০৩. মানুষের শরীর বলিয়া যে-বস্তুটি আছে

মানুষের শরীর বলিয়া যে-বস্তুটি আছে, তাহার আবদার না রাখিলেই নয়। অতএব, অরুণাকেও একদিন চোখের জল মুছিয়া উঠিয়া বসিতে হইল। শুধু তাই নয়, মাসে হিসাবের অতিরিক্ত তেল খরচ হইয়াছে বলিয়া ,/;……1)2)3)।পনার অনুমতি চাই।”

প্রদীপ জানিত যে অরুণার চোখে জল আসিবে; তাই শোকাকে অযথা আর প্রশ্রয় না দিয়া কহিল,—“কলকাতায় গিয়ে ত’ চাকরির জন্য ফের পথে-পথে টো-টো করূতে হবে, দু’মুঠো জুটোতে হবে ত’! অনেক দিন থেকে গেলাম, চমৎকার থেকে গেলাম,—একেবারে নিখুঁত।”

প্রদীপের দীর্ঘনিশ্বাস পড়িল।

আঁচলে চোখের জল মুছিয়া অরুণা বলিলেন, “আমাদের ভুলে যেয়ো না, প্রদীপ।”

প্রদীপ তক্তপোষের একপ্রান্তে বসিয়া পড়িয়া কহিল,—“আপনারা আমাকে ভুলে গেছেন কি-না তা দেখবার জন্যে আমাকেও মাঝে-মাঝে এখানে আসতে হবে। আশা করি, সুধী দরজা বন্ধ করে দিয়ে যায় নি।”

অরুণার দুই চক্ষু পরিপূর্ণ করিয়া আবার অশ্রু আসিল, এবার আর মুছিলেন না। প্রদীপের পিঠের উপর বাঁ-হাতথানি রাখিয়া অনুরোধ করিয়া কহিলেন,–“আরো দু’টো দিন থেকে যেতে পার না? তুমি চলে গেলে এ-ফাঁকা কি করে সইব?”

প্রদীপ কহিল,—“আমার আর থাকা চলবে না, মা। এই অপ্রত্যাশিত মৃত্যু দেখে, এই অসহায় কাকুতি শুনে আমি ভারি দুর্বল হয়ে পড়েছি, মনে আমার অবসাদ এসেছে। এই বৈরাগ্য আমার জীবনের পক্ষে উপকারী হবে না। এর থেকে আমি ছাড়া পেতে চাই।” বলিয়া প্রদীপ অরুণার লাবণ্যমণ্ডিত মুখের পানে চাহিল।

“এখন কোথায় যাবে, কলকাতায়? কলকাতায় তোমার কে আছে? য্যাদ্দিন থেকে গেলে অথচ তোমার কোনো খোজই নেওয়া হ’ল না।”

প্রদীপ কহিল,—“খোঁজ নেওয়ায় বিপদ আছে, মা। খোঁজ যদি পেলে, তবেই ত’ বেঁধে রাখবার জন্যে হাত বাড়াবে; এই অবাধ্য বুনো ছেলেটাকে কেউ বাঁধতে পারেনি। বাঁধতে যাবে, অথচ হারাবে, সেই দুঃখ আর সেধে নিতে চেয়ো না, মা। আমি আবার আস্বাে।”

এই ছেলেটির প্রতি অরুণার মাতৃস্নেহ উথলিয়া উঠিল, সুধী যেন প্রদীপকে প্রতিনিধি রাখিয়া গিয়াছে। অরুণা কহিলেন,-“এমন কথা কেন বলছে প্রদীপ, স্নেহের বাঁধন কি এত সহজেই হেঁড়া যায়? তুমি কি ভাবছে তোমাকে আমরা ভুলে যাবো?”

প্রদীপ কি বলিতে যাইতেছিল, এমন সময় উমা আসিয়া হাজির। উমা সুধী-র ছোট বোন, ম্লান ললিতত মেয়েটি, মৃদু-মৃগস্বভাব;—এই ষোলয় পা দিয়াছে। উমাকে দেখিয়াই অরুণা কহিলেন,—“তোর প্রদীপদা চলে যাচ্ছেন।”

উমা কহিল,-“আজই?”

প্রদীপ উত্তর দিল,—“আজই, উমা। কত কাজ কলকাতায়। আমাকে য়্যাদিন না দেখে ট্রাম বাস নিশ্চয়ই স্ট্রাই করে বসে আছে, রাস্তায় আলো জ্বলছে না।”

উমা হাসিয়া কহিল,—“রাস্তায় আলো জ্বলাবার চাকরিটা আপনার জন্যে পড়ে আছে! যাচ্ছিলেন ত’ কাশ্মীর, য়্যাদ্দিনে কি তার মেয়াদ ফুরিয়ে যেত?”

“কাশ্মীর-ই বল বা কাশী-ই বল, কলকাতার ডাক দু সপ্তাহের বেশি উপেক্ষা করা যায় না। সুধী-র সঙ্গে সেই চুক্তি করেই বেরুচ্ছিলাম, কিন্তু মৃত্যুর পরে যদি কোনো আদালত থাকে মা, সুধী-র বিরুদ্ধে সেই চুক্তিভঙ্গের মামলা আমাকে আনতেই হবে। এ-কালে সৌন্দৰ্য্য যদি কোথাও থাকে উমা, তা হলে কলেই আছে।”

বুদ্ধিদীপ্ত চক্ষু মেলিয়া উমা কহিল,—“কলহেও।”

প্রদীপ বলিয়া চলিল,—“তাই ত’ কলকাতা এমন করে আমার মন ভুলিয়েছে। আকাশের রোদন শুনে বেদ রচিত হয়েছিল পুরাকালে, এ-কালে আমরা যন্ত্রের যন্ত্রণা শুনে আবার মহাকাব্যের জন্যে প্রস্তুত হচ্ছি। মাঠের চেয়ে শহর সুন্দর, মঠের চেয়ে ফ্যাক্টরি-প্রান্তরের চেয়ে প্রাচীর। প্রকৃতিকে কলকাতা যে বিকৃত করে তুলেছে, আমার তা’তে ভারি ভালো লাগে।”

উমা বিস্মিত হইয়া কহিল,—“বলেন কি? প্রকৃতিকে আপনার ভালো লাগে না?”

 

 

প্রদীপের স্বর কিঞ্চিৎ দীপ্ত হইয়া উঠিল : “একটুও না। তুমি কলকাতায় গিয়ে মধ্যরাত্রে একবার ডালহৌসি স্কোয়ারের পারে  দাঁড়িয়ো। সব ট্রাফিক্ বন্ধ, ঘন কালো রাত্রি নেমে এসেছে, চারপাশে প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড দালান,—স্থির, নিরুত্তর, অভ্রভেদী—ওপরে তারকা-দীপ্ত বিস্তীর্ণ আকাশ। ভাব দেখি, কী কৃত্রিম, এবং কী করুণ!”

সমস্ত ছবিটি যেন উমার চোখের উপর ভাসিয়া উঠিল। সুধী-র কাছে উমা অনেক কিছু পড়াশুনা করিয়াছে; তাই ইহার পর বলিতে পারিল : “এই প্রকৃতির পূজা করেই কত কবি চিরকালের জন্য নাম করেছেন। ধরুন ওয়ার্ডসোয়ার্থ।”

প্রদীপ একটুখানি হাসিল, কহিল,—“যদিও তার wordsএর কোনো worth নেই। ভাগ্যিস জন্মেছিলেন কাম্বারূল্যাণ্ড-এ, ছবির মত সবুজ গাঁয়ে—তাই প্রকৃতিকে নিয়ে এমন কেলেঙ্কারিটা তিনি কবুলেন। জন্মাতেন এসে সাহারায়, কিম্বা গ্রীষ্মকালের মধ্যভারতে, লু-তে লুণ্ঠিত হ’তেন, তবে বুঝতেন মজা। ঝড়ে যার নৌকোডুবি হয় উমা, সে বর্ষা নিয়ে আর কবিতা লেখে না।”

উমা বলিল,-“আপনি এবার কলকাতায় গিয়ে বেথুন-বোর্ভিঙে আমার জন্যে একটা সিট রাখবার চেষ্টা করবেন, বুঝলেন?”

অরুণা হাসিয়া কহিলেন,—“এই হয়েছে। ওর মাথা এবার বিগড়ালো।”

উমা চটিয়া কহিল,—“মাথা বিগড়ালে কি? দাদার সঙ্গে-সঙ্গে আমার পড়াশুনোও চুলোয় যাক্, না? কলকাতায় ত’ এবার লোক্যাল গার্ডিয়ান্ পেলাম, গিয়ে গিয়ে দেখা করবেন ত’?”

প্রদীপ কহিল,—“সময় হয়ত করে নিতে পারূববা, কিন্তু কলকাতা গিয়ে তোমারই সময়টা বৃথা অপচয় হবে। তার চেয়ে আর একটা। বছর এখেনে এই শালবনের তীরে বসেই বইগুলোর সঙ্গে শুভদৃষ্টি করূতে থাক—ম্যাটিটা তুমি তাতেই উৎরে যাবে। তারপর না-হয়। কলেজে গিয়ে কলি ফিরিয়ো।”

উমা কহিল,—“আমার বেলায় বুঝি শালবনের টনিক প্রেস্ক্রাইবড, হ’ল! লক্ষটা শাল গজা, কিন্তু এখানে একা বসে থাকলে লক্ষ বছরেও আমার ম্যাট্রিক পাশ হবে না।”

প্রদীপ হাসিয়া বলিল,—“তাতে বরং ভালোই হবে—মাঝখান থেকে তোমার লক্ষ বছর বাঁচা হয়ে যাবে।”

অরুণা চিন্তিত হইয়া বলিলেন,—“একবার যখন গোঁ ধরেছে, সহজে ছাড়বে ভেবেছ?”

“আমি এক্ষুনি বাবার মত নিয়ে আসছি।” বলিয়া উমা ছুটিয়া বাহির হইতেই প্রদীপ তাহাকে ডাকিয়া বাধা দিল; কহিল,—“কলকাতায় মেয়ে-ইস্কুলের বোর্ডিংগুলোর কথা ত’ আর জান না, তাই অমন খেপে উঠেছ। ওখানে মেয়েদের খেতে দেয় না, তা জান? বিকেল পাঁচটার সময় ভাত খাইয়ে সমস্ত রাত উপোস করিয়ে রাখে, ঝি-দের সুবিধে করূতে গিয়ে ঝিয়ারিদের শুকিয়ে মারে। ও জুজু-মাসির বাড়ি যেতে। নেই, উমা। খালি দেয়াল আর কাঠ,-একঘেয়ে কাঠিন্য, জুলুম। হাওয়া নেই, এই শালতরুমৰ্ম্মর সেখানে নিস্তব্ধ হয়ে গেছে, আকাশের অর্থ সেখানে মহাশূন্য!”

উমা প্রতিবাদ করিয়া উঠিল : “এই ত এতক্ষণ কলকাতার কালি আর কলের গুণকীৰ্ত্তন হচ্ছিল। সেখানে আকাশ নেই বলে ত’ আপশোষ করবার আপনার কারণ ঘটেনি। আপনার মতো আমিও না-হয় হাওয়ার বদলে ধোঁয়া খাবো।”

প্রদীপ কহিল, “ধোঁয়া আমার সয়, কিন্তু বিকেল পাঁচটার সময় পেট পুরে ভাত আর কপির ডাটা খেতে হলে সারারাত তোমার চোয়া ঢেকুর উঠবে। ছেলেদের যা সয়, মেয়েদেররা কি তাই সইবে ভেবেছো?”

উমা এইবার রীতিমত চটিয়া উঠিল : “না, সয় না! ছেলেরা সব হনুমান কি-না। সব থার্ড ডিভিশানে পাশ করে।”

“আর মেয়েরা করে ফেল।” “ইস, নিয়ে আসুন ত’ ক্যালেণ্ডার।”

“ক্যালেণ্ডারে বুঝি ফেল-এর সংখ্যা থাকে? তুমি ছেলেদের হনুমান বলে বটে, কিন্তু রামায়ণে হনুমানের মতো বীর আর কি আছে! সেতু বেঁধে দিলে কে?”

“তা’ আর জানি না? নিজের ল্যাজে আগুন ধরিয়ে সমস্ত লঙ্কা পুড়িয়ে দিলে কে? হনুমানের কথা আর বলবেন না। ও একটা প্রথম নম্বরের ইডিয়ট। বিশল্যকরণী আনতে গিয়ে গোটা গন্ধমাদন পর্বতটাই নিয়ে এল।”

“ইডিয়ট, কিন্তু কি প্রকাণ্ড বীর ভেবে দেখ। কোনো বানরনন্দিনীকে পাঠালে তিনি সমস্ত জীবন ধরে ঐ বিশল্যকরণী-ই খুঁজে বেড়াতেন, লক্ষ্মণ আর বাতো না।”

উমা আরো উদ্দীপ্ত হইয়া কহিল,-“নাই-বা বাঁচত! ঐ দ্বিতীয় ইডিয়ট লক্ষ্মণ—রাম ফল এনে ওর হাতে দিয়ে বলতেন—ধর, আর ও এমন গৰ্দত যে সে ফল ধরে’ই থাকূত, খেত না। এম্‌নি করে চোদ্দ বছর লোকটা না খেয়ে বেঁচে রইল। যদি রাম বলতেন—মুখে তোল, ও মুখে তুলত বটে, কিন্তু নিশ্চয় চিবোত না; যদি বলতেন—চিবোও, ও কখনো গির্ত না দেখো।”

প্রদীপ আর অরুণা দু’জনেই হাসিয়া উঠিলেন। উমা বলিয়া চলিল,—“আর ইডিয়ট-শ্রেষ্ঠ রাম সামান্য ধোপা-নাপিত বন্ধ হবে ভেবে সোনার সীতাকে বনে পাঠালেন–সেই সীতা, যে তার জন্যে সারাজীবন সন্ন্যাসিনী হয়ে ছিল। আর যেমনি ধোপারা কাপড় কাচতে ও নাপিতরা দাড়ি চাঁছতে রাজি হ’লঅমনি আবার উনি সীতার জন্যে মাতামাতি সুরু করে দিলেন। ধন্যি মেয়ে সীতা—ঐ মাতালটাকে ছেড়ে পাতালে গিয়ে মুখ ঢাকূলে।”

প্রদীপ আমোদ অনুভব করিয়া কহিল,—“তোমার এই সার্টিফিকেট নিয়ে বেচারা বাল্মীকি বাজারে আর তার রামায়ণ কাটাতে পাবেন না।”

“ছেলেদের কথা আর বলবেন না, সব টুকে পাশ করে।”

“টোকবার মতো ট্যাক্ট মেয়েদের নেই বলে’। একটা কথাতেই তফাৎ ধরা যাচ্ছে, উমা। তুমি ছেলে হলে এই একা-একা পরীক্ষাসমুদ্র উত্তীর্ণ হ’বার ভয়ে এত ভড়কাতে না।”

“কাজ নেই আমার হনুমান হ’য়ে।” বলিয়া উমা হঠাৎ গম্ভীর হইয়া গেল; কণ্ঠস্বর আর্ন হইয়া উঠিয়াছে। কহিল,—“দাদা নেই, সমস্ত বাড়ি খাঁ খাঁ করূছে, বৌদি কঁদতে গিয়ে বোবা হয়ে গেছে, মা দিবারাত্রি চোখের জল ফেলেন, বাবা পাগলের মতো পাইচারি করে’ বেড়ান,—আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। কলকাতায় আমাদের কেউ আত্মীয় থাকলে আপনার সঙ্গেই চলে যেতাম এবার। আমি যাবোই পড়তে।”

উমা ঘর ছাড়িয়া চলিয়া যাইতেছিল, অরুণা ডাকিলেন। উমা ফিরিল। অরুণা কহিলেন,—“বৌমা কোথায়?”

“স্নান করতে গেছে।”

“তোর প্রদীপ-দা আজ চলে যাচ্ছেন, ঠাকুরকে বল কিছু ভালো করে বেঁধে দিতে। বৌমার ঘরে উনুন ধরিয়েছিস?”

“এই যাই।” বলিয়া উমা দ্রুতপদে অদৃশ্য হইয়া গেল।

ক্ষণকালের জন্য আবহাওয়াটা স্বচ্ছ হইয়া আসিয়াছিল, সহসা আবার গাঢ় মেঘ করিয়া আসিল। সেই মেঘান্ধকার নমিতার দুই নিঃসহায় চক্ষু হইতেই ঝরিয়া পড়িতেছে। এই দৃশ্যে নমিতার আবির্ভাব হইল না বটে, কিন্তু প্রদীপের মনোমুকুরে যাহার ছায়া পড়িল সে হয়ত ঠিক নমিতা নয়, একটি কল্পনাভরণা দুঃখৈশ্বৰ্য্যময়ীর ছবি। কবির কল্পনা উন্নত হইতে-হইতে ইন্দ্রিয়াতীত হইয়া যে মহিমাময়ী নারীমূর্তি পরিগ্রহ করে, ঠিক সেই মুর্তি! তাহাকে নমিতা বল, কিছু ক্ষতি হইবে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *