মিলির বয়স তেইশ।
রূপসী মেয়েদের যা যা থাকতে হয়, সবই মিলির আছে। গায়ের রঙ ফর্সা। গড়পড়তা মেয়েদের তুলনায় অনেকখানি লম্বা। কাটা কাটা চোখ মুখ। বা চোখের নিচে চোখে পড়ার মত কালো তিল। তবু মিলির ধারণা তার চেহারাটা খুবই সাধারণ। সাধারণ এবং বাজে। তা না হলে বিয়ে নিয়ে কোনো মেয়ের এত ঝামেলা হয়? কথাবার্তা অনেক দূর এগুবার পর পাত্রপক্ষ হঠাৎ সময় চায়। খালার অসুখ, ছেলের এক ভাই বিদেশে থাকেন— তিনি বিয়েতে আসার ছুটি পাচ্ছেন না ইত্যাদি। বিয়ে ঠিকঠাক হবার পর সময় চাওয়ার একটাই মানে। বিয়ে হবে না।
যার সঙ্গে শেষ পর্যন্ত বিয়ে হল তার নাম মতিয়ুর রহমান। মোটাসোটা বেঁটে-খাটো মানুষ। নাকের নিচে হিটলারী গোফ। সিভিল সাপ্লাইয়ে কাজ করে। মিলির জন্যে খুব যে আকর্ষণীয় পাত্র তা নয়। তবু এই বিয়ে নিয়েও কত ঝামেলা। কথাবার্তা পাকা হয়ে যাবার পর দিনই ছেলের বড় ফুপা টেলিফোন করে জানালেন, ছেলে ঠিক করেছে তার ছোট বোনের বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত সে বিয়ে করবে না।
সে সময়টা মিলির খুব খারাপ কেটেছে। এমনিতেই সে রোগ। এই সব ঝামেলায় আরো রোগ হয়ে গেল। গালের হাড় বের হয়ে এল। তার চেয়েও বড় কথা মাথার চুল পড়ে যেতে শুরু করল। চিরুনী দিয়ে একটা টান দিলেই একগাদা চুল উঠে আসে। মাথা ভর্তি চুল মিলির। কিন্তু এভাবে উঠতে থাকলে মাথা ফাঁকা হয়ে যেতে বেশি দিন লাগার কথা নয়। তার দুশ্চিন্তায় রাতে ঘুম হত না। এ অবস্থায় এক সপ্তাহের মধ্যে হুঁট করে মিলির বিয়ে হয়ে গেল, মতিয়ুর রহমানের সঙ্গেই। এবং তখনো তার ছোট বোনের বিয়ে হয়নি। মিলির ধারণা শ্বশুর বাড়ির কেউ তাকে পছন্দ করেনি, নেহায়েত ছেলের জন্যে কোথাও কিছু পায়নি। তাই আবার তার কাছে এসেছে। কথাটা ংশিক সত্য। শ্বশুরবাড়ির অন্য কেউ তাকে পছন্দ করেনি। কিন্তু মতিয়ুর রহমান করেছিল। এবং বিয়েটা হয়েছে তার আগ্রহেই। এরকম আজগুবী কথা মিলি বিশ্বাস করে না। সে নিজেকে সুন্দর দেখানোর যত রকম প্রক্রিয়া আছে সব চালিয়ে যায়। তার ধারণা কোনোটিই তার বেলায় কোনো কাজ করে না। কাজ করলে তার বরের চোখেই পড়ত। কিন্তু পড়ে না।
সে গত পরশু সামনের দিকের এক গাদা চুল কেটে ফেলেছে। এত বড় একটা ব্যাপারও মতিয়ুরের চোখে পড়েনি। মিলি যখন বলেছে, কোন চেঞ্জ দেখতে পােচ্ছ? সে নির্লিপ্ত গলায় বলেছে।–কী চেঞ্জ?
কিছুই চোখে পড়ছে না?
না তো। কোনো কিছু চোখে পড়ার ব্যাপার আছে না কী?
মিলি বহু কষ্টে নিজেকে সামলেছে। তার ধারণা তার বরের তার প্রতি কোনো উৎসাহ নেই। এটা একটা ভয়াবহ ব্যাপার। বিয়ের দুবছরের মধ্যে কোন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এরকম হয় না। কী? ব্যাপারটা নিয়ে কারো সঙ্গে আলাপ করতে ইচ্ছা করে কিন্তু তার তেমন কোনো ভাল বন্ধু নেই।
বিকেলে মিলি তার শাড়ির ট্রাংক খুলল। কোনোটাই তার পছন্দ হল না। আচ্ছা সে কেন বেছে বেছে সব জংলি কালারগুলি পছন্দ করে? কেনার সময় মনে হয় কী অপূর্ব রঙ, কী অদ্ভুত ডিজাইন। কিন্তু কেনার পর আর তাকাতে ইচেছ করে না।
কোথাও যাচ্ছে নাকি?
হ্যাঁ।
কোথায়?
ভাইয়ের কাছে যাব। মতিয়ুর হালকা সুরে বলল,–আমি একটা লিফট দিতে পারি। এক ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে। মিলি গম্ভীর গলায় বলল, আমার লিফট-টিফট লাগবে না। বলেই মনে হল–এটা সে বলল কেন? তাদের তো কোন ঝগড়া হয়নি। মিলি গলার স্বর বদলে বলল, দেখ তো কোন শাড়িটা পরব।
একটা পরলেই হয়। ভাইয়ের কাছে যেতে আবার এত সাজগোজ লাগে নাকি?
তাই বলে ফকিরনীর মতো যাব?
পর এই সবুজটা পর।
এমন কড়া রোদে ডার্ক কালার পরব?
বিকেলে রোদ থাকবে না।
না থাকুক। ডার্ক কালার আমাকে মানায় না। বিহারি মেয়েদের মত লাগে।
মতিয়ুর কিছু বলল না। তার মানে সে স্বীকার করে নিল যে ডার্ক কালার তাকে মানায় না। যেটা তাকে মানায় না সেটা পরতে বলার অর্থ কী? মিলির গলা ভার ভার হয়ে গেল। সে ঠিক করল কোথাও যাবে না। ঘরেই থাকবে। মিলির কোনো সিদ্ধান্তই দীর্ঘস্থায়ী হয় না। এটাও হল না। সে সবুজ রঙের শাড়িটা পারল এবং কিছুক্ষণের মধ্যে বদলে হলুদ ফুটি দেয়া একটা সাদা শাড়ি পরল।
ওসমান সাহেব ঘরে ছিলেন না। কোথায় গিয়েছেন কখন ফিরবেন আকবরের মা বলতে পারল না। মিলি বিরক্ত স্বরে বলল, কাল টেলিফোন করে বলে রেখেছি আমি আসব। আকবরের মা ভীত স্বরে বলল–আফা চা দিমু?
আমি চা খাই নাকি? কখন ফিরবে কিছু বলে গেছে?
জি না।
কিছুই বলেনি?
বলছে টেলিফোন বাজলে আমরা কেউ যেন না ধরি।
কেন?
আমি কই ক্যামনে?
মিলি আধঘণ্টার মত বসল। এই সময়ের মধ্যেই শোবার ঘর এবং বসার ঘর পরিষ্কার করল। আকবরের মাকে দিয়ে বাথরুম পরিষ্কার করাল। শোবার ঘরের বুক শেলফের সমস্ত বই নামিয়ে আবার নতুন করে রাখল।
লেখার টেবিল কাল যেমন গোছানো ছিল আজও তেমনই আছে। তার মানে ভাইয়া লিখতে বসেনি। সাদা কাগজে অবশ্যি কিছু কাটাকুটি আছে। মিলি পড়তে চেষ্টা করল হলুদ পাখি সবুজ বন। এইটিই আট দশ বার লেখা। কোনো নতুন গল্প বা উপন্যাসের নাম। মিলি তার ভাইয়ের কোনো লেখা ছাপা হয়ে যাবার পর আর পড়ে না। গল্পের বই তার ভাল লাগে না। কয়েক পাতা পড়বার পরই তার মাথা ধরে। শুধু চৈত্রের রাতে বইটা ছয়ত্ৰিশ পাতা পর্যন্ত পড়েছে। কারণ সেখানে একটা চরিত্র আছে নাম মিলি। সবাই বলে এটা নাকি তাকে নিয়েই লেখা; কিন্তু মিলির তা মনে হয় না। কারণ বইয়ের মিলি খুব সুন্দর। একটু বোকা। সেই মিলি অল্পতেই রাগ করে।
আকবরের মা, আমি যাচ্ছি।
বইতেন না?
খালি বাড়িতে বসে থেকে করব কী?
যাইবেন কই?
সেটা দিয়ে তুমি কী করবে? যত বাড়তি কথা। তুমি কথা কম বলবে। এত বেশি কথা বল কেন? গাড়ির ড্রাইভারও জিজ্ঞেস করল–কোথায় যাবেন? রেগে যেতে গিয়েও মিলি রাগ সামলাল। কারণ এটা নিজেদের গাড়ি নয়। মতিয়ুরের মামাতো বোনের গাড়ি। মাঝে মাঝে নিয়ে আসা হয়। আজ রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত মিলি গাড়িটা নিজের কাছে রাখতে পারবে। কিন্তু তার যাবার কোনো জায়গা নেই।
বেগম সাহেব কোন দিকে যাবেন?
নিউমার্কেটে চল।
আজ সোমবার নিউমার্কেট বন্ধ।
তোমাকে যেতে বলছি তুমি যাও। সোমবার নিউমার্কেট বন্ধ এটা তুমি জানো, আমি জানি না? মিলি গেটের সামনে গাড়ি রেখে বন্ধ নিউমার্কেটে ঢুকল। কিন্তু মাস্তান ধরনের ছেলে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এদের দিকে তাকালেই বুকের মধ্যে ধুক করে শব্দ হয়। মিলি তবু তাকাল, সব কটি ছেলে তাকিয়ে আছে তার দিকে। এর মধ্যে একটি প্রায় ছফুটের মত লম্বা। নিউমার্কেট বন্ধ হলেও দু’টি ওষুধের দোকান খোলা। সে গট গট করে ঢুকাল ওষুধের দোকানে চারটি প্যারাসিটামল ও দু’টি ঘুমের ট্যাবলেট ফোনোবারবিটন কিনল। দু’টি কিনল। যাতে দোকানীর মনে কোন সন্দেহ না হয়। দু’টি করে কিনে কিনে সে একটা ক্রিমের কৌটা। ভর্তি করে ফেলেছে। কৌটাটির দিকে তাকালে তার ভয় লাগে। আবার ভালও লাগে।
বেগম সাহেব এখন কোনদিকে যাবেন?
নিউ পল্টন লাইন। গোরস্থানের পাশ দিয়ে যাও। ইরাকি গোরস্থান চেন? ঐ দিকে।
মিলির সমস্ত সিদ্ধান্তের মত এই সিদ্ধান্তও আকস্মিক! এখন সে যাচ্ছে রানুদের বাসায়। সে নিশ্চিত জানে রানুকে বাসায় পাওয়া যাবে না। আজ একটা খারাপ দিন। কাউকে আজ পাওয়া যাবে না। টেলিফোন করলে সেটা হবে রং নাম্বার। টিভির সামনে বসলে কারেন্ট চলে যাবে।
রানু ঘরেই ছিল। মিলিকে দেখে তার যতটা অবাক হবার কথা ততটা হল না। যেন মিলির এখানে আসাটা খুব স্বাভাবিক। সে রোজই আসে। কিন্তু তা তো নয়। মিলি বলল, ভাবী আমি আরো একদিন এসেছিলাম। তুমি ছিলে না।
জানি তোমার নোট পেয়েছিলাম।
আজ কিন্তু ভাবী বেশিক্ষণ থাকিব না। পাঁচ মিনিট বসব।
এত তাড়া কিসের?
ওর এক মামাতো বোনের গাড়ি নিয়ে এসেছি, সাড়ে আটটার মধ্যে ফেরত দিতে হবে। সাড়ে আটটা বাজতে দেরি আছে। তুমি আরাম করে বস। নতুন হেয়ার স্টাইল দেখছি। কেমন লাগছে ভাবী?
রানু হাসি মুখে বললঃ–একটু ছেলে ছেলে লাগছে। মিলির মুখ কালো হয়ে গেল। তাকে ছেলে ছেলে লাগছে। এটা সে নিজেও লক্ষ্য করেছে। রানু বলল–মেয়েদের চেহারা একটু ছেলে ছেলে দেখালে খারাপ লাগে না। ছেলেদের যেমন মেয়ে মেয়ে চেহারাতে ভালই লাগে অনেকটা এ রকম। মিলির মুখের অন্ধকার কাটল না। সে করুণ মুখ করে বসে রইল। রানু বলল, শোবার ঘরে চল। আমার সংসার দেখ।
তার শোবার ঘরটি চমৎকার করে সাজানো! দু’টি খাট পাশাপাশি। একটিতে টগর ঘুমিয়ে আছে। ওর গায়ে পাতলা একটা চাদর।
ও এত তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েছে কেন ভাবী?
টগরের শরীরটা ভাল না জ্বর।
মিলি উদ্বিগ্ন ভঙ্গিতে টগরের কপালে হাত রাখল, বেশ জ্বর তো ভাবী! হাত পুড়ে যাচ্ছে।
খুব বেশি না। একশ এক।
একশ এক, কম দেখলে? ভাইয়াকে খবর দিয়েছ?
না, ওকে খবর দেইনি। সামান্য ব্যাপার নিয়ে আমি হৈচৈ করি না। ঠাণ্ডা লেগেছে, গা গরম হয়েছে। সেরে যাবে। তুমি কিছু খাবে মিলি?
না।
এক কাপ চা খাবে?
আমি চা খাই না ভাবী। চা খেলে রাতে আমার ঘুম হয় না।
রানু সহজ স্বরে বলল–চায়ের সঙ্গে ঘুমের কোনো সম্পর্ক নেই। আমার সাথে এক কাপ খাও কিছু হবে না। এসো রান্নাঘরে, মোড়া পেতে দিচ্ছি। রানু চায়ের কেতলি বসাল। মিলি তার পাশেই চুপচাপ বসে রইল। রানু বলল, গল্পটল্প কর। চুপচাপ বসে আছ কেন?
কী গল্প করব?
তোমরা যে গাড়ি কিনবে শুনেছিলাম তার কী হল?
জানি না কিছু। ও রিকভিশন্ড গাড়ি কিনতে চায় না। নতুন গাড়ি কেনার মত টাকাও বোধ হয় নেই।
বোধ হয় বলছি কেন? তুমি জানো না?
না। টাকা পয়সার ব্যাপারে। আমি ওর সঙ্গে কথা বলি না। ও নিজেও বলে না।
নাও, দেখ চায়ে চিনি হয়েছি কী না।
চায়ে চুমুক দিতে দিতে মিলি রানুকে দেখতে লাগল। স্বাস্থ্য খারাপ হয়েছে কিন্তু তাতে যেন তাকে আরো সুন্দর লাগছে। কলেজে ফাস্ট ইয়ারে পড়া একটি বাচ্চা মেয়ের মত লাগছে। রানু বলল–তুমি কী কিছু বলতে চাও নাকি?
না, কী বলব?
মুখের ভাব দেখে মনে হচ্ছে কী একটা বলতে গিয়েও বলছি না?
মিলি ইতস্তত করে বলল ভাইয়ার মত এমন একজন ভাল মানুষকে তোমার পছন্দ হল না। কেন? এটা আমার খুব জানার ইচ্ছা। নাকি সে ভাল মানুষ না? রানু সহজভাবেই বলল, তোমার ভাই দূর থেকে খুব ভাল মানুষ। শুধু ভাল মানুষ না, খুবই ভাল মানুষ। কিন্তু কাছ থেকে না। তোমরা কেউ ওকে কাছ থেকে দেখিনি।
আমার ভাই আর আমি কাছ থেকে দেখিনি?
রানু হালকা গলায় বলল,–পাশাপাশি থাকলেই কাছ থেকে দেখা হয় না মিলি।
দু’জনই বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। এক সময় রানু বলল–আটটা বেজে গেছে, তোমার না। সাড়ে আটটায় গাড়ি ফেরত দিতে হবে?
মিলি উঠে দাঁড়াল। শোবার ঘরে গিয়ে টগরের মাথায় হাত রাখল। ঘাম দিচ্ছে। জ্বর কমে যাচ্ছে বোধ হয়। রানু তাকে সিঁড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দেখতে এল। মিলির মনে হল আবহাওয়াটা কেমন অন্য রকম হয়ে গেছে। কেউ সহজ হতে পারছে না। মিলি পরিস্থিতি স্বাভাবিক করবার জন্য জিজ্ঞেস করল–শাড়িটাতে আমাকে কেমন লাগছে ভাবী?
খুব একটা ভাল লাগছে না। সাদার ব্যাক গ্রাউন্ড হলুদ ফোঁটা গুটি বসন্তের মত দেখাচ্ছে। রাগ করলে না তো?
না রাগ করব কেন? তোমার কাছে যা সত্যি মনে হয়েছে তাই বলেছ। মিলি সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করল। রানু বলল–খুব সাবধানে নামবে, সিঁড়িটা ভাল না। মিলি কোনো জবাব দিল না। তার চোখ ঝাপসা। অল্পতেই তার চোখে পানি আসে।
মিলিরা থাকে কলাবাগান, লেক সার্কাসে। নিজেদের বাড়ি নয়। ভাড়া বাড়ি। বাড়িটি কেনার কথা হচ্ছে। কথাবার্তা কোন পর্যায়ে আছে মিলি জানে না। মতিয়ুর এ সব ব্যাপারে তার সঙ্গে কখনো কোনো কথা বলে না। মিলির শ্বশুর একবার তাকে জিজ্ঞেস করলেন–বাড়ি কেনার কী হয়েছে। তখনি শুধু মিলি জানল বাড়ি কেনার একটা কথাবার্তা চলছে। একদিন সত্যি সত্যি কেনা হয়ে যাবে এবং তারও অনেক দিন পর হয়ত মিলি জানবে। কিংবা হয়ত জানবেই না।
মতিয়ুর বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়েছিল। তাঁর সঙ্গে খুব রোগা, চশমা পরা একজন লোক। সে ছেলেটির সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলছে। মিলিকে গাড়ি থেকে নামতে দেখেও সে না দেখার ভান করল। এবং আগের মতই হেসে হেসে কথা বলতে লাগল। কিন্তু লোকটি তাকিয়ে আছে মিলির দিকে। বেশ ভদ্রভাবেই তাকিয়ে আছে। চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে না। মিলির কী উচিত কাছে এগিয়ে যাওয়া? না। মতিয়ুর পছন্দ করবে না, সে তার কোনো বন্ধুর সঙ্গে মিলিকে আলাপ করিয়ে দেয় না।
ওদের বাড়িতে বাইরের পুরুষদের সঙ্গে মেয়েদের কথা বলার রেওয়াজ নেই। মতিয়ুরের একটি বোন ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। ফিজিক্সে অনার্স। সেও বোরকা পড়ে ক্লাসে যায়।
মিলি তার নিজের ঘরে ঢুকে গেল। ভাইয়াকে টেলিফোন করল কয়েকবার। রিং হচ্ছে, কিন্তু ধরছে না। তার মানে ভাইয়া ফেরেনি। এবং আকবরের মা টেলিফোন ধরছে না। মিলির রেখ চেপে গেল। কতক্ষণ সে না ধরে থাকবে? রিং হতে থাকুক। পাঁচবার ছবার, সাতবার, আটবার ন’বার।
হ্যালো।
কে ভাইয়া?
টেলিফোন ধরছিলে না কেন?
এইমাত্র আসলাম।
ওদের টেলিফোন ধরতে নিষেধ করে গেছ কেন?
কী বলতে চাস সেটা বল। আমি গোসল করব।
ভাইয়া শোন, আমি ভাবীর বাসায় গিয়েছিলাম।
ভাল।
সুন্দর বাসা।
সুন্দর হলে তা ভালই।
টগরের জ্বর। খুব জ্বর।
ওসমান সাহেব কিছু বললেন না। মিলি বলল–হ্যাঁলো, ভাইয়া আমার কথা শুনছ?
শুনছি।
কিছু তো বলছ না।
কী বলব?
মিলি খানিকক্ষণ ইতস্তত করে বলল–তোমাকে একটা ছেলের কথা বলেছিলাম না, কালো মতো, ভাবীর সঙ্গে এক রিকশায় যাচ্ছিল?
হ্যাঁ বলেছিলি।
ঐ ছেলেটা ভাবীর বসার ঘরে বসেছিল।
তিনি একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন–ঐ ছেলেটার নাম আলম। ও এসেছিল আমার এখানে একটা বই নিতে। আমার সঙ্গেই ছিল এতক্ষণ। তুই ওকে দেখিসনি। শুধু শুধু কেন এত মিথ্যা বলিস?
মিলি কোনো কথা বলল না। ওসমান সাহেব শান্ত স্বরে বললেন রেখে দেই কেমন?
আচ্ছা।
আর কিছু বলবি?
না।
ওসমান সাহেব টেলিফোন নামিয়ে রাখলেন।