০৩. মৃত মানুষকে ভুলে যেতে

এক জন মৃত মানুষকে ভুলে যেতে আমাদের কত দিন লাগে?

তীব্র শোক কাটতে লাগে দুদিন, তীব্র শোকের পরের অংশ ভোঁতা শোক কাটতে দশ দিনের মতো লাগে। কোনো রকমে পনের দিন কাটিয়ে দিতে পারলে পুরোপুরি নিশ্চিন্ত। তখন আর মৃত মানুষদের কথা মনেই থাকে না। মানুষ অতি উন্নত প্রাণী বলেই শোক পনের দিনের মতো ধরে রাখে। নিম্ন শ্রেণীর প্রাণীরা চৰ্বিশ ঘন্টার বেশি ধরে রাখতে পারে না।

আমাদের কাজের মেয়েটি একবার ঝাড়ু দিয়ে পিটিয়ে বিড়ালের তিনটা বাচ্চা মেরে ফেলল। মা-বিড়ালটা পাগলের মতো হয়ে গেল। নালিশ জানাবার ভঙ্গিতে একেকজনের পায়ের কাছে গিয়ে পড়ছে, ছটফট করছে। মা-বিড়ালের দুঃখ দেখে আমরা সবাই অভিভূত হয়ে গেলাম। কাজের মেয়েটাকে তার নৃশংসতার জন্যে মাসের পুরো বেতন দিয়ে বরখাস্ত করা হল। সে হাসিমুখে তার টিনের সুটকেস নিয়ে মিরপুরে চলে গেল। চব্বিশ ঘন্টা পর দেখা গেল মা-বিড়াল তার সন্তান-শোক ভুলে দিব্যি। খাওয়া-দাওয়া করছে। বিকেলে রোদে শুয়ে আরামে হাই তুলছে। এদিকে মতির মার অভাবে সংসার হয়েছে অচল। ঢাকা শহরে কাজ করতে পারে, এ রকম কাজের মেয়ে বাঘের চোখের মতোই দুর্লভ। কাজেই পরদিন সকালে আমি নিজেই মতির মাকে আরো কুড়ি টাকা বেশি বেতন কবুল করে নিয়ে এলাম। তিনটি বিড়ালছানা-হত্যার জন্য মতির মার কুড়ি টাকা বেতন বেড়ে গেল। মাস চারেকের মধ্যে মা-বিড়ালটা বাচ্চা দিল। নিজের ক্ষমতা জাহির করবার জন্যেই মতির মা ঐ বাচ্চা কটিকেও আগের ভঙ্গিতে ঝাড়ু দিয়ে পিটিয়ে মারল। আমরা এইবার তাকে আর কিছু বললাম না। আর আশ্চর্য, মা-বিড়ালটাও আগের মতো হৈচে, দৌড়-ঝাঁপ করল না। সে হয়ত ইতিমধ্যে কন্ডিশন্ড হয়ে গেছে। ধরেই নিয়েছে, একেকবার বাচ্চা হবে এবং মতির মা ঝাড়ু দিয়ে সেগুলোকে পিটিয়ে মারবে। পৃথিবীর নিষ্ঠুরতা সে গ্রহণ করেছে শান্ত ভঙ্গিতে।

আমরা মানুষরাও কি তাই করি না? .

মেজো খালার উত্তর শাহজাহানপুরের বাসায় পা দিয়ে এই জাতীয় কিছু। ফিলসফিক চিন্তা মাথায় এল। এই বাড়িটির সঙ্গে আমার মেজো খালুর অনেক দুঃখকষ্ট এবং স্বল্প জড়িয়ে আছে। এই বাড়ির প্রতিটি ইটে তাঁর মমতামাখা। অথচ বেচারা এই বাড়িতে উঠবার দুদিন আগে মরে গেলেন। প্রকৃতির কী ভয়াবহ নিষ্ঠুরতা। অথচ ফরিদা খালাকে দেখে মনে হল প্রকৃতির এই নিষ্ঠুরতাকে তিনি শান্ত ভঙ্গিতে গ্রহণ করেছেন। হাসি-খুশিতে বাগানে কী যেন একটা চারা লাগাচ্ছেন। আমি বললাম,

আপনাদের নতুন বাড়ি দেখতে এলাম খালা।

খালা আনন্দিত স্বরে বললেন, আয় আয় আয়।

বাড়ি কোথায় খালা, এ তো দেখি রাজপ্রাসাদ। হুলস্থূল কারবার।

আনন্দে খালার মুখ আরো উজ্জ্বল হল। তিনি প্রায় কিশোরীদের গলায় বললেন, বাইরে থেকে বড় দেখায়, আসলে অত বড় না। রুমগুলো ছোট ছোট।

তাই নাকি?

শুধু মাস্টার বেডরুমটা বেশ বড়। অন্যগুলো ছোট।

রুম সব মিলে কটা?

খালা হড়বড় করে রুমের সংখ্যা, বাথরুমের সংখ্যা, স্টোররুমের আয়তনের কথা বলতে লাগলেন। আমি এমন ভঙ্গি করলাম যেন গভীর আগ্রহে শুনছি। শুনে খুবই আনন্দ পাচ্ছি। নিজের আগ্রহটা বোঝাবার জন্যে দুএকটা টুকটাক প্রশ্ন করতে হচ্ছে, মাঝে মাঝে মাথা নাড়াতে হচ্ছে।

বুঝলি টুকু, স্টোররুমটাকে অনায়াসে একটা ঘর করা যায়। বড় জানালা আছে, সিলিং ফ্যান লাগাবার ব্যবস্থা আছে। ভাবছি ঐটাকে একটা ঘর করব।

কিন্তু আপনার তো একটা স্টোররুম দরকার।

কোনোই দরকার নেই। রান্নাঘরেবিট-ইনকআছে। রাজ্যের জিনিস সেখানে রাখা যায়।

তাহলে তো চমৎকার।

ভালে আর্কিটেক্ট দিয়ে বাড়ি করবার এই হচ্ছে সুবিধা। নৰ্বই হাজার টাকা নিয়েছে আর্কিটেক্ট। তখন সবাই বলেছে, এত টাকা আর্কিটেক্টকে দেয়ার দরকার কী? তারা যাকরবে তা তো জানাই আছে। থোড় বড়ি খাড়া খাড়া  বড়ি থোড়। আমি নিজেও তাই ভেবেছিলাম। এখন দেখলাম আর্কিটেক্টের দরকার আছে।

তবে যে বললেন রুমগুলো হোট ছোট হয়েছে।

মডার্ন আর্কিটেক্ট রুম ছোট ছোট হয়। বড় রুম দিয়ে তুই কররি কী? ফুটবল খেলার জন্য তো রুম না।

তা তো বটেই।

তোর সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে। তুই এসেছিস খুব ভালো হয়েছে। তোদর বাড়ির কি সব উড়ো খবর পাচ্ছি। সত্য-মিথ্যা তাও জানি না। টেলিফোন করে যে খোঁজ নেব সেই উপায়ও নাই। টেলিফোন কানেকশন এখনো দেয় নি। সপ্তাহ খানিকের মধ্যে নাকি দেবে। ওদের বিশ্বাস নেই। শেষ পর্যন্ত টাকাই খাওয়াতে হবে। তুই ভেতরে গিয়ে বোস, আমি চারা কটা লাগিয়ে আসছি।

রিমি আছে?

হ্যাঁ, আছে। ওর শরীরটা ভালো না। ডাক্তারকে খবর দিয়েছি, ডাক্তার এখন আসে নি। একা কদিক সামলাব?

রিমি হলুদ রঙের একটা চাদর জড়িয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে খাটের উপর বসেছিল। তার কোলের উপর একটা বই। গায়ে চাদর থাকা সত্ত্বেও তার মাথার উপর ফুলস্পিডে ফ্যান ঘুরছে। রিমিকে দেখে একটু মন খারাপ হল। যে কোন সুন্দর জিনিসের মধ্যে মন খারাপের একটা উপাদান থাকে। রিমিকে যখনই দেখি তখনি মনে হয় আগের বার যে রকম দেখেছিলাম, তারচে সে আরো সুন্দর হয়েছে। আজ তার শরীর ভালো না। চোখের নিচে কালি পড়েছে। অথচ কি আশ্চর্য, চোখের এই কালিও মানিয়ে গেছে।

রিমি বয়সে আমার মাস তিনেকের বড়। তার সঙ্গে আমার সম্পর্কের মধ্যে খানিকটা জটিলতা আছে। অনেক দিন তার সঙ্গে দেখা না হলে সে আমাকে চিঠি লিখবে। সেইসব চিঠিকে সরল বাংলায় প্রেমপত্র বলা ছাড়া উপায় নেই। চিঠি পড়লে মনে হবে, আমাকে না দেখার কষ্টে সে মরে গেছে। কিন্তু সেই চিঠি পেয়ে ব্যস্ত হয়ে ছুটে এলে সে কেন জানি বিরক্ত হয়। আমি একবার তার আবেগপূর্ণ চিঠির জবাবে কিছু গাঢ় কথা লিখে ফেলেছিলাম, সে দারুণ রাগ করেছিল। টেলিফোন করে বলল, তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? এইসব তুই কী লিখেছিস? ছিঃ! তুই ছোটভাই, ছোটভাইয়ের মতো থাকবি। এসব কী! তুই কি আমার সঙ্গে প্ৰেম প্ৰেম খেলা খেলতে চাস? রাগে আমার গা-টা জ্বলে যাচ্ছে।

বলেই সে টেলিফোন খট্‌ করে রেখে দিল। কিছুক্ষণ পর আবার টেলিফোন। এবারে গলা আগের চেয়েও চড়া-টুকু শোন্ আমাদের বাড়িতে আর আসবি না। তোর মনের মধ্যে পাপ আছে। খবরদার, তুই কিন্তু আসবি না।

আমি ঐ বাড়িতে যাওয়া ছেড়ে দিলাম। এক মাসের মাথায় রিমির চিঠি এসে উপস্থিত। আবেগে টইটমুর চিঠি।

আজ যে এই বাড়িতে এসেছি সেও চিঠি পেয়ে। তাও এমন চিঠি, যেই পড়বে মাথায় হাত দিয়ে বসবে।

রিমি আমাকে দেখে কোল থেকে বই নামিয়ে বলল, তুই দেখি বাগানে মার সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বললি।

হ্যাঁ, বললাম।

কী কী কথা হল শুনি।

তেমন কিছু না।

যেমনই হোক কথাগুলো আমি শুনতে চাই।

বললাম তত, ইম্পৰ্টেন্ট কোনো কথা হয় নি। বাড়ি নিয়ে কথা হল। রুমগুলো ছোট ছোট, এইসব।

রিমি এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, বাবার সম্পর্কে মা কি তোর সঙ্গে কোনো কথা বলেছেঃ হা কিংবা না বলবি। হয়েছে কোনো কথা?

না।

বাবা মারা গেলেন পনের দিনও হয় নি। আজ হচ্ছে ফোর্টিনথ ডে, অথচ মা বাবার সব স্মৃতি মুছে ফেলেছে। সারাক্ষণ বাড়ি বাড়ি করছে। ঘর সাজাচ্ছে। বাগান করছে। আমি অবাক হয়ে লক্ষ করছি। তাঁকে দেখে যে কেউ বলবে—এক জন সুখি মহিলা। ওজন পর্যন্ত বেড়েছে। পরশু রাতে বাথরুমে গুন গুন করে গান গাইছিল।

কষ্টের একটা ব্যাপার সারাক্ষণ মনে রেখে লাভ নেই। কেউ রাখেও না। তুইও রাখবি না। কিছুদিন পর দেখা যাবে তুইও দুপুরবেলা শিবরামের বই পড়ে খিলখিল করে আসছিল।

টুকু, আমাকে তুই তুই করে বলবি না। তোর মুখে তুই শুনতে খুব খারাপ লাগে।

আচ্ছা বলব না।

বোস। দাঁড়িয়ে আছিস কেন?

আমি বসলাম। রিমি তার গায়ের চাদর ফেলে দিয়ে কাছে এগিয়ে এল। গলার স্বর নিচু করে বলল, আনন্দে মার মাথা এলোমেলো হয়ে গেছে।

আমার তো মনে হয় তোর নিজের মাথাই এলোমেলে।

আমার মাথা আগে যা ছিল এখনো তাই আছে। আর তা নেই। বাবার টাকা নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে।

ছিনিমিনি খেলছে মানে?

রকিব সাহেব বলে এক ভদ্রলোককে দুলাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। উনি ঐ টাকা দিয়ে ব্যবসা করবেন এবং তার আয় থেকে মাকে মাসে মাসে সাত হাজার টাকা দেবেন। ঐ টাকায় আমাদের সংসার চলবে।

ব্যবস্থা তত ভালেই মনে হচ্ছে।

তোর মাথা মোটা, এই জন্যে তোর কাছে ব্যবসা ভালো বলে মনে হচ্ছে। ঐ লোকটা ধুরন্ধর প্রকৃতির।

বুঝলি কী করে?

আমি বুঝতে পারি। মানুষের চোখের দিকে তাকালেই সেই মানুষটা কেমন আমি বুঝতে পারি। যেমন ধর, তুই-তুই হচ্ছিস বোকা।

শুনে ভালো লাগল।

শুনে তোর ভালো লাগছে। কারণ তুই বোকাই থাকতে চাস। বোকা থাকার মজা আছে, এইটা তুই টের পেয়ে গেছিল।

রকিব সাহেব লোকটা কে?

বাবার বন্ধু। আগেও আসত। তখন ড্ৰয়িং রুমে বসে ভিসিআর দেখত। এখন সরাসরি মার শোবার ঘরে উঁকি দেয়।

উকি দেয়া এবং ঢুকে যাওয়া তো এক না।

এখন উঁকি দিচ্ছে। দুদিন পরে ঢুকবে।

রিমি আবার চাদর দিয়ে শরীর ঢেকে ফেলল। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তুই তো জানি না আমরা এখন সমস্ত আত্মীয়স্বজন থেকে আলাদা। মা আমার সব চাচাদের সঙ্গে ঝগড়া করছেন।

কারণ কি?

মার ধারণা, সব চাচাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে আমাদের টাকা-পয়সা হাতানো। মা তা হতে দিতে চান না।

তোদের কি অনেক টাকা নাকি?

মনে হচ্ছে তাই। অবশ্যি আমি ঠিক জানি না। বাবার তিনটা ইস্যুরেন্স ছিল। সেখান থেকে টাকা এসেছে। ফিক্সড ডিপোজিট ছিল। ডিফেন্স বন্ড ছিল। সাভারে জমি আছে দুবিঘা। নিউ এয়ারপোর্টের কাছে দশ কাঠা জমি কেনা হয়েছে। মগবাজারে একটা ফ্যাট কেনা আছে। চারতলায় ফ্ল্যাট।

বলিস কী।

বাবা অসৎ লোক ছিলেন তা জানতাম কিন্তু এতটা অসৎ ছিলেন তা জানতাম না। যতই জমিজমা, বিষয়-সম্পত্তির খবর পাচ্ছি ততই অবাক হচ্ছি।

অসৎ মানুষের ছেলেমেয়েদের জীবন মোটামুটি সুখেরই হয়। তাদের টাকাপয়সার অভাব থাকে না। ভোর জীবনটা সুখেই কাটবে।

রিমি ক্লান্ত চোখে তাকিয়ে রইল। আমি বললাম, শুয়ে থাক, তোর বোধহয় জ্বর বাড়ছে।

রিমি ক্লান্ত গলায় বলল, দিন দিন তোর চেহারা এত খারাপ হচ্ছে কেন?

খারাপ হচ্ছে নাকি?

কেন, আয়নায় নিজেকে দেখিস না? তোকে দেখাচ্ছে বাসের কন্ডাকটরদের মত। আচ্ছা, তুই এখন যা, তোর সঙ্গে কথা বলতে এখন আর ভালো লাগছে না।

 

মেজো খালার বাগানের কাজ শেষ হয়েছে। তিনি ঝরনার পানিতে হাত ধুচ্ছেন। আমাকে বেরুতে দেখে অপ্রসন্ন গলায় বললেন, কথা হয়েছে রিমির সঙ্গে?

হুঁ।

ও কী বলল?

তেমন কিছু না।

আহ শুনি না। কী বলল? আমার সম্পর্কে কিছু বলেছে?

না।

আমার শত পুরুষের ভাগ্যি। ও তো আমাকে এখন দুচোখে দেখতে পারে না। এমন সব কথা বলে যে, ইচ্ছে করে ঘর থেকে ছুটে বের হয়ে যাই। আমি নাকি তার বাপের সম্পত্তি নয় ছয় করছি। ওর আছে কী যে আমি নয় ছয় করব? একটা দারোয়ান রেখেছি, একটা মালী রেখেছি। অনুচিত হয়েছে? তুই বল।

না। অনুচিত হয় নি।

রিমির ধারণা, দারোয়ানমালী এসব আমাদের দরকার নেই। আমরা দুজন মোটে মেয়েমানুষ, একা একা থাকি। দারোয়ান-মালী ছাড়া চলবে কিভাবে?

তা তো বটেই।

এসব কথা থাক। তোর কাছে তোদর কথা শুনি।

কী শুনতে চান?

তোদের বাড়িতে হচ্ছেটা কী?

কিসের কী হচ্ছে?

ন্যাকা সাজবি না। ভোর ন্যাকা ভাবটা অসহ্য। তোর ছোট চাচা নাকি কোন নার্সকে বিয়ে করে ফেলেছে?

এ রকম অবশ্যি শোনা যাচ্ছে। সত্যি-মিথ্যা জানি না।

আমি তো শুনলাম, ঐ হারামজাদীকে বাড়িতে নিয়ে তুলেছে। তোর ছোট চাচী ঘুমের ওষুধ খেয়ে মর মর।

সে রকম কিছু না তো!

বলিস কী?

যা শুনছ সবই গুজব। বাসায় বলতে গেলে কিছুই হয় নি। খুবই শান্ত পরিস্থিতি। এত শান্ত যে মনে হচ্ছে ছোট চাচা সম্পর্কে যা শুনছি, তাও গুজব।

মেজো খালা এমনভাবে তাকালেন যেন বঝতে চেষ্টা করছেন আমি সত্যি বলছি না। মিথ্যা বলছি। আমার মুখ দেখে তা বোঝা বেশ শক্ত। আমি মিথ্যা কথা বলার সময় খুব স্বাভাবিক থাকি। অত্যন্ত সন্দেহপরায়ণ মানুষও দ্বিধায় পড়ে যায়। মেজো খালা যেমন দ্বিধায় পড়ে গেছেন।

যাই খালা।

চাটা কিছু খেয়ে যা।

আজ একটা জরুরি কাজ আছে। অন্যদিন এসে চা খেয়ে যাব।

তোদের বাসায় তাহলে কোনো ঝামেলা নেই।

উহুঁ।

বাসায় ঝামেলা নেই কথাটা এক শ ভাগ মিথ্যা। অসম্ভব ঝামেলা চলছে। ছোট চাচী সত্যি সত্যি ঘুমের ওষুধ খেয়ে কেলেংকারি কাণ্ড করেছে। ছোট চাচীর বাবা রিটায়ার্ড জাজ সাহেব বলেছেন, তিনি দেখে নেবেন। আমার বড় চাচা ঘন ঘন মিটিং করছেন। ছোট চাচাকে আলটিমেটাম দেয়া হয়েছে। বড় চাষীকে আমেরিকায় টেলিফোন করা হয়েছে। শুক্রবারে তাঁর আসার কথা।

ছোট চাচা কদিন ধরেই চেম্বারে যাচ্ছেন না। বেশিরভাগ সময় দরজা বন্ধ করে নিজের ঘরে বসে থাকেন। এই কদিন দাড়ি-গোঁফ না কামানোয় সমস্ত মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। কুৎসিত একটা অবস্থা। এদিকে বাবা আবার বিছানায় পড়ে গেছেন। দিনে কুড়িবার করে তাঁকে বাথরুমে যেতে হচ্ছে। কয়েক গ্যালন স্যালাইন ওয়াটার খেয়ে তাঁর কিছু হচ্ছে না।

এতসব ঝামেলার মধ্যে কমলা আবার ছাদে ভূত দেখে দাঁত কপাটি লেগে পড়ে গেল। ভূতটা নাকি শূন্যে হাঁটছিল। কমলাকে দেখেই লম্বা কালো হাত বাড়িয়ে বলল,

এই কমলা, তোকে ছুঁয়ে দিলাম।  কমলার এই ভূতের কথা কেউ বিশ্বাস করছেনা, তবে সবাই ভয়ে আধমরা। মীরাইরা সামান্য শব্দেই চেঁচিয়ে উঠছে। মাকে ঘুমুতে হচ্ছে মীরা-ইরার সঙ্গে। অথচ তাঁর খুব ইচ্ছা তিনি অসুস্থ বাবার সঙ্গে থাকেন। তা সম্ভব হচ্ছে না।

গতকাল রাতে আমাকে এসে বললেন, ও টুকু, তুই তোর বাবার সঙ্গে ঘুমুবি?

আমি হেসে ফেললাম।

মা দুঃখিত গলায় বললেন, হাসছিস কেন? হাসির কথা বলেছি?

হুঁ বলেছ।

বাবার সাথে ছেলেরা ঘুমায় না?

দশ বছরের নিচের ছেলেরা হয়ত ঘুমায়। চব্বিশ পঁচিশ বছরের জোয়ান ছেলেরা ঘুমায় না।

ঘুমুলে অসুবিধা কী?

ঘুমুলে দুজনেরই ক্ষতি হয়। দুজনেরই অহংবোধে আঘাত লাগে। ব্যক্তিত্বের সংঘাত শুরু হয়। শুরুটা চেইন রিএ্যাকশনের মতো। একবার শুরু হলে অতি দ্রুত এক্সপ্লোসিভ লিমিটে পৌঁছে যায়। তুমি বুঝবে না।

মা চুপ করে গেলেন।

কিছু কঠিন কঠিন শব্দ এদিক-ওদিক করে বললেই মা চুপ করে যান। ক্ষীণ স্বরে মাঝে মাঝে বলেন, কথা বলার সময় তো বড় বড় কথা, এদিকে পরীক্ষায় তো গোল্লা খাস।

আজ সে রকম কিছু বললেন না। ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে চলে গেলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *