০৩. মুনার মনে হল তার জ্বর আসছে

মুনার মনে হল তার জ্বর আসছে।

মুখ তেতো, মাথায় ভোঁতা। একটা যন্ত্রণা। সকালে নাশতা খেতে গিয়ে টের পেল গলাব্যথা আরো বেড়েছে। গলা দিয়ে কিছুই নামছে না। মুনা ক্লান্ত স্বরে বলল–বকুল, একটু গরম পানি করে দে, গোসল করব। বকুল সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল।

নাশতা শেষ করে যা। বলা মাত্রই দৌড়াতে হবে নাকি?

আমার নাশতা খাওয়া হয়ে গেছে।

বকুল রান্নাঘরে ঢুকে গেল। মুনা বলল, মামা কোথায় রে বাবু?

সকালবেলা কোথায় যেন গেছেন।

নাস্তা খেয়ে গেছেন?

না। বকুল বলেছিল চা খেয়ে যেতে।

মুনা বিরক্ত হয়ে বলল, বকুল বকুল করছিস কেন? কতবার বলেছি আপা বলতে।

আপাই তো বলি।

আবার মিথ্যা কথা? চড় খাবি।

গার্গল করেও লাভ হল না। পানি বেশি গরম ছিল, মাঝখান থেকে জিব পুড়ে গেল; বকুল বলল, তোমার চোখ লাল হয়ে আছে। শুয়ে থাক গিয়ে। মুনা কিছু বলল না। বকুল ইতস্তত করে বলল, ফজলু ভাইদের বাসায় একটু যার আপা? মুনা তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল, কেন?

যেতে বলেছিল আমাকে। খুব নাকি দরকার।

কী দরকার?

জানি নাকি, শুধু বলেছেন খুব জরুরি। বোধ হয় ভাবীর সঙ্গে আবার ঝগড়া-টগড়া হয়েছে।

সেটা ওদের স্বামী-স্ত্রীর ব্যাপার, তুই কেন যাবি?

বকুল আর কিছু বলল না। ফজলুর রহমান সাহেব গলির ওপাশেই থাকেন। মাস ছয়েক হল এসেছেন। খুব সামাজিক ধরনের মানুষ। এসেই আশপাশের সব বাড়িতে গেছেন। বিয়ের সময় নিজে এসে দাওয়াত করে গেছেন। মুনার নিজের ধারণা লোকটি গায়ে-পড়া ধরনের। প্রথম আলাপেই খালা, খালু, আপামণি ডাকাডাকি তার ভাল লাগেনি। বকুলের সঙ্গে ভদ্রলোকের স্ত্রীর খুব খাতির। এটাও মুনার ভাল লাগেনি। অবিবাহিতা মেয়ের সঙ্গে একজন বিবাহিত মহিলার এত ভাব থাকা ঠিক না। বকুল আবার বলল, আপা যাব?

মুনা জবাব দিল না। ব্যাপারটা সে এড়িয়ে যেতে চায়। কিন্তু বকুলের চোখে-মুখে আগ্রহ ঝলমল করছে। মুনা বলল, কী নিয়ে তোদের এত গল্প?

বকুল মাথা নিচু করে হাসতে লাগল। তার গালে লাল আভা। নিশ্চয়ই নিষিদ্ধ গল্পগুজব হয়। নতুন বিয়ে হওয়া মেয়েরা সুযোগ পেলেই অন্য মেয়েদের সঙ্গে বাতের অন্তরঙ্গতার গল্প করতে চায়। মুনা এ ধরনের অনেক গল্প শুনেছে। শুনতে ভালই লেগেছে। বকুলেরও নিশ্চয়ই লাগে।

আপা যাব?

না, রান্নাবান্না করতে হবে না? আজ আমি বাইরে যাব; ফিরতে সন্ধ্যা হবে।

জ্বর নিয়ে কোথায় যাবে?

মুনা জবাব দিল না। বকুল বলল–বেশিক্ষণ থাকব না আপা। যাব আর আসব। যাই?

ঠিক আছে যা।

 

লতিফা বিছানা ছেড়ে উঠলেন। দশটার দিকে। আজ তাঁর শরীর বেশ ভাল; দশ-বারো দিনের মধ্যে আজ এই প্রথম ঘর ছেড়ে বের হলেন। বাবু ছুটে গিয়ে মাকে বসার জন্যে একটা মোড়া এগিয়ে দিল। তিনি অবশ্যি বসলেন না। দেয়াল ধরে ধরে বসার ঘরে চলে এলেন। বাবু বলল, বেশি হাঁটাহঁটি করবে না মা। লতিফা বললেন, তোর বাবা কোথায়?

জানি না।

বকুল, বকুল কোথায় গেল?

ফজলু ভাইদের বাসায় গেছে। ডেকে নিয়ে আসব?

না ডাকতে হবে না।

তিনি একটি বেতের চেয়ারে ক্লান্ত হয়ে বসে পড়লেন।

মুনাকে বল তো আমাকে এক কাপ আদা চা দিতে।

মুনা আপার জ্বর, শুয়ে আছে। আমি বানিয়ে দেই?

না থাক। হাতটাত পুড়বি।

না হাত পুড়ব না।

বাবু খুব উৎসাহ নিয়ে চা বানাতে গেল। লতিফা এলেন তার পেছনে পেছনে। বিরক্ত স্বরে বললেন, ইস কী অবস্থা রান্নাঘরের।

তোমাকে একটা চেয়ার এনে দেব মা? বসবে?

না চেয়ার লাগবে না।

লতিফা নোংরা মেঝেতেই পা ছড়িয়ে বসলেন। বাবু বলল, মা দেখ তো লিকার কড়া হয়ে গেছে?

না ঠিকই আছে। মুনার জ্বর কী খুব বেশি?

হুঁ। ঐ দিন বৃষ্টিতে সবাই ভিজলাম তো। কারো কিছু হল না, মুনা আপার টনসিল ফুলে গেল।

চায়ে চুমুক দিয়েই লতিফার বমি বমি ভাব হল। শরীরটা গেছে। তিনি সাবধানে উঠে দাঁড়ালেন। তার পা কাঁপছে।

চা খাবে না?

উঁহু তুই খেয়ে ফেল। শরীরটা খারাপ লাগছে। শুয়ে থাকব। মুনাকে বল তো একটু আসতে।

তিনি নিজের ঘরে ফিরে গেলেন। তার মনে হল আর কোনোদিন এ ঘর থেকে বেরুতে পারবেন না। বাকি জীবনটা এ ঘরেই কাটাতে হবে। আজকাল প্রায়ই তার এ রকম মনে হয়। মুনা এসে দেখল। লতিফা কাঁদছেন। সে না দেখার ভান করে সহজ ভাবেই বলল ডেকেছিলে মামি?

তুই একটু বোস আমার পাশে।

মুনা বসল। লতিফা কী বলবেন মনে করতে পারলেন না। কি একটা যেন বলতে চেয়েছিলেন। বেশ কিছুদিন ধরে এ রকম হচ্ছে। কিছুই মনে থাকছে না।

কি জন্যে ডেকেছিলে মামি?

এমনি এমনি ডাকলাম! শরীরটা বড় খারাপ।

তোমার নিজের জন্যেই তোমার শরীর ঠিক হচ্ছে না মামি। দুপুর একটার আগে কিছু মুখে দাও না। রুগীদের আরো বেশি করে খেতে হয়।

ইচ্ছা করে না, বমি আসে।

আসলে আসুক।

লতিফা ক্লান্ত স্বরে বললেন, বকুলের একটা বিয়ের ব্যবস্থা কর। তোর মামাকে বল। মুনা অবাক হয়ে বলল, কেন? ওর কী বিয়ের বয়স হয়েছে নাকি? কী যে তুমি বল।

বয়স খুব কমও তো না। নভেম্বর মাসে পনেরো হবে।

পনেরো বছর বয়সে কোনো মেয়ের বিয়ে হয় নাকি?

বিয়ে দিলেই বিয়ে হয়। আমার বিয়ে হয়েছিল চৌদ্দ বছর বয়সে।

তুমি বলছি তেত্ৰিশ বছর আগের কথা।

লতিফা ক্ষীণ স্বরে বললেন, আমার শরীর ভাল না। তুইও চলে যাচ্ছিস। আমার সাহস হয় না। তোর মামাকে বল ঐ ছেলেটার সঙ্গে কথা বলতে। তুই বললে শুনবে।

কোন ছেলেটার সঙ্গে?

বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল যে। গ্রিন রোডে ফার্মেসি আছে ছেলেটার। মামা মিডফোর্ডের ডাক্তার।

বাঁটু বাবাজীর কথা বলছি? তিন ফুট বামুন?

লতিফা ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেললেন। মুনা বলল, বকুলের বিয়ে প্রসঙ্গে আমি কারো সঙ্গে কোনো কথাটথা বলতে পারব না। ওর মতো সুন্দরী মেয়ে খুব কম আছে। ওর বিয়ে নিয়ে কোনো ঝামেলা হবে না। তুমি নিশ্চিন্ত থাক।

লতিফা মৃদু স্বরে বললেন, আমি বেশি দিন বাঁচব না।

মুনা বিরক্ত হয়ে বলল, না বাঁচলে, তাই বলে বাচ্চা মেয়েকে ধরে বিয়ে দিতে হবে? এই সব কী?

তুই চলে গেলে ঝামেলা হবে।

কী কামেলা হবে?

ছেলেরা চিঠিফিটি লেখে।

চিঠি তো লিখবেই। সুন্দরী মেয়েদের এইসব সহ্য করতে হয়। এসব কিছু না।

মুনা উঠে চলে এল। বকুল গিয়েছে দেড় ঘণ্টা আগে, এখনো ফেরার নাম নেই। কখন রান্না হবে কে জানে। মামা বাজার নিয়ে ফিরবেন। কিনা তাও বোঝা যাচ্ছে না। মুনা একবার ভাবল ভাতটা চড়িয়ে দেয়। কিন্তু আগুনের কাছে যেতে ইচ্ছে করছে না। মনে হচ্ছে জ্বর চেপে আসছে।

বাবু গম্ভীর হয়ে বসার ঘরে বসে আছে। মুনাকে ঢুকতে দেখে সে কী মনে করে হাসল। মুনা বলল, ছুটির দিনে ঘরে বসে আছিস কেন? বাইরে খেলাধুলা করগে।

বাবু আবার মুখ টিপে হাসল।

হাসছিস কেন?

এমনি।

আমার জ্বর কী-না দেখ তো।

হুঁ তোমার জ্বর।

গায়ে হাত না দিয়েই টের পেয়ে গেলি?

বাবু লজ্জিত মুখে কাছে এগিয়ে এল। তার হাত বেশ ঠাণ্ডা; তার মানে বেশ জ্বর গায়ে। বাসায় কোনো থার্মোমিটার নেই। জ্বর কত বোঝার উপায় নেই।

মুনা। আপা তুমি শুয়ে থাক, আমি মাথার চুল টেনে দেব।

চুল টানতে হবে না, তুই বকুলকে ডেকে নিয়ে আয়। এক্ষুণি যা। এতক্ষণ কেউ অন্যের বাড়িতে থাকে?

বাবু সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল। মুনা। আপার কাজ করতে তার এত ভাল লাগে। সারাক্ষণই ইচ্ছা! করে কিছু একটা করে মুনা আপনাকে খুশি করতে।

বকুলই রান্না করল। ভাত ডাল এবং ইলিশ মাছের ঝোল। শওকত সাহেব ভর দুপুরে বাজার নিয়ে এসেছেন। রান্না করতে তাই দুটো বেজে গেল। শওকত সাহেব দুবার এসে খোঁজখবর নিলেন তরকারি নেমেছে কিনা। বকুল তাড়াতাড়ি করতে গিয়ে সব কিছুই কেমন এলোমেলো করে ফেলতে লাগল।

খেতে বসে শওকত সাহেব কঠিন কঠিন কিছু কথা বললেন। এত বড় মেয়ে সামান্য একটা তরকারি রাধতে পারে না কেন এই নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করলেন। গলা টেনে টেনে বললেন, লবণ কী সস্তা হয়েছে? আধাসের লবণ দিয়ে দিয়েছিস তরকারিতে। সবটা তুই একা খেয়ে শেষ করবি।

বকুলের লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করল। শওকত সাহেব প্লেট ঠেলে দিয়ে হাত ধুতে গেলেন। বকুল বাবুকে ফিসফিস করে বলল, লবণ খুব বেশি হয়ে গেছে?

শুধু মাছটা খা। ডালের সঙ্গে মিশিয়ে খা।

তুমি খাবে না?

না।

বকুল সত্যি সত্যি কিছু মুখে দিল না। নিজের জন্যে তার খুব কষ্টও হল না। এটা তার অভ্যেস আছে। প্রায়ই সে রাগ করে না খেয়ে থাকে।

মুনা দু’টা প্যারাসিটামল খেয়েছে। মাথা ধরা। তবু কমেনি। আরো যেন বেড়েই যাচ্ছে। আজ কোথাও বেরুনোর কোনো প্রশ্নই ওঠে না। মামুন অপেক্ষা করে করে মহা বিরক্ত হবে। মুনা ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল। মামুনের সঙ্গে যে কবার কোথাও যাবার প্রোগ্রাম করা হয়েছে সে কবারই এ রকম ঝামেলা।

মুনা আপা।

কী।

কিছু খাবে না?

না। মামিকে খেতে দিয়েছিস?

মা ভাত খাবে না। রুটি বানিয়ে দিতে বলছে।

বানিয়ে দে। আটাটা গরম পানিতে সেদ্ধ করে নিবি। নয় তো রুটি নরম হবে না।

ঘরে আটা নেই।

বাবুকে দোকানে যেতে বল।

বাবু যেন কোথায় গেছে। আমি গিয়ে নিয়ে আসব?

না, তুই কি যাবি। মামাকে গিয়ে বল।

আমি বলতে পারব না। তুমি বল।

ঠিক আছে, আমিই বলব।

শওকত সাহেব কোনো রকম বিরক্তি প্রকাশ না করেই আটা আনতে গেলেন। বকুল বলল আপা, টিনা ভাবীর বাচ্চা হবে। মুনা বলল, এখনই বাচ্চা হবে কি, সেদিনই না বিয়ে হল।

সেদিন না। ছয় মাস এগার দিন হয়েছে।

তোর দেখি একেবারে দিন-তারিখ মুখস্থ। এত খাতির কেন তোর সাথে?

খাতির কোথায় দেখলে? আর খাতির হওয়াট ও কি খারাপ?

বেশি হওয়াটা খারাপ। বেশি কোনোটাই ভাল না।

কেন?

মুনা প্রশ্নের জবাব দিতে পারল না। সে লক্ষ্য করল বকুল আজকাল বেশ কঠিন ভঙ্গিতে কথা বলছে। এটা ভাল লক্ষণ। মেয়েদের এত পুতুপুতু থাকলে চলে না।

বকুল বলল মুনা। আপা, ওরা শুক্রবারে কাবলিওয়ালা দেখতে যাবে। ইন্ডিয়ান অ্যাম্বেসিব অডিটোরিয়ামে। আমাকেও সাথে যেতে বলছে। আমার জন্যেও টিকিট এনেছে।

ওরা স্বামী-স্ত্রী দেখতে যাবে, তাদের মধ্যে তুই যাবি কেন?

আমি তো যেতে চাই না। ওরা জোর করছে। আপা যাব?

শুক্রবার আগে আসুক তারপর দেখা যাবে।

তুমি আগে থেকে বাবাকে বলে রাখবে, নয়ত শেষে রাজি হবে না। তুমি আজ আর কোথাও যাবে না?

না।

বকুল মৃদু হেসে বলল, মামুন ভাই অপেক্ষা করে থাকবে। মুনা কিছু বলল না। বকুল তরল গলায় বলল, আমার কেন যেন মনে হচ্ছে তিনি তোমাকে দেখার জন্যে আজ এখানে চলে আসবেন।

বকুল লক্ষ্য করল। মুনা এই প্রসঙ্গটি পছন্দ করছে না। সে কিছুটা বিব্রত বোধ করল। প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, তোমার চোখ লাল টকটকে হয়ে আছে। শুয়ে থাক না।

সন্ধ্যার দিকে মুনার জ্বর খুবই বাড়ল। শওকত সাহেব একটা থার্মোমিটার কিনে আনলেন। জ্বর একশ তিনের কাছাকাছি। তিনি থমথমে স্বরে বললেন, বৃষ্টির মধ্যে ঝাপঝাঁপি, জ্বর তো হবেই। শরীর বেশি খারাপ লাগছে? মুনা ক্লান্ত স্বরে বলল, কনের কাছে বকবক করলে খারাপ লাগে। তুমি যাও তো ঘর থেকে। শওকত সাহেব নড়লেন না। পাশেই বসে রইলেন।

বাতি নিভিয়ে দাও মামা, চোখে লাগছে।

বাবু বাতি নিভিযে বারান্দায় একা একা বসে রইল। বকুল রাতের রান্না চড়িয়েছে। একা একা রান্নাঘরে তার একটু ভয় লাগছে। সে বেশ কয়েকবার বাবুকে ডেকেছে। বাবু আসেনি। লতিফার পানির তৃষ্ণা হয়েছিল। ক্ষীণ কণ্ঠে কয়েকবার পানির কথা বললেন, কেউ শুনল না। তিনি আবার ঘুমিয়ে পড়লেন। বেশিক্ষণ জেগে থাকতে পারেন না। চোখ জড়িয়ে আসে।

মুনা বলল, মামা তুমি আমার পাশে এ রকম বসে থাকবে না তো! অন্য ঘরে যাও।

তোর কোনো অসুবিধা করছি নাকি?

করছি। ভোস-ভোস করে সিগারেট টানছ। গন্ধে থাকতে পারছি না।

শওকত সাহেব আধাখাওয়া সিগারেটটা ফেলে দিলেন। মৃদু স্বরে বললেন, গ্রিন ফার্মেসিতে বলে এসেছি, ডাক্তার এলেই পাঠিয়ে দেবে।

মুনা পাশ ফিরল।

গায়ের ওপর কথাটা দিয়ে রাখ না। ফেলে দিচ্ছিস কেন?

গরম লাগছে তাই ফেলে দিচ্ছি। ঠাণ্ডা লাগলে আবার দেব। তুমি ও-ঘরে গিয়ে বস না মামা।

শওকত সাহেব উঠলেন না। গলার স্বর অনেকখানি নামিয়ে বললেন, তোর বাবা তোর বিয়ের জন্যে আলাদা করে কিছু টাকা দিয়ে গিয়েছিল আমাকে। নয়। হাজার টাকা। সেই আমলে নয়। হাজার টাকা অনেক টাকা। বুঝলি মুনা, টাকাটা সংসারে খরচ হয়ে গেছে।

খরচ হয়েছে ভাল হয়েছে। এখন চুপ কর।

আমি প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে ছয় হাজার টাকা তুলে রেখেছি। তুই নিয়ে নিস। বাকিটা পরে দেবী! ভাগে ভাগে দেব।

মামা আমাকে কোনো টাকা-পয়সা দেয়ার দরকার নেই! তোমরা না দেখলে আমার যাওয়ার জায়গা ছিল? তুমি আমাকে যে আদর কর তার দশ ভাগের এক ভাগ নিজের ছেলেমেদের কোনোদিন করেছ? আর আজ তুমি টাকার কথা তুললে? ছিঃ ছিঃ!

না মানে…।

মাঝে মাঝে তুমি এমন সব আচরণ করা যে মেজাজ ঠিক থাকে না।

কী করলাম?

এই যে দুপুরে খেতে বসে চেঁচামেচিটা করলে। বেচারী বকুল কেঁদে কেটে অস্থির। ভাত খায়নি দুপুরে।

ননীর পুতুল একেকজন। ধমক দিলে খাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। চড় দিয়ে দাঁত ফেলে দিতে হয় এদের।

তুমি যাও তো মামা, ওকে দু’একটা মিষ্টি কথা বল। আমার কানের কাছে বসে ঘ্যান ঘ্যান করবে না;

শওকত সাহেব উঠে পড়লেন। বারান্দায় গিয়ে প্রচণ্ড একটা ধমক দিলেন বাবুকে বই নিয়ে বসার কথাটা বলে দিতে হবে?

বাবু শুকনো মুখে বই আনতে গেল।

অংক বই খাতা নিয়ে আয়। গায়ে তো কারো বাতাস লাগে না? শক্ত মার দিলে হুঁশি হবে। তার আগে হুঁশি হবে না। শয়তানের ঝাড়। দুপুরবেলা হুঁট করে কোথায় গিয়েছিলি?

বাবু কোনো জবাব দিল না। অংক খাতা ও বই নিয়ে বসল। তার মুখ সাদা হয়ে গেছে। বাবাকে সে খুব ভয় পায়। শওকত সাহেব রান্নাঘরে উঁকি দিলেন। বকুল বাবাকে দেখে জড়সড় হয়ে গেল।

রান্নাঘরটাকে একেবারে দেখি পায়খানা বানিয়ে রেখেছিস; গুছিয়ে-টুছিয়ে নিতে পারিস না। কোনোটাই তো দেখি হয় না। পড়াশুনা না কাজকর্মও না। কারবিটা কি? কারো বাড়িতে ঝিগিরিও তো পাবি না। এক কাপ চা বানিয়ে দিয়ে যা।

বকুল ক্ষীণ স্বরে বলল, দুধ চা?

একটা হলেই হল। তোর মা কিছু খেয়েছিল দুপুরে?

রুটি খেয়েছিল।

মুনার জন্যে হালকা করে বার্লি বানা। লেবুর রস দিয়ে লবণ দিয়ে ভাল করে বানা। বার্লি আছে না ঘরে?

আছে।

শওকত সাহেব চলে গেলেন। তখন বকুলের মনে পড়ল ঘরে বার্লি নেই। এই কথাটা এখন বাবাকে বলবে কে? রাগে নিজের হাত কামড়াতে ইচ্ছা হচ্ছে। সে বাবার জন্যে চায়ের পানি চড়াল। ঘরটা একটু গোছাতে চেষ্টা করল। তার আবারও কেন জানি ভয় ভয় করছে। রান্নাঘরে একা থাকলেই একটা ভয়ের গল্প মনে হয়। ঐ যে রান্নাঘরে একটি বউ একা একা মাছ ভাজছিল। হঠাৎ জানালা দিয়ে একটা রোগাকালো হাত বেরিয়ে এল। নাকি সুরে একজন কে বলল, মাছ ভাজা দে। তাছাড়া আজ দুপুরেও ভাবী পাঁচ-ছটা ভূতের গল্প বলেছে। তার কোন খালার নাকি জ্বীনের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল। সেই জ্বীন সুন্দর সুন্দর সব জিনিসপত্র এনে দিত। একবার নাকি একটা ফুলের মালা এনে দিয়েছিল যার সবগুলি ফুল কুচকুচে কালো রঙের। দিনের বেলা গল্পগুলি শুনে হাসি এসেছে কিন্তু এখন আবার কেমন ভয় ভয় লাগছে। সবগুলি গল্পই মনে হচ্ছে সত্যি। ভাবী বলছিল–তুমি যা সুন্দর, সাবধানে থাকবে ভাই। ভর দুপুরে আর সন্ধ্যায় এলোচুলে থাকবে না। বকুল অবাক হয়ে বলেছিল, এলোচুলে থাকলে কি হয়?

খারাপ বাতাস লাগে।

খারাপ বাতাস লাগে মানে?

জীন-ভূতের আছর হয়। সুন্দরী মেয়েদের ওপর জ্বীনের আছর হওয়া খুব খারাপ। সারা রাত এরা ঘুমুতে দেয় না। বিরক্ত করে।

কিভাবে বিরক্ত করে?

এখন বুঝবে না। বিয়ে হওয়ার পর বুঝবে।

এই বলে ভাবী মুখ টিপে টিপে হাসল। রহস্যময় হাসি।

কি বকুল শুনতে চাও কিভাবে বিরক্ত করে?

না শুনতে চাই না।

অবশ্যি অনেকে সেটা পছন্দও করে। আমার ঐ খালার কথা বলছিলাম না সেই খালা জ্বীন না এলে কেমন অস্থির হয়ে যেত কাপড়-টাপড় খুলে ফেলে বিশ্ৰী কাণ্ড করত।

এখন তিনি কোথায় থাকেন?

চাঁদপুরে। এখন আর এইসব নেই। খুব ভাল মানুষ। এক ওভারশিয়ারের সাথে বিয়ে হয়েছে। তিন ছেলেমেয়ে। জ্বীন-ভূতের কথা আর কিছুই মনে নেই।

ডাক্তার এল সাড়ে নটার সময়। তার সঙ্গে এল বাকের। বাকেরের গায়ে চকচকে লাল রঙের একটা শার্ট। শার্টের পকেটে ফাইভ ফাইভের প্যাকেট উঁচু হয়ে আছে। তার মুখ অত্যন্ত গম্ভীর। যেন অসুখের ব্যাপারে দারুণ চিন্তিত। বাকেরকে দেখে মুনার বিরক্তির সীমা রইল না। তাকে পরিষ্কার করে বলা হয়েছে–এ বাড়িতে যেন কোনোদিন না আসে। তবু কেমন নির্লিজের মত এসেছে। আর বাবুর কাণ্ড, একেবারে শোবার ঘরে নিয়ে আসতে হবে। সে তো অব ডাক্তার না। মুনা বিরক্ত চোখে তাকিয়ে রইল। বাকের বলল, খুব ফুঁ হচ্ছে চারদিকে। কাহিল অবস্থা। জ্বর বেশি। নাকি তোমার?

মুনা জবাব দিল না। তাকাল ডাক্তারের দিকে। এই ডাক্তার এ পাড়ায় নতুন এসেছে। দেখে মনে হয় নাইন-টেনে পড়ে। স্টেথিসকোপ হাতে নিয়ে এমন ভাবে চারদিক দেখেছে যেন যন্ত্রটি নিয়ে সে কি করবে। মনস্থির করতে পারছে না। কিংবা হয়ত স্টেথিসকোপ বুকে বসাতে সাহস করছে না। মুনা বলল, আমার গলাটা দেখুন। ঢোঁক গিলতে পারি না।

ডাক্তার সাহেব গলায় ছোট্ট একটা টর্চের আলো ফেললেন। বাকের বলল, দেখি আমি টর্চ ধরছি, আপনি দেখুন ভাল করে। ডাক্তারের কিছু বলার আগেই সে টর্চ নিয়ে নিল। মুনা বলল, আপনি বসার ঘর গিয়ে বসুন না। ওঁকে দেখতে দিন।

উনিই তো দেখছেন। আমি দেখছি নাকি? আমি কি ডাক্তার? হা হা হা।

ডাক্তার সাহেব বললেন, কানে ব্যথা আছে?

জি না।

আপনার কি আগেও টনসিালের প্রবলেম ছিল?

জি।

বাকের একগাল হেসে বলল, একেবারে ছেলেবেলা থেকে মুনার এই প্রবলেম। বৃষ্টির একটা ফোঁটা পড়ল, ওমনি তার গলা ফুলে গেল। পিকিউলিয়ার।

ডাক্তার সাহেব নিচু স্বরে বললেন, একটা থ্রোট কালচার করা দরকার।

বাকের বলল, দরকার হলে করবেন। একবার কেন দশবার করবেন। হা হা হা।

মুনা, বলল, আপনারা বসার ঘরে গিয়ে বসুন। আমি চা দিতে বলি।

বাকের বলল, চা-টা কিছু লাগবে না। রোগীর বাসায় কোনো খাওয়া-দাওয়া করা ঠিক না। কি বলেন ডাক্তার সাহেব? ডাক্তার কিছু বললেন না। বকুলের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমাকে একটু পানি দেবেন? হাত ধোব।

এই প্রথম বোধ হয় বয়স্ক একজন কেউ বকুলকে আপনি বলল। বকুলের গাল টকটকে লাল হয়ে গেল মুহুর্তেই। সে অনেকখানি মাথা নিচু করে ফেলল। বাকের বলল, সাবান আর পানি নিয়ে আস বকুল। পরিষ্কার দেখে একটা টাওয়ালও আনবে।

মুনু বলল, বাকের ভাই, আপনি বসার ঘরে চলে যান। মামার সঙ্গে কথা বলুন। এই ঘরটা গরম।

ফ্যানটা ছাড় না।

ফ্যান নষ্ট। কয়েল নষ্ট হয়ে গেছে।

তাই নাকি! আচ্ছা সকাল বেলা লোক পাঠিয়ে দেব খুলে নিয়ে যাবে। মদীনাকে বললেই এক ঘণ্টার মধ্যে ঠিক করে দেবে।

ঝামেলা করতে হবে না।

কোনো ঝামেলা না। মদীনা শালাকে একটা ধমক দিলেই হবে।

বাকের বেশ নিশ্চিন্ত ভঙ্গিতে সিগারেটের প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করল। চকচকে লাইটার বের করে অনেক সময় নিয়ে সিগারেট ধরাল।

ডাক্তার সাহেব বারান্দায় হাত ধুতে গিয়ে মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, কী নাম আপনার? উত্তর দিতে বকুলের খুব লজ্জা লাগতে লাগল। তার মনে হল যেন এর উত্তর দেয়াটা ঠিক না। সে অস্পষ্ট স্বরে বলল, বকুল। আমাকে তুমি করে বলবেন। আমি স্কুলে পড়ি।

তাই নাকি! কোন স্কুলে?

মডেল গার্লস স্কুলে?

মেট্রিক দেবে এবার?

জি।

সায়েন্স?

জি না।

সায়েন্স পড়লে ভাল করতে। ডাক্তার হতে পারতে। ডাক্তারের খুব দরকার আমাদের। মেয়ে ডাক্তারের দরকার আরো বেশি।

বকুল কিছু বলল না। জগে করে পানি ঢেলে দিতে লাগল। ডাক্তার সাহেবের হাত পরিষ্কার করতে অনেক সময় লাগল। যাবার সময় তিনি ভিজিট ও নিলেন না। কেন ভিজিট নিচ্ছেন না সেই কারণটিও স্পষ্ট করে বলতে পারলেন না। হড়বড় করে যা বললেন তার মানে হল–সবার কাছ থেকে তিনি ভিজিট নেন না। ডাক্তারি তো কোনো ব্যবসা না। ব্যবসায়ী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এটাকে দেখা ঠিক না…ইত্যাদি।

তারা বেশ কিছু সময় বসার ঘরে বসে রইল। ডাক্তার সাহেব বললেন তিনি চা খান না, তবুও শেষ পর্যন্ত চা খেলেন। বাকের বলল ঘরে কাজের লোক নেই এটা তাকে বললেই একটা ব্যবস্থা করতে পারত। বাবুকে সে ছোটখাটো একটা ধমকও দিল, রোজ দেখা হয়, আমাকে বললেই পারতি।

পরদিন সকালে মদন মিস্ত্রীর লোকজন এসে ফ্যান খুলে নিয়ে গেল। বলে গেল বিকেলের মধ্যে দিয়ে যাবে। তার কিছুক্ষণ পর এলেন ডাক্তার সাহেব। তিনি নাকি পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। রুগী কেমন আছে দেখে যেতে এসেছেন। বকুল তাকে চা বানিয়ে খাওয়াল। চাটা তার কাছে খুব চমৎকার লাগল। কোন দোকান থেকে চায়ের পাতা কেনা হয়েছে তা জানতে চাইলেন। বকুল চোখ-মুখ লাল করে তার সামনে বসে রইল। ডাক্তার সাহেব যাবার আগে বললেন, বকুল যাই। বকুলের কিছু একটা বলা উচিত। কিন্তু সে বলতে পারল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *