০৩. মানুষটাকে চেনা চেনা লাগছে

মানুষটাকে চেনা চেনা লাগছে। কিন্তু ঠিকমতো চেনা যাচ্ছে না। তার কী নাম, তার সঙ্গে কোথায় দেখা হয়েছে কিছুই মনে পড়ছে না। শামসুদ্দিন অস্বস্তি নিয়ে তাকিয়ে আছেন। তাঁর সামনে দাঁড়ানো মানুষটা রীতিমতো সুটেট বুটেট। সোনালি রঙের ব্লেজার, লাল টাই। মাথায় হালকা নীল রঙের ক্যাপ। সোনালি ফ্রেমের সানগ্লাসে চোখ ঢাকা।

মানুষটা শামসুদ্দিনের পা ছুঁয়ে সালাম করল। বিনীত ভঙ্গিতে হাসল। শামসুদ্দিন খুবই বিব্রত বোধ করছেন। সুটেট-বুটেট ধরনের কারো সঙ্গে তার পরিচয় আছে বলেই মনে পড়ছে না।

চাচাজি, আমাকে চিনেছেন?

না।

সানগ্লাসটা খুললে চিনবেন। সানগ্লাস পরা থাকলে মানুষকে চেনা যায় না। সিনেমার নায়ক-নায়িকারা এই জন্যে সানগ্লাস পরে থাকে। পাবলিক চিনতে পারে না।

লোকটা সানগ্লাস খুলে হাসিমুখে তাকিয়ে বলল, এখন চিনেছেন?

না।

সুটেট বুটেট মানুষটাকে খুবই আনন্দিত মনে হলো। যেন তাকে চিনতে না পারা খুবই আনন্দময় ঘটনা।

মাথার টুপিটা খুললে হয়তো চিনবেন। আমি জয়নাল। একসঙ্গে ভিসা পেয়ে গেলাম।

বলো কী! তুমি জয়নাল!

আপনি যে আমাকে চিনতে পারেন নি এতে আপনাকে কোনো দোষ দেয়া যায় না। আমি নিজেই আজ সকালে নিজেকে চিনতে পারি নি। আয়নার সামনে দাড়িয়ে ক্যাপটা মাথায় দিয়ে হতভম্ব। আয়নায় যাকে দেখা যাচ্ছে লোকটা কে? Who is him? চাচাজি ইংরেজি কি ঠিক আছে? Who is him.

Who is he হবে।

ভুলভাল যাই হোক ইংরেজি বলে যাচ্ছি। ভাষাটা সরগর হয়ে থাক। আমেরিকানরা বুঝতে পারলেই হলো। আমার যুক্তিটা হচ্ছে চাচাজি, তোরা যখন আমাদের দেশে আসিস তখন তো বাংলা বলতে পারিস না–আমরা ভুলভাল যাই বলি তোদের ভাষাতেই বলি। ঠিক না?

হ্যাঁ ঠিক। জয়নাল বসো। তোমাকে দেখে ভালো লাগছে।

জয়নাল বসতে বসতে বলল, আমার ড্রেসটা কেমন হয়েছে চাচাজি?

খুবই ভালো।

জুতা বাদ দিয়ে কমপ্লিট ড্রেসে কত খরচ পড়েছে একটু আন্দাজ করেন তো? দেখি আপনার আন্দাজ।

এইসব বিষয়ে আমার একেবারেই আন্দাজ নাই। পাঁচ-ছয় হাজারের বেশি তো হবেই।

জয়নাল হাসি মুখে বলল, সর্বমোট ছয়শ একুশ টাকা খরচ পড়েছে। এর মধ্যে মার্কেটে যাতায়াতের আপ এন্ড ডাউন খরচ ধরা আছে। দুকাপ চা খেয়েছি, একটা সিঙ্গাড়া খেয়েছি, সেই খরচও আছে। তিন টাকা দিয়ে একটা বেনসন সিগারেটও কিনেছি। সব মিলিয়ে ছয়শ একুশ। আমার কথা বিশ্বাস করা না করা এখন আপনার ব্যাপার।

কোত্থেকে কিনলে?

আপনাকে নিয়ে যাব। আজই নিয়ে যাব। বঙ্গবাজার থেকে কিনেছি। আপনার জন্যেও কাপড়-চোপড় দেখে এসেছি। আমেরিকার মতো দেশে যাচ্ছেন। নেংটি পরে তো যেতে পারবেন না। আপনি তো আর মহাত্মা গান্ধি না যে খালি গায়ে নেংটি পরে প্লেন থেকে নামবেন। Coming down from the plane with goat, without cloth, only নেংটি। চাচাজি নেংটি ইংরেজি কী?

নেংটির ইংরেজি হলো loin cloth।

জয়নাল বিস্মিত হয়ে বলল, আপনি তো ইংরেজিতে মারাত্মক। নেংটির যে ইংরেজি আছে এইটাই আমি জানতাম না।

শামসুদ্দিন আন্তরিক গলায় বললেন, চা খাবে জয়নাল? ছেলেটার আনন্দ ঝলমল মুখ দেখতে তার ভালো লাগছে।

জয়নাল বলল, চা অবশ্যই খাব। চলুন চা খেয়ে বের হয়ে পড়ি।

কোথায়?

কী বললাম একটু আগে? বঙ্গবাজার যাব। We go to bengali bazar।

আজই কিনতে হবে?

অবশ্যই। দুটা ওভারকোট দেখে এসেছি। গায়ে দিয়ে বরফের চাং-এর উপর শুয়ে থাকলেও কিছু হবে না। উল্টা ওভারকোটের গরমে আপনি ঘামবেন। গরমের চোটে সর্দি গর্মি হয়ে যেতে পারে। চাচাজি, আপনার কাছে সুই-সুতা আছে? হলুদ সুতা লাগবে।

কেন বলো তো?

ব্লেজারের একটা বোতাম খুলে গেছে। বোতাম লাগাতে হবে। ব্লেজার, টপি, টাই সৰু আপনার এখানে রেখে যাব। কোনো অসুবিধা আছে?

না, অসুবিধা নাই। আমার এখানে রাখবে কেন?

আর বলবেন না–আমি যেখানে থাকি গতরাতে সেখানে চুরি হয়েছে। আমার স্যুটকেস নিয়ে চলে গেছে। আল্লাহপাকের অসীম রহমত পাসপোর্টটা সুটকেসে ছিল না। একবার ভেবেছিলাম স্যুটকেসে রাখি। যদি রাখতাম উপায়টা কী হতো বলেন দেখি? আমেরিকান ভিসা লাগানো পাসপোর্ট বাজারে পাঁচ লাখ টাকায় বিকিকিনি হয়।

কী বলল তুমি?

যা বলছি একশ ভাগ খাঁটি কথা বলছি। Hundred percent truth speaking। জাপানি ভিসা লাগানো পাসপোর্ট বিকিকিনি হয় ছয় লাখে। ওদেরটা এখন একটু বেশি দাম যাচ্ছে।

ভিসা লাগানো পাসপোর্ট দিয়ে কী করা হয়?

পাসপোর্টের ছবি পাল্টে অন্য ছবি বসিয়ে দেয়া হয়। এমনভাবে কাজটা করা হয় যে কার বাপের সাধ্যি কিছু বুঝে। মনে করুন, আপনি আপনার পাসপোর্টটা বিক্রি করে দিলেন খোদেজা বেগমের কাছে। পাসপোর্টে আপনার ছবি পাল্টে লাগানো হবে খোদেজা বেগমের ছবি। এই পাসপোর্ট দেখিয়ে খোদেজা বেগম চলে যাবে আমেরিকায়। সে সেখানে এক সময় না এক সময় সিটিজেন হয়ে যাবে। তারপর সে তার আত্মীয়স্বজন একে একে আমেরিকায় টানতে শুরু করবে।

এরকম হয় নাকি?

অবশ্যই হয়। হয় এবং হবে। আমি সবই জানি। গত নয় বছর তো এইটা নিয়েই আছি, জানব না কেন বলুন! চাচাজি, চা আর সুই-সুতা তাড়াতাড়ি নিয়ে আসুন। বঙ্গবাজার চলে যাই। বঙ্গবাজার থেকে যাব ট্রাভেল এজেন্সিতে। আমার দূরসম্পর্কের এক মামা ট্রাভেল এজেন্সিতে কাজ করেন। সবচে কম দামে টিকিটের ব্যবস্থা করে দেবেন। বুকিং দিয়ে রাখি। বুকিং দিতে টাকা পয়সা লাগবে না।

 

ওভারকোট পাওয়া গেল না। বিক্রি হয়ে গেছে। জয়নালের মেজাজ খুবই খারাপ। দুটা গোলাপি রঙের মাফলার অবশ্যি কেনা হলো। তাতেও জয়নালের খুঁতখুঁতানি।

বুঝলেন চাচাজি, গোলাপি রঙের মাফলার কেনা ঠিক হয় নি। আমেরিকায় গোলাপি হলো মেয়েদের রঙ।

শামসুদ্দিন খুবই বিস্মিত হয়ে বললেন, মেয়েদের রঙ বলে আলাদা কিছু আছে নাকি?

আমেরিকায় আছে। আমেরিকায় গোলাপি হলো মেয়েদের রঙ, নীল হলো ছেলেদের রঙ। বড়ই আজিব দেশ।

তাই তো দেখছি।

এখন আর কী দেখছেন–কেনেডি এয়ারপোর্টে পা দেবার পর মাথা ঘুরে। ধরাস করে পড়ে যাবেন। প্রতি সেকেন্ডে সেখানে একটা করে বিমান আকাশে উড়ছে, একটা নামছে। কম্পিউটার সব কনট্রোল করছে বলে রক্ষা। নিউ ইয়র্কের রাস্তাঘাটের এমন অবস্থা যে আমেরিকানদেরও মাথা আউলা হয়ে যায়। অন্য স্টেটের লোকজন পারতপক্ষে নিউ ইয়র্ক আসতে চায় না।

আমরা তো প্রথমে নিউ ইয়র্কেই যাচ্ছি।

অবশ্যই। আপনি মোটেই দুশ্চিন্তা করবেন না। আমি আছি। স্ট্যাচু অব লিবার্টি যা যা আছে আমিই সব দেখাব। স্ট্যাচু অব লিবার্টি দ্বীপের ভেতর। ফেরিতে করে যেতে হয়।

এত কিছু জানো কীভাবে? তুমিও তো জীবনে প্রথম যাচ্ছ।

প্রথম গেলেও চাচাজি আমার সব মুখস্ত। চলুন এখন যাই ট্রাভেল এজেন্সিতে।

আজই যাবে?

অবশ্যই আজ যাব। আগে ভাগে বুকিং দিয়ে না রাখলে পরে সমস্যায় পড়ে খাব। দেখা যাবে সব আছে, প্লেনের টিকিট নাই। চাচাজি, উজবেক এয়ারলাইন্স আপনার কাছে কেমন লাগে?

উজবেক এয়ারলাইন্সের ব্যাপারটা কী?

খুবই সস্তায় টিকিট দেয়। অবশ্যি তাদের সার্ভিস খুব খারাপ। মস্কোতে নিয়ে ফেলে রাখে। কোনো খোঁজ খবর করে না। তাতে আমাদের অসুবিধা কী? ফাঁকতালে মস্কো দেখা হয়ে গেল। সুযোগ-সুবিধা পেলে ঘন্টাটা দেখে এলাম।

ঘণ্টা দেখে এলে মানে কী? কী ঘণ্টা?

মস্কোর ঘণ্টা। পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের এক আশ্চর্য।

মস্কোর ঘন্টা দেখতে দেবে?

অবশ্যই দেবে। পাসপোর্ট হোটেলে জমা রেখে বারঘন্টার একটা পারমিট বের করে দুজন চলে গেলাম। ভাষার সমস্যা হবে। ওরা ইংরেজির ইও জানে না। ইশারায় কাজ সারতে হবে। যদি সত্যি সত্যি আমরা মাস্কো হয়ে যাই তাহলে হয় কাজ চালাবার মতো কয়েকটা রাশিয়ান শব্দ শিখে গেলাম।

যেমন ধরুন, তুমি কেমন আছ? রাশিয়ান ভাষায় হবে–কাক দেলা। মস্কোর ঘন্টা দেখব- রাশিয়ান ভাষায় হবে খাচু স্মাতরিত মস্কোভুসকি কোলাল।

শামসুদ্দিন রীতিমতো বিস্মিত হয়ে বললেন, তুমি রাশিয়ান ভাষা জানো নাকি?

জয়নাল আনন্দের হাসি হেসে বলল, যদি মস্কো হয়ে যেতে হয় এই ভেবে আগেই দু একটা টুকটাক রাশিয়ান শিখে রেখেছিলাম। গুড মর্নিং-এর রাশিয়ান হলো–দোবরে উতরা।

শামসুদ্দিন বললেন তুমি আমাকে খুবই আশ্চর্য করলে।

জয়নাল বলল, উজবেক এয়ারলাইন্সে যাওয়াই যদি সিদ্ধান্ত হয় তাহলে রাশিয়ান এম্বেসিতে যাব। সেখানে রাশিয়ান জানা বাঙালি পাওয়া যাবে। এম্বেসি স্টাফ। ওদের কাছ থেকে ভালো মতো সুলুক-সন্ধান নিয়ে যাব। চাচাজি শুনুন, আজ দুপুরে আমার সঙ্গে খাবেন। খাওয়া ভালো হবে না। নিজে বেঁধে খাই। ডাল, ভাত, ডিমভাজি। তাতে অসুবিধা নেই–খাওয়াটা বড় কথা না। খেতে খেতে প্ল্যান প্রোগ্রাম করতে হবে। আপনার কি কোনো সিরিয়াস অসুখ-বিসুখ আছে?

কেন বলো তো?

অসুখ-বিসুখ থাকলে আমেরিকায় ফ্রি অব কস্ট চিকিৎসার ব্যবস্থা করব। হেলথ ইনস্যুরেন্স না থাকলে ঐ দেশে চিকিৎসা হয় না তা ঠিক, তবে অন্য সূক্ষ্ম ব্যবস্থা আছে। ফেডারেল গভর্নমেন্টের হাসপাতাল আপনার চিকিৎসা করতে বাধ্য। আপনাকে নিয়ে হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে উপস্থিত হতে হবে। চিকিৎসা না করে যাবি কোথায়?

শামসুদ্দিন বিস্মিত গলায় বললেন, আমেরিকার সব কিছুই দেখি তুমি জানো।

জয়নাল আনন্দের হাসি হেসে বলল, নয় বছর ধরে লেগে আছি। জানব না কেন? আমেরিকায় চোখ বন্ধ করে ছেড়ে দিলেও আমার কোনো সমস্যা হবে না।

 

 

দুপুরে জয়নাল রান্না করল। কেরোসিনের চুলায় রান্না। শামসুদ্দিন চৌকিতে পা তুলে বসে জয়নালের রান্না দেখলেন। জয়নাল বলেছিল ডাল, ভাত, ডিম ভাজা। দেখা গেল রান্নার আয়োজন ব্যাপক। বেগুন ভাজা আছে। গরুর মাংসের কিমার সঙ্গে বুটের ডাল দিয়ে কুচকুচে কালো রঙের অদ্ভুত তরকারি। ডিম ভাজা হলো না, সিদ্ধ ডিম কচলে ভর্তা বানানো হলো–তার রঙও কালো।

জয়নালের থাকার জায়গাটা শামসুদ্দিনের পছন্দ হলো। বাড়ির গ্যারেজের উপর লম্বাটে ঘর। দুটা চৌকি এবং টেবিল পাতার পরেও খানিকটা জায়গা আছে। সবই বেশ গোছানো। ঘরে জানালা আছে। জানালা দিয়ে সজনে গাছের ডাল দেখা যায়। শামসুদ্দিন বললেন, তুমি একা থাক না?

জয়নাল বলল, এখন একা থাকি। আগে আমার সঙ্গে সিদ্দিক থাকত। সে বিয়ে করে জুরাইনে তার শ্বশুরবাড়িতে থাকে। মাঝে মাঝে স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া করে আমার এখানে থাকতে আসে। বিছানা রেডি করা থাকে বলে অসুবিধা হয় না। ওর কাছে এক্সট্রা চাবি আছে।

বাথরুমের ব্যবস্থা কী?

নিচে সার্ভেন্টস টয়লেট আছে। চাচাজি বাথরুমে যাবেন?

না, এমনি জিজ্ঞেস করলাম।

আমেরিকায় আপনি তো বেড়াতেই যাচ্ছেন না-কি অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে?

কোনো উদ্দেশ্য নেই। বেড়াতেই যাচ্ছি।

তাহলে প্রথম কিছুদিন আপনাকে নিয়ে বেড়াব। আটলান্টিক সিটিতে নিয়ে যাব। ক্যাসিনো আছে। স্লট মেশিনে অল্প পয়সায় জুয়া খেলবেন।

জুয়া খেলার দরকার কী?

কোনো দরকার নেই। অভিজ্ঞতার জন্যে খেলা। আটলান্টিক সিটি থেকে আপনাকে নিয়ে যাব লাস ভেগাস। মরুভূমির ভেতর কী জিনিস বানিয়েছে না দেখলে বিশ্বাস করবেন না। লাস ভেগাসে কিছু শো হয়। সেগুলিও দেখার মতো। এখন লাস ভেগাসের সির্জাস প্রেসে ডেভিড কপারফিল্ড যাদু দেখাচ্ছে। সিজার্স প্লেসের সঙ্গে ডেভিড কপারফিল্ডের এক বছরের চুক্তি হয়েছে। এক বছর ডেভিড কপারফিল্ডকে নিয়মিত যাদু দেখাতে হবে। ডেভিড কপারফিল্ডের নাম শুনেছেন তো?

না।

বলেন কী! মারাত্মক মেজিশিয়ান। আস্ত এরোপ্লেন ভ্যানিশ করে দিয়েছিল। আপনাকে ডেভিড কপারফিল্ডের যাদু ইনশাল্লাহ দেখাব। ত্রিশ ডলার করে টিকিট। সেখান থেকে আপনাকে নিয়ে যাব গ্রান্ড কেনিয়ন দেখাতে গ্রান্ড কেনিয়নে গাধা ভাড়া পাওয়া যায়। ইচ্ছা করলে গাধার পিঠে চড়ে গ্রান্ড কেনিয়নে নামতে পারেন। ঘণ্টা হিসেবে গাধা ভাড়া করতে হবে। ঘন্টায় বিশ ডলার।

তুমি এমনভাবে বলছ যেন আগেও কয়েকবার লাস ভেগাস গিয়েছ।

না গেলেও সবই জানি। আপনার যে-সব জায়গায় যাবার ইচ্ছা তার দুএকটার নাম বলুন তো।

নায়াগ্রা জলপ্রপাতটা দেখার ইচ্ছা ছিল।

কোনো ব্যাপারই না। নিউইয়র্ক থেকে এমট্রেক নিয়ে চলে যাব। তিন থেকে সাড়ে তিনঘণ্টা লাগবে। ভাড়াও সস্তা। এক কাজে দুই কাজ হবে আমেরিকান ট্রেনও দেখা যাবে। এমট্রেক হলো বিশ্বের এক নম্বর ট্রেন সার্ভিস। আরাম আয়াশের রাজকীয় ব্যবস্থা। ট্রেনে কাচের একটা ঘর আছে। এই ঘরে হাতে বিয়ারের ক্যান নিয়ে বসবেন। চারপাশের সিন সিনারি দেখতে দেখতে যাবেন।

বিয়ারের ক্যান হাতে বসব?

কোনো অসুবিধা নেই। সেই দেশে বিয়ার পানির মতো খায়। দামও পানির মতো সস্তা। এক বোতল পানি কিনতে এক ডলার লাগে। এক ক্যান বিয়ার কিনতে লাগে পঞ্চাশ সেন্ট। চাচাজি, বিয়ার কখনো খেয়েছেন।

না।

আমিও কখনো খাই নাই। ঠিক আছে দুজনে মিলে একদিন টেস্ট করব। কী বলেন? পরে না হয় তওবা করে ফেলব। কী বলেন?

ঠিক আছে।

ষাট ডলারে গ্রে হাউন্ডের টিকিট কাটলে পুরা আমেরিকা দেখে ফেলতে পারতাম।

গ্রে হাউন্ড ব্যাপারটা কী?

গ্রে হাউন্ড হলো কুকুরের নাম। আমাদের দেশের সরাইলের কুকুরের মতো কুকুর। এই কুকুরের নামে আমেরিকানদের ইন্টারস্টেট বাস সার্ভিস আছে। আমাদের দেশের বাস আর ঐ দেশের বাসের মধ্যে আকাশ-পাতাল ফারাক। বাসে চড়লে মনে হবে প্লেনের ফার্স্টক্লাসে বসে আছেন। চাচাজি আসেন, রান্না শেষ। খেয়ে নেই।

আমেরিকার খাওয়া-দাওয়া বিষয়ে তো তুমি কিছু বললে না?

খাওয়া-দাওয়া নিয়ে আপনি মোটেই চিন্তা করবেন না। ম্যাকডোনাল্ড আছে। ফাস্ট ফুড। দামে সস্তা। অতি সুস্বাদু। পুরো আমেরিকা এর উপর বেঁচে আছে। তারপর ধরেন পিজা। পিজা হাটের পিজা একবার খেলে মুখে আর অন্য কিছু রুচবে না। তারপর আছে ক্যান্টাকি ফ্রায়েড চিকেন, কর্নেল সাহেবের রেসিপি। আমেরিকার প্রধান খাদ্য সম্পর্কে তো কিছু বললামই না।

প্রধান খাদ্য কী?

প্রধান খাদ্য হলো–স্টেক। একটা স্টেক খেলে মনে হবে বেহেশতি খানা খাচ্ছেন।

ভাত তো খেতে হবে। ভাত ছাড়া অন্য যে-কোনো খাবার আমার কাছে নাশতার মতো লাগে।

নিজেকে বদলাতে হবে চাচাজি। যখন যে দেশে যাবেন তখন সেই দেশের খানা খাবেন। তারপরেও যদি খুব অসুবিধা হয়–আমি তো আছিই। চারটা চাল ফুটিয়ে দেব।

চাল পাওয়া যায়?

আরে কী বলেন, চাল পাওয়া যাবে না কেন? মোড়ে মোড়ে ইন্ডিয়ান আর বাংলাদেশী গ্রসারি স। চেপা শুটকি পর্যন্ত পাওয়া যায়।

চেপা শুঁটকি আমার খুবই পছন্দের খাবার।

চাচাজি আমেরিকায় কি আপনি চেপা শুটকি খাবার জন্যে যাচ্ছেন? আপনাকে আমেরিকায় নিয়ে দেখি সিরিয়াস বিপদে পড়ব। আপনার সঙ্গে পরিচয় না হলেই ভালো ছিল।

দুপুরে শামসুদ্দিন খুব আরাম করে খেলেন। সারাদিন হাঁটাহাঁটি করায় পেটে ক্ষুধা ছিল- জয়নালের রান্নাও অসাধারণ। কুচকুচে কালো রঙের ডিমের ভর্তার এত স্বাদ তিনি জানতেন না। ভাল-কিমাও অপূর্ব লাগল। তার মনে হলো তিনি সন্ধ্যা পর্যন্ত কালো রঙের ডাল-কিমা দিয়ে ভাত খেতে পারবেন।

খাওয়ার পর কাঁচা সুপারি দেয়া পান। জয়নাল বলল, আমেরিকায় পান পাওয়া যায় না। পান যা খাবার দেশেই খেয়ে নেন। শুকনা সুপারি দিয়ে খাবেন না। কাঁচা সুপারি–হার্টের জন্যে ভালো।

শামসদ্দিন পান খান না। আজ আগ্রহ নিয়ে পাশ চিবাতে লাগলেন। জয়নাল বলল, লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ুন তো চাচাজি। দুপুরে খাবার পর আধ ঘণ্টার ঘুমকে বলে সিয়াস্তা। স্বাস্থ্যের জন্যে অত্যন্ত ভালো। শরীর ফ্রেস হয়ে যায়। আমি আধ ঘণ্টার জন্যে ঘুরে আসি।

কেথায় যাবে।

গুরুত্বপূর্ণ একটা মিশন। দোয়া রাখবেন যেন সাকসেস পাই। কী মিশন ফিরে এসে আপনাকে বলব। আপনি আরামের ঘুম দেন। মশারি খাঁটিয়ে দেব?

দিনের বেলা মশারি খাটাবে কেন?

বাংলাদেশে চাচাজি দিনের বেলা মশারি খাটানোই জরুরি। রাতে মশা কামড়ালে কিছু যায় আসে না। দিনের মশার কামড় মানে ডেঙ্গু। এখন খোদা

না চায় যদি ডেঙ্গু হয় আমাদের আমেরিকা যাবার টাইমিং-এ গণ্ডগোল হয়ে যাবে। আমাদেরকে প্রতিটি স্টেপ নিতে হবে সাবধানে। বাস্তার পাশের ফুচকা চটপটি খাওয়া পুরোপুরি নিষিদ্ধ। বাসি কোনো খাবার দেখলে দশ হাত দূরে থাকবেন। ছোঁয়াচে রোগ হয়েছে এমন কোনো রোগী দেখতে যাবেন না।

কঠিন সব নিয়ম কানুন।

অবশ্যই কঠিন নিয়ম। হজে যাবার আগে হাজিদের কী করে দেখেন না? হাজি ক্যাম্পে নিয়ে যায়। আলাদা করে রাখে। আমেরিকা যাত্রীদেরও এরকম আলাদা করে রাখা দরকার। সিগারেট খাবেন চাচাজি?

খেতে পারি একটা সিগারেট।

জয়নাল সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, আপনার সামনে সিগারেট টানছি, আমার বেয়াদবি নিজগুণে ক্ষমা করে দেবেন।

দিলাম ক্ষমা করে। জয়নাল, তোমার দেশের বাড়ি কোথায়?

ময়মনসিংহ।

ময়মনসিংহ তো বিরাট এলাকা। ময়মনসিংহের কোথায়?

ময়মনসিংহের চোখের কোনায়। নেত্রকোনায়।

দেশের বাড়িতে কে আছে?

কেউ নাই। আত্মীয়স্বজনের মধ্যে এক বোন আছে। খুলনায়। তার ঠিকানাও জানি না।

বোনের ঠিকানা জানো না কেন?

দশ বছর আগে রাগ করে বোনের বাসা থেকে চলে এসেছিলাম, তারপর আর যোগাযোগ করি নাই। বেনি-জামাই এর রিস্টওয়াচ পাওয়া যাচ্ছিল না। সে মনে করল আমি চুরি করে বাজারে বেঁচে দিয়েছি। কথা নাই বার্তা নাই আমার চুল ধরে থাপ্পর।

বলো কী।

মারধর সে আগেও করেছে তাতে মন খারাপ হয় নি। মনে কষ্ট পেয়েছিলাম বোনের কারণে। আমার বোন আমাকে আড়ালে নিয়ে হাতে একশ টাকা দিয়ে বলেছিল–ঘড়িটা ফিরত দিয়ে দে জয়নাল। তোর দুলাভাই-র শখের ঘড়ি। বুঝলেন চাচাজি, মনটা আমার এতই খারাপ হলো সেই একশ টাকা নিয়ে বোনের বাড়ি থেকে চলে এলাম আর ফেরত যাই নাই।

ভালো করেছ।

খুবই কষ্টের জীবন গিয়েছে। এখন আল্লাহপাকের দয়া হয়েছে। তিনি মুখ তুলে তাকিয়েছেন, হাতে কেঁচি সাপ্লাই করেছেন। আর অসুবিধা নাই।

কেঁচি সাপ্লাই করেছেন–মানে বুঝলাম না।

আল্লাহপাক তার পছন্দের মানুষদের হাতে একটা করে ধারালো কেঁচি সাপ্লাই করেন। তাঁর পছন্দের মানুষরা সেই কেঁচি দিয়ে তার সামনের সমগ্র বাধা বিপত্তি কচকচ করে কাটতে কাটতে এগোতে থাকে। আমার হাতে এতদিন কোনো কেঁচি ছিল না, এখন আছে। আমেরিকান ভিসাটা হলো সেই কেঁচি।

শামসুদ্দিন হেসে ফেললেন। জয়নাল বলল, আপনি ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে টাইট হয়ে ঘুম দেন। আমি কাজ সেরে এসে আপনাকে ডেকে তুলব।

আচ্ছা যাও।

কোথায় যাচ্ছি আপনাকে বলেই যাই। শেষ পর্যন্ত তো আপনাকে বলতেই হবে। আমার আত্মীয়স্বজন কেউ নেই আপনাকে আমার উকিল বাপ হতে হবে।

বিয়ের কোনো ব্যাপার?

ঠিক ধরেছেন। মেয়ের নাম ইতি। খুবই সুন্দরী মেয়ে। ফার্স্ট ইয়ার ইন্টারে পড়ে। আমার এক বন্ধু আছে সালাম নাম। তার খালাতো বোন। সালামের মাধ্যমে পরিচয়।

ইতিকে বিয়ে করবে বলে ঠিক করেছ?

আমার দিক থেকে খুবই ইচ্ছা আছে। ইতির ইচ্ছা আছে কিনা জানি না। চ্যাং ব্যাং টাইপ মেয়ে তো, এদের অসিল ভাব বোঝা যায় না।

চ্যাং ব্যাঙ টাইপ মেয়ে মানে?

এরা সব ছেলের সঙ্গে ভাব করে। যে ছেলের সঙ্গে পরিচয় হয় তার সঙ্গেই এমন ভাব করে যেন গলে যাচ্ছে। কিন্তু বিয়ে করার সময় বাবা মা যাকে নিয়ে আসে তাকে বিয়ে করে। এখন অবশ্যি আমার আশা আছে আমেরিকান ভিসা হয়ে গেছে। গেট পাস পেয়ে গেছি। ওরা রাজি হলে তুমি কি ইতিকে বিয়ে করে যাবে?

হুঁ। চাচাজি আমার ধারণা বিয়ে হয়েও যাৰে। দুর্ভাগ্য যখন আসে একের পর এক আসতে থাকে। সৌভাগ্যের বেলাতেও তাই, সৌভাগ্য আসতে শুরু করলে একের পর এক আসতেই থাকে। নেন, আরেকটা সিগারেট নেন। টান দিয়ে শুয়ে পড়ন।

জয়নাল মশারি খাঁটিয়ে দিল। শামসুদ্দিন দিনের বেলাতে মশারির ভেতর ঢুকে গেলেন। ঘুমের জন্যে দিনটা ভালো। আকাশে মেঘ ছিল, দেখতে দেখতে আঁধার করে বৃষ্টি নামল। টিনের চালে ঝুম ঝুম শব্দ। বাতাসের ঝাপ্টায় জানালা দিয়ে সজনে গাছের ডাল ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। শীত শীত লাগছে। চাদর গায়ে জড়িয়ে শামসুদ্দিন গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলেন। ঘুম ভাঙল বিকাল পাঁচটায়, তখনো জয়নাল ফিরে নি। আধ ঘণ্টার জন্যে গিয়ে এতক্ষণ দেরি করার কোনো কারণ নেই।

শামসুদ্দিন বিছানা থেকে নামলেন। কেরোসিনের চুলা জ্বালিয়ে নিজেই চা বানিয়ে খেলেন। পুরনো ম্যাগাজিন পড়লেন। রাত আটটা বেজে গেল, জয়নাল ফিরল না। তিনি কী করবেন বুঝতে পারছেন না। ঘরে তালা লাগিয়ে চলে যেতে পারেন। তালার সঙ্গে চিঠি লিখে যাবেন—

জয়নাল,

তোমার দেরি দেখে চলে গেলাম।

তোমার ঘরের চাবি আমার কাছে।

ইতি শামসুদ্দিন

কিংবা চাবিটা বাড়িওয়ালার কাছেও রেখে যেতে পারেন।

বৃষ্টি কমে গিয়েছিল। রাত আটটার পর আবার বাড়ল। রীতিমতো ঝড়। ঘর-বাড়ি কাপছে। কোনো একটা ফুটো দিয়ে ঘরে পানি ঢুকছে। মেঝেতে চার আঙুল পানি জমে গেছে। রাত সাড়ে নটার দিকে ইলেকট্রিসিটিও চলে গেল। চারদিকে ঘন অন্ধকার। দেয়াশলাইও জ্বালানো যাচ্ছে না। ম্যাচ বাক্স বৃষ্টির পানিতে ভিজে গেছে।

রাত এগারোটার দিকে জয়নালের ঘরে তালা লাগিয়ে শামসুদ্দিন নিতে বাসার দিকে রওনা হলেন। চিঠি লিখে আসা হলো না। কীভাবে লিখবেন? কলম কাগজ অন্ধকারে কোথায় খুঁজবেন। শামসুদ্দিনের দুশ্চিন্তার কোনো সীমা রইল না। জয়নাল ছেলেটা কোনো বিপদে পড়ে নি তো? কোনো এক্সিডেন্ট? বিপদে তো সে অবশ্যই পড়েছে। বিপদটা কী রকম?

রাত এমন কিছু না। মাত্র এগারোটা। অথচ পুরো শহর ফাকা। রাস্তায় নদীর মতো চলমান পানি। ম্যানহোলে পানি পড়ছে–শোঁ শোঁ শব্দ হচ্ছে। মনে হচ্ছে বান ডাকছে। খালি রিকশা অনেক আছে, কোনোটাই যেতে রাজি না। একজুন পঁচিশ টাকা ভাড়ায় যেতে রাজি হলো। শামসুদ্দিন রাস্তার ময়লা পানিতে মাখামাখি হয়ে যখন রিকশাওয়ালার কাছাকাছি পৌছলেন তখন সে বলল না যাব না। শামসুদ্দিন শীতে কাঁপতে কাঁপতে হেঁটে বাড়ি ফিরলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *