তৃতীয় অধ্যায় – মুঘল ও বিজাপুরের সহিত প্রথম যুদ্ধ
প্রথম মুঘল-রাজ্য আক্রমণ
১৬৫৬ সালের ৪ঠা নবেম্বর বিজাপুরের সুলতান মুহম্মদ আদিল শাহর মৃত্যু হইল, এবং অপরিণত-বুদ্ধি রাজকার্য্যে অনভ্যস্ত যুবক (দ্বিতীয়) আলী আদিল শাহ সিংহাসনে বসিলেন। তখন মুঘল-দাক্ষিণাত্যের শাসনকর্তা ছিলেন আওরংজীব। তিনি বিজাপুর অধিকার করিবার এই সুযোগ ছাড়িলেন না। আলী মৃত সুলতানের পুত্র নহেন– এই অপবাদ রটাইয়া তিনি যুদ্ধ ঘোষণা করিলেন, এবং অন্যান্য বিজাপুরী জায়গীরদারদের মত শিবাজীকেও লোভ দেখাইয়া মুঘল পক্ষে যোগ দিতে আহ্বান করিলেন। দুইজনের মধ্যে দেনা-পাওনা লইয়া চিঠিপত্র বিনিময় হইতে লাগিল। পরে শিবাজীর দূত সোনাজী পণ্ডিত বিদর-দুর্গের সামনে আওরংজীবের শিবিরে পৌঁছিলেন (মার্চ ১৬৫৭) এবং তথায় দেনাপাওনার আলোচনায় এক মাস কাল কাটাইলেন। অবশেষে আওরংজীব শীবাজীর সব প্রার্থনা মঞ্জুর করিয়া তাঁহাকে মুঘল-সৈন্যদলে যোগ দিবার জন্য এক পত্র লিখিলেন (২৩ এপ্রিল)।
কিন্তু ইতিমধ্যে শিবাজী মনে মনে ঠিক করিয়া ফেলিলেন যে, তিনি নিজের হইয়া লড়িবেন, মুঘলের পক্ষ হইয়া নহে। মুঘল-রাজ্য লুটিলেই তাহার লাভের সম্ভাবনা বেশী। এই ফন্দী গোপন রাখিয়া, পরামর্শ করিবার ভাণ করিয়া সোনাজীকে এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি নিজের নিকট ফিরাইয়া আনিলেন। আর তাহার কিছুদিন পরেই মুঘল-অধিকৃত দাক্ষিণাত্যের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ (অর্থাৎ মহারাষ্ট্রের অংশ) হঠাৎ আক্রমণ করিলেন। সেখানে দিল্লীশ্বরের সৈন্যও কম ছিল, এবং সেনাপতিগণও অলস, অসতর্ক। মিনাজী ভোঁশলে ও কাশী নামক দুইজন মারাঠা-সর্দ্দার ভীমা নদী পার হইয়া মুঘলদের চামারগুপ্তা ও রায়সীন্ পরগণায় গ্রাম লুটিয়া, আহমদনগর শহরের আশপাশে পর্য্যন্ত আতঙ্কের সৃষ্টি করিল। আর, শিবাজী স্বয়ং ৩০-এ এপ্রিল অন্ধকার রাত্রে দড়ির সিঁড়ি বাহিয়া উত্তর-পুণা জেলায় জুন্নুর নগরের প্রাচীর ডিঙ্গাইয়া ভিতরে প্রবেশ করিয়া রক্ষীদের বধ করিলেন। এখান হইতে তিন লক্ষ হোণ (বারো লক্ষ টাকা), দুইশত ঘোড়া এবং অনেক মূল্যবান গহনা ও কাপড় লুটিয়া লইয়া শিবাজী সরিয়া পড়িলেন।
আওরংজীবের সহিত সন্ধি
এই সংবাদ পাইয়া আওরংজীব ঐ অঞ্চলে অনেক সৈন্য পাঠাইলেন এবং স্থানীয় কর্ম্মচারীদের খুব শাসাইয়া দিলেন। আহমদনগরের দুর্গাধ্যক্ষ মূতফ খাঁ বাহিরে আসিয়া কয়েকটি খণ্ডযুদ্ধের পর চামারগুণ্ডা থানা হইতে মিনাজীকে তাড়াইয়া দিলেন। এদিকে, রাও কর্ণ ও শায়েস্তা খাঁ আসিয়া পড়ার শিবাজী জুন্নর পরগণায় আর বেশীদিন থাকা নিরাপদ মনে করিলেন না। তিনি সরিয়া পড়িয়া আহমদনগর জেলায় ঢুকিলেন (মে মাসের শেষে)। কিন্তু এখানে আওরংজীব কর্তৃক প্রেরিত সৈন্যদল লইয়া নসিরি খাঁ দ্রুত কুচ করিয়া আসিয়া শিবাজীকে হঠাৎ আক্রমণ করিয়া প্রায় ঘিরিয়া ফেলিলেন (৪ঠা জুন)। মারাঠারা অনেকে মারা গেল, বাকী সকলে পলাইয়া প্রাণ বাঁচাইল।
তখন মুঘল-সেনানীরা নিজ রাজ্যের দক্ষিণ-পশ্চিম সীমানার স্থানে স্থানে সসৈন্য বসিয়া দেশ রক্ষা করিতে লাগিলেন; আর মাঝে মাঝে দ্রুত মারাঠা-রাজ্যে ঢুকিয়া লুঠ করিয়া, গ্রাম পোড়াইয়া, প্রজা ও গরু-বাছুর ধরিয়া আনিয়া আবার নিজ নিজ স্থানে ফিরিয়া আসিতে লাগিলেন। আওরংজীবের সুবন্দোবস্ত ও দৃঢ় শাসনে শিবাজী আর কোনই অনিষ্ট করিতে পারিলেন না। বর্ষা আরম্ভ হইল, দুই পক্ষই জুন জুলাই আগষ্ট মাস আপন আপন সীমানার মধ্যে বসিয়া কাটাইলেন।
সেপ্টেম্বর মাসে বিজাপুর-রাজ আওরংজীবের সহিত সন্ধি করিলেন। তখন শিবাজী আর কাহার বলে লড়িবেন? তিনি বশ্যতা স্বীকার করিয়া নসিরি খাঁর নিকট দূত পাঠাইলেন। খাঁ শিবাজীর প্রার্থনা যুবরাজকে জানাইলেন, কিন্তু কোনো সদুত্তর আসিল না। তাহার পর শিবাজী রঘুনাথ বল্লাল কোরডেকে সোজা আওরংজীবের নিকট পাঠাইলেন। যুবরাজ অবশেষে (জানুয়ারি ১৬৫৮) শিবাজীর বিদ্রোহ ক্ষমা করিয়া এবং মারাঠা প্রদেশে তাঁহার অধিকার স্বীকার করিয়া এক পত্র দিলেন; আর এদিকে শিবাজীও প্রতিজ্ঞা করিলেন যে, তিনি মুঘল-সীমানা রক্ষা করিবেন, নিজের পাঁচশত অশ্বারোহী সৈন্য আওরংজীবের অধীনে যুদ্ধ করিবার জন্য পাঠাইবেন এবং সোনাজী পণ্ডিতকে নিজ দূত করিয়া যুবরাজের দরবারে রাখিবেন।
কিন্তু আওরংজীব সত্যসত্যই শিবাজীকে বিশ্বাস করিতে পারিলেন না। তখন তিনি দিল্লীর সিংহাসন দখল করিবার জন্য উভয়-ভারতে যাইতেছেন। দাক্ষিণাত্যে নিজ সৈন্যদিগকে শিবাজীর উপর সর্ক দৃষ্টি রাখিতে বলিয়া গেলেন। মীর জুলাকে লিখিলেন (ডিসেম্বর ১৬৫৭)–“নসিরি খাঁ চলিয়া আসায় ঐ প্রদেশটা খালি হইয়াছে। সাবধান, সেই কুত্তার বাচ্চা সুযোগের অপেক্ষায় বসিয়া আছে।” আদিল শাহকে লিখিলেন– “এই দেশ রক্ষা করিও। শিবাজী এ দেশের কতকগুলি দুর্গ চুরি করিয়া দখল করিয়াছে। তাহাকে সেগুলি হইতে দূর করিয়া দাও। আর যদি শিবাজীকে চাকর রাখিতে চাও, তবে তাহাকে কর্ণাটকে জাগীর দিও,– যেন সে বাদশাহী রাজ্য হইতে দূরে থাকে এবং উপদ্রব বাধাইতে না পারে।”
শিবাজীর উত্তর-কোঁকন জয়
কিন্তু ১৬৫৮ ও ১৬৫৯ এই দুই বৎসর ধরিয়া মুঘল-রাজকুমারগণ সিংহাসন লইয়া যুদ্ধে ব্যস্ত থাকায়, শিবাজীর ঐদিক হইতে কোনই ভয়ের কারণ রহিল না। আর গত যুদ্ধে মুঘলদের কাছে পরাজয় হইল কাহার দোষে,–এই লইয়া বিজাপুরী মন্ত্রী ও সেনাপতিদিগের মধ্যে তুমুল কলহ বাধিয়া গেল। প্রধানমন্ত্রী খাঁ মুহম্মদ রাজধানীতে খুন হইলেন। এই গণ্ডগোলের সুযোগে শিবাজী স্বচ্ছন্দে রাজ্য বিস্তার করিতে লাগিলেন। পশ্চিমঘাট (অর্থাৎ সহ্যাদি পর্ব্বতমালা) পার হইয়া তিনি উত্তর-কোঁকন, অর্থাৎ বৰ্ত্তমান থানা জেলায় ঢুকিয়া বিজাপুরের হাত হইতে কল্যাণ এবং ভিবী নগর দুটি কাড়িয়া লইলেন; তথায় তাঁহার অনেক ধনরত্ন লাভ হইল (২৪ অক্টোবর, ১৬৫৭)।
বিজাপুরের অধীনে মুল্লা আহমদ নামক একজন আরব ওম্রা এই কল্যাণ প্রদেশের শাসনকর্তা ছিলেন। শিবাজীর সেনাপতি আবাজী সোনদেব ঐ দেশ অধিকার করিবার সময় মুল্লা আহমদের সুন্দরী তরুণী পুত্রবধূকে বন্দী করিলেন এবং শিবাজীর নিকট ভোগের উপহার-স্বরূপ পাঠাইয়া দিলেন। কিন্তু শিবাজী বন্দিনীর দিকে একবারমাত্র চাহিয়া বলিলেন, “আহা! আমার মা যদি এর মত হইতেন, তবে কি সুখের বিষয় হইত! আমার চেহারাও খুব সুন্দর হইত।” এইরূপে মেয়েটিকে মা বলিয়া ডাকিয়া আশ্বস্ত করিয়া তাহাকে বস্ত্র অলঙ্কার-সমেত বিজাপুরে তাহার শ্বশুরের নিকট সসম্মানে পাঠাইয়া দিলেন। সেই যুগে ইহা এক নূতন ঘটনা,– শুনিয়া সকলে আশ্চর্য্য হইল।
ইহার পর শিবাজী কল্যাণ ও ভিবণ্ডীর উত্তরে মাহুলী-দুর্গ দখল করিলেন (৮ জানুয়ারি, ১৬৫৮)। এইরূপে উত্তর-কোঁকন দখল করিয়া ক্রমে দক্ষিণ দিকে কোলাবা জেলার কিয়দংশ অধিকারে আনিলেন এবং তথায় অনেক দুর্গ নিৰ্ম্মাণ করাইলেন। কল্যাণের উত্তরে পোর্তুগীজদের দামন প্রদেশের কয়েকটি গ্রাম লুঠ করিয়া শিবাজী আসিরি দুর্গে স্থায়িভাবে আড্ডা গাড়িলেন। আর কল্যাণের নীচে সমুদ্রের খাড়ীতে জাহাজ নির্ম্মাণ করিয়া মারাঠী নৌসেনার সূত্রপাত করিলেন।
শিবাজীর দমনে আফজল খাঁর অভিযান
১৬৫৮ সালের প্রথমভাগে আওরংজীব দাক্ষিণাত্য হইতে চলিয়া গেলেন; তখন বিজাপুর-রাজ্য শান্তি ও নূতন বল পাইল। মন্ত্রী খাওয়াস্ খাঁ বেশ বিচক্ষণ লোক, আর রাজমাতা বড়ী সাহিবা অত্যন্ত তেজ ও দক্ষতার সহিত রাজকার্য চালাইতে লাগিলেন। চারিদিকে অবাধ্য সামন্তদিগকে দমন করিবার চেষ্টা চলিতে লাগিল। শাহজীকে হুকুম করা হইল যে, তাঁহার বিদ্রোহী পুত্রকে বশে আনুন। তিনি উত্তর দিলেন– “শিবা আমার ত্যাজ্য পুত্র। আপনারা তাহাকে সাজা দিতে পারেন, আমার জন্য সঙ্কোচ করিবেন না।“
তখন শিবাজীর বিরুদ্ধে সৈন্য পাঠান সাব্যস্ত হইল। কিন্তু ভয়ে কোনো ওমরাহ এই সময়-অভিযানের নেতা হইতে সম্মত হইলেন না। সুলতান তখন দরবারের মধ্যে একটি পানের বিড়া রাখিয়া বলিলেন, “যিনি এই যুদ্ধের নেতা হইতে প্রস্তুত, কেবল তিনিই এই বিড়া তুলিয়া লইবেন এবং তাঁহাকে বীরশ্রেষ্ঠ বলিয়া গণ্য করা হইবে।“
আবদুল্লা ভটারি (পাঁচক-বংশীয়), উপাধি আফজল খাঁ, বিজাপুর-রাজ্যের প্রথম শ্রেণীর ওমরা; মহীশ্বর-জয়ে, এবং মুঘলদের সহিত গত যুদ্ধে তিনি অনেকবার বীরত্ব ও প্রভুভক্তি দেখাইয়া সুনাম অর্জ্জন করিয়াছেন। তিনিই পানের বিড়াটি খপ্ করিয়া উঠাইয়া লইলেন এবং সগর্ব্বে বলিলেন যে, ঘোড়ার উপর বসিয়া থাকিয়াই শিবাজীকে পরাস্ত করিয়া বাঁধিয়া লইয়া আসিবেন।
কিন্তু গত যুদ্ধের ফলে রাজসরকারের অর্থ ও লোকবল বড়ই কমিয়া গিয়াছে। কাজেই আফজলের সঙ্গে দশ হাজার অশ্বারোহীর বেশী সৈন্য পাঠান সম্ভব হইল না। এদিকে শিবাজীর অশ্বারোহী-সৈন্যই ত দশ হাজারের বেশী, তাহার উপর লোকে বলিত, জাবলীজয়ের ফলে তাঁহার অধীনে ষাট হাজার মাব্লে পদাতিক জুটিয়াছে। এছাড়া একদল সাহসী, রণদক্ষ পাঠান বিজাপুরের চাকরি হারাইয়া তাঁহার বেতনভোগী হইয়াছিল। সুতরাং বিজাপুরের রাণী-মা আফজলকে বলিয়া দিলেন,– “বন্ধুত্বের ভাণ করিয়া শিবাজীকে ভুলাইয়া বন্দী করিতে হইবে।” (তৎসাময়িক ইংরাজ-বণিকের চিঠিতে একথা স্পষ্ট লেখা আছে)।
আফজল খাঁর কার্য্যকলাপ
আফজল খাঁ বিজাপুর হইতে প্রথমে সোজা উত্তর দিকে অগ্রসর হইয়া মহারাষ্ট্রের সর্ব্বশ্রেষ্ট তীর্থ তুলজাপুরে পৌঁছিয়া সেখানকার ভবানী-মূর্ত্তি ভাঙ্গিয়া জাঁতায় পিষিয়া গুঁড়া করিয়া ফেলিলেন।[১] তাহার পর পশ্চিম দিকে ফিরিয়া তিনি সাতারা শহরের ২০ মাইল উত্তরে বাই নামক নগরে পৌঁছিলেন (এপ্রিল ১৬৫৯)। এ নগরটি তাঁহার জাগীরের সদর ছিল। এখানে অনেক মাস থাকিয়া, কিরূপে শিবাজীকে পাহাড় হইতে খোলা জায়গায় আনা যায় অথবা স্থানীয় মারাঠা- জমিদারদের সাহায্যে বন্দী করা যায়, তাহার ফন্দী আঁটিতে লাগিলেন। বিজাপুর-সরকার অধীনস্থ সমস্ত মাব্লে দেশমুখদিগকে হুকুম পাঠাইয়াছিলেন, যেন তাঁহারা সৈন্য দিয়া আফজলের সহায়তা করেন। ইহার কিছু ফলও হইয়াছিল। রোহিড়খোরের দেশমুখী লইয়া খণ্ডোজী খোপড়ে ও কান্হোজী জেধের মধ্যে ঝগড়া চলিতেছিল। কানহোজী শিবাজীর পক্ষে ছিল। খণ্ডোজী আসিয়া আফজল খাঁর সহিত যোগ দিল এবং লিখিয়া অঙ্গীকার করিল যে, ঐ গ্রামের দেশমুখী তাহাকে দিলে সে শিবাজীকে ধরিয়া আনিয়া দিবে। খোপ্ড়েকে নিজ অনুচরসহ আফজলের সেনার অগ্রভাগের নেতা করা হইল।
বর্ষার শেষে অক্টোবর মাসে সৈন্যচালনা করিবার উপযুক্ত সময় আবার আসিবে। ইতিমধ্যে শিবাজী প্রতাপগড় দুর্গে পৌঁছিয়াছেন। এই দুর্গ বাই হইতে মাত্র ২০ মাইল পশ্চিমে অবস্থিত। আফজল খাঁ নিজ দেওয়ান কৃষ্ণাজী ভাস্করকে দিয়া শিবাজীকে বলিয়া পাঠাইলেন, –“তোমার পিতা আমার বহুকালের বন্ধু, সুতরাং তুমি আমার নিকট অপরিচিত পর নহ। আসিয়া আমার সঙ্গে দেখা কর, আমি বিজাপুরের সুলতানকে বলিয়া রাজী করাইব যাহাতে তোমার দুর্গগুলি ও কোঁকন-প্রদেশ তোমারই অধিকারে থাকে। আমি দরবার হইতে তোমাকে আরও মান এবং সৈন্যের সরঞ্জাম দেওয়াইব। যদি তুমি স্বয়ং দরবারে হাজির থাকিতে চাও, ভালই, উচ্চ সম্মান পাইবে। আর যদি তথায় উপস্থিত না হইয়া নিজ জাগীরে বাস করিতে চাও, তাহারও অনুমতি দিবার ব্যবস্থা করিব।”
আফজলের আক্রমণে শিবাজীর ভয় ও চিন্তা
ইতিমধ্যে আফজল খাঁর আগমন-সংবাদে শিবাজীর অনুচরগণের মধ্যে মহা ভয় ও ভাবনা উপস্থিত হইয়াছিল। তাহারা এ পর্য্যন্ত ছোটখাটো লড়াই ও সামান্য পদের লোকজনের ধনসম্পত্তি লুটপাট করিয়াছে। এইবার একটি শিক্ষিত, সুসজ্জিত বিশাল বাহিনী একজন বিখ্যাত বীর সেনাপতির অধীনে তাহাদের বিরুদ্ধে লড়িতে আসিয়াছে, বিজাপুর হইতে বাই পর্য্যন্ত অপ্রতিহত তেজে অগ্রসর হইয়াছে, মারাঠারা তাহাদের বাধা দিতে মোটেই সাহস পায় নাই। আফজল খাঁর অদম্য শক্তি ও নিষ্ঠুরতার গল্প দেশময় ছড়াইয়া পড়িয়াছিল। কয়েক বৎসর পূর্ব্বে সেরা- দুর্গের জমিদার কম্ভরী রঙ্গ, বিজাপুরী সৈন্যের শিবিরে আফজল খাঁর নিকট আত্মসমর্পণ করিতে আসিলে, আফজল তাঁহাকে ধরিয়া খুন করেন। সুতরাং শিবাজী প্রথম যেদিন নিজ প্রধানদের ডাকিয়া তাহাদের মত জানিতে চাহিলেন, সকলেই ভয়ে তাঁহাকে সন্ধি করিতে পরামর্শ দিল, বলিল- যুদ্ধ করিলে বৃথা প্রাণনাশ হইবে, জয়লাভ অসম্ভব।
শিবাজী বিষম সমস্যায় পড়িলেন। যদি তিনি এখন আদিল শাহর বশ্যতা স্বীকার করেন, তবে তাঁহার ভবিষ্যৎ উন্নতির পথ চিরদিনের জন্য রুদ্ধ হইয়া যাইবে;– তাঁহাকে হয় বিজাপুরের বন্দীশালায়, না হয় পুণায় সামান্য আজ্ঞাবাহী জাগীরদার হইয়া জীবন কাটাইতে হইবে। আর যদি এখন বিজাপুর-রাজসৈন্যের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেন, তবে সুলতান আমরণ তাঁহার শত্রু হইয়া থাকিবেন এবং তাঁহাকে অবশিষ্ট জীবন একেবারে অসহায় বন্ধুহীন অবস্থায় মুঘল ও অন্যান্য রাজার সহিত যুদ্ধ করিয়া কাটাইতে হইবে। সারাদিন ভাবিয়া ভাবিয়া রাত্রে তাঁহার চিন্তা জৰ্জ্জরিত দেহে তদ্ৰা আসিল। প্রবাদ আছে, স্বপ্নে ভবানী দেবী তাঁহাকে দেখা দিয়া বলিলেন, “বৎস! ভয় নাই, তোমায় রক্ষা করিব। আফজলকে আক্রমণ কর,– তোমারই জয় হইবে।”
আর সংশয় রহিল না। প্রাতঃকালে আবার মন্ত্রণা-সভা বসিল। শিবাজীর বীর-বাণী এবং দেবীর আশীর্ব্বাদের কথা শুনিয়া প্রধানগণ সকলেই উৎসাহে মাতিয়া যুদ্ধে মত দিল। মাতা জীজা বাঈও শিবাজীকে আশীর্ব্বাদ করিয়া, তাঁহারই জয় হইবে এই ভবিষ্যদ্বাণী করিলেন।
যুদ্ধে হঠাৎ তাঁহার মৃত্যু হইলে কিরূপে রাজ্য চালাইতে হইবে, সে বিষয়ে শিবাজী তখন নিজ কর্ম্মচারীদিগকে বিস্তারিত উপদেশ দিলেন। অত্যন্ত দূরদর্শিতা ও দক্ষতার সহিত আফজলকে আক্রমণ করিবার বন্দোবস্ত স্থির করা হইল। পেশোয়া ও সেনাপতি নেতাজী পালকরের অধীনে দুইটি বড় সৈন্যদল আনাইয়া তাহাদের প্রতাপগড়ের কাছে বনের মধ্যে লুকাইয়া থাকিতে আদেশ দেওয়া হইল।
আফজলের সহিত সন্ধি ও সাক্ষাতের আলোচনা
এমন সময় আফজলের দূত কৃষ্ণাজী ভাস্কর আসিয়া শিবাজীকে খাঁর সহিত দেখা করিতে আহ্বান করিলেন। শিবাজী এই ব্রাহ্মণকে খুব খাতির-যত্ন করিলেন; রাত্রে তাঁহার নির্জ্জন কক্ষে ঢুকিয়া জানাইলেন, “আপনি হিন্দু ও পুরোহিত-জাতি। আমিও হিন্দু। সত্য করিয়া বলুন, আফজল খাঁর অভিসন্ধি কি?” পীড়াপীড়িতে বাধ্য হইয়া কৃষ্ণাজী উত্তর দিলেন যে, খাঁর অভিপ্ৰায় সাধু নহে।
পরদিন শিবাজী নিজ পক্ষের দূত পস্তাজী গোপীনাথকে কৃষ্ণাজী ভাস্করের সহিত আফজলের শিবিরে পাঠাইলেন। খাঁ পস্তাজীর নিকট শপথ করিলেন যে, দেখা করিবার সময় তিনি শিবাজীর কোনই অনিষ্ট করিবেন না। আর, শিবাজীর তরফ হইতে পস্তাজী অঙ্গীকার করিলেন যে, আফজলের প্রতি সে সময় কোনরূপ বিশ্বাসঘাতকতা করা হইবে না। কিন্তু শিবাজীর দূত প্রচুর ঘুষ দিয়া সেখানকার বিজাপুরী-সদারদের নিকট হইতে সন্ধান লইলেন, “খাঁ এরূপ বন্দোবস্ত করিয়াছেন যে, সাক্ষাতের সময় তিনি শিবাজীকে বন্দী করিবেন, কারণ শিাজীর মত ধূৰ্ত্তকে যুদ্ধে বশ করা অসম্ভব।” এই-সব কথা শুনিয়া শিবাজী যাহাতে আফজলকে বধ করিয়া আত্মরক্ষা করিতে পারেন, তাহার জন্য প্রস্তুত হইলেন ।
তাহার পর শিবাজী জানাইলেন যে, খাঁর সহিত সাক্ষাৎ করিয়া তিনি সন্ধি স্থির করিতে সম্মত, কিন্তু বাই নগরে যাইতে ভয় পাইতেছেন; প্রথমে খাঁ তাঁহার বাড়ীর কাছে আসিয়া দেখা করিয়া তাঁহাকে অভয় দিন, তাহার পর তিনি খাঁর শিবিরে যাইবেন।
সাক্ষাতের স্থানে আফজল ও শিবাজীর আগমন
আফজল রাজি হইলেন। উভয়ের সাক্ষাতের জন্য প্রতাপগড় দুর্গের কিছু নীচে একটি পাহাড়ের মাথার উপর তাঁবু খাটান হইল এবং বন কাটিয়া সেখানে যাইবার পথ প্রস্তুত করা হইল। আফজল খাঁ সসৈন্য বাই হইতে কুচ করিয়া মহাবালেশ্বর অধিত্যকার ভিতর দিয়া “পার” নামক গ্রামে আসিয়া ছাউনি করিলেন। গ্রামটি প্রতাপগড়ের এক মাইল দক্ষিণে, নীচের সমতলভূমিতে। তাঁহার সৈন্যগণ কয়না নদীর ধারে গভীর উপত্যকায় চারিদিকে আশ্রয় লইল ।
সাক্ষাতের নির্দ্দিষ্ট দিনে (১০ই নবেম্বর, ১৬৫৯) আফজল খাঁ প্রথমে পার গ্রামের শিবির হইতে এক হাজার বন্দুকধারী রক্ষী লইয়া, পালকীতে চড়িয়া প্রতাপগড় পাহাড়ে উঠিতে লাগিলেন। পন্তাজী গোপীনাথ বলিলেন যে এত সৈন্য দেখিয়া শিবাজী ভয় পাইবেন এবং সাক্ষাৎ করিতে আসিবেন না, সুতরাং খাঁ আর- সকলকে বিদায় দিয়া মাত্র দুইজন রক্ষী লইয়া উপরে উঠুন। তাহাই করা হইল। আফজলের সঙ্গে চলিল– দুইজন সৈনিক, বিখ্যাত তলোয়ার-বাজ বীর সৈয়দ বান্দা এবং দুই পক্ষের দুইজন ব্রাহ্মণ দূত, অর্থাৎ পস্তাজী ও কৃষ্ণাজী।
যে তাঁবুতে উভয়ের মিলনের ব্যবস্থা হইয়াছিল তথায় পৌঁছিয়া সেখানকার মহামূল্য সাজসজ্জা ও বিছানাপত্র দেখিয়া আফজল রাগিয়া বলিলেন, “কি! সামান্য জাগীরদারের ছেলের এত আড়ম্বর।” কিন্তু পন্তাজী তাঁহাকে বুঝাইয়া দিলেন যে, এসব দ্রব্য সন্ধির উপহার-স্বরূপ বিজাপুর-রাজকে দিবার জন্য আনা হইয়াছে।
তখন শিবাজীকে ডাকিবার জন্য প্রতাপগড়ে লোক পাঠান হইল। তিনি জামার নীচে লুকাইয়া লোহার জালের বর্ম্ম এবং মাথার পাগড়ীর নীচে ছোট কড়াইএর মত ইস্পাতের টুপী পরিলেন। বাহির হইতে দেখিলে বুঝিবার যো নাই যে, তাঁহার শরীরে কোন অস্ত্র লুকান আছে; কিন্তু তাঁহার বাম হাতের আঙ্গুলে কড়া দিয়া লাগান ‘বাঘনখ’ নামক তীক্ষ্ণ বাঁকা ইস্পাতের নখরগুলি মুঠির মধ্যে লুকান ছিল, আর ডান হাতের আস্তিনের নীচে ‘বিছুয়া’ নামক সরু ছোরা ঢাকা ছিল। তাঁহার সঙ্গে দুইজন শরীর-রক্ষক– জীব মহালা নামক নাপিত (তলোয়ার-খেলায় দক্ষ ) এবং শম্ভুজী কাজী; উভয়েই অসমসাহসী, ক্ষিপ্রহস্ত ও তেজীয়ান পুরুষ। ইহাদের প্রত্যেকের হস্তে দুইখানা তরবারি ছিল। প্রতাপগড় দুর্গ হইতে নামিবার সময় শিবাজী মাতার চরণে প্রণাম করিয়া বিদায় চাহিলেন। শুক্লবসনা দেবী-প্রতিমা জীজা বাঈ আশীৰ্ব্বাদ করিলেন, “তোমার জয় হউক”, এবং শিবাজীর সঙ্গিগণকে বিশেষ করিয়া বলিয়া দিলেন, “আমার পুত্রকে রক্ষা করিও।” তাহারা উৎসাহে প্রতিজ্ঞা করিল– “তাহাই করিব।”
আফজল খাঁর সহিত কাটাকাটি
প্রতাপগড় দুর্গ শিখর হইতে নামিয়া শিবাজী তাঁহার তাঁবুর দিকে কিছু-দূর ধীরে ধীরে যাইবার পর, হঠাৎ থামিয়া দাঁড়াইলেন এবং বলিয়া পাঠাইলেন যে, সৈয়দ বান্দাকে সাক্ষাতের স্থান হইতে সরাইয়া দিতে হইবে। তাহাই করা হইল। অবশেষে শিবাজী মিলনের শামিয়ানাতে প্রবেশ করিলেন। এই বস্ত্ৰগৃহে উভয় পক্ষেই চারিজন করিয়া লোক উপস্থিত ছিল– স্বয়ং নেতা, দুইজন শরীর-রক্ষক, এবং একজন ব্রাহ্মণ দূত। শিবাজী দেখিতে নিরস্ত্র, কিন্তু আফজল খাঁর কোমরে তলোয়ার ঝুলিতেছে।
সঙ্গীরা সকলে নীচে দাঁড়াইয়া রহিল। শামিয়ানার মধ্য-স্থলে যে বেদীর মত অল্প উঁচু স্থানে আফজল খাঁ বাসিয়াছিলেন, শিবাজী তাহার উপর চড়িলেন। খাঁ গদী হইতে উঠিয়া কয়েক পা অগ্রসর হইয়া শিবাজীকে আলিঙ্গন করিবার জন্য বাহু বিস্ত ার করিয়া দিলেন। শিবাজী বেঁটে ও সরু, তিনি বিশালকায় আফজলের কাঁধ পর্য্যন্ত উঁচু। সুতরাং খাঁর বাহু দুটি শিবাজীর গলা ঘিরিল। তারপর হঠাৎ আফজল খাঁ শিবাজীর গলা নিজ বাম বাহু দিয়া লৌহবেষ্টনে চাপিয়া ধরিলেন এবং ডান হাত দিয়া কোমর হইতে লম্বা সোজা ছোরা (যদ্ধর) খুলিয়া শিবাজীর বাম পাঁজরে ঘা মারিলেন। কিন্তু অদৃশ্য বর্ম্মে বাধিয়া ছোরা দেহে প্রবেশ করিতে পারিল না। গলার চাপে শিবাজীর দমবন্ধ হইবার মত হইল। কিন্তু এক মুহূর্ত্তে বুদ্ধি স্থির করিয়া তিনি বাম বাহু সজোরে ঘুরাইয়া আফজল খাঁর পেটে বাঘনখ বসাইয়া দিয়া তাঁহার পাকস্থলীর পর্দ্দা বিদীর্ণ করিয়া দিলেন, খাঁর ভুঁড়ী বাহির হইয়া পড়িল। আর ডান হাতে ‘বিছুয়া’ লইয়া খাঁর বাম পাঁজরে মারিলেন। যন্ত্রণায় আফজল খাঁর বাহুবন্ধন শিথিল হইয়া আসিল; এই সুযোগে শিবাজী নিজেকে মুক্ত করিয়া বেদী হইতে লাফাইয়া পড়িয়া নিজ সঙ্গীদের দিকে ছুটিলেন। এসব ঘটনা এক নিমেষে শেষ হইল ।
ঘা খাইয়াই আফজল খাঁ চেঁচাইয়া উঠিলেন, –“মারিল, মারিল, আমাকে প্রতারণা করিয়া মারিল।” দুই দিক হইতে অনুচরগণ নিজ নিজ প্রভুর দিকে ছুটিল। সৈয়দ বান্দা তাহার লম্বা সোজা তলোয়ার (পাট্টা) দিয়া এক কোপে শিবাজীর মাথার পাগড়ী কাটিয়া ফেলিল। তলোয়ারের ঘায়ে শিবাজীর পাগড়ীর নীচের লোহার টুপিটা পৰ্য্যন্ত টোল খাইয়া গেল, কিন্তু মস্তক রক্ষা পাইল। তিনি জীব মহালার হাত হইতে একখানি তলোয়ার লইয়া সৈয়দ বান্দাকে ঠোকইতে লাগিলেন। জীব মহালা পাশ কাটাইয়া আসিয়া প্রথমে সৈয়দের ডান হাত ও পরে মাথা কাটিয়া ফেলিল। ইতিমধ্যে বাহকেরা আহত আফজলকে পালকীতে শোয়াইয়া তাঁহার শিবিরে লইয়া যাইবার চেষ্টা করিল। কিন্তু শম্ভুজী কাজী আসিয়া তাহাদের পায়ে কোপ মারায় তাহারা পালকী ফেলিয়া ছুট দিল। তখন শম্ভুজী আফজল খাঁর মাথা কাটিয়া বিজয়-গর্ব্বে তাহা শিবাজীর কাছে হাজির করিল।
আফজলের সৈন্য পরাজিত ও লুণ্ঠিত হইল
আফজল খাঁর মৃত্যুর পর অমনি শিবাজী তাঁহার রক্ষী দুইটির সহিত দৌড়াইয়া পাহাড় বাহিয়া প্রতাপগড় দুর্গে উঠিলেন এবং সেখান হইতে তোপধ্বনি করিলেন। এই সঙ্কেত আগে হইতেই স্থির করা ছিল। তোপের শব্দ শুনিবামাত্র পার গ্রামের নিকট ঝোঁপ ও পর্ব্বতের মধ্যে যেখানে শিবাজীর দুই দল সেনা লুকাইয়াছিল, সেখান হইতে তাহারা বাহির হইয়া চারিদিক দিয়া বিজাপুরী সৈন্যদের আক্রমণ করিল। আফজলের আকস্মিক মৃত্যুর সংবাদে তাঁহার শিবিরের কর্ম্মচারী সিপাহী ও লোকজন একেবারে হতভম্ব হইয়া গিয়াছিল। তাহাদের নেতা নাই, পথঘাট অপরিচিত, অথচ অগণিত শত্রু চারিদিক ঘিরিয়া আছে। পলাইবার পথ বন্ধ; সতুরাং তাহারা হতাশ হইয়া যুদ্ধ করিল। কিন্তু মারাঠারা আজ বিজয়-উল্লাসে উন্মত্ত, দুইজন নামজাদা সেনাপতি তাহাদের চালনা করিতেছেন, যুদ্ধের স্থান তাহাদের সুপরিচিত। তাহারা অদম্য বেগে শত্রু বধ করিয়া অগ্রসর হইতে লাগিল। তিন ঘণ্টার মধ্যে সব শেষ হইল। তিন হাজার বিজাপুরী সৈন্য মারা গেল। মালেরা সামনে যাহা পাইল তাহারই উপর তরবারি চালাইতে লাগিল; পলাতক হাতীর লেজ কাটিয়া ফেলিল, দাঁত ভাঙ্গিয়া দিল, পাঘাল্ করিল; উটকে কাটিয়া ভূমিশায়ী কারিল। যে-সব বিজাপুরী সৈন্য পরাজয় স্বীকার করিয়া দাঁতে তৃণ ধরিয়া ক্ষমা চাহিল, তাহাদের প্রাণদান করা হইল। এই যুদ্ধে শিবাজী লুঠ করিয়া বিশেষ লাভবান হইলেন। আফজল খাঁর সমস্ত তোপ, গোলাগুলি ও বারুদ, তাম্বু ও বিছানাপত্র, ধনরত্ন, মালসমেত ভারবাহী পশু তাঁহার হাতে পড়িল; ইহার মধ্যে ছিল পঁয়ষট্টিটা হাতী, চারি হাজার ঘোড়া, বারো শ’ উট, দু’হাজার কাপড়ের বস্তা এবং নগদ ও গহনাতে দশ লক্ষ টাকা। বন্দীদের মধ্যে ছিলেন একজন উচ্চপদস্থ বিজাপুরী সর্দ্দার, আফজলের দুই শিশুপুত্র, এবং দুজন সাহায্যকারী মারাঠা জমিদার। যে-সব স্ত্রীলোক শিশু ব্রাহ্মণ এবং শিবিরের চাকর ধরা পড়িল, শিবাজী তৎক্ষণাৎ তাহাদের মুক্তি দিলেন। কিন্তু আফজলের স্ত্রীগণ ও জ্যেষ্ঠপুত্র ফজল খাঁ, কয়না নদীর তীর বাহিয়া খণ্ডোজী খোপ্ড়ে ও তাহার মাব্লে সৈন্যের সহায়তায় নিরাপদ স্থানে পলাইয়া গেলেন।
শিবাজী তাঁহার বিজয়ী সেনাদের একত্র করিয়া পরিদর্শন করিলেন। বন্দীদের অন্ন, বস্ত্র ও অর্থ সাহায্য করিয়া নিজ নিজ স্থানে চলিয়া যাইতে দেওয়া হইল। যে- সব মারাঠা-সৈন্য যুদ্ধে প্রাণ দিয়াছিল, তাহাদের বিধবাদের পেন্সন দেওয়া হইল এবং বয়স্ক পুত্র থাকিলে তাহারা পিতার পদে নিযুক্ত হইল। আহত সৈনিকগণ জখমের অবস্থা অনুসারে একশত হইতে আটশত টাকা পুরস্কার পাইল। উচ্চ সৈনিক কর্ম্মচারীদিগকে হাতী, ঘোড়া, পোষাক ও মণিমুক্তা বক্শিশ দেওয়া হইল।
মারাঠাদের এই প্রথম কীৰ্ত্তি এখানেই থামিল না। বিজয়ী শিবাজী দক্ষিণে অগ্রসর হইয়া কোলাপুর জেলা আক্রমণ করিলেন, পন্হালা দুর্গ হস্তগত করিয়া (২৮এ নবেম্বর), রুস্তম্-ই জমানের অধীনে অপর একটি বিজাপুরী সৈন্যদলকে পরাস্ত করিলেন (২৮এ ডিসেম্বর)। আর তাহার পর জানুয়ারি মাসে দক্ষিণ- কোঁকনে রত্নগিরি জেলায় প্রবেশ করিয়া অনেক বন্দর ও গ্রাম লুটিলেন।
আফজল খাঁর মৃত্যু সম্বন্ধে গান ও গল্প
আফজল খাঁর ভীষণ পরিণাম দেশময় আলোচনা ও গল্পের সৃষ্টি করিয়াছিল। “অজ্ঞানদাস” ছদ্মনাম বা ভণিতাধারী একজন কবি মারাঠী ভাষায় ঐ ঘটনা সম্বন্ধে একটি অত্যন্ত তেজপূর্ণ পোবাড়া (ব্যালাড) রচনা করেন, তাহা এখনও জনসাধারণের খুব প্রিয়। আউন্ধের রাজা বালাসাহেব পস্ত প্রতিনিধি ইদানীং ঐ ঘটনা লইয়া একটি গীতিকা লিখিয়াছেন। কিন্তু এই ‘ব্যালাড’ ঐতিহাসিক সত্য অনুসরণ করে নাই, শুধু সুখপাঠ্য কিংবদন্তী ও কাল্পনিক শাখাপল্লবে পূৰ্ণ, –যেন মহাভারতের একটি দ্বন্দ্বযুদ্ধ।
মারাঠা দেশে প্রবাদ আছে, যখন আফজল বিজাপুর হইতে শিবাজীর বিরুদ্ধে রওনা হন, তখন নানা অশুভ ঘটনা ঘটিয়াছিল– তাঁহার পতাকা ভাঙ্গিয়া পড়িয়া যায়, বড় হাতীটা অগ্রসর হইতে চাহে নাই, ইত্যাদি। আর তিনি মৃত্যু নিশ্চিত জানিয়া রওনা হইবার পূর্ব্বেই নিজের ৬৩ জন স্ত্রীকে খুন করিয়া একই চবুতরার নীচে সমান দূরে দূরে তাহাদের কবর দিয়া মনের শঙ্কা মিটাইয়াছিলেন। বিজাপুর শহরের কয়েক মাইল বাহিরে আফজলপুরা নামক স্থানে খাঁর বাড়ী ও চাকর- বাকরের বসতি ছিল। স্থানটি এখন জনমানবহীন শ্মশানে পরিণত হইয়াছে; শুধু ভাঙ্গা দেওয়াল, পরিখা ও বন-জঙ্গল ও দূরে চাষের ক্ষেত্র দেখা যায়। তাঁহার মৃত্যুর ১৪ বৎসর মাত্র পরে ফরাসী-পর্য্যটক আবে কারে ঐখানে আসিয়া দেখেন যে, কারিগরেরা খাঁর সমাধির পাথর কাটিতেছে এবং একখানা প্রস্তরফলকে খোদা আছে যে খাঁ তাঁহার হারেমের দুই শত স্ত্রীলোকের গলা কাটিয়া ফেলিয়াছিলেন। আমি ১৯১৬ সালের অক্টোবর মাসে তথায় যাই, এবং তেষট্টিটি কবর দেখিতে পাই। সেগুলি যে একই সময়ে এবং একই ধরনে গড়া তাহা নিঃসন্দেহে বুঝা যায়। এখন স্থানীয় কৃষকগণ ঐ খুনের বিস্তারিত বিবরণ বলে এবং সেই ঘটনার ভিন্ন ভিন্ন স্থানগুলি দেখাইয়া দেয়।
তথ্যনির্দেশ
১. মারাঠী গাথায় আছে, তিনি ভুলজাপুরের পর মানিকেশ্বর, পংঢারপুর, এবং মহাদেব পর্ব্বতেও দেবদ্বিজের প্রতি অত্যাচার অবমাননা করেন। শ্রীযুক্ত বিনায়ক লক্ষ্মণভাবে বলেন, এ কথা সত্য নহে।