৩
মিসির আলি ভেবেছিলেন পরদিনই আবার আসবে। সন্ধ্যাবেলা তাঁর একটা বিয়ের দাওয়াত ছিল। সেখানে গেলেন না। কিছু খাবার আনিয়ে রাখলেন। অভুক্ত একটি মানুষকে শুধু এক কাপ চা যেন দিতে না হয়।
সে এল না। তার পরদিনও না। দেখতে-দেখতে এক সপ্তাহ পার হয়ে গেল। মিসির আলির বিস্ময়ের সীমা রইল না। ছেলেটির তাঁর কাছে না আসার কোনো কারণ নেই। সে জরুরি কিছু বলতে চায়। তাঁর এক জন ভালো শ্রোতা দরকার। ভালো শ্রোতার দায়িত্ব তিনি পালন করেছেন, এবং প্রমাণও করেছেন যে তিনি অত্যন্ত মনোযোগী শ্রোতা। তাহলে সমস্যাটা কোথায়?
তিনি ছেলেটির গল্প নিয়েও বেশ চিন্তা-ভাবনা করেছেন। ছেলেটি বেশ চমৎকার ভঙ্গিতে স্মৃতিচারণা করেছে। কিন্তু এক জনকে বাদ দিয়ে। সে তার মা সম্পর্কে কিছুই বলে নি। ভদ্রমহিলা জামগাছটা কাটিয়ে ফেলেছেন, এইটুকুই শুধু বলা হয়েছে। এর বেশি নয়।
মা সম্পর্কে তার অস্বাভাবিক নীরবতার কারণ কী হতে পারে? একমাত্র কারণ, মাকে সে পছন্দ করেছে। না। স্মৃতিকথা বলবার সময় যাকে আমরা পছন্দ করি না, তার সম্পর্কে কটু কথা বলি। এই ছেলে তাও করছে না। কারণ মাকে সে এককালে পছন্দ করত, এখন করছে না। কেন করছে না, সেই সম্পর্কেও মিসির আলি অনেক ভাবলেন। মোটামুটিভাবে একটা ঘটনা সাজালেন। ঘটনা এ-রকম দাঁড়াল–
উকিল সাহেবের মৃত্যুর পর খুব সম্ভব এই পরিবারটি গভীর সমুদ্রে পড়ল। দেখা গেল উকিল সাহেব তাঁর জীবনে আয়ের চেয়ে ব্যয়ই বেশি করেছেন। শহরে তাঁর প্রচুর দেনা। তাঁর আত্মীয়স্বজন, যারা তিনি জীবিত থাকা অবস্থায় বিশেষ পাত্তা পায় নি তারা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। সম্পত্তির বিলি-ব্যবস্থা নিয়ে তাদেরকে বিশেষ চিন্তাযুক্ত মনে হতে লাগল।
উকিল সাহেবের স্ত্রী ছিলেন অত্যন্ত রূপবতী। এটা ধরে নেওয়া যেতে পারে, কারণ ছেলেটি সুন্দর। মেয়েটি নিশ্চয়ই সুন্দরী, কারণ তার বাবা খুব আগ্রহ করে মেয়ের নাম রেখেছে ফুলেশ্বরী। যাই হোক, অত্যন্ত রূপবতী এক জন মহিলার জন্যে অনেকেরই আগ্রহ দেখা গেল। তেমনই এক জনকে ভদ্রমহিলা বিয়ে করে ফেললেন।
ছেলেটি এ কারণেই মায়ের সম্পর্কে নীরব। জিজ্ঞেস না করলে সে হয়তো তার মার দ্বিতীয় বিবাহ সম্পর্কে কিছুই বলবে না।
মিসির আলি ছেলেটিকে নিয়েও ভাবলেন। একটা নিঃসঙ্গ ভাবুক ধরনের ছেলে, যার উপর অনেক ঝড়ঝাপ্টা গিয়েছে এবং এখনো যাচ্ছে। ছেলেটি বুদ্ধিমান। বিচার বিশ্লেষণ করতে পারে। তবে তিনি তাঁর মূল সমস্যা সম্পর্কে কোনো ধারণা করতে পারলেন না। পারিবারিক জটিলতা নিশ্চয়ই তার সমস্যা নয়। সমস্যার ধরন এবং প্রকৃতি নিশ্চয়ই ভিন্ন। সেটা কী হতে পারে? মিসির আলি কোনো কিনারা করতে পারলেন না। একমাত্র পথ হচ্ছে ছেলেটির সঙ্গে কথা বলা। সেই সুযোগ হচ্ছে না। মুনির আসছে না।
মিসির আলি আশেপাশে খানিকটা খোঁজখবরও করলেন। মেসজাতীয় বাড়ি আছে কি না। ছেলেটি নিশ্চয়ই বাড়ি ভাড়া করে থাকে না। মেসেটেসেই থাকে। একটা মেস পাওয়া গেল–স্টার মেস। সেখানে মুনির নামের কেউ থাকে না। দুটো সস্তার হোটেলেও তিনি খোঁজ করলেন। মুনির নামের কোনো ছেলের সন্ধান কেউ দিতে পারল না।
ইস্টার্ন মার্কেন্টাইলের ঠিকানা জোগাড় করে টেলিফোনে মুনিরের খবর জানতে চেষ্টা করলেন। তারা বলল, মুনির নামের কেউ এখানে কাজ করে না। মুনির কি মিথ্যা ঠিকানা দিল?
প্রতিটি কথাই কি তার মিথ্যা? পুরোপুরি সত্যি বলা যেমন কঠিন, আবার পুরোপুরি মিথ্যা বলাও কঠিন। এই কঠিন কর্ম মুনির, মনে হচ্ছে, বেশ সহজভাবেই করছে।
মিসির আলি বিরক্তি-মেশান কৌতূহল নিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করতে শুরু করলেন। মুনির আর এল না। বেশ ক’টা মাস কেটে গেল।