০৩. মুরশিদকুলি খানের শাসন

মুরশিদকুলি খানের শাসন

অষ্টাদশ শতাব্দীর সূচনায় বাঙলার রাষ্ট্ৰীয় ইতিহাসের প্রধান নায়ক ছিলেন, মুরশিদকুলি খান। ১৭০০ খ্ৰীস্টাব্দে সম্রাট ঔরঙ্গজেব তাঁকে বাঙলার দেওয়াননিযুক্ত করেন। ঢাকা তখন বাঙলা স্কবার রাজধানী। সুবেদার। আজিম-উসশানের সঙ্গে তাঁর বনিবনা না হওয়ায়, মুরশিদকুলি খান তাঁর দপ্তর ঢাকা থেকে – মুকসুদাবাদে স্থানান্তরিত করেন। মুরশিদকুলি খান বাঙলার রাজস্ব বিভাগের গলদগুলি লক্ষ্য করেন। তিনি দেখেন যে বাঙলা স্ববার বেশীর ভাগ অংশই সামরিক জায়গীরদারদের হন্তে ন্যস্ত। যে অংশ সরাসরি সুবেদারের নিয়ন্ত্রণে, তার আয় স্ববার সামরিক ও অসামরিক শাসন বিভাগের ব্যয় নির্বাহের পক্ষে ষথেষ্ট নয়। এই কারণে বাঙলা সুবা সবসময়েই ঋণে ডুবে থাকত, এবং এই ঋণ। পরিশোধ করা হত। অন্যান্য সুবার অর্থে। মুরশিদকুলি খান দেখলেন যে বাঙলার রাজস্ব প্ৰভূত পরিমাণে বাড়ানো যেতে পারে, যদি সমস্ত ভূম্যধিকারীদের সরাসরি দেওয়ানের অধীনস্থ করা হয়। তিনি এই প্ৰস্তাব ঔরঙ্গজেবের নিকট পেশ করেন। সম্রাট তাঁর প্রস্তাব অনুমোদন করেন।

রাজস্ব আদায় ও জমি বিলির স্থব্যবস্থা করে, মুরশিদকুলি খান বাঙলা দেশের মালগুজারী বাবদ প্ৰতি বৎসর এক কোটি টাকা ঔরঙ্গজেবকে পাঠাতে থাকেন। তার মানে সম্রাটকে খুশী করে নিজের পদ সুপ্রতিষ্ঠিত করবার জন্য বাঙলাকে তিনি দোহন করতে শুরু করেছিলেন। বাঙলার রাজস্ব বৃদ্ধি পাওয়ায় তিনি ঔরঙ্গজেবের প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন। এতে বাঙলার সুবেদার। আজিম-উস-শান ভঁর প্রতি ঈর্ষান্বিত হন। তিনি মুরশিদকুলি খানকে হত্যার জন্য, আবদুল ওয়াহিদ নামক নগদি অশ্বারোহী বাহিনীর এক সেনাপতির সঙ্গে এক চক্রান্ত করেন। পথিমধ্যে তাকে হত্যার জন্য তিনি মুরশিদকুলি খানকে ঢাকায় ডেকে পাঠান। পথে মুরশিদকুলি খান আক্রান্ত হন। কিন্তু আক্রমণের মুর্শিদকুলি খান অসাধারণ সাহস প্ৰদৰ্শন করায়, এই চক্ৰান্ত ব্যর্থ হয়ে যায়। ঢাকায় পৌঁছে মুরশিদকুলি খান আজিম-উল শানকে এই চক্রান্তের স্রষ্টা হিসাবে দোষী করেন ও ছোরা হাতে নিয়ে বলেন- ‘তুমি যদি আমার প্রাণ নিতে চাও, তাহলে এখানেই তার মীমাংসা হয়ে যাক, নচেৎ তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি যে এরূপ কাৰ্য থেকে তুমি ভবিষ্যতে বিরত থাকবে।‘ আজিম-উস-শান এ বিষয়ে নিজেকে নিরপরাধ বলে ঘোষণা করেন এবং আবদুল ওয়াহিদকে ভৎসনা করে তার সৈন্যদলকে রাজকীয় বাহিনী থেকে অপস্থত করেন। তারপর মুরশিদকুলি। খান এই ঘটনার এক যথার্থ প্ৰতিবেদন ঔরঙ্গজেবের কাছে পাঠিয়ে দেন। মুরশিদকুলি খানকে হত্যার চক্রান্তের প্রতিবেদন পেয়ে ঔরঙ্গজেব ক্রোধান্বিত হয়ে আজিম-উস-শানকে লিখে পাঠান যে মুরশিদকুলি খানের কোন ক্ষতি হল আজিম-উল-শান তার পৌত্র বলে রেহাই পাবে না, তিনি যথাযথ শান্তি দিবেন। এ ছাড়া তিনি আজিম-উস-শানকে বাঙলা ত্যাগ করে বিহারে এসে বাস করতে আদেশ দেন। এই আদেশের পর আজিম-উস-শন বাঙলার শাসনভার তাঁর দ্বিতীয় পুত্র ফারুকশিয়ারের ওপর অর্পণ করে, পাটনায় চলে যান।

দুই

নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে মুরশিদকুলি খান রাজস্বের পরিমাণ রীতিমত বাড়িয়ে তোলেন, এবং সশরীরে সম্রাটের নিকট হিসাব-নিকাশ দিতে যান। সম্রাট তার কার্যের প্রশংসা করেন। এছাড়া, তিনি তাঁকে সম্মানিতও করেন। মুরশিদকুলি খানকে তিনি বিহার, বাঙলা ও ওড়িশা এই তিন প্রদেশের দেওয়ানের পদে – পুনর্নিযুক্ত করেন। উপরন্তু তাঁকে বাঙলা এবং ওড়িশার ডেপুটি নিজাম পদেও উন্নীত করেন। আজিম-উশ-শান এতে ভীষণ ক্রুদ্ধ হন, কিন্তু তাঁর পিতামহের। স্বৈরতান্ত্রিক মেজাজের কথা স্মরণ করে, কিছু করতে সাহস করেন না। ইতিমধ্যে ঔরঙ্গজেবের সন্তানদের মধ্যে হিন্দুস্থানের মসনদ নিয়ে দ্বন্দ্বের উদ্ভব হয়, এবং তঁরে তৃতীয় পুত্ৰ সুলতান মহম্মদ আজিম সম্রাটের প্রিয়পাত্র হয়। মহম্মদ আজিম তার ভ্রাতুষ্পপুত্ৰ আজিম-উশ-শানের প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে তাকে পাটনা থেকে দিল্লীতে প্ৰত্যাগমন করতে বলে। এই ঘটনারই কিছু পরে ১৭০৭ খ্রীস্টাব্দে ঔরঙ্গজেবের মৃত্যু ঘটে। জাজোঁ নামক স্থানে মহম্মদ আজিমও নিহত হয়।

আজিম-উশ-শান পাটনা থেকে দিল্লীতে আহুত হবার পর মুরশিদকুলি খানই কার্যত বাঙলা, বিহার ও ওড়িশার শাসক হয়ে দাঁড়ান, যদিও আজিম-উল্‌-শান তাঁর পুত্র ফারুকশিয়ারকে তার উত্তরাধিকারী হিসাবে নাজিমের গদিতে বসিয়ে গিয়েছিলেন।

ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর তাঁর দ্বিতীয় পুত্র বাহাদুর শাহ (আজিম-উস্‌-শানের পিতা) যখন দিল্লীর সম্রাট হন, তখন তিনি পুত্ৰ আজিম-উস-শানের প্ররোচন, মুরশিদকুলি খানকে দক্ষিণাত্যের দেওয়ান করে পাঠান। কিন্তু বাঙলার নূতন শাসক বিদ্রোহী সেনার হাতে নিহত হওয়ায় সম্রাট দেওয়ান ও ডেপুটি নিজামের পদদ্বয় একত্রিত করে মুরশিদকুলি খানকেই বাঙলার শাসক হিসাবে স্বীকৃতি দেন। মুরশিদকুলি খান মেদিনীপুর জেলাকে ওড়িশা থেকে বিচ্ছিন্ন করে বাঙলার সঙ্গে { যুক্ত করেন, এবং নিজ জামাতা শুজাউদ্দিন মহম্মদ খানকে ওড়িশার ডেপুটি নিজাম পদে অধিষ্ঠিত করেন। দুই হিন্দু ব্রাহ্মণকে তিনি দুই বিশ্বস্ত পদ দেন। তাদের মধ্যে ভূপত রায়কে তিনি ট্রেজারী বা খালসার সচিব ও কিশোর রায়কে তার গোপন সচিব বা প্ৰাইভেট সেক্রেটারী নিযুক্ত করেন। কিন্তু হিন্দু জমিদারদের প্রতি তার ব্যবহার অত্যন্ত অত্যাচারপূর্ণ ছিল। প্রদেশের রাজস্ব সম্বন্ধে প্ৰকৃত পরিস্থিতি জানবার জন্য তিনি তাদের বন্দী করেন ও নিজ প্ৰতিনিধির দ্বারা রাজস্ব আদায় করেন। বাঙলার মাত্র দুজন জমিদার এরূপ ব্যবহার থেকে অব্যাহতি পায়। তাদের মধ্যে একজন হচ্ছে বীরভূমের আফঘান ভূস্বামী আশা-উদ-দৌল, -ব্যায়পরায়ণ বাক্তি হিসাবে যার সুনাম ছিল এবং যিনি তার আদায়ীকৃত খাজনার অর্ধেক অংশ জনহিতকর কাজে ব্যয় করতেন। আর অপরজন হচ্ছেন বিষ্ণুপুরের জমিদার, যার জমিদারীর অধিকাংশই অনুর্বর ছিল এবং যিনি ঝাড়খণ্ডের পার্বত্য অঞ্চল থেকে আক্রমণ প্রতিহত করে সরকারকে সাহায্য করতেন। এদের দুজনকে তিনি তাদের জমিদারীতে বহাল রেখেছিলেন এই শর্তে যে তারা নিয়মিতভাবে মুরশিদাবাদের খাজাঞ্চীখানায় রাজস্ব জমা দিবে। এ ছাড়া, মুরশিদকুলি খান বাঙলার সমস্ত জমির নূতন করে জরীপ করেছিলেন (১৭২২)। এই জরীপ ‘জমা-ই-কামিল তুমার’ নামে পরিচিত। এই জরীপ অনুযায়ী বাঙলা দেশকে ১৩টি চাকলায় ভাগ করা হয়। এই ১৩টি চাকলার অন্তভুক্ত মহাল বা পরগণার সংখ্যা ছিল ১৬৬০ ও রাজস্ব পরিমাণ ছিল ১,৪২,৮৮,১৮৬ টাকা।

তাঁর সময়ে ভুষনার জমিদার সীতারাম রায় তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করেন। মুরশিদকুলি কয়েকবার তাঁকে দমনের চেষ্টা করেও অক্ষম হন। ফলে তিনি সৰ্ববিষয়েই স্বাধীন রাজার ন্যায় আচরণ করতে থাকেন। পরে ঐশ্বৰ্যমদে মাত্ত হয়ে ওঠায় তার রাজ্যে বিশৃঙ্খলতার উদ্ভব হয়। সেই সুযোগে নবাব সৈন্য তাঁর বাসগ্ৰাম মহম্মদপুর আক্রমণ করে তাঁকে পরাজিত ও বন্দী করেন। কিংবদন্তী অনুযায়ী তাকে শূলে দেওয়া হয়।

জমিদারদের নিপীড়ন ছাড়া, মুরশিদকুলি খান খুব ন্যায়পরায়ণ শাসক ছিলেন। তার বিচার এত পক্ষপাতশূন্য ছিল যে আইনভঙ্গের জন্য তিনি নিজ পুত্রকেও মৃত্যুদণ্ড দিতে কুষ্ঠিত হননি।

মুরশিদকুলি খানের প্রতাপ ও প্ৰতিপত্তি দেখে ত্রিপুরা, কুচবিহার ও আসামের রাজারা এমনভাবে সন্ত্রস্ত হয়েছিল যে তারা তাঁকে মূল্যবান উপঢৌকন পাঠাতেন, এবং মুরশিদকুলি খান তার পরিবর্তে তাদের প্রতীক-পোষাক উপহার দিতেন, যে পোষাক পরিধান করলে নবাবের আনুগত্য স্বীকার করা হয়। প্ৰতি বৎসরই এইরূপ উপঢৌকন ও উপহার বিনিময় করা হত।

তিন

এই সময় হুগলীর ফৌজদার বাঙলার দেওয়ান ও নাজিম থেকে স্বতন্ত্র ও স্বাধীন ছিল। কিন্তু একই রাজ্যের মধ্যে অন্য এক দ্বিতীয় শাসক থাকা অযৌক্তিক প্ৰতিপন্ন করে, মুরশিদকুলি খান সম্রাটের কাছ থেকে অনুমতি সংগ্ৰহ করেন যে ওই পদে তিমি নিজ মনোনীত ব্যক্তিকে নিযুক্ত করবেন। সেই অনুসারে তিনি ওয়ালি বেগ নামে এক ব্যক্তিকে হুগলীর ফৌজদার নিযুক্ত করেন। আপস্থত ফৌজদার জিনুদ্দিন শান্তভাবেই প্ৰস্থান করবার জন্য প্ৰস্তুত হয়, কিন্তু ওয়ালি বেগ যখন অপস্থত ফৌজদারের পেশকার কিঙ্কর সেনকে হিসাবপত্র বুঝিয়ে দেবার জন্য আটক করে, তখন অপস্থত ফৌজদার জিমুদিন এর প্ৰতিবাদ করে এবং তার ফলে সংঘর্ষ হয়। জিমুদ্দিন চুঁচুড়ায় অবস্থিত ওলন্দাজদের ও চন্দ্রনগরে অবস্থিত ফরাসীদের কাছ থেকে সাহায্য প্রার্থনা করে। মুরশিদকুলি খান তখন ওয়ালি বেগের সাহায্যার্থে দলপত সিং নামে এক ব্যক্তির অধীনে সৈন্য প্রেরণ করেন। দলপত সিং চন্দ্রনগরের কাছে শিবির স্থাপন করে। কিন্তু কোনরূপ যুদ্ধে প্ৰবৃত্ত হয় না। কিছুদিন পরে জিনুদিন। সন্ধি স্থাপনের জন্য দলপত সিং-এর কাছে এক দূত প্রেরণ করে। ওই দূতের সঙ্গে দলপত সিং যখন কথোপকথনে নিযুক্ত ছিলেন, সেই সময় এক ফরাসী গোলন্দাজ কর্তৃক নিক্ষিপ্ত গোলা এসে তাঁর ওপর পড়ে, এবং তিনি নিহত হন। দলপত সিং-এর মৃত্যুর পর নবাবের সৈন্যবাহিনী কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে হুগলীতে গিয়ে আশ্ৰয় নেয়। এর পর জিমুদ্দিন শান্তভাবে দিল্লীতে চলে যায়। নবাব কিঙ্কর সেনকে ক্ষমা করেন এবং তাঁকে হুগলী জেলায় রাজস্ব আদায়কারীর পদে নিযুক্ত করেন। কিন্তু পরে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আসায়, তাকে কারারুদ্ধ করা হয়। এর অল্পদিন পরে কারাগারেই তার মৃত্যু হয়।

রাজস্ব আদায় ব্যাপারে মুরশিদকুলি খানের নীতি কঠোরতার চূড়ান্ত ছিল। এ বিষয়ে তাঁর নিযুক্ত লোকেরা নানাবিধ অমানুবিক শান্তি ও পীড়ন দ্বারা রাজস্ব আদায় করত, যেমন মাথা নীচের দিকে করে পা বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা কিংবা শীতকালে উলঙ্গ করে গায়ে ঠাণ্ডা জল ঢেলে দেওয়া, বগলের তলা দিয়ে দড়ি বেঁধে পচা পুকুরের মধ্য দিয়ে টেনে নিয়ে যাওয়া ইত্যাদি। কখনও কখনও তাদের ঢাউস ইজের পরিয়ে তার ভিতর জ্যান্ত বিড়াল ছেড়ে দিত। এরূপ উৎপীড়ন ও অত্যাচার দ্বারা জমিদারদের কাছ থেকে রাজস্ব আদায় করা হত। এবং প্ৰতি বৎসর বৈশাখ মাসে ৩০০ অশ্বারোহী ও ৫০ ০ পদাতিক সৈন্য সমভিব্যাহারে দিল্লীতে সম্রাটের নিকট এক কোটি পঞ্চাশ লক্ষ টাকা পাঠানো হতু। এর ফলে গোটা দেশ করভারে পীড়িত হয়ে পড়েছিল।

চার

আমরা আগেই বলেছি যে আজিম-উস-শান যখন দিল্লীতে প্ৰত্যাগমন করেন, তখন তিনি তাঁর পুত্র ফারুকশিয়ারকে বাঙলা ও ওড়িশার মসনদে তার প্রতিভু হিসাবে বসিয়ে গিয়েছিলেন। যদিও মুরশিদকুলি খানই বাঙলায় কাৰ্যত শাসক হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, তা হলেও ফারুকশিয়ার মুরশিদকুলি খানের সঙ্গে সম্ভাবই রেখেছিলেন। কিন্তু সম্রাট বাহাদুর শাহের মৃত্যুর (১৭১২) পর তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্ৰ জাহান্দর শাহ যখন নিজ ভ্ৰাতা আজিম-উস-শানকে হত্যা করে সম্রাট হন, ফারুকশিয়ার তখন পিতার মৃত্যুর প্রতিহিংসা নেবার জন্য মুরশিদকুলি খানের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেন। মুরশিদকুলি খান দিল্লীর সম্রাটের আনুগত্য পরিহার করতে অস্বীকার করেন। তখন ফারুকশিয়ার পাটনায় গিয়ে, আজিমউস-শান কর্তৃক অধিষ্ঠিত বিহারের শাসক সৈয়দ হুসেন আলি খানের সাহায্য প্রার্থনা করেন। হুসেন আলি প্ৰথমে ইতস্তত করেন, কিন্তু যখন ফারুকশিয়ারের পরিবারের মেয়েরা গিয়ে তাঁকে অনুনয় বিনয় করল, তখন তিনি ফারুকশিয়ারকে সাহায্য করতে সম্মত হন। অ্যালাহাবাদের শাসক সৈয়দ আবদুল্লা খানকেও আজিম-উল-শানই তার পদে অধিষ্ঠিত করেছিলেন। আবদুল্লা খান সৈয়দ-হুসেন আলি খানেরই ভ্ৰাতা। দুই ভাই একত্রিত হয়ে ফারুকশিয়ারকে সাহায্য করতে প্ৰবৃত্ত হয়। দিলী অভিগামী রাজস্ব তারা লুঠ করে এবং পাটনা ও বারাণসীর ব্যাঙ্কারদের কাছ থেকে টাকা ধার করে, তারা এক সৈন্যবাহিনী গঠিত করে। কাঠগয়া নামক স্থানে তারা জাহান্দর শাহের জ্যেষ্ঠ পুত্ৰ আজিউদ্দিনকে যুদ্ধে পরাজিত করে (১৭১২)। ১৭১৩ খ্রীস্টাব্দে স্বয়ং সম্রাট কর্তৃক পরিচালিত সৈন্যবাহিনীকেও ফারুকশিয়ারের সৈন্যদল আগরায় পরাজিত করে। সম্রাট SBBBDB BB DB BBD DBBDSDDSDDB DuDB DBDuB BD DDD আসাদ-উদ-দৌল বিশ্বাসঘাতকতা করে সম্রাটকে ফারুকশিয়ারের হাতে সমর্পণ করে। ফারুকশিয়ার সম্রাটকে হত্যা করে। এইভাবে ১৭১৩ খ্রীস্টাব্দে ফারুক-শিয়ার হিন্দুস্থানের সম্রাট হন।

পাঁচ

এই ঘটনার এক বৎসর পূর্বে ফারুকশিয়ার যখন পাটনাতে নিজেকে সম্রাট বলে ঘোষণা করেছিলেন, তখন তিনি কিছু প্ররোচনার বশীভূত হয়ে রশিদ খান নামক এক ব্যক্তিকে বাঙলার শাসক নিযুক্ত করেছিলেন। এই সংবাদ পাওয়া মাত্র মুরশিদকুলি খান রশিদ খানকে মুরশিদাবাদের নিকট ‘প্ৰতিরোধ করেন। রশিদ খানের সঙ্গে মুরশিদকুলি খানের যে সংঘর্ষ হয়, সেই সংঘর্ষে রশিদ খান নিজ অশ্ব থেকে পড়ে গিয়ে মারা যান। কিন্তু ফারুকশিয়ার যখন হিন্দুস্থানের সম্রাট হন (১৭১৩) মুরশিদকুলি খান তখন নিজ কুটবুদ্ধি অনুযায়ী সম্রাটের আনুগত্য স্বীকার করেন এবং তাকে বহু মূল্যবান উপঢৌকন পাঠান। ফারুকশিয়ারও মুরশিদকুলি খানকে বাঙলা ও ওড়িশার স্ববেদার নিযুক্ত করেন। তখন মুরশিদকুলি খান মুকসুদাবাদের নাম পরিবর্তন করে মুরশিদাবাদ রাখেন (১৭১৩ খ্রীস্টাব্দ)।।

এইভাবে শক্তিমান হবার পর মুরশিদকুলি খান ইংরেজদের সঙ্গে কলহে প্ৰবৃত্ত হন। শাহজাদা শুজার কাছ থেকে ইংরেজরা যে সমস্ত সুযোগ সুবিধা পেয়েছিল, সেগুলি তিনি বাতিল করে দেন। বাৰ্ষিক তিন হাজার টাকা প্ৰদানের পরিবর্তে ইংরেজরা অবাধ বাণিজ্যের যে অধিকার পেয়েছিল, তাও নাকচ করে তিনি আদেশ দেন যে হিন্দুরা যে বাণিজ্য শুষ্ক দেয়, ইংরেজদেরও তা পুরামাত্রায় দিতে হবে। নবাবের এরূপ আচরণে বিক্রত হয়ে ইংরেজরা দিল্লীতে সম্রাটের নিকট দূত প্রেরণ করে। ১৭১৫ খ্রীস্টাব্দে ইংরেজ কোম্পানি জন সুরম্যান ও এডওয়ার্ড ষ্টিভেনসন নামে দুই ব্যক্তিকে দৌত্যকর্মে নিযুক্ত করে সরাসরি দিল্লীতে বাদশাহ ফারুকশিয়ারের কাছে পাঠিয়ে দেয়। তাদের সঙ্গে যায় দোভাষী হিসাবে খোজা সারহাউদ ও চিকিৎসক হিসাবে ক্যাপটেন উইলিয়াম হামিলটন। তারা সঙ্গে করে নিয়ে যায় বহুমূল্য উপঢৌকন। মুরশিদকুলি খান দূতদের উদ্দেশ্য ব্যর্থ করবার চেষ্টা করেন, কিন্তু এক আকস্মিক ঘটনা ইংরেজদের সহায়ক হয় এবং তারা সম্রাটের কাছ থেকে সহানুভূতিশীল ব্যবহার পায়। ঘটনাটা আর কিছুই নয়, সম্রাটের অণ্ডকোষের এক কঠিন পীড়া। ১৭২৩ খ্রীস্টাব্দে বাদশাহ ফারুকশিয়ারের আদেশে হুসেন আলি খান নামক সেনাপতির অধীনে মোগল বাহিনী যোধপুর আক্রমণ করে। যোধপুরের রাজা অজিত সিং পরাহত হয় এবং সন্ধির শর্ত অনুযায়ী অজিত সিং তার মেয়ের সঙ্গে বাদশাহের বিবাহ দিতে রাজী হয়। কিন্তু সম্রাট হঠাত পীড়িত হওয়ায়, এই বিবাহে বিঘ্ন ঘটে। এই মুহূর্তেই ইংরেজ কোম্পানির দূতগণ দিল্লীতে গিয়ে হাজির হয়। ইংরেজ দূতগণের সঙ্গে আগত চিকিৎসক ডাক্তার উইলিয়াম হামিলটন সম্রাটকে পীড়ামুক্ত করে। এভাবে তার বিবাহের পথ প্ৰশন্ত হয়। সম্রাট খুশী হয়ে ইংরেজদের প্রার্থনা মঞ্জুর করেন ও তাদের ফরমান দেন। ইংরেজদের প্রার্থনা ছিল-(১) কলকাতার প্রেসিডেন্ট কর্তৃক স্বাক্ষরিত ছাড়পত্র প্ৰদৰ্শন করলে, নবাবের কোন কর্মচারী নৌপথে আগত ইংরেজদের কোন মাল আটক বা পরীক্ষা করতে পারবে না, (২) সপ্তাহে তিনদিন মুরশিদাবাদের টাকশালে ইংরেজদের মুদ্রা নির্মাণের অধিকার থাকবে, (৩) ইংরেজরা অনুরোধ করা মাত্র ইংরেজদের কাছে ঋণী এরকম ব্যক্তিকে ইংরেজদের হাতে সমৰ্পণ করতে হবে, এবং (s) কলকাতার সংলগ্ন ৩৮ খানা গ্রামের জমিদারী স্বত্ব তারা কিনতে পারবে। ফারমান দ্বারা সম্রাট ইংরেজদের এ সকল প্রার্থনা মজুর করেন। মুরশিদকুলি খান সম্রাটের আদেশ অমান্য করতে সাহস করলেন না। কিন্তু ৩৮ খানা গ্রামের জমিদারী স্বত্ব কেনা সম্বন্ধে তিনি স্থানীয় জমিদারদের ওপর এমন প্রভাব বিস্তার করলেন যে সে সম্পর্কে ইংরেজদের সব চেষ্টা ব্যর্থ হল।

১৭১৮ খ্রীস্টাব্দে সম্রাট ফারুকশিয়ার মুরশিদকুলি খানকে বিহারেরও শাসক নিযুক্ত করেন। ১৭১৯ খ্রীস্টাব্দে ফারুকশিয়ারের মৃত্যু ঘটে। তার মৃত্যুর পর সাত মাসের মধ্যে পার পর দুজন সম্রাট হন; তারপর ১৭২৭ খ্রীষ্টাব্দে মহম্মদ শাহ দিল্লীর বাদশাহ হন। তিনিও মুরশিদকুলি খানকে বাঙলা, বিহার ও ওড়িশার শাসক পদে বহাল রাখেন। কিন্তু মুরশিদকুলি খান দিল্লীর সঙ্গে নামমাত্র সম্পর্ক রেখে নিজেই স্বাধীন শাসক হয়ে ওঠেন। এভাবে তিনি বাঙলায় নবাবী আমলের স্বচনা করেন। ১৭২৭ খ্রীস্টাব্দে মুরশিদকুলি খানের মৃত্যু ঘটে।

মুরশিদকুলি খান যোগ্য শাসক হলেও, দেশের আর্থিক বা সামাজিক অবস্থার কোন উন্নতি ঘটাতে পারেন নি। তাঁর হিন্দুবিদ্বেষ এবং জমিদার ও প্রজাদের পীড়ন করে অর্থসংগ্ৰহ করার ফলে দেশে হাহাকার পড়ে গিয়েছিল। অর্থনৈতিক শোষণে বাঙলা ক্রমশ জীৰ্ণ হতে আরম্ভ হয়েছিল। দুর্ভিক্ষের সময় দেশের লোকের দুর্দশার সীমা থাকত না। পরবর্তী শাসকদের সময় এই অবস্থাই চলেছিল। মোটকথা, গোটা অষ্টাদশ শতাব্দীতেই বাঙালী সমাজে দৈন্যতা করেছে। মুখব্যাদান। বৎসরের পর বৎসর দিল্লীতে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব প্রেরণের ফলে বাঙলায় রৌপ্য মুদ্রার অভাব ঘটেছিল, যার পরিণতিতে কেনাবেচা ও লেনদেন প্ৰাচীন প্ৰথানুযায়ী কড়ির মাধ্যমেই হওয়া ব্যাপকভাবে প্ৰচলিত হয়েছিল। পলাশী যুদ্ধের সময় পৰ্যন্ত এই অবস্থা বহাল থাকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *