মৃন্ময়ীর দাদা আলিমুর রহমান শাদা হাফ পেন্ট পরে খালি গায়ে নিমগাছের নিচে উবু হয়ে বসে আছেন। গায়ে নিমের বাতাস লাগানোর ব্যবস্থা। কবিরাজ এই বিধান দিয়েছে। কবিরাজের নাম বিজয়কালী ঠাকুর বেদান্ত শাস্ত্রী। আলিমুর রহমানের হযমের সমস্যা কিছুই খেতে পারেন না।
সকালে এক ঘণ্টা নিমের বাতাস। দুপুরে চায়ের চামুচে এক চামচ নিমপাতা পিসা রস। রাতে ঘুমুতে যাবার আগে নিমগাছের ছাল ভেজানো পানি। এই চিকিৎসার নাম মহানিম চিকিৎসা। চিকিৎসা সাতদিন চলবে। সাতদিন পর অন্য বিধান। আজ চিকিৎসার চতুর্থ দিন।
আলিমুর রহমান দূর থেকে মৃন্ময়ীকে দেখলেন। তার মেজাজ ভয়ংকর খারাপ ছিল। মেজাজ ঠিক হতে শুরু করল। তিনি আশেপাশে তাকালেন। কাউকে দেখা যাচ্ছে না। মেয়েটা এসে বসবে কোথায়? মাটিতে নিশ্চয়ই বসবে না? তার মেজাজ আবারো খানিকটা খারাপ হলো। সাভারের তার এই খামার বাড়িতে খুব কম করে হলেও পনেরোজন লোক। আশে পাশে কেউ নেই এটা কেমন কথা?
ম্যানেজারকে এখন অবশ্যি দেখা যাচ্ছে। শীতল পাটি হাতে দৌড়ে আসছে। আলিমুর রহমানের মেজাজ ঠিক হলো। পুরোপুরি না, তবে কাজ চলাবার মতো।
মৃন্ময়ী বলল, দাদাজান দূর থেকে তোমাকে দেখে মনে হচ্ছিল ধবধবে শাদা একটা ব্যাঙ লাফ দেওয়ার জন্যে বসে আছে। ব্যাঙটার সামনে পুকুর। সে লাফ দিয়ে পুকুরে পরবে।
আলিমুর রহমান বললেন, পরীক্ষা শেষ নাকি?
ফার্স্ট পেপার শেষ। তিন দিনের গ্যাপ আছে। তোমাকে দেখতে এসেছি। দাদাজান আমি রাতে কিন্তু থাকব।
থাকতে চাইলে থাকবি। এত বলাবলির কি আছে।
ঢাকায় লোক পাঠিয়ে আমার বইখাতা আনিয়ে দাও। বই ছাড়া চলে এসেছি। রাতে থাকব এ রকম চিন্তা করে তো আসি নি।
হঠাৎ চিন্তাটা করলি কেন?
তোমাকে একা একা বসে থাকতে দেখে মায়া লাগল। তখনই ঠিক করলাম রাতে থাকব। তোমার সঙ্গে গল্প করব।
গল্প করলে পড়বি কখন?
এক রাত না পড়লেও হবে।
বইখাতা আনতে লোক পাঠাতে হবে না?
না।
মৃন্ময়ী পাটিতে বসেছে। সে দাদাজানের দিকে তাকিয়ে বলল, পাটিতে এসে বসো। আমি তোমার পিঠ ডলে দিব।
আলিমুর রহমান পাঠিতে উঠে এলেন। এখন তার মেজাজ সর্বোচ্চ ভালো স্তরে।
নিম চিকিৎসা চলছে দাদাজান?
হুঁ।
আজকে ফোর্থ ডে না?
হ্যাঁ।
আলিমুর রহমান খুবই অবাক হলেন মেয়েটা মনে রেখেছে। আজকালকার ছেলেমেয়েরা তো কোনো কিছুই মনে রাখে না। তিনি মৃন্ময়ীকে একবার শুধু টেলিফোনে বলেছিলেন শুক্রবার থেকে নিম চিকিৎসা।
আলিমুর রহমান বললেন, গাধাটা আছে কেমন?
বাবার কথা বলছ?
গাধা তো ঐ একটাই।
বাবা ভালো আছে।
গাধার স্ত্রী আছে কেমন?
মাও ভালো।
এখনও ঘর অন্ধকার করে বসে থাকে?
হুঁ। দাদাজান তোমার ম্যানেজারকে তেল আনতে বল। তোমার পিঠে তেল দিয়ে দেব।
বাদ দে।
বাদ দেব কেন? ম্যানেজারকে ডাক। আমি কফি খাব। কফির নতুন কৌটা কিনেছ, নাকি ছাতা-পড়া ঐটাই আছে।
আলিমুর রহমান তৃপ্তির সঙ্গে বললেন, তুই যা-ই চাবি তা-ই পাবি। প্রয়োজনে কফির বাগান কিনব। তবে তোর গাধা-বাবাকে একটা শিক্ষা আমি দিব। কঠিন শিক্ষা। বাবাজী টাইপ শিক্ষা।
সেটা কেমন?
শিক্ষা শেষ হলে শুধু বাবাজী বাবাজী করবে। এর নাম বাবাজী শিক্ষা।
বাবা কি নতুন কিছু করেছে?
আমার কাছে নোট পাঠিয়েছে। ইংরেজি নোট তার নাকি কিছু টাকার প্রয়োজন।
তুমি কি করেছ, টাকা পাঠিয়েছ?
আমি নোটের জবাবে নোট দিয়েছি। চিঠিপত্র চালাচালি হচ্ছে। কি লিখেছি তোকে পড়ে শুনাই। ম্যানেজার গাধাটা আবার গেল কোথায়?
দাদাজান তুমি কি সবাইকে গাধা ডাক নাকি?
সবাইকে ডাকি না। তোর বাবাকে ডাকি আর ম্যানেজারটাকে ডাকি। দুজনই একই লেভেলের গাধা। এক্সপোর্ট কোয়ালিটি। দেশে রাখার জিনিস না। বিদেশে পাঠিয়ে দেবার জিনিস।
মৃন্ময়ী কফি খাচ্ছে। তার মুখ হাসি হাসি। আলিমুর রহমান নাতনীকে চিঠি পড়ে শুনাচ্ছেন।
শাহেদুর রহমান
১১৫ বারিধারা
বিষয় : ১৬–৭–২০০৫ এ প্রেরিত ইংরেজিনোটের জবাবে
গাধা পুত্র
তোমার ইংরেজি পত্র পাইয়াছি। পত্রের জবাব এই যে তোমাকে আর কিছুই দেওয়া হইবে না। দশ টাকার ছেঁড়া স্কচ টেপ লাগানো নোটও না। তুমি যে চারতলা বাড়িতে বাস করিতেছ সেই বাড়ি আমার নামে। এক মাসের ভিতর তুমি বাড়ি খালি করিয়া দিবে। তোমার মতো অপদার্থ ষাড়ের গোবরকে টাকা নামক অক্সিজেন সাপ্লাই করিবার কোনো প্রয়োজন আমি বোধ করিতেছি না। আমি বাংলাদেশ অক্সিজেন লিমিটেড কোম্পানী না। তুমি গর্ধব কুলেরও কলঙ্ক।
ইতি
তোমার পিতা
আলিমুর রহমান
চিঠি শেষ করে আলিমুর রহমান বললেন, মুসাবিদা কেমন দেখলি?
মৃন্ময়ী বলল, সত্যিই এই চিঠি পাঠিয়েছ?
আলিমুর রহমান বললেন, অবশ্যই। প্রথম চিঠির পর দ্বিতীয় চিঠি গেছে, তৃতীয় চিঠি গেছে।
দেখি দ্বিতীয় তৃতীয়তে কী লিখেছ?
ঐ চিঠিগুলোতে শুধুই গালাগালি। মুখে গালি দিতে পারছি না বলে চিঠিতে গালি। গালাগালি পড়তে পারব না। তুই পড়ে নে।
মৃন্ময়ীর মুখভর্তি হাসি। সে আগ্রহ নিয়ে চিঠি পড়ছে। আলিমুর রহমান নাতনীর মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। চিঠি পড়তে পড়তে একেকবার এই মেয়েটা খিলখিল করে হেসে উঠছে। কী সুন্দর দৃশ্য! আলিমুর রহমানের মনে হলো আরো কয়েকটা চিঠি থাকলে ভালো হতো।
(দ্বিতীয় চিঠি)
গাধপুত্র
অক্সিজেনের অভাব বোধ করিতেছ? শুধু অক্সিজেন বন্ধ করিয়া তোমাকে শায়েস্তা করা যাইবে না। তোমার নাক দিয়া কার্বনডাই-অক্সাইড ঢুকাইতে হইবে। তবে যদি তুমি শায়েস্তা হও।
ইতি
তোমার পিতা
শায়েস্তা খান
(আলিমুর রহমান)
(তৃতীয় চিঠি)
শাহেদুর রহমান
বারিধারা
বিষয়: তোমার অবস্থান বিষয়ক!
তুই গাধা। তুই গাধা? তুই গাধা। তুই গাধা। তুই গাধা। তুই গাধা। তুই গাধা! তুই গাধা। তুই গাধা? তুই গাধা। তুই গাধা। তুই গাধা।
ইতি
তোমার পিতা
শায়েস্তা খান
(তোমাকে শায়েস্তা করা হইবে)
মৃন্ময়ী বলল, তোমার চিঠি পড়ে খুবই মজা পেয়েছি। তবে এই চিঠিতে কাজ হবে না। বাবাও চিঠি পড়ে মজা পাবে। শায়েস্তা হবে না।
আলিমুর রহমান বলবেন, আমার মাথায় আরো প্ল্যান আছে। চিন্তা করছি। তোমার বাবা নাকি এখন ছবি আঁকা ধরেছে?
হুঁ। তার একজন টিচার আছে। জহির নাম। সপ্তাহে তিন দিন এসে ছবি আঁকা শিখাবে।
তোর বাবা তাহলে পিকাসো হয়ে যাচ্ছে? মহান বাংলাদেশি পিকাসো। পিকাসোর মাথায় তো চুল ছিল না। নাপিত ডেকে তোর বাবার মাথাটা কামিয়ে দে না।
দাদাজান বাবা প্রসঙ্গ বাদ থাকুক। আমি বাবাকে নিয়ে তোমার সঙ্গে আলাপ করতে আসি নি। তোমার সঙ্গে গল্প করতে এসেছি।
দুপুরে কী খাবি?
তুমি যা খাওয়াবে তা-ই খাব।
পুকুর থেকে নিজের হাতে মাছ ধরে দেই?
দাও।
আলিমুর রহমানের পুকুর পুরানো জমিদার বাড়ির পুকুরের মতোই বিশাল।
তিন ঘাটের পুকুর। বরশি ফেলার জন্যে আলাদা মাচা করা আছে। মাথার উপর খড়ের চালা, যেন মাছ মারার সময় মাথায় রোদ না লাগে।
বিপুল আয়োজনে আলিমুর রহমান মাছ মারতে বসেছেন। পাশেই পাটি পেতে শুয়ে আছে মৃন্ময়ী। মৃন্ময়ীর হাতে একটা বই। বইটার নাম The Chariots of Hone. সায়েন্স ফিকশান।
মৃন্ময়ীর প্রচুর গল্পের বই, গানের সিডি, ছবির ভিসিডি, দাদাজানের খামার বাড়িতে রাখা।
মৃন্ময়ী বলল, দাদাজান আমি যদি গান শুনতে শুনতে বই পড়ি তোমার মাছ মারায় অসুবিধা হবে?
না। গানের যন্ত্র এনেছিস?
নিয়ে আসব।
ম্যানেজারকে বলে দেই, সে নিয়ে আসুক।
উনি কোন গান আনতে হবে বুঝবেন না। দাদাজান তুমি গান পছন্দ কর না?
না।
বই পড়তে পছন্দ কর?
না।
ছবি দেখতেও পছন্দ কর না?
না।
পছন্দ না করলেও আজ রাতে তোমাকে নিয়ে একটা ছবি দেখব। আমার একা একা ছবি দেখতে ভালো লাগে না।
আলিমুর রহমান বললেন, তোর কি কোনো ছেলের সঙ্গে ভাব-ভালোবাসা হয়েছে?
না।
যদি কাউকে মনে ধরে আমারএখানে নিয়ে আসবি। আমি পরীক্ষা করে দেখব বুদ্ধিশুদ্ধি আছে কি-না।
বুদ্ধি দিয়ে কী হবে? হাসবেন্ড হিসেবে বোকাই ভালো।
কখনও কোনো বোকার ধারেকাছে যাবি না।
আচ্ছা যাব না। দাদাজান! শুনো আমি কিছুক্ষণ ঘুমাব। তোমার বরশিতে যদি বড় কোনো মাছ ধরা পড়ে আমাকে ডেকে তুলবে। আমি সূতা ছাড়ব।
আচ্ছা ঠিক আছে। তোর কি ক্ষিধে লেগেছে? কিছু খাবি।
ক্ষিধে লেগেছে কিন্তু আমি কিছু খাব না। আচ্ছা দাদাজান তোমার তো প্রচুর টাকা। কি করবে এত টাকা দিয়ে।
তুই চাইলে তোকে দিয়ে দিব। তুই চাস?
না। কখনও না।
তুই একটা বুদ্ধি বের কর, বিলি-ব্যবস্থা কি করা যায়।
হাসপাতাল বানাবে?
হাসপাতাল বানাতে যাব কোন দুঃখে?
অনাথ আশ্রম?
ভুলে যা। দুনিয়ার অনাথ এক জায়গায় এনে তাদের ক্যাঁচক্যাচানি শোনার আমার কোনো শখ নেই।
ইউনিভার্সিটি বানাবে। প্রকৃতির সঙ্গে মিলিয়ে ইউনিভার্সিটি।
আমি কি রবীন্দ্রনাথ যে শান্তি নিকেতন বানাব?
তাহলে কি করা যায়। ভালো সমস্যা হলো তো।
চিন্তা করে বের কর। আমিও চিন্তা করে কিছু পাচ্ছি না।
দাদাজান তোমার টাকা এবং সম্পত্তি সব একত্র করলে কত টাকা হবে?
জানি না কত হবে।
আনুমানিক কত হবে বল, ১৭ কোটি কি হবে?
হবে।
তাহলে এক কাজ কর। বাংলাদেশের সব মানুষের মধ্যে সমানভাবে এই টাকাটা ভাগ করে দাও। সবাই এক টাকা করে পাবে।
আলিমুর রহমান হো হো করে হেসে উঠলেন।
এত আনন্দ নিয়ে তিনি অনেকদিন হাসেন নি।
মৃন্ময়ী বলল, তোমার হাসির শব্দে সব মাছ তো পালিয়ে যাবে।
আলিমুর রহমান আরো শব্দ করে হেসে উঠলেন।
ট্রেতে করে চা নিয়ে খামার বাড়ির ম্যানেজার এসেছে। ম্যানেজারের নাম কালাম। কালাম করিকর্মা লোক। কিন্তু বড় সাহেবের সামনে এসে দাঁড়ালে তার সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। বুক ধড়ফড় করতে থাকে। বড় সাহেবের সব কথাও তখন ঠিকমতো কানে ঢুকে না। তার প্রায়ই মনে হয় এই চাকরি ছেড়ে সে অন্য কোনো চাকরিতে ঢুকবে। চব্বিশ ঘণ্টা আতঙ্কের মধ্যে বাস করার কোনো অর্থ হয় না।
কালাম বলল, স্যার আপনার কাছে একজন আর্টিস্ট এসেছে।
আলিমুর রহমান বললেন, আমার কাছে আর্টিস্ট আসবে কেন?
ঢাকা থেকে ছোট সাহেব পাঠিয়েছেন। আর্টিস্ট আপনার ছবি আঁকবে।
আলিমুর রহমান বললেন, তাকে ঘাড় ধরে বিদায় করে দাও।
কালাম বলল, জি আচ্ছা স্যার।
হাসিমুখে বিদায় করবে না। গলা ধাক্কা দিয়ে বিদায় করবে। এমনভাবে ধাক্কা দিবে যেন পা ঢেগায়ে উল্টে পড়ে।
জি আচ্ছা স্যার।
মৃন্ময়ী বলল, দাদাজান তুমি বাবার উপর রাগ করে অন্য একজনকে গলা ধাক্কা দিতে পার না। আর্টিস্টের তো কোনো দোষ নেই। বাবা তাকে পাঠিয়েছে তিনি এসেছেন। তুমি যদি ছবি আঁকাতে না চাও বলবে ছবি আঁকাব না। তাকে ভদ্রভাবে চলে যেতে বলবে।
আলিমুর রহমান কালামের দিকে তাকিয়ে বললেন, তাকে ভদ্রভাবে চলে যেতে বল।
কালাম ঘাড় কাত করে সঙ্গে সঙ্গে বলল, জি আচ্ছা স্যার।
মৃন্ময়ী বলল, ভর দুপুরে একজন এত দূর এসেছে, তাকে না খাইয়ে বিদায় করে দেওয়াও ঠিক না।
আলিমুর রহমান বললেন, কালাম তাকে ভাত খাইয়ে তারপর বিদায় কর।
কালাম আবারও ঘাড় নেড়ে বলল, কি আচ্ছা স্যার।
কালামের বুকে ব্যথা শুরু হয়েছে। বেশিক্ষণ এখানে থাকলে ব্যথা বাড়বে। সে দ্রুত হাঁটা ধরল।
আলিমুর রহমানের ছিপে মাছ বেঁধেছে। সূতার টান থেকে বুঝা যাচ্ছে তিন থেকে চার কেজি হবে। এরচেয়ে বড়ও হতে পারে। ঠিকমতো সূতা ছাড়তে না পারলে মাছ রাখা যাবে না।
আলিমুর রহমান চেঁচিয়ে বললেন, মৃন্ময়ী ছিপ ধর।
আলিমুর রহমান হাপাচ্ছেন। আনন্দে ও উত্তেজনায় তার চোখ-মুখ ঝলমল করছে। মৃন্ময়ী বলল, তিমিমাছ নাকি দাদাজান! মাছের এত শক্তি!
আলিমুর রহমান বললেন, খুব সাবধানে সূতা ছাড়। মাছ কিন্তু হ্যাচকা টান দিয়ে তোকে পানিতে ফেলতে পারে।
মৃন্ময়ী বলল, দাদাজান তুমি ছিপটা ছেড়ে দিলে কি মনে করে। আমি একা পারব না কি, তুমিও ধর।
আলিমুর রহমান বলেন, গাধা কালামটা আবার গেল কোথায়? থাপড়ায়ে এর দাঁত যদি আমি না ফেলি।
মাছের প্রবল টানে মৃন্ময়ী ঝুপ করে পানিতে পড়ে গেল।
আলিমুর রহমান বললেন, ছিপ ছাড়বি না। ছিপ ধরে থাক।
মৃন্ময়ী এক হাতে ছিপ উঁচু করে রেখে সাতরাচ্ছে। কী সুন্দর দৃশ্য! আলিমুর রহমানের কাছে মনে হলো তিনি এত মধুর দৃশ্য তার জীবনে আর দেখেন নি।
মাছ ডাঙ্গায় তোলার পর ওজন দেয়া হলো। কাতল মাছ। ওজন পাঁচ কেজি তিনশ গ্রাম। মৃন্ময়ী বলল, দাদাজান মাথাটা আমি খাব।
আলিযুর রহমান বললেন, ভাগাভাগি করে খাই। দুজনে মিলে ধরলাম না?
জহির অবাক হয়ে বলল, আপনি এখানে?
মৃন্ময়ী বলল, এত অবাক হচ্ছেন কেন? এটা আমার দাদার খামারবাড়ি। আমি তো এখানে থাকতেই পারি। বরং আমার উচিত আপনাকে দেখে অবাক হওয়া। আমি অবশ্যি সে রকম অবাক হচ্ছি না।
জহির বলল, আপনার বাবা আমাকে কমিশন করেছেন আমি যেন আপনার দাদার একটা পোট্রেট করে দেই।
দাদা নো বলে দিয়েছেন। উনার নো মানে কেপিটেল এন কেপিটেল ও।
আমাকে কালাম সাহেব বলেছেন। আমি চলে যেতে চাচ্ছিলাম, উনি খেয়ে যেতে বললেন।
অবশ্যই খেয়ে যাবেন। কাতল মাছের একটা প্রিপারেশন আপনাকে দেয়া হবে। মাছটা আমি ধরেছি।
জহির খুবই অবাক হচ্ছে মেয়েটার সহজ কথা বলার ভঙ্গিতে। প্রথম দিনে তার কথায় ও চেহারায় কাঠিন্য ছিল। আজ একবারেই নেই।
মৃন্ময়ী বলল, আপনি কি ভালো পোট্রেট করেন?
জহির বলল, যখন মন দিয়ে করি তখন ভালো করি। বেশির ভাগ সময় মন লাগে না।
কখন মন লাগে না?
যার ছবি আঁকছি তাকে পছন্দ না হলে দুবিতে মন লাগে না।
একটা পোট্রেট করতে আপনি কত টাকা নেন?
ধরাবাধা কিছু নেই। চেষ্টা থাকে যত বেশি নেয়া যায়। ক্লায়েন্ট বুঝে দাম।
আমার কাছ থেকে আপনি কত নেবেন? আমি যদি আপনাকে কমিশন করি।
আমি আপনার কাছ থেকে কিছুই নেব না।
কেন নেবেন না?
আপনি আমার বড় একটা সমস্যা সমাধান করিয়েছিলেন এই জন্যে নেব। তাছাড়া আপনার ছবি আঁকার জন্যেও আপনার বাবা আমাকে কমিশন করেছেন।
মৃন্ময়ী বলল, আমিও আমার দাদাজানের মতো। কাউকে দিয়ে ছবি আঁকাই। তবে আমি আমার এক বান্ধবীর ছবি আঁকার জন্য আপনাকে কমিশন করব। আমার খুব প্রিয় বান্ধবী। আপনি যত্ন করে তার ছবি এঁকে দেবেন।
অবশ্যই দেব।
সে যতনা সুন্দর, আপনি তাকে আরও সুন্দর করে আঁকবেন।
চেষ্টার কোনো ত্রুটি থাকবে না।
শুধু তার নাকে একটা হীরের নাকফুল দিয়ে দেবেন। আমি নাকফুলটার ডিজাইন আপনাকে দিয়ে দেব।
জি আচ্ছা।
আমার দাদাজানের খামারবাড়ি কি আপনি ঘুরে দেখেছেন?
জি না।
ঘুরে দেখুন। খামারবাড়ির পুরো পরিকল্পনা আমার। আপনি শিল্পীমানুষ। আপনার মাথায় যদি কোনো আইডিয়া আসে আমাকে বলবেন।–জহির মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে। আজ মেয়েটিকে প্রথম দিনের চেয়ে সুন্দর লাগছে। ব্যাপারটা হাস্যকর। সৌন্দৰ্য্য সময় নির্ভর না। ভোরবেলার ফুল বিকেলেও সুন্দর। মেয়েটি আজ শাড়ি পড়েছে এটা কি একটা কারণ? প্রথম যখন দেখা সেদিন তার পোষাক কী ছিল? শাড়ি ছিল না? জহির মনে করতে পারল না। যেদিন টাকা ফেরত দিতে গেল সেদিন মৃন্ময়ীর সঙ্গে দেখা হয় নি। ম্যানেজার ফরিদের হাতে টাকা দিয়ে এসেছে। ফরিদ কি টাকা ফেরত দিয়েছে? ব্যাপারটা মৃন্ময়ীকে জিজ্ঞেস করা কি উচিত? ত্রিশ হাজার টাকা এদের কাছে তুচ্ছ ব্যাপার। টাকাপয়সা এদের কাছে তেজপাতা। কিংবা তেজপাতার চেয়েও তুচ্ছ কিছু। কাঁঠালপাতা, আমপাতা। আমপাতার কথায় মনে পড়ল মীনা তাকে আমের মুকুল নিয়ে যেতে বলেছে। আমের মুকুল দিয়ে কি এক টক রান্না না-কি টিয়া পছন্দ করে।
জহিরের মেজাজ খারাপ হয়েছে। ঢাকা শহরে সে আমের মুকুল পাবে। কোথায়? সে তো আমবাগানে বাস করছে না। মীনাকে এই সব বলা অর্থহীন।
ভাইয়া শোন, মুকুল যে আনবে মিষ্টি আমের মুকুল আনবে না, টক আমের মুকুল আনবে।
জহির বলল, মিষ্টি টক বুঝব কীভাবে? মুকুল চিবিয়ে দেখব?
ভাইয়া বোকার মতো কথা বলো না তো। তুমি যে গাছের মুকুল আনবে সেই গাছের আম টক কি না জিজ্ঞেস করবে।
ও আচ্ছা।
টুনটুনিকে যে সোনার কিছু দিতে বলেছিলাম তার কী করবে? শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে আমি বেইজ্জত হব তাই চাও?
তোরা যেদিন চলে যাবি সেদিন পাবি।
তোমার বাজেট কত বল? আমি গয়নার দোকানে গিয়ে দেখব এই বাজেটে কি পাওয়া যায়।
বাজেট এখনও ঠিক করি নি। দেখি কি করা যায়।
ভাইয়া তোমার এখানে আসার পর থেকে আমরা ঘরের রান্না খাচ্ছি। ঢাকায় এত বড় বড় রেস্টুরেন্ট হয়েছে–আমাদের বাইরে খাওয়াও। একদিন সীজা হাটে নিয়ে যাও।
হবে ব্যবস্থা হবে।
জহির দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মীনার সঙ্গে একদিন বসতে হবে। তার অনৈতিক অবস্থান ব্যাখ্যা করতে হবে। যেদিন এই বৈঠক হবে সেদিন সে সরাসরি বলবে, মীনা তোর স্বামীর নামটা যেন কী? আমি নাম ভুলে গেছি। নাম বল। নাম দিয়ে শুরু হোক। এই ঘটনা দ্রুত ঘটিয়ে ফেলতে হবে। শুভস্য শীঘ্রম যেমন সত্যি অশুভস্য শীঘ্রম। অশুভ ঘটনাও দ্রুত ঘটিয়ে ফেলতে হয়। দেরি করা যায় না।
জহির ঘুরে ঘুরে খামারবাড়ি দেখছে। এক জায়গায় নকল পাহাড়ের মতো করা হয়েছে। নকল ঝরনা বসেছে। ঝির ঝির করে পানি পড়ছে। ঝরনার পেছন থেকে পানির পাম্পের শব্দ কানে আসছে। হাস্যকর ব্যাপার।
আরেক জায়গায় গোল করে লাগানো সুপাড়ি গাছের সারি পাওয়া গেল। মাঝখানে বসার ব্যবস্থা। মার্বেল পাথরে বানানো বেঞ্চ। কয়েক লক্ষ টাকা নিশ্চয়ই মার্বেল পাথরের পিছনে খরচ হয়েছে। এই জিনিসটা হয়েছে হাস্যকর। বসার জায়গায় মাথার উপরে ছায়া থাকতে হবে। সুপারি গাছে ছায়া দেয় না।
আরেকটু আগাতেই আম বাগান পাওয়া গেল। প্রচুর আমগাছ। প্রতিটি গাছের গোড়া ক্যান্টনমেন্টের গাছের মতো শাদা রঙ করানো। সবাই যেন শাদা প্যান্ট পরে দাঁড়িয়ে আছে। ফরোয়ার্ড মার্চ বলার সঙ্গে সঙ্গেই এরা সামনের দিকে মার্চ শুরু করবে। বেশ কিছু আমগাছে মুকুল ফুটেছে। আশেপাশে কেউ নেই। দূর থেকে কেউ নিশ্চয়ই দুরবিন দিয়ে তাকে দেখছে না। পকেট ভর্তি করে আমের মুকুল নিয়ে যাওয়া যায়। টিয়াবাবু আমের মুকুলের টক খাবে। খা টক রাতে আলিমুর রহমানের শরীর খারাপ হলো। শ্বাস কষ্ট। বুকে ব্যথা। তিনি মুখ বড় করে নিঃশ্বাস নিতে লাগলেন। মৃন্ময়ী চিন্তিত গলায় বলল, চল ঢাকা চলে যাই।
আলিমুর রহমান বললেন, দুপুরে বেশি খেয়ে ফেলেছি বলে এই অবস্থা। ঠিক হয়ে যাবে।
এ রকম কি প্রায়ই হয়?
যেদিন বেশি খেয়ে ফেলি সেদিন হয়।
ঠিক হতে কতক্ষণ লাগে?
কোনো কোনো দিন চট করে ঠিক হয়। কোনো কোনো দিন চার-পাঁচ দিন। লাগে।
ঘরে কি অক্সিজেনের সিলিন্ডার আছে?
না। দরজা জানালা সব খুলে দে। এতেই হবে।
দাদাজান আমার কথা শোন। চল ঢাকায় চলে যাই। তোমাকে কোনো একটা ক্লিনিকে ভর্তি করি।
আলিমুর রহমান হাপাতে হাপাতে বললেন, ঠিক হয়ে যাবে, ঠিক হয়ে যাবে।
তার নিঃশ্বাস স্বাভাবিক হলো রাত একটায়। তিনি বিছানায় উঠে বসতে বসতে বললেন, বলেছিলাম না ঠিক হয়ে যাবে। আর কালাম গাধাটাকে বল এক কাপ লেবু চা আর কাগজ-কলম আনতে।
কাগজ কলম দিয়ে কী হবে?
আমি উইল করব।
চা খাও। খেয়ে ঘুমাও। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি।
উইল করে তারপর ঘুমাব। অবস্থা তো দেখছিস। যে কোনো একদিন মরে যাব। আর তখন আমার গাধাপুত্র সব দখলকরে বসে থাকবে। দু হাতে টাকা উড়াবে। ছবি কিনবে। দুই কোটি তিন কোটি টাকা দিয়ে জমি কিনবে জমির দখল নিতে পারবে না।
মৃন্ময়ী বলল, উইল করা হবে। এখন না, কাল ভোরে।
আমি এখনই করব।
মৃন্ময়ী বলল, আচ্ছা এখন আগে চা খাও। চা খেয়ে চোখ বন্ধ করে দশ মিনিট রেস্ট নাও। তারপর যদি মনে কর উইল করা দরকার উইল করবে।
তেরি কী চাই বল?
দাদাজান আমার কিছুই চাই না। তুমি অনেকবার আমাকে জিজ্ঞেস করেছ তোর কী চাই? আমি প্রতিবারই বলেছি আমার কিছুই চাই না। এখনও আমার একই উত্তর।
আলিমুর রহমান হঠাৎ হাসতে শুরু করলেন। শিশুর হাসির মতো সরল আনন্দময় হাসি।
মৃন্ময়ী বলল, হাসছ কেন দাদাজান?
মজার একটা আইডিয়া মাথায় এসেছে এই জন্যে হাসছি। তোর বাবাকে চূড়ান্ত শিক্ষা দেয়ার আইডিয়া।
বল শুনি।
তোর বাবা তো শিল্পবোদ্ধা হয়েছে। ছবি কিনে ঘর বোঝাই করবে। উইল করে তোর বাবাকে একটা ছবি দিয়ে যাব। সে আর কিছুই পাবে না।
কোন ছবি দেবে?
আজ যে আর্টিস্ট এসেছিল তাকে দিয়ে আঁকাব। আমার ছবি। আমি কঠিন চোখে তাকিয়ে আছি এ রকম ছবি। আইডিয়া কেমন?
আইডিয়া ভালো।
তোর বাবার শিক্ষা সফর হয়ে যাবে না?
হবার কথা।
আর্টিস্টকে টেলিফোন কর সে যেন এক্ষুনি রং-তুলি নিয়ে চলে আসে।
দাদাজান রাত বাজে দুটা। এ সময় কাউকে টেলিফোন করা যায় না। তাছাড়া আমি উনার টেলিফোন নাম্বারও জানি না। আমি ব্যবস্থা করে দেব যেন কালই উনি চলে আসেন।
আলিমুর রহমানের মাথায় আরও একটা আইডিয়া চলে এল। তিনি মৃন্ময়ীর দিকে ঝুঁকে এসে বললেন, তোর বাবা এখন যে বাড়িটায় থাকে সেই বাড়িটার ব্যাপারে কী করা যায়? তোর বাবা ধরেই নিয়েছে যে বাড়িটা তার। উইল যখন পড়া হবে তখন তার ব্রহ্মতালু জ্বলে যাবে। বাড়িটা কাকে দিলে তার ব্রহ্মতালু জ্বলবে।
এটা তো বুঝতে পারছি না।
আলিমুর রহমান বললেন, ঐ বাড়ির অতি তুচ্ছ কাউকে দিতে হবে, মালী দারোয়ান, কাজের বুয়াটুয়া কাউকে। যাকে তোর বাবা দু চোখে দেখতে পারে না।
মৃন্ময়ী বলল, বিন্তিকে দেয়া যায়।
বিন্তিটা কে?
আমাকে দেখাশোনা করে। নতুন এসেছে। বাবা কি কারণে যেন তাকে সহ্যই করতে পারে না।
ঠিক আছে বিন্তি। তোর বাবা এক সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখবে বিন্তি বিশাল বাড়ির মালিক। আর শিল্পবোদ্ধা শাহেদুর রহমান আমার একটা ওয়েল পেইনটিং হাতে নিয়ে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে আছেন। হা হা হা।
অতিরিক্ত হাসির কারণেই আলিমুর রহমানের বুকের ব্যথা আবার শুরু হলো। ভয়াবহ শ্বাস কষ্ট। সকাল আটটায় ব্যথা কমল। তিনি ঘুমুতে গেলেন। মৃন্ময়ী চলে এল ঢাকায়।