মানবজীবনের বিরুদ্ধে অপরাধ
তৃতীয় অধ্যায়
ধারা-৩৩ কতল (হত্যা)-এর সংজ্ঞা
যে কাজের দ্বারা মানবদেহ হইতে প্রাণের সংযোগ ছিন্ন হইয়া যায় তাহাকে কতল বলে।
বিশ্লেষণ
কতল শব্দের অর্থ হত্যা বা হত্যা করা। এখানে শব্দটি মানবহত্যার অর্থে ব্যবহৃত হইয়াছে। লিসানুল আরাব নামক আরবী ভাষার বিশ্বকোষে বলা হইয়াছে, কোন কিছুর আঘাতে, অস্ত্রের সাহায্যে, পাথর নিক্ষেপে, বিষ প্রয়োগে বা অন্য কোন উপায়ে মানুষের প্রাণনাশকে কতল (হত্যা) বলে। মুজামু লুগাতিল ফুকাহা গ্রন্থে বলা হইয়াছে, দেহ হইতে প্রাণের সম্পর্ককে ছিন্ন করিয়া দেওয়ার কাজকে কতল (হত্যা) বলে। শিরকের অমার্জনীয় অপরাধের পর ইসলামে মানবহত্যাই সর্বাধিক মারাত্মক অপরাধ। একজন মানুষের জীবন বাঁচানো যেমন গোটা মানবজাতির জীবন বাঁচানোর সমতুল্য, তদ্রূপ একজন মানুষের জীবনসংহার গোটা মানবজাতির জীবনসংহারের সমতুল্য।
ধারা-৩৪ কতল-এর শ্রেণীবিভাগ
ধরন ও প্রকৃতি অনুযায়ী কতল নিম্নোক্ত পাঁচ শ্রেণীতে বিভক্ত–
(ক) কতলে আম্দ, (খ) কলে শিব্হে আম্দ, (গ) কতলে খাতা, (ঘ) কতলে জারী মাজরীল খাতা ও (৬) কতল বিত-তাসাব্বুব।
ধারা-৩৫ কতলে আম্দ (ইচ্ছাকৃত হত্যা)
কোন ব্যক্তি স্বেচ্ছায় ও সজ্ঞানে যখন এমন কার্য করে যাহার দ্বারা অন্য ব্যক্তির প্রাণনাশ হয় তখন তাহার সেই কার্যকে ‘কতলে আম্দ’ বলে এবং ইহার জন্য কিসাস বাধ্যতামূলক হয়।
বিশ্লেষণ
ইমাম আবু হানীফা (র)-এর মতে অস্ত্র বা অনুরূপ কিছুর সাহায্যে স্বেচ্ছায় ও সজ্ঞানে হত্যাকাণ্ড ঘটাইলে কেবল উহাকেই কতলে আম্দ (Intentional Murder) বলা যাইবে এবং কিসাস (মৃত্যুদণ্ড) বাধ্যতামূলক হইবে। কিন্তু ইমাম। আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মাদ (র)-এর মতে কতলে আম্দ সাব্যস্ত করার জন্য অস্ত্রের ব্যবহার শর্ত নহে। তাঁহাদের মতে অস্ত্রের সাহায্য ছাড়াও কতলে আম্দ সংঘটিত হইতে পারে। যেমন পানিতে ডুবাইয়া, শ্বাসরুদ্ধ করিয়া, বিষ পান করাইয়া বা উচ্চ স্থান হইতে ফেলিয়া দিয়া হত্যা করা হইলে তাহাও কতলে আম্দ হিসাবে গণ্য হইবে এবং কিসাস বাধ্যতামূলক হইবে।
ধারা-৩৬ কিসাস বাধ্যতামূলক হওয়ার শর্তাবলী
নিম্নোক্ত শর্তাবলী বিদ্যমান থাকিলে কিসাস বাধ্যতামূলক হয়, উহার কোন এর অবর্তমানে ফিস গহিত ইয়া যায়–
(ক) হত্যাকারী বালেগ ও বুদ্ধিজ্ঞানসম্পন্ন হইলে এবং বেলায়, সজ্ঞানে ও সরাসরি হত্যাকাণ্ড ঘটাইয়া।
(খ) নিহত ব্যক্তি হত্যাকারীর অংশ নহে; জুয বা অংশ বলিতে পিতা, মাতা ও তাহাদের ঊর্ধ্বতনগণকে বুঝায় এবং নিহত ব্যক্তি মাসূমুদ-দাম; মামুদ-পাম বলিতে সে যেই মাত্র নিহত হইয়াছে সেই রাষ্ট্রের নাগরিক অথবা নিরাপত্তা লাভকারী।
(গ) নিহতের ওয়ারিসগণকে কিসাসের দাবিদার হইতে হইবে।
বিশ্লেষণ
হত্যাকারী বালেগ ও বুদ্ধিজ্ঞান সম্পন্ন হইলেই তাহার উপর কিসাস কার্যকর করা যাইবে। সে নাবালেগ বা মস্তিষ্ক বিকৃত হইলে তাহার উপর কিসাস কার্যকর করা যাইবে না। দ্বিতীয়ত, সে স্বেচ্ছায় ও সরাসরি হত্যা করিয়াছে এবং যাহাকে হত্যা করা লক্ষ্য ছিল তাহাকেই হত্যা করিয়াছে। মহানবী (সা) বলেন :
“ইচ্ছাকৃত হত্যা অবশ্যই প্রতিশোধ গ্রহণযোগ্য। তবে নিহতের ওলী মাফ করিয়া দিলে ভিন্ন কথা।”
তৃতীয়ত, নিহত ব্যক্তি হত্যাকারীর অংশ অর্থাৎ পুত্র বা কন্যা নহে। কারণ পুত্র বা কন্যার হন্তা পিতা বা মাতা হইলে কিসাস রহিত হইয়া যাইবে কিন্তু তাযীরের আওতায় হত্যাকারী শাস্তিযোগ্য হইবে, তাহা ছাড়া নিহত ব্যক্তির রক্ত নিষ্পাপ হইতে হইবে অর্থাৎ সে যেই রাষ্ট্রে নিহত হইয়াছে তাহাকে সেই রাষ্ট্রের অধিবাসী অথবা নিরাপত্তা লাভকারী হইতে হইবে। অনন্তর নিহত ব্যক্তির ওয়ারিসগণ কিসাসের দাবি না করিলে কিসাস রহিত হইয়া যাইবে।
ধারা-৩৭ কতলে শিব্হে আম্দ
যেইরূপ বস্তু দ্বারা সাধারণত হত্যা সংঘটিত হয় না সেইরূপ কোন বস্তু যারা ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করা হইলে সেই হত্যাকে ‘কতলে শিব্হে আম্দ’ বলে এবং এই ক্ষেত্রে দিয়া বাধ্যতামূলক হয়।
বিশ্লেষণ
ইমাম আবু হানীফা (র)-এর মতে, দেহ কাটে না বা দেহে বিদ্ধ হয় না এইরূপ বস্তু দ্বারা ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা সংঘটিত হইলে তাহাকে কতলে শিব্হে আম্দ বলে। আর ইমাম আবু ইউসুফ ও মুহাম্মাদ (র)-এর মতে, যেসব বস্তু দ্বারা সাধারণত হত্যা করা যায় না এইরূপ বস্তু, যেমন ক্ষুদ্র পাথর, ক্ষুদ্র লাঠি, চাবুক, কলম ইত্যাদি দ্বারা হত্যা সংঘটিত হইলে তাহাকে কতলে শিব্হে আম্দ বলে। এই ক্ষেত্রে কিসাস বাধ্যতামূলক হওয়া সন্দেহপূর্ণ হইয়া যাওয়ার কারণে কঠোর দিয়াত বাধ্যতামূলক হইবে। এই ক্ষেত্রে দিয়া বাধ্যতামূলক হওয়ার ব্যাপারে সাহাবায়ে কিরামের মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। কতলে শিব্হে আম্দ-এর ক্ষেত্রে হত্যাকারীর হত্যা করার ইচ্ছা ছিল কি না এই ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ থাকায় ইহাকে কতলে শিব্হে আম্দ (ইচ্ছাকৃত হত্যার সহিত সাদৃশ্যপূর্ণ বা সংশয়পূর্ণ)-এর অন্তর্ভুক্ত করা হইয়াছে। কারণ হত্যাকারী এমন বস্তু সাহায্যে হত্যা করিয়াছে যাহা দ্বারা সাধারণত হত্যা করার ইচ্ছা থাকে না। এই ক্ষেত্রে কাফফারাও বাধ্যতামূলক হইবে কি না তাহাতে মতভেদ আছে।
ধারা-৩৮ কতলে খাতা
কোন ব্যক্তির অনিষিদ্ধ কাজের পরিণতিতে ভুলে বা অসাবধানতাবশত যে হত্যা সংঘটিত হয় তাহাকে ‘কতলে খাতা’ বলে। এই ক্ষেত্রে দিয়াত ও কাফফারা বাধ্যতামূলক হয়।
বিশ্লেষণ
‘কতলে খাতা’ অর্থ ভূলবশত হত্যা। এই ক্ষেত্রে অনিষিদ্ধ কাজ করাকালে প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বন না করার কারণে ভুলবশত হত্যা সংঘটিত হয় এবং হত্যাকারীকে তাহার অসতর্কতার জন্য দায়ী করা হয়। কারণ কোন অনিষিদ্ধ কাজ অবশ্যই কাহারও ক্ষতি সাধন না করার শর্তে করা যাইতে পারে। কেননা কর্তা সতর্কতা অবলম্বন করিলে এই ক্ষতি হইতে রক্ষা পাওয়া যাইত।
এই ভুল কর্তার ধারণার মধ্যেও হইতে পারে, কাজের মধ্যেও হইতে পারে এবং ধারণা ও কাজ উভয়ের মধ্যেও হইতে পারে। যেমন কোন ব্যক্তিকে শিকারের পশু ধারণা করিয়া শিকারী উহার প্রতি তীর বা আগ্নেয়াস্ত্রের গুলি নিক্ষেপ করিল। এই ক্ষেত্রে অপরাধীর কাজের মধ্যে ভুল হয় নাই, কারণ সে যাহা মারিতে চাহিয়াছে। তাহাই মারিয়াছে, বরং ভুল হইয়াছে তাহার ধারণা বা অনুমানের মধ্যে।
কর্তার কাজের মধ্যেও ভুল হইতে পারে। যেমন এক শিকারী একটি হরিণের প্রতি গুলি নিক্ষেপ করিল, কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হইয়া উহা ঝোপের মধ্যে উপবিষ্ট কোন মানুষের দেহে বিদ্ধ হইল এবং ফলে সে মারা গেল।
তৃতীয়ত, ধারণা-অনুমান ও কাজ উভয়ের মধ্যে ভুল হইতে পারে। যেমন শিকারী কোন মানুষকে শিকারের পশু ধারণা করিয়া তাহার প্রতি গুলি ছুঁড়িল এবং উহা লক্ষ্যভ্রষ্ট হইয়া আরেক ব্যক্তির দেহে বিদ্ধ হইল, ফলে সে মারা গেল। এই ক্ষেত্রে সে মানুষকে শিকারের পশু মনে করিয়া নিজের অনুমানে ভুল করিয়াছে এবং যাহার প্রতি গুলি নিক্ষেপ করিয়াছে উহা তাহার পরিবর্তে অন্য ব্যক্তির গায়ে লাগিয়াছে। মানুষ যুগপৎভাবে মস্তিষ্ক ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ উভয়ের সাহায্যে কর্ম সম্পাদন করে। তাই কখনও তাহার মস্তিষ্কও ভুল করিতে পারে, কখনও তাহার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও ভুল করিতে পারে এবং কখনও উভয়টিই ভুল করিতে পারে।
ধারা-৩৯ কতলে শিব্হে খাতা
ভুল বা অসাবধানতা ব্যতিরেকে কোন ব্যক্তির যে কাজের দ্বারা হত্যা সংঘটিত হয় তাহাকে ‘কতলে শিব্হে খাতা’ বলে এবং এই ক্ষেত্রেও দিয়াত ও কাফফারা বাধ্যতামূলক হয়।
বিশ্লেষণ
কতলে খাতার ক্ষেত্রে অপরাধীর একটি নির্দিষ্ট কর্মের সংকল্পও থাকে এবং সে কর্ম সম্পাদনও করে। কিন্তু এই ক্ষেত্রে অপরাধীর সংকল্প ব্যতীতই অপরাধকর্ম সংঘটিত হয়, তবে তাহার কর্ম ও সংঘটিত অপরাধের মধ্যে কারণ-এর সংযোগ (Relation of cause and effect) বিদ্যমান থাকে। যেমন ঘুমন্ত ব্যক্তি পার্শ্ব বদল করাকালে অপর ব্যক্তির উপর পতিত হইল এবং ফলে সে নিহত হইল। অথবা কোন ব্যক্তি ঘটনাক্রমে কোন উচ্চ স্থান হইতে পতিত হইয়া অন্য ব্যক্তির উপর পড়িল এবং ফলে শেষোক্ত ব্যক্তি নিহত হইল। উদাহরণ দুইটি বিবেচনা করিলে দেখা যায় যে, অপরাধীর কর্ম ও নিহত ব্যক্তির মৃত্যুর মধ্যে ‘কারণ’-এর সরাসরি সম্পর্ক বিদ্যমান।
অনিচ্ছা ও অসতর্কতাবশত হত্যা সংঘটিত হওয়ায় ইহা কতলে পাতার অন্তর্ভুক্ত এবং এইজন্য দিয়াত প্রদান বাধ্যতামূলক। আর অপরাধীর কর্ম ও হত্যার মধ্যে সরাসরি ‘কারণ’-এর সম্পর্ক বিদ্যমান থাকায় কাফফারা আদায় করা অপরিহার্য।
ধারা-৪০ কতল বিত-তাসাব্বুব
কোন ব্যক্তির প্রয়োজনীয় সতর্কতার অভাবজনিত কাজের ফলে অন্য ব্যক্তির প্রাণনাশ হইলে তাহাকে ‘কতল বিত-তাতাব্বুব’ বলে।
বিশ্লেষণ
এই ক্ষেত্রে অপরাধী সরাসরি হত্যা করে না, বরং তাহার সরবরাহকৃত উপকরণই হত্যার কারণ হয়। অপরাধী যে কাজটি করে উহা তাহার জন্য বৈধ, কিন্তু সে কর্ম সম্পাদনে বৈধ সীমা লঙ্ঘন করে। এখানে অপরাধীর কর্মে ও হত্যার মধ্যে সরাসরি সম্পর্ক নাই, তবে কমটি হত্যার কারণ হইয়া দাঁড়ায়। যেমন কোন ব্যক্তি যাতায়াতের রাস্তার পাধে গর্ত খনন করিল এবং উহাতে পতিত হইয়া অপর ব্যক্তি নিহত হইল। অথবা কেহ পথিপার্শ্বে একটি প্রকাণ্ড পাথর রাখিল এবং পথিক উহার সহিত ধাক্কা খাইয়া নিহত হইল।
যদিও একদিক হইতে ইহাকে কতলে খাতার অন্তর্ভুক্ত মনে হয়, কিন্তু অন্য দিক হইতে ইহা কতলে খাতার আওতায় পড়ে না। যেমন অপরাধীর খননকার্যের দ্বারা কাহাকেও হত্যা করার ইচ্ছা ছিল না, বরং প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বন না করার কারণে দুর্ঘটনা ঘটিয়াছে। তাই ইহা কতলে খাতার সহিত সামঞ্জস্যপূর্ণ। অন্যদিকে কতলে খাতার ক্ষেত্রে অপরাধীর কাজের দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে হত্যা সংঘটিত হয়, আর এখানে তাহার সরবরাহকৃত ‘কারণ’ দ্বারা হত্যা সংঘটিত হয়।
সারসংক্ষেপ
কতল (নরহত্যা) পাঁচ প্রকার।
(১) কতলে আম্দ–সরাসরি নরহত্যা, ইহাতে ইচ্ছা ও কর্ম উভয়ই বিদ্যমান।
(২) কতলে শিব্হে আম্দ হইল এমন বস্তু দ্বারা নরহত্যা যাহা সাধারণভাবে হত্যা সংঘটনে ব্যবহৃত হয় না। ইহাতে অপরাধীর ইচ্ছার বিদ্যমানতা সংশয়পূর্ণ।
(৩) কতলে খাতা–ইহা ভুলবশত নরহত্যা। এই ভুল ইচ্ছারও হইতে পারে, কর্মেরও হইতে পারে অথবা উভয়েরও হইতে পারে।
(৪) কতলে শিব্হে খাতা–ইহা অনিচ্ছাকৃত ও ভুলবশত নরহত্যা।
(৫) কতল বিত-তাসাব-ইহা সেই প্রকারের নরহত্যা, যাহা প্রয়োজনীয় সতর্কতার অভাবের ফল।
ধারা-১ কতলে আম্দ-এর শাস্তি মৃত্যুদণ্ড
কতলে আম্দ হইলে উহার শাস্তিস্বরূপ হত্যাকারীর মৃত্যুদণ্ড হইবে।
বিশ্লেষণ মহান আল্লাহ বলেন :
“হে মুমিনগণ! নিহতদের ব্যাপারে তোমাদের জন্য কিসাসের বিধান দেওয়া হইয়াছে। স্বাধীন ব্যক্তির বদলে (সেই) স্বাধীন ব্যক্তি, ক্রীতদাসের বদলে (সেই) ক্রীতদাস এবং নারীর বদলে (সেই) নারী” (সূরা বাকারা : ১৭৮)।
“তাহাদের জন্য উহাতে বিধান দিয়াছিলাম যে, প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ” (সূরা মাইদা : ৪৫)।
মহানবী (সা) বলেন, “যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করিয়াছে তাহার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।”
ইমাম আবু ইউসুফ (র) বলেন, আমাদের পূর্ববর্তী নবীগণের শরীআতের কোন বিধান মহানবী (সা) নিজ জবানে রহিত ঘোষণা না করিয়া থাকিলে তাহা অবশ্যই আমাদের উপর প্রযোজ্য হইবে। অতএব স্বাধীন ব্যক্তিকে বা দাসকে অথবা দাস স্বাধীন ব্যক্তিকে বা দাসকে হত্যা করিলে, নারী পুরুষকে বা পুরুষ নারীকে হত্যা করিলে হত্যাকারীর মৃত্যুদণ্ড হইবে।
ধারা-৪২ কিসের অধিকারী কাহারা
নিহত ব্যক্তির ওয়ারিশগণই কিসাসের অধিকারী, অন্য যে নহে, তাহার কিসাস দাবি করিলে তাহা কার্যকর হইবে।
বিশ্লেষণ
নিহত ব্যক্তির ওয়ারিসগণই কিসাসের দাবিদার। ইহা তাহাদের একটি স্বীকৃত অধিকার।
মহান আল্লাহ বলেন :
“কেহ অন্যায়ভাবে নিহত হইলে তাহার উত্তরাধিকারীকে তো আমি উহার প্রতিকারের অধিকার দিয়াছি। কিন্তু হত্যার ব্যাপারে সে যেন বাড়াবাড়ি না করে, সে তো সাহায্যপ্রাপ্ত হইয়াছে” (বনী ইসরাঈল : ৩৩)।
ধারা-৪৩ কিসের অধিকারীগণ নাবালেগ হইলে
(ক) কিলাপের অধিকারীগণের মধ্যে কেহ মালেগ হইলে তাহাদের মধ্যকার বানেগণ তাহাদের অভিভাবক গণ্য হইবে।
(খ) কিলাসের অধিকারীগণের সকলে নাবালেগ ইলে সরকার কিসের সাবিলায় (অধিকারী) হইবে।
ধারা-৪৪ কিসাস অনিবার্য হওয়ার পর রহিত হওয়া
হত্যাকারীর মৃত্যু হইলে, নিহতের ওয়ারিসগণ হত্যাকারীকে ক্ষমা করিলে অথবা অর্থের বিনিময়ে তাহার সহিত সন্ধি করিলে কিসাস রহিত হইয়া যায়।
বিশ্লেষণ
হত্যাকারী মারা গেলে বা নিহত হইলে স্বাভাবিকভাবেই কিসাস রহিত হইয়া যাইবে। কারণ যেই পাত্রে কিসাস কার্যকর হইবে সেই পাত্রই বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে। এই ক্ষেত্রে দিয়াতও আরোপিত হইবে না। নিহতের ওয়ারিস হস্তাকে ক্ষমা করিলেও কিসাস রহিত হইয়া যায়। যেমন সে বলল, আমি হতাকে ক্ষমা করিয়া দিলাম, আমি কিসাসের দাবি ত্যাগ করিলাম, আমি তাহাকে দায়মুক্ত করিলাম ইত্যাদি। ক্ষমা প্রদানের পর দিয়াত আরোপিত হইবে না। নিহতের ওয়ারিস হত্যাকারীর সহিত মাল প্রদানের শর্তে সন্ধি করিলেও কিসাস রহিত হইয়া যায়, মালের পরিমাণ কম-বেশি যাহাই হউক। মহান আল্লাহ বলেন :
“তাহার ভ্রাতার পক্ষ হইতে কিছু ক্ষমা প্রদর্শন করা হইলে ন্যায়নীতির অনুসরণ করা ও সততার সহিত তাহার দেয় আদায় করা বিধেয়” (বাকারা :১৭৮)।
ধারা-৪৫ ক্ষমাকারী ওয়ারিসের যোগ্যতা
ক্ষমাকারী ওয়ারিসকে অবশ্যই বালেগ ও বুদ্ধিমান হইতে হইবে; নাবালেগ বা পাগলের মা কার্যকর হইবে না।
বিশ্লেষণ
ক্ষমাকারীকে কিসাসের অধিকারী অর্থাৎ নিহতের ওয়ারিস হইতে হইবে। কারণ হত্যার বিচার পাওয়া তাহার অধিকার। সে ইচ্ছা করিলে তাহার এই অধিকার ত্যাগও করিতে পারে এবং নাও করিতে পারে। বিচারক বা অন্য কেহ ক্ষমা করিলে তাহা কার্যকর হইবে না। কারণ কাহারও অধিকারে হস্তক্ষেপ তাহার জন্য বৈধ নহে। অনন্তর আল্লাহ পাক হতাকে ক্ষমার অধিকার কেবল নিহতের ওয়ারিসকেই দান করিয়াছেন (দ্র. ২: ১৭৭ আয়াত)। তাহা ছাড়া ক্ষমাকারীকে বালেগ ও বুদ্ধিমান হইতে হইবে, নাবালেগ ও পাগলের ক্ষমা ধর্তব্য নহে। তাহাদের অভিভাবক তাহাদের প্রতিনিধি গণ্য হইবে এবং সে তাহাদের অধিকার প্রয়োগ বা ত্যাগ করিতে পারিবে।
ধারা-৪৬ নিহতের সকল ওয়ালিল হত্যাকারীকে ক্ষমা করিলে
নিহতের সকল ওয়ারিস বা তাহাদেরকে হত্যাকারীকে ক্ষমা করিলে কিসাস রহিত হইয়া যাইবে।
তবে শর্ত থাকে যে, যে বা যাহারা ক্ষমা করে নাই সে বা তাহারা তাহাদের স্বীয় অংশ অনুপাতে দিয়াতের অধিকারী হইবে।
বিশ্লেষণ
কিসাস বা মৃত্যুদণ্ড বিভাজনের অযোগ্য বিষয়। তাই কোন ওয়ারিস হন্তাকে ক্ষমা করিলে তাহার মৃত্যুদণ্ড রহিত হইয়া যাইবে। কারণ মৃত্যুদণ্ড আংশিক কার্যকর করা সম্ভব নহে। এইজন্য যাহারা ক্ষমা করে নাই তাহারা স্বীয় অংশমত দিয়াত (রক্তপণ) প্রাপ্ত হইবে। এই ক্ষেত্রে সাহাবাগণের ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। উমর ইবনুল খাত্তাব, আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ ও আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (র) হইতে বর্ণিত আছে যে, একজন ওয়ারিসের ক্ষমা করার ক্ষেত্রে তাঁহারা অন্যান্য ওয়ারিসের জন্য, যাহারা ক্ষমা করে নাই, দিয়াত ধার্য করিয়াছেন। উপরন্তু তাহার ভ্রাতার পক্ষ হইতে কিছু ক্ষমা করা হইলে…” আয়াত সম্পর্কে বলা হইয়াছে যে, উহা এমন হন্তার বিষয়ে নাযিল হইয়াছে যাহাকে নিহতের কোন ওয়ারিস ক্ষমা করিয়াছে এবং কোন ওয়ারিস ক্ষমা করে নাই। সুতরাং এই ক্ষেত্রে হত্যাকারীর উপর দিয়াত প্রদান বাধ্যতামূলক হইবে।”
ধারা-৪৭ দুই হত্যাকারীর একজনকে ক্ষমা করা হইলে
হত্যাকারী একাধিক বলে এবং তাহাদের একমকে মা মা বলে কেবল কমান্ত হত্যাকারীর কিসাস রহিত হইবে এবং অন্যদের কিসাস বহাল থাকিবে।
বিশ্লেষণ
যেমন দুই বা ততোধিক অপরাধী সম্মিলিতভাবে এক ব্যক্তিকে হত্যা করিল। নিহতের ওয়ারিস তাহাদের মধ্যে এক বা দুইজনকে ক্ষমা করিয়া দিল। এই অবস্থায়। যাহাকে ক্ষমা করা হইয়াছে কেবল সে-ই ক্ষমাপ্রাপ্ত হইবে, অন্যরা নহে।
ধারা-৪৮ মা করার পর মাকামী হত্যাকারীকে হত্যা করিলে
হত্যাকারীকে ক্ষমা করার পর ক্ষমাকারী যদি তাহাকে হত্যা করে তবে কিসম্বরূপ ক্ষমাকারীকে হত্যা করা হইবে।
বিশ্লেষণ
কোন ব্যক্তি ক্ষমা করিয়া দেওয়ার পর হত্যাকারীকে হত্যা করিল। এই ক্ষেত্রে কিসাস বাধ্যতামূলক হইবে। কারণ ক্ষমার পর ক্ষমাকারী ও হত্যাকারী উভয়ের জীবন নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সমান হইয়া যায়
ধারা-৪৯ যে ক্ষমা করে নাই সে হত্যা করিলে
(ক) নিহতের ওয়ারিসের মধ্যে কেহ হত্যাকারীকে ক্ষমা করিল এবং কেহ তাহার কমার কথা অবহিত হওয়ার পূর্বেই তাহাকে হত্যা করিয়া ফেলিল, এই ক্ষেত্রে ক্ষমাকারীদের অংশের সমপরিমাণ দিয়াত প্রদান হত্যাকারী ওয়ারিসের উপর বাধ্যতামূলক হইবে।
(খ) ক্ষমার কথা জ্ঞাত হইয়া এবং ক্ষমা করার পর হত্যা করা নিষিদ্ধ জানিয়াও কোন ওয়ারিস হত্যাকারীকে হত্যা করিলে কিসাস বাধ্যতামূলক হইবে।
বিশ্লেষণ
নিহতের দুইজন ওয়ারিসের মধ্যে একজন হত্যাকারীকে ক্ষমা করিয়া দিল এবং অপরজন তাহাকে হত্যা করিল। এই ক্ষেত্রে লক্ষ্য করিতে হইবে যে, অপরাধীকে হত্যা করার সময় ক্ষমাকারী ওয়ারিসের ক্ষমার কথা হয় সে অবহিত ছিল না, যেমন নিহতের চারজন ওয়ারিসের মধ্যে তিনজন হত্যাকারীকে ক্ষমা করিল এবং অপরজন হত্যাকারীকে হত্যা করিল। বিচারক মোট চার লক্ষ টাকা দিয়াত ধার্য করিলেন। এই ক্ষেত্রে শেষোক্ত হত্যাকারী প্রথমোক্ত হত্যাকারীর ওয়ারিসগণকে তিন লক্ষ টাকা দিয়াত প্রদান করিবে।
অথবা সে ক্ষমা করার কথা অবহিত ছিল, কিন্তু ক্ষমা করিয়া দেওয়ার পর যে তাহাকে হত্যা করা নিষিদ্ধ তাহা জানিত না। এই ক্ষেত্রে শেষোক্ত হত্যাকারী প্রথমোত্ত হত্যাকারীর ওয়ারিসগণকে ক্ষমাকারীদের অংশের সমপরিমাণ দিয়াত প্রদান করিবে। আর ক্ষমার কথা জ্ঞাত হইয়া বা ক্ষমা করার পর হত্যা করা নিষিদ্ধ জানিয়াও অপরাধীকে হত্যা করিলে কিসাস অপরিহার্য হইবে।
ধারা-৫০ আহত ব্যক্তি অপরাধীকে ক্ষমা করিলে
আহত ব্যক্তি আহতকারীকে ক্ষমা করিয়া দেওয়ার পর মারা গেলে ক্ষমা কার্যকর হইবে না এবং কিসাস অপরিহার্য হইবে।
বিশ্লেষণ
কিসাস গ্রহণ ওয়ারিসগণের অধিকার। অতএব আহত ব্যক্তির ক্ষমা প্রদান তাহাদের অধিকার রহিত হইবে না।
ধারা-৫১ আহতের ওয়ারিশ ক্ষমা করিলে
আহত ব্যক্তির ওয়ারিসগণ আহতকারীকে ক্ষমা করার পর আহতের মৃত্যু হইলে এই ক্ষমা শুদ্ধ ও কার্যকর হইবে।
ধারা-৫২ কিসাস কার্যকর করার সময় সকল ওয়ারিসের উপস্থিতি প্রয়োজন কোন ওয়ারিসের অনুপস্থিতিতে কিসাস কার্যকর করা যাইবে না
বিশ্লেষণ
কিসাস কার্যকর করার জন্য সকল ওয়ারিসের উপস্থিত থাকা জরুরী। কোন ওয়ারিস অনুপস্থিত থাকিলে নিশ্চিতভাবে তাহার মতামত না জানা পর্যন্ত কিসাস কার্যকর করা বৈধ নহে। কারণ অনুপস্থিত ওয়ারিস হত্যাকারীকে হয়ত বা ক্ষমা করিয়া দিতে পারে অথবা অর্থের বিনিময়ে হত্যাকারীর সহিত সন্ধি করিতে পারে। এই অবস্থায় কিসাস কার্যকর করা হইলে তাহা অনুপস্থিত ওয়ারিসের অধিকারে অন্যায়ভাবে হস্তক্ষেপ গণ্য হইবে।
ধারা-৫৩ বিভিন্ন পন্থায় হত্যা
শ্বাসরুদ্ধ করিয়া, আগুনে ফেলিয়া, পানিতে নিক্ষেপ করিয়া, উচ্চ স্থান হইতে ফেলিয়া দিয়া, বিষাক্ত পদার্থ পান করাইয়া, মাটিতে পুঁতিয়া অথবা অভুক্ত রাখিয়া কাহাকেও হত্যা করিলে হত্যাকারীর মৃত্যুদণ্ড হইবে।
বিশ্লেষণ
অপরাধী কাহাকেও শ্বাসরুদ্ধ করিয়া হত্যা করিলে ইমাম আবু ইউসুফ ও মুহাম্মাদ (র)-এর মতে কিসাস এবং আবু হানীফা (র)-এর মতে দিয়াত অপরিহার্য হইবে।
ইমাম মুহাম্মাদ (র) তাঁহার আল-জামিউস-সাগীর গ্রন্থে বলিয়াছেন যে, কেহ কোন ব্যক্তিকে আশুনে নিক্ষেপ করিয়া হত্যা করিলে, যাহা হইতে উদ্ধার পাওয়া সব নহে, নিক্ষেপকারীর মৃত্যুদণ্ড হইবে। তাহাকে আগুন হইতে আহত অবস্থায় উদ্ধারের পর বিছানাগত-থাকিয়া মারা গেলেও নিক্ষেপকারীর মৃত্যুদণ্ড হইবে। কোন ব্যক্তিকে উত্তপ্ত গরম পানিতে নিক্ষেপ করিয়া হত্যা করা হইলেও হত্যাকারীর মৃত্যুদণ্ড হইবে। কোন ব্যক্তিকে হাত-পা বাঁধিয়া পুকুর, নদী বা সমুদ্রের গভীর পানিতে নিক্ষেপ করিয়া হত্যা করা হইলে হত্যাকারীর মৃত্যুদণ্ড হইবে। মহানবী (স) বলেন :
“যে ব্যক্তি ডুবাইয়া মারিয়াছে আমরাও তাহাকে ডুবাইয়া মারিব”।
যেই পরিমাণ পানিতে পতিত হইলে সাধারণত মৃত্যুর আশঙ্কা থাকে না এবং সাঁতার কাটিয়া উদ্ধার পাওয়া সম্ভব (যদি সাঁতার জানে) সেই পরিমাণ পানিতে কোন ব্যক্তিকে নিক্ষেপ করা হইলে এবং তাহার মৃত্যু ঘটিলে নিক্ষেপকারীর উপর দিয়াত অপরিহার্য হইবে।
উচ্চ স্থান হইতে নিক্ষেপ করিয়া হত্যা করিলে নিক্ষেপকারীর মৃত্যুদণ্ড হইবে। বিষাক্ত পদার্থ পান করাইয়া হত্যা করিলেও হত্যাকারীর মৃত্যুদণ্ড হইবে। খায়বার অভিযানকালে এক ইহুদী নারী রাসুলুল্লাহ (সা)-কে বিষমিশ্রিত বকরী আহার করিতে দেয়। বিষক্রিয়া হইতে রাসূলুল্লাহ (সা) রক্ষা পাইলেও তাঁহার সাহাবী বিশর ইবনুল বারাআ (রা) নিহত হন। হত্যার অপরাধে উক্ত নারীকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। জীবন্ত মাটিতে পুঁতিয়া হত্যা করা হইলে হত্যাকারীর মৃত্যদণ্ড হইবে। কোন ব্যক্তিকে বন্দী করিয়া অনাহারী রাখা হইল অথবা প্রচণ্ড শীত বা উত্তাপের মধ্যে ফেলিয়া রাখা হইল, ফলে অনাহারে বা প্রচণ্ড শীতে বা উত্তাপে তাহার মৃত্যু হইল। এই ক্ষেত্রে ইমাম আবু ইউসুফ ও মুহাম্মাদ (র)-এর মতে অপরাধীর উপর দিয়া বাধ্যতামূলক হইবে এবং ইমাম মালিক (র)-এর মতে তাহার মৃত্যুদণ্ড হইবে। শাফিঈ ও হাম্বালী মাযহাবমতে যে পরিমাণ সময় অভুক্ত রাখিলে, বিবস্ত্র অবস্থায় শীত বা সূর্যের উত্তাপের মধ্যে ফেলিয়া রাখিলে সাধারণত মারা যাওয়ার আশঙ্কা থাকে সেই পরিমাণ সময় অতিবাহিত হওয়ার পর মারা গেলে অপরাধীর মৃত্যুদণ্ড হইবে।
ধারা-৫৪ নারী, পুরুষ, শিশু পঙ্গু ও পাগলকে হত্যা করিলে
পুরুষ নারীকে, নারী পুরুষকে এবং বালেগ নাবালেগ, অন্ধ, খঞ্জ ও পাগলকে হত্যা করিলে হত্যাকারীর মৃত্যুদণ্ড হইবে।
বিশ্লেষণ
কুরআন মজীদের কিসাসের বিধান সম্পর্কিত আয়াত সাধারণ অর্থ জ্ঞাপক। উহাতে কাহারও রক্তের বা মর্যাদার পার্থক্য করা হয় নাই। তাই হত্যাকারী যেই হউক ‘কতলে আম্দ’ প্রমাণিত হইলেই তাহার মৃত্যুদণ্ড হইবে। মর্যাদার পার্থক্য করা হইলে কিসাসই বিলুপ্ত হইয়া যাইবে এবং পারস্পরিক শত্রুতা আরও ভয়ংকর রূপ ধারণ করিবে।
ধারা-৫৫ মুমূর্ষ ব্যক্তিকে হত্যা করিলে
মুমূর্ষ ব্যক্তির আর বাঁচিবার আশা নাই জানিয়াও তাহাকে হত্যা করিলে হত্যাকারীর মৃত্যুদণ্ড হইবে।
বিশ্লেষণ
কোন ব্যক্তি মৃত্যুশয্যাগত, তাহার বাঁচিবার আশা নাই বা কোন লক্ষণ নাই, এই অবস্থায় সে নিহত হইলে হত্যাকারীকে কিসাসস্বরূপ হত্যা করা হইবে।
ধারা-৫৬ মুসলিম অমুসলিমকে এবং অমুসলিম মুসলিমকে হত্যা করিলে
মুসলিম ব্যক্তি অমুসলিম ব্যক্তিকে এবং অমুসলিম ব্যক্তি মুসলিম ব্যক্তিকে হত্যা করিলে হত্যাকারীর মৃত্যুদণ্ড হইবে।
বিশ্লেষণ
কিসাসের বিধান সম্পর্কিত আয়াতের ভিত্তিতে সাধারণভাবে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের জীবন নিরাপদ। মহানবী (সা) এক অমুসলিমকে হত্যার অপরাধে হত্যাকারী মুসলিমকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন।
ধারা-৫৭ অমুসলিম অমুসলিমকে হত্যা করিলে
এক অমুসলিম ব্যক্তি অপর অমুসলিম কর্তৃক নিহত হইলে হত্যাকারীর মৃত্যুদণ্ড হইবে।”
ধারা-৫৮ বিদেশী বিদেশীকে হত্যা করিলে
মুসলিম রাষ্ট্রে অবস্থানরত অমুসলিম রাষ্ট্রের অমুসলিম নাগরিকগণের একজন অপরজনকে হত্যা করিলে হত্যাকারীর মৃত্যুদণ্ড হইবে।
ধারা-৫৯ নাবালেগ নাবালেগকে হত্যা করিলে
নাবালেগ নাবালেগকে হত্যা করিলে হত্যাকারীর মৃত্যুদণ্ড হইবে না; তাহার মাল হইতে দিয়াত প্রদান বাধ্যতামূলক হইবে।
বিশ্লেষণ
নাবালেগের ‘কতলে আম্দ’ ও ‘কতলে খাতা’ উভয়ই সমান। নাবালেগ একে অপরকে হত্যা করিলে তাহার মৃত্যুদণ্ড হইবে না। তাহার মাল হইতে দিয়াত পরিশোধ করিতে হইবে, কতলে আম্দ হইলেও এবং কতলে খাতা হইলেও। সে মীরাস হইতেও বঞ্চিত হইবে না মহানবী (সা) বলেনঃ “তিন ব্যক্তির উপর হইতে দণ্ড তুলিয়া নেওয়া হইয়াছে-নাবালেগ বালেগ না হওয়া পর্যন্ত. … … … .”।
ধারা-৬০ পাগলে হত্যা করিলে
পাগল কোন ব্যক্তিকে হত্যা করিলে তাহায় মৃত্যুদণ্ড হইবে না; তাহার মাল হইতে দিয়াত প্রান বাধ্যতামূলক হইবে।
বিশ্লেষণ
বদ্ধ পাগল কোন ব্যক্তিকে হত্যা করিলে তাহার মৃত্যুদণ্ড হইবে না; ফাতওয়া আলমগিরীতে বাহরুল মুহীত গ্রন্থের বরাতে বলা হইয়াছে যে, পাগলের বিষয়টি নাবালেগের বিষয়ের অনুরূপ।
ধারা-৬১ পাগল ও নাবালেগ অস্ত্র নিয়া আক্রমণ করিলে
পাগল অথবা নাবালেগ ব্যক্তির সশন্ত্র আক্রমণে আক্রান্ত ব্যক্তি পাগল বা নাবালেগকে হত্যা করিলে অথবা তাহারা প্রতিহত হইয়া নিহত হইলে আক্রান্ত ব্যক্তির উপর দিয়া বাধ্যতামূলক হইবে।
বিশ্লেষণ
ইমাম আবু ইউসুফ ও শাফিঈ (র)-এর মতে দিয়াতও বাধ্যতামূলক হইবে না। ইমাম শাফিঈ যুক্তি প্রদান করিয়াছেন যে, আক্রান্ত ব্যক্তি তাহার জীবনের নিরাপত্তার খাতিরে আক্রমণ প্রতিহত করিতে গিয়া তাহার দ্বারা তাহারা নিহত হইয়াছে। প্রত্যেক ব্যক্তিরই স্বীয় জানমালের নিরাপত্তা লাভের অধিকার রহিয়াছে।
ধারা-৬২ বালেগ ও বুদ্ধিমান ব্যক্তি অস্ত্র নিয়া আক্রমণ করিলে
বালেগ ও বুদ্ধিমান ব্যক্তি কোন ব্যক্তির উপর অন্তসহ ঝাপাইয়া পড়িলে এবং আক্রান্ত ব্যক্তির দ্বারা প্রতিহত হইয়া নিহত হইলে আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ডহইবে না।
বিশ্লেষণ
আক্রমণকারী অন্যায়ভাবে অপরের জীবনের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করিয়া নিজেই নিজের জীবনের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করিয়াছে। আক্রান্ত ব্যক্তি নিজের জীবনের নিরাপত্তা বিধানের অধিকারে অস্ত্র ধারণ করিয়াছে। তাই আক্রমণকারী তাহার হাতে নিহত হওয়ায় সে দোষী নহে। মহানবী (সা) বলেন :
“তোমার জীবনের নিরাপত্তার জন্য অস্ত্রধারণ কর।”
ধারা-৬৩ চোরকে হত্যা করিলে
কোন ব্যক্তির গৃহে চোর ঢুকিয়া তাহার মালপত্র লইয়া পলায়নকালে গৃহকর্তা তাহার পিছু ধাওয়া করিয়া তাহাকে হত্যা করিলে গৃহকর্তার কোন শাস্তি হইবে না।
বিশ্লেষণ
মহানবী (সা) বলেন :
“তোমার সম্পদ রক্ষার জন্য অস্ত্রধারণ কর।”
“যে ব্যক্তি নিজের মাল রক্ষা করিতে গিয়া নিহত হইল সে শহীদ।”
ধারা-৬৪ আঘাতকারীর আঘাতে মারা গেলে
কোন ব্যক্তি অপর ব্যক্তিকে ইকৃতভাবে আহত করিলে এবং আহত অবস্থায় শয্যাশায়ী থাকিয়া অবশেষে সে মারা গেলে আহতকারীর মৃত্যুদণ্ড হইবে।
বিশ্লেষণ
আহত ব্যক্তি আহত হওয়ার কারণেই মারা গিয়াছে, অন্য কোন কারণে মারা যায় নাই। তাই কিসাসের কারণ বিদ্যমান থাকায় আহতকারীর মৃত্যুদণ্ড হইবে। এই বিষয়ে ফকীহগণ একমত।
ধারা-৬৫ পিতামাতা ও দাদাকে হত্যা করিলে
(ক) কোন ব্যক্তি স্বীয় পিতামাতা, সাদা-দাদী, নানা-নানী (যত ঊর্ধ্বগামী হউক) কাহাকেও হত্যা করিলে হত্যাকারীর মৃত্যুদণ্ড হইবে।
(খ) পিতা-মাতা, দাদা-দাদী ও নানা-নানী পর্যায়ক্রমে পুত্রকে বা নাতিকে হত্যা করিলে হত্যাকারীর মৃত্যুদণ্ড হইবে না, কিন্তু দিয়াত প্রদান বাধ্যকর হইবে।
বিশ্লেষণ
কিসাস সম্পর্কিত আয়াতের নির্দেশ সাধারণভাবে যে কোন হত্যাকারীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তাই কেহ নিজ পিতা বা মাতা, সাদা বা দাদী এবং নানা বা নানীকে (যত ঊর্ধ্বগামী হউক) হত্যা করিলে হত্যাকারী পুত্র, পৌত্র বা দৌহিত্রের মৃত্যুদণ্ড হইবে। কিন্তু পিতা বা মাতা পুত্রকে, দাদা বা দাদী পৌত্রকে এবং নানা বা নানী দৌহিত্রকে হত্যা করিলে হত্যাকারীর মৃত্যুদণ্ড হইবে না। মহানবী (সা) উপরোক্ত ব্যক্তিগণকে কিসাসের সাধারণ নির্দেশ-বহির্ভূত রাখিয়াছেন।
“সুরাকা ইবন মালিক (রা) বলেন, আমার উপস্থিতিতে রাসূলুল্লাহ (সা) পিতৃহত্যার অপরাধে পুত্রের উপর কিসাস কার্যকর করিয়াছেন এবং পুত্রহত্যার অপরাধে পিতার উপর কিসাস কার্যকর করেন নাই।”
“উমর ইবনুল খাত্তাব (রা) বলেন, আমি রাসূলুনাহ (সা)-কে বলিতে শুনিয়াছি। পুত্র হত্যার অপরাধে পিতার উপর কিসাস কার্যকর হইবে না।”
“ইবন আব্বাস (রা) হইতে বর্ণিত। মহানবী (সা) বলেন : পুত্রহত্যার অপরাধে পিতার মৃত্যুদণ্ড হইবে না।”
এই ক্ষেত্রে দিয়াত প্রদান বাধ্যতামূলক হইবে। পুত্র, পৌত্র ও দৌহিত্রগণও (যত নিম্নগামী হউক) পুত্রের অন্তর্ভুক্ত এবং দাদা-দাদী ও নানা-নানী (যত ঊর্ধ্বগামী হউক) পিতা-মাতার অন্তর্ভুক্ত
ধারা-৬৬ কিসাস বহির্ভূত ও কিসাস অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তি একত্রে হত্যা করিলে
কিসাস বহির্ভূত ব্যক্তি কিসাস অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তির সহিত মিলিত হইয়া কোন ব্যক্তিকে হত্যা করিলে উভয়ের জন্য দিয়াত প্রদান বাধ্যকর হইবে।
বিশ্লেষণ
যদি এমন দুই ব্যক্তি মিলিতভাবে কোন ব্যক্তিকে হত্যা করে যাহাদের একজন একা হত্যা করিলে কিসাস বাধ্যতামূলক হয় না কিন্তু অপরজন একা হত্যা করিলে কিসাস বাধ্যতামূলক হয়, তবে এই ক্ষেত্রে দুইজনের কাহারো কিসাস (মৃত্যুদণ্ড) হইবে না। যেমন নাবালেগ ও বালেগ একত্রে, সুস্থ বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি ও পাগল একত্রে, অথবা পিতা ও অন্য ব্যক্তি একত্রে, অথবা একজন ইচ্ছাকৃতভাবে এবং অন্যজন ভুলবশত কোন ব্যক্তিকে হত্যা করিল। এই ক্ষেত্রে কিসাস অপরিহার্য হইবে না, দিয়াত প্রদান বাধ্যতামূলক হইবে। কিন্তু ইমাম শাফিঈর মতে বালেগ, সুস্থ বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি ও পিতার সহিত অংশীদার ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড হইবে, কিন্তু ইচ্ছাকৃত হত্যাকারীর উপর দিয়াত প্রদান বাধ্যতামূলক হইবে।
ধারা-৬৭ এক ব্যক্তি একদল লোককে হত্যা করিলে
এক ব্যক্তি একাই একাধিক ব্যক্তিকে হত্যা করিলে হত্যাকারীর মৃত্যুদণ্ড হইবে।
বিশ্লেষণ
কিসাস বাধ্যতামূলক হওয়ার জন্য এই ক্ষেত্রে নিহত ব্যক্তিগণের প্রত্যেকের ওয়ারিসগণের সম্মিলিতভাবে কিসাস দাবি করার প্রয়োজন নাই। যে কোন একজন নিহতের ওয়ারিসগণ কিসাস দাবি করিলেই উহা কার্যকর হইবে। অবশিষ্ট নিহতগণের ওয়ারিসগণের অনুপস্থিতি কিসাস কার্যকর করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হইবে না।
ধারা-৬৮ একদল এক ব্যক্তিকে হত্যা করিলে
একদল লোক সম্মিলিতভাবে এক ব্যক্তিকে হত্যা করিলে উক্ত দলের সকলের উপর কিসাস কার্যকর হইবে।
বিশ্লেষণ
প্রাণ হত্যার অপরাধে কিসাস কার্যকর করার জন্য হত্যাকারী ও নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে সংখ্যার সমতা বিদ্যমান থাকা শর্ত নহে। অতএব কয়েক ব্যক্তি একত্র হইয়া এক ব্যক্তিকে হত্যা করিলে কিসাসম্বরূপ হত্যাকারী দলের সকলের মৃত্যুদণ্ড হইবে। ফকীহগণ এই বিষয়ে একমত।
“সাঈদ ইবনুল মুসায়্যাব (র) হইতে বর্ণিত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা) এক ব্যক্তিকে হত্যার অপরাধে পাঁচ অথবা সাত ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন। তাহারা লোকটিকে ধোঁকা দিয়া হত্যা করিয়াছিল। উমর (রা) আরও বলিলেন, সানবাসী সকলে মিলিয়া তাহাকে হত্যা করিলে উহার প্রতিশোধস্বরূপ আমি অবশ্যই তাহাদের সকলকে হত্যা করিতাম।”
ধারা-৬৯ হত্যা করার পর হত্যাকারী ইসলাম গ্রহণ করিলে
কোন ব্যক্তি অপর ব্যক্তিকে হত্যা করার পর ইসলাম গ্রহণ করিলেও হত্যাকারীর মৃত্যুদণ্ড হইবে।
ধারা-৭০ অপরের নির্দেশে হত্যা করা
আদেশদাতার আদেশক্রমে আদিষ্ট ব্যক্তি ইহা জানিয়া যে, ঐ আদেশ তাহার উপর বাধ্যকর নহে, আপশোভাকে অথবা ফোন ব্যক্তিকে হত্যা করিলে হত্যাকারীর উপর দিয়া বাধ্যতামূলক হইবে এবং আদেশ তাবীরের অধীনে দণ্ডযোগ্য হইবে।
বিশ্লেষণ
এক ব্যক্তি অপর ব্যক্তিকে বলিল, তুমি আমাকে অথবা অমুক ব্যক্তিকে হত্যা কর এবং তাহার উপর ঐ আদেশ বাধ্যকর নহে জানিয়াও সে আদেশদাতাকে বা অপর ব্যক্তিকে হত্যা করিল। এই ক্ষেত্রে ইমাম আবু হানীফা, আবু ইউসুফ ও মুহাম্মদ (র)-এর মতে হত্যাকারীর উপর দিয়া বাধ্যতামূলক হইবে। পক্ষান্তরে ইমাম যুফার, মালেক, শাফিঈ ও আহমাদ (র)-এর মতে হত্যাকারীর মৃত্যুদণ্ড হইবে এবং আদেশদাতা তাযীরের আওতায় দণ্ড প্রাপ্ত হইবে। কারণ মহানবী (সা) বলেন :
“সৃষ্টি স্রষ্টার নাফরমানী করিতে নির্দেশ দিলে তাহার আনুগত্য করা যাইবে “(মুসনাদে আহমাদ, হাকেম)।
ধারা-৭১ বলপ্রয়োগে হত্যা করাইলে
কোন ব্যক্তি বলপ্রয়োগে বাধ্য হইয়া অপর ব্যক্তিকে হত্যা করিলে বলপ্রয়োগ কারীর মৃত্যুদণ্ড হইবে এবং হত্যাকারী তাযীরের আওতায় দণ্ডযোগ্য হইবে।
বিশ্লেষণ
ইমাম আবু হানীফা ও মুহাম্মদ (র)-এর মতে বলপ্রয়োগকারীর মৃত্যুদণ্ড হইবে এবং যাহার উপর বলপ্রয়োগ করা হইয়াছে তাহার উপর দিয়াত বাধ্যতামূলক হইবে। মহানবী (সা) বলেন :
“আল্লাহু তা’আলা আমার উম্মতের ভুলভ্রান্তি, ভুলিয়া যাওয়া এবং যাহার উপর বলপ্রয়োগ করা হইয়াছে তাহার অপরাধ উপেক্ষা করিয়াছেন।”
ধারা-৭২ মুরতাদকে হত্যা করিলে
কোন ব্যক্তি মুরতাদকে হত্যা করিলে হত্যাকারীর মৃত্যুদণ্ড হইবে না, তবে সে তাযীরের আওতায় দণ্ডযোগ্য হইবে।
ব্যাখ্যা
কোন মুসলিম ব্যক্তি স্বেচ্ছায় ও সজ্ঞানে ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করিলে তাহাকে ‘মুরতাদ’ (ধর্মত্যাগী) বলে।
বিশ্লেষণ
যে কোন ধরনের অপরাধীর উপর শাস্তি কার্যকর করার দায়িত্ব সরকারের। কোন ব্যক্তিকে বিচারের সম্মুখীন না করিয়া শাস্তি দেওয়া বৈধ নহে। মুরতাদ যদিও ইসলাম ত্যাগ করিয়া মৃত্যুদণ্ডের অপরাধী হইয়াছে এবং নিজের জীবনের নিরাপত্তা হারাইয়া ফেলিয়াছে, তবুও বিনা বিচারে তাহাকে হত্যা করা যাইবে না। অতএব যে ব্যক্তি মুরতাদকে হত্যা করিল সে সরকারের কর্তৃত্বের অবমাননা করিল। এইজন্য সে তাযীরের আওতায় দণ্ডযোগ্য হইবে। এই বিষয়ে ফকীহগণ একমত।
ধারা-৭৩ কোন ব্যক্তিকে একের পর এক আহত করিলে
একাধিক ব্যক্তি কোন ব্যক্তিকে একের পর এক আঘাত করার ফলে সে মারা গেলে–যাহার আঘাতে সে নিহত হইয়াছে তাহার মৃত্যুদণ্ড হইবে এবং তাহার সহযোগীদের উপর দিয়াত বাধ্যকর হইবে।
বিশ্লেষণ
যেমন সহযোগীদের কেহ এক ব্যক্তির পায়ে আঘাত করিল, কেহ পেটে আঘাত করিল এবং কেহ কণ্ঠনালীতে আঘাত করিল ও কে ঘাড়ে আঘাত করিল এবং ফলে আহত ব্যক্তি মারা গেল। এই ক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয় হইবে কাহার আঘাতে সে মারা গিয়াছে? যাহার বা যাহাদের আঘাতে সে নিহত হইয়াছে বলিয়া সাব্যস্ত হইবে তাহার বা তাহাদের মৃত্যুদণ্ড হইবে এবং অন্যদের উপর দিয়াত আরোপিত হইবে।
ধারা-৭৪ লাওয়ারিস ব্যক্তি নিহত হলে
লাওয়ারিস ব্যক্তি নিহত হইলে তাহার কিসাসের দাবিদার হইবে সরকার এবং ইচ্ছা করিলে হত্যাকারীকে মৃত্যুদণ্ড দিতে পারে অথবা ক্ষমাও করিতে পারে।
বিশ্লেষণ
যাহার সুনির্দিষ্ট কোন অভিভাবক নাই এমন ব্যক্তি নিহত হইলে তাহার অভিভাবক হইবে সরকার।
মহানবী (সা) বলেন :
“যাহার অভিভাবক নাই আমিই তাহার অভিভাবক।”
“আয়েশা () হইতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলিয়াছেন ও যাহার অভিভাবক নাই শাসক তাহার অভিভাবক।”
ধারা-৭৫ মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার অস্ত্র
তরবারি বা অন্যান্য শরীআত সম্মত পদ্ধতিতে হত্যাকারীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করিতে হইবে।
বিশ্লেষণ
তরবারি দ্বারাই হত্যাকারীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করিতে হইবে। এই বিষয়ে হানাফী ফকীহগণ একমত। অন্য কিছুর সাহায্যে তাহার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা বৈধ নহে। হত্যাকারী কোন ব্যক্তিকে নির্যাতন করিয়া হত্যা করিলেও তাহাকে নির্যাতন করিয়া হত্যা করা যাইবে না। মহানবী (স) বলেন :
“তরবারি দ্বারাই কিসাস কার্যকর করিতে হইবে।”
ধারা-৭৬ কতলে আম্দ-এর দিয়াত
(ক) ‘কতলে আম্দ’-এ দিয়াত প্রদানের শর্তে সন্ধি হইলে উহার পরিমাণ হইবে ত্রিশটি চারি বৎসর বয়সের, ত্রিশটি তিন বৎসর বয়সের এবং গর্ভবতী চল্লিশটি উট বা উহাদের সমমূল্য।
(খ) আদালত তাহার সুবিবেচনা অনুযায়ী দিয়াতের সহিত কারাদণ্ডের শাস্তিও যোগ করিতে পারে।
(গ) ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ ইচ্ছা করিলে উহাদের (ধারা–ক) কম সংখ্যক শর্তেও সন্ধি করিতে পারে, কিন্তু ইহার অধিক দাবি করিতে পারিবে না।
(ঘ) দিয়াত প্রদানে হত্যাকারী বেজায় সম্মত না হইলে তাহা তাহার নিকট হইতে জোরপূর্বক আদায় করা যাইবে না।
বিশ্লেষণ
দিয়াত প্রদানের শর্তে হত্যাকারী ও নিহত পক্ষদ্বয়ের মধ্যে সন্ধি স্থাপিত হইলে দিয়াতের পরিমাণ হইবে এক শত উষ্ট্রী বা উহার সমমূল্য। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেন :
“যে ব্যক্তি অপর ব্যক্তিকে ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করিয়াছে তাহাকে নিহত ব্যক্তির অভিভাবকদের নিকট অর্পণ করা হইবে। তাহারা ইচ্ছা করিলে তাহাকে হত্যা করিবে, অথবা ইচ্ছা করিলে দিয়াত গ্রহণ করিবে। উহা হইল : ৩০টি তিন বৎসর বয়সের, ৩০টি চার বৎসর বয়সের এবং ৪০টি গর্ভবতী উষ্ট্রী। আর যদি তাহারা সন্ধি করে তবে যত সংখ্যকের বিনিময়ে সন্ধি হইয়াছে ততটি পাইবে। ইহা দিয়াত কঠোর করার জন্য।”
নিহতের অভিভাবকের জন্য সন্ধির ক্ষেত্রে উক্ত পরিমাণের অধিক দাবি করা বৈধ নহে। অবশ্য উহার কম সংখ্যকেও সন্ধি করা তাহাদের জন্য বৈধ।
দিয়াত বস্তুসামগ্রীর দ্বারাও পরিশোধ করা যায় এবং নগদ অর্থেও পরিশোধ করা যায়। মহানবী (সা)-এর যুগে নগদ অর্থে দিয়াতের পরিমাণ ছিল বিভিন্ন বর্ণনা অনুযায়ী আট হাজার, দশ হাজার ও বার হাজার দিরহাম। আমর ইবন শুআয়ব (র) হইতে পর্যায়ক্রমে তাঁহার পিতা ও তাহার দাদার সূত্রে বর্ণিত। তিনি (দাদা আবদুল্লাহ ইবন আমর) বলেন :
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম উটের সমসাময়িক বাজারদরে চার শত দীনার অথবা উহার সমপরিমাণ দিরহাম গ্রামবাসীদের দিয়াত নির্ধারণ করিতেন। উটের বাজারদর বাড়িয়া গেলে দিয়াতের পরিমাণও বাড়িয়া যাইত, উহার বাজারদর কমিয়া গেলে সিয়াতের পরিমাণও কমিয়া যাইত। মহানবী (সা)-এর যুগে উটের মূল্য চার শত দীনার হইতে আট শত দীনার পর্যন্ত উন্নীত হয়। যাহাদের গরু আছে তাহাদের বেলায় মহানবী (সা) নির্দেশ দেন যে, তাহাদের নিকট হইতে দিয়াত বাবদ দুই শত গৰু নেওয়া হইবে এবং যাহাদের বকরী আছে তাহাদের নিকট হইতে দিয়াত। বাবদ দুই হাজার বকরী নেওয়া হইবে।
“আমর ইবন শুআয়ব (র) হইতে পর্যায়ক্রমে তাঁহার পিতা ও তাহার দাদার সূত্রে বর্ণিত। তিনি (দাদা) বলেন, “রাসূলুল্লাহ (সা)-এর যুগে দিয়াতের (উটের) মূল্য ছিল আট শত দীনার অথবা আট হাজার দিরহাম………। অতঃপর এভাবে দিয়াতের বিধান অব্যাহত রহিল। অতঃপর উমর (রা) খলীফা হওয়ার পর ভাষণ দিতে দাঁড়াইয়া বলেন, উটের দাম বাড়িয়া গিয়াছে। রাবী বলেন, অতএব তিনি স্বর্ণে প্রদানকারীদের দিয়াত এক হাজার দীনার এবং রৌপ্যে প্রদানকারীদের দিয়াত বার হাজার দিরহাম নির্ধারণ করেন।”
ইমাম আবূ হানীফা (র) বলেন, দিয়াতের ক্ষেত্রে উট নির্ধারণ করা হইয়াছে নস্-এর ভিত্তিতে এবং স্বর্ণ বা রৌপ্যে উহার মূল্য নির্ধারণ করা হয় উটের (মূল্যের) ভিত্তিতে। ইমাম শাফিঈ (র)-এর মতে, উট ব্যতীত অন্যান্য বন্ধুর মাধ্যমে যে দিয়াত নির্ধারণ করা হইয়াছে তাহা সমঝোতা বা সার্বিক সুবিধার ভিত্তিতে।
দিয়াত প্রদানে হত্যাকারীর সম্মত হওয়া আবশ্যক। তাহার অসম্মতিতে তাহার নিকট হইতে উহা আদায় করা বৈধ নহে। হত্যার অপরাধে তাহার জীবন সংহার বৈধ হইলেও তাহার সম্পদ দখল করা বৈধ নহে। মহান আল্লাহ বলিয়াছেন :
“তোমরা নিজেদের মধ্যে একে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করিও না” (বাকারা : ১৮৮; নিসা : ২৯)। মহানবী (সা) বলেন :
“কোন মুসলিম ব্যক্তির সম্পদ তাহার আন্তরিক সম্মতি ব্যতীত অন্যের জন্য বৈধ নহে।”
ধারা-৭৭ কতলে শিব্হে আম্দ-এর দিয়াত
কতলে শিব্হে আম্দ-এর ক্ষেত্রে হত্যাকারীর পরিবারের উপর দিয়াত বাবদ তিন বৎসর বয়সের ত্রিশটি, চার বৎসর বয়সের ত্রিশটি এবং গর্ভবতী চল্লিশটি উষ্ট্রী বা উহাদের সমমূল্য প্রদান বাধ্যকর হইবে।
বিশ্লেষণ
কতলে শিব্হে আম্দ-এর ক্ষেত্রেও কতলে আম্দ-এর মত কঠোর দিয়াত প্রদান বাধ্যকর হইবে এবং উহা হত্যাকারীর বংশের লোকেরা পরিশোধ করিবে।
ধারা-৭৮ কতলে তার দিয়াত
কতলে খাতার ক্ষেত্রে হত্যাকারীর পরিবারের উপর দিয়াত বাবদ এক বৎসর বয়সের বিশটি উট ও বিশটি উ, দুই বৎসর বয়সের বিশটি উী, তিন বৎসর বয়সের বিশটি উী এবং চার বৎসর বয়সের বিশটি অী বা উহাদের সমমূল্য প্রদান বাধ্যকর হইবে।
বিশ্লেষণ
ইবন মাসউদ (রা) বলেন, মহানবী (সা) বলিয়াছেন :
“ভুলবশত হত্যার দিয়াত পাঁচ ভাগে বিভক্ত : এক বৎসর বয়সের বিশটি উষ্ট্রী, এক বৎসর বয়সের বিশটি উট, দুই বৎসর বয়সের বিশটি উষ্ট্ৰী. তিন বৎসর বয়সের বিশটি উষ্ট্রী এবং চার বৎসর বয়সের বিশটি উষ্ট্রী। এইভাবে পাঁচটি অংশ পূর্ণ হইল।”
কুরআন মজীদে বলা হইয়াছে :
“এবং কেহ মুমিন ব্যক্তিকে ভুলবশত হত্যা করিলে একজন মুমিন দাস বা দাসী মুক্ত করা এবং নিহতের পরিবারবর্গকে দিয়াত প্রদান করা বিধেয়, যদি না তাহারা ক্ষমা করে। যদি সে তোমাদের শত্রুপক্ষের লোক হয় এবং মুমিন হয় তবে এক মুমিন দাস মুক্ত করা বিধেয়। নিহত ব্যক্তি যদি তোমাদের সহিত চুক্তিবদ্ধ (অমুসলিম) সম্প্রদায়ের লোক হয় তবে তাহার পরিবারবর্গকে দিয়াত প্রদান এবং এক মুমিন দাস মুক্ত করা বিধেয়। যে তাহা পাইবে না তাহাকে একাদিক্রমে দুই মাস রোযা রাখিতে হইবে। তওবার জন্য ইহা আল্লাহর ব্যবস্থা এবং আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়” (সূরা নিসা : ৯২)।
উপরোক্ত আয়াতে নিহতের পরিবারকে দিয়াত প্রদানের জন্য হত্যাকারীকে নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে এবং উপরন্তু একজন মুমিন দাস বা দাসীকে মুক্ত করিতে বলা হইয়াছে, দাস-দাসী না পাওয়া গেলে একাধারে দুই মাস রোযা রাখার নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে। প্রসঙ্গক্রমে এখানে অমুসলিম ব্যক্তিকে হত্যা করিলে তাহার জন্যও একই বিধান প্রদান করা হইয়াছে অর্থাৎ মুসলিম-অমুসলিম উভয়ের দিয়াত সমান।
ধারা-৭৯ কতনে শিব্হে খাতা ও কতল বিত-তাসাব্বুব-এর দিয়াত
“কালে শিব্হে খাতা’ ও “কতল বিত-তাসাব্বুব”-এর দিয়াতের বিধান করলে তার অনুরূপ।”
বিশ্লেষণ
কতল বিত-তাসাব্বুব-এ অপরাধীর কাজ হত্যাকাণ্ডের ‘কারণ’ হওয়ায় এবং নিজের কাজে বৈধ সীমা অতিক্রম করায় দিয়াত প্রদান বাধ্যকর হয়।
ধারা-৮০ কিসাস ও দিয়াত রহিত হইলে বিকল্প শাস্তি
ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষে ক্ষমা যারা অথবা অন্য কোন কারণে হত্যাকারী কিসাস ও দিয়াতের দণ্ড হইতে রক্ষা পাইলেও আদালত তাযীরের আওতায় তাহাকে দণ্ডিত করিতে পারিবে।
বিশ্লেষণ
হত্যাকাণ্ড ঘটাইয়া হত্যাকারী কেবল একটি জীবনেরই ক্ষতি করে না, বরং সে সামাজিক নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে। তাই যদি কোন কারণে কিসাস বা দিয়াত রহিত হইয়া যায় তবুও তাহার কিছু শাস্তি হওয়া উচিত। ইমাম মালিক ও লাইস (র)-এর মতে কিসাস মাফ করার ক্ষেত্রে হত্যাকারী এক শত বেদণ্ড ও এক বৎসরের কারাদণ্ড ভোগ করিবে। হযরত উমর ফারুক (রা)-এরও অনুরূপ একটি মত পাওয়া যায়। ইমাম আবু হানীফা, শাফিঈ, আহমাদ ইন হাম্বল, ইসহাক ও আবু সাওর (র)-এর মতে হত্যাকারী পেশাদার দুষ্কৃতিকারী হইলে রাষ্ট্র তাহাকে তাযীরের আওতায় যে কোন ধরনের শাস্তি দিতে পারে। উদাহরণস্বরূপ পিতা পুত্রকে হত্যা করিলে তাহার উপর কিসাস কার্যকর না হইলেও সে তাযীরের আওতায় দণ্ড ভোগ করিবে।
ধারা-৮১ হত্যাকারিণী গর্ভবতী হইলে
হত্যাকারিণী গর্ভবতী হইলে তাহার গর্ত খালাস এবং সন্তানের দুধপানকাল সমান্ত না হওয়া পর্যন্ত কিসাস স্থগিত থাকিবে; অতঃপর উক্ত মেয়াদ শেষ হইলে কিসাস কার্যকর হইবে।
বিশ্লেষণ
কোন গর্ভবতী নারী অপর ব্যক্তিকে হত্যা করিলে আদালতের রায় ঘোষণার পরপরই তাহার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা যাইবে না। বরং সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর এবং তাহার দুধপানের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরই কিসাস কার্যকর হইবে। “জুহায়না কবীলার উপপোত্র গামিদ-এর এক নারী যেনার দ্বারা গর্ভবতী হয়। সে মহানবী (সা)-এর নিকট উপস্থিত হইয়া নিজের অপরাধের স্বীকারোক্তি করে। মহানবী (সা) তাহাকে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর আসিতে বলেন। অতঃপর সন্তানসহ সে উপস্থিত হইলে তিনি তাহাকে সন্তানের দুধপানকাল শেষ হওয়ার পর আসিতে বলেন। অতঃপর সে উপস্থিত হইলে মহানবী (সা) তাহার উপর শাস্তি কার্যকর করার নির্দেশ দেন।”