মীরাদের বাড়িতে শুভ্ৰ এই প্রথম এসেছে। হুলস্থূল ধরনের বাড়ি। মীরাকে দেখে কে বলবে ঢাকা শহরে তাদের এত বড় বাড়ি আছে। অতি সাধারণ শাড়ি পরে সে ইউনিভার্সিটিতে আসে। শুধু শাড়ি না, তার সবকিছুই সাধারণ। পায়ের স্যান্ডেল জোড়া ডালা থেকে কেনা। কাঁধের চামড়ার ব্যাগটা দেখে মনে হয়। এই ব্যাগ মীরা নিজেই চামড়া কেটে ঘরে বানিয়েছে। ইউনিভার্সিটিতে যখন থাকে তখন দেখা যায় অফ পিরিয়ড়ে সে নানানজনের কাছে ছোটাছুটি করছে। কেউ তাকে ক্যান্টিনে নিয়ে যদি এক কাপ চা খাওয়ায়। কোনো মেয়ে হয়ত এক বোতল কোক কিনল, মীরা অবশ্যই বলবে, দেখি এক চুমুক খেয়ে দেখি। সেই মেয়ের এত বড় বাড়ি? একে বাড়ি বলাও তো ভুল- এটা হল রাজপ্রাসাদ।
বাড়ির গেটে পুলিশের পোশাক পরা দারোয়ান। দারোয়ানের পাশেই শিকল দিয়ে বাধা মস্ত বড় কুকুর; কুকুরটার শরীর মস্ত বড় হলেও তার চোখ গরুর চোখের মত শান্ত। বাড়ির সামনে শুধু যে বাগান আছে তাই না, ছোট্ট একটা ফোয়ারাও আছে। ফোয়ারার মাঝখানে পাথরের পরীমূর্তি। পরীর একটা ডানা ভাঙ্গা। ডানা ভাঙ্গা হলেও কী যে অপূর্ব সেই মূর্তি মূর্তির পা থেকে বিরঝির করে পানি বের হচ্ছে। বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে শুভ্ৰয় মনে হল- এই বাড়ি মানুষ থাকার জন্যে বানানো হয় নি- ছবির শুটিং এর জন্যে বানানো। তাও সব ধরনের ছবি না। রূপকথা জাতীয় ছবি। হেনসেল এন্ড গ্রেটেলের রূপকথা। দারোয়ান বলল, কাকে চান? দারোয়ানের চোখও কুকুরটার চোখের মত শান্ত। ধমক দেয়া দারোয়ান না। ধমক দেয়া দারোয়ান বা ভয়ংকর চোখের কুকুর এ বাড়িতে মানাতো না।
শুভ্ৰ পুরোপুরি নিশ্চিত হবার জন্যে বলল, এটা কি মীরাদের বাড়ি? ঢাকা ইউনিভার্সিটির ছাত্রী। এপ্লায়েড ফিজিক্স।
দারোয়ান বলল, জ্বি। যান। ভেতরে যান।
শুভ্র বলল, আমি রিকশা করে এসেছি কিন্তু রিকশা ভাড়া দিতে পারছি না। মানিব্যাগ ফেলে এসেছি। মীরার কাছ থেকে রিকশা ভাড়া আনতে হবে।
দারোয়ানকে এইসব কথা বলা অর্থহীন। শুভ্ৰ কেন বলছে নিজেও বুঝতে পারছে না। কোনো কোনো মানুষ আছে যাদের দেখলেই বেশি কথা বলতে ইচ্ছা করে। মীরদের বাড়ির দারোয়ান মনে হয়। সেই গোত্রের। শুভ্র বলল, এই কুকুরটা কি এলশেশিয়ান?
জ্বি না। এটা জার্মান ডোভার।
আমি এক্ষুণি রিকশা ভাড়া নিয়ে ফিরে আসছি। আপনি যদি দেখেন রিকশাআলা অস্থির হয়ে গেছে তাকে শান্ত করবেন। পারবেন না?
দারোয়ান মাথা নাড়ল। শুভ্ৰ লন পার হয়ে বাড়ির দিকে রওনা হল। শুভ্ৰর মনে হচ্ছে জার্মান ডোভার নামের ভয়ংকর কুকুরটা তার পেছনে পেছনে আসছে। যদিও সে পরিষ্কার দেখেছে কুকুরটা শিকল দিয়ে বাধা। এইটুক পথ পার হতে শুভ্র কয়েকবার পেছনে তাকাল। প্রতিবারই দেখল কুকুরটা তার দিকে তাকিয়ে আছে, দারোয়ান তার দিকে তাকিয়ে আছে, এবং রিকশাওয়ালা তার দিকে তাকিয়ে আছে। রিকশাওয়ালা তার বিষয়ে কী ভাবছে তা সে অনুমান করতে পারছে, কিন্তু দারোয়ান এবং কুকুরটা তার বিষয়ে কী ভাবছে কে জানে!
মীরাদের বাড়িতে আজ কোনো একটা উৎসব। হলঘরের মত বিরাট বসার ঘরে মানুষ গিজগিজ করছে। সবার গায়ে উৎসবের পোশাক। মনে হচ্ছে রঙের মেলা বসেছে। শুভ্ৰর মনে প্রথম যে চিন্তাটা এল তা হচ্ছে। এত অতিথি নিশ্চয়ই হোটে হেঁটে আসে নি, গাড়ি করে এসেছে। গাড়িগুলি কোথায় রাখা হয়েছে? বাড়ির সামনেতো একটা গাড়িও ছিল না। বাড়ির সামনে শুধু তার রিকশাটিা অপেক্ষা করছে। রিকশাওয়ালীকে পনেরো টাকা ভাড়া দিতে হবে। ভাংতি পনেরো টাকা কি মীরার কাছে আছে! এত বড় বাড়িতে যারা থাকে তাদের কাছে ভাংতি টাকা থাকার কথা না। তবে না থাকলেও সে জোগাড় করে দেবে। অবশ্যি মীরার যা স্বভাব সে হয়ত বলে ফেলতে পারে, যা ভাগ, আমি তোকে টাকা দেব কেন?
শুভ্র দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। একটু আগে সে যখন লন পার হচ্ছিল তখন তিনজন তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। দুজন মানুষ আর একটা কুকুর। আর এখন হল ভর্তি মানুষ অথচ কেউ তার দিকে তাকাচ্ছে না। সবাই ব্যস্ত। সবাই কথা বলছে। ঘরের একেবারে শেষ মাথায় ষ্টেজ তৈরি করা হয়েছে। বোধহয় গান বাজনা হবে। স্টেজের ঠিক মাঝখানে বিরক্ত মুখে মাঝবয়েসী এক ভদ্রলোক বসে আছেন। মনে হচ্ছে তিনিই গায়ক। এবং বেশ নামি গায়ক। নামি গায়করা গান শুরু হবার আগ পর্যন্ত খুব বিরক্ত হয়ে থাকেন। শুধুমাত্র গান করার সময় হাসিমুখে গান করেন। গায়ক ভদ্রলোকের দুপাশে বাদ্যযন্ত্রের লোক। তারা সবাই বেশ হাসিখুশি। মীরা আছে স্টেজের সামনে। সে দুটা স্পট লাইট নিয়ে ষ্টেজে আলো ফেলার চেষ্টা করছে। একটা স্পট লাইটের আলো পড়বে গায়কের মুখে, অন্য স্পট লাইটের আলো বাদ্যযন্ত্রীদের মুখে। বাদ্যযন্ত্রীরা দুভাগ হয়ে বসেছে বলে একটা স্পট লাইটে হচ্ছে না।
মীরা শুভ্ৰকে দেখল এবং তার কাজ বন্ধ করে হাসিমুখে শুভ্ৰর দিকে এগিয়ে এল। মীরাকে একেবারেই চেনা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে ড্রেস এজ ইউ লাইক খেলায় সে সাদা পরী সেজেছে। সে সেজেছে তাদের বাড়ির সামনের লনের পরীটার বড় বোন। লনের পরীটার একটা পাখী ভাঙ্গা। তার দুটি পাখাই ভাঙ্গা। মীরা পরেছে সাদা শিফনের শাড়ি। পায়ের স্যান্ডেল জোড়া সাদা আর কানে দুলছে পায়রার ডিমের মত দুটা সাদা পাথর। গলায় ঠিক সেই সাইজের পাথরের মালা। চুল খোঁপা করে বাধা। খোঁপায় বেলী ফুলের মালা। দুই হাতেও চুড়ির মত করে পরা বেলী ফুল।
শুভ্রর কাছাকাছি এসেই মীরা হাসি থামিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, এই শুভ্ৰ আমি কি আজ তোকে আসতে বলেছি? [মীরা তার ক্লাসের সবাইকে তুই করে বলে। শুভ্ৰ কাউকেই তুই বলতে পারে না।]
শুভ্র বলল, না।
এত দিন থাকতে বেছে বেছে আজই হুট করে এসে পড়লি কী মনে করে?
আজ কী?
আজ আমার বাবা-মার পঁচিশতম বিবাহ বার্ষিকী। আমরা কিছু সিলেক্টেড গেস্টকে বলেছি। তুই সিলেক্টেডদের তালিকায় নেই।
চলে যাব?
এসেছিস যখন এক পিস কেক আর এক কাপ চা খেয়ে যা। গান বাজনা আছে। গান শুনবি?
না।
তাহলে আয় বাবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেই। ম্যারেজ এ্যানিভার্সরি উৎসবে বাবা খুব মন খারাপ করে থাকেন। এটা খেয়াল রেখে বাবার সঙ্গে কথা বলবি।
শুভ্ৰ বলল, মন খারাপ করে থাকেন কেন?
মীরা হাসি মুখে বলল, বিবাহ বার্ষিকী আসলে দুজনের উৎসব। বাবাকে সেই উৎসব একা একা পালন করতে হয়।
শুভ্ৰ তাকিয়ে রইল, কিছু বলল না। মীরা বলল, জিজ্ঞেস কর, কেন বাবাকে এক এক উৎসব পালন করতে হয়।
কেন?
কারণ আমার মা তাঁর তিন নম্বর কন্যার জন্ম দিতে গিয়ে মারা যান। বাবা তখন পত্নীপ্ৰেমে শরৎচন্দ্রের নায়কের মত হয়ে যান। বিরাট একটা ভুল সিদ্ধান্ত নেন— বাকি জীবন বিবাহ করব না। বুকে স্ত্রীর স্মৃতি রেখে কন্যাদের বড় করব।
ও।
বাবার ক্যারেক্টাটার তোর কি ইন্টাররেটিং মনে হচ্ছে?
হুঁ।
বাবার চরিত্রের মধ্যে ইন্টারেস্টিং কোনো ব্যাপারই নেই। বাবা খুবই বোরিং টাইপের মানুষ। এক অর্থে মা ভাগ্যবতী, দীর্ঘদিন একজন বিরক্তিকর স্বামীর সঙ্গে থাকতে হল না। চল যাই বাবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেই। জাষ্টি হ্যালো বলে। বাবার কাছ থেকে ছুটে আসবি। বাবা কিন্তু তোকে আটকে ফেলার চেষ্টা করবে। আটকা পড়ে গেলে তোর নিজেরই ক্ষতি। বাবা পাঁচশর মত বোরিং গল্প জানে। সে চেষ্টা করবে। সবই তোকে শুনিয়ে ফেলতে; আগে ভাগে বলে দিলাম। যাতে পরে আমাকে দোষ দিতে না পারিস।
মীরার বাবা ব্যারিস্টার ইয়াসিন তাঁর শোবার ঘরে বিছানায় আধশোয়া হয়ে আছেন। মানুষটা অত্যন্ত সুপুরুষ। মাথায় সব চুল পেকে ধবধবে সাদা। সাদা চুলের যে আলাদা সৌন্দৰ্য আছে তা ইয়াসিন সাহেবকে না দেখলে কেউ তেমন জোরের সঙ্গে বলতে পারবে না। তিনি পারছেন। ধবধবে সাদা রঙের পায়জামা পাঞ্জাবি! মনে হচ্ছে এই পোষাকেই তাকে সবচে মানায়; তবে শুভ্রর ধারণা, এই মানুষটা যে পোষাকই পরবে মনে হবে সেই পোষাকে তাকে সবচে ভাল মানায়।
ইয়াসিন সাহেবের গায়ের রঙ বিদেশীদের মত লালচে ধরনের সাদা। স্বাস্থ্যু ভাল। তাঁকে দেখে মনে হয়। তিনি আসলে একজন যুবা পুরুষ। কোন এক সিনেমায় বৃদ্ধের ভূমিকায় অভিনয় করছেন। মেকাপ ম্যান ভাল মেকআপ দিতে পারে নি বলে চেহারায় যুবা ভাব রয়ে গেছে।
মীরা বলল, বাবা একজনকে তোমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে এনেছি। তাকে ভাল করে দেখে বল দেখি সে কে?
ইয়াসিন সাহেব বালিশের উপর রাখা চশমা চোখে দিয়ে পরীক্ষকের ভঙ্গিতে শুভ্রর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, এর নাম শুভ্র। হয়েছে?
হ্যাঁ, হয়েছে। কী করে বললে?
চশমা দেখে বললাম, তুই বলেছিলি শুভ্র খুব ভারী কাচের চশমা পরে। শুভ্ৰ! বাবা তুমি বোস। চেয়ারটা টেনে বোস।
শুভ্ৰ কিছু বলার আগেই মীরা বলল, শুভ্র বসবে না। বাবা। ও চলে যাবে।
চলে যাবে কেন?
শুভ্ৰকে আসলে দাওয়াত করা হয় নি। ও নিজে নিজে কী মনে করে যেন চলে এসেছে। এখন অপরিচিত সব লোকজন দেখে খুব অস্বস্তি বোধ করছে। তাই না শুভ্র? তুই অস্বস্তি বোধ করছিস না?
শুভ্ৰ হাসল, কিছু বলল না। ইয়াসিন সাহেব বললেন, অপরিচিত লোকজনের সঙ্গে কথা না বললে পরিচিত হবে কীভাবে? তাছাড়া আমিতো আর এখন অপরিচিত না; ও আমার সঙ্গে গল্প করুক। তুই যা আমাদের জন্যে চট করে। দুকাপ চা পাঠিয়ে দে।
তোমার ম্যারেজ এ্যনিভার্সিরি উপলক্ষে লোকজন এসেছে আর তুমি মুখ ভোতা করে শোবার ঘরে বসে আছ এটা কেমন কথা। তুমি দয়া করে বসার ঘরে যাও। এক্ষুণি গান শুরু হবে। আর শুভ্র এখানে তোমার সঙ্গে গল্প করতে আসে। নি। বোরিং গল্প সে সহ্যই করতে পারে না। তাছাড়া শুভ্র কখনো কোনো কাজ ছাড়া কোথাও যায় না। এখানে যে এসেছে। কোনো একটা কাজে এসেছে বলে আমার ধারণা। শুভ্ৰ বল দেখি কী জন্যে তুই এসেছিস?
শুভ্র একটু হকচাকিয়ে গেল। মীরা বলল, বাবার সামনে বলতে লজ্জা লাগলে আয় বারান্দায় চলে আয়। বাবা শোন, তুমি দয়া করে বসার ঘরে গিয়ে বোস, আমি শুভ্রর কথা শুনে তাকে বিদায় করে তারপর আসছি।
বসার ঘরের মত বাক্সান্দাতেও অনেক লোকজন। বেশির ভাগই মেয়ে। ফিল্যের নামকরা এক নায়িকা এসেছেন। বারান্দায় জটলােটা তাকে ঘিরে। নায়িকারা অনেক লোকজনের মাঝখানে সহজে মুখ খুলেন না। ইনি সে রকম না। বেশ আগ্রহ নিয়ে গল্প করছেন। সিঙ্গাপুরের অভিজ্ঞতার গল্প বলছেন। সবাই আগ্ৰহ নিয়ে শুনছে। একবার তিনি মোস্তফার দোকানে শপিং করতে গিয়েছেন। হঠাৎ সিঙ্গাপুরের প্রবাসী বাঙালিরা তাকে চিনে ফেলে ঘিরে ধরল। দোকানের লোকজন ভাবল— অন্য কিছু। তারা পুলিশে খবর দিয়ে দিল। ইতিমধ্যে বাঙালির সংখ্যা আরো বাড়ছে। ম্যাডাম হঠাৎ ভয়ে এবং দুঃশ্চিন্তায় ফেইন্ট হয়ে মেঝোয় পড়ে গেলেন। সেখান থেকে পুলিশ উদ্ধার করে তাকে নিয়ে গেল এলিজাবেথ হাসপাতালে। এলিজাবেথ হাসপাতাল হচ্ছে সিঙ্গাপুরের সবচে বড় হাসপাতাল। সব আমেরিকান ডাক্তার। কাজেই এক অর্থে আমেরিকান হাসপাতাল। দীর্ঘ ক্লান্তিকর গল্প। কিন্তু সবাই শুনছে খুব আগ্রহ নিয়ে।
মীরা শুভ্রকে বারান্দার এক কোণায় নিয়ে গিয়ে বলল, এখন বল আমার কাছে এসেছিস কী জন্যে? সৌজন্য সাক্ষাৎ? না-কি অন্য কিছু? আমার প্রেমে তুই হাবুডাবু খাচ্ছিস এ ধরনের সস্তা ডায়ালগ দিবি নাতো?
শুভ্র ইতস্তত করে বলল, তোমাদের বাসায় কি ক্যাসেট রেকর্ডার আছে?
মীরা বলল, আছে। অডিও ভিডিও সবধরনের রেকর্ডার আছে। কোনটা দরকার।
একটা ব্ল্যাংক ক্যাসেটে তুমি কি তোমার হাসি রেকর্ড করে আমাকে দিতে পার?
অবশ্যই পারি। কেন পারব না! কতক্ষণের হাসি? এক মিনিট, দুমিনিট না টানা তিন মিনিট।
ধর দু মিনিট।
দু মিনিট ধরে হাসা অসম্ভব ব্যাপার। আমার এত দম নেই। এক মিনিটে হবে?
হবে।
হাসির রেকর্ডটা কি এখনই দরকার?
পরে হলেও হবে।
পরে কেন, এসেছিস যখন আজই নিয়ে যা। ঝামেলা শেষ হয়ে যাক। একটু অপেক্ষা কর।
আচ্ছা।
এক কাজ কর। পার্টিতে খুব ইন্টারেস্টিং একজন ভদ্রলোক আছেন। নাম আখলাক। তোর উল্টো পিঠ। তুই তার সঙ্গে গল্প কর। আমি হাসি রেকর্ড করে নিয়ে আসি।
শুভ্র বলল, আমার উল্টো পিঠ মানে কী?
তুই পূর্ব হলে সে পশ্চিম। তুই সুমেরু হলে সে কুমেরু। খুবই মন্দ টাইপ মানুষ।
আমি কি ভাল টাইপ?
হুঁ।
মীরা আখলাক সাহেবকে খুঁজছে। তার পেছনে পেছনে যাচ্ছে শুভ্ৰ। শুভ্ৰ ভেবে বের করার চেষ্টা করছে— মীরা অন্য মেয়েদের থেকে কি একটু আলাদা? না-কি সে আলাদা হবার ভাব করে? অন্য যে-কোনো মেয়ে জানতে চাইত হাসির রেকর্ড দিয়ে কী হবে। মীরা জানতে চাইছে না। তার কি আসলেই জানতে ইচ্ছে করছে। না? না-কি সে মনের ইচ্ছেটা চাপা দিয়ে রেখেছে?
আখলাক সাহেব বসার ঘরের এক কোণায় একা একা বসে আছেন। তার হাতে এক গ্লাস পানি। তিনি পানিতে খুব ধীরে ধীরে চুমুক দিচ্ছেন। যেন তিনি পানি খাচ্ছেন না, হুইস্কি খাচ্ছেন। ভদ্রলোকের চেহারা সাধারণ। পোশাক পরিচ্ছদও সাধারণ। ছাই রঙের ইস্ত্রি বিহীন হাফ সার্টের সঙ্গে লাল টাই। ছাই রঙের সার্টের কারণে লাল টাইটা খুব ফুটেছে। চশমা পরেছেন। চশমা নাকের ডগার কাছাকাছি চলে এসেছে। তিনি তাকাচ্ছেন চশমার ফাঁক দিয়ে। শুভ্ৰ ছোটবেলায় একটা বই পড়েছিল, নাম শিয়াল পণ্ডিতের পাঠশালা। এই বই-এর প্রচ্ছদে চশমা চোখে এক শিয়ালের ছবি ছিল। ভদ্রলোককে দেখাচ্ছে শিয়ালের মত।
মীরাকে দেখে তিনি নিচু গলায় বললেন, তোমাদের গান শুরু হতে কত দেরি?
মীরা বলল, জানি না। আপনি একটু শুভ্ৰকে কোম্পানি দিনতো। ও খুব বোর ফিল করছে। বলেই মীরা প্রায় উড়ে চলে গেল।
আখলাক সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। শুভ্রর দিকে হাত বাড়িয়ে আন্তরিক ভঙ্গিতে বললেন, আমার নাম আখলাক। পেশায় আমি একজন আর্কিটেক্ট। সবার কাছে দুষ্টলোক হিসেবে পরিচিত। ফেরেশতাদের কোম্প্যানি ইন্টারেস্টিং হয় না, দুষ্টলোকদের কোম্প্যানি ইন্টারেস্টিং হয়। বসুন দাঁড়িয়ে আছেন কেন?
শুভ্র বসল। বয়স্ক একজন মানুষ তাকে আপনি আপনি করছেন, সম্মানের সঙ্গে কথা বলছেন, পরিচয় করিয়ে দেবার সময় উঠে দাঁড়ালেন। সব মিলিয়ে ব্যাপারটা একটু যেন অস্বস্তিকর।
শুত্র সাহেব!
জ্বি।
শুভ্ৰ নামের শেষে সাহেব ব্যবহার করছি আপনার অস্বস্তি লাগছে না?
জ্বি লাগছে।
লাগাই উচিত। আমার ধারণা শুভ্র সাহেব বলে এর আগে কেউ আপনাকে ডাকে নি। আমি কি ঠিক বলেছি?
জ্বি।
মীরা আপনার সঙ্গে পড়ে?
জ্বি।
আপনাকে কি সে খুব পছন্দ করে?
আমি জানি না।
আপনারীতে জানা উচিত। কেন জানেন না? একটা মেয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে দেয়া যায়। সে আপনাকে পছন্দ করছে বা করছে না। সে আপনার সঙ্গ কামনা করছে না-কি করছে না।
আপনি পারেন?
অবশ্যই পারি। এই কাজটা দুষ্টলোকরা শুধু যে ভাল পারে তা-না, খুব ভাল পারে। কেন পারে জানেন?
জ্বি না।
কারণ দুষ্টলোকদের মেয়েদের চোখের ভাষা পড়তে শেখাটা খুব জরুরি। তাকে মেয়েদের চোখের ভাষা পড়ে ভবিষ্যৎ কর্ম পদ্ধতি ঠিক করতে হয়।
ও আচ্ছা।
মীরা যখন আপনাকে আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল তখন দেখলাম মমতা এবং ভালবাসায় তার চোখ টনটন করছে। কাজেই আমার ধারণা সে আপনাকে খুবই পছন্দ করে।
শুভ্র সহজ গলায় বলল, আপনি কি পুরুষদের চোখের ভাষা পড়তে পারেন?
আখলাক সাহেব পানির গ্লাসে চুমুক দিয়ে বললেন, না। পুরুষদের চোখে কোনো ভাষা থাকে না। কাজেই পুরুষের চোখের ভাষা পড়া অসম্ভব। শুভ্র সাহেব?
জ্বি।
ধূমপান করেন?
জ্বি না।
ভাল করে মনে করে দেখুন। কোনো বিয়ের দাওয়াতে গেছেন, খাওয়া দাওয়া শেষ হয়েছে। বন্ধু-বান্ধবের পাল্লায় পড়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে খুব কাশছেন। এমন কখনো হয় নি?
জ্বি না, হয় নি।
মদ্যপান করেছেন?
জ্বি-না।
আখলাক সাহেব সহজ গলায় বললেন, আমার প্রশ্ন শুনে অস্বস্তি বোধ করছেন?
জ্বি-না।
আমার প্রশ্ন করা শেষ হয়েছে। এখন আপনি যদি আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে চান, জিজ্ঞেস করতে পারেন। আপনার অবগতির জন্যে বলছি অস্বস্তিকর প্রশ্নের জবাব দিতেই আমি সবচে স্বস্তি বোধ করি।
আমি কিছু জিজ্ঞেস করতে চাচ্ছি না।
আপনার বাসা কোথায়?
ইংলিশ রোডে।
ইংলিশ রোডের কোথায়? ঐ অঞ্চলটা আমার খুব ভাল করে চেনা। চিত্রমহল সিনেমা হলের কোন দিকে?
পশ্চিম দিকে।
গোলাপপাল রোডের আগে?
গোলাপপাল রোডে। দশের এক গোলাপপাল রোড।
আখলাক সাহেব একটু ঝুঁকে এসে আগ্রহের সঙ্গে বললেন, আপনাদের কাছেই বড় একটা পতিতালয় আছে না?
শুভ্ৰ চুপ করে রইল। আখলাক সাহেব আরেকটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন- আপনি এত লজ্জা পাচ্ছেন কেন? আপনার বাড়ির পাশে পতিতালয়, সেই দোষতো আপনার না। আপনিতো আর পতিতালয় দেন নি। কিংবা ইচ্ছা করে পতিতালয়ের পাশে বাড়ি ভাড়া নেন নি।
মীরা ক্যাসেট প্লেয়ার নিয়ে এসেছে। শুভ্ৰ উঠে দাঁড়াল। মীরা বলল, এখন ইচ্ছা করলেও যেতে পারবি না। গান শুরু হচ্ছে। টেবিলে খাবার লাগানো হয়েছে। খেতে খেতে গান শোন। না-কি খুব বেশি বোর ফিল করছিস?
আমার গান শুনতে ইচ্ছা করছে না।
তোর একার না। এখানে কারোরই গান শুনতে ইচ্ছা করছে না। কিন্তু দেখবি গান শুরু হলেই সবাই এমন ভাব করবে যেন স্বৰ্গ সুখ অনুভব করছে।
মীরা বলল, আখলাক সাহেবের সঙ্গে কী নিয়ে গল্প হচ্ছিল?
শুভ্ৰ এই প্রশ্নের জবাব দিল না। আখলাক সাহেব বললেন, বাংলাদেশের সবচে বড় পতিতালয়টি শুভ্ৰদের বাড়ির ঠিক পেছনে। এক সময় ঐ অঞ্চলে আমার সামান্য যাতায়াত ছিল। এই নিয়েই আমরা কথা বলছিলাম। তোমার বন্ধু অবশ্যি আমার কথায় একটু মনঃক্ষুন্ন হয়েছে।
শুভ্ৰ উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, আমি এখন বাসায় যাব।
মীরা বলল, গান শুনবি না?
না।
বাইরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। তুই কি সঙ্গে গাড়ি এনেছিস? না-কি তোকে গাড়ি দিয়ে পৌঁছে দিতে হবে?
শুভ্রর বুকে ধ্বক করে ধাক্কা লাগল। গাড়ির কথাতে মনে পড়েছে সে গাড়ি আনে নি। রিকশা করে এসেছে। সেই রিকশা ভাড়া দেয়া হয় নি। রিকশাওয়ালা হয়ত এখনো অপেক্ষা করছে।
আখলাক সাহেব বললেন, শুভ্ৰ, ইজ এনিথিং রং? হঠাৎ করে আপনার মুখের ভাব বদলে গেল। এই জন্যে জিজ্ঞেস করছি।
শুভ্র বলল, আমি রিকশা ভাড়া দেই নি। টাকা ছিল না, ভেবেছিলাম মীরার কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে দেব। ভুলে গেছি। এখন খুবই লজ্জা লাগছে।
এটা এমন কোনো ভয়ংকর অপরাধ না যে মুখ শুকিয়ে ফেলতে হবে। রিকশাওয়ালা যদি অপেক্ষা করে থাকে তাহলে সে তার ওয়েটিং চার্জ পাবে। আর যদি ভাড়া না নিয়ে চলে গিয়ে থাকে, তাহলে সে বোকা। বোকারা নিজেরাই নিজেদের প্রতারিত করে। কাজেই আপসেট হবার কিছু নেই।
আখলাক সাহেব পা নাচাতে নাচাতে বললেন, শুভ্ৰ, আপনার সঙ্গে একহাজার টাকা বাজি— আপনি বারান্দায় গিয়ে দেখবেন, রিকশাওয়ালা আপনার জন্যে অপেক্ষা করে নেই। চলে গেছে। রাখবেন বাজি?
শুভ্ৰ কথার জবাব না দিয়ে বাইরের বারান্দায় চলে এল। বারান্দা থেকে গেট দেখা যাচ্ছে। গেটের পাশে কোনো রিকশাওয়ালা নেই।
বসার ঘরে গান শুরু হয়ে গেছে। বিরক্ত মুখের গায়ক এখন হাস্যমুখী হয়ে কীর্তন গাইছেন। ভদ্রলোকের গলা অবিকল মেয়েদের মত। শ্যাম ছাড়া আমি বাঁচিব কেমনে। এই আকুলতা তাঁর গলায় খুব মানিয়ে গেছে। তাঁর গলা একটু পুরুষালী হলে গানটা এত ভাল লাগত না।
আখলাক সাহেব বারান্দায় চলে এসেছেন। তার হাতে এখনো সেই পানির প্লাস। তিনি তীক্ষ্ণ চোখে শুভ্ৰকে দেখছেন।
শুভ্র বলল, কিছু বলবেন?
না, কিছু বলব না। রিকশাওয়ালা চলে গেছে?
জ্বি।
বাজি ধরলে হেরে যেতেন। বাজি না ধরে ভাল করেছেন।
আপনি কি সব কিছু নিয়েই বাজি ধরেন?
হ্যাঁ, ধরি। শুনুন শুভ্ৰ, আপনাকে আরেকটা কথা জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করছে। রাগ করবেন কি-না এটা ভেবে জিজ্ঞেস করতে সংকোচ হচ্ছে।
রাগ করব না। জিজ্ঞেস করুন।
ঢাকা শহরের সবচে বড় পতিতালয়ের সঙ্গেই আপনাদের বাড়ি। আপনার কি কখনো সেখানে যেতে ইচ্ছা করে নি?
না, আমার কখনো যেতে ইচ্ছা করে নি।
আখলাক সাহেব শান্ত গলায় বললেন, আপনার কথার ধরন থেকেই বুঝতে পারছি আপনি সত্যি কথা বলছেন। আপনি সত্যবাদী মানুষ এটা আমার পছন্দ হয়েছে। আমার এক প্রাইভেট টিচার ছিলেন— যামিনি বাবু। উনি বলতেন— সত্যবাদী মানুষ কখনো খারাপ হতে পারে না। ছোটবেলায় স্যারের কথাটাকে ধ্রুব সত্য বলে মনে হত। এখন জানি কথাটা পুরোপুরি মিথ্যা। আমি খুবই সত্যবাদী। একটাও মিথ্যা বলি না। কিন্তু আমার চেয়ে খারাপ মানুষ এই শহরে খুব নেই।
শুভ্র বলল, আমি আজ যাই। অন্য আরেক দিন আপনার সঙ্গে কথা হবে।
বৃষ্টি থেমে গেছে। শুভ্ৰ পথে নেমে গেল।
শুভ্ৰদের বাড়ির সামনের রাস্তাটা দুভাগ হয়ে গেছে। একটা কিছুদূর গিয়েই নাম নিয়েছে ইংলিশ রোড। অন্যটা গিয়েছে সরাসরি পতিতালয়ের দিকে। এই রাস্তাটা ভাঙ্গা। খানাখন্দে ভরা। মিউনিসিপালটি এইসব অঞ্চলের রাস্তাঘাট নিয়ে মাথা ঘামায় না। লাইটপোষ্টের কোনোটিতে বাতি নেই। বাতি না থাকার জন্যে কোনো অসুবিধা অবশ্যি হয় না। রাস্তার দুপাশে পান সিগারেটের দোকানে বাতি জ্বলে। দোকানগুলি সারারাতই খেলো থাকে।
আকাশে মেঘ জমছে। দু এক ফোটা বৃষ্টিও পড়ছে। শুভ্রর হাতে এক ফোটা পড়ল। সে মাথা উঁচু করে আকাশ দেখল। আকাশের কোন জায়গাটা থেকে বৃষ্টি পড়ছে এটাই বোধহয় দেখার ইচ্ছা। শুভ্ৰ তাদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
নিশিপল্লীতে লোকজন যাওয়া শুরু করেছে। এদের দিকে তাকানোর ইচচ্ছা! শুভ্রর কখনো মনে হয় নি। আজ সে দেখছে। এর কারণ কী আখলাক সাহেব? এরা যেভাবে যাচ্ছে আখলাক সাহেব কি সে ভাবেই যেতেন? বেশির ভাগ মানুষের চোখে মুখে কোনো আনন্দ নেই। যা আছে তার নাম ভীতি। গরমের মধ্যেও অনেকের গায়ে চান্দর। চাঁদর মাথার ওপর তুলে দেয়ায় মুখ ঢাকা পড়েছে। কেউ কেউ রাতেই সানগ্লাস পরেছে। মানুষ হাঁটার সময় দুপাশে তাকায়। না ডাকলে কখনো পেছনের দিকে তাকায় না। এরা এই রাস্তায় যখন হাঁটে— কিছুক্ষণ পর পর এমন ভঙ্গিতে পেছনের দিকে তাকায় যেন কেউ পেছন থেকে তাদের ডাকছে।
ছোট বাবু!
শুভ্ৰ চমকে উঠল। বাড়ির নাইটগার্ড রহমত মিয়া ঠিক তার কানের কাছে এসে ছোটবাবু বলেছ।
এইখানে দাঁড়াইয়া আছেন কেন?
দেখি।
কী দেখেন?
লোকজন যে যাচ্ছে সবাইকে দেখছি একটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে কী যেন কিনছে। কী কিনছে?
পান।
সবাই এক দোকান থেকে পান কিনছে কেন?
এইটা হইল হাফিজের দোকান! হাফিজের দোকানের পান খুবই বিখ্যাত।
শুভ্ৰ বলল, রহমত মিয়া তুমি একটা কাজ করত। হাফিজের দোকানের একটা পান। কিনে আন। হাফিজের দোকানোর পান খেতে ইচ্ছা করছে।
রহমত মিয়া বলল, আপনে ঘরে যান, আমি পান দিয়া আসব।
রহমত মিয়া তীব্ৰ চোখে শুভ্রর দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখ জ্বলজ্বল করছে। পশুদের চোখের জ্বলজ্বলে ভাব একসময় নাইটগার্ডদের চোখেও চলে আসে। পশুদের সঙ্গে কোথাও বোধহয় তাদের মিল আছে।