সোফি দ্রুত ঘর থেকে বাইরে বেড়িয়ে গিয়েছিলো গৃহস্থালীর কাজ করার জন্যে।

পরের দিন সকালে, সোফি তার দাদুর কাছ থেকে জন্ম দিনের কোন উপহার পায়নি। যা সে করেছে, তারপর সে এমন কিছু প্রত্যাশাও করেনি। কিন্তু তিনি সারাটা দিন তাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছাও জানাননি। রাতে, দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে সোফি শুতে গিয়ে ছিলো। বিছানার বালিশের নিচে একটা কার্ড খুঁজে পেয়ে ছিলো সে। কার্ডে একটা সহজ সরল ধাঁধা ছিলো। ধাঁধাটা সমাধান করার আগেই সে মুচকি হেসে ছিলো। এটা কি, আমি তা জানি! তার দাদু গত ক্রিসমাসের সকালেও এটা করেছিলেন। গুপ্তধন খোজা!

সোৎসাহে সে ধাঁধাটা সমাধান করার জন্যে ঝাঁপিয়ে পড়েলো। সমাধানটা তাকে বাড়ির আরেকটা জায়গার ইঙ্গিত দিলো, সেখানে সে অন্য আরেকটা ধাঁধার কার্ড খুঁজে পেলোলা। এটাও সোফি সমাধান করে ফেলে আরেকটা কার্ডের পেছনে ছুটলো। এভাবে। সে ঘরের মধ্যে দৌড়াদৌড়ি করতে লাগলো। একটা ক্লু থেকে আরেকটা কুতে। সোফি সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে নিজের ঘরে এসে থমকে দাঁড়ালো। ঘরের মাঝখানে একটা লাল রঙের বাইসাইকেল রাখা। সাইকেলটার হাতলে একটা ফিতে বাধা। সোফি আনন্দে চিৎকার করে উঠেছিলো।

আমি জানি তুমি পুতুল চেয়েছিলে, তার দাদু বলে ছিলেন। এক কোণে দাঁড়িয়ে হাসছিলেন তিনি। আমার মনে হলো, এটা তার চেয়েও ভালো কিছু হবে।

পরের দিন, তাঁর দাদু তাকে সাইকেল চালানো শিখালেন। তার পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সাহায্য করলেন। যখন লনে সাইকেল চালাতে গিয়ে সোফি ভারসাম্য রক্ষা করতে না পেরে দাদুসহ ঘাসের উপর চিৎপটাং হয়ে পড়ে গিয়েছিলো তখন তারা দুজনেই খুব হেসেছিলো।

গ্র্যঁ পেয়া, সোফি এই বলে তার দাদুকে জড়িয়ে ধরেছিলো। ঐ ঘটনার জন্য আমি সত্যি দুঃখিত।

আমি জানি, সুইটি। তোমাকে ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে। তোমার ওপর আমি বেশিক্ষণ রাগ করে থাকতে পারি না। দাদু আর নাতনী সব সময়ই একে অন্যকে মাফ করে দেয়।

সোফি জানতো তার জিজ্ঞেস করাটা ঠিক হবে না, কিন্তু জিজ্ঞেস না করে থাকতেই পারলো না সে। এটা দিয়ে কি ভোলা হয়? এরকম চাবি আমি কখন দেখিনি। ওটা দেখতে খুব সুন্দর ছিলো।

তার দাদু কিছুক্ষণ নিরব ছিলেন; আর সোফি ভেবে পাচ্ছিলো না তিনি কী বলবেন। দাদু কখনও মিথ্যা বলেন না।

এটা দিয়ে একটা বাক্স খোলা হয়, অবশেষে তিনি বলে ছিলেন। সেখানে আমি অনেক গোপন কিছু লুকিয়ে রেখেছি।

সোফি কপট অভিমানের সুরে বলে ছিলো, আমি গোপনীয়তাকে ঘৃণা করি!

সেটা আমি জানি, কিন্তু এসব গোপনীয়তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একদিন তুমি আমার মতোই এটা সংরক্ষণ করবে।

আমি চাবির ওপরের অক্ষরগুলো দেখেছি, একটা ফুলও।

হ্যাঁ, আমার প্রিয় ফুল। এটাকে ফ্লার-দ্য-লিস বলা হয়। আমাদের বাগানে এগুলো আছে। সাদা রঙেরগুলো। ইংরেজিতে এ ধরনের ফুলকে আমরা বলি লিলি।

এগুলো আমি চিনি। এগুলো আমার প্রিয় ফুল!

তাহলে আমি তোমার সাথে একটা চুক্তি করি। তার দাদুর চোখ দুটো কপালে উঠে গিয়ে ছিলো, যেমনটি তিনি করে থাকেন তাকে একটা চ্যালেঞ্জ দেয়ার সময়। তুমি যদি আমার চাবিটার কথা গোপন রাখো, এবং এ ব্যাপারে কারো সাথে, এমনকি আমার সাথেও আর কখনও আলোচনা না করো, তবে একদিন তোমাকে আমি এটা দিয়ে দেবো।

সোফি তার নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছিলো না।

সত্যি?

আমি প্রতীজ্ঞা করছি। সময় এলে, চাবিটা তোমার হয়ে যাবে। এটাতে তোমার নাম লেখা আছে।

সোফি অবিশ্বাসে তাকালো। না, তাতে নেই। এটাতে পি এস লেখা আছে। আমার নাম তো পি এস নয়!

তার দাদু কণ্ঠটা নিচে নামিয়ে নিয়ে ছিলেন, যেনো অন্য কেউ কথাটা শুনতে না পায়। ঠিক আছে, সোফি, যদি তুমি জানতেই চাও তো শোনো, পিএস হলো একটা কোড। এটা তোমার গোপন নামেরই আদ্যক্ষর।

তার চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গিয়ে ছিলো। আমার গোপন নাম আছে?

অবশ্যই। নাতনীদের সবসময়ই একটা গোপন নাম থাকে, যা তাদের দাদুরাই কেবল জানে।

পি এস?

তিনি সোফিকে আলতো করে টোকা দিলেন। প্রিন্সেস সোফি।

সে মাথা দোলালো। আমি তো প্রিন্সেস নই!

তিনি আশ্বস্ত করে বলেছিলেন। আমার কাছে তুমি তা-ই।

সেদিন থেকে তারা আর চাবিটা নিয়ে কোন কথা বলেনি। আর সেও হয়ে উঠলো প্রিন্সেস সোফি।

 

সলদে এতাত্-এর ভেতরে সোফি নিরবে দাঁড়িয়ে হারানোর সুতীব্র বেদনায় আচ্ছন্ন হয়ে গেলো।

আদ্যক্ষরটা, তার চোখের দিকে অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে ল্যাংডন ফিসফিস্ করে বললো। তুমি কি ওগুলো দেখেছো?

সোফির মনে হলো, তার দাদুর কণ্ঠস্বরটা জাদুঘরের করিডোর থেকে ভেসে আসছে। এই চাবিটা সম্পর্কে কখনও কিছু বলবে না, সোফি। আমার সাথে কিংবা অন্য কারোর সাথে। তার মনে পড়ে গেলো, পিএস, রবার্ট ল্যাংডনকে খুঁজে বের করো। তার দাদু ল্যাংডনের কাছে সাহায্য চেয়েছেন। সোফি মাথা নাড়লো। তা, আমি পিএস অক্ষরটা একবার দেখেছি। তখন আমি খুব ছোট ছিলাম।

কোথায়?

সোফি দ্বিধাগ্রস্ত হলো। তাঁর কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এমন কোন কিছুতে।

ল্যাংডন তার চোখে চোখ রাখলো।

সোফি, এটা খুবই জরুরি। তুমি কি আমাকে বলতে পারো, আদ্যক্ষরটা একটা প্রতীকে ছিলো কিনা? একটা ফ্লার-দ্য লিস-এ?

সোফি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলো। কিন্তু…তুমি সেটা কীভাবে জানতে পারলে।

ল্যাংডন নিঃশ্বাস ছেড়ে নিচু কণ্ঠে বললো, আমি খুবই নিশ্চিত যে, তোমার দাদু একটি গোপন সংগঠনের সদস্য ছিলেন। খুবই পুরাতন, একটা গোপন ভ্রাতৃসংঘ।

সোফির মনে হলো তার পেটের ভেতরে কোন কিছু গিট দিয়ে শক্ত করে বেঁধে রাখা হয়েছে। সেও এ ব্যাপারে খুব নিশ্চিত ছিলো। বিগত দশ বছর ধরে সে ঐ দুঃসহ ঘটনাটা ভুলতে চেষ্টা করেছে। সে অচিন্তনীয় কিছু একটা দেখে ফেলেছিলো। ক্ষমার অযোগ্য।

ফ্লার-দ্য-লিস, ল্যাংডন বললো, পি এস অক্ষর সংবলিত, এটা ভ্রাতৃসংঘের নিজস্ব প্রতীক। তাদের লোগো।

তুমি এটা কীভাবে জানো? সোফি মনে মনে প্রার্থনা করতে লাগলো যেনো ল্যাংডন আবার না বলে বসে যে, সে নিজেও ঐ সংগঠনের সদস্য।

আমি এই দলটির সম্পর্কে লিখেছি, সে বললো, তার কণ্ঠ উত্তেজনায় কাঁপছে। গোপন সংগঠনের প্রতীক নিয়ে গবেষণা করাই আমার বিশেষত্ব। তারা নিজেদেরকে ডাকে প্রায়োরি দ্য সাইওন বলে অর্থাৎ প্রায়োরি অব সাইওন। তারা ফ্রান্স ভিত্তিক হলেও, সারা ইউরোপ থেকে শক্তিশালী সদস্য আকর্ষিত করে থাকে। সত্যি বলতে কী, তারা এই পৃথিবীর সবচাইতে প্রাচীন গোপন সংগঠন।

সোফি তাদের ব্যাপারে কখনও কিছু শোনেনি।

ল্যাংডন এবার ক্রমাগতভাবে এ ব্যাপারে বলতে শুরু করলো।

প্রায়োরি অব সাইন ইতিহাসের অনেক বিখ্যাত সংস্কৃত ব্যক্তিত্বকে অর্ন্তভূক্ত করেছিলো : বত্তিচেল্লি, স্যার আইজাক নিউটন, ভিক্টর হুগোর মতো মানুষদেরকে। সে একটু থামলো। তার কণ্ঠটা এখন শিক্ষকের মতো শোনাচ্ছে। এবং লিওনার্দো দা ভিঞ্চি।

সোফি তার দিকে চেয়ে রইলো। দা ভিঞ্চি গোপন সংগঠনে ছিলেন?

দা ভিঞ্চি প্রায়োরিতে ১৫১০ থেকে ১৫১৯ সাল পর্যন্ত গ্র্যান্ড মাস্টার হিসেবে অধিষ্ঠিত ছিলেন। এতে তোমার দাদুর লিওনার্দো প্রীতি সম্পর্কে জানতে সাহায্য করবে। দুজনেই ঐতিহাসিক একটা দলিলে চুক্তিবদ্ধ ছিলেন। আর এটা তাদের দুজনেরই দেবীদের আইকননালজি, প্যাগান মতবাদ, নারীত্ব এবং চার্চবিরোধী কৌতূহলের সাথে খাপ খেয়ে যায়। পবিত্র নারী সম্পর্কে প্রায়োরিদের কাছে যথেষ্ট দলিল-দস্তাবেজ রয়েছে।

তুমি বলছো এই দলটি প্যাগান দেবীদের পূজক?

প্যাগান দেবীদের পূজকের চেয়েও বেশি কিছু। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, তারা একটি প্রাচীন সিক্রেট অর্থাৎ গুপ্ত ব্যাপারের অভিবাবক হিসেবেই বেশি পরিচিত। এটা এমন একটা জিনিস, যা তাদেরকে সীমাহীন শক্তিশালী করে তুলেছিলো।

ল্যাংডনের কথাবার্তা সোফির কাছে অবিশ্বাস্য শোনালো। গোপন প্যাগান পূজক। এক সময় লিওনার্দো দা ভিঞ্চি তার প্রধান ছিলেন? এস কথা শুনতে একদম অর্থহীন বলে মনে হচ্ছে। তারপরও, এসব বাতিল করে দিলেও, তার মন ফিরে গেলো দশ বছর আগে রাতে, সে ভুলক্রমে তার দাদুকে দেখে যারপরনাই অবাক হয়েছিলো। এমন কিছু দেখে ফেলেছিলো সে যা কখনও মেনে নিতে পারেনি। এটাকে কি ব্যাখ্যা করা যায়–?

প্রায়োরিদের জীবন্ত সদস্যদের পরিচিতি খুবই গোপনীয় একটি ব্যাপার, ল্যাংডন বললো, কিন্তু তুমি ছোটবেলায় যে পিএস এবং ফ্লার-দ্য-লিস দেখেছিলে, সেটাই প্রমাণ করে, এটা কেবল প্রায়োরিদের সাথেই সংশ্লিষ্ট।

সোফি এখন বুঝতে পারলো যে, ল্যাংডন তার দাদু সম্পর্কে তার চেয়েও অনেক বেশি জানে। এই আমেরিকানটার অবশ্যই অনেক কিছু আছে যা তার সাথে ভাগ করা উচিত। কিন্তু এটা সেই জায়গা নয়। আমি তোমাকে তাদের হাতে ধরা পড়তে দিতে পারি না। রবাট, আমাদের অনেক কিছু নিয়েই কথা বলতে হবে। তোমাকে যেতে হবে!

ল্যাংডন কেবলমাত্র সোফির বিড়বিড় করাটাই শুনতে পেলো। সে কোথাও যাচ্ছে। অন্য আরেকটা জায়গায় সে হারিয়ে গেছে এখন। এমন এক জায়গায় যেখানে প্রাচীন গুপ্ত গোলাপটি উদয় হয়েছে। এমন এক জায়গায়, যেখানে বিস্মৃত ইতিহাস অন্ধকার থেকে বেড়িয়ে আসছে, ধীরে ধীরে।

ধীরে, যেনো পানির নিচে নড়ছে; ল্যাংডন তার মাথাটা ঘুরিয়ে লাল আলোর ঘোলাটে পরিবেশে থাকা মোনালিসার দিকে তাকালো।

ফ্লার-দ্য-লিস…দ্য ফ্লাওয়ার অব লিসা…মোনালিসা।

একটা আরেকটার সাথে সংশ্লিষ্ট। একটা নিঃশব্দ সিম্ফোনি প্রায়োরি অব সাইন আর লিওনার্দো দা ভিঞ্চির গহীন গোপনীয়তাকে প্রতিধ্বনিত করতে লাগলো।

 

কয়েক মাইল দূরে, লে ইনভ্যালিদ পেরিয়ে, একটা নদীর তীরে, হতভম্ব এক ট্রাক ড্রাইভার অস্ত্রমুখে দাঁড়িয়ে আছে। পুলিশ জুডিশিয়ারের ক্যাপ্টেন ট্রাকের পেছন থেকে একটা সাবানের টুকরো পেয়ে রাগে ফুঁসে ওঠে সিন নদীতে সাবানটা ছুঁড়ে ফেলে দিলো।

 

২৪.

সাইলাস সেন্ট-সালপিচের অবিলিস্কটার দিকে তাকালো, বিশাল আর দীর্ঘ মার্বেলের গাঁথুনীটা দেখে হতাশ হলো। তার মাংসপেশী উত্তেজনায় আড়ষ্ট হয়ে আছে। সে চার্চের চারপাশটা আবার তাকিয়ে দেখলো নিশ্চিত হবার জন্য যে, সে একাই আছে এখানে। তারপর হাঁটু গেঁড়ে ওটার নিচে বসে পড়লো, শ্রদ্ধা বোধ থেকে নয়, প্রয়োজনে।

কি-স্টোনটা রোজ লাইনর নিচে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। সালপিচের অবিলিস্কটার গাঁথুনীর নিচে।

ভ্রাতৃসংঘের সবাই একই কথা বলেছিলো।

হাটু গেঁড়েই সাইলাস পাথরের জমিনে হাত দিয়ে খুঁজে ফিরলো আগা টাইলসের কোন ফাঁটল অথবা দাগ আছে কি না, যাতে সে বুঝতে পারে কোন টাইলসটা সরানো যাবে। মুষ্টিবদ্ধ হাতটা আলতো করে জমিনে আঘাত করতে লাগলো। সবগুলো টাইলসই পরীক্ষা করে দেখতে লাগলো সে। শেষ পর্যন্ত, একটা টাইলস থেকে অদ্ভুত প্রতিধ্বনি শোনা গেলো।

সাইলাসের ঠোঁটে হাসি দেখা গেলো, আর সেই সাথে বেলকনি থেকে সিস্টার সানভৃনের দীর্ঘ নিঃশ্বাসটাও বাতাসে ভেসে এলো। তাঁর গভীর অন্ধকার ভীতিটা এইমাত্র নিশ্চিত হলো। এই অতিথি সেরকম কেউ নয়, যে রকমটা তিনি মনে করেছিলেন। ওপাস দাইর রহস্যময় সন্ন্যাসীটা সেন্ট সালপিচে অন্য কোন উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছে।

একটা গোপন উদ্দেশ্য।

গোপনীয় কিছুর তুমিই একমাত্র ব্যক্তি নও, তিনি ভাবলেন। সিস্টার সানড়ন এই চার্চের একজন তত্ত্বাবধায়কের চেয়েও বেশি কিছু। তিনি একজন প্রহরীও বটে। আর আজ রাতে, সেই পুরনো চাকাটা আবার ঘুরতে শুরু করেছে। এই আগষুকের অবিলিস্কের গাঁথুনীর নিচে এসে কিছু খোঁজাটা ভ্রাতৃসংঘের একটা সংকেত।

এটা একটা নিরব যন্ত্রণার ডাক।

 

২৫.

প্যারিসের ইউএস এ্যামবাসি শাম্প এলিসির দক্ষিণের গ্যাবৃয়েল এভিনুর একটা ছোটখাটো কমপ্লেক্সে অবস্থিত। এই তিন একরের জায়গাটিকে যুক্তরাষ্ট্রের মাটি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তার অর্থ, যে এখানে এসে পড়বে, সে-ই যুক্তরাষ্ট্রের আইন আর আশ্রয়ের অনুরূপ, একই রকম অধিকার ভোগ করবে।

এ্যামবাসির রাত্রিকালীন অপারেটর টাইম ম্যাগাজিনের আন্তর্জাতিক সংস্করণটা হাতে নিয়ে পড়ছিলো। ফোনটা বেজে ওঠায় সে বিরক্ত হলো।

ইউএস এ্যামবাসি, মেয়েটা বললো।

শুভ সন্ধ্যা। ফোনের অপর পাশ থেকে ফরাসি টানে ইংরেজিতে বললো। আমার একটু সাহায্যের দরকার। লোকটার কথাবার্তায় ভদ্রতা আর মার্জিতভাব থাকা সত্ত্বেও, তার কণ্ঠটা কট্রটে আর খুব বেশি কর্তৃত্বপরায়ণ শশানাচ্ছিলো। আমাকে বলা হয়েছিলো যে, আপনাদের কাছে আমার একটা মেসেজ রয়েছে, অটোমেটেড সিস্টেমে। নাম ল্যাংডন। দুঃখের বিষয়, আমি আমার তিন ডিজিটের কোডটা ভুলে গেছি। আপনি যদি সাহায্য করতে পারেন, তবে আমি খুবই কৃতজ্ঞ থাকবো।

অপারেটর একটু চুপ মেরে গেলো, দ্বিধাগ্রস্ত মনে হলো। আমি দুঃখিত স্যার, আপনার মেসেজটা অনেক দিন আগের হয়ে থাকবে। এই সিস্টেমটা দুবছর আগে নিরাপত্তাজনিত কারণে বদলে ফেলা হয়েছে। এখন সবগুলো একসেস কোড হলো পাঁচ ডিজিটের। আপনাকে কে বলেছে, আমাদের কাছে আপনার মেসেজ রয়েছে?

আপনাদের কাছে কোন অটোমেটেড ফোন সিস্টেম নেই?

না, স্যার। আপনার কোন মেসেজ আমাদের সার্ভিস ডিপার্টমেন্টে থাকলে সেটা হাতে লেখায় হতে হবে। আপনার নামটা যেনো কী বললেন?

ইতিমধ্যেই ওপাশের লোকটা ফোন রেখে দিলো।

সিন নদীর তীরে পায়চারি করতে থাকা বেজু ফশের মনে হলো, সে বধির হয়ে গেছে। সে একেবারেই নিশ্চিত, ল্যাংডনকে সে লোকাল নাম্বারে ডায়াল করতে দেখেছে তিন সংখ্যার কোডটা দিয়ে। তারপর রেকর্ডিং করা মেসেজও সে শুনেছে। কিন্তু ল্যাংডন যদি এ্যামবাসিতেই ফোন না করে থাকে, তবে সে করলো কার কাছে? সাথে সাথেই তার চোখ গেলো সেলুলার ফোনের দিকে। ফশে বুঝতে পারলো উত্তরটা তার হাতের মুঠোয়ই আছে। ফোনটা করার জন্য ল্যাংডন আমার ফোনই ব্যবহার করেছিলো।

ফোনের মেনু বাটনটা চেপে সাম্প্রতিক করা ফোন কলের নাম্বারগুলো চেক্ করে ল্যাংডনের করা নাম্বারটা খুঁজে পেলো সে।

প্যারিসের একটা নাম্বার, তারপর সেটা তিন সংখ্যার কোড নাম্বার ৪৫৪-তে ডায়াল করা।

সেই নাম্বারটা পুণরায় ডায়াল করে ফশে লাইনটা পাবার জন্যে অপেক্ষা করলো।

অবশেষে, একটা নারী কন্ঠের জবাব এলো। বজুঁখ, ভু ইতে ব্যুঁ শেজ সোফি নেভু, রেকর্ড করা কণ্ঠটা বললো। জো সুই এবসেস্তে পুর লো মেমোয়া, মেই…

৪…৫…৪, সংখ্যাটা ডায়াল করার সময় ফশের রক্ত বলক দিয়ে উঠলো।

 

২৬.

সুবিশাল খ্যাতি থাকা সত্ত্বেও, মোনালিসা মাত্র একত্রিশ ইঞ্চি লম্বা আর একুশ ইঞ্চি চওড়া—এমনকি লুভরের গিফট শপে বিক্রি হওয়া পোস্টারের চেয়েও এটা আকারে ছোট। সল দে এতা-এর উত্তর-পশ্চিম দেয়ালে, দুই ইঞ্চি পুরু বুলেট প্রুফ গ্লাসের পেছনে এটা টাঙানো রয়েছে। এটা আঁকা হয়েছে পপুলার কাঠের ওপর। তার ধোঁয়াটে, কুয়াশাচ্ছন্ন পরিবেশটা লিওনার্দো দা ভিঞ্চির ফুমাতো স্টাইলের অনন্য সাধারণ কীর্তির স্বাক্ষর বহন করছে। এই স্টাইলে ফর্মগুলো একটার উপর আরেকটা ঘোয়াটে হয়ে আর্বিভূত হয়। লুভরে স্থান পাওয়ার পর থেকে মোনালিসা অথবা লা জকোন্দো, যেমনটি তাকে ফ্রান্সে ডাকা হয় দু দুবার চুরি হয়েছিলো। সাম্প্রতিক কালেরটা হয়েছিলো ১৯১১ সালে, যখন সে লুভরের সল ইমপেনেট্রেবল থেকে উধাও হয়েছিলো। প্যারিসবাসী রাস্তা-ঘাটে কান্নাকাটি করে, সংবাদপত্রে কলাম লিখে, চোরের কাছে ছবিটা ফিরে পাবার আবেদন জানিয়েছিলো। দুবছর বাদে, মোনালিসা ফ্লোরেলের একটা হোটেল কক্ষের ট্রাঙ্কের গোপন কুঠুরি থেকে উদ্ঘাটিত হয়েছিলো।

ল্যাংডন, এখন সোফিকে স্পষ্ট জানিয়ে দিলো যে, তার চলে যাবার কোন ইচ্ছেই নেই। সোফির সাথেই সে সল দে এতা-এ ঢুকলো। সোফি ব্ল্যাক লাইটটা যখন জ্বালালো তখনও মোনালিসা বিশ গজ দূরে। হালকা নীল ক্রিসেন্ট আলোটা ফ্লোরের উপর গিয়ে পড়লো। সোফি আলোটা ফ্লোরে এমনভাবে নিক্ষেপ করলো যেনো ফ্লোরটা ঝাড়া মোছা করছে। লুমিনিসেন্ট কালি আছে কি না খুঁজে দেখলো সে।

তার পাশে হাটতে হাটতে ল্যাংডনের মনে হলো, বিখ্যাত চিত্রকর্মগুলো মুখোমুখি দেখার সুযোগটা আবারো আসলো। তার বাম দিকে, ঘরের মাঝখানে কাঠের ফ্লোরে রাখা আটকোনা বেঞ্চিটাকে অন্ধকারে মনে হচ্ছিলো একটা ফাঁকা কাঠের সমুদ্রে ভেসে থাকা দ্বীপ।

ল্যাংডন এবার দেয়ালের কালো গ্লাসের প্যানেলটা দেখতে পেলো। সে জানতো, এটার পেছনেই, নিজের ঘরে বন্দী হয়ে আছে বিশ্বের সবচাইতে খ্যাতিমান চিত্রকর্মটি।

ল্যাংডন জানে, বিশ্বের সবচাইতে বিখ্যাত চিত্রকর্ম হিসেবে মোনালিসার যে অবস্থান তার সাথে রহস্যময় হাসির কোন সম্পর্ক নেই। অনেক চিত্রসমালোচক আর ষড়যন্ত্র খুঁজে বেড়ানো ভক্তের রহস্যময় ব্যাখ্যার জন্যেও নয়। খুব সহজেই বলা যায়, মোনালিসা বিখ্যাত, কারণ লিওনার্দো দা ভিঞ্চি দাবি করেছিলেন যে, এটা তার সবচাইতে সেরা কাজ। তিনি যেখানেই যেতেন, ছবিটা সঙ্গে নিয়ে নিতেন। যদি জিজ্ঞেস করা হয় কেন, জবাবটা হলো, তিনি এতে তার নারী সৌন্দর্যের সূক্ষ্মপ্রকাশ ঘটাতে পেরেছিলেন।

তারপরও, চিত্রকলার ইতিহাসবিদদের অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন যে, দা ভিঞ্চি মোনালিসাকে শ্রদ্ধা করেছেন তার শৈল্পিক রহস্যের জন্য নয়। সত্যি বলতে কী, ছবিটা বিস্ময়করভাবেই ফুমাতে পোট্রেটের একটি সাধারণ কাজ। এই কাজের জন্য দা। ভিঞ্চির প্রশংসা, অনেকেই দাবি করে, এর অন্তর্নিহিত কিছুর জন্যেই : ছবিটার পরতে পরতে লুকায়িত কোন মেসেজের জন্য। মোনালিসা, সত্যি বলতে কী, পৃথিবীর সবচাইতে নথিবদ্ধ বিখ্যাত অর্ন্তনিহিত একটি জোক। সাম্প্রতিক সময়ে এই ছবিটির দ্ব্যর্থবোধকতা আর ঐন্দ্রজালিক ব্যাপারটি উন্মোচিত হলেও, অবিশ্বাস্যভাবেই, এটা এখনও তার হাসির জন্যেই বিশাল রহস্য হয়ে আছে।

কোন রহস্যই নেই, ল্যাংডন ভাবলো। সে সামনের দিকে এগিয়ে গেলো সোফির পাশাপাশি। কোন রহস্যই নেই।

অতিসম্প্রতি, ল্যাংডন মোনালিসার রহস্যময়তা আর গুপ্তব্যাপারটি নিয়ে একদল অদ্ভুত লোকের চিন্তাভাবনার সাথে পরিচিত হয়েছিলো—এসেক্সের কাউন্টি জেলের একদল কয়েদী। ল্যাংডনের এই জেল সেমিনারটা ছিলো হারভার্ডের জেলখানায় শিক্ষা দীক্ষার প্রকল্পের একটি অংশ বিশেষ অপরাধীদের জন্য সংস্কৃতি, ল্যাংডনের সহকর্মীরা এটাকে এই নামেই উল্লেখ করেছিলো।

জেলখানার লাইব্রেরির অন্ধকার একটি কক্ষে, মাথার ওপর একটা প্রজেক্টর নিয়ে ল্যাংডন কয়েদীদের সাথে মোনালিসার রহস্য আর গুপ্ত ব্যাপারটা আলোচনা করেছিলো। ওখানে সে দেখতে পেয়েছিলো, লোকগুলো বিস্ময়করভাবেই খুব। মনোযোগী রাফ এন্ড টাফ, কিন্তু প্রখর বুদ্ধিমত্তার অধিকারী। আপনারা হয়তো খেয়াল করে থাকবেন, প্রজেক্টর থেকে মোনালিসার ছবিটা লাইব্রেরির দেয়ালে প্রক্ষেপন করে সেখানে হেটে গিয়ে ল্যাংডন তাদের বলেছিলো, তার পেছনের দৃশ্যপটটা অসমান। ল্যাংডন তাদের দিকে ঘুরে বললো, দা ভিঞ্চি বাম দিকের আনুভূমিক রেখাটা উদ্দেশ্যমূলকভাবেই ডান দিকের চেয়ে একটু নিচু করে এঁকেছেন।

দা ভিঞ্চি এটাকে টাল করে ফেলেছেন? কেউ একজন বলেছিলো।

ল্যাংডন কথাটাতে খুব মজা পেয়ে ছিলো। না, দা ভিঞ্চি এরকমটা হরহামেশা করতেন না। আসলে এটা দা ভিঞ্চির একটা ছোটখাটো চালাকি। বাম দিকের নৈসর্গিক দৃশ্যটা একটু নিচু করে দেয়ায়, মোনালিসাকে ডান দিকের তুলনায়, বাম দিক থেকে একটু বড় দেখা যায়। এটা দা ভিঞ্চির একটা ছোট্ট অর্ন্তনিহিত জোক। ঐতিহাসিকভাবে নারী আর পুরুষের অবস্থানগত হিসাবটা হলো বাম দিক নারীর। ডান দিক পুরুষের। যেহেতু দা ভিঞ্চি নারীবাদের একজন বড় ভক্ত ছিলেন, তাই তিনি মোনালিসাকে এমনভাবে একেছেন যেনো, ডান দিকের তুলনায় বাম দিক থেকে তাকে বেশি অভিজাত আর বড় দেখায়।

আমি শুনেছি, তিনি একজন সমকামী ছিলেন, ছোটখাটো ছাগলা দাড়িওয়ালা এক লোক বললো।

ল্যাংডন চোখ কুচকে বললো, ঐতিহাসিকরা সাধারণত ব্যাপারটাকে এভাবে দেখেন না, কিন্তু এটা সত্যি, দা ভিঞ্চি একজন সমকামী ছিলেন।

একজন্যেই কি তিনি এইসব নারী সংক্রান্ত বিষয়ে আগ্রহী ছিলেন?

আসলে, দা ভিঞ্চি ছিলেন নারী এবং পুরুষের মধ্যেকার ভারসাম্যপূর্ণ একজন ব্যক্তিত্ব। তিনি বিশ্বাস করতেন, মানুষের মধ্যে যততক্ষণ না, নারীপুরুষ উভয়ের উপাদান থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তার আত্মা আলোকিত হবে না।

তার মানে, বলতে চাচ্ছেন, পুরুষের মধ্যে মেয়েলীপনা থাকতে হবে? কেউ একজন বললো।

কথাটা শুনে ঘরের মধ্যে একটা হাসির রোল পড়ে গেলো। ল্যাংডন ভাবলো Hermaphrodite শব্দটির শাব্দিক ব্যাখ্যাটা আলোচন করবে, যা Hermes আর Aphrodite শব্দের সম্মিলনে তৈরি হয়েছে। কিন্তু তার কাছে মনে হলো, এটা হয়তো এই হৈহল্লার মধ্যে হারিয়েই যাবে।

এই, মি. ল্যাংফোর্ড, শক্তপেশীর এক লোক বললো, এটা কি সত্য যে, মমানালিসা দা ভিঞ্চির নিজের ছবিরই অনুকরণ? আমি শুনেছি, এটা সত্যি।

এটা খুবই সম্ভব, ল্যাংডন বললো, দা ভিঞ্চি একজ খেয়ালি মানুষ ছিলেন। কম্পিউটারের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, মোনালিসা এবং দা ভিঞ্চির আত্ম-প্রতিকৃতির সাথে অদ্ভুত রকমের সাদৃশ্য রয়েছে। দা ভিঞ্চি যা-ই করে থাকুক, ল্যাংডন বললো, তার মোনালিসা না পুরুষ, না নারী। এটা আসলে দুটোরই মিলিত রূপ।

আপনি নিশ্চিত, এটা হরাভার্ডের সেই হাজামজা জিনিস না, যারা বলে, এটা হলো এক কুৎসিত ছুক্‌রি।

ল্যাংডন হেসে ফেললো। আপনি হয়তো ঠিক বলেছেন। কিন্তু দা ভিঞ্চি আসলে যথেষ্ট কু রেখে গেছেন যে, ছবিটা উভয়লিঙ্গের। এখানে কেউ কি মিশরীয় দেবী আমন এর নাম শুনেছেন?

হ্যাঁ-হ্যাঁ। বিশালাকৃতির লোকটা বললো। পুরুষ উর্বরতার দেবতা!

ল্যাংডন দারুণ অবাক হলো।

এটা আমন কনডমের প্রতিটি প্যাকেটেই বলা আছে। পেশীবহুল লোকটা চওড়া একটা হাসি দিলো। এটাতে একটা ভেড়া-মাথার পুরুষ রয়েছে আর বলা হয়েছে, সে হলো মিশরীয় উর্বরতার দেবতা।

ল্যাংডন অবশ্য এই কনডম কোম্পানির নামটার সাথে পরিচিত ছিলো না। তার পরও সে খুব খুশি হলো যে, প্রস্তুতকারকরা তাদের সঠিক হায়ারোগ্লিফস ঠিকই ধরতে পেরেছে। খুব ভালো। আমন সত্যি ভেড়া মাথাওয়ালা পুরুষকেই প্রতিনিধিত্ব করে আর তার বাঁকানো শিং দুটো আমাদের আধুনিক যৌন স্ল্যাং Hornyর সাথে সংশ্লিষ্ট।

কী!

কী, ল্যাংডনও পাল্টা বললো। আপনারা কি জানেন, আমনের সঙ্গী কে ছিলো? মিশরীয় উর্বরতার দেবী? প্রশ্নটা কয়েক মুহূর্তের নিরবতার আবহ তৈরি করলো।

আইসিস, ল্যাংডন তাদের বললো। একটা কলম হাতে তুলে নিলো সে। তো, আমরা পুরুষ দেবতা আমনকে পেলাম। সে নামটা লিখে ফেললো। আর নারী দেবী আইসিস, যার প্রাচীন প্রতীকটাকে ডাকা হতো LISA বলে। ল্যাংডন লেখা শেষ করে প্রজেক্টরের সামনে থেকে সরে দাঁড়ালো।

AMONLISA

কিছু বোঝা যাচ্ছে? সে জিজ্ঞেস করলো।

Mona Lisa … পবিত্র জঞ্জাল, কেউ একজন ফোঁস করে উঠলো।

ল্যাংডন মাথা নেড়ে সায় দিলো। ন্দ্রমহোদয়গণ, মোনালিসার চেহারাটা শুধুমাত্র উভলিঙ্গেরই নয়, তার নামটাও নারী-পুরুষের স্বর্গীয় ঐক্যের একটি এনাগ্রাম। আর এটাই, আমার বন্ধুগণ, দা ভিঞ্চির ছোটখাটো রহস্য আর মোনালিসা যে হাসছে তার কারণ।

 

আমার দাদু এখানেই ছিলেন, সোফি বললো, হঠাৎ করেই মোনালিসা থেকে মাত্র দশ ফিট দূরে হাটু গেঁড়ে বসে পড়লো। সে ব্ল্যাক লাইটের আলোটা কাঠের ফ্লোরে ফেলে খুঁজতে লাগলো কিছু।

প্রথমে ল্যাংডন কিছুই দেখতে পেলো না। তারপর, সেও হাটু গেঁড়ে তার পাশে বসে পড়তেই, দেখতে পেলো ছোট্ট এক ফোটা শুকিয়ে যাওয়া তরল, যা আসলে লুমিনেসিং। কালি? হুট করেই সে বুঝে গেলো ব্ল্যাক লাইটটা যার জন্যে আসলে ব্যবহার করা হয়। রক্ত। তার চিন্তা ভাবনা একটু ধাক্কা খেলো। সোফি ঠিকই বলেছে। জ্যাক সনিয়ে মারা যাবার আগে মোনালিসা দেখতে এসেছিলেন।

তিনি এখানে কোন কারণ ছাড়া আসেননি, সোফি উঠে দাঁড়িয়ে নিচু স্বরে বললো। আমি জানি, তিনি এখানে আমার জন্যে একটা মেসেজ রেখে গেছেন। সে সোজা চলে এলো মোনালিসার ঠিক সামনে। ছবিটার সামনের ফ্লোরে ব্ল্যাক লাইটটা দিয়ে কিছু খুঁজে চললো সে।

এখানে কিছু নেই!

ঠিক সেই মুহূর্তেই, ল্যাংডন মোনালিসার বুলেটপ্রুফ কাঁচের ওপর হালকা বেগুনী রঙের কিছু একটা দেখতে পেলো। সামনে এসে সে সোফির হাতটা ধরে ধীরে ধীরে ব্ল্যাক লাইটটা ছবিটার দিকে নিক্ষেপ করলো।

দুজনেই বরফের মতো জমে গেলো।

কাঁচের ওপর, বেগুনী রঙের ছয়টা শব্দ জ্বল জ্বল করছে। সরাসরি মোনালিসার চেহারা বরাবর।

 

২৭.

সনিয়ের ডেস্কে বসে, লেফটেনান্ট কোলেত অবিশ্বাসে তার কানে ফোনটা ধরলো। আমি ফশের কথা ঠিক ঠিক শুনতে পারছি? একটা সাবানের টুকরো? কিন্তু ল্যাংডন কীভাবে জিপিএস ডটটার কথা জানতে পারলো?

সোফি নেভু, ফশে জবাব দিলো। সে-ই ওকে বলেছে।

কী! কেন?

খুব ভালো প্রশ্ন করেছে, আমি এইমাত্র একটা রেকর্ড করা মেসেজ শুনে বুঝতে পেরেছি সোফিই ওকে সর্তক করে দিয়েছে।

কোলেত বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লো। নেভু কি ভাবছে? ফশের কাছে প্রমাণ রয়েছে, সোফি নেভু ডিসিপিজের অপারেশনে নাক গলিয়েছে? সোফি নেভূকে শুধু বরখাস্তই করা হবে না, জেলেও যেতে হবে। কিন্তু, ক্যাপ্টেন…তাহলে ল্যাংডন এখন কোথায় আছে?

এখানকার কোন ফায়ার এলার্ম কি বেজেছে?

না, স্যার।

আর গ্র্যান্ড গ্যালারির সদর দরজা দিয়ে কেউ কি বের হয়েছে?

না। সদর দরজায় আমাদের নিরাপত্তা অফিসাররা রয়েছে। আপনার অনুরোধেই তাদের রাখা হয়েছে।

ঠিক আছে, ল্যাংডন অবশ্যই গ্র্যান্ড গ্যালারির ভেতরে আছে।

ভেতরে? কিন্তু, সে করছেটা কি?

লুভরের নিরাপত্তা প্রহরী কি সশস্ত্র অবস্থায় রয়েছে?

হ্যাঁ, স্যার। সে একজন সিনিয়র ওয়ার্ডেন।

তাকে ভেতরে পাঠাও, ফশে আদেশ করলো।আমি আমার লোকদেরকে কয়েক মিনিটের মধ্যে সেখানে ফিরে আনতে পারবো না, আর আমি চাই না ল্যাংডন ওখান থেকে বের হয়ে যাক। ফশে একটু থামলো। তুমি প্রহরীকে বলে দাও, এজেন্ট সোফি নেভুও তার সাথেই আছে।

আমার মনে হয়,এজেন্ট নেভু চলে গেছে।

তুমি কি তাকে চলে যেতে দেখেছো?

না, স্যার কিন্তু–

ওখানকার কেউই তাকে চলে যেতে দেখেনি। তারা শুধু তাকে ঢুকতে দেখেছে।

কোলেত সোফি নেভুর সাহসিকতায় দারুণ অবাক হলো। সে এখনও ভেতরেই আছে?

এদিকটা একটু সামলাও, ফশে নির্দেশ দিলো। আমি চাই, ফিরে এসেই যেনো দেখি ল্যাংডন আর সোফি অস্ত্রের মুখে বন্দী হয়ে আছে।

ট্রাকটা চলে যেতেই ক্যাপ্টেন ফশে তার লোকদের জড়ো করলো। রবার্ট ল্যাংডন আজ রাতে একটা লুকোচুরি খেলা শুরু করেছে। আর এখন এজেন্ট নেভু তাকে সাহায্য করছে। ধারণার চেয়েও তাকে বেশি কঠিন বলে মনে হচ্ছে।

ফশে ঠিক করলো, সে কোন সুযোগই দেবে না ওদের। তার লোকদের অর্ধেককে লুভরে ফিরে যেতে বললো সে। বাকি অর্ধেক লোককে প্যারিসের একমাত্র যে স্থানে ল্যাংডন নিজেকে নিরাপদ ভাবতে পারে, সেখানে গিয়ে পাহাড়া দিতে বললো।

 

২৮.

সল দে এতাত-এর ভেতরে ল্যাংডন বুলেট প্রুফ কাঁচের ওপর লেখা ছয়টা শব্দের দিকে বিস্ময়ে চেয়ে রইলো। লেখাগুলো দেখে মনে হচ্ছে বাতাসে ভাসছে। সেগুলোর ছায়া মোনালিসার রহস্যময় হাসির উপরে গিয়ে পড়েছে।

তোমার দাদু, ল্যাংডন নিচু স্বরে বললো।  প্রায়োরিদের একজন সদস্য ছিলেন, এটা তারই প্রমাণ!

সোফি তার দিকে দ্বিধাগ্রস্তভারে তাকালো। তুমি এটা বুঝতে পেরেছো?

এটা খুবই নিখুঁত, ল্যাংডন মাথা নেড়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বললো। এটা প্রায়োরিদের একটি মূল দর্শনকেই ব্যক্ত করছে! মোনালিসার চেহারায় ভেসে থাকা মেসেজটার দিকে হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইলো সে।

SO DARK THE CON OF MAN

সোফি, ল্যাংডন বললো। দেবী পূজার ব্যাপারে প্রায়োরিদের বিশ্বাসের মূলে যে প্রেক্ষাপট রয়েছে সেটা তোমাকে জানতে হবে। খৃস্টিয় চার্চের শুরুর দিকে, ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে পৃথিবীকে নারীদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলেছিলো, যাতে করে পুরো ব্যাপারটা পুরুষতন্ত্রের পক্ষে যায়।

লেখাগুলোর দিকে চেয়ে সোফি নিচুপ রইলো।

প্ৰায়োরিরা বিশ্বাস করে, কনস্টানটিন এবং তার পুরুষ-বংশধরেরা সাফল্যজনকভাবেই মাতৃতান্ত্রিক প্যাগান সমাজকে পিতৃতান্ত্রিক খৃস্টিয় সমাজে রূপান্তরিত করেছিলেন পবিত্র নারীকে ডাইনীকরণের মধ্য দিয়ে, আধুনিক ধর্ম থেকে তাদেরকে চিরতরের জন্য নির্বাসিত করে।

সোফি নির্বাক হয়ে রইলো। আমার দাদু আমাকে এসব জিনিস খুঁজে বের করার জন্য এখানে পাঠিয়েছেন। তিনি অবশ্যই এর চেয়ে বেশি কিছু বলার চেষ্টা করেছেন।

ল্যাংডন বুঝতে পারলো সে কি বোঝাতে চাইছে। সে মনে করছে এটা একটা কোড! এখানে কোন লুকানো অর্থ আছে কী না সেটা ল্যাংডন তৎক্ষণিকভাবে বলতে পারলো না। তার মন সনিয়ের লেখা মেসেজটার কথা ভেবে ভেতরে ভেতরে দারুণ উত্তেজিত বোধ করছিলো।

So dark The con of man অর্থাৎ অন্ধকার মানুষের বিরুদ্ধে, সে ভাবলো। খুবই অন্ধকার। আজকের সমস্যা সংকুল বিশ্বে আধুনিক চার্চ যে, বিশাল জনকল্যাণ মূলক কাজ করেছে সে ব্যাপারটা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না, তারপরও বলতে হয়, চার্চের রয়েছে খুবই জঘন্য আর হিংসাত্মক এক ইতিহাস। তাদের বর্বর ক্রুসেড তিন শতাব্দী ধরে প্যাগান আর নারী পূজারীদের পুণঃদীক্ষা করেছে। আর এসব করতে গিয়ে তারা এমন সব পদ্ধতি ব্যবহার করেছিলো, যা এতোটাই বিভীষিকাময় ছিলো যে তারা আরো বেশি উৎসাহী হয়ে উঠেছিলেন।

ক্যাথলিক ইনকুইজিশন একটা বই প্রকাশ করেছে যাকে মানব ইতিহাসের সবচাইতে রক্তাক্ত-ঘামের প্রকাশনা হিসেবে বলা যেতেই পারে। মালিয়াস মেল ফিকারাম অথবা ডাইনী শায়েস্তাকরণ—এমন একটি মতবাদ, যাতে বলা হয়েছে মুক্তচিন্তার নারীরা বিপজ্জনক। আর পুরোহিতদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, কীভাবে তাদেরকে খুঁজে বের করে অত্যাচার করে ধ্বংস করা যেতে পারে। চার্চ যাদেরকে ডাইনী বলে মনে করেছিলো তাদের মধ্যে জ্ঞানী, নারী যাজক, জিপসি, আধ্যাত্মিক নারী ব্যক্তিত্ব, প্রকৃতি প্রেমী, লতাপাতা সংগ্রহকারী এবং প্রাকৃতিক বিশ্বের সাথে মিলে যায় এমন যে কোন নারী। ধাত্রীদেরকেও হত্যা করা হয়েছিলো তাদের উত্তরাধিকারী সূত্রে পাওয়া বাচ্চা প্রসবের সময় প্রসূতির বেদনা লাঘবের কৌশলের জন্য প্রসব বেদনাটা, চার্চের দাবি অনুসারে, হাওয়া স্বর্গ থেকে জ্ঞানের গন্ধম ফল খাওয়ার জন্য ঈশ্বর প্রদত্ত একটি ন্যায়সঙ্গত শাস্তি। এভাবেই তারা প্রসব বেদনার মধ্য দিয়ে আদি পাপের শাস্তি বহন করে। তিন শত বছর ধরে ডাইনী শিকারের সময়ে চার্চ অবিশ্বাস্য সংখ্যক পঞ্চাশ লক্ষ নারীকে জীবন্ত পুড়িয়ে মেরেছিলো।

প্রচারণা আর রক্তপাত বেশ ভালোই কাজে লেগেছিলো। সফল হয়েছিলো তারা। আজকের এই পৃথিবীই তার সব চেয়ে বড় প্রমাণ।

এক সময় আধ্যাত্মিক উজ্জীবনের অর্ধেক হিসেবে যে নারী গণ্য হতো, তারা এই পৃথিবীর ধর্মশালা থেকে একেবারেই উৎখাত হয়ে গেছে। বর্তমান বিশ্বে কোন নারী অর্থোডক্স রাব্বি নেই, কোন নারী ক্যাথলিক যাজক নেই, এমন কি ইসলামী দুনিয়ায় কোন নারী ধর্মীয় নেতাও নেই। এক সময় যে হায়ারোস গামোস অর্থাৎ নারী পুরুষের স্বাভাবিক সঙ্গমের মাধ্যমে আধ্যাত্মিকতার পূর্ণতায় পৌঁছানো কাজটাকে ভক্তি করা হতো, সেটাই হয়ে উঠলো লজ্জাজনক একটি কাজ। সাধুপুরুষরা এক সময় ঈশ্বরের সাথে মিলিত হবার জন্যে তাদের নারী সঙ্গীদের সাথে যৌন মিলনে লিপ্ত হতেন। সেই তাঁরাই তাঁদের স্বাভাবিক যৌন তাড়নাকে শয়তানের কাজ বলে মনে করতে শুরু করলেন। নারীদের সাথে মিলিত হওয়াটা শয়তানি কাজ হিসেবে বিবেচনা করা হলো।

নারীদের সাথে সংশ্লিষ্ট, বাম দিকটাও চার্চের হাত থেকে রেহাই পায়নি। ফ্রান্স এবং ইতালিতে, বাম শব্দটার অর্থ গশে এবং সিনিস্ত্রা—এটা এসেছে খুবই নেতিবাচক অর্থ থেকে। যেখানে ডান দিকের সঙ্গী হলো সততা নিরপেক্ষতা আর বিশুদ্ধতার প্রতীক, সেখানে আজকের দিনেও, উগ্রবাদী চিন্তাসমূহকে বলা হয় বামপন্থী, অযৌক্তিক চিন্তাকে বলা হয় বাম মস্তিস্ক, আর শয়তানী ব্যাপারকে বলা হয় সিনিস্তার।

দেবীদের দিন শেষ হয়ে গেছে। পেন্ডুলামটা ঝুলছে। ধরিত্রী জননী হয়ে উঠেছে পুরুষের বিশ্ব। আর তাই ধ্বংসের দেবতা এবং যুদ্ধ ব্যাপক প্রাণহানি ঘটাচ্ছে এই বিশ্বে। পুরুষ অহংবোধটা তাদের নারী সঙ্গীদের অলক্ষ্যে দুই হাজার বছর কাটিয়ে দিয়েছে। প্রায়োরি অব সাইওন বিশ্বাস করে, পবিত্র নারীকে এভাবে দমন করার জন্য আমাদের আধুনিক জীবন হয়ে গেছে আমেরিকান আদিবাসিরা যাকে বলে কয়ানিস কোয়াসি অর্থাৎ ভারসাম্যহীন জীবন—একটা অস্থিতিশীল অবস্থা, যা নারী বিদ্বেষী সমাজের আধিক্য আর পুরুষতান্ত্রিকতার যুদ্ধংদেহীভাবকেই চিহ্নিত করে আর সেই সাথে ধরিত্রী মাতাকে ক্রমবর্ধমানভাবে অসম্মান করা হয়।

রবার্ট! সোফি বললো, তার কণ্ঠ অস্ফুট। কেউ আসছে!

সে হলওয়ে থেকে একটা পায়ের আওয়াজ শুনতে পেলো।

এখানে! সোফি তার ব্ল্যাক লাইটটা নিভিয়ে দিয়ে ল্যাংডনের সামনে থেকে যেনো উধাও হয়ে গেলো।

মূহূর্তের জন্য ল্যাংডনের মনে হলো, সে একদম অন্ধ হয়ে গেছে। এখানে! তার দৃষ্টিটা পরিষ্কার হতেই সে দেখতে পেলো সোফির অবয়বটা ঘরের মাঝখানে আটকোনা বেঞ্চিটার আড়ালে চলে যাচ্ছে। যখন একটা কণ্ঠ তাকে থামতে বললো, সেও সোফিকে অনুসরণ করতে লাগলো।

আরেতেজ! দরজা থেকে একটা কণ্ঠ বললো। লুভরের নিরাপত্তারক্ষী সল দে এতার ভেতরে প্রবেশ করে তার পিস্তলটা ল্যাংডনের বুকের কাছে তা করলো।

ন্যাংডন তার দুহাত উপরে তুলে ধরলো।

কুশেজ—ভূ! রক্ষীটা আদেশ করলো। শুয়ে পড়ো!

ল্যাংডন মুহূর্তেই ফ্লোরের দিকে মুখ করে শুয়ে পড়লে রক্ষীটা দ্রুত কাছে এসে তার পায়ে লাথি মারলো।

মভোয়া আইদি, মঁসিয়ে ল্যাংডন, সে ল্যাংডনের পিঠে অস্ত্রটা ঠেকিয়ে বললো,মভোয়া আইদি।

কাঠের ফ্লোরে হাত-পা ছড়িয়ে এভাবে শুয়ে থাকাটা ল্যাংডনের কাছে নিয়তির নির্মম পরিহাস বলে মনে হলো। উপুড় হয়ে থাকা ভিটাভিয়ান ম্যান, সে ভাবলো।

 

২৯.

সেন্ট-সালপিচের অভ্যন্তরে, সাইলাস বেদীর পাশে রাখা ভারি লোহার মোমবাতির স্ট্যান্ডটা নিয়ে অবিলিস্কের কাছে ফিরে আসলো। এটা দিয়ে অনায়াসেই হাতুড়ির কাজ করা যাবে। ধূসর মার্বেল প্যানেল, যেটার নিচটা ফাঁপা, সেটার দিকে তাকিয়ে সে বুঝতে পারলো, কোন ধরনের শব্দ ছাড়া এটা ভাঙতে পারবে না।

মার্বেলের উপর লোহার আঘাতের শব্দটা ঘরের ছাদে প্রতিধ্বনিত হবে।

এটা কি নান শুনতে পারবে? এই সময়ের মধ্যে উনি নিশ্চিত ঘুমিয়ে যাবেন। তারপরও, সাইলাস কোন ঝুঁকি নিতে চাইলো না। লোহার স্ট্যান্ডটার মাথা একটা কাপড় দিয়ে পেঁচিয়ে নেবার দরকার, কিন্তু সে বেদীর লিনেন কাপড় ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেলো না। ওটাকে অসম্মান করতে চাইলো না সাইলাস। আমার আলখেল্লাটা, সে ভাবলো। সে জানে, বিশাল এই চার্চে সে একাই আছে। সাইলাস শরীর থেকে আলখেল্লাটা খুলে ফেললো।

ওটা খুলতে গিয়ে কাপড়ের আঁশ সাইলাসের পিঠের ক্ষতে লেগে যাওয়াতে একটু ব্যথা করলো।

নিমাঙ্গের অর্ন্তবাসটা ছাড়া সে এখন নগ্নই বলা চলে। সাইলাস তার আলখেল্লাটা লোহার স্ট্যান্ডের মাথায় পেঁচিয়ে নিলো, তারপর ফ্লোরের টাইলসের মাঝ বরাবর নিশানা করে সজোড়ে আঘাত করলো। একটা ভেঁতা শব্দ হলো। কিন্তু পাথরটা ভাঙলো না। আবারো আঘাত করলে একটা ভোতা আওয়াজটা হলো, কিন্তু সেই সাথে ভেঙে যাবার শব্দও শোনা গেলো। তৃতীয় আঘাতে টাইলসটা পুরোপুরি ভেঙে গেলে ফ্লোরের নিচে গহ্বরটা দেখা গেলো।

একটা কক্ষ।

খুব দ্রুত আরো কিছু টাইলস্ খুলে সাইলাস ফোকরটা দিয়ে ভেতরে তাকিয়ে দেখলো। হাটু গেঁড়ে বসার সময় তার রক্ত টগবগ করছিলো। বিবর্ণ ফ্যাঁকাশে হাত দুটোয় ভর করে সে ভেতরে ঢুকে পড়লো।

প্রথমে তার কিছুই মনে হলো না। ভেতরের কক্ষটার জমিন মসৃন পাথরের আর সেটা একেবারেই খালি। তারপর রোজলাইন রেখাটা ধরে কয়েক হাত এগোতেই, একটা কিছুর স্পর্শ পেলো। পাতলা একটা পাথরের তক্তা। সেটার কোণা দুটো হাত দিয়ে ধরে তুলে ফেললো। সাইলাস দেখতে পেলো একটা অমসৃণ পাথরের ফলক, তাতে কিছু লেখা খোঁদাই করা আছে। কিছুক্ষণের জন্য তার নিজেকে মনে হলো আধুনিক কালের মুসা পয়গম্বর বলে।

ফলকটার লেখাগুলো পড়ে সাইলাস দারুণ অবাক হলো। সে আশা করেছিলো কিস্টোন একটা মানচিত্র হবে, অথবা একটা জটিল নির্দেশনা, কিংবা হয়তো কোন কোড। কি-স্টোনটা, দেখা যাচ্ছে, আসলে সহজ সরল একটা প্রস্তর ফলক।

জব ৩৮:১১

বাইবেলর একটা পংক্তি? সাইলাস এমন সহজ সরল জিনিস দেখে হতবাক হয়ে গেলো। তারা যে গোপন জায়গাটা খুঁজে ফিরছে, সেটা বাইবেলের একটা পংক্তিতে প্রকাশ করা হয়েছে? ভ্রাতৃসংঘ কি শেষ পর্যন্ত ঠাট্টা করলো!

জব। অধ্যায় আটত্রিশ। পংক্তি এগারো।

যদিও সাইলাসের এগারো নাম্বার পংক্তিটা হুবহু মুখস্ত নেই, তারপরও, সে জানতো, জব পুস্তকে এমন একজন লোকের গল্প বলা হয়েছে, যার ঈশ্বরের বিশ্বাসটা পরীক্ষা করবার পরেও টিকে ছিলো। যথার্থই, সে ভাবলো, তার উত্তেজনার সাথে মিলে যাচ্ছে।

মাথার ওপর তাকিয়ে সাইলাস না হেসে পারলো না। প্রধান বেদীর উপরে রাখা বই রাখার বড় একটা স্ট্যান্ড, তার উপড়ে চামড়ায় মোড়ানো বিশাল একটা বাইবেল রাখা।

বেলকনির ওপরে দাঁড়িয়ে সিস্টার সানডৃন কাঁপছিলেন। লোকটা যখন তার আলখেল্লাটা আচমকা খুলে ফেললো, তখন চলে যেতে উদ্যত হয়েছিলেন তিনি। তার প্রতি যে নির্দেশ ছিলো, সেটা পালন করতে চাইছিলেন। লোকটার ফ্যাঁকাশে সাদা চামড়া দেখে তিনি ভয় পেলেন। তার চওড়া বিবর্ণ পিঠটা রক্তে ভিজে আছে। এমন কি এখান থেকে তিনি স্পষ্ট দেখতে পেলেন টাকা ক্ষত চিহ্নগুলো।

লোকটাকে নির্দয়ভাবে চাবুক মারা হয়েছে।

তিনি তার ঊরুতে রক্তাক্ত সিলিস্ বেল্টটাও দেখতে পেলেন। সেখান থেকে রক্ত ঝড়ছে। কোন ধরনের ঈশ্বর এ রকম শারিরীক শান্তি কামনা করে? ওপাস দাইর নিয়ম-নিষ্ঠা সিস্টার সানড্রন কখনও বুঝতে পারেননি। তবে এই ব্যাপারটা তার কাছে এখন আর তেমন বিবেচ্য বিষয় নয়। ওপাস দাই কি-স্টোনটার খোঁজ করছে। তারা এ সম্পর্কে কীভাবে জানতে পারলো, সিস্টার সানন সেটা কোনোভাবেই ভেবে পেলো না। অবশ্য, তিনি জানতেন, ভাবার মতো সময় তাঁর এখন নেই।

রক্তাক্ত সন্ন্যাসিটি এবার নিরবে তার আলখেল্লাটা পরে নিলো। এরপর, সে বেদীতে রাখা বাইবেলের দিকে গেলো।

শ্বাসরুদ্ধকর নিরবতায় সিস্টার সানন বেলকনি ছেড়ে দ্রুত নিজের ঘরে ফিরে গেলেন। হাটু গেঁড়ে বসে তার কাঠের খাটটার নিচ থেকে সিলগালা করা একটা খাম বের করলেন। তিন বছর আগে এটা তিনি লুকিয়ে রেখেছিলেন।

খামটা ছিঁড়ে, খুলে দেখতে পেলেন, প্যারিসের চারটা ফোন নাম্বার।

কাঁপতে কাঁপতে তিনি ডায়াল করলেন।

নিচে, পাথরের ফলকটি সাইলাস তুলে নিয়ে আসলো বেদীর সামনে। অন্য হাতে চামড়ার বাইবেলটা তুলে নিলো সে। তার লম্বা-লম্বা সাদা আঙ্গুল দিয়ে পাতা ওল্টাতে শুরু করলো। ওল্ড টেস্টামেন্টটা ঘেঁটে-ঘেঁটে বুক অব জব খুঁজে পেলো সে। আটত্রিশতম অধ্যায়টা বের করলো। যে শব্দগুলো সে খুঁজছে, সেই শব্দগুলো পেয়ে গেলো এখানে।

তারাই পথ দেখাবে।

এগারো নাম্বার পংক্তিটা খুঁজে পেয়ে সাইলাস সেটা পড়ে দেখলো। এতে মাত্র সাতটা শব্দ রয়েছে। দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে, সে ওটা আবার পড়তে লাগলো। তার মনে হচ্ছিলো, বিশাল একটা ভুল হয়ে গেছে। পংক্তিটা একেবারেই সহজ সরল।

এ পর্যন্তই তোর আসা উচিত, এর চেয়ে বেশি না।

 

৩০.

সিকিউরিটি ওয়ার্ডেন ক্লদ গ্রুয়াদ মোনালিসার সামনে অবনত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা, তার বন্দীর সামনে অস্ত্র তাক করে রেখে দারুণ উত্তেজনা অনুভব করলো। এই বানচোতটা জ্যাক সনিয়েকে হত্যা করেছে। সনিয়ে ছিলেন গ্রুয়ার্দ এবং তার টিমের কাছে একজন স্নেহপরায়ণ পিতার মতোন।

গ্রুয়ার্দ টৃগারটা টিপে রবার্ট ল্যাংডনের পিঠে একটা বুলেট ঢুকিয়ে দেয়া ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারছিলো না। একজন সিনিয়র ওয়ার্ডেন হিসেবে গ্রুয়ার্দ হলো সেই সব স্বল্প সংখ্যক লোকদের একজন, যে সঙ্গে করে অস্ত্র বহন করে। সে নিজেকে প্রবোধ। দিলো যে, ল্যাংডনকে খুন করা মানে, ফরাসি জেলখানায় যাওয়া আর বেজু ফশের সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়া।

গ্রুয়ার্দ তার কোমরের বেল্ট থেকে ওয়াকি-টকিটা নিয়ে ব্যাক-আপের জন্য সাহায্য চাইলো। কিন্তু সে কেবল ঘঘ শব্দই শুনতে পেলো। এই কক্ষের বাড়তি ইলেক্ট্রনিক সিকিউরিটির জন্য সবসময়ই রক্ষীদের যোগাযোগ বিঘ্নিত হয়ে থাকে। আমাকে দরজার কাছে যেতে হবে। ল্যাংডনের দিকে অস্ত্রটা তা করে রেখেই গ্রুয়ার্স আস্তে আস্তে পিছু হটে দরজার বাইরে দিকে যেতে লাগলো। তার তৃতীয় পদক্ষেপেই, সে কিছু একটা বুঝতে পেরে একটু থামলো।

এটা আবার কি?

ঘরটার মাঝখানে কিছু একটা নড়ে-চড়ে উঠছে। একটা ছায়ার অবয়ব। এই ঘরে তাহলে আরেক জন আছে? দূরের অন্ধকারে একটা মেয়েকে নড়তে দেখা যাচ্ছে। তার সামনে একটা বেগুনী আলোর রেখা ফ্লোরের এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছে। যেনো রঙ্গীন ফ্লাশ লাইটটা দিয়ে কেউ কিছু খুঁজছে।

কুয়ে এস্ত লা? গ্রুয়ার্দ গর্জন করে বললো, শেষ ত্রিশ সেকেন্ডের মধ্যে দ্বিতীয় বারের মতো শিড়দাঁড়া দিয়ে শীতল অনুভূতিটা অনুভব করলো। আচমকাই সে খেই হারিয়ে ফেললো। অস্ত্রের নিশানাটা কোথায় তা করবে আর কোন দিকেই বা সে যাবে।

পিটিএস, মেয়েটা শীতল কণ্ঠে জবাব দিলো, এখনও লাইটটা দিয়ে সে খোঁজাখুঁজি করে যাচ্ছে।

পুলিশ তেকনিক এ সাইন্তিফিক। গ্রুয়ার্দ এবার ঘামে ভিজতে শুরু করলো। আমি ভেবেছিলাম সব এজেন্টই এখান থেকে চলে গেছে। সে বেগুনী আলোটা চিনতে পারলো, আন্ট্রাভায়োলেট রশ্মি। পিটিএস দলের কাছে এগুলো থাকে। তারপরও সে বুঝতে পারলো না, কেন ডিসিপিজে এখানে প্রমাণ বা আলামতের জন্য খোঁজাখুঁজি করছে।

ভোতার নম! গ্রুয়ার্দ চিৎকার করে বললো। তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বললো কিছু একটা অসঙ্গতি রয়েছে। রিপোদে!

সে সোয়ে, কণ্ঠটা খুব শান্ত, ফরাসিতে বললো। সোফি নেভু।

গ্রুয়ার্দের মনের কোণে কোথাও এই নামটা আছে, সোফি নেভু? এই নামটাতো সনিয়ের নাতনীর নাম, তাই না? ছোটবেলায় সে এখানে আসতো, কিন্তু সেটাতো অনেক বছর আগের কথা। এই মেয়েটা সম্ভবত সে নয়। আর যদি সে সোফি নেভূই হয়ে থাকে তারপরও তাকে বিশ্বাস করার কোন কারণ নেই, গ্রুয়ার্দ সনিয়ে এবং তার নাতনীর সাথে সম্পর্কচ্ছেদের গুজবটা শুনেছিলো।

আপনি আমাকে চেনেন, মেয়েটা বললো। রবার্ট ল্যাংডন আমার দাদুকে খুন করেনি। বিশ্বাস করুন।

ওয়ার্ডেন গ্রুয়ার্দ এই কথাটা আমলেই নিলো না। আমার দরকার ব্যাক-আপের। তার ওয়াকি-টকিতে আবারো চেষ্টা করলো, সাড়াশব্দ কিছুই পেলো না। প্রবেশ দ্বারটা এখান থেকে আরো বিশ গজ পেছনে। গ্রুয়াদ আস্তে আস্তে পিছু হটতে লাগলো। সে ঠিক করলো, ফ্লোরে শুয়ে থাকা লোকটার দিকেই অস্ত্রটা তাক করে রাখবে। পিছু হটতেই গ্রুয়ার্দ দেখতে পেলো মেয়েটা ঘরের অন্য পাশ থেকে তার ইউভি লাইটটা দিয়ে সল দে এতাত এর দেয়ালে মোনালিসার ঠিক বিপরীতে টাঙানো বিশাল একটা

ছবির দিকে আলো ফেলে কি যেনো খুঁজছে।

গ্রুয়ার্দ ভাবলো, বুঝতে চেষ্টা করলো, কোন্ পেইন্টিং সেটা।

ঈশ্বরের দোহাই, মেয়েটা করছে কি?

সোফি নেভুর মনে হলো, তার কপালটা ঠাণ্ডা ঘামে ভিজে গেছে। ল্যাংডন মাটিতে ডানা ছড়ানো ঈগলের মতোই পড়ে আছে। একটু, রবার্ট, এইতো। জানতো তাদের প্রহরী কাউকেই গুলি করবে না। সোফি তার নিজের কাজেই মনোেযোগ দেবার মনস্থির করলো। একটা মাস্টার পিসের পুরোটাই খুঁজে দেখলো, বিশেষ করে আরেকটা দা ভিঞ্চি। কিন্তু ইউভি লাইটে কিছুই ধরা পড়লো না। ফ্লোরেও না, দেয়ালেও না, এমনকি ক্যানভাসেও না।

এখানে কিছু একটাতো আছেই।

সোফির মনে হলো সে তার দাদুর সংকেতের পুরোটাই ঠিক ঠিকভাবে মর্মোদ্ধার করতে পেরেছে।

এ ছাড়া আর কীইবা তিনি বোঝাতে চাইবেন?

যে মাস্টার পিসটা সে পরীক্ষা করলো, সেটা পাঁচ ফুট লম্বা একটা ক্যানভাস। দা ভিঞ্চি একটা অদ্ভুত দৃশ্য এঁকেছিলেন, যাতে জবুথুবুভাবে কুমারী মেরি শিশু যিশুকে কোলে নিয়ে বসে আছেন, পাশে জন দ্য ব্যাপটিস্ট এবং ইউরিয়েল এনজেল একটা পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। সোফি যখন ছোট ছিলো তখন তার দাদু এই ছবিটার কাছে তাকে জোর করে ধরে না নিয়ে এসে মোনালিসা দর্শন শেষ করতেন না।

গ্র্যঁ-পেয়া, আমি এখানে! কিন্তু সেটা দেখতে পাচ্ছি না! তার পেছনে, সে শুনতে পেলো, রক্ষীটা আবার সাহায্যের জন্য রেডিওতে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে যাচ্ছে।

ভাবো!

সে মোনালিসার বুলেট প্রুফ কাঁচের ওপরে লেখা মেসেজটা আবার দেখলো। So dark the con of man। তার সামনের পেইটিংটার কোনো কাঁচ নেই, যাতে কোন মেসেজ লেখা থাকতে পারে। সোফি জানে, তার দাদু বিখ্যাত কোনো মাস্টার পিসের উপরে কিছু লিখে সেটা নষ্ট করবেন না। সে একটু থামলো। সামনে তো কোনোভাবেই নয়। তার চোখ ওপরের দিকে গেলো। ক্যানভাসটা সিলিংয়ের থেকে যে তারটা দিয়ে ঝোলানো রয়েছে, সেটা লাফিয়ে ধরলো। এটাই কি তবে সেই জিনিস? ক্যানভাসটার বাম দিকটা ধরে তার কাছে টেনে আনলো সেটা। ছবিটা বেশ বড়, তাই দুলতে লাগলো। সোফি কোনোমতে তার মাথাটা ক্যানভাসের পেছনে ঢুকিয়ে উঁকি মারলো। ব্ল্যাক লাইটটা দিয়ে পেছনে খুঁজে দেখতে চেষ্টা করলো।

মাত্র কয়েক সেকেন্ড লাগলো বুঝতে যে, তার ধারণাটা ভুল। ছবিটার পেছন দিক কালো আর বিবর্ণ, সেখানে কোন বর্ণালি রঙের লেখা নেই, শুধুমাত্র পুরনো ক্যানভাসের পেছনকার কালো ধূসর চিটচিটে রঙ আর–

আরে।

সোফির চোখ কাঠের ফ্রেমের নিচের দিকের খাজের মধ্যে একটা ধাতব, চঞ্চকে বস্তুর দিকে আঁটকে গেলো। জিনিসটা ছোট, সেটাতে আঁটকে আছে জ্বলজ্বলে একটা সোনার চেইন।

সোফি যারপরনাই বিস্মিত হলো। চেইনটার সাথে লাগনো আছে অতিপরিচিত সোনার চাবিটা। চাবিটার চওড়া মাথাটা ক্ৰশ আকৃতির, আর তাতে আছে একটা খোঁদাই করা সিল, যা সে নয় বছর বয়সের পর আর কখনও দেখেনি। একটা ফ্লার-দ্য লিস তার সাথে আছে পিএস অক্ষরটা। সোফির মনে হলো, তার দাদুর অশরীরি কণ্ঠস্বরটা তার কানে ফিস্ ফিস করে বলছে। যখন সময় আসবে, চাবিটা তোমার হবে। তার দাদু মারা গেলেও নিজের প্রতিশ্রুতি ঠিকই রক্ষা করেছেন, এটা বুঝতে পেরে তার গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো। এই চাবিটা দিয়ে একটা বাক্স খোলা যায়, তাঁর কণ্ঠটা বলছে, সেখানে আমি অনেক গোপনীয় জিনিস রাখি।

সোফি এবার বুঝতে পারলো, আজকের রাতের পুরো শব্দখেলার সত্যিকারের উদ্দেশ্য ছিলো এই চাবিটা। তার দাদু যখন মারা যাচ্ছিলেন, তখন চাবিটা তার কাছেই ছিলো। তিনি চাননি এটা পুলিশের হাতে গিয়ে পড়ক। তাই ছবিটার পেছনে সেটা রেখে দিয়েছিলেন। তারপর একটা অতিপরিচিত গুপ্তধন খোজা খেলাটা খেলালেন, যাতে কেবলমাত্র সোফিই এটা খুঁজে পায়।

অ্যা সিকোর! রক্ষীটা জোরে বলে উঠলো। সোফি চাবিটা ফ্রেমের পেছন থেকে এক ঝটকায় নিয়ে ইউডি লাইটটা সহ তার পকেটে ঢুকিয়ে ফেললো। ক্যানভাসের পেছনে থেকেই সে উঁকি মেরে দেখলো রক্ষীটা তখনও ওয়াকি-টকিতে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। সে পিছু হঁটে-হঁটে প্রবেশ দ্বারের দিকে যাচ্ছে, আর হাতে ধরা অস্ত্রটা ল্যাংডনের দিকেই তাক্ করে রাখা।

অ্যা সিকোর! সে আবারো রেডিওতে চিৎকার করে বললো।

কোন সাড়া শব্দ নেই।

লোকটা যোগাযোগ করতে পারছে না, সোফি বুঝতে পারলো। তার মনে পড়ে গেলো, প্রায়শই দশনার্থী পর্যটকরা মোনালিসা দেখে অভিভূত হয়ে তাদের সেল ফোনে কথা বলতে গিয়ে দেখে যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছে না। এখানের দেয়ালে এক্সট্রা সার্ভিলেন্স যন্ত্রের জন্য কোন ধরনের বেতার যোগাযোগ একরকম অসম্ভবই হয়েই পড়ে, যদি না দরজার বাইরে না গিয়ে সেটা করা হয়। রক্ষীটাও এখন খুব দ্রুত দরজা দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। সোফি জানে, তাকে এক্ষুণি কিছু একটা করতে হবে। বড় ছবিটার পেছন থেকে সোফি তাকিয়ে দেখছিলো আর ভাবছিলো যে, লিওনার্দো দা ভিঞ্চি আজ রাতে দ্বিতীয় বারের মতো সাহায্যে আসতে পারে কিনা।

আর মাত্র কয়েক মিটার দূরেই, গ্রুয়ার্দ মনে মনে বললো, অস্ত্রটা তা করেই রাখলো।

আরেতেজ! ওউ জো লা দেই। মেয়েটা ঘরের একপাশ থেকে বলে উঠলো। গ্রুয়ার্দ তাকিয়ে দেখেই পিছু হটা থামিয়ে দিলো। মদিউ, নো!

ঘোলাটে লাল আলোর মধ্য দিয়ে সে দেখতে পেলো, মেয়েটা ঝুলে থাকা তারটা ছিঁড়ে ফেলে একটা বিশাল চিত্রকর্ম তার সামনে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। পাঁচ ফুট লম্বা ছবিটা মেয়েটাকে প্রায় ঢেকেই ফেলেছে। গ্রুয়ার্দ প্রথমে অবাক হয়ে ভাবলো, ছবিটা তার থেকে ছিঁড়ে ফেলার সময় এলার্ম কেন বাজলো না, অবশ্য, পরক্ষণেই, সে বুঝতে পারলো তারগুলোর সাথে এলার্মের সেন্সরটা এখনও নতুন করে সেট করা হয়নি। মেয়েটা করছে কি?

দৃশ্যটা দেখে তার রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে গেলো।

ক্যানভাসটার মাঝখান ফুলে উঠেছে। কুমারি ম্যারি, শিশু যিশু, জন ব্যাপটিস্ট এর নাজুক জায়গাটা ছিঁড়ে যাবার উপক্রম হলো।

নোঁ! গ্রুয়ার্দ চিৎকার করে বললো। দা ভিঞ্চির অমূল্য চিত্রকর্মটির এ অবস্থা দেখে সে ভয়ে জমে গেলো। মেয়েটা ক্যানভাসের পেছন থেকে হাটু দিয়ে ছবিটার মাঝখানে চাপ দিচ্ছে!

নোঁ।

গ্রুয়ার্দ তার পিস্তলটা ল্যাংডনের থেকে সরিয়ে মেয়েটার দিকে তাক্ করেই বুঝলো এটা একটা অসাড় হুমকি। ক্যানভাসটা কাপড়ের হলেও, সেটা একেবারেই অভেদ্য–ছয় মিলিয়ন ডলার দামের একটা বর্ম।

আমি দা ভিঞ্চিকে গুলি করতে পারি না!

আপনার ওয়াকি-টকি আর অস্ত্রটা নামিয়ে রাখুন, মেয়েটা ফরাসিতে শীতল কণ্ঠে বললো, তা-না হলে, আমি এই ছবিটা ছিঁড়ে ফেলবো। আমার মনে হয় আপনি জানেন, আমার দাদু এতে কী রকম কষ্ট পেতো।

গ্রুয়ার্দ একটা হতবুদ্ধিকর অবস্থায় পড়ে গেলো। দয়া করে…না। এটা ম্যাড়োনা অব দি রস! সে তার ওয়াকি-টকি আর অস্ত্রটা ফেলে দিয়ে মাথার উপর দু হাত তুলে ধরলো।

ধন্যবাদ আপনাকে, মেয়েটা বললো। এখন, আমি যা বলি তা-ই করুন, তাহলে সবকিছুই ঠিকঠাক হয়ে যাবে।

কিছুক্ষণ বাদে, ল্যাংডন যখন সোফির পাশাপাশি জরুরি বর্হিগমনের সিঁড়িটা দিয়ে বের হতে লাগলো, তখন তার নাড়িস্পন্দনটা লাফাচ্ছিলো। লুভরের সল দে এতা-এ রক্ষীটাকে মাটিতে শুইয়ে দিয়ে, ওখান থেকে বের হবার সময় থেকে তারা একটা কথাও বলেনি। রক্ষীর পিস্তলটা এখন ল্যাংডনের হাতে। আর এই জিনিসটা পরিত্যাগ করার জন্য একটুও অপেক্ষা করতে চাইলো না। অস্ত্রটা তার কাছে খুবই ভারি আর অচেনা মনে হচ্ছিলো। একসাথে দুটো করে সিঁড়ি ভেঙে নামতে নামতে ল্যাংডন অবাক হয়ে ভাবছিলো, সোফি কি জানে, যে ছবিটা সে প্রায় নষ্ট করে ফেলতে যাচ্ছিলো, সেটা কত দামী। আজ রাতে, এই এ্যাডভেঞ্চারের জন্য মেয়েটা ভালো একটা ছবিই বেছে নিয়েছিলো। দা ভিঞ্চির যে ছবিটা সে নিয়েছিলো, সেটা অনেকটা মোনালিসার মতোই, শিল্প ইতিহাসবেত্তাদের কাছে প্রচুর পরিমাণে প্যাগান প্রতীক লুকিয়ে থাকার জন্য সমালোচিত ও আলোচিত।

তুমি খুব দামি জিম্মি বেছে নিয়েছিলে, দৌড়াতে দৌড়াতে ল্যাংডন তাকে বললো।

ম্যাড়োনা অব দি রস, সে জবাব দিলো। কিন্তু আমি এটা বেছে নেইনি, আমার দাদুই বেছে নিয়েছেন। তিনি ওটার পেছনে আমার জন্যে ছোট্ট একটা জিনিস রেখে গিয়েছেন।

ল্যাংডন মেয়েটার দিকে অবাক হয়ে তাকালো। কী! কিন্তু তুমি কি করে জানলে কোন্ ছবিটাতে সেটা আছে? ম্যাডোনা অব দি রক্স কেন?

So dark the con of man। সে একটা বিজয়ীর হাসি হাসলো। আমি প্রথম দুটো এনাগ্রাম ধরতে পারিনি, রবার্ট। তৃতীয়টা ঠিকই ধরতে পেরেছি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *